বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪০

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪০
ইশরাত জাহান

দর্শনের গাড়ি বাড়ির সামনে থামতেই বাতাসে অদ্ভুত একটা চাপা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল।গাড়ি থেকে নামার পর হাতা গুটিয়ে নিল।চোখেমুখে হিংস্র দৃষ্টি,মনে হচ্ছিল আগুন জ্বলে উঠেছে তার ভেতরে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শামীম যেই দর্শনকে দেখে খুশি হয়ে কিছু একটা বলার জন্য এগিয়ে আসতেই দর্শন তাকে তোয়াক্কা করলো না।সোজা গিয়ে কুদ্দুসের কলার চেপে ধরে একেবারে নাকের ওপর গর্জে উঠল তার প্রথম ঘুষি।মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে বলে,“ঘরে নিজের বউ থাকতে,অন্যের বউয়ের দিকে এত নজর কেন?”

মুহূর্তেই রক্ত ঝরতে লাগল কুদ্দুসের নাক থেকে। দর্শনের ঘুষির পর ঘুষি,একটার পর একটা আঘাতে কুদ্দুস দম নিতে পারছে না।শোভার বুক ধড়ফড় করতে লাগল।মানুষটা বাঁচবে না তো এমন করলে।পরিবারের সামনে স্বামীর এমন রূপ দেখাতে চায়নি সে।অথচ দর্শন নিজেই হিংস্রতা উন্মোচন করল।
শোভা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে দর্শনের হাত আঁকড়ে ধরে কাঁপা কণ্ঠে বলল,“আপনি থামুন!এসব ঠান্ডা মাথায় মিটে যেতে পারে।কুদ্দুস ভাই আমাকে বোনের নজরে দেখে।বিপদের সময় ওরাই আমাদের পাশে থেকেছে।”
শোভার কথা যেন আগুনে ঘি ঢালল।দর্শন কুদ্দুসকে ছেড়ে এক ঝটকায় শোভার গলা চেপে ধরল।চোখ লালচে হয়ে উঠল তার।কর্কশ কন্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,“ভাই হয় তোমার?শামীম ভাইজানকে নিয়ে তো আমার কখনো রাগ ওঠেনা।কিন্তু যখন এই কুদ্দুস তোমার ভাইয়ের জায়গা নিতে আসে,তখন কেন আমার রাগ ওঠে?কারণ ও একটা পরপুরুষ।আমি তোমার জীবনে কোনো পরপুরুষের উপস্থিতি মেনে নেব না!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শোভার শ্বাস রুদ্ধ হতে লাগল।হিজাব আর গরমে ঘেমে ওঠা শরীর তার কষ্টকে দ্বিগুণ করছিল।শামীম ভয়ে কাঁপছে।কিছু বলতে পারছে না।দুর্বল কুদ্দুসও এগিয়ে এসে আটকাতে চাইলে দর্শন কনুই দিয়ে মেরে ফেলে দিল মাটিতে।পড়ে থাকা কুদ্দুসকে আবার কলার চেপে পেটাতে লাগল দর্শন।বেচারার সব নাকের উপর দিয়ে যাচ্ছে।কারণ ওখানেই তো তার বউ চুমু দিয়েছিল।যেটাকে চুমু বলে না বলে লালা দেওয়া।
কাশতে কাশতে শোভা শামীমের কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,“ভাইজান,কিছু একটা করেন! উনি তো পুরো হিংস্র হয়ে উঠেছেন।”

ঘরের ভেতর থেকে মিতু উঁকি দিয়ে সবকিছু দেখে দ্রুত পারুল বেগমকে ফোন দিল।সব শুনে পারুল বেগম প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলেন না।কিন্তু যখন দীপ্ত ফরাজিকে জানালেন,তখন তিনিই দৃঢ়ভাবে বললেন,“আমাকে নিয়ে চলো ওর কাছে।দর্শনের মাথায় নিশ্চয়ই কিছু জমে আছে,না হলে সে এত সহজে কাউকে আঘাত করত না।”
পারুল বেগম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“তাই বলে পশুর মতো মানুষকে মেরে ফেলবে?”
দীপ্ত কোনো উত্তর দিলেন না,শুধু তাড়াহুড়ো করে হুইলচেয়ারে বসে প্রস্তুত হলেন।পারুল বেগম তাকে বহন করে গাড়িতে উঠাচ্ছেন।উদ্দেশ্য শোভাদের বাড়িতে যাওয়া।
দর্শন দ্রুত এগিয়ে এসে শোভাকে নিয়ে বাইরে যেতে নিলে শোভা প্রশ্ন ছুঁড়ে,“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে।”
“আমার সাথে ঢাকায় যাবে।”

“না,আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।”
বলেই হাত ঝাড়া দিয়ে ছুটে আসে শামীমের কাছে।শামীমের পিছনে আশ্রয় নিয়ে কাপাকাপা কণ্ঠে বলে,“ভাইজান আমি যাবো না।আপনার কাছে আমাকে আশ্রয় দিন।”
শামীম নিজেও ভরসা পাচ্ছে না দর্শনকে।তাই পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বলে,“বোনকে কয়েকদিন এখানে থাকতে দিন ভাইজান।ভার্সিটি ভর্তির সময় নাহয় যাবে।”
গর্জে উঠল দর্শন।জানালো,“এসব অজুহাত আমাকে দেখাবেন না।”
এক ঝটকায় শোভার হাত ধরে টেনে আনল সামনে।শোভা কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,“আমি যাব না… ভাইজান,আমাকে বাঁচান!”

শামীম কিছু বলার আগেই দর্শন হুংকার ছেড়ে উঠল।কেঁপে উঠলো সবাই।অঘটন ঘটিয়ে দিলো কুদ্দুস।শোভাকে বাঁচাতে দেয়ালের গায়ে শুকোতে দেওয়া কয়েকটা লাঠি দেখে দুটো দুইহাতে নিয়ে আসলো।একটা লাঠি দিয়ে দর্শনের পিছন থেকে আঘাত করলো।মাথা নস্ট দর্শনের এমন আক্রমণে যেনো মাথা কাজ করা বন্ধ।শোভা তো আরো অবাক।চিৎকার করে বলে,“আপনার কি মাথা খারাপ কুদ্দুস ভাই?”
দর্শন পড়ে যেতে নিলেও পড়েনি।শামীম হাত ধরে নেয়।দর্শন হিসহিস করে তাকালো।দাঁত খিঁচে দর্শন পকেট থেকে বন্দুক বের করে সোজা তাক করল কুদ্দুসের দিকে।মুহূর্তেই সবাই জমে গেল বরফের মতো।
শোভার মাথা ঘুরে এল,শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল।পড়ে যেতে নিচ্ছিল,কিন্তু দর্শনের বামহাত তাকে আঁকড়ে ধরে রাখল।দর্শন হুকুমের সুরে বলে,“আমার বউকে আমি নিয়ে যাব,কারো বাপেরও ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর।”
শামীম কিছু বলতে নিবে দাঁত কিড়মিড় করে দর্শন বলল,“যে আমার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে লের,সে আজ লাশ হয়ে যাবে।”

শোভা অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল।চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন বলছিল,“আমি এমন জীবন চাইনি।”
মিতু ভয়ে আতকে উঠলো। মৌলিকে জড়িয়ে ধরে আছে।মেয়েটা না থাকলে বাইরে বের হতো কিন্তু বাচ্চা মেয়েকে এসব দেখাতে চায়না।বলা যায়না ওর মস্তিষ্কে কিভাবে চাপ সৃষ্টি হয়।দর্শন শোভাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছে।শামীম পিছনে পিছনে এসে অনুরোধ করেই চলেছে।দর্শন মানবতার জন্য চুপ করে শুনে নেয়।শামীমের প্রতি একটা আলাদা মায়া কাজ করে দর্শনের।তাই বেশি কথা বাড়াবে না।চুপচাপ শোভাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।শোভা ছটফট করতে থাকে।দর্শন যেই ওকে গাড়িতে বসিয়ে দেয় শোভা ছুটে ঘরের দিকে দৌড়তে নেয়।দর্শন এবার দরজার সাথে বেঁধে থাকা কাপড় শোকানো দড়ি খুলে নেয়।শোভার পিছনে এসে শোভার হাত মুচড়ে ধরে আবারও গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে মারে।শোভা আর্তনাদ করে ওঠে।শামীম অনুরোধ বাড়িয়ে দেয়।কোনোটাই কাজ হয়না দর্শনের।ও শোভার পা দুটো বেঁধে দিলো।অতঃপর শোভার হাত বেঁধে দিলো।শোভা মুখ মেলতেই দর্শন ধমকে বলে,“এবার কি চাও,আমি মুখটা বেঁধে দেই?”

শোভা ঠোঁটজোড়া এক করে চুপ করে থাকলো।ভয়ে শোভার বুক কাপছে।শামীম আশপাশ তাকিয়ে কয়েকবার অনুরোধ করে থেমে গেলো।বন্দুকের ভয় আবার দর্শনের অতি বাড়াবাড়ি করা কাজগুলোর জন্য।
দর্শনের গাড়ি চলে যেতেই দীপ্ত ফরাজির গাড়ি হাজির হলো।পারুল বেগম দ্রুত নেমে পিছনের দিকে চেয়ে বলেন,“দর্শন কোথায়?”
শামীম মাথা চেপে কান্না করে বলে,“ভাইজান হুমকি ধামকি দিয়ে নিয়ে গেছে।না জানি আমার বোনের সাথে কি করে!আমার বোন বাঁচবে তো?”
পারুল বেগম রাগ দেখিয়ে বলেন,“এসব কি কথা!দর্শন আর যাই হোক শোভার ক্ষতি করবে না।”
শামীম বলেই দেয়,“আমার সামনেই আমার বোনের গলা চেপে ধরেছে।”

পারুল বেগমের মুখে হাত।দীপ্ত ফরাজি জানালেন তাকে গাড়ি থেকে নামানোর জন্য।পারুল বেগম দ্রুত তাকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন।ভিতরে এসে একেক করে সব শুনলেন সবাই।সবকিছু শুনে দীপ্ত ফরাজি বলতে শুরু করেন,“দর্শনের মানসিক সমস্যা আছে।এটা আমি কাউকে এতদিন বলিনি।”
পারুল বেগম অবাকের সাথে বলে,“কি বলছো তুমি?”
দীপ্ত ফরাজি কুদ্দুসকে দেখে বলেন,“ওকে আমাদের গাড়িতে বসিয়ে দেও।ড্রাইভারকে বলো হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে।”
শামীম দ্রুত কুদ্দুসকে গাড়িতে বসায়।কুদ্দুসের পরিবারের কেউই কিছু জানে না।সবকিছুতে গেঞ্জাম সৃষ্টি না হওয়ায় কারো কানে কিছু পৌঁছালো না।শামীম ড্রাইভারকে সব বুঝিয়ে দিয়ে দৌড়ে আসে।পারুল বেগম বলেন,“এবার বলো।”

দীপ্ত ফরাজি পুরোনো কথা চিন্তা করতেই চোখ দিয়ে পানি ফেলান।তাও বলতে শুরু করেন,
“ফারহা আমার প্রাক্তন স্ত্রী ও দর্শনের বায়োলজিক্যাল মা।ওর একজনের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।প্রথমদিকে লোকটা ফারহার কাকাতো ভাইয়ের পরিচয়ে আমার সামনে এসেছিল।আমিও মেনে নেই।গ্রাম থেকে নাকি যশোরে চাকরির জন্য এসেছে।সব মেনে আমরা দুপুরে ও রাতের খাবার রান্না করে জবরুল আহমেদ মানে ওই লোকটার জন্য পাঠিয়ে দিতাম।প্রায় সময় ফারহা যেতো।একদিন আমি কাজের ছুটি নিয়ে দর্শনের স্কুলে যাই।উদ্দেশ্য বাবা ছেলে মিলে ফারহাকে সারপ্রাইজ দিবো।সেদিনই আমাদের চোখ থেকে কালো পর্দাটা সরিয়ে গেলো।ফারহা তার সেই পাতানো ভাইয়ের সাথেই পার্কে বসে নোংরা কাজে লিপ্ত হয়ে আবার হাসাহাসি করছে।দর্শন আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে বারবার বলেছিলো,‘আব্বাজান আব্বাজান ওই দেখো আম্মাজান।পঁচা কাজ করছে কেন?তুমি না বলো এসব ছবি দেখতে নেই।গুনা হয়তো।’

আমরা দর্শনকে বাজে সিনেমা বা নাটক দেখতে দিতাম না।তাই ও ওই বয়সে এটুকু জানে কোনটা নোংরা কাজ আর কোনটা ভালো কাজ।নিজের মাকে নোংরা কাজে দেখে ছুটে যায় দর্শন সেখানে।ফারহার হাত ধরে টেনে আনে। জবরুল প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরে ফারহাকে উস্কানি দেয়।ওহ!ওর চাকরির বেতন আবার বেশি ছিল।আমাদের তখন ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে।তো এটার সুযোগ নিলো দুজনে।ফারহা ওই মুহূর্তেই আমার থেকে তালাক চায়।আমি বলি,‘ছেলের মুখ চেয়ে ভালো হও।’
কাজে দিলো না।তবে ফারহাকে বাসায় আসতে হয়।ওর সার্টিফিকেট আমাদের বাড়িতে ছিল তাই।ওগুলো আর ওদের বাড়ি থেকে দেওয়া গহনা নিয়ে যেতে নিলে দর্শন পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিল,‘যেওনা আম্মাজান।ওগুলো পঁচা কাজ।ওগুলো ভালো না।আমরা আজকে ঘুরতে যাবো।আব্বাজান বলেছে।’

কোনকিছুতে ফারহা গলেনি বরং ওই সময় আমার ছেলেটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়।ইচ্ছা করে নাকি বাধ্য হয়ে জানি না।রাগ মাথায় প্রেমিককে চাওয়ার তাড়নায় এমনটা করেছে বেশ বুঝলাম।আমি ধমকে কথা বললে আমাকে ও আমার ছেলেকে অপমান করে।আমাদের হাসিহাসি মুখশ্রী থাকতো সর্বদা।দর্শন সবসময় মিলেমিশে থাকতো।ওইদিন থেকে ছেলেটার মুখের সেই বোকা হাসি কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।চোখ বেয়ে বেয়ে পানি।পানি শুকিয়ে গেলো কিন্তু ছেলেটা আমার এক্সিডেন্ট দেখে নিজেও অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল।ডাক্তার সুযোগ বুঝে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কড়া ডোজের ঔষধ দেয়।যেটা দর্শনকে খাওয়ালে দর্শন সত্যিই ঠিক হয় কিন্তু ওর মধ্যে উদ্ভট আচরণ দেখা দেয়।যেটা আমরা কেউই দেখিনি।”

দীপ্ত ফরাজি একটু থেমে সবাইকে দেখলেন।সবার চোখেই পানি।শামীম নিজেও কান্না করছে।মৌলি ঘুমে।মিতু ওকে বিছানায় রেখে এসেছে।মিতুর টিয়া রংয়ের হিজাব ভিজে গাঢ় রং ধারণ করা।বোঝাই যাচ্ছে সেও কান্না করেছে।দীপ্ত ফরাজি আবারো বলতে শুরু করেন,“এখানেই ঘটনা থেমে থাকেনি।ঘটনা ঘটেছে দর্শনের স্কুলেও।ফারহা চলে যাবার পর ও একটু অস্বাভাবিক থাকলেও লেখাপড়ায় মুখটা গুঁজে রাখতো সবসময়।আমার ছেলের রোল আগে দুই থাকতো।রোল এক হয় চেয়ারম্যানের নাতির।তো ওই সময় দর্শনের রেজাল্ট ভালো হয়।নতুন ম্যাম দর্শনকে না বুঝেই ভালো রেজাল্টের জন্য এক রোল দিয়ে দেয়।এটা নিয়ে চেয়ারম্যান স্কুলে গিয়ে ঝামেলা করে।

ওই চেয়ারম্যানের সাথে ওঠাবসা জবরুল আহমেদের।দুজনেই স্কুলে এসেছিল একসাথে।দর্শনকে তেমন কিছু বলেনি কিন্তু নতুন ম্যামকে হুমকি দেয়।নতুন ম্যাম বাধ্য হয়ে দর্শনকে রোল দুই দিয়ে দিলো।পুরো এলাকা জুড়ে জবরুল আহমেদ ও চেয়ারম্যান মিলে মিষ্টি বিতরণ করে।এটা অবশ্য একটা গা জ্বালানো কাজ ছিল মাত্র।আমাদের এলাকায় অনেকেই মানতে নারাজ হলেও মেনে নেয় নিজেদের সমাজে টিকিয়ে রাখার জন্য।দর্শন সহ্য করতে পারেনি।ওই যে কড়া ঔষধের প্রভাব!ওটাই কাজে দিলো।সবার সামনে রাস্তা থেকে ইট নিয়ে ছুঁড়ে মারে জবরুলের মাথায়।চিৎকার করে বলেছিল,‘প্রতারক,চোর,মিথ্যুক।আমার মাকে কেড়ে নিয়েছিস তোরা।এখন ক্ষমতা দেখিয়ে আমার রোল!আমি তোদেরকে ছাড়বো না।’

চেয়ারম্যানের লোক ওইদিন আমার ছেলেটাকে গাছের সাথে বেঁধে অনেক মারে।মারতে মারতে ওর পিঠের ছাল চামড়া ঝাঁঝরা করে দেয়।মাথায় কয়েকবার লাঠি দিয়ে মেরেছে অব্দি।আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবার পায়ে ধরি।আব্বাজান আর আম্মাজান সবার পায়ে ধরে অনুরোধ করেও থামাতে পারল না।ওই সময় আমার আম্মাজান স্ট্রোক করে মারা যান।আম্মাজানের মৃত্যুর কারণেই ছেড়ে দেওয়া হয় দর্শনকে।ছেলেটা অজ্ঞান থাকে টানা তিনদিন।ওর দাদীজানের মৃত্যুর মিলাদ শেষ হবার পর ওর জ্ঞান ফিরল।হাসপাতালের বিছানায় বসে বারবার বলেছিলো,‘আমি ওদেরকে খুন করবো।’

আব্বাজান ওখানে ছিলেন না।আম্মাজানের কবরের কাছে পড়ে থাকতেন বেশিরভাগ সময়।এই সুযোগে আমি দর্শনের সমস্ত ব্যাপার বুঝে নিলাম।গোপন করি আব্বাজানের থেকেও।ডাক্তার তখন জানায়,‘আপনারা এই কয়দিন যে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন সে আপনার ছেলেকে ভুল ঔষধ দিয়েছে।বয়সের তুলনায় কড়া ডোজের ঔষধ। এতে ছেলেটার আরো বেশি ক্ষতি হয়েছে।ওর মস্তিষ্কে চেপে গেছে খুনের তাড়না।ছেলেটা নিজেই বাঁচবে কি না গ্যারান্টি নেই।কারণ ওর শরীরের ঔষধ ওকে আপাদমস্তক ক্ষতি করে দিচ্ছে।’

ডাক্তারের সাথে আরো কিছু কথা বলে ঢাকায় ভালো চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেলাম।আমাকে তখন সাহায্য করে আমার কাকা।উনি বরিশাল থেকে এসে আমাদের ঢাকায় নিয়ে যায়।দর্শনকে ওখানে ভর্তি করায়।দর্শনের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।ওই সময় আশার আলো হয়ে আসলো তুহিন।ওই ছেলেটা আমার ছেলেকে রক্ত দেয়।রাত দুইটায় ওই আমাদের শুভাকাঙ্খী ছিলো।এরপর ওদের দুজনের বদ্ধুত্ব হলো।দর্শনকে ইচ্ছা করে আমি ঢাকায় ভর্তি করিয়ে আসি।ওই জবরুলের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি।কিন্তু সবকিছু ঠিক হলেও ঠিক হয়নি দর্শনের রাগ,হিংসা ও জেদ।ও ওই সময় থেকেই নিজের মধ্যে একটা জিনিসই গেঁথে রেখেছে,‘যেটা আমার সেটা আমারই।কেউ সেই জিনিস কেড়ে নিতে চাইলে তাকে শেষ করে দিবো।’
দীপ্ত ফরাজি হঠাৎ ডুকরে উঠলেন।পারুল বেগম এগিয়ে এসে তার বুকে হাত রেখে মিতুর উদ্দেশে বলেন,“বউমা এক গ্লাস পানি দেও।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩৯

মিতু পানি এনে দিতেই দীপ্ত ফরাজি পানি পান করেন।তারপর কান্না কন্ঠেই বলেন,“আমার ছেলের সাথে অন্যায় না হলে,প্রতারণা না হলে ও এতকিছু শিখতো না।আসলে আমার বোকা ছেলেটা নিজেকে এমন পরিবর্তন করেছে যে ওর মনোভাব কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না।যখন যেটা সঠিক মনে করে ওটা সঠিক থাকবেই।কেউ পরিবর্তন করতে আসলে তার জীবনটাও ঝুঁকিতে থাকে।তুহিন ওকে সামলে চলে।ছেলেটা যশোরে খুব কম আসে তবে একবার কি দুইবার দর্শনের জন্য এসেছিল।দর্শনকে যেনো রন্ধে রন্ধে ওই একজনই চিনেছে।সবসময় সাথেই সাথে ছেলেটার।অথচ স্কুল জীবনে যখন মাহারা হলো তখন কত অভিবাবক ওকে কটু কথা শুনিয়েছে।একদম শেষ করে দেয় আমার ছেলেটার মনোভাব।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here