ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৫

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৫
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

অনন্যা বেগমকে বললো,
— “আম্মু, আমি হেল্প করবো?”
অনন্যা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। মনে-মনে মেয়ের তারিফ করে বললেন,
— “মাশাআল্লাহ! সত্যি, উনার বড়ো বাশুড় একদম ঠিক কথা বলেন। প্রিয়তা একদম উনার শাশুড়ির মতো দেখতে। নাক, ঠোঁট, চোখ—সবই উনার কাছাকাছি। শুধু তিনি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিলেন, আর উনার মেয়ে উজ্জ্বল গৌরবর্ণের। এতটুকু পার্থক্য না থাকলে সবই প্রায় সেম।”
প্রিয়তা আম্মুর হাত ঝাঁকিয়ে বললো,

— “কি ভাবছো আম্মু? আমি একটু হেল্প করি?”
অনন্যা বেগম হেসে নিজের চোখ থেকে কাজল নিয়ে মেয়ের কানের পাশে একটু লাগিয়ে দিয়ে বললেন,
— “মাশাআল্লাহ! আমার মেয়েটার উপর যেন কারো নজর না লাগে।”
প্রিয়তা মিষ্টি হাসলো।
অনন্যা বেগম বললেন, “ঠিক আছে।” প্রিয়তা খুশি হলো। ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করতে করতে মনে-মনে বলল,
— “হেল্প করা তো বাহানা মাত্র, উদ্দেশ্য তো অন্য কিছু!”
প্রণয় এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। প্রেম সকাল ৫:৩০ পর্যন্ত পাক্কা দুই ঘণ্টা ভাইকে জলপটি দিয়েছে। এখন জ্বরটা একটু কম। প্রেম উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে ভাইয়ের পাশে বসলো।
প্রণয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রেম বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “তুই অনেক ধৈর্যশীল ভাই। তোকে আল্লাহ অনেক ধৈর্য দিয়েছেন। কেমন করে পারিস? কেমন করে সহ্য করিস? তোর কষ্ট আমি হয়তো অনুভব করতে পারবো না, কিন্তু ভাবলেই যে পরিমাণ কষ্ট লাগে, তাহলে তুই কিভাবে সহ্য করিস?”
প্রেম পুনরায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করল,

— “আমি জানি না, তোদের ভাগ্যলিপিতে কি লেখা আছে। জানি না তোদের ব্যর্থ প্রেম কখনো পূর্ণতা পাবে কি না বা আদৌ তার সম্ভাবনা আছে কিনা। আমি এটাও জানি না, তোদের প্রণয়ের উপসংহারে আদৌ পরিণয় আছে নাকি বিচ্ছেদ—সেটা একমাত্র আল্লাহ মাবুদই ভালো জানেন। শুধু এতোটুকুই চাই, ভাই, তুই ভালো থাক।
তুই আমার আপন মায়ের পেটের বড় ভাই। তুই কষ্ট পেলে যে আমার দেখতে ভালো লাগে না। শুধু তুই কেন, ওরাও তো আমার ভাই-বোন। তোদের কাউকেই কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগে না। ছোট বলে কিছু বলতে ও পারি না। যারা তোর সাথে এমন নির্দয় আচরণ করেছে, তোর কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, তাদেরই বা কিভাবে দোষ দিই বল? তারাও তো তোরই মতো এক ব্যথায় ব্যথিত। কথায় আছে না—যুদ্ধ আর ভালোবাসায় ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু হয় না। কিন্তু তোকে কষ্ট দিয়ে যদি তারা ভালো থাকতো, সুখে থাকতো, তাও তো একটা কথা ছিল। কিন্তু তারা—”

ওহ! পুড়ছে সেই আগুনে, যে আগুনে তারা তোকে ষড়যন্ত্র করে ফেলে দিয়েছে।
প্রেম আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠলো।
সামনের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে চোখের সামনে ধরলো। মোবাইল স্ক্রিনে একটা নাম ঝলঝল করছে—চিত্রাঙ্গনা।
নামটা দেখে প্রেমের হৃদয়ে কেমন সূক্ষ্ম অনুভূতি হলো।
সে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটি সুপরিচিত রিনরিনে নারী কণ্ঠ ভেসে এলো। চিত্রা বললো,
— “চিত্রকর সাহেব!”
সুমধুর নারী কণ্ঠটা প্রেমের হৃদয়ে ধাক্কা দিলো। প্রেম বললো,
— “জি,
পুরুশালী কণ্ঠস্বর টা চিত্রার মনে দুলা দিল।
আরো মিষ্টি করে চিত্রা বললো,

— ” একটু কথা ছিল।”
ভ্রু কুঁচকালো প্রেম। এত নরম সুর কেন? নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে?
প্রেম গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— “জি, বলুন।”
এমন জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে চিত্রার প্রাণ লাফিয়ে উঠলো। মনে-মনে বললো, এই লোকের মুখে কি মধু নেই?
সে গলায় আরো পাঁচ বালতি মধু ঢেলে বললো,
— “আপনার সাথে আমাকে নিয়ে যাবেন, প্লিজ?”
প্রেম এক ভ্রু তুলে বললো,
— “কোথায়?”
চিত্রা উৎসাহ নিয়ে বললো,
— “আপনার আর্ট এক্সিবিশনে।”
প্রেম বললো,
— “কেন?”

চিত্রা আমতা-আমতা করতে লাগলো। সে এখন কীভাবে বলবে যে তার ক্রাশকে দেখতে ইচ্ছে করছে? তার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে? প্রিয় মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করছে? তার চোখ জুড়ে যে ভীষণ তৃষ্ণা, শুধু এই পুরুষটাকে একবার দেখার জন্য প্রাণটা আকুলি-বিকুলি করছে।
প্রেম হালকা ধমক দিয়ে বললো,
— “কি হলো? কথা বলছো না কেন?”
চিত্রা চমকে উঠলো। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো।

— “আমতা-আমতা করে বলল, মা মানে… আপনার আর্ট এক্সিবিশন দেখতাম আর কি!”
প্রেম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
— “তাহলে একা চলে যাও। আমার সঙ্গে কেন যেতে হবে?”
চিত্রা বললো,
— “না না, আপনার সাথেই যেতে হবে।”
প্রেম পুনরায় শুধালো,
— “কেন?”
চিত্রা বললো,
— “বাহ! আপনার সাথে যাওয়ার কত সুবিধা!”
প্রেম ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “যেমন?”
চিত্রা উৎসাহ নিয়ে বললো,

— “এই ধরুন, আমি একা গেলে কেউ আমাকে চিনবেও না, পাত্তা দেবে দূরের কথা! কিন্তু সেখানে আপনি একজন মস্ত শিল্পী কত পাত্তা আপনার সাথে গেলে সবাই বিশেষ নজরে দেখবে, নিজেকে স্পেশাল-স্পেশাল ফিল হবে আরকি।”
প্রেম বললো,
— “বিশেষ নজর মানে?”
চিত্রা থতমতো খেয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
— “না মানে, আমার একা ভয় লাগে… প্লিজ, আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন। প্লিজ, প্লিজ!”
প্রেম আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লো! শেষমেশ রাজি না হয়ে আর উপায় হলো না। সে সম্মতি জানিয়ে বললো,
— “ঠিক আছে। কিন্তু I have one condition!”
চিত্রা উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো,
— “কি?”
প্রেম বললো,
— “আমার সাথে গেলে ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকতে হবে, তিরিং-বোরিং করা যাবে না।”
চিত্রা বেজায় খুশি! সে মনে-মনে লাফিয়ে উঠলো, সম্মতি জানিয়ে বললো,
— “এই নিয়ে আপনাকে একদম চিন্তা করতে হবে না! আমি একদম মুখে কুলুপ এটে থাকবো।”
প্রেম বললো,

— “Good!”
চিত্রা বললো,
— “তাহলে কখন, কোথায় দাঁড়াবো আপনার জন্য?”
প্রেম বললো,
— “টেক্সট করে জানিয়ে দেবো।”
চিত্রা সম্মতি জানালো।
এমন করেই দু’জনের অনেকক্ষণ আলাপচারিতার পর ফোনটা রেখে দিলো।
প্রেম মনে-মনে হেসে বললো, পাগলী একটা! এত বাহানা কীভাবে বানায়!
প্রেমের মুডটা একদম ঝরঝরে, ফ্রেশ হয়ে গেলো। সে প্রণয়ের দিকে তাকালো। বেলা ৯টা বেজে গেছে, দাদানকে তুলতে হবে, তাই বিনয়ের সাথে ডাক দিলো,
— “বড় দাদা! বড় দাদা!”
প্রণয় একটু নড়ে-চড়ে উঠলো, কিন্তু জাগলো না।

প্রেম আবারও ডাক দিলো,
— “বড় দাদা! বড় দাদা!”
প্রণয়ের ঘুমটা হালকা হয়ে গেল। আরো কয়েকবার ডাক দিতেই সে চোখ পিটপিট করে তাকালো। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে, সামনের সব কিছু ঝাপসা লাগছে।
প্রেম বললো,
— “দাদান, উঠো।”
সে কোথায় কী হয়েছে, সব ঘটনা তার মস্তিষ্কে প্রসেস হতে একটু সময় লাগছে। পাক্কা পাঁচ মিনিট পর তড়িতগতিতে প্রেমের দিকে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বললো,
— “আমি তোর ঘরে কেন?”

প্রেম আমতা-আমতা করছে। সে বড় ভাইকে কীভাবে বলবে যে মাতাল অবস্থায় তুলে এনে এখানে শুইয়ে দিয়েছে! তাই হাসার চেষ্টা করে সত্যের সঙ্গে এক চামচ মিথ্যে মিশিয়ে বললো,
— “কালকে ভোর রাতে তুমি আমার ঘরের সামনের দরজার কাছে পড়ে গিয়েছিলে, তাই তোমাকে এনে এখানে শুইয়ে দিয়েছি।”
প্রণয় চোখ সরু করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে সে বিশ্বাস করছে না। কিন্তু এটা নিয়ে আর কথা বাড়ালো না প্রণয়। ছোট করে বললো,
— “ওহ।”

প্রেম আবার হাসার চেষ্টা করলো। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে প্রণয় মনে করার চেষ্টা করল কাল রাতের ঘটনা। চোখে ভেসে উঠতে থাকলো কাল রাতের একের পর এক দৃশ্য। সে পরম সুখে আবারও চোখ বন্ধ করে নিজের হাতটা বুকের বাঁ পাশে রাখলো। হৃদয়টা কেমন অদ্ভুত, অস্বাভাবিক গতিতে ছুটে চলছে। সে মুচকি হাসলো।
নজর পড়লো তার white shirt-এর ওপর। শার্টটা নাকের কাছে নিল। সেখান থেকে স্নিগ্ধ, প্রশান্তিদায়ক মাদকীয় গন্ধটা হালকা হালকা আসছে।
সে হেসে মনে মনে বললো,

— “তুই ছাড়া আমি সর্বহারা, নিঃস্ব, অসম্পূর্ণ প্রিয়তমা। বেঁচে থাকার জন্য হলেও মাঝে মাঝে তোকে একটু চাই।
তোর একটু স্পর্শ আমার জন্য খুব জরুরি, নাহলে এই বিষাক্ত পবনেতে নিঃশ্বাস নিতে পারবো না। খানিকটা স্বস্তির জন্য হলেও তোর ওইটুকু ছোঁয়া খুব প্রয়োজন।”
এসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘরে প্রবেশ করলো। প্রহেলিকা আশেপাশে নেই দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। গায়ের শার্টটা খুলে আবার নাকের কাছে নিয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। এরপর ওয়ার্ডরোবে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

শিকদার বাড়ির ডাইনিং হল বেশ সরগরম হয়ে আছে। ছুটির দিন বলে কথা! টেবিলে গোল হয়ে বসে আছে শিকদার বাড়ির বড়ো বাচ্চারা। তাদের কথা-বার্তা আর হাসির শোরগোলের শব্দ ড্রয়িং রুম পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে।
শুদ্ধ রেডি হয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। আজকে তার গুরুত্বপূর্ণ দুইটা সার্জারি রয়েছে। ডাক্তারদের জন্য শুক্রবার-শনিবার বলে আবার কিছু হয় নাকি? যখনই ডাক পড়ে তখনই যেতে হয়।
সে স্যান্ডউইচ মুখে দিয়ে পাশের চেয়ারে তাকাতে থমকে গেল। তার পাশে যেন একটা শুভ্র পরি বসে আছে। সিম্পল সাদা রঙের ড্রেসের সাথে সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় লাগছে হাঁটু অব্দি খোলা চুল আর সমুদ্র-নীল চোখ। সে চোখই ফেরাতেই ভুলে গেছে। কোনো রকম টেনে-হিঁচড়ে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে পাশের রমণীকে অনুভব করার চেষ্টা করল।

। শুদ্ধ মনে মনে প্ল্যান করল—এভাবে আর দূরে থাকা যাচ্ছে না, কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু তার মন এসব কথা পাত্তা না দিয়ে বলল—”বেশি না ভেবে এখন চুপচাপ দেখে যা!”
অরণ্য আর সমুদ্র নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে, পৃথম ফোনে মুচকি-মুচকি হাসছে। সদাফ, রাজ আর প্রেম গোগ্রাসে গিলছে। শুধু প্রণয় আর পরিণীতা অনুপস্থিত। প্রহেলিকা আর প্রেরণা রান্নাঘরে ব্যস্ত।
তন্ময় আর প্রিয়তার কোনো কাজ নেই। তারা হাঁ করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তন্ময় তখন থেকে উশখুশ করছে কিছু একটা বলার জন্য। তার এমন মুচরামুচরি দেখে প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বললো—

—”কি হয়েছে তোর?”
তন্ময় আপুর ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি গলায় বললো—
—”প্রিয় আপু…”
প্রিয়তা কপালে ভাঁজ ফেললো। “গতিক! সুবিধার ঠেকছে না। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে!”
পরিণীতা স্পষ্ট বাংলায় বললো—
—”এতো অভিনয় না করে কি চাই? পরিষ্কার বল!”
এই কথা শুনে তন্ময় একটু সোজা হয়ে বসলো। ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে বললো—
—”আজকে তো শুক্রবার, সবাই বাসায়!”
প্রেম ফোড়ন কেটে বললো—
—”তো তোর জন্য কি বাসায় থাকবো না?”
তন্ময় বিরক্ত চোখে ছোট দাদানের দিকে তাকালো।
সে ফুস করে শ্বাস নিয়ে বললো—
—”আজকে আমরা মেলায় যাব।”
এমন কথায় সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে।
তন্ময় বললো—

—”রায়পুরের দক্ষিণ সীমান্তে বিশাল মেলা বসেছে। আর আজ আমরা সবাই সেখানে যাব।”
অরণ্য বললো—
—”শখ কত! আব্বু, চাচ্চু আর বড় দাদার জানতে পারলে তোর পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে!”
তন্ময় কাঁদো কাঁদো হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকাল।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি?”
তন্ময় ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে আপুর কোল চড়ে বসলো। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর পানে।
তন্ময় আপুর গালে টুকুস টুকুস করে দুইটা চুমু দিয়ে বলল, “প্রিয় আপু, তুমি অনেক সুন্দর!”
এমন বেহুদা তেল মারা দেখে প্রিয়তা বিরক্ত হলো।
প্রিয়তা বলল, “আবার কি চাই?”
তন্ময় আপুর গালে আরেকটা চুমু খেয়ে বলল, “আপু, তুমি যদি বলো, বড় দাদান না করবে না। প্লিজ আপু!”
তীর আর তোরি ও সম্বতি জানিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আপু। তুমি যদি বলো, তাহলে দাদান রাগ করবে না, যেতে দেবে। প্লিজ আপু!”

প্রিয়তা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, “আমি পারবো না। তোরা যাবি এর জন্য পারমিশন তোদের কেই নিতে হবে।”
সমুদ্র বলল, “ভাই, তোরা আর যাওয়া হচ্ছে না।”
প্রীতম সবাইকে ধমক দিয়ে বলল, “কেন শুধু শুধু আমার ছোট ভাইটার সাথে লাগছো?”
প্রীতমের প্রশ্রয় পেয়ে তন্ময় মুখটা কাঁদো কাঁদো করে ফেলল। সে যেভাবে লাফিয়ে প্রিয়তার কোলে উঠেছিল, সেভাবে লাফিয়ে নেমে গেল।
প্রীতম একটু প্রশ্রয় দিয়ে বলল, “কাঁদিস না ভাই।”
তন্ময়ের চোখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। সে আবারো তরতর করে বসা থেকে উঠে প্রীতমের কোলে গিয়ে বসল। প্রীতমের গালে একটা চুমু খেয়ে বললো—

—”ও মেজো দাদান, প্লিজ তুমি বলো! তুমি বললে বড় দাদান রাজি হয়ে যাবে, প্লিজ!”
ছোট ভাইয়ের এমন অনুনয়-বিনয় দেখে প্রীতমের মন গলে গেল। সে ছোট ভাইয়ের গাল টেনে দিয়ে বললো—
—”ঠিক আছে, বলব।”
সে আবার প্রীতমের গালে চুমু দিয়ে বললো—
—”এই জন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি!”
প্রিয়তা নাক সিটকে বললো—
—”ঢং!”
সদাফ তখন থেকে এদিক-ওদিক চোখ ঘুরাচ্ছে আর ছটফট করছে। তার এমন ছটফটানি দেখে শুদ্ধ বললো—
—”যাকে খুঁজছো, সে নেই এখানে।”
সদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো—
—”তুমি কেমন করে জানলে আমি কাকে খুঁজছি?”
শুদ্ধ টিস্যুতে মুখ মুছে সদাফের দিকে তাকালো। বাঁকা হাসি দিয়ে বললো—
—”আমি একজন ডাক্তার, এতটুকু না বুঝলে হয়? আর তাছাড়া কিভাবে জানলাম, সেটা বড় কথা না। যা বলেছি, সেটাই বড় কথা।”

শুদ্ধ একটু চিন্তার অভিনয় করে বলল, “আমি যা দেখছি, তোমার কপালে আমার থেকেও বেশি দুর্ভোগ আছে।”
সদাফ অবাক ভঙ্গিতে বলল, “মানে?”
শুদ্ধ একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “সেটা তো সময় হলেই বুঝতে পারবে।”
সদাফ ওর কথার আগামাথা পেল না। শুদ্ধ আবারও বলল, “এখনো সময় আছে। যেটা বলেছি, করে ফেলো। না হলে পরে দেখা যাবে, কেঁদে কুল পাবে না।”
সে টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে উঠে যেতে যেতে বললো—
—”যদি তুমি আমার শত্রুর বন্ধু হও, তবুও আমি কারো খারাপ চাই না।”

সদাফ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। সে মাঝে মাঝে ভাবে, এ আসলে কি বলতে চায় আর কি বা করতে চায়! এই বাড়ির মানুষগুলো এত রহস্যময় কেন, তা বুঝে আসে না সদাফের। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বাড়ির ইট-কাঠ-পাথর—সবকিছুই রহস্যের মোটা চাদর দিয়ে আবৃত। এই বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে লুকিয়ে আছে রহস্য। এমনকি এ বাড়ির ছোট-বড় প্রত্যেকটি মানুষকেই রহস্যময় লাগে। সে চায় না এসব রহস্যের মধ্যে ফেঁসে যেতে।
সে ভেবেই রেখেছে, একবার তার ফুলপরীকে নিয়ে এই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গাতে পারলে—এই বাড়ি তো দূরে থাক, এই দেশেই আর পা রাখবে না! এত সাসপেন্স তার মোটেই পছন্দ নয়।
প্রিয়তা, ওর পছন্দের খিচুড়িতে বোম্বাই মরিচ চটকে মুখে পুরতেই, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, সেই নিষিদ্ধ পুরুষের উপস্থিতি—প্রণয় তার আশেপাশেই আছে।
এই কথা মনে হতেই, তড়িতগতিতে উপরে তাকাতেই এক জোড়া গাঢ় বাদামি বর্ণের চোখে চোখ আটকে গেল।
প্রণয়, ওর সামনে চেয়ারে বসে ওর দিকেই চেয়ে আছে। প্রণয়ের নজরে নজর আটকতেই প্রিয়তার শরীর শিরশির করে উঠলো।

কাল রাতের প্রণয়ের আদরমাখা কথা আর স্পর্শগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। মুহূর্তেই তার গোলাপি গালজুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
তার অসম্ভব লজ্জা লাগছে। প্রণয় সামনে বসে থাকায় বারবার শুধু কাল রাতের কথা মনে পড়ছে। স্পর্শগুলো যেন এখনো গায়ে লেগে আছে। সবকিছু মিলিয়ে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে, কিন্তু সে লজ্জা পেতে চাচ্ছে না। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না।
প্রণয়ের মাঝে চোখ সরিয়ে নেওয়ার কোনো তাড়া দেখা গেলো না। সে নিজের চোখের তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত। প্রিয়তার খোলা চুলগুলো তাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে। সে মনে মনে বললো, এই মেয়ে চুল খুলেছে কেন? আমাকে মারবে নাকি!
প্রিয়তা বেশি সময় ওই বাদামি বর্ণের চোখে চেয়ে থাকতে পারলো না, নামিয়ে নিলো চোখ।
তন্ময় ছুটে এসে বড় দাদানের কোলে চড়ে বসলো। প্রণয় এবার চোখ সরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো।
তন্ময় ফটাফট বড় ভাইয়ের দুই গালে দুটো চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বললো—

—”ও দাদান…”
প্রণয় স্মিত হেসে বললো—
—”বল।”
তন্ময় একটু ভয়ে ভয়ে বললো—
“আজকে তো ফ্রাইডে, সবাই একসাথে আছে। ও দাদান, আমরা একটু মেলায় যাই?”
প্রণয় দেখলো, ছোট ভাইয়ের চোখে অনুনয় প্লাস উৎসাহ। সে বাকি ভাই-বোনদের দিকে তাকালো। তারাও উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রীতম বলল, “চিন্তা নেই দাদা, আমি নিয়ে যাব ওদের।”
প্রণয় গম্ভীর গলায় বলল, “মেলা তো সন্ধ্যার সময়। তুই একা এতজনকে দেখে রাখতে পারবি?”
রাজার, প্রেম সমস্বরে বলল, “আমরা তো আছি! আমরা দেখে রাখবো। আমাদের ছোট ভাইটা এত আশা করেছে।”
তন্ময় তার প্রতি এত দরদ দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলল।
প্রণয় সবার কথা শুনে সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে।”
এমন কথায় সবাই মনে মনে খুশিতে ফেটে পড়লো।

ওদের সবার খাওয়া শেষ, তাই সবাই ফটাফট উঠে ড্রয়িং রুমের সোফায় গুছিয়ে বসলো আলোচনা করার উদ্দেশ্যে।
প্রিয়তার আর খাবার গলা দিয়ে নামছে না। প্রণয় সামনে বসে আছে, ওর কেমন কেমন লাগছে। তাই উঠে যেতে নিল।
তখনই পেছন থেকে প্রণয় গম্ভীর সুরে ডাক দিলো—
—”রক্তজবা!”
প্রিয়তার পদযুগল স্থির হয়ে গেল। সে প্রণয়ের দিকে ফিরে চাইল। পীচ কালারের টি-শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজারে মারাত্মক সুদর্শন দেখাচ্ছে। কথা বলার তালে তালে গলার Adam’s apple নড়ছে।
প্রিয়তা না চাইতেও আবারও কয়েকটা ক্রাশ খেলো।
প্রণয় বলল, “এদিকে আয়।”
প্রিয়তা প্রশ্নচোখে চাইল প্রণয়ের পানে।
প্রণয় আবারও বললো—
—”এদিকে আয়”
প্রিয়তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো। মনে মনে বলছে, ‘কালকের সব কিছু কি প্রণয় ভাইয়ের মনে আছে? কিছু বলবেন না তো আবার?’
সে ধীর পায়ে প্রণয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রণয় বললো—
—”বস।”

প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড প্রণয়ের দিকে চেয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।
প্রণয় প্রিয়তার আধখাওয়া প্লেটটা সামনে দিয়ে বললো—
—”খাইয়ে দে। কালকে তুই খাইয়ে দেওয়ার পর আর কিছু খাইনি।”
কথাটা প্রণয় স্বাভাবিক সুরেই বললো, কিন্তু প্রিয়তার হৃদয়ে
ভীষণ ভারী লাগলো। নীল চোখ জলজল করে উঠলো, ব্যথা হলো মনে।
এই জন্যই কাল রাতে পেট থেকে মদ ছাড়া আর কিছু বের হয়নি!
সে হাত বাড়াতে নিলে আবার মনে পড়লো, কাল বিকেলের প্রহেলিকার তিক্ত কথাগুলো।
সে আশেপাশে চেয়ে দেখলো, কেউ নেই। কিন্তু দেখে ফেললে নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না।
তাই প্রিয়তা আবার নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলো।
প্রিয়তাকে ইতস্তত করতে দেখে প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বললো—

—”কি হলো?”
প্রিয়তা প্রণয়ের দিকে করুণ চোখে তাকালো। প্রণয়ও ওর দিকেই চেয়েছিল।
প্রিয়তা ভয় ভয় বলে উঠলো—
—”বড় আপুকে ডেকে দেই? সে খাইয়ে দেবে।”
এই কথা শোনামাত্রই প্রণয় চরম রেগে গেল। ধমক দিয়ে বললো—
—”আমি তোকে বলেছি, অন্য কাউকে নয়! যদি অন্য কারো প্রয়োজন হতো, নিশ্চয়ই তোকে বলতাম না।”
প্রণয়ের কণ্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট।
প্রিয়তা মাথা নিচু করে নিলো।
প্রণয় কিছু না বলেই টেবিল থেকে উঠে যেতে নিল।
প্রিয়তা পিছন থেকে ডেকে বললো—

—”খাবেন না?”
প্রণয় কঠিন গলায় বললো—
—”ক্ষিধে নেই।”
সে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। গটগট করে ওপরে চলে গেল।
প্রিয়তা অশ্রুশিক্ত চোখে চেয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। সমস্ত আনন্দ কোথায় যেন পালিয়ে গেল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আবার প্রণয় ওর ওপর রাগ করে না খেয়েই চলে গেল। মানুষটা পুরো একটা দিন ধরে না খেয়ে আছে—ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
প্রণয় নিজের ঘরে ঢুকেই দেখলো, প্রহেলিকা ফোন কানে ধরে আছে। প্রণয় কিছু না বলে পিছনে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রহেলিকা বলছে,
— “একটা কিছু করো। এভাবে তো আর চলতে পারে না! তুমি যদি কোনো উপায় বের না করো, তাহলে আমিই কিছু একটা করে দেব।”
এটা বলতে বলতেই সে দরজার দিকে ফিরলো। সামনে প্রণয়কে দেখে চমকে উঠলো; হৃদপিণ্ড যেন লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। প্রণয় সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রহেলিকার দিকে। প্রহেলিকার হাঁটু সামান্য কেঁপে উঠলো। এসির মধ্যে থেকেও মনে হচ্ছে, সে ঘামছে! মনে মনে বললো, “সব শুনে ফেলল নাকি?”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বললো,

— “কার সাথে কথা বলছিলে?”
প্রহেলিকা ভীষণ স্মার্ট—সে এমনভাবে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে যে কেউ এক সেকেন্ডের জন্যও বুঝতে পারবে না। সে ভাবলো, আগে বুঝে নিতে হবে—কতদূর শুনেছে!
প্রহেলিকা ছুটে প্রণয়ের কাছে চলে এলো। অশ্রুশিক্ত চোখে বললো,
— “কোথায় ছিলে প্রণয়, কাল সারারাত?”
বলতে বলতেই প্রণয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদে দিয়ে বললো,
— “তুমি জানো, কাল রাতে আমি এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি! তোমাকে কতবার ফোন দিয়েছি! সকালে কতবার ফোন করেছি, কিন্তু তুমি একবারও ধরোনি। কোথায় ছিলে?”
প্রণয় এমন সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল, কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। মৃদু হেসে বললো,

— “ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল।” বলে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল।
পাশের সোফায় গিয়ে বসে পড়লো।
প্রহেলিকা নিশ্চিত হলো, তেমন কিছুই সে শুনতে পায়নি। অদৃশ্য হাতে নিজের মাথায় চাটি মারলো। “আজ একটুর জন্য ধরা পড়ে যেতে বসেছিলাম! শুদ্ধ ঠিকই বলে—আমি একদম অসাবধান! আমাকে আরও সাবধান থাকতে হবে!”
প্রণয় নিজের ল্যাপটপ খুলতে খুলতে বললো,
— “কি হলো? বললে না, কার সাথে কথা বলছিলে?”
প্রহেলিকা বললো,
— “আসলে বিসিএস-এর কিছু জটিলতা নিয়ে একটা বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম।”
প্রণয় ছোট্ট করে বললো,
— “ওহ।”

প্রহেলিকার কোনো বিষয়েই তার কোনো আগ্রহ নেই। সেখানে সে কি করলো, না করলো—সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় তার নেই।
প্রণয় দ্রুত হাতে মেইল চেক করছে।
প্রহেলিকা কাছে এসে মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
— “তোমার এখন আর বউকে ভালো লাগে না, তাই তো?”
প্রণয় কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বললো,
— “এমন মনে হওয়ার কারণ?”
প্রহেলিকা প্রণয়ের কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে নিয়ে নিজে বসতে বসতে বললো,
— “তুমি কখনো নিজের ইচ্ছেতে আমার কাছে এসেছো? আমি তো একটা মেয়ে—সব সময় কি সব কিছু মুখে বলতে পারি? তুমি তো আমার স্বামী, তুমি ও তো একটু বুঝে নিতে পারো!”
প্রণয়ের এসব প্যাঁচাল ভালো লাগল না। সে বললো,
— “তুমি সব সময় যা চেয়েছো, তাই তো হয়েছে। আর কি চাও?”

প্রহেলিকা মনে মনে জ্বলে উঠলো। সে ভালোই বুঝেছে, প্রণয় তাকে পছন্দ করছে না। কিন্তু প্রণয় পছন্দ না করলেই কি হবে? প্রহেলিকা যা চায়, তা সে আদায় করে নিতে জানে।
প্রহেলিকা প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে মোহনীয় গলায় বললো,
— “আচ্ছা প্রণয়, তোমার একটা জিনিস চাইবো, দেবে?”
প্রণয় ভাবলেশহীনভাবে বললো,
— “কোনটা চেয়ে পাওনি?”
প্রহেলিকা প্রণয়ের ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
— “পেয়েছি। আমি জানি তো, তুমি আমাকে কত ভালোবাসো। কখনো কিছুতেই না বলোনি।”
প্রণয় বললো,
— “এখন তোমার নিশ্চয়ই বড় কিছু চাই।”
প্রহেলিকা আবারও লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে বললো,
— “হুম্…”

প্রণয় বেশি কিছু না ভেবে ওয়ালেট থেকে নিজের ক্রেডিট কার্ডটা বের করে প্রহেলিকার হাতে দিয়ে বললো,
— “যতো বড় কিছুই দরকার, কিনে নিও।”
বলেই আবার ল্যাপটপ হাতে নিলো।
প্রহেলিকা হাতের কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রেগে বললো,
— “তোমার কি মনে হয়, আমি শুধু তোমার কাছে টাকা চাই?”
প্রণয় এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
— “তাহলে কি চাও?”
প্রহেলিকা নিজের রাগটা শান্ত করার চেষ্টা করল। প্রণয়ের গলায় চুমু খেয়ে বললো,
— “স্পেশাল কিছু… যেটা আমাদের জীবনটাই পাল্টে দেবে।”
প্রণয় আবার ভীষণ চটে গেল। মনে মনে বললো, “তুমি তো এমনিতেই আমার জীবন পাল্টে দিয়েছো। আর কি পাল্টানোর বাকি আছে?”
প্রণয় বললো,

— “কি চাও, স্পষ্ট করে বলো।”
প্রহেলিকা লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে বললো,
— “আমরা তো দু’জন… এখন দুই থেকে তিনজন হতে চাই। আমাদের জীবনে ভালোবাসার চিহ্ন আনতে চাই—ছোট্ট একটা প্রিন্স বা প্রিন্সেস। যে আমাকে ‘আম্মু’ ডাকবে, তোমাকে ‘আব্বু’ ডাকবে।”
এমন কথা শুনেই প্রণয়ের হাত থেমে গেল, চমকে তাকালো প্রহেলিকার মুখের দিকে। প্রহেলিকা লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে বসে আছে।
— “প্রহেলিকা, বাচ্চা পর্যন্ত চলে গেছে!”
হঠাৎ প্রণয়ের বুকটা কেমন চিনচিনে ব্যথায় ছেয়ে গেল। বাচ্চার কথা শুনতেই মনে পড়ে গেল দশ বছর আগের কিছু কথা…
অতীত—
ছয় বছরের ছোট্ট প্রিয়তা পুতুল খেলছে প্রণয়ের ঘরে বসে।

মেয়েটা পুতুল খেলছে ঠিকই, কিন্তু ও নিজেই যেন একটা জীবন্ত পুতুল। শিশুসুলভ চেহারায় অপার্থিব মায়ার সাগর, যা সবাইকে চরমভাবে আকর্ষিত করে বাচ্চাটার প্রতি যে-ই দেখতো, সেই আদর করতে চাইতো। কিন্তু প্রণয় কাউকে হাত পর্যন্ত লাগাতে দিতো না। প্রণয়ের অনুমতি ছাড়া বাইরের কারো চোখ তুলেও তাকানো বারণ।
প্রিয়তা কোমর সমান লম্বা, চুলগুলো দু’পাশে ঝুটি করা। সামনের বেবি হেয়ারগুলো কপালে পড়ে আছে। একটা বেবি ফ্রক পরে প্রণয়ের ঘরের মেঝেতে বসে পুতুল খেলছে। একটা পুতুলকে কোলে নিয়ে তখন থেকেই আদো আদো গলায় বলে যাচ্ছে—
— “এই, আম্মু ডাক। ডাক বলছি!”

কিন্তু কিছুতেই পুতুলটা “আম্মু” ডাকছে না!
এমন করে অনেকবার জোড়াজুড়ি করার পরও যখন কাজ হলো না, তখন মুহূর্তেই নীলচে চোখ পানিতে টলমল হয়ে গেল। অভিমানি প্রিয়তার ভীষণ অভিমান হলো। গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো!
প্রণয় তখন মাত্রই ওয়াশরুমে ঢুকেছে গোসল করার জন্য। সে ভীষণ ক্লান্ত। ইউনিভার্সিটিতে তার অ্যাডমিশন টেস্ট চলছে। সারাদিন শেষে ঘরে ফিরেই দেখলো, প্রিয়তা তার মেঝেতে বসে পুতুল খেলছে। তার সারাদিনের ক্লান্ত হৃদয়টা প্রশান্তিতে শীত হয়ে গেল।
সে ছুটে গিয়ে প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিলো। সারা শরীর থেকে বেবি পাউডার আর বেবি লোশনের গন্ধ নাকে আসলো। প্রিয়তার ফুলো-ফুলো গালে টপাটপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো—

— “আমি স্নান করে আসি, রক্তজবা।”
প্রিয়তা ওর গালে পরপর অনেকগুলো ছোট ছোট চুমু খেয়ে বললো—
— “পরে আগে চলুন, আমার মেয়ের বিয়ে দেবো!”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বললো—
— “তোর মেয়ে?”
প্রিয়তা মাথা দুলিয়ে বললো—
— “হুম! শুধু আমার একার মেয়ে কেন বলছেন?”
প্রণয় বললো—
— “তাহলে?”
প্রিয়তা আদো আদো গলায় বললো—
— “ওর বাবা তো আছে!”
প্রণয়ের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। মনে মনে বললো, “এই পিচ্চি বলে কি!”
বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো—

— “কে?”
প্রিয়তা প্রণয়ের গলায় জড়িয়ে ধরে আরেকটা চুমু খেয়ে বললো—
— “আপনিই!”
প্রণয় আশ্চর্য হলো! মনে মনে বললো, “আমি আবার কবে পুতুল জন্ম দিলাম?”
প্রিয়তা বললো—
— “কি ভাবছেন, প্রণয় ভাই?”
প্রণয় প্রিয়তার বেবি হেয়ারগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ভাবনার সুরে বললো—
— “আমি কেন ওর বাবা হবো? আমি তো ওর বাবা নই!”
প্রণয়ের বিরোধিতা শুনে প্রিয়তার নাকের পাটা ফুলে উঠলো। জড়িয়ে আসা গলায় বললো—
— “না, আপনি ওর বাবা!”
বলতে বলতেই কান্না করে দিলো।

প্রণয় মোহিত হয়ে চেয়ে রইলো নিজের কোলে থাকা পুতুলটার দিকে। সে নিজেই একটা পুতুল, আর আরেকটা পুতুলের পিতৃত্বের দাবি নিয়ে আসছে!
প্রণয় প্রিয়তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে নরম গলায় বললো—
— “কাঁদে না, জানবাচ্চা! আমি তো মজা করছিলাম। আমি ওর বাবা, হ্যাপি!”
প্রিয়তার কান্না কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল।
প্রণয় মনে মনে হেসে বললো—
— “কি পাল্টিবাজ মেয়ে রে বাবা! সত্যি, ভবিষ্যতে এরা মা-মেয়ে মিলে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে!”
প্রণয় আবার প্রিয়তার গালে চুমু দিয়ে বললো—
— “তাহলে, আমি গোসল সেরে আসি, জানবাচ্চা।”
প্রিয়তা প্রণয়ের নাকে চুমু দিয়ে বললো—

— “আচ্ছা!”
প্রণয় প্রিয়তাকে খাটে বসিয়ে কেবলই ওয়াশরুমে ঢুকেছে, তখনই আবার প্রিয়তার কান্নার শব্দ ভেসে এলো।
প্রণয়ের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলো—
“আমার নীলাঞ্জনা আবার কোথায় ব্যথা পেলো?”
ছুটে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই দেখলো, প্রিয়তা মাটিতে পড়ে কাঁদছে।
প্রণয় দৌড়ে গিয়ে প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিলো। সান্ত্বনা দিয়ে বললো—
— “কি হয়েছে, রক্তজবা?”
প্রিয়তা ক্রন্দনরতো গলায় বললো—
— “ওরে! কতক্ষণ থেকে আম্মু ডাকতে বলছি, ডাকছেই না!”
প্রণয় একবার প্রিয়তার দিকে, আর একবার পুতুলের দিকে তাকালো। মনে মনে বললো—
“পাগলী!”
প্রণয় বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো—

— “ওটার তো প্রাণ নেই, কথা বলতে পারে না! তোকে আম্মু কীভাবে ডাকবে?”
প্রিয়তা নাক টেনে বললো—
— “তাহলে ওরকম একটা এনে দাও, যে আম্মু ডাকবে!”
প্রণয় প্রিয়তার দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো—
— “অবশ্যই এনে দেবো। কিন্তু এখনো তো দেওয়া যাবে না।”
প্রিয়তার চোখ-মুখ কালো হয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে বললো—
— “তাহলে কবে দেবেন?”
প্রণয় নরম তুলতুলে গালে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো—
— “এর জন্য আগে তোকে বড় হতে হবে। তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা, তাহলেই তোকে একটা আসল মেয়ে এনে দেবো!”

বর্তমান—
প্রহেলিকা ঝাঁকিয়ে বললো—
— “কি ভাবছো, প্রণয়?”
প্রণয় চমকে উঠলো। তড়িৎ বেগে প্রহেলিকার দিকে তাকালো।
প্রহেলিকা বললো—
— “কি দেবে? তো আমাদের বিয়ের দুই বছর হতে চললো! বড় আম্মুও সেদিন বলছিলেন, এখন একটা নাতি-নাতনির দরকার!”
প্রণয় তড়াক করে বসা থেকে উঠে গেল। কঠিন গলায় কাঠ-কাঠ কণ্ঠে বললো—

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৪

— “কোনো বাচ্চাকাচ্চা হবে না! আর এই নিয়ে আমি দ্বিতীয় কোনো কথা শুনতে চাই না!”
বলেই দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো।
প্রহেলিকা রাগে জ্বলে উঠলো। টাইলসের মেঝেতে লাথি দিয়ে বললো—
— “খুব পিরিত দেখছি! কিন্তু তোমার বাচ্চা আমার পেটেই হবে—তুমি চাও বা না চাও, হবেই!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৬