বিকেলের প্রণয় পর্ব ৩

বিকেলের প্রণয় পর্ব ৩
Arshi Ayat

পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো অনুরুপ।প্রায় দৌড়ে এসে মিলাতের হাত চেপে ধরলো।পেছন ফিরে অনুরুপকে দেখে নিরুত্তাপ গলায় মিলাত বলল,’আমাকে যেতে দিন ডাক্তার।এইরকম অভিশপ্ত জীবন আমি চাই না।’
‘পাগলামি করবেন না।আসুন আমার সাথে।’অনুরুপ জোর দিয়ে বলল।
মিলাত কথা বাড়ালো না।অনুরুপের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।অনুরুপ বুঝলো এভাবে হবে না।আচমকাই মিলাতকে কোলে তুলে নিলো সে।ঘটনার আকষ্মিকতায় মিলাত খানিক সময়ের জন্য চুপ হয়ে গেলো।তবে হুশ ফিরতেই ছটফট করতে লাগলো।পাগলামির মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে।উন্মাদের মতো নিজের জীবনের বিনাশ চাইছে।তবে নিজে অনড় থেকে পরিস্থিতি সামলে নিলো অনুরুপ।ছাঁদ থেকে বের হয়ে নিচে নিয়ে এলো মিলাতকে।ওকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা গেছে বলে সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।মেয়েকে বাঁচানোর জন্য মিলাতে বাবা,মা অনুরুপের প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ।মিলাতকে আবারও ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হলো আর ওর বাবা,মায়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে গেলে মিলাতকে মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করা হবে।

দুপুরের খাওয়া শেষে রেভান নিজের ঘরে গেলো একটু বিশ্রাম নেবে বলে।বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে সাইফুলসহ পুরোনো বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেবে অনেকদিন পর।বন্ধুদের মধ্যে সিংহভাগই বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেছে।তাই আগের মতো এখন আর দেখা,সাক্ষাৎ,আড্ডা কোনোটাই হয় না।তবে জীবনে কঠিন একটা ছ্যাঁকা খাওয়ার পর এখন আর বিয়ের প্রতি মন আসে না ওর।তাই পারিবারিক চাপ থাকারও পর বিয়েতে তেমন একটা আগ্রহ নেই।
বিছানায় কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাচ্ছে সাইফুল।তাতে অবশ্য ভালোই হলো।নিরিবিলিতে সাজগোছ করা যাচ্ছে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুন করে মেকআপ করছে চৈতি।এই সাজ সাইফুলের জন্য নয়।অবশ্য কোনোদিনই ও সাইফুলের জন্য সাজে না।নিজের জন্য সাজে কেবল তবে আজ একটা বিশেষ মানুষের জন্য সাজছে।শিফনের নতুন শাড়ি,বাহারি কাঁচের চুড়ি,নতুন ঝুমকা জোড়া,ভ্রু যুগলের মাঝে কালো টিপে অনন্য লাগছে ওকে।সাজগোছ শেষে নিজের দিকে মুগ্ধ চোখে একবার চেয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো ও।রেভানের রুমের সামনে এসে কড়া নেড়ে বলল,’আসতে পারি?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আধশোয়া হয়ে ফোনে গেইম খেলছিলো ও।চৈতির গলায় স্বরে শুনে উঠে বসলো।গেইম অফ করে বলল,’জ্বি,ভাবি আসুন।’
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো চৈতি।কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’আসলে এই ঘরের বারান্দায় আমার কিছু প্রিয় ফুল গাছ আছে।ওগুলোতে পানি দিতে এসেছি।’
‘জ্বি,নিশ্চয়ই।’
রেভান সৌজন্যসূচক উত্তর দিয়ে আবারও গেইম খেলায় মনযোগ দিলো।চৈতি ওর দিকে তাকিয়েই বারান্দায় আসলো।যতোটা খুশি মন নিয়ে এসেছিলো এখন ততটাই রাগ হচ্ছে।এই রুপে সকল পুরুষ দিওয়ানা হয়,প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় কিন্তু এই পুরুষটি একেবারের বেশি তাকালোই না।ওর চোখে কি সৌন্দর্য ধরা পড়ছে না?প্রচন্ড আত্মসম্মানে লাগলো চৈতির।এই পুরুষটিকে যেকোনো উপায়ে নিজের করেই ছাড়বে ও।বারান্দায় দাড়িয়ে এসবই ভাবছিলো চৈতি।হঠাৎই সাইফুলের গলার আওয়াজ পেয়ে গাছে পানি না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসলো।যদিও গাছে পানি দেওয়াটা উদ্দেশ্য ছিলো না।আর এগুলো মোটেই ওর পছন্দের গাছ না।এগুলো তো মিলাতের পছন্দের ছিলো না।ভেবেছিলো ফেলে দেবে কিন্তু এভাবে কাজে আসবে ভাবে নি।থাক,যতদিন রেভান আছে ততদিনের জন্য একটা বাহানা হয়ে।

ছলনাময়ীর রুপে আরও একবার মজিলো বোকা পুরুষ।ঠোঁটের কোণে এক টুকরো অহং মিশ্রিত হাসি ঝুলিয়ে চৈতি মনে মনে বলল,’দেখ,মিলাত।তোর স্বপ্নের পুরুষ যে তোকে ছাড়া কিছু বুঝতো না সে প্রতিদিন আমার রুপে পাগল হয়।তুই হেরে গেছিস।এভাবেই তোকে সব জায়গায় হারাবো আমি।তোর সবকিছু এভাবেই ছিনিয়ে নেবো।প্রচন্ড কষ্টে তুই যখন নিথর হয়ে পড়ে রইবো তখন আমি শান্তি পাব।’
সাইফুলের কোলে বসে এসবই ভাবছিলো চৈতি।অপরদিকে স্বামীর মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসার কথা কিছুই কানে ঢুকছে না ওর।

বিকেলে ড্রইং রুমের আড্ডায় গরুর দুধের ঘন চা আর নিমকি বানানো হলো।চৈতি ভেবেছিলো রেভানের কাছে থেকে প্রশংসা পাবে কিন্তু রেভান নাস্তা ছুঁয়েও দেখলো না।কারণ সে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া,তেল,মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খায়।আর চায়ের ক্ষেত্রে চিনি ছাড়া রঙ চা আর গ্রীন টি।এসব শুনে চৈতির প্রচন্ড মন খারাপ হলো।এত আগ্রহ নিয়ে যার জন্য বানালো সে খেলোই না।অপরদিকে সাইফুল নিজেরটা তো খেলোই সাথে রেভানের ভাগেরটুকুও খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিত্যদিনের মতো স্ত্রীর প্রসংশায় মাতলো।
রাত আট’টার রুটিন চেক-আপে আসলো অনুরুপ।মিলাতের এখন জ্ঞান আছে।সে শূন্যদৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে।অনুরূপ জিজ্ঞেস করলো,’কেমন আছেন?কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে?’
মিলাত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো অনুরুপের দিকে।ম্লান হয়ে যাওয়া ধীমি স্বরে বলল,’আমকে বাঁচালেন কেন,ডাক্তার?’
‘কারণ মরে যাওয়া কোনো সমাধান নয়।বেঁচে থেকেই জীবনের সমস্যার সমাধান খুঁজতে হয়।’
‘কিন্তু আমার তো বাঁচতেই ইচ্ছে করছে না।’

অনুরুপ চেয়ার টেনে ওর পাশে বসে বলল,’আমি জানি না আপনার জীবনে কি ঘটেছে।কিরকম পরিস্থিতিতে আপনি যাচ্ছেন তবে আমি এতটুকু বুঝতে পারছি আপনি বড় কোনো ধরনের আঘাত পেয়েছেন।দেখুন,জীবন কখনোই সমান্তরাল না।দুঃখ,কষ্ট আসবেই তাই বলে থেমে যাওয়া যাবে না,হেরে যাওয়া যাবে না।’
‘কিন্তু আমি তো হেরেই গেছি।’
‘না,আপনি হারেন নি।প্রতিদিন নিজের সব দুঃখ,কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার মতো স্বার্থকতা আর হয় না।বেঁচে থাকাই জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা।’
একটু থেমে অনুরুপ আবার বলল,’মা,বাবাকে কষ্ট দিয়েন না।আপনার জন্য তারা পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন।’
তারপর চেক-আপ শেষে চলে গেলো অনুরুপ।

বিকেলের প্রণয় পর্ব ২

রেভান আর সাইফুল রাত দশটায় বাসায় ফিরলো।চৈতি ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।ওরা ফিরতেই বলল,’হাতমুখ ধুয়ে খেতে আসুন আপনারা।’
রেভান চৈতিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’আমি আড্ডায়ই খেয়ে এসেছি ভাবি।সাইফুল তেমন খায় নি।ওকে খাবার দিন।আমার ক্লান্ত লাগছে।আমি একটু ঘুমাবো।’
এই বলেই রেভান চলে গেলো নিজের ঘরে।রাগে ফুঁসছে চৈতি।এভাবে হচ্ছে না।তাই ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নিলো ও।আজ রাতে রেভানকে নিজের করেই ছাড়বে।বেশি অপেক্ষা আর সহ্য হয় না ওর।

বিকেলের প্রণয় পর্ব ৪