বিয়ে থা পর্ব ৩৭
তাহিনা নিভৃত প্রাণ
শিলিগুড়ির একটি হোটেলে উঠেছে তারা। ধ্রুব একহাতে ট্রলি ও অন্য হাতে নিনীকার এক হাত চেপে ধরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ট্রলি সাইডে রেখে ঠাস করে বন্ধ করে দিলো দরজা। নিনীকার ধরে রাখা হাত টেনে নিজের কাঁধে রাখলো। কোমড়ে হাতের শক্ত বাঁধন স্থাপন করে অপলক তাকিয়ে রইলো।
‘ আমি কিন্তু এসেছি, তুমি কি এবারও বলবে না মিসেস? ‘
নিনীকা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। দুজনের দৈহিক স্পর্শ গাঢ় হচ্ছে। ধ্রুব চোখে অন্ধকার দেখলো। টেনে নিয়ে ফেললো নরম বিছানায়।
এর আগে নিনীকা এমন এগ্রেসিভ হয়েছে কি না বুঝতে পারছে না ধ্রুব। আজকের সবটুকুতে নিনীকা ভীষণ শক্ত ছিল। ধ্রুব দূর্বল হলেও টেনে আবার ঠিক করে নিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছে বার-বার। ধ্রুব আজ যেনো এক নতুন নিনীকাকে দেখেছে। কেমন অস্বাভাবিক আচরণ! স্বাভাবিক মানুষের দৈহিক চাহিদা কখনো এরূপ হয়না। দূরত্বের পর কাছাকাছি এলেও না! ধ্রুব মুখ তুলে নিনীকার ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে তাকালো। বন্ধ চোখজোড়া, গালে শুকিয়ে যাওয়া জলের চিহ্ন। মোমের মতো শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে যেনো। ধ্রুব তো এমন চায়নি! তবে কেন নিনীকা ইচ্ছে করে নিজেকে এতোটা তুলে ধরলো। ওর কি কোনো প্রব্লেম আছে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ধ্রুব মাথা চেপে ধরলো। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে সব। নিজের শরীরের অবস্থাও ভালো না। নিনীকা নিজেকে ছিন্নভিন্ন করার পথ তৈরি করার সাথে সাথে ধ্রুবকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
এতো ডার্ক বিষয় নিয়ে ধ্রুব কখনো ভাবেনি। তবে আজ ভাবতে হচ্ছে। নিনীকার বড়ো হওয়া স্বাভাবিক নয়। চিন্তা ভাবনাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ধ্রুব ওকে যখন হলে রেখে গেছে তখন স্বাভাবিক ছিল। এতো উত্তেজিত, চেহারার এই হাল কিছুই আগে ছিল না।
নিনীকা ফোনে স্বীকার করেছিল রাত জাগে। কেন! ধ্রুবর জন্য? কিন্তু ধ্রুব তো প্রতিদিন ফোন করে খুঁজ নিতো। দৈহিক ভাবে দূরত্ব থাকলেও মন তো সবসময়ই দুজনের কাছে দুজনের পড়ে থাকতো। নিনীকার এই হালের জন্য দায়ী কি শুধু দৈহিক দূরত্ব? নাকি সাথে আরও কিছু একটা রয়েছে যা ধ্রুব ধরতে পারছে না।
ধ্রুব অসহায় চোখে তাকালো। কি এমন কারণ থাকতে পারে। কি হতে পারে। যা সে মিস করে যাচ্ছে। তার মিসেসের গুরুতর কোনো প্রব্লেম হয়েছে, নাহলে এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন করবে!
ধ্রুব শরীরে প্যান্ট চাপিয়ে ওয়াশরুমে ছুটলো। একেবারে গোসল করে বের হয়ে নিনীকাকে ওই অবস্থাতেই কোলে নিয়ে শাওয়ারের নিচে ছেড়ে দিয়ে আসলো। নিনীকা নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলো। ধ্রুব একটু শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ চুপচাপ গোসল করে বের হও। আমি ড্রেস বের করে দিচ্ছি। ‘
নিনীকা বের হলো কাঁপতে কাঁপতে। ধ্রুব বিছানা ঠিকঠাক করে ফেলেছে। নিনীকাকেও কাঁথার তলে ঢুকিয়ে দিলো। নিজে আধশোয়া হয়ে থাকলো। মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো।
‘ ঘুমাতে চেষ্টা করো। ‘
নিনীকা মুখ বের করে তাকালো।
‘ অনেক কষ্ট হচ্ছে। ‘
ধ্রুব অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ এতো এগ্রেসিভ হলে কেন? নিজেও ডুবলে আমাকেও ডুবালে। একটু সহ্য করো, আমি বের হয়ে খাবার ও ঔষধ নিয়ে আসছি। খবরদার এই অবস্থায় বের হয়ে যেও না। ‘
ধ্রুব উঠে দরজা পর্যন্ত যেতেই নিনীকা ডেকে উঠলো।
‘ ওয়ালেট তো নিয়ে যাও। ‘
ধ্রুব বের হতে গিয়ে ও ফিরে এলো। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে হেসে ওয়ালেট নিয়ে বের হয়ে গেলো।
নিনীকার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। নিজের উপর ঘৃণা হতে লাগলো প্রচন্ড ভাবে। এটা তার কি হলো!
নিনীকার বুক খা খা করছে। এতো একাকিত্বে সে কখনো ভুগেনি। বিগত কয়েকদিন যাবত সে মারাত্মক ডিপ্রেশনে কাটিয়েছে। আজকের এসব যদি ডিপ্রেশনের প্রভাবে হয় তো তাকে এমন ভয়ংকর ডিপ্রেশন থেকে বের হতে হবে। ধ্রুবকে বলতে হবে।
নিনীকার কন্ঠরোধ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস অস্বাভাবিক। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরলো। তার নিজেকে কোনো মানসিক রোগী মনে হচ্ছে!
ধ্রুব ফিরে যখন রুমে ঢুকলো তখন হাতের খাবার গুলো নিচে পড়ে গেলো। নিনীকা দরজা খোলার শব্দে চমকে হাত থেকে ছু*রি ফেলে দিলো। ধ্রুবের চোখে অবিশ্বাস। দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। নিনীকা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ধ্রুবর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো জল।
দীর্ঘ এক ঘন্টা ওভাবেই বসে ছিল তারা। নিনীকা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধ্রুব দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তাকিয়ে আছে। চোখমুখ শক্ত করে রাখার কারণে ব্যথা অনুভব করছে।
দীর্ঘক্ষণ পর চোখ ফিরিয়ে নিনীকার দিকে তাকালো। তাকিয়ে থাকলো অপলক। এক মিনিট দু মিনিট করে দশ মিনিট অতিক্রম হলো। আস্তে করে নিনীকার মাথা রাখলো বালিশে। উপরে নিজের দীর্ঘকায় শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। সে টের পেলো তার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে।
ধ্রুব নিজেকে শান্ত করলো সময় নিয়ে। ঘুমন্ত নিনীকাকে টেনে তুললো। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তোমার থেকে এরকম কিছু আমি আশা করিনি মিসেস। এরকম একটা পথ বেছে নেওয়ার আগে আমার কথা মনে পড়েনি? ‘
নিনীকা মাথা নিচু করে রইলো। ধ্রুব ফের বলল,
‘ তুমি আমাকে ভালোবাসোনি কখনো, বাসলে আজ এমন করতে পারতে না। তুমি খুব ভালো করেই জানতে আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। তুমি অবুঝ নও, তুমি এতোদিনে বুঝোনি? তুমি না থাকলে কারো জীবন থেমে যেতে পারে! ‘
‘ জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না মেজর। ‘
কি শক্ত কন্ঠ! ধ্রুব অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ এটা দিয়ে তুমি কি বুঝালে? ‘
নিনীকা ঠোঁট আলাদা করে হাসতে চেষ্টা করলো।
‘ এটাই কঠিন বাস্তবতা। আজ যদি আমি না থাকি তুমি একদিন দুদিন কাঁদবে, কিন্তু একসময় ঠিকই আবারও নতুন করে সব শুরু করবে। তখন হয়তো আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকবে। কিন্তু জীবন থামবে না, সে চলে যাবে যেভাবে চলে যায় পৃথিবী থেকে মানুষ! ‘
‘ নিনীকা! পৃথিবীর ৯৯% মানুষের জীবন কাহিনি এটা। বাকি ১% এর টা বললে না যে? ‘
নিনীকা অবাক হয়ে শুধালো,
‘ ১% এর জীবন কাহিনি টা কি মেজর? ‘
ধ্রুব মাথা টেনে বুকে চেপে ধরলো,
‘ পৃথিবীর ১% মানুষ প্রিয়জনের শোকে সারাজীবনের জন্য থমকে যায়। উঁহু তারা আবেগি নয়, তারা আমার মতো শক্ত কঠিন হৃদয়ের বলেই তাদের থমকে যেতে হয়। এই ১% মানুষেরা দ্বিতীয়বার কাউকে নিয়ে ভাবতে পারে না। তুমি ঠিকই বলেছো নিনীকা, জীবন থেমে থাকে না। বয়স বাড়বে, আয়ু কমবে। ওই ১% মানুষেরাও সময়ের স্রোতে ভেসে বুকে কারো জন্য বুক ব্যথা নিয়ে মা*রা যাবে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় কি জানো? ‘
নিনীকার কন্ঠে কৌতুহল,
‘ কি? ‘
‘ সেই ১% মানুষেরা নিয়ম মেনে সব কাজ করবে। চাকরি টা ঠিকঠাক করবে। স্বাভাবিক থাকবে সব। কিন্তু হঠাৎ সে যান্ত্রিক জগতের যান্ত্রিক কাজকর্ম থামিয়ে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। তার তখন বিষন্ন লাগবে। কেউ ছেড়ে চলে গেছিলো বা কেউ তার হয়নি কিংবা কেউ তার মা*রা গেছিলো আবার কাউকে ধরে রাখতে পারেনি বলে তখন তার সবকিছু থমকে যাবে। নিনীকা তুমি কি সেই ১% মানুষদের ব্যাপারে জানো? ‘
নিনীকা মুখে হাত চেপে মাথা নিচু করে কেঁদে উঠলো। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসলো,
‘ তুমি কাঁদছো কেন নিনীকা? ‘
নিনীকা বুকে আঘাত করতে লাগলো,
‘ বাজে লোক, বাজে লোক, বাজে লোক আপনি। ‘
ধ্রুব আটকালো না। বরং ঠোঁট প্রসারিত হলো তার।
‘ প্রিয় নিনীকা, আমার মতো বাজে লোকের জন্যে হলেও থেকে যেও। তুমি সবসময়ই মনে রেখো, পৃথিবীর ওই ১% মানুষের মধ্যে কেউ না কেউ তোমার জন্যে থেমে যাবে! ‘
নিনীকার চোখমুখে অপরাধী ভাব।
‘ আমি কখনোই এমন করতে চাইনি, জানিনা হঠাৎ কি হয়েছিল। ছু*রি দেখে হঠাৎ মাথা ঘুরে গেলো। কি থেকে কি করতে চেয়েছি নিজেও বুঝিনি। আমায় ক্ষমা করো। আর করবো না, সত্যি। ‘
ধ্রুব নির্নিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে।
‘ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। ‘
নিনীকা নিজের দিকে তাকালো। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। ধ্রুব হেসে বলল,
‘ অনেকক্ষণ আগে কেউ একজন আমার সাথে নিজ থেকে অস্বাভাবিক অনেককিছু করেছে। তুমি কি থাকে চেনো? ‘
নিনীকা বালিশে মুখ গুঁজে ফেললো। ধ্রুব বলল,
‘ তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো। রেডি হয়ে নাও। বাহিরে গিয়ে একেবারে খাবো না-হয়। ‘
নিনীকা মুখ তুলে বলল,
‘ কিসের ডক্টর? ‘
‘ সাইকিয়াট্রিস্ট। ‘
নিনীকা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব গালে হাত রাখলো,
‘ একদম নিজেকে দোষ দিবে না। নিজেকে খারাপ ভাবারও দরকার নেই। তুমি যা করেছো তোমার হাসবেন্ডের সাথে। আর হাসবেন্ডের সাথে সবকিছু করা যায়। এরকম এগ্রেসিভ মাঝে মধ্যে হলে কোনো ক্ষতি হয় না, তবে যদি প্রত্যেক দিনের রুটিন হয়ে যায় তবে দুজনেরই পরবর্তীতে নানা সমস্যা দেখা দিবে। হাসবেন্ড ওয়াইফের নরমাল যে দৈহিক মিলন একসময় সেটার আগ্রহ ও কমে যেতে পারে। আমি কি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি মিসেস? ‘
‘ আমি! আসলে হঠাৎ করেই প্রচন্ড ডিপ্রেশন! ‘
‘ হুসস, তোমাকে কিছু বলতে হবে না এখন। আগে ডক্টরের কাছে যাবো আমরা। ‘
নিনীকা নিজেকে প্যাকেট করে নিলো একেবারে। ধ্রুব মিটমিট করে হাসলো,
‘ মুখটা তো বের করে রাখো, শ্বাস নিতে না পারলে আমার বউ মা*রা যাবে যে। ‘
নিনীকা নাক-মুখ কুঁচকে তাকালো,
‘ তোমার খুব হাসি পাচ্ছে? ‘
ধ্রুব হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। বলল,
‘ একদম না, আমি এখন ভীষণ সিরিয়াস। ‘
ইন্ডিয়ার একজন বড়ো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এসেছে তারা। সাইকিয়াট্রিস্ট মহিলা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চশমা ঠেলে দিয়ে বললেন,
‘ কেমন আছো নিনীকা মা? ‘
নিনীকা অবাক হলো। তাদের আজ প্রথম সাক্ষাৎ, অথচ ভদ্রমহিলা যেভাবে কথা বলছেন মনে হচ্ছে কতো বছরের চেনা। আবারও বললেন,
‘ আমাদের আজ প্রথম সাক্ষাৎ। আমাকে ডক্টর না ভেবে নিজের বন্ধু ভাববে। এবং নিজের সমস্যাটা বলবে। কি বলবে তো? ‘
নিনীকা মাথা নাড়ালো। ধ্রুব কথা বলল,
‘ ও সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না, একটু চাপা স্বভাবের। ‘
তিনি হাসলেন,
‘ ব্যাপার না, এইতো সে এখন আমার সাথে মিশতে পারবে। কি পারবে তো মা? ‘
নিনীকা ঠোঁট উল্টে ধ্রুব ও ডক্টরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। ধ্রুব এক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরলো,
‘ কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করার দরকার নেই মিসেস। বি ইজি। ইনি অনেক ভালো একজন ডক্টর, তুমি যদি ইজি না হও তো তোমার সমস্যা টা সমাধান হবে কিভাবে? ‘
নিনীকা কথা বললো এবার,
‘ বলুন কি বলতে হবে। ‘
‘ তোমার ডিপ্রেশনের কারণ কি মা? এখন তো উড়ে বেড়ানোর বয়স। মন খারাপ হলে পাহাড়ে সমুদ্রে ঘুরবে, তা না ডিপ্রেশনে চলে গেছো। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা অনেক বুঝদার। তারা সহজে ডিপ্রেশনে যায় না। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও। আ’ম রাইট নিনীকা? ‘
‘ আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার বড়ো হওয়াটা সহজ নয়। ছোটবেলা থেকেই নানান কিছুর সম্মুখীন হয়েছি৷ তবে কখনো তেমন ডিপ্রেশনে যাইনি। এক কথায় সহ্য করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। আমার মস্তিষ্ক ও মেনে নিয়েছিলো। সেজন্য ডিপ্রেশন টাচ করতে পারতো না। একাকিত্ব আমার প্রিয় হয়ে গেছিলো। কিন্তু যখন ধ্রুবর সাথে সংসার করতে শুরু করি তখন আমি একাকিত্ব ভুলে যাই। আমাদের একমাসের সংসারে ও কখনো আমাকে একা ছাড়েনি। আমি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম।
তারপর ও যখন একমাস পর ওর জবে চলে যায় আর আমি ইন্ডিয়াতে চলে আসি পরীক্ষা দিতে। প্রথম দু একদিন তেমন প্রব্লেম হয়নি। কিন্তু তারপর থেকেই আমাকে আবারও একাকিত্ব ঘিরে ধরলো। এক সময় যেটাকে আমি পছন্দ করতাম, এখন সেটাই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল। আমার ভালো লাগতো না।সবসময়ই বিষন্ন লাগতো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছিলো। সাথে আমি ভীষণ করে একজন সঙ্গীর অভাববোধ করছিলাম। আমার ধ্রুবকে লাগবে মনে হতো৷ কিন্তু ও তো কাজে, কিভাবে আসবে। ওকে বলতেও পারতাম না। মনের দিক থেকে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। ওর অভাববোধ এতোই অনুভব হয়েছিল যে আমি!
ধ্রুবর শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠ,
‘ তুমি কি মিসেস? ‘
নিনীকা চোখ বন্ধ করে বলল,
‘ আমি ফিঙ্গার ব্যবহার করতে গেছিলাম! ‘
ডক্টর বললেন,
‘ ব্যবহার করতে গেছিলে, তার মানে ব্যবহার করোনি। রাইট মাই চাইল্ড? ‘
‘ হু, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করেছি। কেউ ছিল না যাকে কিছু বলতে পারবো। রুমমেটদের সাথে ততোটা ক্লোজ ছিলাম না। সুমিত্রার বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় চলছে, ও বিজি সেজন্য ওর সাথেও তেমন ভাবে যোগাযোগ হতো না। আমি ধ্রুবকে কিছু বলতে পারতাম না, মনে হতো ওর কাজে আমি বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছি না তো! ‘
‘ মিস্টার ধ্রুব, আপনার এই বিষয়ে কি ধারণা? ‘
‘ আজ ও অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। আমার মনে হয়েছিল এটা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মাঝে মধ্যে হয়ে থাকে, বাট প্রতিদিন যদি এরকম অস্বাভাবিক ভাবে দৈহিক কিছু হয় তবে দুজনেরই সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া মনে আরও অনেক সন্দেহ এসেছিলো। আর সে ছু*রি হাতে নিয়েছিলো শেষপর্যন্ত। আমার মনে হলো ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। ‘
ভদ্রমহিলা হাসলেন,
‘ আপনি অনেক দায়িত্বশীল মানুষ। আপনার স্ত্রীর ভাগ্য ভালো যে তাকে আপনি প্রথম দিনই আমার কাছে নিয়ে এসেছেন। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটা আপনি স্বাভাবিক ভাবে নিন। কারণ চাকরির জন্যে আপনি দূরে থাকায় কয়েকদিন আপনাদের মধ্যে দৈহিক কিছু হয়নি। আপনি কাজে ডুবে ছিলেন। সে একাকিত্বে ভুগছিলো। ক্ষিদে ফেলে আমরা যদি খাবার না পাই, যদি দুদিন না খেয়ে থাকতে হয় তখন হঠাৎ করে কেউ সামনে খাবার রাখলে এগ্রেসিভ আচরণ এমনিতেই চলে আসবে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চেষ্টা করবেন। ঘুরাঘুরি করবেন। সে এখন আর আগের মতো একাকিত্বে অভ্যস্ত নয়। সে আর আগের মতো নেই। সে পরিবর্তন হয়েছে। আগের নিনীকা একাকিত্ব ভালোবাসতো, এখন যে আছে সে আপনার স্ত্রী যে একাকিত্ব ভুলে আপনাকে বেছে নিয়েছে। আমি কি আপনাকে বুঝাতে পেরেছি মিস্টার ধ্রুব? ‘
ধ্রুব দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়লো। তার বুক থেকে ভারী কিছু একটা নেমে গেলো।
‘ আমি বুঝতে পেরেছি ডক্টর। আমি অবশ্যই ওর খেয়াল রাখবো। তাছাড়া আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করেও রেখেছিলাম, যাতে ওকে আমার থেকে দূরে না থাকতে হয়। কিন্তু সবকিছুরই একটি পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। তাকে কয়েকমাস পর এমনই নিজে যেখানে যেতাম সেখানে নিয়ে যেতাম, সেটা নাহয় এখন থেকেই করলাম। ‘
‘দ্যাটস গুড। আপনি অনেক সাপোর্টিভ এবং বুদ্ধিমান। আপনার ওয়াইফ লাকি। এরকম কিছু কোনো পুরুষ সহজে বুঝতে পারে না। আমার মনে হয় আপনার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ থাকলে দৈহিক চাহিদা পূরণের মজা নিতো, তার মাথাতে এটা আসতো না যে এটা অস্বাভাবিক কিছু, স্বাভাবিক নয়৷ নিজের স্ত্রীর খেয়াল রাখবেন। যত্ন করবেন। ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর নিনীকার দিকে তাকালেন,
‘ এসব নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মা। তোমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি ফিট। স্বামীকে সবকিছু বলতে চেষ্টা করবে। তুমি মনে রাখবে তোমার একজন পার্সোনাল সাইকিয়াট্রিস্ট আছে, সে হলো তোমার স্বামী। তোমার এরকম সাধারণ প্রব্লেম সে নিজেই সমাধান করতে পারবে। ‘
নিনীকা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। ধ্রুব কিছু সময় পর বের হয়ে এলো নিনীকাকে নিয়ে।
রাস্তায় রোদের তাপে তাকানো যায় না। ধ্রুব কোমড় টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে হাঁটতে লাগলো। আচমকা ওড়নার উপর দিয়ে নিনীকার কাঁধে চুমু খেলো। নেশালো কন্ঠে বলল,
‘ আমার পুতুল, আমার সুন্দরী মিসেস, নিনীকা! ‘
নিনীকা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আমার ভাগ্যটা হয়তো অনেক ভালো, নাহলে পালিয়ে আসা মেয়ের কপালে কি এমন স্বামী জুটে বলো? যার সাথে সংসার করবো না বলে পালিয়ে এসেছিলাম আজ সে-ই আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আজ আমি নিজেই তাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি। তুমি এতো ভালো কেন গো? ‘
ধ্রুব চোখে চোখ রেখে হাসলো,
‘ যার বউ এতো রোমান্টিক তার কি খারাপ হওয়া মানায়? ‘
‘তুমি সবমসময়ই আমাকে লজ্জা দাও, অসভ্য মেজর।’
ধ্রুব জীপে টেনে তুললো।
‘ ডক্টর বলেছে বউকে সবসময়ই কাছাকাছি রাখতে। তার মানে কি বুঝতে পারছো তো? তুমি সবসময়ই আমার সাথে লেপ্টে থাকবে ওকে? ‘
নিনীকা চোখ রাঙানোর অভিনয় করলো,
‘ একদম না, কাছাকাছি বলতে বুঝিয়েছে আমার খেয়াল রাখতে। তুমি সবমসময়ই উল্টো পাল্টা বেশি বুঝো। ‘
‘ আচ্ছা ম্যাম, আপনি যদি এখন দয়া করে বুকের উপর থেকে সরে যান তবে আমি গাড়ি চালাতে পারি।
নিনীকা দেখলো সে সত্যিই ধ্রুবর বুকের উপর ঝুঁকে আছে। নাক ফুলিয়ে সরে গেলো।
‘ তুমি নিজেই আমাকে গাড়িতে টেনে তুলতে গিয়ে নিজের উপর ফেলে দিয়েছো। ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করবে না একদম। বাজে লোক। ‘
খেয়ে ঘুরেফিরে তারা হোটেল রুমে ফিরলো সন্ধ্যার আগে। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম দেখা দিলো। ধ্রুব বুকে টেনে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো।
‘ সারাদিন অনেক জ্বালিয়েছো, এবার ঘুমাও। ‘
নিনীকা বাধ্য মেয়ের মতো ঠোঁট উল্টে ঘুমিয়ে পড়লো। ধ্রুব এক হাতে মোবাইল নিয়ে ফোন করলো নিরবকে। রিসিভ হতেই বললো,
‘ ক্যাপ্টেন, চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আগামীকাল রওনা হবো। ওদিকটা সামলে নিও। ‘
নিরব বলল,
‘ চিন্তা করবেন না আমি সামলে নিবো। ‘
‘ আমাদের সেনানিবাসের আশেপাশে ভালো কটেজ বুক করে রেখো। সাথে তোমার ম্যামও আসবে। আমি ঢাকা ট্রান্সফার না হওয়া পর্যন্ত সে আমার সাথে কটেজেই থাকবে। ‘
‘ ব্যবস্থা হয়ে যাবে মেজর। আপনি ম্যামকে নিয়ে সাবধানে আসবেন। ‘
ধ্রুব কান থেকে মোবাইল নামিয়ে ফারিনকে ফোন দিলো। রিসিভ হতেই বলল,
‘ তোর ভাবীকে আমার কাছে নিয়ে যাবো বনু, বাবাকে ইন্ডিয়ায় আসতে হবে না বলে দিস। ‘
ফারিন প্রায় চিৎকার করে বলল,
‘ তুমি কি এখন ভাবীর কাছে আছো? সত্যি তোমার কাছে নিয়ে চলে যাবে? ‘
‘ হ্যাঁ সত্যি নিয়ে যাবো। চট্টগ্রামে কটেজে থাকবে আমার সাথে৷ আপাতত পরীক্ষার পর প্রতিষ্ঠান বন্ধ ওর। মাকে চিন্তা করতে মানা করিস। আমি ওর খেয়াল রাখবো। আর আমি ডিউটিতে থাকলেও ও কটেজেই থাকবে। ওর মোবাইল সবসময়ই অন থাকবে। ফোন দিয়ে কথা বলবি প্রতিদিন। নিজের কি অবস্থা করেছে।’
ফারিন চমকে গেলো,
‘ কি হয়েছে ভাবীর? ‘
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
‘ চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে। ওকে একা ছাড়াটা রিস্ক। একাকিত্বের অভ্যাস এখন ওর নেই। আমি ডিউটিতে থাকলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবি ফোনে কথা বলে হাসানোর। বুঝেছিস?’
ফারিনের কন্ঠ ভেজা শুনালো,
‘ সব দোষ তোমার ওই চাকরির। আমার মোমের মতো ভাবিটা শুকিয়ে গেছে! তোমাকে আমি ছাড়বো না, একবার আসো বাসায় শুধু। পাপাকে বিচার দিবো দাঁড়াও। ‘
ধ্রুব হাসলো,
‘ দিস, আপাতত ফোন রাখ। ‘
ফারিন রাগ দেখিয়ে ফোন রেখে দিলো। ধ্রুব ঘুমন্ত বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আচমকা চুমু খেলো ঠোঁটে। হাত দিয়ে ছুয়ে দেখলো চোখের নিচের কালো দাগগুলো। তার অনুভব হলো তখনকার রাগ করে বলা ‘তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসোনি কথাটা মিথ্যা!
বিয়ে থা পর্ব ৩৬
মিসেস নিনীকা শেখ শুধু তাকে ভালোই বাসে না, বরং এমন ভাবে ডুবে গেছে আজ যদি ধ্রুবর কিছু হয়ে যায় তবে তার মিসেসের স্থান হয়তো পাগলাগারদে হতে সময় নিবে না! ভেবে ধ্রুব আশ্চর্য হয়ে গেলো। মেয়েটা কবে তাকে এতো ভালোবেসে ফেললো!
ধ্রুব কপালে আদর দিলো। সামনে আসা চুল গুছিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল,
‘ মেজর ধ্রুব মাহবুব ও তার পাগল মিসেসকে অসম্ভব ভালোবাসে মেয়ে!