ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৭
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
বিকেল ৩টা ৩০। হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে পেসেন্টের পরিবারের সকলে অস্থির পায়চারি করছে। পেশেন্টের মা তো বাবার ছেলে, ছেলে করে জ্ঞান হারাচ্ছেন। অপারেশন এখনো চলছে, সকলেই ভীতসন্ত্রস্ত, কখন না জানি কি দুঃসংবাদ শুনতে হয়।
আরো মিনিট ২০ পর রুমের বাতি নিভে গেল। সকলেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলো তুহিনা, সহ আরো দু’জন অ্যাসিস্ট্যান্ট। তারা পেসেন্টের পরিবারের দিকে তাকিয়ে, একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
লোকটার বাবা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে, আহত কণ্ঠে সুধালেন,
— “বেঁচে আছে তো আমার ছেলে?”
উনার অবস্থা দেখে তুহিনার ভীষণ কষ্ট হলো। তবু, সে সাবলীল ভঙ্গিতেই জানালো,
— “পেশেন্টের কন্ডিশন সম্পর্কে ডাক্তার চৌধুরী বলবেন।”
আরো দুই মিনিট পর, অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলো শুদ্ধ। টানা ৬ ঘন্টা লেগেছে, তাই এই সার্জারি কমপ্লিট করতে। পেশেন্টের বাবা শুদ্ধকে দেখে, ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে, করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— “বাবা, বেঁচে আছে তো আমার ছেলে?”
কন্ঠ ভীষণ আহত শোনালো ভদ্রলোকের।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শুদ্ধ কয়েক সেকেন্ড উনার দিকে তাকিয়ে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, যথেষ্ট বীনয়ি ভাবে সম্মতি জানিয়ে বললো,
— “হুঁ… বেঁচে আছে। তবে, ৭২ ঘণ্টা পার না হলে বলা যাচ্ছে না, অপারেশন কতটা সাকসেসফুল হয়েছে। তাই আপাতত আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন,” বলে চলে গেলো।
ভদ্রলোকের চোখে মুখে তীব্র অসহায়ত্ব।
তিনি এই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না।
তুহিনা, সহ অন্যান্য অ্যাসিস্ট্যান্টরা দেখলো, উনার অবস্থা, তাদের মন ব্যথিত হল।
তুহিনা ধীর পায়ে, উনার কাছে এগিয়ে, নরম কণ্ঠে ডাকলো,
— “আঙ্কেল।”
ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন।
তুহিনা উনাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
— “আপনি চোখ বন্ধ করে ধরে নিন, আপনার ছেলের অপারেশন ৯৯% সফল হয়েছে, আঙ্কেল।”
বাকি ৯ জনও একই ভঙ্গিতে সম্মতি জানালো।
ভদ্রলোকের চোখে মুখে খানিক আশার আলো ঝলকে উঠলো।
তিনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
— “তবে ডাক্তার সাহেব… যে বললেন?”
তুহিনা পুনরায় বললো,
— “ডাক্তার চৌধুরী কিছু সম্ভাব্য আশংকার কথা জানিয়েছে, যার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই আপনি এতো পেনিক করবেন না, আঙ্কেল। আপনি জানেন, উনি কত বড় ডাক্তার! উনার ক্যারিয়ারে কোনো ফেলিউর নেই। উনার হাতে আজ বব্দি একটা পেশেন্টও মারা যায়নি। আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারেন।”
ভদ্রলোকের মনে হয়, বুক থেকে ভারী বোঝা নেমে গেল।
তিনি হাত তুলে দোয়া দিলেন, কিন্তু কাকে দিলেন, সেটা বোঝা গেল না।
শুদ্ধ কেবিনে ঢুকে এপ্রোনটা খুলে চেয়ারের উপর গা এলিয়ে দিল। শরীরটা কেমন জানি, বড্ড মেজমেজ করছে তার…
সে বসে চোখ বন্ধ করতেই চোখের পাতায় ভেসে উঠলো একজোড়া ভীষণ মায়াবী নীল চোখের প্রতিচ্ছবি।
সে ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। ফোনের গ্যালারি ঘেঁটে একটা ছবি বের করলো—যেখানে কালো শাড়ি পরিহিতা এক অপরূপ মায়াবী কন্যা,
যার চোখে-মুখে উপচে পড়া লাবণ্য আর উজ্জ্বলতা।
সে ছবিটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মাদকীয় কণ্ঠে বলল,
“সুইটহার্ট, বড্ড পুড়ছি আমি। তুমি হীনা তৃষ্ণার্ত চাতকের মত ছটফট করে মরছি।
তোমার এতটুকু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে আছে এই তৃষ্ণার্ত, পিপাসার্ত বুক।
কেন আমার থেকে দূরে দূরে পালাও তুমি, প্রিয়তমা?
কেন আমাকে আপন ভাবতে পারো না?
কবে তুমি সম্পূর্ণ আমার হবে, প্রিয়তমা?
কবে হবে আমাদের সুখের সংসার?
কবে আমার দিনের শুরুতেও তুমি থাকবে, মধ্য রাতের আবেশেও তুমি থাকবে?
কবে সমাপ্ত হবে আমার এই অসহনীয় দিন?
কবে আমাকে মুড়িয়ে নেবে তোমার ভালবাসার চাদরে, মুক্তি দেবে সকল যন্ত্রণা হইতে?”
তার গভীর চিন্তাভাবনার মাঝেই ফোনটা তীব্র শব্দ তুলে বেজে উঠলো—
ভাবনার শুতো ছিড়ে যেতেই চরম বিরক্ত হলো শুদ্ধ।
ফোনটা হাতে নিয়ে, ফোনে ভাসতে থাকা নাম্বারটাতে দৃষ্টি আটকাতেই বিরক্তির মাত্রাটা একটু বাড়লো।
সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশের ব্যক্তি ঝাঝিয়ে উঠে বললেন,
“কি ব্যাপার, চারটা কি এখন বাজে? এখনো আসছো না কেন? কি করো এত?”
শুদ্ধের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলেও সে ঠান্ডা কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল,
“বাসর করছি, ডিস্টার্ব করবেন না।”
এমন লাগামছাড়া জবাবে অপর প্রান্তের ব্যক্তির কাশি উঠে গেল।
তিনি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমি অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি আসো,” বলে ফোন কেটে দিলেন।
চরম বিরক্তির সহিত শুদ্ধ,
মনে মনে কিছু ভয়ঙ্কর গালি আওড়ে বেরিয়ে গেল।
প্রিথম আর ইনায়া বসে আছে একটা বিলাসবহুল ক্যাফেতে।
সামনে তাদের হরেক রকমের উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবার, বেশিরভাগটাই সুইট আইটেম।
ইনায়া খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে মুখ চুপসে বসে আছে।
প্রিথম ওর সামনের চেয়ারে বসে রাগী রাগী লুকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ইনায়া বেচারির অবস্থা বিড়ালের মুখে ফেঁসে যাওয়া অসহায় মাছের মতো।
প্রিথম যেভাবে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে, ইনায়ার মনে হচ্ছে—এই লোক বোধ হয় এখনই টুকুস করে গিলে ফেলবে।
ইনায়া নিজের সাফাইয়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য হাঁ করবে, তার পূর্বেই প্রীতম রাগী অথচ শান্ত কণ্ঠে বললো,
— “তোমাকে এক্ষুনি কামড়ে খেয়ে ফেলবো, তাই দুই মিনিট সময় দিলাম। শেষ ইচ্ছা প্রকাশের জন্য কিছু বলার থাকলে বলো, না হলে আমি আমার কাজ শুরু করছি?”
ইনায়ার অন্তর-আত্মা লাফিয়ে উঠলো। সে ভয়ার্থ চোখে প্রীতমের দিকে তাকিয়ে তুতলিয়ে বললো,
— “ক-ক-কি বলছেন এসব? খেয়ে ফেলবেন, মামানে?”
প্রীতম চোখ ছোট ছোট করে ইনায়ার দিকে তাকালো, রহস্যময়ী হেসে মুখটা একদম ইনায়ার মুখের সামনে এনে গভীর কণ্ঠে বললো,
— “হুম, এক্ষুনি খেয়ে ফেলবো। বলো, কোথা থেকে খাওয়া শুরু করব!”
ইনায়া ভয়ে ভয়ে প্রীতমের নীল চোখের দিকেই তাকিয়ে ঢোঁক গিললো। প্রীতম এখনো তার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সত্যি সত্যি ইনায়ার সম্মতির অপেক্ষা করছে।
প্রীতম ইনায়ার হা হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বললো,
— “তাড়াতাড়ি বলো, রসগোল্লা আমার! আর তর সইছে না। না হলে পরে দেখা যাবে, এখন যতটুকু আছে, কিছুদিন পর আর এটুকুও থাকবে না। তার মানে কি দাঁড়ালো? ফুল লস! আর আমি শিকদার বংশের ছেলে—ব্যবসায়িক নীতি শিরায় শিরায় বইছে। এই প্রতীক শিকদার প্রীতম তার এত বড় প্রোজেক্টে কিছুতেই লস খেতে চায় না!”
ইনায়া কাঁপা কণ্ঠে বললো,
— “মামানে, কিকিসের লস?”
প্রীতম ভ্রু বাকিয়ে উত্তর দিল,
— “লস না! আর কয়েকদিন পর তো তোমাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আমার রসগোল্লা শুকিয়ে সাবুদানা হয়ে যাবে! মানে ব্যাপারটা কি হলো? আমি আঙ্গুর গাছের মালিক, কষ্ট করে গাছে আঙুর ফলালাম , পাকালাম, —কিন্তু সেটা খাওয়ার ও সময় এলো কিন্তু আমার পেটে যাওয়ার আগেই আমার এত মেহনতের ফসল শুকিয়ে কিসমিস হয়ে গেল! এটা আমি মানতে পারবো না! তাই বুকে পাথর চেপে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
ইনায়া অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
— “কি?” মনে মনে বললো, এই লোক কি ভিনগ্রহের কোন এলিয়েন?
ইনায়া যখন গভীর চিন্তাভাবনায় ডুবে, প্রীতম দুষ্টু হেসে একদম তার কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসলো। ইনায়ার নরম কোমর চেপে ধরে, কাঁধে নাক ঘষে দিয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,
— “আজকেই খেয়ে ফেলবো! পুরোটাই খেয়ে ফেলবো!”
প্রীতমের স্পর্শে আর হঠাৎ বদলে যাওয়া কণ্ঠে ইনায়ার বক্ষপিঞ্জরে কাপন ধরল। হঠাৎ করেই গলা শুকিয়ে গেল, পানির অভাব বোধ করলো। প্রীতম ওর অবস্থা দেখে বাঁকা হাসল। ভয় আর লজ্জা আর একটু বাড়িয়ে দিতে, গালের কাছে মুখ নিয়ে নেশাগ্রস্তের ন্যায় বললো,
— “ভয় পেলেই তো তোমাকে ছেড়ে দেবো না, রসগোল্লা। এটা তোমার শাস্তি!”
“No one can stop me now… not even you.
I’ll eat you alive… slowly.
And you’ll smile, thinking it’s all over —
but that’s exactly when the real game begins.”
প্রীতমের এমন নেশা জড়ানো কণ্ঠে ইনায়া চোখ বন্ধ করে নিল। নিঃশ্বাসের তীব্রতা বেড়ে গেল, কাঁপন ধরল তার হাড়ে হাড়ে।
প্রীতম তার ডান হাত দিয়ে ইনায়ার গলায় হালকা স্লাইড করল। ডান পাশের চুল সরিয়ে বা পাশের দিকে ঠেলে দিয়ে সেখানে চরম ভালোবাসায়, উষ্ণ গভীর চুম্বনে তাকে ছুঁয়ে দিল।
প্রীতমের ঠোঁটের পরশ অস্তিত্বে অনুভব হতেই সর্বাঙ্গে যেন তীব্র বৈদ্যুতিক ঝটকা লাগল ইনায়ার। সে আবেশে খামচে ধরল প্রীতমের ডান বাহু।
প্রিয় নারীর নরম দেহের স্পর্শে আর গন্ধে প্রীতমের তীব্র নেশা চেপে বসল। ঘোর লেগে এলো চোখে। সে কানের লতিতে চুমু খেয়ে বলল,
“You’re the poison I crave — dark, delicious, and deadly to my soul.”
বলতে বলতেই তার ঠোঁটের স্পর্শ লাগামহীনভাবে ছুটে চলতে লাগলো ইনায়ার অস্তিত্বে।
কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর প্রীতমের এমন বেপরোয়া স্পর্শ আর নিতে পারলো না ইনায়া। সে প্রীতমের চুল খামচে ধরে আকুল কণ্ঠে অনুনয় করে বলল,
— “Don’t do this, Pritham… please stop!”
প্রীতম সত্যিই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। সে টেনে হিচড়ে নিজেকে সরিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল।
দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে সে।
তার দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দু উত্তপ্ত লাভার ন্যায় ফুটছে। গলার অ্যাডামস অ্যাপল দ্রুত উঠানামা করছে। দেহের শিরায় শিরায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরুষালী হরমোনেরা, যারা প্রিয় নারীর সংস্পর্শে এলেই মাথায় চড়ে বসে।
সে ইনায়ার দিকে চাইল। ইনায়ার রক্তিম গাল নজরে আসতেই দমিয়ে রাখা তীব্র অনুভূতিরা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
সে চোখ বন্ধ করে নিয়ে কাটাকাটা কণ্ঠে হুমকি দিয়ে বলল,
— “আমার সামনে একদম লাল হবে না রসগোল্লা। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছি। আবার যদি মাথা খারাপ করে দাও, তাহলে সত্যি বলছি, আল্লাহর কসম, এখান থেকে তুমি আর বেঁচে ফিরবে না।”
এমন ভয়ানক হুমকি কর্ণকুহরে পৌঁছতেই ইনায়ার লজ্জারা জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিল।
প্রায় মিনিট দশেক পর প্রীতম শান্ত হয়ে ইনায়ার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
— “গ্রীন সালাদ অর্ডার দিয়ে দিব জান খাবে?”
প্রীতমের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনায়া সামনের মিষ্টির প্লেট থেকে টপাটপ দুটো রসগোল্লা গালে পুরে ফেলে থেমে থেমে বলল,
— “প্লিজ, আর হবে না।”
দুই দিকের গাল ফুলে পাহাড় হয়ে গেছে। ইনায়ার এমন বাচ্চামো দেখে প্রীতমের ভীষণ হাসি পেল।
ইনায়া গাল ভর্তি মিষ্টি নিয়ে অনুনয় করে বলল,
— “বিশ্বাস করুন, আর এমন করবো না। প্রয়োজনে দিনে চার বেলা আট প্লেট ভাত খাবো!”
প্রীতম হেসে ইনায়ার ফুলফুল দুই গালে সময় নিয়ে চুমু খেয়ে গভীর সুরে বলল,
— “আমার সামনে থেকে সরলেই তো তোমার এসব কথা মনে থাকে না। তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করবো জান?”
সে প্রীতমের সফেদ রঙা শার্টে মুখ মুছে বলল,
— “সত্যি বলছি, আর হবে না।”
প্রীতম ওর দিকে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলল,
— “সত্যি?”
ইনায়া প্রিথমের ডান হাত ধরে বললো,
— “তিন সত্যি!”
হাসলো প্রিথম। ইনায়ার গালে বুড়ো আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বললো,
— “যা ইচ্ছা করো, শুধু আমার রসগোল্লার সাইজ যেন ছোট না হয়। রসগোল্লা মুখে দিলেই যেন রসগোল্লা রসগোল্লা ফিল পাই—সেটা যেন সুজির দানা না হয়!”
ইনায়া চোখ বড় বড় করে নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। মনে মনে শিকদারদের গোষ্ঠী উদ্ধার করে বললো,
— “নির্লজ্জ পুরুষ মানুষ! ছিঃ!”
প্রিথম ক্যাফের একদিক পুরো বুক করে নিয়েছিল তার আর তার রসগোল্লার জন্য। প্রিথম আর ইনায়া বিল পে করে যাওয়ার সময় কিছু একটা দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলল প্রিথম। সে ইনায়ার গালে হাত রেখে বললো,
— “My love, তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি এখুনি আসছি। Then টেস্টি রসগোল্লা চেখে দেখবো!”
ইনায়া গাল ফুলিয়ে প্রিথমের পেটে গুতো মেরে বলল অসভ্য লোক বলে চলে গেল।
ইনায়া যেতেই প্রিথমের চোখেমুখে গম্ভীরতা ভর করল।
সে মুখে একটা কালো মাস্ক পরে কিছুটা দূরে বসা দুই ব্যক্তির দিকে ঈগলের চোখে তাকালো। অতঃপর কৌশলে তাদের পেছনের টেবিলে গিয়ে সুকৌশলে বসে পড়লো।
ক্যাফেতে একজন ব্যক্তির মুখোমুখি বসে আছে শুদ্ধ। চোখেমুখে তার চরম বিরক্তি।
সে নিজেকে সামলে সামনের ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “কি বলবেন, ঝটপট বলে ফেলুন। আমার হাসপাতালের অনেক কাজ আছে।”
সামনের ব্যক্তি শুদ্ধর দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ নীরব থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “তুমি মনে হয় ভুলে গেছো, তোমাকে আমি কি অর্ডার করেছিলাম?”
এই একটাই কথায় শুদ্ধর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তবুও সে নিজেকে সংযত রেখে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
— “শুদ্ধ চৌধুরীকে অর্ডার করছেন? আমি যা করি, নিজের ইচ্ছেতে করি। অর্ডার করে শুদ্ধ চৌধুরীকে দিয়ে কিছুই করানো যায় না।”
সামনের ব্যক্তি বোধহয় একটু মজা পেল।
সে কটাক্ষ করে বলল,
— “কিন্তু তুমি তো গত বারো বছর আমার সকল হুকুম অক্ষরে অক্ষরে তামিল করেছো। আমার হাতের ইশারায় চলেছো, যা করতে বলেছি তখন তাই করেছো, ভালো মন্দের দিকে তাকাওনি। কারণ তুমি জানো, আমার কথামতো না চললে তোমার আর দ্বিতীয় কোনো রাস্তাও নেই।
তুমি খুব ভালোভাবেই জানো, আমি না চাইলে তুমি কিছুতেই তোমার প্রাণপাখিকে তোমার করতে পারবে না। তোমাকে তোমার জান একমাত্র আমি পাইয়ে দিতে পারি। আমার সাহায্য ছাড়া ওদিকে তুমি কোনদিনও হাত বাড়াতে পারবে না।”
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল,
— “ঠিক বলেছেন। আমি আপনার সকল হুকুম মেনেই চলেছি, কারণ আপনি জানতেন আমার দুর্বলতা কী। তাই তো আপনার ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পেরেছেন। ভালোবাসায় দিশেহারা হয়ে গিয়ে আপনার সব কথা মেনে চলেছি।
কিন্তু কী জানেন তো, এখন আমি আপনাকে খুব ভালোমতন চিনি। আপনি এমনিতে ও তো কোনদিনও আমার প্রাণ আমাকে দিবেন না, শুধু গুটি হিসেবে ইউজ করে যাবেন। তাই আপনার হাতের দিকে চেয়ে থাকার মত মানুষ আমি নই।
শুদ্ধ চৌধুরী যেটা চেয়ে পায় না, সেটা সে কেড়ে নিতে জানে। আমার ভালোবাসা কেড়ে নেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে।
আসলে কী বলুন তো, আপনালে দেখে মাঝে মাঝে ভাবি—সেই যখন আপনার মতো একখান চিজ তৈরি হবে, তখন শয়তানের কি দরকার ছিল? আপনি তো মিয়া, খুব তাড়াতাড়ি শয়তানের চাকরিটাও খেয়ে নিবেন দেখি!
আপনার সাথে শয়তানি বুদ্ধিতে শয়তানও ডাহা ফেল। আপনি কী সুন্দর এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন! লোহা গরম থাকতে থাকতে ঘা মেরে দিয়েছেন, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ঢিল মেরেছেন—আমাকে আর প্রণয়কে একসাথে আপনার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
আর আমরাও আপনার প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।
কিন্তু এখন আর আমি আপনার একটা কথাও শুনতে বাধ্য নই। কারণ, আপনি যেমন আমাকে ব্যবহার করেছেন, আমিও আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ এতটা কাঁচা খেলোয়াড় আমিও নই।
আমি জাস্ট একটা টোকা দিলেই আপনার এতদিনে গড়া মান-মর্যাদার, আত্মসম্মানের, টাকা-পয়সার পাহাড়—জাস্ট গুঁড়িয়ে যাবে।
আপনাকে ধ্বংস করে দিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দিতে আমার জাস্ট ৫ সেকেন্ড লাগে।
তাই খুব সাবধান। ভুলেও ভাববেন না, এখন আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
এমন অপমানজনক কথায় সামনের ব্যক্তি একটুও রাগল না। বরং হেসে বলল,
“ভালোবাসা কমে গেছে মনে হয়, না কি এখন আর পেতে ইচ্ছে হয় না?
তুমি যদি আমার কোনো কাজেই না আসো, তবে এমন সুন্দর হরিণী তোমাকে দিয়ে আমার কি লাভ?
তুমি জানো ভালো মতোই—আমার প্ল্যান B, C এগুলো অলওয়েজ রেডি থাকে।”
প্রিয়তাকে নিয়ে এমন কুরুচিকর মন্তব্য কানে আসতেই শুদ্ধর ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে গেল।
সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল, তার কণ্ঠ অস্বাভাবিক শীতল।
সে হেসে বলল,
“আমাকেই দিবেন।
কারণ সবাই জানে ভিলেন আমি, কিন্তু পর্দার আড়ালের আসল ভিলেন সম্পর্কে কেউ কি জানে?
জানে না। তবে আমার সুইটহার্ট যদি আমার না হয়, তবে আপনার সম্বন্ধে শুধু এদেশের খবরের কাগজে নয়, সারা পৃথিবীর নিউজ চ্যানেলে প্রচারিত হবে।
আপনি একদিনেই পুরো সেলিব্রেটি হয়ে যাবেন।
আর আপনি জানেন, আমি এটা করতেই পারি।”
আমার সুইটহার্টকে পাওয়ার জন্য যদি আমাকে গোটা দুনিয়ার সাথে লড়তে হয়, শুদ্ধ চৌধুরী তাতেও রাজি।
শুধু যেকোনো মূল্যে আমার সুইটহার্ট শুধুই আমার।”
শুদ্ধের কণ্ঠ শান্ত, অথচ চোখ-মুখ ভয়ানক রকমের ভয়ংকর।
সে পুনরায় হেসে বলল,
“আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আপনি মাত্র ১৭ বছরের একটা ছেলেকে দিয়ে কী করিয়েছিলেন।
সে ওইটুকু বয়সেই যদি ৫টা খুন করতে পারে, তাহলে ১২ বছর পর সে কী কী করতে পারে, সেটা আপনার চেয়ে ভালো আর কে জানে?”
সামনের লোকটার কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার রেখা দেখা গেল।
লোকটা হেসে জবাব দিল,
“যে গড়তে পারে, সে ভাঙতেও পারে। আমি নিজের হাতে তোমাকে তৈরি করেছি। প্রয়োজনে নিজের হাতের ধ্বংসও করে দেব।”
এমন কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল শুদ্ধ। কী বিভৎস, ভয়ংকর দেখাল সেই হাসি!
সে লোকটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ভয়ংকর ভঙ্গিতে বলল,
“এখন আর আমি আপনার অকাদের মধ্যে নেই।
আমায় খোঁচাতে এলে আপনি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবেন।
যতই হোক, এতদিনের ক্রাইম পার্টনার আমরা। আপনি বরং আমার কথামতো চলুন—দেখবেন, আপনার বিশ্রী রূপ সম্পর্কে কেউ জানবে না।”
লোকটা রেগে বলল,
“দুই দিনের ছেলে, তুমি আমায় ব্ল্যাকমেইল করছ?”
শুদ্ধ হেসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“ধরে নিন তাই।”
সামনের ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হলেও—
তিনি নিজেকে ঠান্ডা রাখলেন।
কারণ, তিনি একে নিজের হাতে সাইকো বানিয়েছেন। এ যে কী পরিমাণ ভয়ানক, সেটা উনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
তাই তিনি রাগটা গিলে ফেললেন।
ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“পরিনীতা এখনও ওই ছেলেটার সঙ্গে মেলামেশা করছে কেন?”
শুদ্ধ কফির কাপে দ্বিতীয়বারের মতো চুমুক দিয়ে বলল,
“ভালোবাসে। অনেক।”
সামনের লোকটা মুহূর্তে চটে গেল। টেবিলের উপর বাড়ি মেরে বলল,
“ভালোবাসা, মাই ফুট!
তোমাকে বলেছিলাম, ওই ভিখারির বাচ্চার থেকে পরিনীতা-কে দূরে রাখতে।”
শুদ্ধ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আমি চেষ্টা করেছিলাম।
কিন্তু পরে দেখলাম, ওদের ভালোবাসার গভীরতা আপনার মনের নর্দমার গভীরতার থেকেও হাজার ফুট বেশি।”
এতক্ষণ না রাগলেও, এই মুহূর্তে সামনের ব্যক্তি রাগে ফেটে পড়লেন।
তিনি হুংকার দিয়ে বললেন,
“ওই ভিখারির বাচ্চার সঙ্গে কিসের ভালোবাসা?
ওর কিসের যোগ্যতা আছে পরিনীতাকে ভালোবাসার?”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনার সমস্যা, আপনার পরিনীতা—আপনি আলাদা করে দিন।
এটা আপনার জন্য আর কী এমন বড় ব্যাপার?
মানুষের ভালোবাসা কেড়ে নেওয়া তো আপনার পুরনো পেশা?”
শুদ্ধ একটু ভাবনার ভঙ্গিতে বলল,
“এই কেসে মনে হয় আপনার মুখোশটা সরিয়ে সামনে আসতেই হবে। ভাবছি, তখন আপনার কেমন অবস্থা হবে?
সোজাসুজি কিছু বললে আপনার মুখোশ খুলে যাবে।
আর না বললে আমার এতদিনের গড়া আত্ম-অহংকার ধুলোয় মিশে যাবে।
ভালো পেঁচে পড়েছেন আপনি!”
লোকটার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। শুদ্ধর বেশ মজা লাগল।
সে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলল,
“কি ভাবছেন? প্রণমী আর আদিলের সঙ্গে যা করেছিলেন, পরিনীতা আর আবিদের সাথেও তাই করবেন নাকি?”
‘প্রণমী’র কথা কানে যেতেই লোকটার চোখ সম্ভবত লাল হয়ে গেল, যেন চোখ বন্ধ করলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে।
শুদ্ধ দেখে বাঁকা হাসল। কণ্ঠে ঘৃণা মিশিয়ে বলল,
“আপনি কোনোদিনও কাউকে ভালোবাসতে পারেননি।
আমি জানি, আপনি প্রণমী আর আদিলের সঙ্গে যা করেছেন, ভবিষ্যতে পরিনীতা আর আবিদের সঙ্গেও তাই করবেন।”
“Whatever! আমার এসব নিয়ে কোনও ইন্টারেস্ট নেই। আপনার পরিণীতা, আপনি যা ইচ্ছা তাই করুন। আমার বন্ধু কই?”—লোকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল—“জানি না, পিছু নিয়েছিলাম, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি।”
এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল শুদ্ধকে উত্তেজিত করার জন্য। মুহূর্তেই শুদ্ধর কপালের শিরা ফুলে উঠলো। সে তাড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সামনের ব্যক্তির দিকে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল—
“আমার বন্ধুর যদি কিছু হয়, I swear তোকে আর তোর so-called মান-সম্মানকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে দেবো। Mind it!”
বলেও হন হন করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল।
লোকটা শুদ্ধর কথা কানে তুলল না, বরং সে নিজেই খুব চিন্তিত প্রণয়ের ব্যাপারটা নিয়ে।
প্রিথমের চোখ-মুখ হাঁ হয়ে গেছে—এসব কি শুনল সে? এত খারাপ এরা? এটা ভাবতেই ঘৃণায় প্রিথমের গা গুলিয়ে এলো। বিশেষ করে ওই ব্যক্তির কথা ভাবতেই প্রিথমের মন তীব্র ঘৃণায় বিষে ভরে উঠল। তার মন বলল, ওই ব্যক্তিকে নিজের হাতে শেষ করতে পারলে হয়তো একটু মানসিক শান্তি পেত।
এই মানুষ নামক জানোয়ারটার জন্যই সবার জীবনে এত সমস্যা। এর জন্যই প্রিথম তার প্রিয় আপুকে হারিয়েছে। এই লোকটার জন্যই তার বোনের জীবনে এত সমস্যা, এত কষ্ট। সে মনে মনে শপথ করল—যদি কোনোদিন সুযোগ পায়, এই ব্যক্তিকে সে নিজের হাতে শাস্তি দেবে।
কিন্তু প্রণয় ব্যাপারটা মাথায় আসতেই প্রিথমের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। সে দ্রুত হাত প্রণয়ের নাম্বারে ডায়াল করতে করতে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল।
সন্ধ্যা ৬টা। দক্ষিণ আকাশে মেঘ ঘুরঘুর করছে। খানিক পরপরই ঝড়ো হাওয়া বইছে। হয়তো রাতে আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি নামবে, হয়তো গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার আগমন ঘটেছে।
প্রিয়তা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্রিয় সাদা গোলাপের গাছে পানি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে বয়ে আসা ধমকা হাওয়া তার দীঘল চুল বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তার সারাদিন থেকেই মনটা কেমন অস্থির অস্থির করছে। সে কিছুতেই কোথাও একদণ্ড শান্তি পাচ্ছে না। বারবার তার কাল রাতের প্রণয়ের সেই অবিশ্বাসী দৃষ্টিজোড়া চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ভীষণ আফসোস হচ্ছে তার। মন বলছে—
“কেন যে কাল মিথ্যে বলতে গেলাম! একটু সাহস করে সত্যিটা বলেই দেখতাম। প্রণয় ভাই নিশ্চয়ই ওতটা ভুল বুঝতেন না। তিনি তো আমাকে আমার থেকেও ভালো বুঝেন। তিনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন, আমি মিথ্যে বলেছি।”
প্রিয়তা দোলনায় বসে দূরের আকাশে চাইল। সেখানে টুকরো টুকরো কালো মেঘ জমাট বেধে আছে। হঠাৎ হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। সে দূরের আকাশে দৃষ্টি রেখে আনমনে বললো—
“আমার মিথ্যে বলাতে আপনি কি খুব বেশি কষ্ট পেয়েছেন, প্রণয় ভাই? কী করতাম বলুন? কীভাবে বলতাম—ওই লোকটা আমাকে আপনার থেকে ও বেশি ছুঁয়ে দিয়েছে? আপনার কষ্ট হতো না? হয়তো হতো না। কেনই বা হবে! আপনি তো আমাকে ভালোবাসেননি। হয়তো ভুল বুঝতেন, খারাপ ভাবতেন—এই ভয়ে বলিনি। ভীষণ ভয় হয় জানেন? যদি আপনি আমাকে ঘৃণা করেন, আপনার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা নেই এটা মেনে নিতে পারলেও —ঘৃণা মেনে নিতে পারবো না। মরে যাব!
হয়তো আপনি আমাকে ভালোবাসেননি কখনো। কিন্তু আমি তো বাসি। আপনার চোখে ভালোবাসা না পাই, ঘৃণাও পেতে চাই না। হয়তো আমি আপনার কাছে—আপনার অভ্যাস, আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য, আপনার মায়া। কিন্তু আপনি আমার কাছে এসব কিছুর অনেক ঊর্ধ্বে। আপনি আমার… আমার কাছে আমার না-পাওয়া ভালোবাসা, আমার আমৃত্যু আক্ষেপ-অপেক্ষা, আমার বেঁচে থাকার কারণ।
হয়তো আপনি আমাকে অনেক গভীরে আঘাত করেছেন, কেড়ে নিয়েছেন সব অধিকার। ভালোবাসেননি কখনো—এর জন্য আমি আপনার উপর কোনো অভিযোগ করি না। জানেন কেন? কারণ, আপনি আপনার ভালোবাসার সাথে আছেন, ভালো আছেন। এটাই অনেক। আপনার সুখেই আমি সুখী। আপনি আমাকে ভালো না-ই বাসতে পারেন—এটা আপনার স্বাধীনতা। মনের ওপর কারো জোর চলে না।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে কতটা ভালোবেসেছি, তার কোনো পরিধি আমি নির্ধারণ করতে পারবো না। জানি না এটা ভালোবাসা, নাকি মরণ রোগ! হবে হয়তো কিছু একটা। কিন্তু আমার জন্য এটা প্রাণঘাতী।
আমার এই নিষিদ্ধ ভালোবাসা—হয়তো সবার কাছে কলঙ্ক, বেহায়াপনা, দুশ্চরিত্রতার লক্ষণ। কিন্তু কী করবো বলুন? এগুলো ত্যাগ করা আমার পক্ষে প্রাণ ত্যাগ করার থেকেও যন্ত্রণাদায়ক। এই বোঝা আমাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এটা আমার মরণের অসুখ। আপনার কথা যারা জানে, সবাই বলে—এটা পাপ, আপনাকে ভুলে যেতে। কিন্তু তারা কি কখনও আমার জায়গায় নিজেকে রেখে কল্পনা করেছে? আমার মতো করে কাউকে ভালোবেসেছে?
আপনি আমার সম্পূর্ণ ‘অবস্থিত’, আমি তার ক্ষুদ্র এক অংশ। আমি নিজেকে বাদ দিতে পারবো, কিন্তু আপনাকে নয়।”
ভুলে যাও বললেই কি আমি আপনাকে ভুলে যাবো সত্যিই কি ভালোবাসা ভোলা যায় ? সবাই যদি ভালোবেসে ভালোবাসাকে ভুলেই যায়, তবে কষ্ট পাবে কারা? যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরবে কারা? কষ্ট পেতে পেতে বাঁচার জন্য হলেও আমায় তোমাকেই ভালোবাসতে হবে প্রণয় শিকদার। যতদিন জীবনে বাঁচবো, ততদিন তোমার প্রেমানলে জ্বলে মরতে চাই—হোক সেটা সুখের বা দুঃখের।
মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনের সকল ব্যথা উজার করে গুনগুনিয়ে দুইলাইন গাইলো প্রিয়তা।
“হওওও যত বলি ভুলে যেতে মন কথা শোনে না চোখেরি আকাশে সে বৃষ্টি যে থামে না ”
“জীবনের সব চাওয়া কখনো কি পাওয়া যায় হাসিমুখে কিছু ব্যথা মেনে তাই নিতে হয় ”
ভারি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করতেই নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো কয়েকটি বিন্দু তরল।
প্রিয়তার ব্যথায় আকাশ ও বোধহয় ব্যতীত হলো তার অশ্রু জলের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশ ও কেঁদে উঠলো টুপটাপ করে পড়তে লাগলো বছরের প্রথম বারিধারা।
বাইরে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়াতে শিকদার বাড়ির পরিবেশ বেশ সরগরম। সকলের দাবি, আজকের ডিনারে কেবল খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা হবে। চার গিন্নি মিলে স্পেশাল খিচুড়ি রান্নায় ব্যস্ত। ড্রইংরুমে সব ভাই-বোন মিশে খুশ গল্পে মেতে উঠেছে, শুধু প্রিথম একদম চুপচাপ বসে আছে। সে কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।
তন্ময় হোমওয়ার্ক শেষ করে হেলেদুলে এসে অরণ্যের পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। তার বিশাল খিদে পেয়েছে। অরণ্য তন্ময়কে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, “কি রে কুমড়ো পটাশ! ছোট আম্মুকে ফাঁকি দিয়ে পড়া থেকে কেটে পড়েছিস!”
কিন্তু তন্ময় ওর কথায় কোনো পাত্তাই দিল না। বাঁকা হাসল অরণ্য। সে ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে আবার কিছু বলবে, তার আগেই প্রিথমের কথায় বাজ পড়লো শিকদার বাড়ির ড্রয়িংরুমে!
প্রিথম উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন হসপিটাল? কী হয়েছে?”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৬
ওপাশের ব্যক্তি শুধু হসপিটালের নামটি বলল, আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই ফোনটা কেটে গেল।
প্রিথমের চিৎকার শুনে অনুশ্রী বেগম ছুটে আসলেন। তখন প্রিয়তা ও সিঁড়ি দিয়ে নামছিল।
অনুশ্রী বেগম উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে, আব্বু? চিৎকার করছো কেন?”
প্রিথম কাঁপা কণ্ঠে বলল, “বড় দাদান… কার অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, বড় আম্মু!