বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৭৭
রোজা রহমান
শিশির কুয়াশাকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। কুয়াশা ব্যথায় ছটফট করছে শিশিরের বুকের কাছকার টিশার্ট হাতের মুঠোর মাঝে মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলার পণ করেছে। অন্যহাতে পিঠের উপর খামচে ধরে আছে৷ মরণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে৷ সহ করতে পারছে না আর। শিশির একটা একটা করে সিঁড়ি অতি নিপুণতায় অতিক্রম করছে। কুয়াশা এবার ব্যথা সহ্য করতে না পেরে শিশিরের কাঁধ বরাবর বুকের কাছটায় কামড়ে ধরল।
ব্যথা যতটা যন্ত্রণাদয়ক সেটা সহ্য করতে শিশিরকে কামড়ে ধরেছে তার মানে কতটা জোরে ধরতে পারে!! শিশির থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য মাঝের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কামড়টা হজম করে নিল৷ কিন্তু কোনো রা করল না। একপল তাকাল কুয়াশার দিকে। পিঠ, বুক ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে, টিশার্ট ছিঁড়ে দিচ্ছে। শিশির সেদিকে আর নজর না দিয়ে সিঁড়িগুলো অতিক্রম করল৷
বড় বড় কদম ফেলে টান পায়ে বাহিরে এম্বুলেন্সে তুলে দিল৷ সে-ও বসে পড়ল৷ জাকিয়া, আজমিরাও উঠলেন৷ আম্বিয়া রয়ে গেল। বৃষ্টি, ইয়াসমিন, শশীরাও রইল। জাকির মালিথা শিশিরকে শক্ত থেকে অভয় দিলেন যেন কোনো পরিস্থিতিতে ভেঙে না পড়ে।
তুহিন, হিম বাইকে গেল৷
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রাত প্রায় বারটার দিকে হসপিটালে পৌঁছাল ওরা৷ পুপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে এম্বুলেন্স থামলে শিশির নেমে আবার কোলে করেছে কুয়াশাকে। অবস্থা করুণ মেয়েটার। ব্যথায় অজ্ঞান হবার জোগাড়। তুহিন, হিম বাইকে করে আগেই এসে ইমারজেন্সিতে ডক্টর ঠিক করেছে৷ শিশির কুয়াশাকে নিয়ে এলেই কুয়াশাকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে নিল৷ নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করবে আগে।
শিশির কুয়াশাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চুল খামচে ধরল। তুহিন এসে পাশে দাঁড়িয়ে ভাইকে জড়িয়ে নিল। জাকিয়া ছেলেকে আশ্বাস দিলেন আল্লাহ সব ভালো করবেন৷ বলে আবার বললেন,
” আয় বোস আব্বু৷ কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার আব্বু অনেক স্ট্রোং। ”
আজমিরাকে হিম সামলাচ্ছে। জাকিয়া শিশিরকে নিয়ে পাশে বসল। মাকে পাশে পেয়ে যেন একটু মনের জোর পেল সে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মা’কে। বলল,
” আম্মু ও কী বলল দেখলে তোহ্? ও ওমন করে কি করে বলতে পারল? আমার দম আটকে আসছে৷ কেমন অস্থির লাগছে। আম্মু তোমাদের ঐ আহ্লাদীকে ছাড়া আমার একটুও চলবে না৷ তবুও ওসব বাজে কথা বলল, কেন ওমন বলল আম্মু? ”
অতিরিক্ত শান্ত কথা কিন্তু গভীর ব্যথাময় কথাগুলো। তার বুকের ভেতর দগ্ধ হচ্ছে। বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভেতর পর্যন্ত কাঁপছে। তার চোখের শুধু তার আহ্লাদী বউয়ের ব্যথায় নীলবর্ণ ধারণ করা মুখটা ভাসছে। সে যদি ব্যথানাশক ওষুধ হতো তাহলে বোধহয় তখন তার আহ্লাদী বউয়ের ব্যথা কমিয়ে দিত। একটু সহ্য হচ্ছে না৷ মা’কে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। জাকিয়া এই সময়ে ছেলের কষ্টের ঢাল হলেন। ছেলেকে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বললেন,
” শান্ত হ আব্বু। পাগলীটা ব্যথা সহ করতে না পেরে ওভাবে বলেছে। ঐ সময় মৃত্যু সমান যন্ত্রণা হয় রে। আমি তো মা হয়েছি, আমি জানি৷ মা হওয়া যেমন যন্ত্রণাদায়ক তেমনই সুখদায়ক। এত এত যন্ত্রণা সন্তানের মুখ দেখলে সব নিমেষেই শান্ত হয়ে যায়। ”
শিশির শুনে আরেকটু শক্ত করে ধরল৷ সময় জলদি যাক। আর নেয়া যাচ্ছে না এত কষ্ট।
ঘন্টা খানেকের মাঝে বাহিরে নার্স এলো৷ শিশির, হিম, তুহিন নার্সকে দেখে লাফিয়ে ওঠার মতো উঠে সামনে গিয়ে প্রশ্ন করল। শিশির কিছু বলতে যাবে তৎক্ষনাৎ নার্সটা বলল,
” বি নরমাল, এভ্রিথিং ইজ ওকে৷ প্রেশেন্টের নরমাল ডেলিভারিই হয়েছে এবং বাবু ও মা দুই জনই সুস্থ আছে। ”
শ্রবণ হতেই শিশিরের যেন শরীর ছেড়ে দেওয়ার মতো নিঃশ্বাস এলো। সকলের মুখে হাসির ফোয়ারা ফুটল। একসাথে বলে উঠল,
” আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ”
শিশির লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করল আল্লাহ্’র কাছে৷ এতক্ষণ বুকে যেই ব্যথাটা ছিল সেটা যেন নিমেষেই গায়েব হয়ে গেল৷ পাথর নেমে গেল বুক থেকে৷ চোখ মুখ ঝলমলিয়ে উঠল৷ চোখে, মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে বাবা হয়েছে? আহ্!! কী মধুর ডাক, বাবা! তার ঘরে আলো এসেছে। তাদের ঘর পূর্ণ করে তার সন্তানের আগমন ঘটেছে। হিম বলে উঠল,
” আমি কার মামা হয়েছি? ভাগ্নে নাকি ভাগ্নির? ”
” ও মেয়ে। বাবার প্রিন্সেস হয়ে এসেছে। ”
হিমের প্রশ্নের উত্তর শিশির দিল৷ যদিও হিমও জানত তবুও শিওর হলো। শিশিরের কথায় নার্স হেসে বলল,
” হ্যাঁ মেয়ে হয়েছে। একদম ফুটফুটে। ”
শিশির হাসল। বুকটা শান্তিতে ভরে যাচ্ছে। এই আনন্দ সে প্রকাশ করতে পারছে না। এ অনুভূতি প্রকাশ করার যায় না শুধু অনুভব করা যায়। বুকের বাম সাইটের উপর হাত রাখল সে৷ বিড়বিড়াল,
” আমার প্রিন্সেস, আমার বাবা।”
জাকিয়া আনন্দে বিমোহিত হয়ে গেলেন৷ আজমিরা চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছেন৷ নার্সটি চলে গেল আবার ভেতরে৷
তুহিন বলল,
” অভিনন্দন আমার ভাই! বাবা হয়ে গেলি! ”
শিশির মুচকি হাসল। ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” থ্যাঙ্কিউ ভাই৷ আল্লাহ সব ভালো করেন। তুমিও খুব জলদি বাবা হবে দেখো ”
তুহিন শুনে মলিন হাসল৷ ছেলেটা কম কষ্ট পায় না৷ প্রায় দিনই ইয়াসমিন কান্না করে। কিন্তু আল্লাহ সহায় হচ্ছেন না৷ দীর্ঘ শ্বাস গোপন করল সে। জাকিয়া বললেন,
” আমার ছোট মানিকও আজ বাবা হয়ে গেল? আমি দ্বিতীয় বারের মতো দাদি হলাম? ইশশ এই আনন্দ কী করে প্রকাশ করব? ”
শিশির শুনে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
” অভিনন্দন আম্মু আবার দাদি হলে।”
জাকিয়া হাসলেন। শিশির আজমিরার মুখে পুরো পৃথিবীর আনন্দ দেখল৷ মা’কে ছেড়ে দিয়ে ছোট আম্মুকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
” অভিনন্দন ছোট আম্মু, তুমি নানি হয়েছ।”
আহ্! প্রশান্তিতে ভরে গেল বুকটা। তার সেই সেদিনের মেয়েটা আজ নিজেই মা হয়ে গেল! নিজে হাতে মানুষ করা মেয়েটার জীবনের রঙিন রূপ এসেছে। খুশিতে চোখ ছলছল করছে৷ শিশিরের দিকে তাকিয়ে মুখের উপর হাত রেখে মাথা এগিয়ে এনে চুমু দিলেন কপালে। বললেন,
” অভিনন্দন আব্বু। আমার নাতনির বাবা হয়েছিস। এভাবে তোরা ভরা সংসার নিয়ে সুখী হ সারাজীবন। ”
শিশির হাসল৷ হিম শিশিরকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়ে বলল,
” ভাই মামা হয়ে গেলাম আমি! ”
শিশির হিমের বাহুতে চাপ্পড় দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ”
হিম কথার মাঝে তাকিয়ে দেখল শিশিরের বুকের উপরে কাঁধ বরাবর যেখানে কুয়াশা কামড় দিয়েছিল সেখানে ভিজে উঠেছে। হিম হাত দিয়ে দেখল রক্ত৷ আঁৎকে উঠল। এতক্ষণ কেউ খেয়াল করেনি। আর শিশিরেরও কুয়াশার, বাচ্চার টেনশনে এখানে নজর ছিল না। বলল,
” ভাই রক্ত বের হচ্ছে তোহ্!”
শিশির হাসল শব্দহীন। তার আহ্লাদী বউয়ের কামড়। বউটার তখনকার চিৎকার যেন এখনো কানে ভেসে আসছে। বলল,
” ও কিছু না। সেভলন দিয়ে নেব। ”
হিম বুঝল এটা কুয়াশা করেছে। বড়দের সামনে কথা বাড়াল না৷ বোনটা তার ব্যথার জন্য কামড়ে কতটা জোরে যে রক্তই বের হয়েছে গেছে!
সকলে বাহিরে বসে আছে। অপেক্ষা করছে নতুন অতিথির মুখ দেখার জন্য। হিম বাড়িতে কল করে সব জানিয়ে দিয়েছে৷ শিশির বসে ছটফট করছে৷ বউ, বাচ্চার মুখটা দেখার জন্য। হাজার ভাবনার মাঝে আবারও সেই আগের নার্সটা এলো বেবি কোলে করে নিয়ে৷ তোয়ালের মাঝে জড়ানো ছোট্ট হাত ছোট্ট পা। চোখ বন্ধ করা।
নার্স বেড়িয়ে আসতেই সেদিকে সকলের নজর পড়ল৷ শিশিরের বুকের মাঝে কিছু একটা যেন বাড়ি দিল৷ নার্সের কোলের দিকে তার নজর৷ অপলক সেদিকে দেখছে৷ বুকে সমানে বাড়ি দিচ্ছে। নার্স এগিয়ে এলো হাসি মুখে। শিশির সহ সকলে উঠে দাঁড়াল। হাসি মুখ সবার। শিশির শুকনো ঢোক সহ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল৷ হিম বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ। ”
একে একে সবাই দেখে বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ। ”
শিশির এখনো কাছে যায়নি। জাকিয়া ডাকলেন,
” আব্বু দেখ! ”
শিশির আবেগে ভেসে যাচ্ছে। তার কি যেন হয়ে গেছে৷ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল৷ আর চোখের মানসপটে সব থেকে জান্নাতি সুখ সে দেখল৷ হ্যাঁ, এটাই তো জান্নাতি সুখ! সে এই ছোট্ট হাত, ছোট্ট, পা, ছোট্ট দেহ ওয়ালা বাচ্চাটার বাবা! তার জান্নাত, তার সুখ৷ মেয়ের মুখ দেখতেই ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ফুটল। নার্সটি মেয়েকে এগিয়ে ধরল শিশিরের দিকে৷ জাকিয়ার দিকে শিশির তাকাল। তিনি সম্মতি দিলেন। শিশির দুই হাত বাড়িয়ে দিল৷ নার্সটি কোলের উপর দিতেই সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল সে। হায়!! এ সুখ, এ অনুভূতির ভাষা নেই। চোখটা জ্বলে উঠল কেন যেন৷ অদ্ভুত ভাবে বাচ্চাটি বাবা কোলে নিতেই চোখ মেলে তাকাল৷ শিশির ঐ নজরে আবার কেঁপে উঠল। শিরশির করছে শরীর। মেয়ের চোখের দিকে তাকাল। মেয়েও বাবার দিকে তাকিয়েছে৷ সে বোধহয় বাবাকে সর্বপ্রথম দেখবে বলে এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল ভাবটা এমনই লাগল৷ টানা টানা ছোট্ট চোখের মাঝে আরো সুখ খুঁজে পেল শিশির। ফর্সা ধবধবে মুখটা মা বাবার মতোই গোলগাল। অনেকটা শিশিরের মতো। শিশির জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আম্মু দেখো তাকিয়েছে!”
জাকিয়া টলমল চোখে ছেলের আনন্দ দেখছেন। আজমিরা শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” শিশির আব্বু! তোর মতো হয়েছে একদম। ”
শিশির আবার কেঁপে উঠল। তার মেয়ে, তার রাজকন্যা তার মতো হয়েছে? তার ঝগড়ুটে আহ্লাদী বউটা এটা শুনলে নিশ্চয়ই ঝগড়া করবে? ভেবেই আপন মনে হাসল। হেসে মেয়েকে হালকা উপরে তুলে ঠোঁট ছোঁয়াল কপালে। এরপর দুই গালে। বিড়বিড়াল,
” আমার বাবা, আমার কাছে চলে এসেছে। এবার অনেক আদর দেব তোমায়। ”
বলে গালে গাল জোড়াল। কাঁচুমুচু করে উঠল শিশিরের দাঁড়ি বিঁধে৷ হাতের মাঝে কিলবিল করতে দেখে মুখ তুলে চাইল। হাসল অমায়িক। আজমিরাকে বললেন,
” ছোট আম্মু! কোলে নাও। ”
আজমিরা আনন্দে আটখানা হয়ে উঠলেন। জাকিয়া হাসলেন৷ শিশির আজমিরার কোলে দিল। আজমিরা অনেকটা আদর দিলেন৷ তার স্বামীর কথা মনে উঠে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষটাকে খুব মনে পড়ে। কিছুক্ষণ তিনি রেখে জাকিয়াকে নিতে বললেন। জাকিয়া কোলে নিয়ে আদর দিলেন। আদরের অভাব হবে না, বাড়িতে আরো একটা মেয়ে এলো। সর্বপ্রথম তার মা এখন সে৷ ভেবেই জাকিয়া হাসলেন। তার ছোট মানিকের ঘরের লক্ষ্মী৷ কিছুক্ষণ পর হিম নিতে চাইল। হিম কোলে নিল একমাত্র ভাগ্নিকে। চুমু দিল গালে। মামা হবার অনুভূতিও এক অন্যরকম প্রশান্তি। বলল,
” আমার বুবু ছিল একমাত্র মেয়ে এখন তুমিও হয়ে এলে একমাত্র মেয়ে। আমার মামাটা! ”
বলে গালে গাল লাগাল৷ সকলে মুচকি হাসল। তুহিনও কোলে নিয়ে আদর করল৷ তারও বাবা হবার বাসনা জাগে। আল্লাহ কবে মুখ তুলে চাইবে কে জানে!!
‘
রাত প্রায় একটা কুয়াশা ঘুমাচ্ছে। তাই ভেতরে কেউ যায়নি এখনো৷ শিশির মেয়েকে কোলে করে বসেছিল৷ একটা নার্স এসে বলল,
” প্রেশেন্ট তো ঘুমচ্ছে এখন জাগানোর দরকার নেই৷ মেয়েকে দেন মায়ের কাছে রাখি৷ জাগলে আমরা ইনফর্ম করব৷ ”
শিশির শুনে বলল,
” যদি সমস্যা না থাকে ভেতরে যেতে পারব? ও ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আমি ডাকব না শুধু ও’কে একটু দেখব। ”
নার্সটি কিছু বলবে জাকিয়া বললেন,
” যেতে দেন। ঘুম ভাঙাবে না৷ আপনারা অন্যদিকে যেতে পারেন৷ প্রয়োজন হলে ডেকে নেব আমরা। ”
নার্সটি আর কথা বলল না। সম্মতি দিয়ে চলে গেল। জাকিয়া বললেন,
” ভেতরে যা। ”
শিশির তুহিনকে বলল,
” ভাই আম্মুকে, ছোট আম্মুকে রেখে আসো৷ আমি এদিকে দেখে নেব। প্রয়োজনে নার্সকে ডাকব। আর তোমাদেরও আসতে হবে না। সকালে এসো। ”
জাকিয়া নাকচ করলেন। নাকচ আজমিরাও করলেন। হিম বলল সে থাকবে। তুহিন বলল,
” প্রয়োজন পড়তে পারে। আমি থাকছি। ”
” না ভাই তোমার সকালে অফিস আছে তুমিও চলে যাও। হিম তোরও থাকতে হবে না। সকালে আসিস। এখন সকলে গিয়ে রেস্ট করো। আমি আছি এদিকে। ”
কড়া ভাবেই বলল সে৷ জাকিয়াও ভাবলেন নরমাল ডেলিভারি তেমন সমস্যাও আর হবে না। যতটুকু প্রয়োজন নার্স সহ শিশিরই পারবে। সেটাই জানালেন। আজমিরা এত করে বললেন তিনি থাকবেন কিন্তু শিশির থাকতে দিল না। উপায় না পেয়ে তারা কুয়াশাকে এক ঝলক করে দেখে দেখে বেড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গেলেন। সকালের অপেক্ষা করবেন বাড়ি গিয়ে৷
সকলকে বিদায় দিয়ে মেয়েকে কোলে করে সে ভেতরে ঢুকল৷ দরজার কাছ থেকে কুয়াশার ঘুমন্ত মুখটা নজরে এলো। আহ্ শান্তি..! সে এগিয়ে গেল মেয়ে নিয়ে। মুখটা কিঞ্চিৎ কালো বর্ণ ধারণ করেছে। যে ধকল টা গেল!! তবে মুখটায় অনেক মায়া ছড়িয়ে আছে। চোখটা ফুলে গেছে অতিরিক্ত কান্নার কারণে। মুখে মা মা ভাব এসেছে। হেঁটে কুয়াশার বেডের কাছে দাঁড়াল। ফিসফিস করে মেয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” বাবা, আম্মু ঘুমোচ্ছে আমরা জাগাব না হুম? তোমাকে দুনিয়ায় আনার জন্য কতটা কষ্ট করল আম্মু! তাই এতটুকু তো আমরা করতেই পারি তাই নাহ্? ”
ঘুমন্ত মেয়েও। মা মেয়ে দু’জনেই ঘুমে। শিশির হাসল। আবার বিড়বিড়াল,
” আমার ঘুমন্ত পরীরা ”
পাশে টুলের উপর বসল সে৷ মেয়েকে যত্ন করে ধরে রেখেছে। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল৷ চোখের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। এই মেয়েটা নাকি তাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবে বলেছিল। থাকতে পারত সে? তারও তো নিঃশ্বাস তখনই আঁটকে যেত!! মেয়ে কোলে রেখেই একটু ঝুঁকে বউয়ের কপালে চুমু আঁকল। তার সন্তানের মা এখন এই মেয়ে। সেই ছোট্ট থেকে মা-রা মা-রি, চুলোচুলি করা মেয়েটা! গাঁটিগাঁটি ঝগড়া করত শুধু। ভালোবাসা তো কিঞ্চিৎ পরিমাণেও ছিল না। এখন ভাগ্যর লীলাখেলায় তারা এই পুচ্চুর মা, বাবা। সেই মেয়েটার আর তার এখন ভরা সংসার।
বিড়বিড় করে বলল,
” দেখলি বউ! আল্লাহ আমাদের হাজার জীবন একসাথে বাচার তৌফিক দিয়েছেন। তোকে ছাড়া তো একপলও আমার চলা হবে না৷ আমার এই বুকেই তোকে থাকতে হবে৷ তোর শান্তির জায়গা তোর বরাদ্দ হাজার বছর। তোকে ছাড়া কাকে সেই জায়গা দেব বল তো! ”
থেমে আবার বলল,
” তোকে আগে সহ্য করতাম না এখন তোর এই সব আহ্লাদীপনাগুলোই আমার প্রিয় আমার রোজকার অভ্যাস। চিরন্তন তুই আমার। কলিজায় ফুটো করেছিস মৃত্যুর কথা বলে, সুস্থ হ তোর সেই শাস্তি তোলা রইল!”
বলে ডান হাতটা তুলে নিয়ে চুমু দিল৷ হাতের মাঝে হাত দিয়ে ধরে রাখল৷ কুশার শরীর অতিরিক্ত দূর্বল আর ঘুমের ঔষধেও ঘুমচ্ছে। তাই টের পেল না কিছু।
ডেলিভারির পর মেয়ের মুখ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল সে। তার সকল কষ্ট, যন্ত্রণা নিবারনের ঔষধ।
চারিদিকে আজানের ধ্বনি। ভোর সাড়ে চারটার দিকে শিশির নামাজের জন্য নিচে নেমে এসেছে। সারারাত ঘুমোয়নি সে। নার্স রাত তিনটার আগে এসে মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছিল কুয়াশা ঘুমন্ত অবস্থাতেই ছিল৷ নার্সই হ্যান্ডেল করেছে। শিশির কেবিন থেকে বেরিয়ে হাঁটাহাঁটি সহ কুয়াশার, মেয়ের খেয়াল রেখেছে৷
আজান দিলে বেরিয়ে এসেছে৷ নামাজ আদায় করবে।
ভোর পাঁচটার দিকে আলো ফুটেছে অনেকটা ধরিত্রীপুরে। সে আকাশের দিকে তাকাল মসজিদ থেকে বেরিয়ে৷ তাদের জীবনে আজ থেকে আরো একটা নতুন অধ্যায় শুরু। বেরিয়ে হসপিটালে এলো৷ দোকান পার্ট এখনো ভালোভাবে খুলে নি৷ কফি খেতে হবে। ছয়টার দিকে আসবে ভেবে উঠে গেল। কেবিনের সামনে বসল।
সকাল সাতটার দিকে কুয়াশার ঘুম ভাঙল৷ কেবিনে নার্স আছে। শিশির বাহিরে বসে। ঘুম থেকে উঠে চোখ মিলে আশেপাশে তাকাল৷ এরপর সব মনে হলে পাশে তাকাল৷ দেখল তার কোলের মাঝে এক ঘুমন্ত রাজকন্যা। ছলছল করে উঠল চোখ। দূর্বল শরীরে পাশ ফিরল৷ তার সব ব্যথা, দূর্বলতা যেন গায়েব হলো। মেয়ের শরীরের উপর আলতো করে হাত রাখল। শরীরের অদ্ভুত মাতৃত্ব অনুভব হলো৷ চুমু দিল মেয়ের গালে৷ নার্স দেখে বলল,
” গুড মর্নিং মিসেস কুয়াশা! ”
” গুড মর্নিং। ”
” কেমন লাগছে শরীর এখন? ”
” আলহামদুলিল্লাহ। ”
” আপনার হাজব্যান্ড বাহিরে আছেন। সারারাত তিনি জেগে এবং তিনিই একমাত্র হসপিটালে আপনার জন্য আছেন দেখভালের জন্য। যারা ছিলেন সকলকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ ইউ আ’র ভেরী লাকি গার্ল৷ আপনার প্রতি অনেক যত্নবান তিনি। সচারাচর এমন হাজব্যান্ড খুব কম দেখি। ”
কুয়াশা মুচকি হাসল। বলল,
” ডেকে দেন না একটু! ”
” ও’কে। ”
নার্সটা চলে গেল। কুয়াশা মেয়েকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে শিশির ঢুকল। তাকাল কুয়াশা। নজরে নজর পড়ল৷ অমায়িক হাসল দু’জন। এগিয়ে গিয়ে বসল সে৷ কুয়াশা মেয়ের দিকে তাকিয়ে দূর্বল কন্ঠে বলল,
” আমাদের মেয়ে, অনুভূতি বলো! ”
” উহু, ও আমার মেয়ে ”
কুয়াশা তা শুনে ভ্রু কুঁচকাল৷ শিশিরের ভ্রু জোড়ার মাঝে রাগ দৃশ্যমান৷ কুয়াশা বলল,
” এ্যাই! ও শুধু তোমার মেয়ে কেন হবে? ”
” হ্যাঁ, ও শুধু আমারই মেয়ে।”
” আইছে আমার অধিকার দেখানে ওয়ালা রে.. মৃত্যুর সাথে লড়াই করে জন্ম দিলাম এখন বলে শুধু তার মেয়ে! ”
” তুই না বলেছিলি ফিরবি না আর হেন তেন বলেছিলি… ”
কুয়াশা শিশিরের মুখের কথা পুরো করতে না দিয়ে বলল,
” ঐ সময় মনেই হচ্ছিল মরে যাব৷ ঐ যন্ত্রণার থেকে মৃত্যুই শ্রেয় মনে হচ্ছিল। ”
” ঠাটিয়ে থাপ্পড় দেব বেয়াদব.! এখন কিন্তু মেয়ে চলে এসেছে! তাই মারও হবে নিয়মিত৷ আর একবার বলবি তো এবার আমি নিজে তোকে মৃত্যুর মুখ দেখিয়ে আন।”
কুয়াশা মুচকি হাসল। বলল,
” আমাদের মেয়ে…।”
” বললাম তো ও শুধু আমার মেয়ে..। ”
ক্ষেপে উঠল কুয়াশা৷ রাগী ভাব তুলে বলল,
” এ্যাই, বুনো ওলের বাচ্চা ও শুধু তোমার মেয়ে হয় কীভাবে? ”
” আস্তে চেঁচাহ্! আমার বাবা ভয় পেয়ে উঠছে! ”
মেয়ে চমকেই উঠেছে কুয়াশার কথায়। শিশির মেয়ের বুকের উপর হাত রেখে মৃদু ধমকে বলল কুয়াশাকে৷ কুয়াশা একটু রাগ কমাল৷ তাকাল মেয়ের দিকে৷ আবার চোখ তুলে বলল,
” তো এক গান গাইছ কেন? ”
” এক গান গাইব কেন? ও আমারই মেয়ে।”
কীরকম ঘাড়ত্যাড়া একটা ভাবা যায়! ঘুরানো প্যাচানো কথা বলে কুয়াশাকে রাগিয়ে তুলছে৷ ঝগড়া করতে না পেরে বোধহয় পেট তার ফেটেফুটে যাচ্ছিল৷ বউটা যে অসুস্থ সেটার সেবা না করে সে ঝগড়ায় ব্যস্ত। কুয়াশা বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল৷ আর কথায়ই বলল না৷ শিশির হাসল। খুবই শান্তি লাগছে আজ৷ জীবন সার্থক মনে হচ্ছে। কুয়াশা ভ্রু ম্রু কুঁচকে ক্ষণে ক্ষণে শিশিরের দিকে তাকাচ্ছে আর মেয়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে আদর দিচ্ছে। ভাবটা এমন শিশিরকে দেখিয়ে দেখিয়ে মেয়ে আদর করছে৷ শিশিরও কি কম নাকি? সে এমন দেখিয়ে আদর দেয়া সহ্য করে নেবে? কুয়াশার কোলের মাঝে থেকে মেয়েকে তুলে নিল কুয়াশা চেঁচিয়ে উঠল,
” এ্যাই এ্যাই..! ”
” চুপপ! আস্তে চেঁচা! তোর গলার রগ আমি কে-টে দেব! এত জোর কোথা থেকে এলো? চেঁচাচ্ছিস বার বার! আমার মেয়ে কেঁপে উঠছে কিন্তু! ”
এরা আগে নিজেদের ছুতো খুঁজে ঝগড়া করত আর এখন পেল মেয়ে নিয়ে। এই মেয়ে নিয়ে না বিশ্বযুদ্ধ হয় এদের মাঝে! ভাবে তো তেমনই লাগছে। কুয়াশা ওঠার চেষ্টা করল। তা দেখে আবার ধমকাল,
” আবার উঠছিস কেন? চুপচাপ শুয়ে থাক।”
” এ্যাই দেখো এত ধমকাইয়ো না কিন্তু! দূর্বল বলে মানব না! মেয়ে দাও খাওয়াতে হবে। ”
তা শুনে মেয়ের দিকে তাকাল। দেখল এখনো ঘুমে। বলল,
” ঘুমাচ্ছে তোহ্! ”
” ওরা ঘুমাবেই। ঘুমের মাঝেই খাওয়াতে হয়। ভাবি বলেছিল। বর্ষণকে দেখতাম ঘুমের মাঝেই খাওয়াত।”
শিশির মেয়ের দিকে তাকাল আবার। আহ্ তার ঘুমন্ত রাজকন্যা। পুরোই রাজার রাজকন্যা। বলল,
” ওঠ আস্তে আস্তে। ”
বলে একহাতে মেয়েকে ধরে একহাতে কুয়াশাকে সাহায্য করল যদিও প্রয়োজন ছিল না। কুয়াশা হাসল৷ এই ঝগড়া করার জন্য ছুঁতো খুঁজে এই আদর, ভালোবাসা দেখায়৷ বিড়বিড়াল শিশিরের দিকে তাকিয়ে,
” খঞ্জুশ একটা ”
শিশির শুনে ভ্রু কুঁচকাল৷ এরপর মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে কুয়াশার কোলে দিল৷ কুয়াশা আধশোয়া হয়ে বসা। কুয়াশার কপালে চুমু আঁকল। বলল,
” একজন সদ্য বাবা হওয়ার ফিলিংস হয় বেস্ট ফিলিংস৷ মুখে প্রকাশ করার মতো না৷ আজ আমি সেই অনুভূতি পেয়েছি৷ মেয়ের মুখ দেখার পর উত্তেজনায় বুকের পাঁজরে তীব্র শব্দ হয়েছে এখনো সেই শব্দ হচ্ছে বুঝলি। জান্নাতি সুখ পেয়েছি আমি। জীবন রাঙিয়ে দিয়েছিস, থ্যাঙ্ক ইউ আমার বউকে। ”
কুয়াশা হাসল অমায়িক। শিশিরও হেসে আবার বলল,
” বাহিরে যাচ্ছি আমি। নার্সকে পাঠাচ্ছি সাহায্য করবে। ”
” প্রয়োজন নেই আমি পারব। আর তোমারও বাহিরে যাবার কি হলো? ”
শিশির তা শুনে কুয়াশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল। কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে আছে৷ শিশির দুষ্টু চোখে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে কুয়াশার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে বলল,
” আসলেই গোবর ঠাসা একটা।”
বলে হাঁটা ধরল৷ কুয়াশার বিষয়টা বোধে এসে এবার সত্যি একটু লজ্জা এসে গেল। যতই স্বামী হোক প্রথম তাই একটু লজ্জা এলো। প্রথমে বুঝেনি। এই ছেলেটা এতটা অসভ্য কেন! যেতে যেতে বলে গেল,
” দেখলি তো বলতেই লজ্জা টের পেয়ে গেলি। স্বাধে তো আর ওই নামে ডাকি না।”
আটটার দিকে মালিথা ভিলা থেকে এলো আজমিরা, আম্বিয়া, শশী, ইয়াসমিন, বৃষ্টি, বর্ষণ, হিম। শিশিরের জন্য খাবার এনেছে। এসে কেবিনে ঢুকল একসাথে। কুয়াশা শুয়ে আছে। শিশির পাশে বসে। মেয়ে ঘুমোচ্ছে কুয়াশার কোলের মাঝে।
শশী ঢুকে লাফিয়ে উঠল মেয়ে দেখে। শিশির বলে উঠল,
” আস্তে আস্তে শশী! ”
শশী ভুল বুঝতে পেরে থেমে গেল। সকলে হেসে এগিয়ে গেল৷ মেয়ের মুখ দেখে সকলে বলল,
” মাশাআল্লাহ। ”
হাসল শিশির কুয়াশা। বৃষ্টিরা জিজ্ঞেস করল কুয়াশাকে শরীর কেমন আছে! কুয়াশা উত্তর করল। আজমিরা পাশে গিয়ে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
” শরীর কেমন লাগছে এখন মা? ”
” মোটামুটি ভালো আম্মু। ”
থেমে বলল,
” নানি হয়ে গেছ আম্মু! ”
” হ্যাঁ, নানি হয়ে গেলাম৷ আজ তোর বাবা থাকলে কতই না খুশি হতেন! ”
কুয়াশার চোখটা ভিজে এলো। আজমিরার ধরা গলা। শিশির দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
” ছোট্ট আম্মু রাখো ওসব কথা। ”
কুয়াশা চোখ মুছে বর্ষণকে বলল,
” পুচ্চু এই দেখ তোর বোন! ”
বর্ষণ বুঝল কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু কুয়াশাকে দেখে ডাকল,
” ফুপি, ফুপি। ”
বৃষ্টি বলল,
” ফুপি এখন অসুস্থ। নিতে পারবে না তোমায়। ”
বর্ষণ জেদ ধরল। সে যাবেই ফুপুর কাছে। তা দেখে শিশির নিতে গেল ওমা শিশিরের কাছেও গেল না৷ সে ফুপুর কাছেই যাবে। কুয়াশা বলল দাও এখানে। সমস্যা হবে না৷ বৃষ্টি পাশে বসি দিল। সে একবার ফুপুর কোলের মাঝে থাকা বেবিকে দেখছে একবার ফুপুকে। সকলে হাসছে। পাকনা তা দেখে নিয়ে তোতলা ভাবে জিজ্ঞেস করল,
” এতা কে? ”
” তোর বোন। ”
” বুন..? ”
” হ্যাঁ। ”
শিশির উত্তর করল। পাকনাটা পাকা পাকা কথা বলছে। শশী বলল,
” কোলে নেব বুবু! ”
” হুঁ, নে। ”
শিশির তুলে শশীর কোলে দিল৷ এরপর একে একে সকলে কোলে নিল। বৃষ্টি কোলে নিয়ে বলল,
” দেবরজী এ তো তোমার কার্বনকপি চেহারা গো! ”
শিশির শুনে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের একটা হাসি দিল। যেন সে খুব বড় যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। কুয়াশা তা দেখে তৎক্ষনাৎ বলল,
” হুরর, কি যে বলো না? ওর মতো হবে কেন আমার মেয়ে? আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে। ও কোন দিক দিয়ে ওর মতো হয়েছে? ”
” জানতাম গোবর ঠাসা, এখন দেখি কানাও! এ্যাই তোর চোখ নেই? কানা তুই? আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে। ”
কুয়াশা আবার ফুঁসে উঠল। মানে শুধু আমার মেয়ে, আমার মেয়ে করার কি আছে? বলল,
” এ্যাই, কখন থেকে আমার মেয়ে আমার মেয়ে লাগিয়ে রেখেছ কেন? ও তোমার একার মেয়ে? শুধু এক কথা! ”
সকলে হাসছে এদের মেয়ে মেয়ে নিয়ে ঝগড়া দেখে৷ আজমিরা চোখ রাঙিয়ে থামাল কুয়াশাকে। হিম কোলে নিয়ে বলল,
” বুবু, শিশির ভাই বাবুর নাম কি রাখবে? ”
তা শুনে দুইজনে একসাথেই বলে উঠল
শিশির বলল,
” প্রহেলিকা মালিথা।”
কুয়াশা বলল,
” কুজ্ঝ মালিথা। ”
ল্যাহ্ ঠেলা দু’জন তো দুটো নাম বলল! এখন এই নাম না নিয়েও ঝগড়া বাঁধায় এরা৷ মনে কথা মনে রইল শুরু করল ওরা ঝগড়া৷
শিশির চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে কিড়মিড়িয়ে বলল,
” আমার মেয়ের নাম আমি দেব। ওর নাম প্রহেলিকা মালিথা। ”
” আমার নামই আমার মেয়ের পরিচয় হবে। এ্যাই নামেই ডাকবে সবাই। ওর নাম হবে কুজ্ঝ। ”
শিশির কিছু বলতে যাবে বৃষ্টি, ইয়াসমিন, হিম বলে উঠল,
” আরে থামো তোমরা। দুটো নামের মানেই এক আসে তো এভাবে ঝগড়া করার কি আছে? ”
শিশির কুয়াশার দিকে তাকাল। কুয়াশাও তাকাল। দু’জনের চোখে বিরক্তির ছাপ। শশী বলল,
” দু’জনের নামই রেখে দাও৷ ”
” হ্যাঁ, প্রহেলিকা কুজ্ঝ মালিথা। ”
হিম বলল কথাটা। বৃষ্টি বলল,
” হ্যাঁ, সুন্দর হবে। কুয়াশার বিশেষ্য প্রহেলিকা, কুজ্ঝ।”
কুয়াশা শিশির দিকে তাকাল৷ শিশির তাকালে ভেঙচি কাটল। শিশির বলল,
” তবে তাই থাকুক৷ কুজ্ঝ ওর ডাক নাম আর প্রহেলিকা ভালো নাম থাকবে৷ ‘প্রহেলিকা কুজ্ঝ মালিথা’। ”
সকলে বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ। ”
হিম কুজ্ঝ’র গালে গাল লাগিয়ে বলল,
” আমার মামাটা কুজ্ঝ মালিথা। ”
শিশির, কুয়াশা মুচকি হাসল। সুখের নৌকায় ভাসছে তারা৷
আজ রাজপ্রাসাদে রাজার কোলে চড়ে রাজকন্যা প্রবেশ করল। শিশির, কুয়াশা এবং তাদের মেয়ে প্রহেলিকা কুজ্ঝ মালিথা ভিলায় প্রবেশ করল৷ দুইদিন পর আসল তারা। হসপিটাল থেকে পরের দিন রিলিজ করলেও শিশির কুয়াশাকে আনেনি। ভালোভাবে ট্রিটম্যান্ট করিয়ে এনেছে।
শিশিরের কোলে কুজ্ঝ, কুয়াশা পাশে দাঁড়িয়ে। বাড়িতে কুজ্ঝ প্রবেশ করতেই যেন মালিথা ভিলা ঝলমলিয়ে উঠল। সকলের চোখে, মুখে, ঠোঁটে অমায়িক হাসি। বাড়ির তিন গিন্নি সহ জা’য়েরা একমাত্র মেয়ে এবং নাতনিকে নিয়ে আনন্দে মাতল। জাহিদ মালিথা এসেছেন নাতনিকে দেখতে বিকেলে আবার চলে যাবেন৷ জাকির মালিথা নাতনির মুখ দেখতে পেরে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন৷ তাদেরই মেয়ের মেয়ে সে। বাড়িতে আনন্দ দুই রকম হয়ে প্রকাশ করছে সব৷
কুজ্ঝকে কোলে নিলেন দুই দাদু। জাকির মালিথা সোফায় বসে অনেকটা সময় নিয়ে আদর করলেন৷ জাহিদ মালিথা নাতনির মুখ দেখলেন সোনার চেইন দিয়ে৷ আদরের যেন বন্যা বয়ে গেল কুজ্ঝর৷ সে এতক্ষণ ঘুমে থাকলেও এত এত কথার ভিরে উটে গেছে৷ উঠে কেঁদে দিয়েছে। তার বোধহয় বিরক্ত লাগছে এত মানুষজন আর কথা৷ শিশির, কুয়াশা মেয়ের কান্না দেখে অস্থির হয়ে উঠল। সকলে তা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে৷ এই দৃশ্য দেখে জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথাও হাসছেন৷ তাঁরা কিনা এই দুটোকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল? দু’জনই কথাটা ভেবে আপন মনে হাসলেন৷
জাকিয়া কুয়াশাকে খেতে ডাকলেন সাথে শিশিরকেও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিতে বলল। সকালের খাবার এখনো খায়নি তারা। কুয়াশা জানাল মেয়ে থামিয়ে খাবে৷ জাকিয়া বললেন,
” উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে আর মেয়েকে থামিয়ে কারোর কাছে দে। ”
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গেলে শিশির গিয়ে তৎক্ষনাৎ মেয়েকে নিয়ে নিল কোলে। বলল,
” সাবধানে ওঠ। ”
বলে হাত ধরল৷ কুয়াশা বলল,
” আরেহ্ আমি পারব একায়৷ আমার কি কাটা ছেঁড়া আছে নাকি? সমস্যা হবে না।”
” বেশি পাকনামো করতে বলেছি তোকে?”
কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে কিছুপল দেখে শিশিরের সাথে তাল মিলিয়ে উঠল৷ আহ্, কী সুন্দর দৃশ্য! মা, বাবা এবং মেয়ে এক সাথে ঘরে প্রবেশ করবে। ঘরের সামনে এসে দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। মুচকি হেসে মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। এই ঘরের রাজকন্যা তাদের কোলে চড়ে প্রবেশ করল। শিশির মেয়ের দিকে তাকাল৷ মেয়ে কেঁদে আবার থেমে গেছে৷ ঘুমিয়ে গেছে। বর্ষণ যেমন কাঁদত কম আবার ঘুমাতোও কম কুজ্ঝ তেমন হয়নি। এ কাঁদেও বেশি আবার ঘুমায়ও বেশি। কুয়াশা বলল,
” আমার কাছে দাও ও’কে। দিয়ে তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”
” আগে জিনিসগুলো বের কর আর বিছানায় শোয়াবার জন্য জায়গা কর।”
কুয়াশা শুনে মেয়ের বেড সহ ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বের করল। বিছানার মাঝে ছোট তুলোর বেড রাখল৷ সব ঠিকঠাক করে কুয়াশা মেয়েকে দিতে বলল৷ শিশির মেয়েকে দিলে কুয়াশা বসে মেয়ের দিকে তাকাল। বলল,
” আমার আম্মা। ”
শিশির মুচকি হাসল। বসল সে সামনে। মেয়ের একটা হাত বের করে নিয়ে আঙুলের মাঝে রাখল। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেয়ের হাতের উপরিভাগে স্লাইড করতে করতে তাকাল কুয়াশার পানে৷ কুয়াশা শিশিরের দিকেই চেয়ে ছিল৷ বাবা হবার সুখ সে ক্ষণে ক্ষনে টের পায় মানুষটার মাঝে। কুয়াশাকে বলল,
” সন্তান জিনিসটা বড্ড আদরের জিনিস রে আহ্লাদী বউ। একরাশ প্রশান্তি। ”
” আমার বুকের মাঝে এর জন্য একরাশ সুখ জানো! এত আদর কেন গো? ”
শিশির হাসল ঠোঁট জোড়া প্রশারিত করে৷ মেয়ের হাত এখনো ধরা। ঝুঁকে চুমু দিল কপালে মেয়ের। কুয়াশার কোলের উপর সে ঘুমে। কুয়াশাও দিল চুমু৷
তারা মা বাবা হবার সুখগুলোই বলে প্রকাশ করতে পারছে না। দুটো এত এত ঝগড়া করে অথচ মেয়ের সুখে তারা আবেগী। শিশির বলল,
” শুয়ে দে। তার আগে একটু খাইয়ে দে৷ আমি গোসল করব একবারে। আসলে তুই ঢুকিস। ”
কুয়াশা সম্মতি দিলে শিশির বাথরুমে চলে গেল৷ সে মেয়েকে খাইয়ে বিছানায় সুন্দর করে শুইয়ে দিল৷ ঘুম কাতুরী হয়েছে। ঘুমাতে দিলে কোনো কান্না নেই তার। কুয়াশা হাসল৷ ঠোঁটের উপর হাত দিয়ে চুমুর মতো করলো৷ বলল,
” ইশশ সত্যি বাবার মতো হয়েছিস! কিউটের ডিব্বা পুরো। ”
অকপটে শিশিরের সামনে সেটা স্বীকার না করে এখন করছে। মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে উঠে জিনিসগুলো গুছিয়ে নিল সে। হসপিটালের জামা কাপড়গুলো একজায়গায় করল আর ভালোগুলো ভাজ করে রাখল৷ আজ সে গোসল করবে না। জাকিয়া, আজমিরা দুইজনই বারণ করেছে৷ সব ঠিকঠাক করতে করতে শিশির এলো। নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করে বিছানায় মেয়ের কাছে গিয়ে শুলো। তার সারাদিন মেয়েকেই দেখতে ইচ্ছে করে। মেয়ে ছাড়া আর কিছুই বুঝছে না। কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মুখ ঝামটা দিয়ে বাথরুমে চলো গেল। বিড়বিড়াল,
” অসভ্য লোক আর ভালোবাসে না আমায়। মেয়ে পেয়ে ভুলে গেছে এই বউকে। আসিস, শয়তান বেটা একটা! ”
বলে টান পায়ে ঢুকে শব্দ করে বাথরুমের দরজা আঁটকে দিল। শিশির সেদিকে ঘুরে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে থাকল কিছুক্ষণ এরপর হেসে দিল নিঃশব্দে। মেয়ের মুখের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
” বাবা, তোমার আম্মুটা হিংসুটে খুব জানো তো! দেখো তোমার উপরেও হিংসে করছে ফাজিলটা! আমার বউটাকেও আমি অনেক ভালোবাসি। তোমাদের দু’জনের জায়গা আমার দুই পাঁজরে।”
সকাল দশটার পর শিশির কুয়াশা মেয়েকে নিয়ে নামল। শিশির মেয়েকে শশীর কাছে দিল। পাশে বর্ষণ বসে আছে৷ ওরা দু’জন খেতে চলে গেল।
এদিকে বর্ষণ হা করে চেয়ে আছে শশীর কোলের দিকে। হয়তো তার ছোট্ট মস্তিষ্ক ভাবছে এটাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার কি আছে? কে এ! যে তার জন্য তাকে কোলে নিচ্ছে না কেউ? বর্ষণ কুজ্ঝকে কোলে করা দেখে শশীকে ডাকতে ডাকতে সোফার উপর দাঁড়াল বলল,
” শশামা, শশমা তোলে নাও। ”
শশী কুজ্ঝর দিকে তাকাল। মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। শশী বলল,
” বাবা, বোনকে নিছি তোহ্! তুমি বসো পরে নেব তোমায়। ”
” নাহ্ তোলে। আমি উতপ। শশামা..! ”
শশী না পেরে এক সাইটে কুজ্ঝকে নিল একসাইটে ও’কে নিল। বিড়বিড়াল,
” হিংসুটে ছেলে একটা। ”
দুপুরের খাবার সকলে একসাথে খেয়ে বসার ঘরে বসেছে৷ সে-সময়ে শিশিরের ফোনে কল এলো। সে রিসিভ করে কীসব কথা বলল যেটা বেশিকিছু বুঝল না কেউ৷ শিশির ফোন রেখে জাকির মালিথাকে বলল,
” বাবা রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’ ডিপার্টমেন্টে আমাকে গেস্ট লেকচারার হিসেবে নিতে চাচ্ছেন৷ ওনাদের নাকি লেকচারারের প্রয়োজন। ”
উপস্থিত সকলে শুনে আনন্দে অমায়িক হাসি ঠোঁট ঝুলাল। জাকিয়া বলে উঠলেন,
” এটা তো ভালো সংবাদ আব্বু! তুই কি বললি? তোর ইচ্ছে নেই? ”
” তেমনটা না আম্মু তবে একটু চাপ হবে৷ এমনিতেও কেস ভালোই পাচ্ছি। ”
জাকির মালিথা বললেন,
” সমস্যা কি? এটা তো পারমানেন্ট না৷ জীবনে এগুতে গেলে অনেককিছু করতে হয়। কেস হ্যান্ডেলের পাশাপাশি ভার্সিটির জবটাও করো আপাতত। যোগ্যতা যখন পেয়েছ সেই যোগ্যতায় তোমাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাবে৷ ”
শিশির হাসল। বলল,
” বাবা ডিপার্টমেন্ট হ্যাড আমাকে নিজে কল করেছিলেন। উনি নাকি আমার ক্যাডার হওয়ার বিষয়ে জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ খুঁজছিলেন লেকচারার। ”
জাহিদ মালিথা বললেন,
” এটা ভালোই হবে তোমার জন্য। তুমি যোগ্যতাবান একজন ছেলে দেশ তো তোমাকে খুঁজবেই! আগেপিছে না ভেবে তাদের ডাকে সারা দাও। ”
শিশির বলল,
” আচ্চা চাচু চেষ্টা করব। দেখি কতদূর হয়। দোয়া করো তোমরা। ”
” সবসময়।”
শশী বলল,
” ভাইয়া ওটা তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাই নাহ্?”
” হ্যাঁ, প্রাইভেট। ”
কুয়াশা স্বামীর দিকে তাকাল৷ তার স্বামী ঘরে, বাইরে সব জায়গায় যোগ্যতাবান, দায়িত্ববান। যেমন সমাজের লোকের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায় দেয় তেমনই বাড়ির বউ, সন্তানের প্রতি যত্ন নেয়। তার পারফেক্ট স্বামী। একজন পারফেক্ট মানুষ। অতুলনীয় ব্যক্তি সে, তার অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব।
জাহিদ মালিথা তিনটার দিকে চলে গেলেন। তুষার আসবে সপ্তাহখানেক পর।
শিশির বাড়িতেই থাকল আজ। রিজভী ফোন দিয়েছিল। জানিয়েছে স্মৃতিকে নিয়ে আসবে বিকেলে। ঈশাও আসছে। তারা কুজ্ঝকে হসপিটালে গিয়ে দেখে এসেছিল। আজ বাড়িতে এসেছে শুনে আসছে দেখা করতে।
জিনিয়া, মিহিররা সকলে আকিকাহর দিন আসবে। জাকির মালিথা সকলকে দাওয়াত করেছেন। শিশির বাবার কাছে জানিয়ে দিয়েছে সব৷
বিকেলের দিকে রিজভীরা এলো৷ সকলে বসার ঘরে বসে গল্প করছে৷ কুজ্ঝকে স্মৃতি নিয়েছে৷ এমন সময়ে নীহার ফোন দিল। শিশির ছোট্ট মেসেজ করেছিল কুজ্ঝ হবার পরেরদিন। তা দেখে আজ কল দিয়েছে সুযোগ সুবিধা বুঝে ভিডিও কলই দিয়েছে। শিশির নীহারের কল পেয়ে হাসল। রিসিভ করতেই নীহার শিশিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠল,
” পরে কথা আগে ভাগ্নী দেখা। ”
” আমার মেয়ের মুখ দেখবি কি দিয়ে তুই? শুধু শুধু তো মেয়ের মুখ দেখাব না। মাগনার ভোল ছাড়।”
শিশিরের কথা শুনে সকলে হাসল৷ নীহার বলল,
” আমার ভাগ্নী আমি দেখব। কি দেব না দেব তোকে এত হিসেব কেন দেব? ”
বলে কুয়াশাকে বলল,
” এ্যাই কুশু কই রে আমার ভাগ্নী কই। দেখা জলদি! তর সইছে না আমার। ”
” কী কিপটে রে তুই ভাই? আমার মেয়ে দেখবি খালি হাতে? এই তোর লজ্জা করছে নাহ্?”
শিশিরের কথায় নীহারও এক সুরে বলল,
” এ্যাই তোর লজ্জা করছে না ছোঁচার মতো জিনিস চাইতে? ”
সকলে হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে। শিশির আবার কিছু বলতে যাবে কুয়াশা ফোন কেঁড়ে নিল। শিশির বিরক্ত হলো ঝগড়াটা সুন্দর মতো করতে না পেরে। কুয়াশা ফোন কেঁড়ে নিয়ে ব্যাক ক্যামেরায় স্মৃতির কোলে থাকা মেয়ের দিকে ধরল। বলল,
” ভাইয়া তোমার ভাগ্নী।”
নীহার কিছুপল চুপ করে দেখল। এরপর বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। নাম কি রেখেছিস রে বুড়ি?”
সকলে হাসল। কুয়াশা হেসে বলল,
” প্রহেলিকা কুজ্ঝ মালিথা। ”
” মাশাআল্লাহ অসম্ভব সুন্দর নাম।”
নীহার আবার বলল,
” কী কিউট হয়েছে রে কুশু বুড়ি? একদম তোর মতো! ”
শিশির তা শুনে আবার চেঁচিয়ে উঠল,
” এ্যাই রাজা-কারের বংশধর এতদিন জানতাম তোরা এক একটা রাজা-কার এখন দেখি ভাই বোন দুটোই কানা। এ্যাই চোখ নেই তোদের? আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে। তোর বোনের কানি-কোণাও হয়নি।”
” চুপ থাক ফাজিল! তুই কোন গোয়ালের ছাগল রে? আমার ভাগ্নী আমাদের মতো হয়েছে।”
আরেকদফা হাসল সব। কুয়াশা শিশিরের কথায় এবার ক্ষেপে উঠেছে। বলল,
” এ্যাই মুখ সামলে কথা বলো! তুমি আমার সামনে আমার ভাইকে, আমাকে রা-জাকার বলছ? তুমি ভারী সুশীল বাঙালি? আমার মেয়ে আমার মতোই হয়েছে। ”
শিশির কিছু বলবে উপর থেকে জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা এলেন। জাকিয়া ধমক দিলেন সকলকে। বললেন,
” কী করছিস কী তোরা? এমন চেঁচামেচি করছিস কেন? ”
আম্বিয়া ছেলেকে কলে দেখে এগিয়ে এলেন। ফোন নিয়ে কথা বললেন। নীহার মা’কে পেয়ে আনন্দিত হলো। মা’কে বেশি দেখা হয়ে ওঠে না। আজ দেখতে পেরে ভালো লাগল। কথা বলল। একে একে বাড়ির সকলের সাথে কথা বলল। অনেকটা সময় নিয়ে আড্ডা দিল। শেষে শশীর কাছে দিতে বলল। শশী এতক্ষণ নিরবে সব শুনছিল আর দেখছিল। তার কথা বলতেই চোখটা ভিজে এলো৷ হাসিখুশি স্বামীকে সে মন ভরে দেখছিল। শশীকে ফোন নিয়ে স্বাভাব সূলভ উপরে যেতে বলল। শশী চলে গেল।
রাতের খাবার খেয়ে সকলে যে যার ঘরে চলে এসেছে৷ সন্ধ্যার দিকে রিজভীরা চলে গেছে৷
কুয়াশা খেয়ে উপরে এলো। মেয়েকে আজমিরা আনল খাবার সময় নানির কাছেই ছিল। শিশির বাহিরে গেছে এখনো আসেনি৷ আজমিরা মেয়েকে টুকিটাকি কিছু পদ্ধতি দেখিয়ে দিলেন গল্প করে সঙ্গ দিলেন। শিশির দশটার দিকে এলে তিনি চলে গেলেন। শিশির এসেই ফ্রেশ হয়ে আগে মেয়েকে একটা চুমু দিল। দিয়ে চলে গেল খেতে।
খেয়ে দেয়ে শিশির এলে কুয়াশা শুয়ে পড়ল। আজ থেকে তাদের মাঝে মেয়ে থাকবে। নতুন অতিথির আগমন ঘটেছে কীনা!! জীবনের সাথে তাদের সব কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গেল। শিশির দেখল কুয়াশা মেয়েকে কোলের মাঝে নিয়ে চোখ বুজে আছে। হাসল কিঞ্চিৎ সে৷ ডাকল,
” কুয়াশা..! ”
কুয়াশা চোখ খুলে চাইল। সে বলল,
” মেয়ের এই পাশে আয়।”
কুয়াশা বুঝল না কি বলল শিশির। ভ্রু কুঁচকে কিছু বলবে কিন্তু শিশির সেটার সুযোগ দিল না। কুয়াশা যে পাশে শুয়েছে সে পাশে গিয়ে কুয়াশাকে কোলে তুলে নিল। কুয়াশা,
” এ্যাই, এ্যাই কি করছ? ”
বলে চেঁচিয়ে উঠল। শিশির মৃদুস্বরে ধমকে বলল,
” আস্তে চেঁচা বেয়াদব! মেয়ে উঠে যাবে।”
কুয়াশা এবার নিচু স্বরে বলল,
” তো..!”
থেমে গেল। কারণ শিশির ও’কে শিশিরের পাশে শুইয়ে দিয়েছে। বলল,
” মেয়েকে একটু টেনে দে ওইদিকে ”
কুয়াশা এতক্ষণে বিষয়টা বুঝল। হাসল সে। শিশিরের কথামতো মেয়েকে একটু সরিয়ে দিল পাশে সুন্দর করে কোলবালিশ দিল। দিয়ে শিশিরের দিকে তাকাল। শিশির হেসে লাইট অফ করে দিল। শুয়ে পড়ল কুয়াশার পেছনে। জড়িয়ে ধরল কুয়াশার পেট। ঘাড়ের পিছনে মুখ গুঁজে দিল। বলল,
” জানিস তো তোকে বুকে না নিলে ঘুম হবে না। সারাজীবন এই বুক তোরই জন্য থাকবে। মেয়ের জন্য ভালোবাসা আলাদা জায়গায় থাকবে। তোরা দু’জনেই আমার জন্য ইম্পরট্যান্ট। সেদিন মৃত্যুর কথা বলে এ বুকে কতটা আঘাত করেছিস খবর নিয়েছিস? তোকে ছাড়া চলা আমার জন্য ঠেলাগাড়ির মতো হবে৷ ”
কুয়াশা অন্ধকারে মুখ দেখার চেষ্টা করল শিশিরের৷ কিন্তু সক্ষম হলো না। হাসল অমায়িক। পিছন ঘুরল। ঘুরে শিশিরকে জড়িয়ে ধরল। বুকে মুখ গুঁজে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” আমার দায়িত্ববান, যত্নবান স্বামী৷ একদম পারফেক্ট স্বামী, ভালোবাসি খুব।”
” আমিও। ”
বলে অন্ধকারেই কপালে চুমু দিল কুয়াশার৷ কুয়াশা আবেশে চোখ বুজল।
মাস দুয়েক পর দুপুরের দিকে শিশির এলো৷ সে ভার্সিটিতে জয়েন করেছে মাস খানেক আগে। এসে কুয়াশাকে ঘরে পেল না। অথচ মেয়ে ঘুমিয়ে। রাগ উঠল একটু। মেয়েকে একা রেখে কোথায় গেছে? শিশির ঘর্মান্তক শার্ট খুলতে খুলতে কুজ্ঝ উঠে পড়ল৷ উঠেই কান্না শুরু করেছে। শিশির শার্ট খুলে কিছু না পড়েই তড়িঘড়ি করে মেয়ের কাছে গেল বাবা বাবা বলতে বলতে। কিন্তু সে থামছে না। কোলে তুলে নিল, কুজ্ঝ তবুও কান্না করছে৷ সে থামাতে না পেরে চেঁচাতে লাগল,
” কুয়াশা..! এ্যাই কুয়াশা। কুয়াশা! ”
কুয়াশা তড়িঘড়ি করে আসতেই ছিল কান্নার শব্দ পেয়ে। মেয়ের কাছে বসে পড়তে ছিল তার দেড় মাস পর এলএলবি চতুর্থ বর্ষের ইনকোর্স পরীক্ষা। পড়তে পড়তে মাত্রই রেখে সে ইয়াসমিনের কাছে গেছিল একটু৷ আসতেই শিশির দিল ধমক। বলল,
” এ্যাই কোথায় গেছিস তুই আমার মেয়েকে একা রেখে? ”
” মাত্রই গেছি বুবুর ঘরে। ”
শিশির বিরক্ত নিয়ে মেয়েকে শান্ত করতে করতে বলল,
” আসলেই গোবর ঠাসা তুই একটা। আমার মেয়ে থামছে না ওর খিদে পেয়েছে। জলদি খেতে দে আমার মেয়েকে, নেহ্ ধর!”
কুয়াশা বেজায় বিরক্ত সহ রাগল। কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” কেন হাওয়া শেষ? থামাও তোমার মেয়েকে! এখন আমাকে লাগবে কেন? ডাকলে কেন আমায়? দিনে চৌদ্দ বেলা কথায় কথায় আমার মেয়ে, আমার মেয়ে বলে জব করে মুখে ফ্যানা তুলো এখন মেয়ে কাঁদছে তো থামানোর মুরদ হচ্ছে না কেন তোমার? হ্যাঁ! থামাও আর খাওয়াও তোমার মেয়েকে, দেখি এবার কত মুরদ তোমার! ”
শিশির কটমট করতে করতে বলল,
” এ্যাই আমি খাওয়াব কি করে? জলদি আয় বেশি কথা না বলে। অনেকক্ষণ থেকে কাঁদছে মেয়েটা৷ ”
কুয়াশা রাগে ফু্ঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে এসে এক প্রকার কেঁড়ে নেবার মতো করে মেয়ে নিল। ঝারিপারি নিয়ে বলল,
” যত্তসব, আগলা পিরিত দেখানোর মুরদ ঠিকই আছে।”
বলে মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মা’কে পেয়ে এবং খেতে পেয়ে থেমে গেল৷ কুজ্ঝ থামতেই শিশিরের দিকে কুয়াশা এমন একটা লুক দিলো যেন শিশিরকে সে কাঁচায় চিবিয়ে খাবে। তাকানো টা বলে দিচ্ছে, দেখো আমি না ছাড়া তোমার মেয়ের কিছুই চলবে না আর হবেও না। শিশির হাসল দেখে। বাবার ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? মা তো এক অলৌকিক জিনিস!!
সে মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেই টিশার্ট পড়ল। দরজা আঁটকে এসে কুয়াশার পেছনে গিয়ে ধারাম দিয়ে শুয়ে পড়ল কুয়াশাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। বুকের সাথে কুয়াশা পিঠ মিশিয়ে নিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে দিয়ে বলল,
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৭৫+৭৬
” আমার আহ্লাদী বউটাকে ছাড়া আমি এবং আমার মেয়ে আমরা দু’জনই অসম্পূর্ণ। সে আমাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।”
কুয়াশা শিশিরের অগোচরে মিটমিট করে হাসল৷ মেয়ে খাচ্ছে চোখ থেকে পানি পড়েছে সেটা মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিল কুয়াশা। শিশির পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল৷
