ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৯

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৯
তাজরীন ফাতিহা

উমায়ের ভুঁইয়া, এজেন্ট তাহমিদ চুপচাপ বসে আছে। আশপাশের গার্ডসরাও অস্ত্র নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এজেন্ট তাহমিদের দুই হাতে ব্যান্ডেজ করা। রক্তে ব্যান্ডেজ ভিজে একাকার। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। তার চোখে একধরনের ক্রোধ ফুটে আছে। আজারাক সাইফার, জিনান আদহাম, নেওয়াজ শাবীর, মুনতাজির জায়েদ সকলেই তাদের সামনে উপবিষ্ট। রুবানা আজমেরী একটু দূরেই নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো। বাচ্চাটা কাঁদছিল দেখে সে কান্না থামাতে কোলে নিয়ে হেঁটেছে কিছুক্ষণ। নাহওয়ান তার ঘাড়ে মাথা ফেলে হেঁচকি তুলে ফোঁপাচ্ছে।
আজারাক সাইফার একটু ধাতস্থ হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

“এবার বলুন মিস্টার ব্ল্যাক ভাইপার আপনার মূলত আমাকে নিয়ে সমস্যা কি? এত এত লোক ভাড়া করে আমাকে ধ্বংস করার উন্মাদনায় কেন নেমেছেন? আমার সাথে আপনার শত্রুতা কি নিয়ে? যতদূর জানি আমি আপনার কোনো ক্ষতি করেছি বলে তো মনে পড়ে না।”
সাইফারের ছোঁড়া প্রশ্নে পুরো হলরুম নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। পিনপতন নীরবতা পুরো রুমে। সকলের দৃষ্টি উমায়ের ভুঁইয়া ওরফে ব্ল্যাক ভাইপারের দিকে স্থির। তার মুখে কোনো শব্দ নেই। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসা। মুনতাজির কঠোর গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“চুপ করে আছ কেন? কেন সাইফারের প্রতি আমাকে উস্কেছিলে? তার সাথে আমার দুরত্ব কেন চাইতে? কেন ফাটল ধরিয়েছিলে আমাদের দুজনের মাঝে? তোমার সমস্যা কি তাকে নিয়ে? বলো জবাব দাও। আনসার মি ড্যাম ইট!”
নেওয়াজ এগিয়ে এসে মুনতাজিরকে সামলালো।
“শান্ত হোন মিস্টার মুনতাজির।”
রাগে মুনতাজিরের শরীর থরথর করে কাঁপছে। সাইফার আগের ন্যায় শক্ত মুখে চেয়ে। মুনতাজির কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে বলল,

“শান্ত হতে বলেছেন? আমার উপর সেই দিনগুলোতে কি কি গেছে উপর আল্লাহ আর আমি ছাড়া কেউ জানে না। বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা কাউকে বোঝানো যায়না। প্রেম-ভালোবাসার বিচ্ছেদে মানুষ কষ্ট পায়, প্রেমের সমাধি বানায়, উপন্যাস-কাব্য রচনা করে কিন্তু বন্ধুত্বের বিচ্ছেদে কে কি করে? আমি কতরাত কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি আল্লাহ আর আমি জানি। সাইফার যখন আমার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিল, আমি ওকে ভুল বুঝে দূরে সরে গেলাম হেন মুহূর্ত নেই তাকে মনে করিনি। দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। সে ছাড়া আমার আশপাশটা ধূ ধূ মরুভূমি যেন! তার ভিন্ন রূপ দেখে সবচেয়ে হতবাক আমিই হয়েছিলাম। যাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করতাম, যে বন্ধুর জন্য কলিজা কেটে দিতেও দ্বিধাবোধ করতাম না সেই বন্ধুর সাথে গাদ্দারী, দেশদ্রোহী রূপ, বিচ্ছেদ কতটা যন্ত্রণার কাউকে যদি বোঝাতে পারতাম! দেহ থেকে চামড়া তুলে ফেলার সমতুল্য। ওই লোকটার জন্য কত দহন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দুজনকে যেতে হয়েছে কেউ জানে? নাটক মানে কি সবকিছুই নাটক ছিল? বরং সবাইকে যা দেখানো হয়েছে এর থেকেও ভয়াবহতা ছিল সম্পর্কে।

একটু নিঃশ্বাস নিয়ে,
“কতদিন হয় হাব ডাকেনা। এখনো সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও সেই মন কেমন করা সম্বোধনে আমাকে আর ডাকেনি। হয়তবা বিশ্বাসের পারদ নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। আগের ন্যায় বিশ্বাস করাটাই বরং অস্বাভাবিক। ওই লোককে বলুন সেই বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসার ডাক আর বিশ্বস্ততা ফিরিয়ে দিতে। পারবে?
উপস্থিত সকলের চেহারায় বিমর্ষতা ফুটে উঠল। সাইফার গাম্ভীর্য দৃষ্টিতে ব্ল্যাক ভাইপারের দিকে চেয়ে। মুনতাজিরের কথা শুনেও তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। গাল ও কপালে ডান হাতের দুই আঙ্গুল ঠেকিয়ে সামনাসামনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। নেওয়াজ ব্ল্যাক ভাইপারকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বলল,
“কিছু বলছন না কেন? পারবেন?”

আজারাক সাইফার কোট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধোঁয়া ছাড়ল। ধূম্র গুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে নাক, মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়িয়ে দুই হাঁটুর উপর কনুইয়ের ভর দিয়ে খানিক সামনে এগিয়ে এসে বলল,
“একটা গল্প বলি। কারো কোনো অবজেকশন থাকলে বলতে পারবেন। নো টেনশন..”
শেষের কথাটা ব্ল্যাক ভাইপারের দিকে চেয়ে টেনে টেনে বলল সাইফার। সিগারেট দুই ওষ্ঠে চেপে ধোঁয়া ছাড়িয়ে বলতে লাগল,

“একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর দুই পুত্র সন্তান ছিল। বড় পুত্র সন্তান যখন নয় এবং ছোট পুত্র যখন চার বৎসরে পদার্পণ করল সেই মুহূর্তে তাদের মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। তাদের পিতা ছিলেন ব্যবসায়ী মানুষ। বাচ্ছাদুটোকে লালন পালন করা তার কাছে ভীষণ কষ্টসাধ্য ছিল। অনেকের পরামর্শে দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সন্তানদ্বয়কে মাতৃ ছায়া দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ধ হলেন। নিজের হিমশিম খাওয়া অবস্থায় বিয়ে করে অবুঝ সন্তানকে মা এনে দিলেন। সেই মা তাদেরকে আগলে বড় করতে লাগলেন। বড় পুত্র মহাশয় দ্বিতীয় মায়ের আগমনে নারাজ ছিল। কোনোভাবেই সহ্য করতে পারত না তাই সর্বদাই সৎ মা থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলত। সৎ মায়ের প্রতি এতটাই বিদ্বেষ পোষণ করত যে মাত্র দশ বছর বয়সেই হোস্টেল লাইফে থেতু হলো। সেখানে থেকে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে লাগল। ছোট পুত্র সৎ মায়ের ছত্রছায়ায় লালিত পালিত হতে লাগল। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন বড় পুত্রের কাছে খবর পৌঁছুলো তার বোন নাকি পৃথিবীতে আগমন করেছে। নিজের সমস্ত রাগ, জেদ সব গিয়ে পড়ল ওই কন্যা শিশুটির উপরে।
এটুকু বলে একটু থেমে ব্ল্যাক ভাইপারের দিকে চাইল। সকলের উৎসুক দৃষ্টি সাইফারের দিকে নিবদ্ধ। সাইফার আবারও বলতে শুরু করল,

“বড় পুত্র মহাশয় হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে হুলস্থূল ঘটিয়ে ফেলল। সৎ মা, বাবা সকলেই ভীত হয়ে পড়ল মাত্র এগারো বছর বয়সী বড় পুত্রের এই বিধ্বংসী রূপ দেখে। বাবা কিছুতেই পুত্রের ক্রোধকে দমাতে পারছিলেন না। নিজের সেই ক্রোধ এক মাস বয়সী দুধের শিশুটিকে দেখাতে গিয়েই চরম ফাঁসা ফাঁসল বড় পুত্র। দোলনায় দুলতে থাকা লাল টুকটুকে হাত পা ছড়িয়ে তার দিকে ফিচফিচ করে হাসতে থাকা পুতুলটিকে দেখে নিজের সমস্ত ক্রোধ নিমেষের মধ্যে কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেল। সে একদৃষ্টিতে শিশুটির দিকে চেয়েই রইল। এরপর থেকে শিশুটি অস্ফুট আওয়াজ করলেও সবার আগে উপস্থিত থাকত তার বড় ভাই। এভাবেই বড্ড আদর, সোহাগে বড় ভাইয়ের একমাত্র দুলালী বোন বড় হতে লাগল। সৎ মায়ের প্রতি অসন্তুষ্টি, অনিচ্ছা থাকলেও সেটা কখনো আর প্রকাশ করেনি। বোনের সমস্ত চাহিদা, খুশি তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিল। বোন মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই সবকিছু হাজির করে ফেলত। হোস্টেল লাইফ ছেড়ে পুরোদমে বাড়িমুখী হলো সে। এভাবেই বড় হতে লাগল ভাইয়ের আদরের দুলালী ছোট্ট পুতুলটি।

উপস্থিত সকলে আগ্রহী শ্রোতার মতো শ্রবণ করছে। সাইফার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
“বোনটিও ভাই বলতে অজ্ঞান। আস্তে ধীরে ভাইয়ের আদুরী বড় হতে লাগল। যখন যুবতী বয়সে পদার্পণ করে ঠিক তখন সবার অগচরে নিজের প্রেমিককে বিয়ে করায় বড় ভাই আবারও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়ে। বোনের হাসিমুখ দেখে নিজেকে দমালেও যখন পিতা সেই কন্যাকে অর্ধেক সম্পত্তির মালিকাধীন করে যান তখনই ঘটে মহাঅঘটন।”
জিনান আগ্রহী গলায় শুধালো,
“তারপর?”

সকলেই উন্মুখ হয়ে আছে পরবর্তী কাহিনী শোনার জন্য। সাইফার হাই তুলে বলল,
“তারপর আর কি? টিপিক্যাল বাঙালিদের মতো সম্পত্তির জন্য সম্পর্কের দাফন। বড় পুত্র ছোটবেলা থেকে নিজের না পাওয়ার খাতা খুলে অতীতের সকল ক্রোধ আবারও পুঞ্জীভূত করে বোনের স্বামী, সন্তানের প্রতি বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সকল কুমন্ত্রণা কাজে লাগিয়ে সে হয়ে উঠল কালো জগতের অধিপতি। বোনের সংসারে ফাটল ধরাতে, তার সন্তানদের ক্ষতি করতে তিনি ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট। এক প্রতিশোধের খেলায় মেতে উঠেছিল সে।”
ব্ল্যাক ভাইপার চাপড় মেরে ক্রোধান্বিত গলায় বলল,

“মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে। সবকিছু মিথ্যে।”
প্রত্যেকে ভ্রু কুঁচকে তার পানে চাইল। সাইফার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“ওহ আচ্ছা। তাহলে সত্যটা আপনিই বলুন।”
উমায়ের ভুঁইয়া ওরফে ব্ল্যাক ভাইপার শান্ত হয়ে বসে বলল,

“মায়ের মৃত্যুর পরে বাবার পাশে কোনো দ্বিতীয় নারীকে আমি সহ্য করতে পারিনি। সেজন্য ওই মহিলাকে আমি এভয়েড করতে হোস্টেল লাইফ বেছে নিয়েছিলাম। নিজের মতো থাকতে পছন্দ করতাম। উর্মি যখন হয় তখন আমি খুশি ছিলাম না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ও আমার সবচেয়ে আদরের হয়ে ওঠে। ওকে আমি প্রথম প্রথম পছন্দ না করলেও পরবর্তীতে ওই আমার প্রাণ ভোমরায় রূপ নেয়। আমার কলিজার একটা টুকরা ছিল উর্মি। ভাইজান বলে যখন ডাক দিত আমার পরাণটা জুড়িয়ে যেত। এই দুহাতে আমি পুতুলটাকে মানুষ করেছি। একটা নরম তুলা ছিল ও। ভাইজান ভাইজান বলে যখন আবদার করত কোনোদিন ওর আবদার ফিরিয়ে দেয়ার দুঃসাধ্য কিংবা দুঃসাহস আমার কিংবা উজান কারোরই ছিল না। ওর আবদারের ভান্ডার ছিলাম আমি। কেউ কোনো কিছু না দিলে আমাকে এসে নালিশ জানাতো। আমি শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার পুতুলটার সব নালিশ মনোযোগ দিয়ে শুনে সবাইকে শাস্তি দিতাম। মোটকথা ও আমার পাথুরে হৃদয়ে মরুর ফুল হয়ে ফুটেছিল। একদিন..”
এই পর্যন্ত বলে ব্ল্যাক ভাইপারের কণ্ঠরোধ হয়ে এল। একটু পানি খেয়ে ধাতস্থ হয়ে বলল,

“একদিন কলেজ শেষ করে আমার কাছে ছুটতে ছুটতে এল। তখন আমি জরুরি বৈঠকে ছিলাম। কিন্তু উর্মির কাছে সবকিছু তুচ্ছ ছিল। উর্মি উচ্ছ্বাসিত গলায় তার স্বপ্নের পুরুষটির কথা বলল। আমার কাছে তাকে চাইল। আমি ভেবেছিলাম স্রেফ বয়ঃসন্ধিকালের পাগলামি। তাই গুরুত্ব দেইনি তেমন। কিন্তু পরবর্তীতে ওর পাগলামি দেখে আমি খোঁজ লাগাই সেই পুরুষের। বয়স আমার মতোই। নেতা গোছের ছেলে। সুদর্শন, বলিষ্ঠ পুরুষ। এক দেখাতেই বুঝে গিয়েছিলাম উর্মির ঘুম উড়াল দেয়ার রহস্য। সারাদিন সেই স্বপ্নপুরুষের নাম জপার কারণই বা কি সেটাও বুঝলাম। সেদিন উর্মিকে যেয়ে বলেছিলাম, পছন্দ হয়েছে কিন্তু বয়সটা বেশি। বেচারি কেঁদেকুটে একেবারে সমুদ্র বানিয়ে ফেলেছিল। পরে কতকিছু করে কান্না থামিয়েছি। বলেছিলাম কলেজ শেষ হলেই বিয়ে করিয়ে দেব। আমার পুতুলটা সেদিন কত যে খুশি হয়েছিল!”

ব্ল্যাক ভাইপারের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। মুনতাজির, রুবানা উভয়ের ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসি লেগে আছে। মায়ের গল্প শুনলে প্রত্যেক সন্তানই খুশি হয় বোধহয়। স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎই মুখের হাসি অস্তমিত হয়ে গেল ব্ল্যাক ভাইপারের। শক্ত মুখে বলতে লাগল,

“আমার পুতুলের সুখ বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। একদিন কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে আমার গলা জড়িয়ে বলল, তার স্বপ্নপুরুষ নাকি তাকে চায়না। ভালবাসে না। ওই স্বপ্নপুরুষকে ছাড়া সে বাঁচবে না এমন নানা কথা। আমি কিছুতেই বোনের কান্না সহ্য করতে পারছিলাম না। পাগলের মতো করছিল ও। আমি তার স্বপ্নপুরুষকে এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম। বোনকে কাউন্সেলিং করিয়ে মোটামুটি সারিয়ে তুললাম। তারপর একটু সুস্থ অনুভব করায় হাসিমুখে কলেজে গেল। তবে সেই হাসিমুখ আমি চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলব তা বুঝতে পারিনি। দুপুর নাগাদ একটা কল আসে আমার ফোনে। উর্মি নাকি হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম পুতুলটার কাছে। হাসপাতালে পৌঁছেই দেখি তার স্বপ্নপুরুষ দেয়ালে হেলান দিয়ে রক্তে ভেজা জামাকাপড়ে দাঁড়িয়ে। আমি বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম। উর্মি উর্মি বলতে বলতে এগিয়ে আসতেই ওই ছেলেটা এগিয়ে আসল। ওর চোখে পানি ছিল। মনে করেছিলাম আমার পুতুলের জন্য বোধহয় কাঁদছিল। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম কেন, কার জন্যে ছিল সেই পানি। আমি কোনো কথা না বলে কাউন্টারে উর্মির কেবিন নম্বর জিজ্ঞেস সেদিকে ছুটলাম।”
একটা দম নিয়ে বলল,

“উর্মির কেবিনের সামনে আসতেই দেখতে পেলাম আমার পুতুলটা কিভাবে শুয়ে আছে। হাত-পায়ে ক্যানোলা, মুখে ভেন্টিলেটর সংযোগ দেয়া রক্তাক্ত ছোট্ট পুতুলটাকে। যে একদমই চুপচাপ হয়ে শুয়ে আছে। কোনো নড়চড় নেই। হার্ট মনিটরে বিপ বিপ শব্দে রেখা ওঠানমা করছে। আমি একদম ভেঙে পড়ছিলাম কাচের দরজা দিয়ে ওর এই অবস্থা দেখে। আমার কলিজার এহেন দশায় আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম যেন। হৃদযন্ত্রটা বেসামালভাবে তড়পাচ্ছিল আমার পুতুলটার কাছে যাওয়ার জন্য। পুরো দুইদিন আইসিইউতে ভর্তি থাকার পরে ডাক্তার খবর জানালো রোগীর জ্ঞান ফিরেছে হালকা। অবস্থা গুরুতর আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি তো দুইদিন এক পাও নড়িনি আইসিউ রুমের সামনে থেকে। যদি কোনো আপডেট পাই সেই আশায় চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষারত ছিলাম। দুদিনের মাথায় আপডেট ঠিকই এসেছিল তবে…”

এটুকু বলে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বুক চেপে ধরলো ব্ল্যাক ভাইপার। সকলের উৎসুক চাহনি তার দিকে স্থির। ব্ল্যাক ভাইপার আবার বলতে শুরু করল,
“কেবিনে ঢুকে আমি মৃত্যুর ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম কেবল। ঔষধ ও বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তুর গন্ধ মিলেমিশে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ নাসাগহ্বরে বারি খাচ্ছিল শুধু। কেমন গা ছমছম করছিল আমার। সেই ছোট্ট লাল লাল দেখতে উর্মির কথা মনে পড়ছিল বারবার। এগিয়ে যেতেই পুতুলটা আমার দিকে খুব কষ্টে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তার পাশে বসতেই ভেন্টিলেটর খুলে খুব ধীরে ইশারা করল কান এগিয়ে দিতে। আমি দুরুদুরু বুকে কান এগিয়ে দিতেই ধীরে ধীরে ভাঙা গলায় উর্মি আমাকে বলছিল,

ভাইজান আমার স্বপ্নপুরুষের স্বপ্নের মানুষ আছে। আমি সেই সৌভাগ্যবতী নারীটিকে বাঁচিয়েছি, জানো? ভীষণ মিষ্টি দেখতে। কি সুন্দর চেহারা! একদম পুতুলের মতোন। উনি তার রক্তাক্ত দেহটা নিয়ে কেমন ছটফটাচ্ছিল। আমি যে তার স্বপ্নের নারীকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছি সে খেয়ালও করেনি। আপুটা আমার চেয়ে বয়সে বড়। কেউ নেই তার। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন তিনি। মানসিকভাবে কিছুটা অস্থিতিশীল। আমাদের কলেজ ক্যাম্পেইনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন আপু এসেছিল বলেছিলাম না? সেই সময় এই আপুটাও ছিল। আমাকে অনেক হেল্প করেছিল। প্রথম বর্ষে পড়ে। খুবই ভালো মানুষ। এই ঢাকা শহরে পরিচিত কেউ নেই, এতিম। তুমি জানলে অবাক হবে, আপুটার নাম ঊর্মিলা। উনি বোধহয় উর্মি মালা ডাকে। রক্তাক্ত দেহটা নিয়ে বারবার উর্মি মালা উর্মি মালা করছিল। আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আমাকে তো কোনদিন ডাকবে না অন্তত আমার নাম নিয়ে ওই আপুকে ডেকেছে এই সই। আহ উর্মি মালা, কি মধুর সেই ডাক!”

ব্যাস এইটুকু বলে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে গেল আমার ছোট্ট লাল লাল পুতুলটা। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেল। আমাকে কেউ আর ভাইজান ভাইজান বলে সেদিনের পর ডাকেনি। আবদারের ঝুলি নিয়ে দৌঁড়ে আসেনি। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখার জন্য সেই উর্মি আর কোনোদিন আসেনি। ওর মৃত্যু আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। পাথরের মতো শক্ত হয়ে লাশটা বুকে জড়িয়ে কেবল ফ্যালফ্যাল করে মূর্তির মতো বসে ছিলাম। যেন আমার সমস্ত ক্রোধের সমাধি গড়া পুতুলটাকে কেউ ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। ওর মৃত্যুর পরে বহুদিন ঘর থেকে বের হয়নি। খালি কানে ভাইজান ভাইজান ডাকটা প্রতিধ্বনি হতো। মস্তিষ্কের বিভ্রান্তি ঘটেছিল। বারবার মনে হতো আমার পুতুলটা এই বুঝি এসে ডাকল ভাইজান।”

এইটুকু বলে ব্ল্যাক ভাইপার ‘আমার ছোট্ট পুতুল’ বলে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। মুনতাজির, রুবানা উভয়ই স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। এতবড় শক তারা জীবনেও খায়নি। এসব কি শুনছে তারা! সকলে ব্ল্যাক ভাইপারকে সময় দিল। প্রত্যেকেরই খারাপ লাগছে সেই উর্মি ভুঁইয়ার বিয়োগে। ব্ল্যাক ভাইপার বেশ কিছুক্ষণ পর ভাঙা গলায় বলল,
“উর্মি মারা যাওয়ার পরে ওর কলেজে গিয়েছিলাম ওর সেই স্বপ্নপুরুষের খোঁজ নিতে। পুতুলের কলেজের সামনেই আস্তানা ছিল তার। নেতাগিরি করত, চরম দাপট নিয়ে চলত। তারপর ঊর্মিলার খোঁজ নিলাম। দুজনের উপরে নজরদারি করতে লাগলাম। জানতে পারলাম ঊর্মিলা নামের মেয়েটি উর্মির সেই স্বপ্নপুরুষটিকে পছন্দ করেনা। সেই ছেলের একপাক্ষিক ভালোবাসা হলো ঊর্মিলা মেয়েটি। দুজনকে একসাথে দেখলেই উর্মির রক্তাক্ত দেহটা চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠত। ক্রোধে শরীর ফেটে পড়ত। ক্রোধ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। পারব কিভাবে ছোট থেকে ক্রোধ নিয়ন্ত্রনের মানুষটাই তো ছিল আমার উর্মি। সেই তাকেই তো এদের জন্য চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলেছি।

ঊর্মিলাকে আমার পুতুল বাসের ধাক্কা থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। সেও আহত হয়েছিল। আর আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল ও ছিল ডিমেনশিয়ার রোগী। এছাড়াও ওর মেডিকেল হিস্ট্রিও তেমন ভালো ছিল না। সেই সুযোগটাই আমি নিয়েছিলাম। ওর সামনে আপন ভাই সেজে উপস্থিত হয়েছিলাম। ঊর্মিলা বিশ্বাস করতে চায়নি। প্রায় তিনমাস বহু কসরৎ করে ওকে বিশ্বাস করিয়েছিলাম আমিই ওর ভাই উমায়ের ভুঁইয়া। ওর নাম ঊর্মিলা নয় উর্মি ভুঁইয়া।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৮

ব্যাস একজন ডিমেনশিয়ার রোগীকে কব্জা করে প্রতিটি ধাপে ধাপে এগোতে লাগলাম। আমার বুকে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম উর্মির সেই স্বপ্নপুরুষ আর আমাদের পদবী একই; ভুঁইয়া। আর সে জানত ঊর্মিলার ভাই আমি। কারণ হাসপাতালে উর্মি বলতে বলতে যখন ছুটে আসছিলাম তখন ভেবে নিয়েছিল তার ঊর্মিলাকে দেখতে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। এটাও ছিল আমার জন্য বড় প্লাস পয়েন্ট।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৬০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here