ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩০

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

সে বুকের দিকে চাইল, যেখানে গুটিসুটি হয়ে বিড়াল ছানার ন্যায় ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে আছে একটা ছোট্ট সত্তা। তার দীঘল কালো কেশরাশি প্রণয় সযত্নে তার ডান হাতে পেছিয়ে রেখেছে। হাসল সে। জৈবিক সকল চাহিদা দূরে ছুঁড়ে মেরে, আর একটু শক্ত করে নিজের বক্ষে মিশিয়ে নিল কোমল দেহখানা।
বড় শান্তি… শান্তি লাগছে মনে।
কি আছে এই মেয়েটার স্পর্শে, যা তার মনকে এতটা প্রশান্তি দেয়?
মনে বয়ে চলা যে কোনো ঝড় মুহূর্তেই শান্ত করে দেয়।
নিঃসঙ্গ জীবন, বছরের পর বছর পার করছে সে—শুধুমাত্র এই মেয়েটার দর্শনে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সে—দেহ ও মনের সকল চাহিদাই তুঙ্গে। পাশে সুন্দরী নারী থাকা সত্ত্বেও কখনো কিছু করবে—এমন চিন্তাধারার দুঃস্বপ্নও আসে নি কখনো।

অন্য কোনো নারীর প্রতি তার সেই টানটাই আসে না।
যতটুকু আসলে কিছু হতে পারে? মন যার প্রতি আগ্রহ অনুভব করে না?
দেহ ও তার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করে না।
যতটুকু না করলেই নয়, অতটুকু করতে গেলেই প্রনয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, গা গুলিয়ে ওঠে।
ওই আকর্ষণই অনুভব করতে পারে না—যে আকর্ষণ সে এই ষোড়শী নারীর মাঝে অনুভব করে।
বড় দায়… এই নারী আশেপাশে থাকলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এই নারীর মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখটা পর্যন্ত তাকে তীব্রভাবে আকর্ষিত করে।
এই নারীর দেহের সেই পরিচিত ঘ্রাণ তার চিন্তা-চেতনাকে নষ্ট করে দেয়, ভেঙে দেয় মনের সকল দিধার দেয়াল।
জীবনের সকল হিসেব-নিকেশে তালগোল পাকিয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওই নারীর নীলাভ অক্ষিযুগল—যা মাদকতাময়, বিশাল সমুদ্র—যেখানে ডুব দেওয়ার স্বপ্ন তার বহু বছরের ছিল।
কিন্তু সেই সকল স্বপ্ন আজ তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেছে।
ওই নারীকে আর কখনোই পাওয়া সম্ভব নয় তবু ও…
যতদিন যায়, নিজেকে সামলে নেওয়া ততই মুশকিল হয়ে পড়ে।
তা ও সে নিজেকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।
সে চায় না, তার জন্য এই নারীর গায়ে কলঙ্কের একটা বিন্দুও লাগুক।
এই নারীর দেহের আকর্ষণের চেয়ে মনের আকর্ষণ হাজার গুণ ভারী।
এই নারীকে ভালোবাসতে পুরো জীবনে একবারের জন্যও তাকে দেহে অনুভব করার প্রয়োজন পড়বে না।
এই নারীর দর্শনই যথেষ্ট তার সকল উন্মাদনাকে শান্ত করে দিতে।
কিন্তু সেই সুখও মনে হয় আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না।
সে আর কিছুতেই পারবে না, তার শান্তির জন্য তার ‘রক্তজবা’কে এতটুকুও কষ্ট দিতে।
ব্যস, আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।
তারপর… প্রণয় শিকদার।

সে চোখ বন্ধ করে নিল। অনেকক্ষণ ভেবে, চিন্তে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। অন্তরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে মন কিছুতেই মস্তিষ্কের সাথে একমত নয় । তবু সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল তরল জলের ধারা। চোখ বন্ধ রেখেই বিড়বিড় করে কয়েকটা কথা বলল—
“আমি জানি, তুই অনেক অন্যায় করেছিস—যেগুলোর ক্ষমা হয় না। আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিস, আমার সবথেকে কাছের।

তুই আমাকে জীবনের সবথেকে বড় আঘাত দিয়েছিস,
আমার বেঁচে থাকার কারণ বিলুপ্ত করেছিস।
তবুও আমি তোকে কখনো ঘৃণা করিনি। তবে এটা ও সত্যি—তোর প্রতি অনেক রাগ জমে ছিল। তোকে ক্ষমা ও করতে পারিনি।
তবে আজ আর আমার তোর প্রতি কোন রাগ, বা অভিযোগ নেই।
আমার যা হারিয়ে যাওয়ার, তা তো হারিয়েই গেছে।
আমি তো আর তা কখনো ফিরে পাবো না।
তাহলে শুধু শুধু তোকে দায়ী করে কী লাভ?
এটাও তো সত্যি, তুই এসবের জন্য আসল পরাধী না।
তুইও ষড়যন্ত্রের শিকার—আমার মতোই।

তুইও ফেঁসে গেছিস। তাই তোকে শুধু শুধু আর দোষ দিয়ে লাভ নেই।
যে আমার ভাগ্যে নেই, আমি তাকে যতই আঁকড়ে ধরব, সে ততই ছটফটিয়ে, মরতে থাকবে—
যা আমি সহ্য করতে পারবো না।
তাই তোকে ক্ষমা করে দিলাম।
তুইও তো আমার আপন।
তোরা যদি ভালো থাকিস, আমি মরে ও শান্তি পাব।
তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না।”
সে প্রিয়তার দিকে মায়াভরা নজরে তাকালো।
নরম গালে স্লাইড করে স্লো ভয়েসে বলল,

“তুমি তো বুকেই আছো,
তবুও এত ব্যথা কেন করছে জান?
প্লিজ, একটু শান্ত করে দাও না আমায়…
অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।”
ঠোঁটের কোনায় যন্ত্রণাময় হাসিটা তখন ও বিদ্যমান।
সে হাসিটা ধরে রেখেই পুনরায় চোখ বন্ধ করে বলল—
“ভাবিস না, তোর প্রতি দয়ামায়া উথলে উঠেছে তাই তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি, কারণ এ ছাড়া আমার কাছে আর দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই।
তাই হার মেনে নিলাম।

এই জন্য আবার এটা ভাবিস না—প্রণয় শিকদার তোর কাছে হেরে গেছে।”
সে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আবারও প্রিয়তার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকাল।
কপালে গাঢ় চুম্বন করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—
“প্রণয় শিকদার হেরে গেছে… নিজের হৃদয়ের কাছে হেরে গেছে।
তার রক্তজবার ভালোবাসার কাছে।
এই সকল অসুস্থ দ্বন্দ্বের মাঝে কষ্ট পাচ্ছে আমার রক্তজবা।
তাই এসব করে আমি আর আমার ‘জান’-কে কষ্ট দিতে চাই না।
তাই আজ সব দ্বন্দ্বের ইতি টানলাম।
সব শত্রুতা শেষ করে দিলাম।”

সে দুই-একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে প্রিয়তার নরম ঠোঁটে হাত ছুঁইয়ে ভেজা কণ্ঠে বলল—
“আমায় ক্ষমা করে দিস জান পাখি… আমি পারিনি।
আমি পারিনি দুনিয়ার সঙ্গে লড়ে তোকে আমার করে রাখতে।
তাহলে যে তোর অনেক কষ্ট হবে তর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে—
সবাই তোর কাছ থেকে ভালোবাসার অধিকার কেড়ে নিয়েছে,,আমিও পারিনি তোকে তোর অধিকার দিতে।
আমি ব্যর্থ, আমি কাপুরুষ।
আমার জন্য আজ তুই এত কষ্ট পাচ্ছিস।
তবে একদম চিন্তা করিস না

“তোকে এই যন্ত্রণাময় শিকলে আর বেঁধে রাখব না। তোকে আর এই বিষাক্ত কাটায় বিদ্ধ হতে দেব না।
খুব তাড়াতাড়ি এসব কিছুর থেকে মুক্ত হবি তুই জান,
এই সব কথা বলতে বলতে প্রণয়ের কণ্ঠনালী কেঁপে উঠল।
সে প্রিয়তার বাম হাতের তালুতে ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখে কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করল—
‘আমি যদি তোকে দূরে সরিয়ে দিই, তুই কি আমায় সত্যি ভুলে যাবি পাখি? সত্যি আর ভালোবাসবি না আমায়?
সত্যি আমায় ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য আর বাহানা খুঁজবি না?
যখন তখন উত্তাল ঢেউয়ের মতো বক্ষ-পাঁজরে আছড়ে পড়বি না?
এই পাখি, বল না… সত্যি কি তুই আমায় ভুলে অন্য জনকে আপন করে নিবি?

সে তোকে ভালোবাসবে, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে তা সহ্য করতে পারব না, জান… পারব না আমি।’
‘তবে তুই একদম চিন্তা করিস না, তুই ভুলে গেলেও আমি আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমার জানপাখিকে ভুলব না।’
‘তুই আমার হৃদপিণ্ডের ক্যান্সার। এই রোগ ভালো হওয়ার নয়।
এই রোগ আমার রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় মিশে আছে, যা মৃত্যু অবধি আমাকে মনে করাবে—
আমি কেবল এক রক্তজবার তৃষ্ণাতেই তৃষ্ণার্ত।
কিন্তু এই অসুখ তোর না হোক…’
প্রণয়ের গলা শুকিয়ে গেল। পানির অভাব বোধ করল সে।

একটু সোজা হয়ে শুতে নিলে প্রিয়তা ঘুমের ঘোরে প্রশস্ত পিঠ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল, গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল।
হেসে ফেলল প্রণয়। প্রিয়তার নরম মসৃণ গালে নিজের পুরুষী গাল ঘসে দিল।
ঘুমের মধ্যেই নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা, একটু নড়ে-চড়ে উঠে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল।
এই মুহূর্তে যদি কেউ তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাইরে ফেলে ও দেয়, তা-ও সে বুঝতে পারবে না।
প্রণয় মৃদু হেসে তার নরম তুলতুলে গালে গভীরভাবে নিজের কালচে লাল ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল,
সময় নিয়ে গাঢ় চুম্বন করে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আমার ঘুম কুমারী…
জীবন ফুরিয়ে যাবে, ফুরাবে না কভু এই প্রেমতৃষ্ণা।’
ভোর ৫টা ৪৫।
প্রিয়তার ঘুম বেশ হালকা হয়ে এসেছে।
তবু সে আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতে চায়।
ঘুমের ঠেলায় চোখ খোলা দায়।

আজ বহুদিন পর এত ভালো ঘুম হলো।
সে এত তাড়াতাড়ি কিছুতেই এই সুখসজ্জা ছেড়ে উঠতে চায় না।
তাই পাশ ফিরে শুতে নিল।
কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সে এক চুলও নড়তে পারল না।
সে বড় করে শ্বাস নিতে চাইল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেটাও পারল না।
এমন মনে হচ্ছে যেন সে ১০০ কেজির সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়ে আছে।
সে দুই হাতে ভারী জিনিসটা নিজের উপর থেকে সরানোর চেষ্টা করল,
তবু এক চুল নড়াতে পারল না।
বস্তাটা বেশ শক্তপোক্ত, ভালো দৈর্ঘ্য-প্রস্থযুক্ত ভারী।
এমনভাবে কয়েক মিনিট ট্রাই করার পর কিছু একটা মনে হতেই প্রিয়তার ঘুম ছুটে গেল।
সে তড়াক করে চোখ মেলে তাকাল।
ঘুমের রেশটা এখনও প্রবল।
সে পুনরায় চোখ খিচে বন্ধ করে নিল—চোখ জ্বালা করছে।
খুব কাছ থেকে পরিচিত পুরুষালী দেহের গন্ধটা নাকে এসে ঠেকছে,
যা তার মন-মস্তিষ্ককে প্রশান্তি দিচ্ছে।

মন চাচ্ছে এভাবে আরও কিছুক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকতে।
কিন্তু… সে তো কিছু একটা’র নিচে চাপা পড়ে আছে!
এটা মাথায় আসতেই তার ব্রেন সচল হলো।
সে ধীরে ধীরে চোখ পিটপিট করে তাকাল।
কিন্তু চোখ খুলে সামনের দৃশ্য দেখে প্রিয়তার চক্ষু কুটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
সে মনে মনে বলল,
‘নেশা-টেশা করেছি বলে তো মনে পড়ছে না!’
সে ঢোক গিলে, গুল-গুল চোখে নিজের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করল।
যা দেখছে, তাতে তার মাথা ঘুরছে।
সে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে কম্পনরত হাতটা তার বুকের উপর পড়ে থাকা মাথায় রাখল।
ঘটনা সত্য—অনুভব হতেই সর্বাঙ্গে তীব্র কাঁপন ধরল।
যদিও সেটা মন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইল, শরীর আর কেঁপে উঠতে পারল কই?
কাঁপবে কীভাবে—প্রণয় যে দুই হাত দিয়ে প্রিয়তার কোমল দেহখানা নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে,
তার বুকে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে।

তার বিশাল শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে প্রিয়তার মোমের মতো দেহখানা।
তার ভারি শ্বাসপ্রশ্বাস প্রিয়তার গলায় কাছে এসে আছড়ে পড়ছে।
প্রণয়ের প্রতিটা নিশ্বাস প্রিয়তার হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরাচ্ছে।
শিউড়ে উঠছে দেহ। গলা শুকিয়ে কাঠ, হাত-পায়ের তালু শিরশির করছে।
প্রাণপাখিটা বুকের খাঁচায় ছটফট করছে।
সে কম্পনরত কণ্ঠে আওড়ালো,
‘প্রণয় ভাই আমার এত কাছে!
এটা কি সত্যি, না আমার কল্পনা?
আমি কি আপনাকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করি প্রণয় ভাই?’
সে পুনরায় যাচাই করার জন্য উঠে বসতে চাইল,
কিন্তু পুনরায় পুরুষালী শক্তির কাছে পরাস্ত হলো।
এবার সে নিশ্চিত,

সে—কাল রাতের ঘটনাগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করল।
কখন ঘুমিয়েছে? কীভাবে ঘুমিয়েছে?
সে মনে মনে বলল,
‘তবে কি আমি সারারাত প্রণয় ভাইয়ের সাথে ঘুমিয়েছি? এভাবে জড়িয়ে ধরে?’
এসব ভাবনাতেই প্রিয়তার হৃদপিণ্ড তীব্র বেগে ধুকপুক করতে শুরু করল।
লজ্জায় দুই গাল রক্তিম হয়ে গেলো।
বিষয়টা চিন্তার—সে লজ্জা পেতে চায় না,

তবু কোথা থেকে লজ্জারা তার খানদান নিয়ে এসে প্রিয়তার উপর ভর করছে।
প্রিয়তা লজ্জা-শরম পাশে রেখে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় দুই হাতে প্রিয়তার পেট জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে প্রগাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন।
সিল্কি চুলগুলোর কয়েকটা আলগোছে কপালের সামনে পড়ে আছে।
খাড়া নাক, কালচে লাল ঠোঁট, ধারালো চোয়াল, ফরসা গালে হালকা হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।
সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে কালচে লাল ঠোঁটজোড়া।
প্রিয়তা কিছুক্ষণ গবেষণা করে আবিষ্কার করল,
এই ঠোঁট আগে খয়েরি লাল ছিল, এখন কালচে লাল হয়েছে—
যা পূর্বের চেয়েও বেশি ম্যানলি ও আকর্ষণীয়।
অজান্তেই প্রিয়তার হাত চলে গেল প্রণয়ের ঠোঁটে।
সে ঠোঁট দুটো ভালো মতো দেখে বলল,
‘আপনি কি সিগারেট খান প্রণয় ভাই?’

প্রণয়ের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে একটু পর পর উড়ছে।
প্রিয়তা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল…
তার ভীষণ ইচ্ছা হলো—কপালে একটু ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে, একটু ছুয়ে দিলে কি খুব বেশি পাপ হবে?
সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মনে মনে বলল,
“আমি যে লেভেলের পাপী, নিঃসন্দেহে আমি মরলে জাহান্নামেই যাবো। পাপের তো আর কিছু বাকি নেই।
এই পাপের কারণ যদি হয়—তোমাকে ভালোবাসা, তবে এই পাপ আমি শতবার করতে রাজি আছি।
লোকে বলে, কিছুর উপর বেশি মায়া করা ঠিক না, বেশি ভালোবাসা ঠিক না, কোনো কিছু বেশি চাওয়া ঠিক না।
তাহলে তোমাকে আজীবন সেই মানুষটাকে ছাড়াই মৃত্যু তুল্য জীবন কাটাতে হবে।
তাকে তোমার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে। তার জন্য প্রতি মুহূর্তে ছটফট করবে, কিন্তু তাকে তুমি পাবে না।

যেমন আমার জন্য আপনি। আমি একটু বেশি লোভ করে ফেলেছিলাম বোধহয়। তাই বুঝি এমন হলো।
আপনি আমার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন।
আমার জন্য আপনি নিষিদ্ধ। আপনার স্পর্শ নিষিদ্ধ,
আপনাকে ভালোবাসা নিষিদ্ধ, আপনাকে ভালোবাসাময় দৃষ্টিতে দেখাও পাপ।
তবু আপনি আমার তীব্র আসক্তি।
You are my obsession. I am deadly obsessed with you.
এর জন্য আমি জাহান্নামি হতেও রাজি আছি।
আমি আপনাকে না পাই, কিন্তু ভালোবাসা ছাড়তে পারবো না।
ভালো তো আমি বাসবই।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল প্রিয়তা।
নরম হাতখানা প্রণয়ের সিল্কি চুলের ভাঁজে রেখে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“কেন এমন হয়, প্রণয় ভাই!
জীবনে সবচেয়ে পছন্দের জিনিসগুলোই
হয়তো অবৈধ, নয়তো নিষিদ্ধ—

হয়তো বা অনেক দামী , নয়তো অন্য কারও।”
কি এমন ক্ষতি হতো, যদি আপনি আমার হতেন?
আমি আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকতাম, আপনার দাসী হয়ে থাকতাম,
আপনার সব কথা শুনতাম। বিনিময়ে আপনি শুধু একটু ভালোবাসতেন।
মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় মানুষের উপর। জানেন, সবাই ফ্রিতে একটাই উপদেশ দেয়—আপনাকে ভুলে যেতে।
ওরা কেন বুঝে না, পৃথিবীর কোনো শক্তি-ধারা আমি আপনাকে ভুলতে পারবো না!
আপনার প্রেম আমার জন্য এক ভয়ানক রোগ,
ক্যান্সারের চেয়েও ভয়ানক।
যত সময় যাবে, অসুস্থতা বাড়তেই থাকবে।
রোগ বাড়তেই থাকবে, শরীর খারাপ হতেই থাকবে, আমি ও অসুস্থ হতেই থাকবো—
কিন্তু মৃত্যু আমার হবে না!
আপনি আমার জন্য মরীচিকা।

আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আমার জীবনে যেহেতু পাপের আর কিছু বাকি নেই,
তবে আরেকটু বেশিই না হয় করলাম! ক্ষতি কী?
আমি তো এমনিতেই পাপী—ওমনিতেই তো পাপী! তাই একটু ছুঁয়ে দেই আপনাকে!
এই বলে প্রিয়তা প্রণয়ের ডান গালে হাত রাখল।
বাম গালে সময় নিয়ে কোমল, পদ্মলাল ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিল।
অন্য গালে নাক ঘসে মায়াময় কণ্ঠে বলল,
“ভালোবাসি।”
অতঃপর প্রণয়ের কপালের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে কপালে গভীর চুম্বন করল।
তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“বিষ জেনেও পান করি তোমায়,
পাপ জেনেও ভালোবাসি তোমায়।
এই পাপে যদি ও বা হয় মৃত্যুদণ্ড,

তবে তা কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই মাথা পেতে নেব।
আমি এক তৃষ্ণার্ত পথিক—যার শুধু তোমাকেই চাই।”
প্রণয়ের গলার অ্যাডামস অ্যাপল নড়ে উঠল,
কিন্তু প্রিয়তা সেটা লক্ষ করলো না।
সে ধীরে ধীরে প্রণয়ের হাতটা নিজের কোমরের ভাঁজ থেকে ছাড়িয়ে নিলো।
অতঃপর ধীরে ধীরে প্রণয়ের থেকে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে।
প্রণয়ের মাথাটা কুশনের ওপর ভালোমতো রেখে উঠে দাঁড়ালো।
কিছু একটা মনে হতেই চুড়িদারের গলার কাছটা নাকে নিয়ে গেলো।
সারা শরীর থেকে মেনলি ঘ্রাণটা তীব্রভাবে নাকে লাগছে।
সে হালকা হাসলো।

আসেপাশে নিজের ওড়নাটা খুঁজলো, কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওড়নাটা বিছানার নিচ থেকে উদ্ধার করল।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওড়নাটা তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো।
হাঁটু অবধি চুলগুলো হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রিয়তা যেতেই চোখ মেলে তাকালো প্রণয়।
সে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে প্রিয়তার গমনপথের দিকে চেয়ে ধরা গলায় বলল,
“এভাবে আমাকে দুর্বল করে না, জান।
—তাহলে আমি যে আরও দুর্বল হয়ে পড়ব,
আরও বেশি লোভ হবে তোমাকে পাওয়ার।
আর তখন নিজের মনকে আর কিছুতেই রাজি করাতে পারব না, পাখি। সে যে বড় ব্যাকুল ভাবে অনুরোধ করছে তোমাকে কাছে রাখতে।

আমাকে এভাবে শেষ করে দিও না, জান। নিজেকে ধরে রাখতে পারব না আর…
তোকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা এই খোদার দুনিয়ায় নেই।
তাই আমাকে এত দুর্বল করে দিস না, জানপাখি।
যতটা দুর্বল হলে আমি তোর সামনে নিজেকে শক্ত দেখাতে পারব না।
তুই এমন করলে আমি আর কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারব না—
যেটা নেওয়া খুব দরকার।
তোকে তো একটা সুন্দর জীবন দিতে হবে।
তুই শুধু আমার ভালোবাসা না,
তুই আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্বও।”
একটি অন্ধকার ঘর। চারদিকে ঘন গুমোট আবহাওয়া।

ঘরের ঠিক মাঝখানে একজন লোককে শক্ত করে চেয়ারের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে।
লোকটার মাথার ওপরে ঝুলছে একটা টিমটিমে হলুদ বাল্ব, যার ম্লান আলো তীব্র অন্ধকার দূর করতে না পারলেও কিছুটা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে।
ঘরের চার কোণে কালো পোশাক পরিহিত চারজন বলিষ্ঠ দেহের ব্যক্তি রাইফেল হাতে প্রফেশনাল স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে—
যেন তাদের বস আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তারা নিশ্বাসও নেবে না।
অন্ধকার ঘর জুড়ে পিন পতনের নীরবতা,
শুধু আটককৃত ব্যক্তির গোঙ্গানোর শব্দ আশপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
তার মধ্যেই হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে গেল।

চেয়ারে বাঁধা লোকটা আতঙ্কিত চোখে সামনে তাকাল।
দরজা দিয়ে বেশ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে একজন বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন যুবক ঘরে প্রবেশ করল।
চোখ-মুখ ভয়ংকর অথচ ঠোঁটে ঝুলছে বাঁকা হাসি,
যা মুহূর্তেই যেকোনো শত্রুর বুকের রক্ত জমিয়ে দিতে সক্ষম।
সে রাজকীয় ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে বসলো লোকটার সামনে ।
লোকটার মুখ লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা, বিধায় সে কোনো শব্দ করতে পারছে না।
তার মুখ দিয়ে কেবল “হুঁ… হুঁ…” করে শব্দ বেরোচ্ছে।
যা দেখে সামনের যুবকটা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,

— কেমন লাগছে, আমার জামাই আদর?
বাঁধা লোকটা শুধু ফেলফেল করে তাকিয়ে আছে।
হয়তো কিছু বলতে চায়, কিন্তু তা হয়তো সামনের ব্যক্তি শুনতে ইন্টারেস্টেড না।
সে আবারো বাঁকা হেসে বলল,
— আজকে আপনাকে এমন ‘জামাই আদর’ করব, যার গল্প আপনি নরকেও করবেন।
ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ যা করে, তার সবই স্মরণীয় করে রাখে।
লোকটার চোখে ভয় উপচে পড়ছে, যা দেখে শুদ্ধ বেশ মজা পেল।
রসিয়ে বলল,
— তাহলে বলুন, আপনার প্ল্যান ‘সি’ তো পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ল।
এবার কী করবেন? এবার কে আপনাকে বাঁচাবে?
আমি আবার ভদ্রলোক—ভদ্রলোকের এক কথা। যা বলি, তাই করি।
শুদ্ধর চোখ-মুখ হিংস্রতায় চকচক করে উঠল।
সে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা লোকটাকে থাবা মেরে ধরল।
ভয়ংকর ভঙ্গিতে বলল,

— শেষবার আল্লাহর নাম স্মরণ করে নে…
বলেই সজোরে বুক বরাবর লাথি মারল।
হিংস্র সিংহের ন্যায় গর্জে উঠল।
লোকটার চুলের মুঠি ধরে মুখের কাছে ঝুঁকে গিয়ে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বলল,
— তোকে আমি ওয়ার্ন করেছিলাম—আমার বন্ধুর থেকে দূরে থাকতে।
তোকে আমি বলেছিলাম, সাপের লেজে পা দিবি না!
বাঁধা লোকটা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে।
শুদ্ধর সুদর্শন চেহারা বীভৎস ভয়ঙ্কর খুনের নেশা মাথায় চেপে বসেছে !
তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ছে।
সে নিজের সাদা শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বলল,
— আমার বন্ধুর গাড়ির ব্রেক তুই ফেল করেছিলি, ঠিক?
লোকটা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দুপাশে মাথা নাড়ালো।
শুদ্ধ ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,

— আমার বন্ধুকে তুই এক্সিডেন্ট করিয়েছিস, মেরে ফেলতে চাস তাই না?
বলতে বলতেই সে লোকটার নাক বরাবর সজোরে ঘুষি মারল।
— তোর কলিজাটা আজ নিজের হাতে বের করে মেপে দেখব!
তুই যাকে দুর্বল করতে আমার কলিজায় হাত দিয়েছিলি, তার মধ্যে কোনো দুর্বলতা নেই।
তুই কী শয়তান!
তুই যার পেছনে পড়েছিস, সে তোদের গোটা শয়তান খানদানের বাপ!
তার পুরো বংশ নিশ্চিহ্ন করে দিলেও তার কিছুই যাবে আসবে না।
অথচ তুই বারবার আমার কলিজায় হাত দিচ্ছিস!
তোর সাথে আমার কোনো শত্রুতা ছিল না,
কিন্তু তুই শালা সেধে মরতে আসলি!
লোকটা “উহু… উহু” করে কিছু বলল,
কিন্তু শুদ্ধ সেসব কানে তুলল না।
সে চিৎকার করে ডাকল,

— জাভেদ!
একপ্রকার ঝড়ের বেগে ছুটে এলো জাভেদ।
শুদ্ধর হাতে তুলে দিল ধারালো নাইফ।
বিশিষ্ট হার্ট সার্জন ডক্টর শুদ্ধ চৌধুরীর থেকে ভালো কাটাছেঁড়ার কাজ আর কে জানে!
শুদ্ধ নৃশংস চোখে তাকাল মাটিতে লুটিয়ে থাকা লোকটার দিকে।
বসের উদ্দেশ্য বুঝে নিতেই জাভেদের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেলো।
মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে।
তার দুই বস একবার রেগে গেলে একেবারে সাইকো হয়ে যায়।

তাদের মাথায় একবার খুনের নেশা চেপে গেলে রক্ত দিয়ে হাত লাল না করা পর্যন্ত তারা শান্ত হতে পারে না।
ভয়ঙ্কর খুনি এরা! ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করা তাদের কাছে পান্তা ভাত!
অথচ কী সুন্দর দেখতে —দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না, এরা এত ভয়ঙ্কর!
নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই জাভেদের পেনিক অ্যাটাক আসে।
যেদিন প্রণয় স্যার তার আসল সত্যিটা জানবেন, সেদিন ওর অবস্থা কেমন হবে—
ভাবলেই জাভেদের নিজের মাথায় বাড়ি মেরে কোমায় চলে যেতে ইচ্ছা হয়।
শুদ্ধ লোকটার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল,
— ডোন্ট ওরি ডার্লিং, তুই এত সহজে মরবি না।
পাক্কা দশ মিনিট কলিজা ছাড়া বাঁচবি!

বলতে বলতেই সজোরে কোপ বসাল লোকটার বুকে।
লোকটার গগনবিদারী চিৎকার বদ্ধ ঘরের দেয়ালে বাড়ি খেতে লাগল।
রক্তের পিচকারি দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল।
সাথে সাথেই জাভেদও চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
শিকদার বাড়ির প্রায় সকলেই বাড়ি ফিরে গেছেন।
অনুশ্রী বেগম থাকতে চেয়েছিলেন,
কিন্তু তিনিও অসুস্থ ছিলেন বিধায় জোর করেই তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
হাসপাতালে বর্তমানে প্রিথম, প্রণয় আর প্রিয়তা ছাড়া তেমন কেউ নেই। অনেকেই প্রিয়তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে, কিন্তু প্রিয়তা রাজি হয়নি। তার একটাই কথা—প্রণয় ভাইকে সঙ্গে নিয়েই সে যাবে। অন্যরাও আর তেমন কিছু বলেনি।

তবে প্রণয়ের সঙ্গে দেখা করে প্রহেলিকা কাল যেই বেরিয়ে গেছে, তার পর আর একবারের জন্যও হাসপাতালে আসেনি। কোথায় গেছে, কী করছে—কেউ জানে না, বা কেউ খেয়াল করার অবস্থায় নেই।
প্রিয়তার মুডটা আজ আবার অনেক ফ্রেশ লাগছে। গতকালের রাতের ঘটনা সে প্রায় ভুলেই গেছে। ওর সঙ্গে এমনটাই হয়—ও বেশিক্ষণ পেটে কিছু ধরে রাখতে পারে না। আর মামলাটা যখন প্রণয় ভাইয়ের হয়, তখন প্রণয় ভাইয়ের সামান্য কিছু আদুরে বাক্যই যথেষ্ট তার মনের সকল বরফ গলিয়ে দিতে। সে প্রণয় ভাইয়ের উপর বেশিক্ষণ রেগে থাকতেই পারে না।
যাই হোক, সে প্রণয়ের সামনে টুলে বসে খুশি মেজাজে প্রণয়ের ফোনে ক্যান্ডি ক্রাশ গেম খেলছে।
ডাক্তার আবার প্রণয়ের হাতে তৃতীয়বার ব্লাডের ক্যানুলা গুঁজে দিয়ে গেছেন। প্রণয় ওর দিকে পাক্কা ১০ মিনিট ধরে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সেসবের কোনো হেলদোল নেই প্রিয়তার। সে পারেনা—ফোনের মধ্যে ঢুকেই যায়। তার সব ধ্যান-জ্ঞান এখন ফোনে। এক সেকেন্ডের জন্যও স্ক্রিন থেকে চোখ সরাচ্ছে না।
প্রণয়ের এবার মেজাজ খারাপ হলো। সে জোরালো গলায় ধমক দিয়ে ডাকল,

— “প্রিয়া!”
গভীর মনোযোগ অন্যদিকে থাকায়, হঠাৎ এমন তীব্র ধমক কানে আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠল প্রিয়তা। ফোনটা হাত থেকে ছিটকে পড়ল ফ্লোরে। মুখটা কাঁদো কাঁদো করে সামনে তাকিয়ে বলল,
— “এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন? আর একটু হলেই তো পটল তুলতাম!”
প্রণয় ভুরু কুঁচকে বলল,
— “কয়টা বাজে?”
প্রিয়তা মুখটা আর একটু ইনোসেন্ট বানিয়ে বলল,
— “এই জন্য কি এভাবে ধমকাবেন প্রণয় ভাই? একটু মিষ্টি করে বললে কি আমি শুনতাম না!”
প্রণয় ফুঁশ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
— “যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দে।”
প্রিয়তা ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে বলল,

— “সকাল ৯টা ৩৫।”
প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “এখন সকাল ৯টা ৩৫…”
প্রিয়তা ওপরে-নিচে মাথা ঝাঁকালো।
প্রণয় বলল,
— “তোর পেটে কয় কেজি নূরী পাথর ঢুকিয়ে রাখছিস শুনি?”
প্রিয়তা অবাক কণ্ঠে বলল,
— “নূরী পাথর কেন? ঢোকাবো?”
প্রণয় আগের মতোই বলল,
— “তাহলে তোর খিদে পায় না কেন?”
প্রিয়তার মুখটা চুপসে গেল। মনে মনে বলল, খিদে কি আর এখন পেয়েছে!
প্রণয় ফের বলল,

— “এখন সকাল ৯টা নয়, রাত ৯টা। ধ্যান-জ্ঞান কোথায় থাকে তোর? এখন ডিনার টাইম। কী খাবি বল, অর্ডার করে দিই।”
প্রিয়তা খাবারের কথা শুনতেই খিদে বেড়ে গেল। সে ফোন ফেলে এক লাফে প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসল। মধুর কণ্ঠে বলল,
— “আপনি যা খাবেন।”
প্রণয় সম্মতি জানিয়ে বলল,
— “তাহলে অ্যাভোকাডো অ্যান্ড স্পিনাচ স্যান্ডউইচ, আর গ্রিন ভেজিটেবল সালাদ অর্ডার করে দিই। ইট’স টু হেলদি।”
এই সব খাবারের নাম শুনতেই প্রিয়তা নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। মুখ বিকৃত করে বলল,
— “ছিঃইইই! এই রাতের বেলা আপনার এসব ঘাস-ফুঁশ আমি খাব না!”
প্রণয় কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

— “তাহলে বল, কী খাবি? অর্ডার করে দিই।”
প্রিয়তা আবার হেসে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
— “আপনি যা খাবেন, তাই।”
প্রণয়ের নিজের মাথায় বাড়ি মারতে ইচ্ছা হলো। সে তড়িঘড়ি করে বলল,
— “তাহলে বিরিয়ানি অর্ডার করে দিই?”
প্রিয়তা আগের থেকেও দ্বিগুণ মুখ কালো করে বলল,
— “ছিঃ! আপনি জানেন, বিরিয়ানিতে কত তেল থাকে? কত ক্যালোরি থাকে? এটা কত অস্বাস্থ্যকর? এত তেল খেলে কী হয় জানেন?”
প্রণয়ের কপালে বড় বড় ভাঁজ পড়ল।
প্রিয়তা নিজের মুখটা প্রণয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় বলল,

— “ভালো করে দেখুন!”
প্রণয় চোখ ছোট ছোট করে তাকাল।
প্রিয়তা উৎসাহ নিয়ে বলল,
— “কী দেখতে পাচ্ছেন?”
প্রণয় ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “সাদা মূলা!”
প্রিয়তা বড় বড় চোখে তাকালো,
— “প্রণয় ভাই! কী আমাকে… অপমান করলেন?”
কিন্তু সে সব গায়ে মাখল না। বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিজের ঢোল নিজেই পিটিয়ে বলল,

— “এই যে দেখছেন, আমার স্কিন কত সফট আর স্মুথ, কত ক্লিয়ার! এগুলো কি এমনি এমনি হয়েছে? কঠিনভাবে মেইনটেইন করতে হয়েছে! অতিরিক্ত তেল-মসলা খেলে বড় বড় পিম্পল বের হবে, স্কিন খারাপ হয়ে যাবে। আমার এত মেহনত, এত স্কিন কেয়ার সব পানিতে যাবে! তাই এসব অতিরিক্ত তেল-মশলাযুক্ত খাবার আমি খাই না।”
প্রণয় ওর ডান গাল চিপে ধরে বলল,
— “অনেক ড্রামা করেছিস, এখন আমি যা এনে দেবো, চুপচাপ তাই খাবি!”
প্রিয়তা “আআআহ” বলে চেঁচিয়ে উঠল,
— “উফ্! লাগছে, প্রণয় ভাই!”
প্রণয় ওকে ছেড়ে দিয়ে খাবার অর্ডার করে দিল।
প্রিয়তা গাল ফুলিয়ে সরে গেল।
প্রণয়ের ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে উঠল—যা ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা যায় না।
সে কয়েক সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে প্রিয়তার ফর্সা মসৃণ গালের দিকে তাকিয়ে রইল।
টসটসে দুটো গাল দেখলেই কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
প্রণয়েরও ইচ্ছে হল… দুই একটা কামড় বসাতে…
কিন্তু পরক্ষণেই অন্য কিছু মনে পড়ে গেল।
তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে নিল প্রণয়। ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে ফেলল।
প্রায় দশ মিনিট পর খাবার এসে গেল।
প্রিথম, প্রিয়তার হাতে খাবারের প্যাকেটটা দিয়ে বলল,

— “আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ পড়ে গেছে বোন, আমি আর রাতে আসব না।”
বলে চলে গেল।
প্রিয়তা শুধু সম্মতি জানিয়ে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসল।
প্রণয় বলল,
— “এবার আর লাফালাফি না করে চুপচাপ খা।”
প্রিয়তা এসব সতর্কবাণী কানে নিল না।
খাবারের র‍্যাপিং খুলে দেখল—ওর প্রিয় ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে চিকেন রোস্ট, সাথে পেয়াজ-মরিচও দিয়েছে।
খাবারের গন্ধে প্রিয়তার ক্ষুধাটা এবার আকাশ ছুঁয়ে ফেলল।
আর এমন ক্ষুধার সময় পছন্দের খিচুড়ি দেখে মুখটা যেন পূর্ণচাঁদের ন্যায় ঝলমল করে উঠল।
প্রণয় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে হাসল।
প্রিয়তা হাত ধুয়ে এসে প্রণয়ের পাশে আসন পেতে বসল।
এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে খাবারের প্রথম লুকমাটা প্রণয়ের মুখের সামনে ধরল।
প্রণয় অবাক হলো না একটুও”ও!”—বরং মুগ্ধ নয়নে তাকাল।
প্রিয়তার মায়াময় চোখে, প্রিয়তা অধৈর্য কণ্ঠে বলল,

— কী হলো? হা করুন, ক্ষুধা পেয়েছে তো আমার!
প্রণয় কিছু বলল না, চুপচাপ হা করল।
প্রিয়তা মৃদু হেসে অতি যত্নে প্রণয়ের মুখে খাবার তুলে দিল।
এই খাবারটা গিলতে প্রণয়ের আজ কেমন কষ্ট হচ্ছে।
কই, আগে তো এমন হয়নি।
আগে যতবার ওর জান ওকে খাইয়ে দিত, ততবার দেহমন শান্তিতে জুড়িয়ে যেত।
তবে আজ কেন প্রশান্তির চেয়ে কষ্টটা বেশি হচ্ছে?
নাকি মন বুঝে গেছে—এটাই শেষবার?
এটাই তার প্রিয়তমার হাতে শেষ খাওয়া?
‘শেষবার’ কথাটা মাথায় আসতেই অন্তর তীব্র দহনে পুড়ে গেল।
সে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইল সামনের রমণীর পানে।
প্রিয়তা বাঁ হাত দিয়ে কানের পেছনে চুল গুঁজে সুচারু ভঙ্গিতে প্রতি লুকমার সঙ্গে একটা করে কাঁচা মরিচ কামড় বসাচ্ছে।

ঝালে তার রক্তিম উষ্টযুগল আরও বেশি রক্তিম লাগছে।
এই দৃশ্যটা ও ভীষণ মোহময়।
প্রণয় ভাবতে চায় না সামনে কী হবে।
এই সময়টা আল্লাহর দেওয়া আশীর্বাদ।
একবার চলে গেলে, এসব দিন তো আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না।
এসব স্মৃতি নিয়েই যতদিন বাঁচা যায়, বাঁচতে হবে।
ইচ্ছা করলেই তো আর সে তার প্রাণকে দেখতে পাবে না, তার হাতে খেতে পারবে না।
প্রিয়তা আরেক লুকমা খাবার প্রণয়ের মুখের সামনে ধরে বলল,
— কী ভাবছেন? হা করুন!
প্রণয় বেদনা চোখে তাকিয়ে হাসল।
খাবার শেষ করে প্রিয়তা নিজের সাদা ওড়নাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৯

— মুখটা মুছে নিন।
প্রণয় মুখ মুছে নিল।
প্রিয়তার একটা বিষয় খুব অবাক লাগছে—
যার স্বামী হাসপাতালে, সে কীভাবে বাড়িতে বসে থাকতে পারে?

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩১