বাদশাহ নামা পর্ব ৪১+৪২

বাদশাহ নামা পর্ব ৪১+৪২
আমিনা

মাঝারি আকৃতির জাহাজ টা এখন শিরো মিদোরি থেকে বেশ অনেক খানি দূরে চলে এসেছে। এখান থেকে শিরোমিদোরি কে দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা মুকুট, যেটার নিচের অংশ সমুদ্রের তীরের বালু রাশির ওপর সূর্য কিরণ পড়ে সাদা রঙ ধারণ করেছে, আর ওপরের অংশ জঙ্গলের ঘন গাছপালার কারণে গাঢ় সবুজ রঙে রাঙিয়ে আছে। বেঞ্জামিন ছেলেটা জাহাজের পেছনের অংশে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা শিরো মিদোরির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। অন্যরা জাহাজের সামনের দিক টাতে উচ্চস্বরে আড্ডা দিতে ব্যাস্ত।

পাটাতনের ডান দিক টাতে জাহাজের রেলিঙের কাছে থাকা একটি কাঠের চেয়ারের ওপর পিছনে হাত বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে অ্যানা কে। অ্যানা নির্বিকার চিত্তে সাগরের বুক চিরে আসা জাহাজের পেছন দিকের ফেনা তোলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে। ফেনার সাথে সেখানে খেলা করে বেড়াচ্ছে কিছু ডলফিন, সাদা রঙা ফেনা কে ধরার চেষ্টা করছে ওরা কিন্তু পেরে দিচ্ছে না। অ্যানা সেদিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ডলফিন গুলোর কান্ডকারখানা দেখে হাসছে আর হাই তুলছে ঘন ঘন। কালাভুনা টার কারণে ওর আজকাল রাতে ঘুম হচ্ছে না, তার ইমপ্যাক্ট পড়ছে এখন, চোখ ছোট ছোট হয়ে আসছে, আর হাই উঠছে বার বার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওর থেকে কিছুটা দূরেই পাটাতনের মেঝেতে সারি সারি বসে আছে বেশ কয়েকটি যুবক ছেলে, চোখগুলো ওদের অ্যানার দিকে। হা হয়ে অ্যানাকে দেখে চলেছে ওরা। আসার সময় হুডির হুড টা অ্যানার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছে বেঞ্জামিন, আলগা হয়ে আছে ওর নিতম্ব ছাড়ানো ঘন কালো চুল। চুলের বাহারে স্নো হোয়াইটের ন্যায় উজ্জ্বল অ্যানাকে অপ্সরার ন্যায় দেখাচ্ছে। টেরাকোটা রঙা তুলতুলে ঠোঁট জোড়া বার বার হাই তোলার কারণে মুভ করছে, ছেলেগুলো সে দৃশ্যটা বারবার চকচকে চোখে গিলে চলেছে।

এমন সময় মধ্যবয়সী হেনরি এলো সেখানে। অ্যানা নামক মেয়েটা যে এত সুন্দরী হবে তা ও কল্পনাতেও আনেনি। বেঞ্জামিন অবশ্য ওকে বলেছিলো যে এমন সুন্দরী মেয়ে হেনরি কখনোই দেখেনি, কিন্তু হেনরি বেঞ্জামিনের এহেন কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। তার কাছে শতশত সুন্দরী মেয়ে আছে যাদের বাহুডোরে ওর রাত গুলো কাটে, হেনরি অ্যানাকে ওই মেয়েগুলোরই প্রথম সারির সুন্দরী গুলোর মতো ভেবেছিলো। কিন্তু অ্যানা নামক মেয়েটা যে বুক ফাটানো সুন্দরী হবে তা হেনরির জানা ছিলো না।

হেনরি ভেবেছিল মেয়েটা ওর সাথে কাজ করতে রাজি না হলে সমুদ্রে কেটে ভাসিয়ে দেবে, কিন্তু এমন আদুরে মেয়েকে ও কিভাবে আঘাত করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটাকে দেখলেই তো গাল দুটো টিপে দিয়ে আফর করতে ইচ্ছা করছে! মেয়েটির সামনে দাড়ালেই কেমন যেন বুক হালকা হয়ে আসছে ওর, খুব আদর আদর পাচ্ছে। এমন বেড়ালের বাচ্চার মত বাচ্চা একটা মেয়েকে নিয়ে ও কি করবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটার মুখের দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করছে ওর, ওই স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে তাকালেই চোখ জোড়াতে শীতল শান্তির স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন!
হেনরি ধীর পায়ে ওর গাবদাগোবদা শরীর টা নিয়ে এগিয়ে এলো অ্যানার দিকে, তারপর অ্যানার সামনে, পাটাতনের মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসে নরম গলায় বলল,

— তোমার নাম অ্যানা তাই না?
অ্যানা তখনও জাহাজের পেছন দিকের ফেনা তোলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিলো। হেনরির কথায় মুখ ফিরিয়ে তাকালো ও। অ্যানার টানা টানা কালো রঙা চোখ জোড়ার সে চাহনিতে হেনরির হার্টবিট মিস হলো যেন। অ্যানা হেনরির করা প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে আবার আগের জায়গায় স্থাপন করলো। হেনরি সেটা দেখে আহত হলো যেন, নতুন উদ্যাম নিয়ে ও আবার আগের মতো করে বলে উঠলো,
— শুনেছি তুমি নাকি ফাইটিং এ অনেক স্কিলড। আমি আমার গ্রুপে সবসময় এমন স্কিল্ড একজন কে চেয়েছি যে কিনা যেকোনো পরিস্থিতিতে সব সমস্যার সমাধান এক তুড়িতে করে দিতে পারবে। এখন আমি তোমাকে একটা অফার দিতে চাই, তুমি অফার টিতে রাজি হলে আমি খুশি হবো, আমি বলছিনা যে তোমাকে রাজি হতেই হবে, কিন্তু হলে খুশি হবো।
একটু বিরতি দিয়ে হেনরি আবার বলা শুরু করলো,

— আমি তোমাকে আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত করতে চাই অ্যানা। তুমি যদি চাও তবে আমি আমার এই বিশাল গ্রুপের ভারও তোমার ওপর দিয়ে দেবো, তুমি যেভাবে চাও সেভাবে আমার গ্যাং চলবে, তুমি যা বলবে আমার ছেলেরা তাই শুনবে। কেউ তোমার কথার বিন্দুমাত্র বিরোধিতা করবে না, রানীর হালে থাকবে তুমি৷ তোমার সমস্ত প্রয়োজন আমি মেটাবো, তোমার নিজের থেকে একটা নেইটও খরচ করা লাগবে না, তোমার জন্য পুরোটাই আমি প্রোভাইড করবো আমার পকেট থেকে।

আমার কোনো স্ত্রী সন্তান নেই, আমাকে কারো পেছনে নেইট ওড়ানো লাগে না। তাই খরচ করার মতো কাউকে পেলে আমি খুবই খু্‌শি হবো। ভেবোনা যে আমি তোমাকে ভোগ করার জন্য এসব কথা বলছি, তোমাকে আমি আমার মেয়ের মতো করেই দেখবো। এখন শুধু তুমি একবার রাজি হয়ে যাও।
হেনরির শেষোক্ত কথা গুলো শুনে অ্যানা মুখ ফিরিয়ে হেনরির দিকে তাকালো আবার, তারপর কিছুক্ষণ হেনরির গোলগাল খোচাখোচা দাড়ী যুক্ত চেহারাটা পরখ করে নিয়ে প্রশ্ন করলো,

— তোমার মান্থলি ইনকাম কত, হেনরি?
— থ্রি হান্ড্রেড ব্লু কয়েন্স, মিনিমাম।
গর্ব ভরে উত্তর দিলো হেনরি। শিরো মিদোরিতে এক কিলোগ্রাম পিউর গোল্ডের প্রাইস সমান একশত ব্লু কয়েন। সেই হিসেবে হেনরি হেব্বি পয়সা ওয়ালা। অ্যানাকে নিজের ইনকামের কথা টা জানাতে পেরে গর্বে যেন বুকটা ফুলে উঠলো হেনরির। তার ব্লাক মানি প্রচুর, তার ব্লাক মানি যদি হোয়াইট মানি হতো তবে সে হয়তো কুরো আহমারের দ্যা মোস্ট রিচেস্ট পারসন হতো।
হেনরির উত্তরে অ্যানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। অ্যানার নিরবতায় হেনরি মনে মনে ভেবে নিলো অ্যানা ইজ ইমপ্রেসড। যার মান্থলি ইনকাম মিনিমাম থ্রি হান্ড্রেড ব্লু কয়েন তার কাছে যে কোনো মেয়ে অনায়াসে চলে আসবে, আসতে বাধ্য।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেনরির দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অ্যানা এবার প্রশ্ন করলো,

— আমার গায়ে যে হুডি আর ট্রাউজারের সেট টা দেখছো, এটার প্রাইস কতো জানো হেনরি?
— কত?
আগ্রহভরে অ্যানার দিকে তাকিয়ে শুধালো হেনরি। অ্যানা আগের মতো করেই বলে উঠলো,
— ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড স্যাভেন্টি ফাইভ ব্লু কয়েন্স।
অ্যানার কথা শুনে মুহুর্তেই তব্দা খেয়ে গেলো হেনরি। মুখ নেমে গেলো ওদের পাশে বসে অ্যানাকে এতক্ষন হা করে দেখতে থাকা ছেলে গুলোরও। বলে কি এ মেয়ে! এই হুডি ট্রাউজারের প্রাইস নাকি ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড স্যাভেন্টি ফাইভ ব্লু কয়েন্স! কিভাবে সম্ভব! হাউ ইজ দিজ পসিবল!
হেনরি কে তব্দা খেয়ে যেতে দেখে অ্যানা আবারও বলল,

— আমার একটা পোশাকের দামই তোমার মান্থলি ইনকামের অর্ধেকের চাইতে বেশি। আর এছাড়া আমি যে বিউটি প্রোডাক্টস অ্যান্ড স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টস ইউজ করি সেগুলো প্রোভাইড করতে হলে তোমাকে তোমার পুরো মাসের ইনকাম টাই আমার পেছনে ঢালতে হবে। পারবে?
হেনরি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অ্যানার দিকে। এটা কোন ফ্যামিলির মেয়ে! এত আভিজাত পরিবার কোথায় আছে আর! কুরো আহমারে যতগুলো অভিজাত পরিবার আছে তাদের সবাইকে হেনরি ভালো ভাবেই চেনে, এই মেয়েটা তো তাদের কেউ না! আর তাছাড়া তাদের কেউ হলেও এত এক্সপেন্সিভ লাইফস্টাইল তাদের কোনো মেয়ে লিড করার মতো ক্ষমতা রাখে না। তবে এই মেয়ে টা কোন পরিবারের?

হেনরির ভাবনার মাঝেই অ্যানার কপালে এসে বসলো একটা মশা, অ্যানা সেটাকে সরাতে নিজের অজান্তেই তার পেছনে বাধা হাত জোড়া সামনে নিয়ে এলো, সাথে সাথেই কচাত করে দড়ি ছিড়ে যাওয়ার শব্দ হলো, কিন্তু অ্যানার তাতে সামান্যতম বিকারও দেখা গেলো না। ও নির্বিকার চিত্তে মশা টা কপাল থেকে হাত দিয়ে বাতাসে ঢেউ খেলানোর ভঙ্গিতে তাড়িয়ে দিলো, কিন্তু তখনি ওর মনে পড়লো ওর তো হাত বাধা ছিলো! হেনরির দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে ও বলে উঠলো,

— ওহ, আমার তো হাত বাধা ছিলো, ভুলে গেছিলাম!
কিন্তু হেনরির অ্যানার কথার দিকে কোনো খেয়াল নেই, ওর মাথায় ঘুরছে অ্যানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা ছাড়াই দড়ি ছিড়ে হাত সামনে নিয়ে আসার দৃশ্য টা। বেঞ্জামিনের কথা মতো সতর্কতা অবলম্বনের জন্য অ্যানার হাত জোড়া ও ডেনিম রোপ দিয়ে বেধেছিলো, আর এমন গিট দিয়েছিলো যেন কোনোভাবেই সেটা খোলা না যায়। আর এই মেয়েটা কিনা এত শক্তিশালী দড়িটা কোনো বিকার ছাড়া এক টানেই ছিড়ে ফেললো! এটা কিভাবে সম্ভব! এই মেয়েটা আসলে কে! এতটা শক্তিশালী মেয়ে মানুষ কিভাবে হয়!
হেনরির এবার যেন ভয় করতে লাগলো কিছুটা। সে কি আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো বড় ধরণের ভুল করে বসলো!
এমন সময় মাঝসমুদ্রের আকাশে শোনা গেলো একটি বাজপাখির তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর। হেনরি চমকে তাকালো তার মাথার ওপরে, দূর আকাশে রাজকীয় ভঙ্গিতে পাখা মেলে দিয়ে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি বিশালাকার ফ্যালকন পাখি।
কিন্তু ওরা সমুদ্রের যতটা গভীরে তাতে এদিকটায় পাখি আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে এই শিকারী পাখি টা এই ভরদুপুরে এইখানে কি করছে।
হেনরির এসব ভাবনার মাঝেই ওর সামনে বসা অ্যানা আফসোসের সুরে বলে উঠলো,

— আ’ ফ্যিল সর‍্যি ফ’ ইয়্যু হেনরি!
হেনরি চমকালো আবারো, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
— কে-কেন?
অ্যানা মৃদু হেসে নিজের ডান ভ্রু টা সামান্য উঁচু করে উত্তর দিলো,
— কজ, কালাভুনা ইজ অন ফায়ার!
হেনরি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো অ্যানার দিকে, তারপর একটা শুকনো ঢোক গিলে ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
— তুমি কোন বংশে বিলং করো অ্যানা?
হেনরির প্রশ্নের উত্তরে অ্যানা মৃদুস্বরে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
— দেমিয়ান।

আর ঠিক সেই মুহুর্তেই জাহাজের পেছন সাইডে প্রচন্ড শব্দ তুলে বিদ্যুৎ গতিতে আছড়ে পড়লো কিছু একটা, সাথে সাথেই জাহাজের পেছন দিকটার কাঠের অংশটা শব্দ করে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে কয়েক হাত পানির নিচে চলে গেলো, আর সামনের দিক টা ভার সামলাতে না পেরে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে উঠে গেলো দু হাত ওপরে, তারপর আবার গিয়ে আছড়ে পড়লো পানিতে। সমুদ্রের বুক ছলকে এক ঝটকা পানি এসে পড়লো জাহাজের পাটাতনের ওপর।
সচকিত হয়ে উঠলো সকলে। জাহাজে হামলা হয়েছে ভেবে সকলেই অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য এলোপাথাড়ি ছোটাছুটি শুরু করলো।

কিন্তু হেনরি ঠাই বসে রইলো অ্যানার দিকে তাকিয়ে। অ্যানার মুখ থেকে দেমিয়ান শব্দ টা শোনা মাত্রই ওর গলা বুক সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, চাতক পাখির ন্যায় খুজেও গলা ভেজানোর জন্য একফোটা লালাও হেনরি খুজে পেলোনা তার মুখের ভেতরে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে ওর, হৃদপিণ্ড টা যে গতিতে লাফাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বুকের খাচা ভেদ করে সেটা লাফিয়ে বের হয়ে আসবে যে কোনো মুহুর্তে! উঠে দাড়ানোর মতো শক্তিও যেন আর খুজে পাচ্ছে না হেনরি। ওর সমস্ত শক্তি, বুদ্ধি যেন মুহুর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
ঠিক তখনি এতক্ষণ জাহাজের পেছন সাইডে থাকা বেঞ্জামিন হন্তদন্ত হয়ে, সমস্ত মুখে হতভম্বতা আর ভীতি নিয়ে ছুটে আসলো সেখানে। হেনরির কাছে এসে দাঁড়িয়ে ও হতভম্ব চোখে তাকিয়ে হাফালো কিছুক্ষণ, তারপর নিজের হতভম্বতা সামান্য কাটিয়ে উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে বিস্ফোরিত নয়নে দম হারানো গলায় আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠলো,

— বস, বাদশাহ! বাদশাহ!
হেনরি যেন শরীরে আর এক ফোটাও জোর পেলো না। তার দৃষ্টি এখনো অ্যানার দিকে। হতভম্বতা আর অসহায়ত্ব এসে গ্রাস করে ফেলেছে ওকে। হেনরির আর বুঝতে বাকি রইলো না তার সামনে বসা মেয়েটি ঠিক কে। এই মেয়েটি পঞ্চদ্বীপের একমাত্র শেহজাদী, এবং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের বিবাহিতা স্ত্রী, আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান।
হেনরি এবার ভেঙে পড়লো একেবারে। ভারী শরীর টা লুটিয়ে দিলো অ্যানার পায়ের কাছে, তারপর কাঁদোকাঁদো কন্ঠে, আর্তনাদের সুরে বলে উঠলো,

— ক্ষমা করুন শেহজাদী! আমার ভুল হয়েছে শেহজাদী, এই অধম কে আপনি ক্ষমা করুন, দয়া করুন। এমন টা আর কখনো হবে না শেহজাদী! আমি সব কিছু ছেড়ে দেবো শেহজাদী, আমার সমস্ত নেইট আমি গরীব দুঃখী দের কে দান করে দিবো শেহজাদী! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন! হিজ ম্যাজেস্টির ক্রোধ থেকে আমাকে বাচান শেহজাদী, পায়ে পড়ি আপনার।

ততক্ষণে সমস্ত জাহাজ টা জুড়ে চাউর হয়ে গেছে স্বয়ং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান তাদের জাহাজে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পাটাতনের ওপরে এসে জড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের সমস্ত কর্মি! আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাসে তারা যেন জমে গেছে। পালানোর কথা এক প্রকার ভুলেই গেছে ওরা! নিঃশব্দে ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা সকলে।
সমস্ত জাহাজ জুড়ে পিনপতন নিরবতা, কেউ কোনো টু শব্দটি করছে না। শুধুমাত্র হেনরির কাকুতি মিনতি ছাড়া আর কোনো শব্দই কোনো দিক থেকে কানে আসছেনা কারো।
কিন্তু তখনি সমস্ত নিরবতাকে ভেদ করে, হেনরির আর্তনাদের শব্দটাকে ছাপিয়ে শোনা গেলো জাহাজের কাঠের পাটাতনের ওপরে কারো শক্ত বুটের ভারী পদশব্দ, যার প্রতিটা ধীর গতির পদক্ষেপে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো সম্পুর্ন জাহাজ টা।

আর এই পদধ্বনি শোনা মাত্রই আতঙ্কিত হয়ে গেলো হেনরি। থেমে গেলো ওর আর্তনাদ। অ্যানার পায়ের কাছ থেকে মাথা টা উঠিয়ে নিয়ে ও বসলো পদধ্বনি ধ্বনিত হওয়ার দিকে ফিরে। আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই নিরবতায় ডুবে যাওয়া পরিবেশ টাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো সেই ভারী পদধ্বনির মালিক, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।
কুচকুচে কালো রঙা, লম্বা চওড়া, সুঠামদেহী, বলিষ্ঠ শরীরের অধিকারী, ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুলের স্বর্ণচোখি পুরুষটির ইস্পাত-দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন চেহারাটা দৃষ্টি গোচর হওয়া মাত্রই হেনরি সহ সেখানে উপস্থিত সমস্ত লোকগুলো আনুগত্যের সাথে মাথা নিচু করে কুর্নিশ জানালো তাকে।
কিন্তু পরক্ষণেই তাদের অন্তরাত্মা কে কাঁপিয়ে দিয়ে শক্ত, ধারালো চেহারার ব্যাক্তিটি বজ্রকঠিন কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
— আমার শাসন তলে থেকে, আমার দ্বীপে এসে আমারই চোখের সামনে দিয়ে আমার স্ত্রীকে অপহরণ করার স্পর্ধা তোদেরকে কে দিয়েছে?

হেনরি পাটাতনের ওপর বসা অবস্থাতেই একপ্রকার হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেলো মীরের দিকে তারপর মাথা নত করে মিনতির সুরে বলল,
— ক্ষমা করে দিন, ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমরা বুঝতে পারিনি, চিনতে পারিনি ওনাকে! আমরা যদি ওনাকে চিনতাম তবে কখনোই এমন দুঃসাহস দেখাতাম না! ক্ষমা করে দিন ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমাদের প্রাণ নেবেন না! ক্ষমা করে দিন! এমন টা আমরা আর কখনোই করবো না। সব পাপ কাজ ছেড়ে দেবো, ক্ষমা করে দিন!
হেনরির কথায় মীর অত্যান্ত অবজ্ঞার সাথে বাঁকা হাসলো, তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
— ক্ষমা! এই নামে কোনো শব্দ আমি চিনি না।

আর তার পরমুহূর্তেই মীরের ডান হাতের কব্জির ঠিক ওপরে থাকা যান্ত্রিক মেটালিক আর্মরের অংশটার ভেতর থেকে ধাতব শব্দ করে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে এলো একটা স্বর্ণের নকশা দেওয়া কালো রঙা হাতলের ঝা চকচকা সৌর্ড। এবং পরক্ষণেই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্থীর হয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মীর নিজের ডান হাতে থাকা সৌর্ড টির হাতল তড়িৎ গতিতে স্পিন করে ওর ডানদিকে, বেশ খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে আড়াআড়ি ভাবে ছুড়ে দিলো, আর ছুড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ধারল সৌর্ড টা সেখানে দাঁড়ানো লোকগুলোর ডান দিক থেকে তীব্র গতিতে স্পিন করতে করতে ঢুকে গেলো লোকগুলোর শরীরের ভেতর, আর এরপর খ্যাচ খ্যাচ শব্দ তুলে সেখানে থাকা সমস্ত শরীর গুলোকে বিদ্যুৎ গতিতে ফালা ফালা করে দিতে দিতে সর্বশেষ লোকটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে বা দিক থেকে বেরিয়ে স্পিন করতে করতে আবার চলে এলো মীরের কাছে। মীর সেটাকে হাতে নিয়ে নিজের তর্জনী আর মধ্যমা দ্বারা দক্ষ ভঙ্গিতে দুবার দুদিকে স্পিন করতেই সৌর্ডের ধারালো অংশের ওপর থেকে উধাও হয়ে গেলো তাতে লেগে থাকা লাল রঙা তরল।

হেনরি এতক্ষণ বিস্ফোরিত নয়নে মীরের পায়ের কাছে বসে দেখছিলো এ দৃশ্য। ওর যে কোনো ক্ষমা নেই সেটা বুঝতে ওর আর বাকি রইলো না। অথর্বের ন্যায় পাটাতনের মেঝেতে বসে রক্তের সমুদ্র বয়ে যাওয়া লাশের স্তুপের দিকে তাকিয়ে রইলো ও৷ এবার যে ওর পালা সেটা বুঝতে পেরে, নিজের শেষ পরিণতি মেনে নিয়ে মীরের সৌর্ড চালানোর অপেক্ষায় মাথা পেতে বসে রইলো ও।
কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মীর চলে গেলো ওর পেছন দিকে, অ্যানার নিকট। অ্যানার কাছে গিয়ে নিজের বা হাত খানা অ্যানার পিঠের ওপর দিয়ে নিয়ে ওর অপরপাশের বাহুতল টা আকড়ে ধরে অ্যানাকে চেয়ার থেকে উঁচু করে উঠিয়ে নিজের বুকের ওপর নিলো। অ্যানা মীরের বুকের সাথে লেগে দুহাতে মীরের গলা জড়িয়ে ধরে দু পা দ্বারা মীরের কোমর টা আকড়ে ধরলো, আর তখনি মীর জাহাজের পাটাতন থেকে উঠে গেলো শূণ্যে। তারপর জাহাজ থেকে উপরের দিকে বেশ খানিক টা গিয়ে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। ওদের চারপাশে তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উড়ে বেড়াতে লাগলো ফ্যালকন।

হেনরি ভেবে পেলোনা এরা ঠিক কি করতে চাইছে ওর সাথে। এরা কি জাহাজ টাকে অকেজো করে দিয়ে এই লাশের স্তুপের সাথে ওকে এইখানে একা ফেলে রেখে চলে যাবে? না অন্য কিছু করবে?
অ্যানাকে বুকে নিয়ে শূণ্যে ভেসে থাকা মীর তার মুখের অতি নিকটে থাকা অ্যানার মুখ খানার দিকে তাকালো একপলক, তারপর কিছু একটা ইশারা করতেই অ্যানা মৃদু গতিতে মাথা নাড়ালো। আর তার পরমুহূর্তেই মীর ওকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে ভেসে এলো জাহাজের চারপাশের সমুদ্রপৃষ্ঠের দিকে। আর এরপর সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছ ঘেঁষে জাহাজের চারপাশটা প্রচন্ড দ্রুত গতিতে চক্কর দিতে শুরু করলো, আর সেই সাথে সাথে অ্যানা ওর মুখ থেকে বের করলো তিমি মাছের কণ্ঠনিঃসৃত শব্দের ন্যায় অদ্ভুত এক শব্দ। আর তার কিছুক্ষণ পরেই বিশালাকার কিছু একটা এসে পানির নিচ থেকে ধাক্কা দিলো জাহাজ টাকে।

সাথে সাথেই প্রচন্ড গতিতে দুলে উঠলো জাহাজ টা। সেই সাথে জাহাজের চারপাশ ঘিরে সমুদ্রতল থেকে উঠে এলো ঝাকে ঝাকে নিলতিমি। তাদের কণ্ঠনিঃসৃত হাড়হিম করা অদ্ভুত শব্দে বুক কেঁপে উঠলো হেনরির।
পরক্ষণেই সে বিশালাকৃতির নীলতিমি গুলো অ্যানার ইশারায় জাহাজের চারপাশে একে একে গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করে দিলো, আর তাদের এই ঘূর্ণণের কারণে সেখানে ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হলো বিশাল এক জল ঘূর্ণির, আস্তে আস্তে জাহাজ টা সেই জল ঘূর্ণির সাথে তাল মেলাতে শুরু করলো। হেনরি প্রমাদ গুনলো! সমুদ্রের ভেতরের ওই বিশাল জল ঘূর্ণি দেখে ওর আত্মা উড়ে গেলো যেন! তাকে তবে জীবন্ত অবস্থাতেই সলিল সমাধি দেওয়া হবে!

জল ঘূর্ণির চারপাশে বিশালাকার নীলতিমি গুলো উৎসব করে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা হোয়াইট শার্ককেও দেখা যাচ্ছে সেখানে, জাহাজ থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের গন্ধে উন্মাদ হয়ে এদিক ওদিক ছটফটিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ওরা।
জাহাজ টা পানির ঘূর্ণনের সাথে এবার পুরোপুরি তাল মেলালো, হেনরি ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো। বার বার করে ক্ষমা চাইতে লাগলো মীর আর অ্যানার কাছে, যেন শেষ মুহুর্তে এসে হলেও তাকে ওরা বাঁচিয়ে নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা ওর হলো না। জাহাজটা ঘূর্ণির সাথে প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মিলিয়ে গেলো সমুদ্রের অতল গহ্বরে, সেই সাথে চিরকালের জন্য সমুদ্রের বুকে মিলিয়ে গেলো হেনরির আর্তচিৎকার।
আর জাহাজের চিহ্ন পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হতেই অ্যানাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কোলে নিয়ে ঝড়ের বেগে সোজা প্রাসাদের দিকে উড়ে চলল মীর৷

— আঙ্কেল, হোই আঙ্কেল! শুনছেন? এই যে আঙ্কেল!
উপুড় হয়ে ঘুমানো মীরের পেশিবহুল, চওড়া পিঠখানাতে পেছন থেকে হাত দিয়ে মৃদুমন্দ গতিতে থাবড়া দিতে দিতে ডাকলো অ্যানা।
অ্যানার মুখ থেকে আঙ্কেল’ শব্দটি শুনে ভ্রু কুটি করে মুখ তুলে তাকালো মীর। ভোর সকালে সদ্য স্নান করে আসা, মীরের একটি পাতলা ফিরফিরা পার্ল রঙা শার্ট পরিহিতা অ্যানাকে বৃষ্টিস্নাত সাদা রঙা অর্কিডের ন্যায় দেখাচ্ছে। পাতলা শার্ট টার কারণে ওর আবেদনময়ী শরীর টা দৃশ্যমান হয়ে আছে। ওর প্রতিটা পদক্ষেপে সাদা মার্বেলের মেঝে থেকে অদ্ভুত সুন্দর মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে, যেন কেউ কাঁচের রেশমি চুড়িতে মৃদুমন্দ টুংটাং বাজিয়ে চলেছে৷ নিতম্ব ছাড়ানো সাদা রঙা চুল গুলো বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ে চলেছে, এক হাতে সেগুলোই একটা টাওয়েল দিয়ে মুছে চলেছে অ্যানা। আর এই পরিস্ফুটিত শুভ্র গোলাপের ন্যায় অ্যানাকে দেখা মাত্রই মীরের ভ্রু কুটি করা দৃষ্টি মুহুর্তেই কোমল হয়ে এলো, অ্যানার স্নিগ্ধতায় ভরা মুখ খানা নেশাতুর চোখে দেখতে লেগে গেলো ও৷

মীরের চাহনির এমন পরিবর্তন দেখে অ্যানা ফিক করে হেসে উঠলো, আর অ্যানার এ হাসি কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই মীরের মনে পড়লো একটু আগেই অ্যানা ওকে আঙ্কেল ডেকেছে। নিজের কোমল হওয়া চাহনি আবারও রুক্ষ করে নিয়ে অ্যানার হাত খানা ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের তলে টেনে নিলো ও, তারপর অ্যানার সমস্ত মুখ গলা বুক জুড়ে নিজের সুচালো দন্তের অগ্রভাগ দিয়ে উন্মাদের ন্যায় আদুরে কামড় দিতে দিতে শাসনের সুরে বলে উঠলো,

— এই তোমাকে না একদিন বলেছি আমাকে আঙ্কেল ডাকবে না! তোমার কি হাল করি দেখো এইবার।
মীরের কান্ডে অ্যানার সুড়সুড়ি লাগতে শুরু করলো, খিলখিল করে হেসে মীরের এই দন্ত আক্রমণ থেকে বাঁচতে শরীর টা একিয়ে বেকিয়ে ও ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা শুরু করলো, কিন্তু মীর এবার আরও শক্ত করে ধরলো ওকে, আঙ্কেল ডাকার শাস্তি খুবই গুরুতর হতে চলেছে।

কিন্তু মীরের এই শাস্তি প্রদানের চেষ্টার সূচনা ঘটতে না ঘটতেই সমাপ্তি এসে নাড়া দিলো, বিছানার পাশের সাইড টেবিলের ওপর রাখা অ্যানার ফোন টা বেজে উঠলো শব্দ করে।
চরম বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালো মীর, মাথাটা সামান্য উঁচু করে দেখার চেষ্টা করলো কলার ব্যাক্তি টা কে। কোকোর নাম দেখা মাত্রই মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে নেমে গেলো অ্যানার ওপর থেকে, তারপর বিরক্তিপূর্ণ কন্ঠে চরম হতাশার সাথে বলে উঠলো,

— মানে ছেলে গুলো যদি এক ফোটাও শান্তি দেয়! কয়টা বাজে এখন, সাড়ে চার টা! রাত ফুটো করে ফোন লাগাচ্ছে সব ফাজিলের দল। ওদের কি এইটুকু জ্ঞান বোধ নেই যে এই সময়ে কাপলরা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে! বিরক্তিকর!
অ্যানা উঠে গিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফোন টা হাতে নিতে নিতে মীরের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— উহ্‌, থামো তো! কোনো জরুরি নিউজ দিতে ফোন করেছে নিশ্চয়। নইলে এমন অসময়ে তো কোকো কখনোই কল করে না। আর তাছাড়া ওকে কোথায় পাঠিয়েছি তা কি ভুলে গেছো!
চিন্তিত কন্ঠে শেষোক্ত কথা টা বলে কল টা রিসিভ করলো অ্যানা, আর রিসিভ করা মাত্রই অ্যানার কানে এলো কোকোর ভীতিপূর্ণ কন্ঠস্বর,

— আম্মা! আম্মা আমি এখানে আটকে গেছি আম্মা! ওরা জেনে গেছে আমি এইখানে ওদের ওপর নজরদারি করতে এসেছি, ওরা আমাকে খুজছে। কিন্তু আমি ওদের ডেরাতেই আটকে গেছি আম্মা, বের হওয়ারও কোনো রাস্তা পাচ্ছিনা আম্মা! আমি কি করবো!
কোকোর এমন আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে অ্যানা আঁতকে উঠলো, তড়িঘড়ি করে বলল,
— কোথায় আটকে আছিস? লোকেশন বল দ্রুত! আর আলফাদ কোথায়?

— আলফাদ কোন দিকে ছুটে পালিয়েছে আমি বলতে পারিনা। আমি আর ও আলাদা হয়ে গেছি। আমি আপনাকে লোকেশন সেন্ড করে দিয়েছি চ্যাটনেস্ট এ। আমি এখানে এসে যতটুকু ইনফর্মেশন জোগাড় করেছি তাতে এদের যে মেইন বস তার বসবাস কুরো আহমারে নয়, অন্য কোনো আইল্যান্ডে। হেনরির মতো তার আন্ডারে বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় ত্রিশ জনের মতো পিপল কাজ করে, তাদের ডেরআও আলাদা আলাদা, এক এক টা সেক্টরের মতো। আর এই জায়গাটায় এদের মেইন ডেরা। এদের বস রাতের আধারে এখানে আসে, আবার রাতের আধারেই চলে যায়। একটা কালো রঙা ডাইনোভো কারে করে সে আসে, তার চেহারা মাস্কের আড়ালে ঢাকা থাকে, তাকে তার মোস্ট পার্সোনাল পিপলস ছাড়া অন্য কেউ দেখেনি এখনো পর্যন্ত। কিন্তু আমি আর আলফাদ দুর্ঘটনাবশত দেখে ফেলেছি তাকে, আর সেটা টের পেয়েই ওরা আমাদেরকে ধাওয়া করেছে। ডেরার মুখ আঁটকে দিয়েছে যেন আমরা কোনো ভাবেই এখান থেকে বের হয়ে পালিয়ে যেতে না পারি!

এই পর্যায়ে এসে একটা শুকনো ঢোক গিললো কোকো, তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
— ওদের কাছে সব টপ নচ ব্রাণ্ডের অস্ত্রপাতি, সবার হাতেই গান, ফুলি লোডেড। পেলেই স্পটে ফায়ার করে দিবে। এখন আমি কি করবো আম্মা! আমি যদিও তুলনামূলক নিরাপদ জায়গাতে লুকিয়েছি, কিন্তু আলফাদ টা কোথায় আমি জানিনা! ও কি অবস্থায় আছে, এদের হাতে ধরা পড়েছে কিনা সেটাও জানিনা! আর…… আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে, তাদের বস কে দেখতে সম্পুর্ন হিজ ম্যাজেস্টির মতো! সেইম চোখ, সেইম নাক, সেইম দেহ। শুধু তার কালার টা অনেক লাইট শেইড এর আর চোখ গুলো খুব সম্ভবত পার্পল রঙের। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমার দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে কিনা, কিন্তু আলফাদও তো তাই-ই দেখেছে, দুজনের তো আর একসাথে দৃষ্টিভ্রম হবে না! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব আমি বুঝতে পারছিনা আম্মা! আপনি কিছু একটা করুন আম্মা! আমার চাইতেও হয়তো আলফাদের বিপদ বেশি। আম্মা আপনি যত তাড়াতাড়ি…..

কথা টা শেষ হওয়ার আগেই কোকোর কল টা কেটে গেলো। অ্যানা হ্যালো হ্যালো করলো কিছুক্ষণ, কিন্তু ও পাশ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না। অ্যানা চিন্তিত মুখে ফোন টা কান থেকে নামিয়ে মীরের দিকে তাকালো। মীর আগে থেকেই ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। অ্যানা তাকালে মীর ইশারায় জিজ্ঞেস করলো ব্যাপার টা কি।
— তোমার ধারণাই সঠিক। মেইন কালপ্রিট ইলহানই। ও ডার্ক প্যালেস থেকে লুকিয়ে, রাতের আঁধারে কুরো আহমারে গিয়ে এই সমস্ত অরাজকতার সৃষ্টি করছে। এত গুলো দিন ধরে যাকে তুমি খুঁজে পাচ্ছিলে না সে তোমার আশেপাশেই ছিলো। এবং সবার চোখে ধুলো দিয়ে সে এতগুলো দিন ধরে এতগুলো ক্রাইম সেক্টর তৈরি করেছে, আর এসব ও কেন করছে সেটাও পরিষ্কার। তোমাকে যেন পঞ্চদ্বীপের জনসাধারণের নিকট খারাপ ভাবে উপস্থাপন করে প্রমাণ করতে পারে যে তুমি শাসন করতে ব্যর্থ হচ্ছো! আর সেই সুযোগ টা ও কাজে লাগাতে পারে।

কথা শেষ করে অ্যানা মীরের দিকে ‘এখন কি করা যায়’ ভঙ্গিতে তাকালো। মীর মাথার নিচে বা হাত টা দিয়ে রেখে শুয়ে শুয়ে অ্যানার দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিলো। অ্যানার ইশারাপ্রশ্নের উত্তরে অ্যানার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ও গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
— তুমিই আমাকে দিয়ে ওয়াদা করিয়েছিলে যেন আমি আর কখনো নৃশংস শাসক না হই। আমি আমার কথা রেখেছি, কাউকে কোনো ভয়ঙ্কর শাস্তি দেইনি। আর এইটা হচ্ছে তার ফলাফল। আজ যদি আমি আমার সমস্ত কর্মকাণ্ড জারি রাখতাম তবে না ইলহান এমন কিছু করার কথা চিন্তা করার সাহস পেতো, আর না পঞ্চদ্বীপের কোনো ব্যাক্তি কোনো ক্রাইম করার কথা ভাবতো।
অ্যানা হাতের ফোন টা সাইড টেবিলের ওপর শব্দ করে রেখে দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে শক্ত গলায় বলল,

— মীর, তোমার নৃশংসতা সেবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিলো। অত গুলো মানুষ কে, হোক তারা অপরাধী, তুমি তাদেরকে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিলে সেটাও জীবন্ত অবস্থায়৷ আমি শুধু তাদের আর্তনাদ শুনেছিলাম সেদিন। আমার গা শিউরে উঠেছিলো, কিন্তু তুমি! তুমি ছিলে একদম নির্বিকার। তোমার এতটুকুও বুক কাঁপেনি অতগুলো মানুষ কে একত্রে ওই এসিড ভর্তি পুল টায় ফেলে দিতে। তুমি ওদের জ্বলে পুড়ে গলে হাড় মাংস সহ এসিডে মিশে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছিলে একেবারে অনুভূতি শূন্য চোখে! এটা কি স্বাভাবিক? তুমি বলো! স্বাভাবিক এটা?
আমি তোমাকে কেন মানা করেছিলাম জানো? যেন তুমি কোনো পশুতে পরিণত হয়ে না যাও। জায়ান চাচাজানের কাছে আমি শুনেছি তুমি মানুষ মেরে আনন্দ পাও। এটা ঠিক যে তুমি অন্য দেমিয়ান দের থেকে অনেকাংশে আলাদা, কিন্তু তাই বলে এই নয় যে তোমার এই ফ্যান্টাসি টা বৈধ! ওই মানুষ গুলো কে তো তুমি আমার সামনে মেরেছিলে! তাহলে আমার অগোচরে তোমার নৃশংসতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা ভাবলেও আমার গায়ে কাটা দেয়। মানুষের কষ্ট দেখলে তুমি মজা পাও! স্যাডিস্ট তুমি! আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি যে আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিতেই থাকো দিতেই থাকো এটাও তোমার ওই অসুস্থ বিনোদনেরই একটা অংশ৷

মীর এতক্ষণ সিলিঙের দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে নিজের মেজাজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু অ্যানার শেষোক্ত কথা টা কানে যাওয়া মাত্রই ও নিয়ন্ত্রণ হারালো নিজের ওপর থেকে।
বিছানা থেকে তড়িৎ গতিতে উঠে অ্যানার শার্টের বুকের কাছ টা খামচে ধরে এক ঝটকায় নিয়ে এলো নিজের কাছে তারপর অ্যানাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে অ্যানার মুখের কাছে মুখ নিয়ে হিংস্র কন্ঠে বলে উঠলো,
— আজ বলেছো বলেছো, দ্বিতীয় বার যদি কখনো তোমার মুখে আমি এই ধরণের কথা শুনি তবে সেদিন টা তোমার মোটেই ভালো যাবে না, মনে রেখো কথা টা! শুধুমাত্র তোমার কাছে ওয়াদা করেছি বলে সেদিনের পর থেকে আমি আর একটিবারের জন্যও কোনো নৃশংসতা দেখাইনি। শুধু এবং শুধুমাত্র তুমি বলেছিলে বলে!

এই বিশাল পৃথিবী টাতে তুমি আমার একমাত্র আপন জন। তুমি আর আমার এই সাম্রাজ্য পৃথিবীর বাকি সবকিছুর উর্ধ্বে! তাই দ্বিতীয় বার কখনো আর ওই সমস্ত জানোয়ার গুলোর সাথে নিজের তুলনা করে নিজেকে ছোট করবে না। তোমাকে আমি কষ্টগুলো ইচ্ছে করে দেইনি কখনো, বাধ্য হয়ে দিয়েছি! তুমি যদি জানতে যে তুমি কষ্ট পেলে আমার বুকে তার কতখানি এসে লাগে তাহলে এই ধরণের কথা কোনোদিনও বলতে না।

তোমার শরীরে সামান্য আঘাত লাগলে সেটা আমার বুকে পাথর চাপার ন্যায় ঠেকে, তুমি সামান্য অসুস্থ হলে আমার প্রাণে সেটা বিষাক্ত কাঁটার ন্যায় বিঁধে, তোমার চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়ালে সেটা আমার হৃদয়ে জলোচ্ছাসের ন্যায় আছড়ে পড়ে। আর সেই ‘সাধনার তুমি’কে আমি মীর নিজে ইচ্ছাকৃত ভাবে কষ্ট দিবো সেটা তুমি ভাবো কিভাবে? কখনো সম্ভব হলে নিজেকে আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখো একটু! আমি কতটা অসহায় সেটা একটু হলেও বুঝবে! ন্যাও স্টপ দ্যিজ শিটস অ্যান্ড গেট রেডি ট্যু রেস্কিউ দোজ বয়েজ।

শেষোক্ত কথা টা বলেই মীর ঝড়ের গতিতে উঠে গেলো অ্যানার ওপর থেকে তারপর বিছানা ছেড়ে নেমে সোজা চলল ওয়াশরুমে। অ্যানা স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়। অনেক অনেক গুলো দিন পর মীর আজ এইভাবে ওর সামনে অ্যানাকে নিয়ে ওর নিজের ভেতরের কথা ব্যাক্ত করলো। কতগুলো বছর হচ্ছে তার হিসাব নেই।
বিছানায় শুয়ে সিলিঙের দিকে দৃষ্টি দিয়ে অ্যানা দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা৷ গত ছয়টা বছর ধরে ওর লাইফে সবকিছু এলোমেলো হয়ে চলেছে। কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। মীর অনেক বার এগিয়ে এসেছে৷ চেষ্টা করেছে সবকিছু ঠিক করার, কিন্তু অ্যানা তা হতে দেয়নি। মীর কে ও ক্ষমা করতে পারেনি পুরোপুরি। দুই নক্ষত্রের সংঘর্ষের ন্যায় দুর্বার শক্তিশালি আদরে পর্যবসিত হওয়ার পরও মীরের বাহুডোরে, মীরের বুকে লেপ্টে থেকেও ও অনুভব করেছে এক আকাশ পরিমাণ দুরত্ব। যেটাকে ও ডিঙিয়ে মীরের আত্মার সমীপে পৌঁছাতে পারেনি কোনোভাবেই! অভিমানের পাল্লা এতটা ভারী হয়েছে ওর, যে সেগুলো মীরের আকাশ সমান চেষ্টাও গলাতে পারেনি পুরোপুরি। সমুদ্রের তলদেশে বিশাল অস্তিত্ব নিয়ে সামান্য অগ্রভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠে দৃশ্যমান করে রাখা হিমশৈলের ন্যায় ওর অভিমান সুপ্তাবস্থায় রয়ে গেছে বরাবরই, যেটার অস্তিত্ব সম্পর্কে মীরের কোনো ধারণাই নেই! বার বার হাতড়েও যে সেই অভিমান কে মীর এখনো ছুতে পারেনি।

অ্যানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আবারও। তারপর নিজের সমস্ত জমাট বাধা অভিমান কে আগ্নেয়গিরির উত্তাপে গলিয়ে ফেললো। কি প্রয়োজন শুধু শুধু এতখানি অভিমান জমা করে রেখে নিজে কষ্ট পাওয়া, অপর পাশের মানুষ টিকেও কষ্ট দেওয়া! মীর তো কম চেষ্টা করেনি!
শোয়া থেকে এবার উঠে বসলো অ্যানা৷ চুল গুলো এখনো ভিজে। মীরের কামরার ডান দিকের দেয়ালে থাকা সরু দরজা টা দিয়ে ও চলে এলো নিজের কামরায়। চুলগুলো শুকিয়ে নিলো। এখনো পর্যন্ত প্রাসাদের কেউ ওর অস্তিত্ব টের পায়নি এখানে। গতকাল মীর ওকে নিয়ে সোজা নিজের কামরাতেই ঢুকেছে। তারপর আর বের হয়নি। আসার পর থেকেই অ্যানার সাথে চিপকে আছে ও। রাতের খাবার টাও অ্যানাকে ঠিক করে খেতে দেয়নি, অ্যানাকে নিজের পাহাড়সমান আদরে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য৷

নিজের ক্লজেটে ঢুকলো অ্যানা৷ তারপর ওয়াল আলমিরা থেকে একটা স্ট্রেচি ট্রাউজার নিয়ে পরে নিলো। মিশনের সময়ে ওপরে মেটালিক আর্মর থাকবে ঠিকই, কিন্তু কোনো কারণে আর্মর টা হঠাৎ সরে গেলে তখন বিপদে পড়তে হবে৷ ট্রাউজার টা পরা শেষ হতেই অ্যানার হঠাৎ কি যেন মনে হলো। ক্লজেট থেকে বেরিয়ে ও ছুটলো মীরের কামরায়, ওর ক্লজেটের দিকে।

মীর ওর ক্লজেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে, ডান হাত টা ওয়াল আলমিরার ওপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলো। একটু আগে অ্যানার সাথে করা ব্যাবহারের জন্য ওর আপসেট লাগছে প্রচুর। নিশ্চিত মেয়েটা এইবার রাগ করে বসে থাকবে, কথা বলতে চাইবে না ওর সাথে। আর সেটাই হয়ে দাঁড়াবে মীরের কাল! এই মেয়েটা ওর সাথে কথা না বললে ওর যেন পুরো দুনিয়া টাই অন্ধকার হয়ে যায়, মনে হয় যেন কিচ্ছু ঠিক নেই! চরম অশান্তি এসে গ্রাস করে তখন ওকে, যার জন্য মীর আরও রেগে যায়, গিয়ে আরও বাজে বিহ্যেভ করে ফেলে! কি করবে এখন ও!
কিন্তু ওর ভাবনার মাঝেই কেউ তার তুলতুলে দেহটা দিয়ে দখল করে নিলো ওর খোলা পিঠ খানা, তারপর শভ্র, নরম হাত জোড়া বাহুতল দিয়ে এনে রাখলো মীরের শক্তপোক্ত বুক খানাতে৷ অ্যানার হাতের শীতল কোমল স্পর্শে কেঁপে উঠলো মীর। তারপর ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই মৃদু গলায় শুধালো,

— রাগ করেছো আমার ওপর!
অ্যানা মীরের বলিষ্ঠ, চওড়া পিঠ খানায় ওর নিজের হাতের তীক্ষ্ণ নখাগ্রভাগ দিয়ে করা সুক্ষ্ম ক্ষতের আঁকিবুঁকির ওপর ছোয়ালো ওর নরম ঠোঁট জোড়া, তারপর মীরের করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কোমল গলায় বলে উঠলো,
— তোমাকে করানো ওয়াদা আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোমার থেকে তোমার সত্তা, নিজস্বতা আমি কখনোই কেড়ে নিতে চাইনা মীর! তুমি যেভাবে আছো আমি তোমাকে সেভাবেই ভালোবাসি। তোমার কোনো পরিবর্তন আমি চাইনা। তুমি মানসিক শান্তি পেলেই আমি শান্তি পাবো। তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি থাকবো। ইয়্যু ক্যান ব্যি অ্যা ব্যাড বয় ন্যাও!
মীর সাথে সাথেই উদভ্রান্তের ন্যায় ফিরলো এদিকে। তারপর অ্যানার হীরক খন্ডের ন্যায় চোখ জোড়ায় একবার নজর বুলিয়ে অ্যানাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে উঁচু করে নিজের সমান করে নিলো, অত:পর মুখ ডোবালো অ্যানার শুভ্র গলা আর চুলের ভেতরে।

সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে শিরো মিদোরি থেকে কুরো আহমারে যাওয়ার গ্লাস বর্ডারের চওড়া রাস্তা টা দিয়ে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে দুইটা প্যিচ ব্লাক শেইডের অত্যাধুনিক রয়্যাল ভাইপারক্রুজ বাইক। দুজন রাইডারের শরীরই মেটালিক আর্মর দিয়ে আবৃত, সামনের জন আবৃত কালো আর সোনালি রঙের মিশেলে, পেছনের জন আবৃত সাদা আর সোনালি রঙের মিশেলে। আর্মরের সাহায্যে বাইকের মেটালিক সাইড গুলোর সাথে আঁটকে আছে তারা, যেন কোনোভাবেই এই সুপার বাইক গুলো থেকে তারা কোনো দুর্ঘটনাবসত ছুটে না যায়।
রয়্যাল বাইক গুলোর পেছন পেছন আসছে চারটা র‍্যাপিড রাইডার বাইক। চার জন রাইডারের পরনেই ধুসর রঙের মেটালিক আর্মর। রয়্যাল বাইক গুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ওরা হাকিয়ে নিয়ে চলেছে নিজেদের বাইক গুলো।
শুধুমাত্র রয়্যাল ইয়্যুজ এবং ইম্পোর্ট এক্সপোর্টের কাজে ব্যাবহৃত হয় বলে রাস্তা টা পুরোপুরি ফাঁকা। শুধু মাত্র এই ছয়টি বাইক ছাড়া আর কোনো যানবাহনের অস্তিত্ব নেই সেখানে৷

গ্লাস বর্ডারের চার পাশে সমুদ্রের নানা রকমের, রঙ বেরঙের, বিভিন্ন সাইজের সামুদ্রিক প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে, কয়েক জোড়া বিশালাকার তিমিকেও ঘুরতে দেখা যাচ্ছে সেখানে। সমুদ্রের নীল রঙা স্বচ্ছ পানির কারণে সমুদ্রের তলদেশে থাকা পাথরের উঁচুনিচু খাদ গুলো স্পষ্ট। হরেক রঙের জলজ উদ্ভিদ আর শ্যাওলায় ছেয়ে আছে সেগুলো। ছোট ছোট মাছেরা সেখানে নিজেদের আবাসস্থল তৈরি করে নিয়ে মহা সমারোহে দিনাতিপাত করছে। কয়েকটা কিং সাইজের কচ্ছপ একগাদা বাচ্চাকাচ্চা সাথে নিয়ে গ্লাস বর্ডারের চারপাশ টা গোল করে চক্কর দিচ্ছে বারবার, বাচ্চাগুলো আগে আগে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে অ্যাডাল্ট কচ্ছপ গুলো বাচ্চাদের আবদারে ফেসে গেছে।
এসব দেখতে দেখতে একসময় ওরা পার করে ফেললো পানি পথের রাস্তা৷ তারপর বাচ্চাদেরকে সহ এসে উপস্থিত হলো যানবাহনের ভিড় ওয়ালা, আকাশ ছোয়া স্থাপনায় ভর্তি কুরো আহমারে।

কোকোর লাস্ট টাইমের লোকেশন টা সবার বাইকের জিপিএস এ পাঠিয়ে দিয়েছে অ্যানা। গাড়ি ভর্তি রাস্তা আর মানুষের কোলাহলের ভেতর দিয়ে বাইকে করে অপরিচিতের ন্যায় এগোতে লাগলো ওরা সকলে। অ্যানা আর মীরের বাইক দুটোর দিকে নজর গেলো রাস্তার পথচারীদের৷ কালো রঙা রয়্যাল ভাইপারক্রুজ গুলো খুবই রেয়ার। কুরো আহমারের মতো বিলাশবহুল শহরেও এগুলো হাতে গোনা কয়েকটি দেখা যায়। সেখানে একসাথে দুইটা দেখে অনেকেই নিজেদের ফোন বের করে রয়্যালক্রুজ দুটোর ফটোশ্যুট করতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে ওদের চারপাশে ভীড় জমতে শুরু করলো।
অবস্থা বেশি ভালোনা দেখে মীর একপলক তাকালো অ্যানার দিকে। মাথায় থাকা অত্যাধুনিক হেলমেটের ভেতর থেকে ও সকলের উদ্দ্যেশ্যে কমান্ড দিলো,

— স্প্লিট আপ!
আর তারপরেই বাইকের গতি বাড়িয়ে ও চলল অন্য দিকে। মীর চলে যেতেই অ্যানা এগোলো মীরের বিপরীত দিকের রাস্তেতে, ফ্যালকন গেলো ওর পেছন পেছন। জোভি, লিও, আর হাইনা এগোলো সোজা রাস্তায়। জিপিএস ট্র‍্যাকারে কোকোর দেওয়া লোকেশন টা লাল দাগে বিপ বিপ করে জ্বলছে। সেদিকেই এগোলো ওরা তিন জনে।

সাদা ধবধবে মেঝের এক কোণায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আলফাদ। হাত জোড়া পিঠ মোড়া করে বাধা৷ সমস্ত মুখ আর শরীর জুড়ে গভীর ক্ষত। জ্ঞানহীন আলফাদের ঠোঁটের কোণা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত৷
পাশেই কোকো কে সিলিঙের সাথে হাতে দড়ি বেধে ঝুলিয়ে ওর অনাবৃত উর্ধাঙ্গে শপাং শপাং শব্দ তুলে একের পর এক সজোর বাড়ি দিয়ে চলেছে দানব সাইজের কেউ একজন৷ প্রতিটা বাড়িতে কঁকিয়ে উঠছে কোকো। ব্যিস্ট স্কোয়াডস এর অন্যদের তুলনায় অত্যাধিক শক্তিশালি হওয়ায় এখনো টিকে আছে ও। কিন্তু আর পারছে না, শরীর টা অবশ হয়ে আসছে৷ চোখে অন্ধকার দেখছে ও। বিশাল শরীর টা নিস্তেজ হয়ে আসতে চাইছে। দানব সাইজের লোকটা ক্ষণে ক্ষণেই জিজ্ঞেস করছে ‘ বল তোকে কে পাঠিয়েছে এখানে’ কিন্তু কোকো নিরব, ওর মুখ থেকে একটা শব্দও কেউ বের করতে পারেনি।
মারের চোটে কোকোর জ্ঞানলোপ হওয়ার ঠিক আগ-মুহুর্তে কয়েকজন মানুষের সাথে সেখানে এসে উপস্থিত হলো ইলহান। ইলহান কে দেখা মাত্রই মার থামিয়ে দিলো দানব লোকটি।

— ও কিছু স্বীকার করেছে?
ইলহানের পাশে দাঁড়ানো ওর সেক্রেটারি লোকটি এতক্ষণ ধরে কোকোকে পেটাতে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো। সে লোকটি হাঁফাতে হাঁফাতে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো,
— নাহ বস! ওকে যে মাইর টা দিয়েছি তাতে অন্য কেউ হলে এতক্ষণ জন্মের আগের কাহিনীও বলে দিত! কিন্তু এর যেন গণ্ডারের চামড়া, মাইর যেন লাগেই না ওর গায়ে।
কোকো তখনও সেন্সলেস হয়নি। এদের কথা সব শুনলো ও। কিন্তু গণ্ডারের চামড়া চামড়া কথা টা শুনে ও ঝুলন্ত, রক্তাক্ত অবস্থাতেই নিভু নিভু কন্ঠে বলে উঠলো,

— এটা গণ্ডারের চামড়া নয়, এটা কুমিরের চামড়া।
তারপর দাঁত বের করে হাসলো। সমস্ত দাঁত জুড়ে লেগে থাকা রক্তের কারণে ওর সে হাসিটা ভয়ঙ্কর দেখালো। দানব সাইজের লোকটা নাক কুচকে তাকালো সেদিকে। ইলহানও শুনতে পেলো কোকোর কথা টা। এবার কোকোর কাছে এগিয়ে এলো ও৷ তারপর কোকোর ঝুলন্ত দেহের কাছে এসে ওকে কিছুক্ষণ পরখ করে জিজ্ঞেস করলো,
— ব্যিস্ট স্কোয়াডস! মীর পাঠিয়েছে তোকে?
কোকো নিভু নিভু চোখ জোড়া তুলে তাকালো ইলহানের দিকে, তারপর আবার দাঁত বের করে হেসে বলল,
— নাহ, আম্মা পাঠিয়েছে।
আম্মা শব্দটা শুনে ইলহান বিভ্রান্ত হলো কিছুটা, আম্মা পাঠিয়েছে মানে কি! কে এর আম্মা!
কোকো কে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তার আগেই শব্দ করে বেজে উঠলো ইলহানের পরণের ওভারকোটের পকেটে থাকা ফোনটি।
কোকোর দিকে দৃষ্টি রেখেই ইলহান পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে কানে ধরলো, তারপর ছোট্ট করে বলল,

— বলো৷
ওপাশের ব্যাক্তি টা হড়বড় করে বলে উঠলো,
— বস, আপনি যেমন টা বলেছিলেন তেমন ভাবে আমরা কুরো আহমারে আসা সব রাস্তা চেইক করছিলাম। শিরো মিদোরির পানিপথের দিক থেকে দুটো রয়্যাল ভাইপারক্রুজ আসতে দেখেছি। যদিও তারা একসাথে নেই। দুজন দুদিকে চলে গেছে, কিন্তু তবুও আপনাকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখলাম, যদি আপনার কোনো কাজে লাগে।
কলারের কথা শুনে ইলহান বাকা হাসলো, তারপর বলে উঠলো,

বাদশাহ নামা পর্ব ৩৯+৪০

— খুব কাজে লাগবে!
আর এরপর কল টা কেটে দিয়েই কোকো আর আলফাদ কে নির্দেশ করে দানব সাইজের লোকটার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— দুটোকেই শেষ করে দাও।

বাদশাহ নামা পর্ব ৪৩+৪৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here