বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৫

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৫
ইশরাত জাহান

রাত ১১টা।খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।শোভা নিঃশব্দে দর্শনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।হাত কাঁপছিল তার।সে জানে এই ঘরে পা রাখলেই আবার তাকে অপমানিত হতে হবে।দাদাজান ও পরিবারের কথা ভেবে সে দরজার কড়া নেড়ে ধীরে ধীরে খুলে ঢুকে গেল।দর্শন বিছানায় বসে ছিল। শোভাকে দেখেই ঠান্ডা গলায় চোয়াল শক্ত রেখে বলল,“তুমি কি আমার কথার মানে বুঝোনি? বলেছিলাম এই ঘরে পা দেবে না।দিজাকে তো জানালাম তোমাকে ওর ঘরে থাকতে দিতে।”

শোভা চোখ নামিয়ে নেয়।অপমান লাগছে মনে মনে কষ্ট হচ্ছে।ভাবছে ভাই ভাবির টানাপোড়া সংসারে ঝামেলা না হলে এখানে থাকতই না।কোনরকমে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,“দাদাজান যদি জিজ্ঞেস করেন আমি আলাদা ঘরে কেন?তখন কী বলব?”
দর্শনের চোখে ব্যঙ্গাত্মক।সে চুপচাপ দেখলো শোভাকে।মুখ দেখা যাচ্ছেনা আবারও সেই হিজাব দেওয়া মুখ।রাগান্বিত হয়েই বলে,“তুমি এত অভিনয় করো কিভাবে?চার বছর আগে থেকে দেখছি নিজেকে শান্ত রাখার নাম করে কিভাবে আমার জীবনে আসলে।সেদিন আমার একার মুখ খুলেছিল কিন্তু তুমি ঢং করে ভাবীর পিছনে গুটিয়ে ছিলে।ভদ্রতার কি নিখুঁত অভিনয়!আজকে আবার দাদাজানের দোহাই দেও।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শোভা শান্ত কণ্ঠে বলল,“আমি কোনো অভিনয় করিনি।শুধু ভয়ে গুটিয়ে ছিলাম।ওমন বাজে পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।আপনি বুঝবেন না আমার কষ্টটা কিন্তু আমিও নিরুপায় ছিলাম।মুখ খোলার সাহস থাকা লাগে,যেটা আমার ছিল না।”
দর্শন পেছন ঘুরে বলল,“আমি এখনও তোমাকে মেনে নিতে পারছি না।এই চারটে বছর বাইরে ছিলাম একবারও তোমার কথা মাথায় আনিনি।প্রথমদিকে যদিও একটা ট্রমা ছিল কিন্তু ব্যস্ততায় সব ভুলে গেছি।আমি বৈবাহিক সম্পর্কে বিশ্বাসী না।এটাও বিচ্ছেদে রূপ নেয়।আজ সুখ তো কাল নদীর স্রোতে ভরে যায় অশ্রু।সম্পর্ক যেহেতু মানতে পারছি না আমাদের ক্লোজ হওয়াটা সম্ভব না।তুমি যেখানে খুশি ঘুমাও।কিন্তু আমার পাশে না।”

শোভা কিছু ভেবে বলল,“ঠিক আছে।”
সে ধীরে ধীরে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল একটি বালিশ নিয়ে।সেখানে রাখা একটা পাতলা চাদর মেলে নিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।চোখে পানি নেই আছে কেবল অব্যক্ত স্তব্ধতা।দর্শন পেছনে তাকায় না।এমনকি একবারও দেখেও না মেয়েটা কোথায় ঘুমাচ্ছে।

ঘড়ি যখন রাত ২টার কাঁটা ছুঁয়েছে দর্শন উঠে দাঁড়ায়।তার গলা শুকিয়ে গেছে।সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।ভাবছে দাদাজানকে বলে দ্রুত দুজনে মুক্তি নিবে।হঠাৎ এক গ্লাস পানি খেতে গিয়ে চোখ পড়ে যায় ব্যালকনির দরজার দিকে।চাঁদের আলোয় শোভার ঠোঁটের নিচে তিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।দরজার দিকেই মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।চোখের উপর দিয়ে নাক পর্যন্ত ওড়না দেওয়া যেনো ল্যাম্পষ্টের আলোয় অসুবিধা না হয়।একটি নির্বাক অসহায় মুখ কিন্তু সম্পুর্ণ দেখার সুযোগ মেলেনি।চায়ও না এমন সুযোগ।দর্শন বিছানায় শুয়ে পড়ে।চোখ বন্ধ করলেও ঘুম আসে না।ভাবছে,“মুক্তি দিতে চাই তাই বলে শাস্তি না।কালকেই মেয়েটাকে নিয়ে পরিবারের সামনে কথা বলতে হবে।ডিভোর্সের ব্যাপারটা জানাতে হবে।একমাস আমার জন্য কোনমতে কাটলেও মেয়েটার জন্য কষ্টকর হবে।”

ফজরের আযানের সাথে ঘরে খটখট শব্দ বাড়ল।মাত্রই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দর্শন।এরমধ্যে হঠাৎ এমন শব্দ কানে আসায় বিরক্তিতে চোখ খুললো।পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।চামড়ার জুতার সাথে মেঝেতে বারি খেলে নিস্তব্ধ পরিবেশে যেমন লাগে আর কি।মাথা উঁচিয়ে পিছন ফিরতেই দেখে শোভা কিছু খুঁজছে।দর্শন মনে মনে বলে,“মেয়েটা চোর নাকি?মতলব কি খারাপ কিছুর!এজন্যই হয়ত আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে আমার ঘরে আছে।”
শোভা অস্বস্তির সাথে কিছু একটা খুঁজতে থাকে।রাতের আধারে অবয়ব দেখে বুঝতে পারছে না দর্শন।অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর দর্শন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,“কি করছো তুমি?”
শোভা কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে।দর্শন যখন দেখে শোভার মেরুদণ্ড সোজা হয়েগেলো ধরে নিলো এই মেয়ে কোনো মতলবেই আছে।নাহলে হঠাৎ ভয় পাবে কেন?দর্শন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,“মতলব কি তোমার?আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম তুমি…

“জায়নামাজ আর একটা গামছা খুঁজছিলাম।আযান দিচ্ছে নামাজ পড়তে হবে।”
শোভার নমনীয় আচরণ।শুনে দর্শন থমকে গেলো।বিবেগ জাগ্রত হলো।মেয়েটা নামায পড়ে।ঘড়ির দিকে চোখ রেখে দেখে আযান দিয়েছে পাঁচ মিনিট মত হবে।দর্শন জানায়,“ওযু করে আসো আমি ওগুলো বের করে দিচ্ছি।”
শোভা বাক্য ব্যয় না করে চলে যায়।দর্শন গামছা আর জায়নামাজ বের করে রাখে।শোভা আসতেই বলে,“সোফায় রাখা আছে ওগুলো।”
বলেই যেই বিছানায় এক হাঁটু রাখতে নেয় শোভা বলে,“আপনি নামায পড়েন না?”

দর্শনের পা থেমে গেলো।আজকালকার আধুনিক সময়ের যুবক।নিজের মত জীবন যাপন করতে গিয়ে নামাযকে গুরুত্ব দেয়নি।পড়ে শুধু জুম্মার।শোভা বুঝলো লোকটার ইগো হার্ট করা যাবে এই সুযোগে।তাই বলে,“কবরে গেলে হিসাব দিতে হবে।আমার দায়িত্ব বেনামাজিকে সতর্ক করা।আপনি যদি নামায পড়ে ঘুমান।তাহলেই ভালো হয়।”
শোভা আর দাড়ালো না।নিজের মত জায়নামাজ বিছিয়ে নামায পড়ে।দর্শন কিছুক্ষণ চিন্তা করে উঠে দাঁড়ালো।চলে গেলো ওযু করতে।বাইরে এসে টুপি মাথায় দিয়ে বের হয়।দীপ্ত ফরাজি নামায পড়ছেন নিজ ঘরে।পুরুষ মানুষের নামাযের দোয়াগুলো জোরেই পড়ে।দর্শন শুনতে পায়।লোকটা হাঁটতে পারেনা তাই বাসায় নামায পড়ে।হাঁটতে না পারার কারণ দর্শনের নিজের মা।তিনি ছেড়ে দেবার প্রস্তাব রাখার পর রাস্তায় অনেক ঝামেলা হয়।এর মাঝেই এক্সিডেন্ট হয় দীপ্ত ফরাজির।ট্রাকের চাকা সোজা তার দুই পায়ের হাঁটুর উপর দিয়ে পিষে যায়।দর্শন তখন থেকেই ধারণা করে নিয়েছে জীবন সঙ্গীর ধোঁকার থেকেও একেকটা তিক্ত বুলিতেই জীবন ধ্বংস করে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মত মসজিদে গেলো।

নামায পড়ে মাত্র বাসায় ফিরলো দর্শন।টুপি খুলে হাতে নিলো।উষ্কখুষ্ক চুলগুলো হাত দিয়ে নারা দেয়।পারুল বেগম চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন।দর্শনকে দেখে তিনি অবাক।ছেলেটাকে কখনও দেখেনি নামাযে যেতে।এমনি শুনেছে নামায পড়ে।দিদার এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন।নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় বলেন, “কাল থেকে দিদারকেও নিয়ে যাবি।ও আমার অবাধ্য হয়েছে অনেক।একটু শাসন করলেই আব্বা থামিয়ে দেয়।তুই শাসন করলে কেউ কিছু বলেনা।”
দর্শন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,“আচ্ছা।”
একটু থেমে পারুল বেগম জিজ্ঞাসা করেন,“কিছু খাবি?”
“নাহ,এখন একটু ঘুম দিবো।”
“আচ্ছা যা তাহলে।”
দর্শন চলে যেতেই পারুল বেগম মুচকি হেঁসে ঘরে ঢুকে বলেন,“আমাদের ছেলের পরিবর্তন হচ্ছে গো।”
“কোনটার কথা বলছো?”

“বড়টার কথা বলছি।নামায পড়ে আসতে দেখলাম।আমি বলে দিয়েছি কাল থেকে যেনো ছোটটাকে নিয়ে যায়।”
“ভালোই করেছো।বড় ভাই সঠিক রাস্তায় থাকলে ছোট ভাই আপনাআপনি সঠিক হয়ে যাবে।যে টাইট দিবে দর্শন!তাতে ভালো না হয়ে উপায় নেই।”
“এই সব কিন্তু বড় বউমার জন্যই সম্ভব হলো।”
“আসলেই,মেয়েটা আসতে না আসতে কত ভালো একটা সকালের দেখা পেলাম।এমন সকালবেলা পেলে কতই না ভালো লাগে।ছেলে মেয়ে উঠবে,সকালের বাতাস গায়ে মাখবে।ওদের দিনটাও ভালো যাবে।”
“সব ঠিক হবে দেখে নিও।”

“ছেলেটা তোমাকে দেখে বুঝতে পারল না যে সব নারী এক না।”
দীপ্ত ফরাজি আফসোস করে বললেও লাজুক হাসলো পারুল বেগম।তারপর বলেন,“অন্যের দেওয়া ধোঁকা কখনও গায়ে লাগেনা।নিজের কাছের কেউ ধোঁকা দিলে ওটাই বেশি গায়ে লাগে।আমিও তো ছোটবেলায় মাকে হারালাম দর্শনের মতোই।আমারও কিন্তু মনে মনে মাকে নিয়ে আক্ষেপ আছে।দর্শনের মধ্যে একটা আলাদা ভীতি তৈরি হয়েছে।ও কিন্তু মাঝে মাঝে প্যানিক এটাকে ভোগে।কাছের লোকেদের হারানোর ভয় আছে ওর।তাই ওকেও একটু সুযোগ দেওয়া উচিত।ওর রাগকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে কন্ট্রোলে আনতে হবে।সবকিছুই তুড়ি মেরে ঠিক করা যায়না।সময় নিয়ে ঠিক করতে হয়।”

দীপ্ত ফরাজি হাসলেন।প্রথম বউকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেন।কি রূপ ছিলো তার!সুন্দরী রমণী পেয়ে নিজেকে তার আঁচলে বেঁধে রেখেছিলেন।তারপর কি হয়ে গেলো!তবে আল্লাহ ভালো কিছুই লিখে রেখেছিলেন তার জন্য।এই পঙ্গু হয়ে বৃদ্ধ বয়সে নিজের জীবনে ভালো বউ পেলেন।সুন্দরী বউ যে তার সেবা করা তো দূর এক গ্লাস পানিও দিতো না।পারুল বেগম সুন্দরী না এটা বললে সম্পুর্ণ ভুল হবে।তিনি সুন্দরী কিন্তু তফাৎ হিসেবে স্মার্ট মেয়েদের মত না।সংসার জীবনে শুধু সাজগোজ বলতে তার লম্বা চুলের খোঁপা আর শাড়ি পরা দেখেছেন দীপ্ত ফরাজি।এতেই মায়া লাগে তার মনে।শখ করে কখনও লিপস্টিক পড়েনি সংসারের সব দায়িত্ব নিজে পালন করেন।দীপ্ত ফরাজি অনেক কিছুই কিনে দেন কিন্তু পারুল বেগম বলেন,“আমাকে কি এভাবে ভালো লাগেনা দেখতে?”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪

কথার পিঠে দ্বিমত জানান না।বরং প্রথম বউয়ের জন্য আনা থেকে যে অভ্যাস ওটা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন।পারুল বেগম চা পান করছেন আর দীপ্ত ফরাজি বিছানায় হেলান দিয়ে দেখছেন।তার হাতেও চায়ের কাপ আছে।পারুল বেগমের যত্ন তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here