বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫২+৫৩
রোজা রহমান
কিছু মেয়েরা হয় জেদি, উগ্র স্বভাবের৷ নিজের মতামত নিজেরা জোর করে দেয়। পরিবার না নিতে চাইলেও তারা জোর, জবরদস্তি, জেদ ধরে বাধ্য করে। তারা তাদের নিজের মত দেবার জন্য নিজের জেদটাকে আগে প্রধান্য দেয়৷
আবার কিছু মেয়েরা হয় শান্ত-শিষ্ট, নরম সরম স্বভাবের৷ পরিবার যা বলবে তাই মুখ বুজে মেনে নেবে৷ কোনো উচ্চবাচ্য করবে না। তারা তাদের সকল দায়িত্ব পরিবারের উপর ছেড়ে দেয়। ভাবে পরিবার যা করবে সেটাই ভালো। নিজের মত বলে যে কিছু থাকে সেটা তাদের কাছে শোভা পায়না।
আর কিছু মেয়েরা এমন হয় যে, নিজেদের মতামত থাকে, ভালো মন্দ মতামত দেবার চেষ্টা করে কিন্তু পরিবারের শাসনের গেঁড়াকলে পড়ে নিজের মতামতগুলো প্রকাশ করতে পারে না। মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা মনমর্জি মতো মতামতগুলো জলাঞ্জলী দিয়ে দেয়। পরিবার নামক শব্দটার জন্য এমন অহরহ ছেলে-মেয়েরা তাদের ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারে না মতামত দিতে পারেনা৷ তাদের কাছে যেন ছেলে মেয়েরা বড়-ই হয়না। সন্তান বড় হলে যে নিজেদের মত প্রকাশের একটা অধিকার হয় সেটা তাদের বোধে আসে না। তারা নিজেরা যা ভালো মনে করে সেটা করতে পারলেই যেন রাজা।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
হ্যাঁ অভিভাবক হিসেকে একটা সন্তানের ভালো মন্দের দায়িত্ব তাদেরই থাকে তবুও অনেক সময় যে তারা সন্তানের ভালো করতে গিয়ে খারাপ করে ফেলে সেটার খোঁজ রাখেন না। পরিবার ভালো চায় সেটা ঠিক আছে কিন্তু সব পরিবারেরও উচিত সেই ভালোটা চাইতে গিয়ে সন্তানের খারাপ হবে কিনা ভালো হবে সেটার মতটাও একটা এডাল্ট সন্তানের থেকে নেবার। পরিবারও ভুল করে, তারা যে সব সময় সঠিক করে তা না। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল থাকে ঐ সন্তানের জন্য। পরিবারের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে না নিজের মনের কথা বলতে পারে আর না মত দিতে পারে তখন হয়ে দ্বারাই পরিবারের চাপে পরে কাজটা করেছে বা করেছি।
আর এই তিন কাতারের মেয়েদের মধ্যে স্মৃতি হচ্ছে তিন নাম্বারে। সে পরিবারের শাসনের একটা মেয়ে। তাদের পরিবারে খুবই কাঠিন্যতা বজায় রাখে৷ সন্তানদের ভালো খারাপ তারাই দেখেন৷ তবে অভদ্রতা নেই স্মৃতির পরিবারে। যথেষ্ট ভদ্রতা আছে। থাকে না এরকম কিছু পরিবার? ঠিক তেমনই স্মৃতির পরিবার। স্মৃতির বাবারা শহরের মাঝে থাকলেও তাদের জ্ঞানবোধ একটু আলাদা৷ উনারা এক কথার মানুষ। শহরে থাকলেই যে খোলামেলা স্বভাব বা খোলামেলা ভাবে চলতে হবে সেগুলি স্মৃতির পরিবারে নেই। তারা সন্তানদের যথেষ্ট শাসনে রাখেন আর ভালো মন্দও তারাই দেখেন।
তেমনি স্মৃতির আজ ভালো করতে গিয়ে উনারা নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন। তার যে একটা মত আছে সেসব দেখার বা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি।
স্মৃতির জন্য পাত্র দেখা হচ্ছিল আজ বছর যাবত ধরেই সেটা একদমই আড়ালে অর্থাৎ স্মৃতিকে না জানিয়ে। জানাবেই বা কেন? তারা তো সন্তানের মতের আশা করেন না! এই জন্য জানাননি। আর আজ সপ্তাহ খানেক আগে থেকে যে বিয়ের কথা বার্তা, দেখাশোনা চলছে সেটা স্মৃতি জানতই না। পাত্রপক্ষ ওকে দেখেছে ফটোতে। আর আজ আসছে বিকেল পাঁচটার দিকে পাকা দেখতে মানে আজ দেখতে এসে ভালো লাগলে আকদ করে ফেলবেন এমনই কথা হয়েছে। বিয়ে উঠানো হবে স্মৃতির ইন্টার পরীক্ষার পর৷ তো সকাল থেকে সেসব তোড়জোড় চলছিল স্মৃতি পরীক্ষা দিতে চলে গেলে। তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি কেউ।
পরীক্ষা দিয়ে দুটোর সময় এসে দেখে, আর শুনে তার মাথায় হাত উঠে যায়। বজ্রাহত হয়ে ভেঙে পড়ে। বাবাকে প্রচুর ভয় পায়। এছাড়া স্মৃতির দাদি এবং বড় চাচা মানে রনির বাবা খুবই রাগী মানুষ। ওর দাদি এখনো সংসারের কর্তী। আলাদা বাড়িতে আলাদা থাকেন ওর চাচারা কিন্তু মায়ের মতামতে চলে। স্মৃতির দাদি দুই ছেলের দিকেই থাকেন। বাবার বড় বয়সের দুইটা ফুপু আছে ওর।
স্মৃতি জন্য পাত্র দেখা হয়েছে ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। ভালো কোম্পানিতে জব করে। ভালো পরিবার ছেলে দেখতে শুনতেও সুদর্শন। সব দিকে মিলে গেছে বিধায় বাড়ির লোক দেরি করেতে চাইছেন না আজই বিয়ে পড়িয়ে দেবেন। ছেলে পক্ষের আসার সময় হয়ে এসেছে। এলো বলে। এদিকে স্মৃতি গুমরে কাঁদতে কাঁদতে শেষ। বাড়িতে সে কিছুতেই বলতে পারছে না তার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে। এটা শুনলে হয়তো আজই মে-রে কেটে নদীতে দেবে চাচুরা। আর দাদি তো সাথে তাল মেলানোর জন্য আছেনই! যে মেয়ে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক করতে পারে সে মেয়েকে রেখে কী হবে? স্মৃতির দাদি গ্রামের সেকেলে মানুষ। চিন্তা ভাবনা আগের যুগের মতো। মেয়েদের, বউদের ট্রিটও করেন তেমন।
যায়হোক স্মৃতি সেই দুপুর থেকে রিজভীকে হাজারটা কল দিয়ে চলেছে সাথে ভুরিভুরি মেসেজ। স্মৃতি এসে জানতে পেরে কুয়াশাকে বলে এরপর দু’জন মিলে সমানে শিশির, রিজভীকে কল, মেসেজ দেয়। স্মৃতি রিজভীকে সমানে কল দিয়েছে। কুয়াশা শিশিরকে দিয়েছে৷ কুয়াশা নিজে প্রথমে ট্রাই করে না পেরে নীহারের সাহায্য নিয়েছে। রিজভীকে ছাড়া কিছুই সম্ভব হবে না। স্মৃতি চায় রিজভী কিছু একটা করুক। তার নিজের দ্বারাই সম্ভব হবে না।
স্মৃতিকে তৈরি করে দেয়া হয়েছে। কেঁদেছে ভেবেছে বিয়ের জন্য কেঁদেছে তবুও জিজ্ঞেস করেননি কেউ। আর মা’কে যদিও একটু ভরসা করে তিনিও কাছে আসেন নি।
ছেলে পক্ষ আসার আগেই শিশির আর রিজভী এলো। রিজভী ওর বাবা মা’কে জানিয়ে দিয়েছে। উনারা বিষয়টা জানতেন। স্মৃতির বাবা আর মা সম্মন্ধ নিয়ে আসবেন বলেছেন। কিছুক্ষণের মাঝে কুয়াশাকে নিয়ে নীহার এলো। ওরা এক সাথে বাড়ির মধ্যে ঢুকল না। নীহার আর রিজভী নিচে থাকল কারণ আগেই ওরা গেলে ঘেটে ঘ হয়ে যাবে বিষয়টা। কুয়াশাকে সকলে চেনে। এছাড়া শিশিরের কথাও টুকটাক জানে স্মৃতির বাবারা। এক তালা বিশিষ্ট ফ্ল্যাট স্মৃতিদের। বসার ঘরে বসে আছে বাবারা৷ শিশির গেলে দেখে তার সাথে কথা বলে। শিশির সালাম দিয়ে পরিচয় দেয়। ঈশা এখনো আসে নি। সে আসছে।
শিশির সালাম দিয়ে পরিচয় করল প্রথমে। উনারা ভদ্রতা দেখিয়ে বসতে দিয়ে নাস্তা পানির আয়োজন করলেন। শিশির ভাবছে কীভাবে শুরু করবে! কুয়াশা স্মৃতির কাছে চলে গেছে। কিছুক্ষণ ভাবার পর শিশির স্মৃতির বাবার উদ্দেশ্য করে ডাকল। বলল,
” আঙ্কেল! আপনার সাথে একটু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে পারি একা? ”
স্মৃতির বাবা বিষয়টা প্রথমে বুঝে নিলেন। তারপর তিনিও ভদ্রতা রেখে বললেন,
” অবশ্যই, দ্বিধা ছাড়া বলো ”
পাশে স্মৃতির চাচু ছিল। শিশির অবশ্য ইচ্ছে করলে চাচুর সামনেও বলতে পারত৷ কিন্তু সে ভেবে নিল আগে যাদের মেয়ে তাদের বলবে। ওনারা বিষয়টা বুঝতে পারলে আর কোনো টেনশন থাকবে না। বিষয়টা আসলেই জটিল হয়ে গেছে। যেখানে পাত্রপক্ষ আসবে আর সব ঠিকঠাক সেখানে কোনো জারিজুরি খাটবে কিনা জানা নেই। তবুও সর্বশেষ চেষ্টা করতে হবে।
শিশিরের ভাব ভঙ্গিতে ওনারা বুঝলেন একান্তই একা কথা বলবে। তাই স্মৃতি দুইটা চাচতো ভাই, স্মৃতির বড় ভাই আর চাচা চলে গেলেন। শিশির নিজেকে সামলে নিল। এরপর সবটা খুলে বলল। শিশির রিজভী আর স্মৃতির রিলেশনের কথা হাইড করেছে শুধু পছন্দ করে রিজভী একমনটা জানিয়েছে। সবটা শুনে স্মৃতির বাবা হতবাক হলেন। এও ভাবলেন এখন এসব বলে কী হবে? ঐ ছেলেও ভালো। তার থেকে বড় কথা তারা আসছে। পাকা কথাও হয়েছে। শিশির এসব শুনে এবার সবটাই বলে দিল উপায় না পেয়ে৷ তা নাহলে বুঝবেন না বুঝেছে সে। এবার স্মৃতির বাবা একটু রাগল। মেয়ে তার শাসনের বাহিরে ভেতরে ভেতরে এত দূর? শিশির বুঝল বোধহয় বিষয়টা৷ সে আবার বলল,
” দেখেন আঙ্কেল, একটা ছেলে মেয়েরা বড় হলে তাদের পছন্দ অপছন্দ বলে একটা জিনিস তৈরি হয়। আর সেই পছন্দ অপছন্দকে প্রাধাণ্য দেওয়া উচিত পরিবারের অভিভাবকদের।
আমরা ছেলে মেয়েরা এখন এডাল্ট। এটা বলছি না যে এডাল্ট হয়ে গেলে পরিবারের অধিকার থাকে না ছেলে মেয়েদের উপর। থাকে অবশ্যই থাকে। বাবা মা তাদের সন্তানকে কষ্ট করে মানুষ করেন তাদেরই অধিকার থাকে ভালো মন্দ দেখার৷ কিন্তু আঙ্কেল, অনেক সময় পরিবারের দ্বারা কিন্তু ভুল হয়! পরিবারের চাপে পরে সন্তানেরা মুখ বুজে মেনে নেয় সব। তাদের মতামত দিতে পারে না। আঙ্কেল এমন বিয়েও এই সমাজে অহরহ আছে যেগুলো পরিবারের দ্বারাই হয় কিন্তু মেয়েরা সুখী হয় না। কত শত ডিভোর্স হচ্ছে। তাহলে কী পরিবারের দ্বারা ভুল হয় না বলেন? আবার এমন বিয়েও কত শত আছে মেয়ের পছন্দ থাকা সত্বেও অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় এমন হয় না বলেন? এখন যদি বলেন বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে চললে সব ঠিক হয়ে যাবে। তো আমি বলব, হ্যাঁ হবে হয়তো ঠিক হবে কিন্তু স্মৃতি যে মেনে নিয়ে মানিয়ে চলে কতটুকু সুখী হবে সেটা বলতে পারবেন? আঙ্কেল মনের উপর জোর খাটে না৷
হয়তো স্মৃতি মানবে, কয়েকবছর সংসার করার পর সবটা নিয়ন্ত্রণে আসবে, সংসারের চাপে পরে সবটা মানতে শিখে যাবে। কিন্তু এটা বলতে পারবেন আপনার মেয়ে ভালোবাসা দিয়ে সংসার করতে পারবে? ভালোবেসে মন থেকে মেনে নিয়ে সব কিছু মানতে পারবে? আঙ্কেল স্মৃতি রিজভীকে ভালোবাসে ওদের বিয়ে হলে ওরা ভালোবাসা দিয়ে সংসার করতে পারবে। আপনার মেয়ের বিয়ে হলে আমার বন্ধুরও বিয়ে হবে। সেও সংসার করবে। অন্য কোনো মেয়ের সাথে। কিন্তু এই যে তার সুপ্ত চাওয়াটা স্মৃতি এটা কিন্তু থেকে যাবে এবং একই ঘটনা আপনার মেয়ের সাথেও হবে। এই সুপ্ত চাওয়াটা ওদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে।
ভাববে একটা বার যদি পরিবার বুঝত! জোর করে বিয়ে দিলে সমস্যা নেই কিন্তু তারা একে অপরকে পছন্দ করে। এই পছন্দটা না থাকলে কোনো সমস্যা হতো না। জোর করে বিয়ে দেবার পর মেনে নিয়ে সংসার করতে করতে ঠিক হতো। আঙ্কেল আপনি বাবা আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না আপনার মেয়ে এমন কোনো আফসোস নিয়ে সারাজীবন থাকুক? ক্ষতি কী আঙ্কেল ওদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে হলে? এখনো তো কিছুই হয়নি। শুধু দেখাশোনা চলছে। আপনি চাইলে সব সম্ভব হবে। বাবা হিসেবে একটু তো সেক্রিফাইজ করতেই পারেন না? আঙ্কেল ছেলে মেয়েরা পছন্দ করলে কোনো পাপের কাজ হয়না যদি না পরিবার বাঁধা হয়। তারা পছন্দ করেছে এখন আপনারা মেনে নিয়ে যদি সবটা সুন্দর ভাবে এটার শেষ করেন তো এটা একটা মহৎ কাজ হবে আর যদিনা না মানেন এটার ওদের অবৈধতা হবে। আপনি কী নিশ্চয়তা দিতে পারবেন ভবিষ্যতে ওরা একে অপরকে ছাড়তে পারবে?
যদি বিয়ের পরেও ওরা সম্পর্ক চালিয়ে যায় বা সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে চায়? আমি কথার কথা বলছি, যদিও আমরা বন্ধু আর স্মৃতি কেউই এমন না আর করবেও না এমন কিছু। তবুও আঙ্কেল হয়তো এরকম অহরহ! আবার দুঃখে কষ্টে যদি নিজের ক্ষতি করারও চেষ্টা করে তখন কী সেটার সমাধান পাবেন? আঙ্কেল ভালোবাসা মানুষকে সব করাতে বাধ্য করে। আমাদের এই আপডেট যুগে এখন এগুলোই অহরহ চলছে। যদিও এগুলো বলা ঠিক হচ্ছে না আপনি গুরুজন আমার তবুও বলছি দুটো সুন্দর জীবনের জন্য। আঙ্কেল আপনারা এই আপডেট যুগের বাবা মা, বিষয়টা একটু বুঝে সিদ্ধান্ত পাল্টালে দুটো জীবন সুন্দর একটা নাম পাবে। ”
অনেকক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে উঠল শিশির। থামল সে। ওদিকে স্মৃতির বাবা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থেকে কথাগুলো শুধু শুনে গেলেন। গভীর ভাবনায় মগ্ন তিনি। শিশিরের প্রতিটা কথা মনে ধরেছে উনার। তাই ভাবনাতে ব্যস্ত। ভাবনার মাঝে শিশির আবার বলল,
” আঙ্কেল রিজভী আমার সাথে আইন নিয়ে পড়াশুনো করছে৷ আমাদের দু’জনের ভবিষ্যত কল্পনা একরকম। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ সহায় হলে আমরা ভবিষ্যত কিছু করতে পারব। এছাড়া আমার বন্ধুর ফেমিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও ভালো। যথেষ্ঠ সচ্ছলতা। তবে সমস্যা কী? আপনাদের মতামত পেলে আমার বন্ধুর অভিভাবক আসবেন।”
” কিন্তু ছেলে পক্ষ চলে এসেছে প্রায়। এখন আমি কী করতে পারব? এখানে মান-অপমানের ব্যাপার স্যাপার আছে। আমি এমন কিছু করতে পারি না। উনারা অপমানিত হবেন। ”
” আঙ্কেল সেটা না হয় সুন্দর ভাবে হ্যান্ডেল করা যাবে? আপনি শুধু এদিকের মতটা দিয়ে দেন। ওদিক আমরা সামলাব। একটু ভরসা করেন প্লিজ! আপনার বড় ভাই ও মায়ের সাথে আপনি কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন প্রয়োজনে৷ শুধু মতামতটা দেন বাকিটা আমার দায়িত্ব। ”
স্মৃতির বাবা খুবই গভীর চিন্তায় পড়লেন। শিশির যে এত সুন্দর করে ব্রেনটা ওয়াশ করল এখন তিনি দ্বিধায় পড়েছেন। তিনি সম্পূর্ণ কথা শুনে মনে মনে শিশিরের তারিফ করতেও ভুললেন না৷ এও ভাবলেন শিশিরের বন্ধুও ঠিক একই প্রকৃতির হবে? কিন্তু তিনি পড়লেন দোটানায়। বাবা মা হিসেবে মেয়ের সুখের কথাটাও ভাবা উচিত এদিকে কথা দিয়েছেন সেটা কীকরে কী করবেন ভাবছেন। রিজভীর বিষয়ে শিশির যা যা বলল তা থেকে বোঝা যায় রিজভী যথেষ্ট সুপাত্র এবং ঐ ছেলের থেকে সুপাত্র। তিনি শিশিরকে বলল আমি ওদিক থেকে আসছি৷ শিশির সম্মতি দিলে তিনি উঠে গেলেন। শিশির একা একা বসে থাকল। টেক্সট করে সবটা রিজভীকে বলল। তারা নিচে একটা দোকানে বসে আছে।
এদিকে কিছুক্ষণ পরে স্মৃতির বাবা সহ চাচু, দাদি এবং ভাইরা এলো। সবটা বুঝিয়ে বলেছেন। সুপাত্র রিজভীকে এক কথায় বলা চলে। ব্যাটারের থেকে ব্যাটার পেলে কী আর কেউ ছাড়তে চায়? কিন্তু সকলের চিন্তার কারণ হলো পাত্রপক্ষকে নিয়ে। শিশির আশ্বাস দিল সেটাও সে হ্যান্ডেল করবে না পারলে তার ভাই তুষার হ্যান্ডেল করবে। শিশিরের কথাতেই থাকল সকলে।
পাত্রপক্ষের সাথে ইচ্ছে করলে শিশির ফোনে কথা বলত কিন্তু সেটার থেকে সামনাসামনি বলাটা ভালো হবে বলে মনে করল শিশির।
পাঁচটার পর পাত্রপক্ষ এলো। স্বাভাবিক ভাবেই সকলকে আপ্যায়ন করা হলো। এরই মাঝে স্মৃতির বাবা পাত্রের বাবাকে সবটা জানালেন। সব শুনে বেজায় রাগলেন তিনি। কারণ তারা এসেছে বিয়ের মতো করে। মেয়ে তাদের পছন্দ। এতদিন কেন জানায় নি? মেয়ের মত না নিয়ে বিয়ের কথা বলে এ কেমন বাবা মা? আর এতদিন মত নিতে চায়নি তবে আজ কেন আদিক্ষেতা? এসব ভেবেই রাগলেন। বিষয়টা দুপুরেও জানালে তারা আসত না৷ শিশির এবার না পেরে স্মৃতির বাবার থেকে অনুমতি নিয়ে পাত্রের সাথে আলাদা কথা বলতে চাইল। ছেলেটা নেহাত ভদ্র, শিক্ষিত তাই চুপচাপ মানল৷ শিশিরের সাথে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরেও এলো। এসে বাবা, মায়ের সামনে বলল,
” বাবা, উনারা সব থেকে বড় ভুল করেছেন বিয়ের মতো একটা জিনিসে মেয়ের মত না নিয়ে৷ এটা উনাদের উচিত হয়নি। যে সংসার করবে তার থেকে মত নেয়াটা একান্তই প্রয়োজন ছিল। তবে সেটা ভুল যখন করেছেন সেই একই ভুল আমি করতে চাই না৷ আমি এই যুগের ছেলে হয়ে বিষয়টাকে হেলাফেলা মনে করতে পারিনা৷ এছাড়া তোমরা এসেছ মেয়ে দেখার মতো করে। এখানে আয়োজন করে বিয়ে করতে আসিনি আমি। মেয়ে দেখে পছন্দ না হলেও বিয়ে হতো না সেখানে বিষয়টা একই দ্বারাই। এখানে জোরজবরদস্তির কিছু নেই। আঙ্কেলরা ভুল করে ফেলেছেন সেটাকে আমাদের মেনে নিয়ে বুঝা উচিত। আমি জানি আমার বাবা মা শিক্ষিত এসব বুঝবে। আমরা উঠি তবে?”
ছেলের কথা পাত্রের মা, বাবা খুশি হলেন। এটাও বুঝলেন তারা রাগবাগ করে কিছুই হবে না৷ সংসার যারা করবে একান্তই তাদের বিষয় এসব৷ যথেষ্ট বড় ছেলে মেয়েরা। বিদায় নিয়ে উনারা চলে গেলেন৷ যাবার আগে শিশিরের সাথে পাত্র হাসি মুখে কথা বলে গেল। শিশির ধন্যবাদ জানাতে বলল না৷ ছেলেটাও উল্টো ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না। কারণ বিষয়টা আগে থেকে বলে ভালো করেছে আর শিশির খুব সুন্দর ভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছে।
উনারা চলে যেতেই সব কিছু স্মৃতিদের জানানো হলো। রনি তো শুনে কুয়াশাদের কাছে গিয়ে স্মৃতিকে বলল,
” তুই তলে তলে ট্যাম্পু চালাতি? ”
এই কথাটা শুনে স্মৃতি রনিকে মারে। ঈশাও চলে এসেছে। তারা হাসাহাসি করছে। সেখানে স্মৃতির কাজিন সহ ভাবিরা আছে। স্মৃতির আনন্দ দেখে কে! কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরে শিশিরের নামে গুনগান করেই চলল। কুয়াশা শুধু হাসল। তার বরটা বুঝদার বলেই তো এতটা অপত্যা থাকা সত্বেও আজ তারা সংসার করতে পারছে।
এদিকে শিশির স্মৃতির বাবা মায়ের কাছে শুকরিয়া আদায় করে রিজভীকে সব জানাল। তার বাবা মাকে আসতে বলে দিল। শিশিরের প্রতি খুবই সন্তুষ্ট স্মৃতির বাবারা৷ বুঝদার ছেলে এত সুন্দর করে সবটা হ্যান্ডেল করল যে কেউ কোনো দ্বিরুক্তি করার সুযোগটুকু পেল না। এমনকি স্মৃতির রাগী চাচা আর দাদিও না। বুড়িটার বেশ লোভ আছে৷ ভালো পাত্রের কথা শুনে মুখে কুলো পেতেছেন৷ চাচাটাও মানলেন কারণ যাদের মেয়ে তারা যদি নাকচ করেন তো কী আর করার? শিশির এই জন্যই আগে স্মৃতির বাবার সাথে কথা বলেছিল যেন সবটা সুন্দর ভাবে হ্যান্ডেল হয়৷
ছয়টা বেজে গেছে৷ রিজভীর কথা বলে নীহার আর রিজভীকে বাড়ির মধ্য এনেছে শিশির৷ রিজভীকে দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়েছেন স্মৃতির বাবারা৷ একদম শিশিরের মতো করেই কথা বলে। কার্বন কপি বলা যায়৷ মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না উনারা। ছেলে সেই লেভেলের পছন্দ হলো সকলের৷ এখন রিজভীর বাবা, মা আসলে কথা বলবেন৷ শিশিররা বসার ঘরে বসে নিজেদের মতো করে কথা বলছে৷ রিজভী তো পারলে এখানে ধরেই শিশিরকে জড়িয়ে ধরে চুমুর বর্ষণ শুরু করত৷ সেটা বলাতে তিনজন হাসাহাসি করছে। সেসময়ে দৌড়ে কুয়াশা এসে ধারাম দিয়ে শিশিরের পাশে সোফায় বসে পড়ল। শিশির টের পেয়ে মৃদু ধমকে উঠল,
” এ্যাই..! দৌড়াচ্ছিস কেন? আর এটা অন্যর বাড়ি দেখছিস না? ”
কুয়াশা শিশিরের কথায় পাত্তা দিল না৷ সে তো আনন্দে আটখানা। ফিসফিস করে শিশিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। ”
শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভড়কে তাকাল৷ বলে কী এ মেয়ে! শিশির কিড়মিড় করে সেও ফিসফিস করে বলল,
” যাবি এখান থেকে? ”
” আরেহ্ সত্যি, এখন ভাইয়ারা না থাকলে সত্যি আগে চুমুর বর্ষণ ঘটাতাম। ইশশ আমার বরটা এত সুন্দর কেন!! ”
ফিসফিস করে বলে মুখ ঢাকল৷ ওদিকে রিজভীরা কথায় ব্যস্ত এদিকের কথা শুনতে পারছে না অতি আস্তে একে অপরের কানের কাছে বলাতে। ভ্রু কুঁচকে শিশির একই ভাবে বলল,
” রাতে দেখব তোর চুমুর বর্ষণ। কত প্রকার বর্ষণ ঘটাতে পারিস! বর্ষণ ঘটিয়ে যদি প্লাবন না বানাতে পারিস তবে তোর উপর আমি তুষারপাত ঘটাব।”
কুায়াশা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল৷ সে কী তেমন কিছু বলেছে নাকি? এ ছেলে যখন বলেছে তখন করিয়ে ছাড়বে। কথার কথা বলতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল৷
” ধুরর…!”
বলে কুয়াশা উঠে ধেই ধেই করে আবার স্মৃতির ঘরের দিকে গেল। শিশির ওর যাবার পানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে মিটমিট করে হাসছে।
রিজভীর মা-বাবা আসলেন সন্ধ্যার পর। এসে স্মৃতিকে দেখলেন৷ তাদের পছন্দ হয়েছে স্মৃতিকে। বিয়ের কথা বলাতে স্মৃতির চাচা জানালেন উনারা পারলে আজই আকদ সেরে ফেলবেন৷ এই কথা রিজভীর বাবা-মা রিজভীর থেকে মতামত নিয়ে মত দিলেন। রিজভীর কোনো সমস্যা নেই। সে-ও আর নামহীন সম্পর্ক চালাতে চাই না। সুযোগ যখন পাচ্ছে তবে সমস্যা কী? তার বাবা বললেন সমস্যা হবে না তিনি এক মাত্র ছেলের বউকে রাখতে পারবেন। কিন্তু উনাদের এই ভাবনার মাঝেই স্মৃতির বাবা জানালেন মেয়ে তাদের একটা তারা আকদ করে রাখবেন পরে বিয়ে উঠাবেন ততদিন স্মৃতি তাদের কাছেই থাকবে। স্মৃতির বাবার কথায় রিজভীর বাবা জানালেন তাহলে বিয়ে উঠানোর কাজ রিজভীর পড়াশুনোর পর উঠাতে। এই কথায় কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না কেউ। সকলে মত দিলেন৷ একেবারে মেয়ের বিয়ে উঠিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন।
রিজভী আর স্মৃতির আকদ করার জন্য কাজি ডাকা হয়েছে। টুকটাক কিছু আত্মীয়দের ডাকা হলো। রিজভীর বড় বোন আর তার স্বামী এসেছেন। ছোট বোন আসতে পারবেন না। তার বাড়িটা দূরে। রিজভীর একটা ফুপু আছে তার স্বামী এসেছেন অর্থাৎ। কেউ বাড়িতে যায়নি। রিজভী বেচারা ভাবেই নি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এত কিছু হয়ে যাবে আবার বিয়ে পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে৷ ভাবা যায়!
রাত নয়টার দিকে রিজভী আর স্মৃতির আকদ সম্পূর্ণ হলো। সকলে আলহামদুলিল্লাহ পড়ল। শিশির সহ নীহার রিজভীকে পাশে থেকে অভিনন্দন জানাল। স্মৃতি লজ্জায় লাল, নীল হচ্ছে ভাবে লাগছে। তাদের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো। রিজভী প্রশান্তিময় হাসল। সে তার রসমালাইকে পেয়ে গেছে। বিকেলে মনে হচ্ছিল আজ বোধহয় অন্তরটাই হারিয়ে ফেলবে। আত্নাটা বেড়িয়ে যাবে। স্মৃতিকে এই কয় মাসের মধ্যে সে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে৷ মেয়েটা সব সময় নরম সরম হয়ে থাকে। কথা বলে কী সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি করে! সে সত্যি রসমালাই। দেখতেও এবং কাজেও। ভেবে হাসল রিজভী।
স্মৃতি আর রিজভীর জীবনের নতুন ক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। তারা এখন স্বামীস্ত্রী। দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। অমায়িক হাসল রিজভী৷ স্মৃতির প্রচুর লজ্জা করছে। চোখ নামিয়ে নিল। কুয়াশা, ঈশা, রনি হাসছে ওদের কার্বার দেখে৷
রাত দশটা পাড় হয়ে গেল। স্মৃতির বাড়ির সকলে ঠিক করেছে রিজভীকে আজ রেখে দেবে৷ ভালোভাবে পরিচয় হলো না হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল৷ শুধু মাত্র কিছু সময়ের এবং কথার উপর ভিত্তি করে বিয়েটা দিলেন একমাত্র মেয়ের কথা ভেবে তার সুখের জন্য। ভালোভাবে খোঁজ খবরটাও নিতে পারেননি। যদিও স্মৃতির বাবা মা বুঝেছেন ছেলে ওনারা ভালোই পেয়েছেন৷ মেয়ে সুখে থাকলেই হলো। শাসন করে এতটা বছর লালন পালন করেছেন। মেয়ের ভবিষ্যতটা না হয় নিজের পছন্দমতোই হোক! ক্ষতি কী তাতে?
এদিকে শিশিররা তা শুনে রীতিমতো মজা নিতে লেগে গেছে। একপ্রকার রিজভীকে সব পেড়ে ধরেছে৷ বেচারা পড়েছে গেঁড়াকলে। শিশির টিপ্পনী কেটে বলল,
” এ দোস্ত তোর তো কপাল খুলে গেল রে.. বিয়ে করলি আবার শ্বশুরবাড়ি বাসর করার সুযোগ ও পেয়ে গেলি? আরেহ্ তোর শ্বশুর, শাশুড়ী তো তোর কপাল খুলে দিল রে! মেয়ে-জামাইর বাসরের ব্যবস্থাও করে দিল!”
রিজভী কটমট করে তাকাল শিশিরের দিকে। কিছুই বলতে পারল না। কারণ আজ তার পালা এসেছে। সে এতদিন সুযোগ বুঝে টপ দিয়ে এসেছে। নীহার ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। শিশির তার মতো মজা নিয়ে চলেছে একের পর এক।
রিজভীকে রাখবে শুনে রিজভীর বাবা চলে যাবেন ঠিক করলেন। ফুপা, বোনেরাও চলে যাবেন বলেছেন। সকলকেই থাকার কথা জানালেন স্মৃতির বাবারা। কিন্তু কিছুতেই রাজি হলেন না রিজভীর বাবা, মা। অবশেষে ঠিক হলো সকলে চলে যাবেন শিশির কুয়াশাকে রাখবেন। শিশির কুয়াশা রাতটা থেকে যাবে। ওরা মানা করেও কাজ হলো না জোর করে রাখল। এছাড়া স্মৃতি, রিজভীও জোর করল। এগারটার পর নীহার চলে গেল রিজভীর বাবাদের সাথে। ঈশা রয়ে গেল কুয়াশাদের সাথে।
রাত প্রায় বারটার দিকে কিছু নিয়ম-কানুন পালন করে রিজভীকে স্মৃতির ঘরে দেয়া হলো৷ স্মৃতিকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে সাজানো হয়েছে। মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই মিষ্টি লাগছে। দুপুর থেকে যে ঝড়টা গেল দুটি মনের উপর। এক মূহুর্তের জন্য দুটি মন ভেঙে যেতে নিয়েছিল। দুটি মন আলাদা হতে গেছিল।
আল্লাহ চাইলে কিনা পারে! সব ভাগ্যর পরিহাস। আজ যদি রিজভী সাথে স্মৃতির ভাগ্য জোরা না থাকত হাজার কোনো জারিজুরিই খাটত না৷ তাদের আশা পূরণ হয়েছে। নিয়তিতে যদি না থাকত হাজার ভালোবেসে কী হবে? ভাগ্যর উপর কী জারিজুরি খাটে? খাটত না। রিজভী তার রসমালাইকে হারাত৷ স্মৃতি নিয়তি মেনে অন্যর সংসার করত৷ ভালোবাসা না থাকলেও জোর করে বাসতে হতো। কিন্তু সুপ্ত চাওয়া দু’জনের মনে থেকেই যেত।
পরিবার মানা তো একটা অছিলা মাত্র! পরিবার না মানলেও যদি রিজভী স্মৃতির নিয়তিতে এক হওয়া থাকত তবে সেটা কাররি সাধ্য থাকত না তাদের মিলনে বাঁধা হবার যে করেই হোক, যে ভাবেই হোক মিলন তাদের হতোই। নয়তো একটা শাসন করা পরিবার কী করে মেনে নিল? এটা নিশ্চয়ই হবারই ছিল?
রিজভী, স্মৃতি আজ যতবার আল্লাহকে ডেকেছে দু’জন দু’জনকে না পেলে বোধহয় কাঁচের ন্যায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।
রিজভী পরীক্ষার হল থেকে যেমন ছিল তেমনই বেড়িয়ে এখানে এসেছে৷ বাসাতেও আর যায়নি। আর চেঞ্জ ও করতে পারেনি। বিয়েটাও হয়েছে তেমন অবস্থাতেই। তাই স্মৃতির বাড়ি থেকে আপাতত ড্রেসের ব্যবস্থা করেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে মার্কেটের দোকানগুলো বন্ধ নতুন কিছু কিনতে যেতে পারেনি৷ জানিয়েছে সকালে মেয়েজামাইকে কিছু কিনে এনে দেয়া হবে। তাই এখন লুঙ্গি আর টিশার্ট দেয়া হবে রিজভীকে রাতে পরার জন্য।
রিজভী স্মৃতির ঘরে ঢুকে বসে আছে বিছানায়। স্মৃতি বাহিরে ছিল মাত্রই আসল সাথে করে রিজভীর জন্য লুঙ্গি টিশার্ট এনেছে। মা এগুলোই দিয়েছে। এসে দরজার সামনে থেকে দু’জনের চোখাচোখি হলো। ধুক করে উঠল দু’জনের বুক। তাকিয়ে রইল কিছু পল। স্মৃতি লজ্জায় মাথা নূয়ে ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিল। রিজভী সালাম নিয়ে ফেরত সালাম দিল। স্মৃতি সালামের জবাব দিয়ে মায়ের বলা কথাগুলো বলল আর রিজভীকে চেঞ্জ করতে বলল৷ রিজভী সবটা শুনে বলল,
” সমস্যা নেই। এতেই চলবে৷ নিজেই ভাবিনি আজই আমার বিয়ের কপালটা খুলে যাবে। এখন লুঙ্গি পরে শ্বশুরবাড়ি তাও আবার বউয়ের ঘরে থুরি বাসর ঘরে রাত কাটাব।”
রিজভীর লাগাম ছাড়া কথা শুনে স্মৃতির পুরো অন্তর, কায়া কেঁপে উঠল। হাতুড়ি পিটা শুরু হলো বুকে। কিছু বাড়ি দিচ্ছে বুকে। লজ্জায় কান, মুখ লালাভ হয়ে উঠল। শিউরে ওঠল শরীর। কাটার ন্যায় বিঁধল লোমগুলো। রিজভী হাসল। আপাতত বউকে লজ্জা দেয়া থেকে দূরে রাখল। স্মৃতির হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে বিছানায় রেখে স্মৃতিকে কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ইমোশনাল হয়ে উঠল দু’টি মন। স্মৃতি শব্দহীন কেঁদে দিল। এই জড়িয়ে ধরাতে আবেগ ছিল। রিজভী বুঝিয়ে দিল তা স্মৃতিকে। অনেক সাধনা করে পেল তার রসমালাইকে। স্মৃতি বুঝে রিজভীর শার্ট খামচে ধরল। মিশে যেতে চাইল রিজভীর বুকে। ছাড়বে না আর। ছাড়লেই যদি হারিয়ে যায়? স্মৃতি কান্না করতে করতে মিষ্টি কন্ঠে বলল,
” স্বপ্ন, স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। কল্পনাও করিনি আজ আপনাকে পাব। পরিবার সব সময় শাসনে রেখেছেন। দাদি সব সময় নরম থাকতে বলেছেন, ব্যবহার নরম রাখতে বলেছেন, উগ্রতা হতে দেন নি। সব সময় জানিয়েছেন মেয়ে মানুষ নরম মাটি হয়ে থাকতে হয়। এই সব ছোট থেকে পেয়ে পেয়ে নিজের ভালো, মন্দ কোনো মন্তব্য, মত দিতে পারিনি৷ রাগী বাবার উপর জোর খাটানোর সাধ্যি আমার ছিল না৷ চাচুও এক কথার মানুষ। বাড়িতে দাদি যা বলবেন তাই। এসবের বাহিরে আমার ক্ষমতা ছিল না কিছু বলার। অনেক সময় মত দিতে পারতাম অনেকসময় পারতাম না৷ মা যদিও একটু সুযোগ দিতেন কখনো সাহস করতেন না বাবার উপর৷ আমারও ইচ্ছে অনেক লেখাপড়া করার। কুয়াশা ল’ পড়তে চায় শুনে ইচ্ছে করে কিন্তু কখনো বাড়িতে জানায়নি এসব৷ যদি না মানে? যদি বলে, মেয়ে মানুষের এত কিসের লেখাপড়া? লয়ার হয়ে কী হবে?
সেই তো শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খুন্তা নাড়াতেই হবে৷ আমার বড় চাচুর বড় মেয়ের ডক্টর হবার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু দাদি পড়তে দেননি৷ অযথা নাকি টাকা নষ্ট! আর দেখেন না আমার বছর যাবত বিয়ের দেখাশোনা চলত অথচ আমি জানতামই না! কতটা হেলাফেলা মনে করেন আমাকে! বড় ভাইয়ারাও বাবার মতো শাসন করে রাখেন। বাড়িতে এসে যখন এসব শুনলাম বিশ্বাস করেন পুরো পৃথিবীই ঘুরে গেছিল আমার। ভেবেই নিয়েছিলাম আমার আর পাওয়া হবে না আপনাকে। আমি শিশির ভাইয়ার কাছে চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব৷ ভাইয়া না থাকলে এসব হতো না বোধহয়। ভাইয়ার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সত্যি অমায়িক। সবদিকে হ্যান্ডেল করে নিল। আর আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। তিনি আমার ভাগ্যে আপনাকে লিখেছিলেন৷ শিশির ভাইয়ার মাধ্যমে আমাদের এক করে দিলেন। ”
কান্না করতে করতে কথাগুলো বলল স্মৃতি। রিজভী সবটা শুনল। সে-ও শিশিরের কাছে কৃতজ্ঞ। বন্ধু সে পেয়েছে কপাল করে। আল্লাহ এমন বন্ধু কয়জনের দেন? আজ যদি আল্লাহ সহায় না হতেন? শিশির যদি রাজি না করাতে পারত? তাহলে কী হতো? ভাবতে ভাবতে স্মৃতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। স্মৃতি আরো কিছুক্ষণ কাঁদল। রিজভী স্মৃতিকে বুক থেকে তুলল এবার। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
” কেঁদো না আর৷ আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন৷ আমাদের পথ চলা দীর্ঘ হয়েছে। যতকাল বাঁচব একে অপরকে আঁকড়ে ধরে, আগলে রেখে বাঁচব। আমরা একে অপরের নিয়তিতে ছিলাম এই জন্যই তোমার পরিবার মেনেছেন। না মানলেও আমরা এক হতাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করব চলো। ”
থামল রিজভী। আবার বলল,
” আর তুমি পড়বে। তুমিও ল’ নিয়ে পড়বে। আমি পড়াব তোমায়। সব রকম সুযোগ পাবে তুমি। এখন তুমি আমার অধিকার। তোমার ঐ বুড়ি দাদির কোনো জারিজুরি খাটবে না আর। আর না তোমার ঐ খারুচ বাপ, চাচার। ”
স্মৃতি হেসে ফেলল রিজভীর শেষ কথাগুলো শুনে। তবে পড়াবে শুনে খুশি হলো। আবার জড়িয়ে ধরল রিজভীকে৷ রিজভীও আগলে নিল মিষ্টি বউকে। স্মৃতি বলল,
” ফ্রেশ হয়ে আসেন৷ ”
রিজভী সম্মতি দিয়ে চলে গেল। স্মৃতি ঘরের দরজা আঁটকে দিল৷ কিছুক্ষণের মাঝে রিজভী এলো। গোসল করেছে। সারাদিন পর কেমন যেন লাগছিল৷ শরীর ঘেমেও চিপচিপ করছিল। সকালে গোসল করে বেড়িয়েছিল। সে শুধু লুঙ্গি পরে বেড়িয়েছে৷ স্মৃতি সেদিকে দেখে শরীর হিম হয়ে গেল। নগ্ন শরীর রিজভীর৷ ছেলেটা অমায়িক, সুদর্শন। রিজভী ভালোভাবে চুল মুছে তাকাল বউয়ের দিকে। স্মৃতির অবস্থা বুঝে হাসল ঠোঁট টিপে। বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল,
” এখনি হিম হলে হবে মিষ্টি রসমালাই? রসমালাই তো এখনো ছুঁয়েই দেখলাম না!”
এই লোকটা পাক্কা ফাজিল। শুধু লজ্জা দেয়। আজ কয়টা মাস এসব শুনে সয়ে গেছে সে। তাই কিছু মনে না করলেও লজ্জা আজ বেশি করছে কেন যেন। আবার গাল লালাভ হয়ে উড়ল। রিজভী হাসল অমায়িক। টিশার্ট পরতে পরতে বলল,
” ওজু করে আসো। নামাজ পড়ব ”
স্মৃতি সম্মতি দিয়ে চলে গেল৷ কিছুক্ষণ পর ওজু করে এলো। দু’জনে নফল নামাজ সহ তাহাজ্জুদ পড়ে নিল৷ আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করল সাথে এই নতুন জীবনের সূচনা যেন হাজার বছরের দীর্ঘ হয় সেই দোয়াও করল। দু’জন নামাজ শেষ করে উঠল৷
রিজভী এবার বিছানায় বসে স্মৃতির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল৷ সে মিররের সামনে নিজের কাজ করছে৷ মেয়েটাকে শাড়িতে অসাধারণ লাগে। এই শাড়ির জন্যই তো সেদিন মেয়েটার উপর সে পিছলিয়েছিল৷ পুরোই রসমালাইয়ের ডিব্বা৷ লাল টুকটুকে একটা সিল্ক শাড়ি পড়েছে স্মৃতি। লম্বা দীঘল কাল চুল গুলো খোঁপা করা। পিছনে ঘাড়ের উপর বড় সড় বল হয়ে আছে খোঁপার জন্য৷ শরীরে টুকটাক ছোট ছোট সোনার গহনা। রিজভীর বাড়ি থেকে কিছুই আনেনি। শুধু আঙটি এনেছিল রিজভীর মা৷ বিয়ের কিছুই ভাবনায় ছিল না৷ রিজভীর মা ছেলে বউকে পরে সব দিবেন জানিয়েছেন৷ হঠাৎ বিয়ের আর কি’বা হয়!
রিজভী উঠে গিয়ে স্মৃতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল৷ খোঁপা চুল গুলো দিল ছেড়ে৷ ঝরঝর করে ছড়িয়ে পড়ল পুরো পিঠ, কোমড় বেয়ে। কোমড়ের নিচে চলে গেল। রিজভী দেখে অভিভূত হলো। এদিকে স্মৃতি জমে আছে। রিজভী তার পেটে হাত রেখেছে তাও আবার নগ্ন পেটে৷ শাড়ির আঁচলের নিচ দিয়ে। ভেতর পর্যন্ত জড়িয়ে আসছে৷ রিজভী চুল দেখে বলল,
” তোমার এই চুলগুলো আমার ভীষণ প্রিয় জানো! শিশিরদের বাড়ি থেকে দেখেছিলাম প্রথম৷ এত সুন্দর চুল আমি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম৷ ”
স্মৃতি লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে মাথা নূয়ে নিল৷ স্মৃতি রিজভীর কাঁধের অনেকটা নিচে লম্বাতে। তবে সেটাতে রিজভীর কোনো ভাবান্তর নেই৷ তার ছোট খাটো গুলুমুলু রসমালাই সে৷ এত মিষ্টি কেন মেয়েটা? রিজভী কিছুক্ষণ মিররে দেখল স্মৃতির নূয়ে রাখা বদনখানি। এরপর কোলে তুলে নিল হঠাৎ। স্মৃতি চমকে উঠল। গলা জড়িয়ে ধরল ভয়ে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
” আরেহ্ করছেন কী? ভয় পেয়ে গেলাম একদম!”
” আরো পাও ভয়। আমি তোমার ভয়ই দেখব আজ। কিন্তু আজ ছাড়ছি না আমার রসমালাইকে। রসমালাই আজ আমি খাবই। সুযোগ করে দিল আমার খারুচ শ্বশুরমশাই, সেই সুযোগ হাতছাড়া করব আমি? আমিই বোধহয় প্রথম যে পরীক্ষার হল থেকে বেড়িয়ে প্রেমিকার বাড়িতে এসে বিয়ে করে আবার সেই শ্বশুর বাড়িতে বাসর করব তাও আবার লুঙ্গি পড়ে। ভাবা যায় কী কপাল আমার! ”
বলে রিজভী দাঁত বের করে দুষ্টু চোখে দুষ্টু হাসল। স্মৃতি জমে ক্ষীর। তার ভেতরে তুফান শুরু হয়েছে৷ হাপরের মতো ওঠা নামা করছে বুক৷ লজ্জায় না পেরে রিজভীর বুকে মুখ গুঁজে দিল। সুখ সুখ লাগছে তার। প্রজাপ্রতির ন্যায় উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। রিজভী দেখে এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। হেসে নিয়ে স্মৃতিকে কোলে নিয়েই বিছানায় বসল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে স্মৃতির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
” আমার রসমালাই কী শুধু লজ্জায় নূয়েই থাকবে নাকি একটু টেস্টও করতে দেবে? পুরো ডিব্বা কোলের উপর নিয়ে বসে আছি। সামনে রেখে অপেক্ষা করতে পারছি না তো আর! ”
রিজভীর এরকম লাগামহীন কথায় স্মৃতি বার বার ম-রছে। রিজভীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। মুখ সে তুলবে না৷ আজ এ ছেলে তাকে লজ্জা দিয়ে দিয়েই খু-ন করে ফেলবে নির্ঘাত! মুখ তুলে তাকানোর ক্ষমতা নেই তার। রিজভী বুঝে সে এবার নিজে থেকে বউয়ের মুখ তুলল৷ তাকাল মুখের দিকে। স্মৃতির চোখ বন্ধ। আদেশের সুরে বলল,
” তাকাও আমার দিকে! আর দ্বিধা থাকলে বলো আমাকে। আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আমি অপেক্ষা করব৷ ”
স্মৃতি এবার চটজলদি চোখ খুলে তাকাল রিজভীর চোখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নেশায় বুদ হয়ে উঠল সে। তার স্বামী এখন এই ছেলে। ভালোবাসা এতগুলো মাসের যেখানে সাধনা করে পেয়েছে সেখানে বাঁধা মানা কিসের? তারা এক হতে পারলে অন্তরের জ্বালা মিটবে।
স্মৃতি সম্মতি বোঝাতে রিজভীর গলা আঁকড়ে ধরল৷ আরেটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইল৷ রিজভীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভালোবাসি খুব।”
রিজভী সম্মতি তো পেলোই সাথে খুশিও হলো। এ মেয়ের মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা বের হওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া৷ এটা নিয়ে দু’বার বলল স্মৃতি ভালোবাসি৷ রিজভী মুচকি হেসে স্মৃতিকে আরো টেনে নিল। স্মৃতির নগ্ন,নরম পেটের মাঝে হাত গলিয়ে শক্ত করে ধরল। ঝুঁকে স্মৃতির ঠোঁটে ঠোঁট দিল। স্মৃতি রিজভীর ঘাড় আঁকড়ে ধরে সম্মতি দিল৷ রিজভী স্মৃতির পেট খামচে ধরল। গুঙিয়ে উঠল সে। কিন্তু রিজভী আরো গভীর হলো। তার ছোঁয়া, চাওয়া সব গভীর হতে লাগল। স্মৃতি সামলাতে ব্যস্ত হলো অস্থির স্বামীকে।
রিজভী অবশেষে পেল তার রসমালাইকে পূরোপুরি রূপে। আজ থেকে কোনো বাঁধা নেই। তাদের প্রণয়ের পরিণয় হয়েছে। তাদের প্রণয়ের পূর্ণতা পেয়েছে। মিলেছে তাদের নিয়তি। এক সুত্রে বাঁধা পড়েছে তারা৷ ভালোবাসা সফল হয়েছে তাদের৷ আজবীনের সঙ্গী হয়েছে দু’জন৷ এখন তারা অর্ধাঙ্গ-অর্ধাঙ্গিনী।
এদিকে কুয়াশা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সেই কখন থেকে সে হেসেই চলেছে। সেই হাসি যেন থামাথামির নাম নেই৷ বিছানার মাঝখানে বসে থেকে থেকে দম ফাটা হাসিতে মত্ত হচ্ছে সে। আর শিশির বিরক্ত মুখে চোখ-মুখ কুঁচকে বউয়ের হাসি দেখে যাচ্ছে৷
কুয়াশার হাসির কারণ শিশিরকে লুঙ্গি পরা অবস্থায় দেখে৷ স্মৃতির বাড়ি থেকে শিশিরদের আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে। রাতে শোবার জন্য শিশিরকেও লুঙ্গি দেয়া হয়েছে। মূলত যখন থেকে শিশিরকে লুঙ্গি পরে বের হতে দেখেছে তখন থেকে তার হাসি সঙ্গী হয়েছে।
আসলে শিশির লুঙ্গি বেশি পরে না৷ সে বাড়িতে থাকলে টাউজার পরেই থাকে আর রাতেও সেটা পরেই শোয়। লুঙ্গি খুব প্রয়োজন ছাড়া ইউজ করে না। ঘরের বাহিরে তো একদমই না৷ তার নাকি আনইজি লাগে। আর বিয়ের পর লুঙ্গি পড়াও হয়নি। সেই জন্য কুয়াশা এখন লুঙ্গিতে দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আগে পড়েছে কিনা কুয়াশার সেসব মনে নেই। বড় হওয়া অবধি আজ প্রথম দেখল। কিন্তু কুয়াশার কাছে নাকি খুবই হাস্যকর লাগছে লুঙ্গিতে শিশিরকে।
শিশির কটমট করছে বউয়ের কার্বার দেখে। আশ্চর্য পাগলের পাল্লায় পড়ল তো! লুঙ্গিই তো পরেছে সে! এখানে হাসির কি আছে এত? অদ্ভুত!
না পেরে দিল ধমক। বলল,
” এ্যাই! থামবি তুই?”
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল,
” থামছে না হাসি। সিরিয়াসলি তোমাকে সেই লাগছে! আসো একটা ছবি তুলে দিই।”
শিশির কুয়াশার মাথায় এবার জোরে সোরে চাটি বসাল৷ কুয়াশার হাসি এবার আপনাআপনি পালাল। কথায় আছে না? মাই-রের আগে ভূত পালায়! ঠিক তেমন। শিশির বলল,
” ফাজিল, থামেনা বলে তোর হাসি? মা-রের আগে ভূত পালায়৷ তোকে চব্বিশ ঘণ্টা মারের উপরই রাখতে হবে। ”
কুয়াশা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে শিশিরের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। শিশির আবার বসাল চাটি। এবার রেগে গেল কুয়াশা। মানে তার কাছে হাস্যকর লেগেছে বলে সে হেসেছে! সেটাও আবার তারই মুখে। তো এই বুনো ওলের কী খসে পড়ল তাতে? যার জন্য মারতে হবে! রেগে বলল,
” বদমাইশ লোক। আমার হাসি পেয়েছে তাই হাসছি৷ এখানে মারার কি হলো? বেয়াদব।”
শেষ কথাটা বলতে বলতে আধশোয়া হয়ে বসে থাকা শিশিরের চুলগুলো দিল আচ্ছা মতো টেনে। শিশির দু’হাত দিয়ে কুয়াশার হাত ছাড়িয়ে নিল। রাগ নিয়ে তাকাল। বলল,
” ফাজিল, হাসছিস তুই আমার উপর। আর আমি ছেড়ে দেব? ওরা এখন লুঙ্গি পরতে দিল। এখানে আমি টাউজার কই পাব গোবর ঠাঁসা? এতে তোর হাসতে হচ্ছে কেন এত? ”
” কখনো দেখি নি তাই। ”
” কেন তুই তোর স্বামীকে ছোট থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিস অথচ লুঙ্গি পরা দেখিস নি? ”
কুয়াশা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। বলল,
” ধুর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আর বড় হয়ে একদিনও দেখিনি ”
শিশির ভাবল। সত্যি সে তো! কখনো বাহিরে লুঙ্গি পরে বেরই হয়নি। আর সে কেন? কোনো ভাই-ই না। বেশি একটা লুঙ্গি পরে বেরোই না। বাবা, চাচু পরে শুধু। আর তুষার, তুহিন ভাই মাঝে মাঝে পরে বের হয়। নীহারও কখনো লুঙ্গি পরে না। বলল,
” হ্যাঁ, তা ঠিক। আমি লুঙ্গি পরে বের হয়না৷ প্রয়োজনে পরি। বিয়ের পর পরিও নি। আর যখন মস…..”
থেমে গেল৷ বিব্রত হলো শিশির। কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। জিজ্ঞেস করল,
” কি?”
শিশির নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” না মানে, যখন লুঙ্গি পরার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল তখন তোর জন্মই হয়নি। আর হলেও ছিলি লেদা বাচ্চা। দেখবি কি করে? ”
কুয়াশা খুবই লজ্জা পেল৷ কী জ্বালা! বউয়ের বড় হওয়া দেখেছে! শিশির বুঝে হাসল ঠোঁট কামড়ে। কুয়াশার পেট ধরে উঁচু করে তুলে বসিয়ে নিল নিজের ঊরুর উপর। সে আধশোয়া অবস্থায় বসে। কুয়াশার ঠোঁটে লজ্জা মাখা হাসি ঝুলছে এখনো। শিশির তা দেখে বলল,
” কী ভাগ্য আমার৷ বউয়ের জন্ম হবার পর থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত দেখলাম। তুই নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছিলি তাও আবার রাতে। আমার খুব বেশি কিছু মনে নেই৷ তবে চার বছর বয়সের স্মৃতি কিছু কিছু মনে থাকে। আমারও আছে৷ রাতে তো আর জেনেছিলাম না যে বউ আমার পয়দা হয়েছে। ”
শেষ কথাটু্ুকু বলতে গিয়ে শিশির নিজেই হেসে ফেলল। কুয়াশা তা শুনে ফুঁসে উঠল। কয়েকটা কি-ল, ঘু-ষি, চা-প্পড়, থা-প্পড়ও ফ্রিতে খেল বউয়ের হাতে। সেগুলো দিয়ে কুয়াশা ক্ষান্ত হলো না। শিশিরের চুল ধরে টেনে দিয়ে বলল,
” ইতরমার্কা লোক। ”
শিশির হেসে কুটিকুটি হচ্ছে কথাটা ভাবলেই। হেসে নিয়ে আবার বলল,
” আরেহ্ শুনবি তো গল্পটা! ”
বলে সে আবার বলা ধরল,
” তো সকালে যখন শুনলাম বউ আমার পয়দা হয়েছে তখন কিছু বুঝেছিলাম না৷ তারপর যখন তোকে দেখলাম ছোট আম্মুর কোলের মাঝে শুয়ে ফ্যালফ্যাল করে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছিস, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলি তখন বুঝলাম তোর কথা বলেছে সব৷ সকলের আদিক্ষেতা দেখে আমি রীতিমতো বিরক্ত। ভাবছিলাম, আজব! এত নাচানাচির কী আছে সকলের? তোকে নিয়ে সব আমদে-আহ্লাদে মাতল। আমার পাত্তা আর কেউ দিচ্ছিল না৷ রাগে ফুঁসতাম। আমার আদর সব তুই নিয়ে নিলি৷ তোকে নিয়ে সকলে ব্যস্ত হলো৷ এর কোল থেকে ওর কোলে ঘুরতে লাগলি। আমি যে কী ঐ বাড়ির তাই-ই সকলে ভুলে গেল৷ ছোট চাচু আমি বলতে পাগল ছিল অথচ তুই হতে না হতেই তোকে নিয়ে আদর করা শুরু করল। আমাকে আর বেশি আদর করত না। নীহার ভাই তোকে কোলে করে নিয়ে নিয়ে বসে থাকতে লাগল। সে তোর কাছ থেকে উঠবেই না ভাবটা এমন। ও তো ছোট ছিল তবুও ও কী বুঝেছিল কে জানে! কিন্তু আমার কেন যেন তোর উপর রাগ ছাড়া কিছুই আসছিল না৷ আমাকে কেউ বেশি কোলে নিত না আর, আদর করত না। ভাইরা তোকে নিয়ে ঘুরত৷ এসব দেখে দেখে ছোট্ট আমি খুব হিংসা করতাম৷ এরপর থেকে তুই যত বড় হতে লাগলি তত হিংসা হতে শুরু করল৷ কারন সকলে তোর গুণগানে পঞ্চমুখ৷ কিউটের ডিব্বা হয়েছিলি নাকি৷ কিন্তু তোকে তো আমি তাকিয়েও দেখতাম না। দেখলেই মা-রতে ইচ্ছে করত। তোকে আমার কাছে পেত্নীর থেকে কম কিছু লাগত না ”
এইটুকু বলতে না বলতে আবার খেল মার৷ বুকের উপর কিল খেল বউয়ের হাতে৷ শিশির ‘আহ্’ করে উঠে হাসল আবার৷ বলল,
” আরেহ্ আগে তেমন কিছুই মনে হতো আমার। তোকে সহ্যই করতে পারতাম না৷ ভাইরা যে আদিক্ষেতা তোকে নিয়ে করত বাবাহ্ রে বাবাহ্! যেন মেয়ে আর কারো বাড়ি নেই! হ্যাঁ, যদিও একটা মেয়ে ছিলি তাও তোর জন্য কেন অন্যর আদর কমাতে হবে?”
কুয়াশা শিশির বুকের উপর এবার শুয়ে পড়ল ঊরুর উপর বসে থাকতে থাকতে৷ শুয়ে শিশিরের বুকে কামড় দিল আলত করে। বলল,
” হিংসুটেএকটা তুমি। আর আদর কমেছিল না তোমার। শুধু আমার আদর বাড়িয়েছিল বলে তোমার এমন মনে হতো। ”
” হ্যাঁ, কিন্তু তখন তো ছোট ছিলাম। ওসব কী বুঝতাম নাকি? ”
কুয়াশা উত্তর করল না৷ শিশির কুয়াশা চুল কানের পিঠে গুঁজে দিল। ডান হাতটা তুলে কুয়াশা গালে রেখে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ঠোঁটের পাশে স্লাইড করতে লাগল। করতে করতে বলল,
” তোকে তো বিয়ের পর থেকে অন্য রূপে অন্য চোখে দেখা ধরলাম। বিয়ে না হলে বোধহয় আজীবন হিংসার পাত্রীই থাকতি। কিউটের ডিব্বা তোকে বিয়ের পর মনে হয়েছে৷ আগে যদি জানতাম সেদিনের ঐ কাপড়ের টুকরোর মাঝে শুয়ে বড় বড় চোখ দু’টো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা ইট্টুখানি মেয়েটা বউ হবে আমার তাহলে বোধহয় হিংসা না করে সেদিন থেকেই আদর করা শুরু করতাম। ”
কুয়াশা আবার একটা কি-ল বসাল বুকে। লজ্জা পেয়ে হাসল। সে নিজের চিবুকের নিচে দুই হাত মেলে হাতের পিঠে ভর দিয়ে শিশিরের উপর শুয়ে আছে আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনছে৷ শোবার কায়দাটা এমন যেন সে বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে বই পড়ছে৷ ভাবে লাগছে শিশির ওর বিছানা। শিশির গল্প বলছে আর কুয়াশার দিকে তাকাচ্ছে। কুয়াশা বলল,
” ভালোই হয়েছে হিংসা করে। তোমাকে ছোট থেকে কামড়াতে তো পেরেছি! ”
বলে খিলখিল করে হাসল সে৷ শিশির বলল,
” তাই না? বেয়াদব আবার গলাবাজি করে বলছিস? মেয়ে ছিলি আর সম্পর্কে বোন হতি৷ নয়তো তোকেও দেখাতাম কামড় কত প্রকার৷ ”
” হ্যাঁ, এখনতো ঠিকই দাও”
এই কথায় শিশির কুয়াশাকে টেনে নিল উপরে৷ মুখোমুখি করল কুয়াশাকে। বলল,
” এখন তো তুই আমার লিখিত জিনিস। বোনটোন আছিস নাকি আর? বউ এখন৷ আর বউয়ের উপর স্বামীর জোর কত এবার ভাব! ”
কুয়াশা মুচকি হেসে শিশিরের গলার মাঝে মুখ গুঁজল। চুমু আঁকল সেখানে৷ ধারাল দাঁত দিয়ে শিশিরের গলার চামড়াতে ছোট ছোট দু’টো কামড় দিল ইঁদুরের ন্যায়। শিশির টের পেল সব। বলল,
” ওহ্ তোর তো চুমুর বর্ষণ ঘটানোর কথা। নেহ্ শুরু কর তোর চুমুর বর্ষণ। তখন নাচতে নাচতে এসেছিলি চুমুর বর্ষণ ঘটাতে। এখন শুরু কর। ”
কুয়াশার নিজের কপালে নিজেরই চাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করল। কোথায় ভাবল ভুলে গেছে হয়তো৷ মুখ তুলে বলল,
” আরেহ্ আনন্দে বলেছিলাম। সকলের মুখে আমার স্বামীর গুণগান শুনে৷ আমার গর্ব হচ্ছিল তাই সেই গর্ববোধ থেকে তোমাকে চুমু দিতে ইচ্ছে করছিল৷ ”
” তো এখন দে সেই গর্ববোধ থেকে৷ মানা করছে কে?”
কুয়াশা বিরক্ত হলো। বিরক্ত নিয়ে নেমে যেতে নিল। শিশির নামতে দিল না৷ ফিসফিস করে বলল,
” হানিমুনে যাচ্ছি আমরা। আট দিন পর একটা পরীক্ষা আছে৷ ওটা দিয়ে দুইদিন পরেই রওনা দেব। তোর পরীক্ষাও এই সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।”
কুয়াশার বুকে বাড়ি লাগল হানিমুন শব্দটা৷ তাকাল শিশিরের দিকে৷ অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। শিশির আবার বলল,
” সাজেক যাচ্ছি। ভেবেছিলাম কক্সবাজার যাব। কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছি। আরো পরে যেতাম কিন্তু এখনই যাব। আমার আহ্লাদী বউকে নিয়ে সাজকের মেঘের রাজ্যে ডুবব। ”
থেমে কানের কাছে মুখ নিয়ে কানের সাথে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে বলল,
” শুধু মেঘের রাজ্যে না আমার আদরের রাজ্যেও ঘুরাব তোকে, রেডি হ গোবর ঠাঁসা। এবার আর ইতিউতি শুনব না তোর”
কুয়াশার বুকের মাঝে ধুকপুক করতে লাগল৷ শিশিরের বুকে মাথা রাখল৷ শিশির আবেশে শক্ত হাতে ধরল বউকে বুকের সাথে। মাথার চুল সমেত চুমু আঁকল।
হসপিটালে সকলে জাকির মালিথাকে নিয়ে ছুটা ছুটি করছে৷ সকলে কেঁদে কেটে অস্থির।
ঠিক সে-সময়ে নীহারের ফোনে কল এলো অপরিচিত নাম্বার থেকে। আর কল পাবার সাথে সাথে ওপাশের কথা শুনে আপনা আপনি নীহারের পা জোড়া ভেঙে পড়ে গেল। বসে পড়ল ফ্লোরে। শরীর হিম হয়ে এলো। তুহিন দৌড়ে নীহারের কাছে এসে বলল,
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫০+৫১
” নীহার! ভাই ঠিক আছিস তুই? ”
নীহার ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল ভাঙা ভাঙা কন্ঠে,
” ভাই, শিশির…! ”
