ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৬
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
বাড়ির সবার এমন করুণ অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল প্রিয়তা।
সে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
— “কাঁদছো কেন, বড় আম্মু?”
প্রিয়তার কণ্ঠ কানে আসতেই সবাই সচকিতে দরজার দিকে তাকাল।
প্রিয়তাকে সুস্থ-সবল, অক্ষত অবস্থায় দেখে সবার চোখ-মুখ চকচক করে উঠল।
অনন্যা বেগম আরও জোরে কেঁদে উঠলেন।
প্রিয়তা বিস্ময় নিয়ে সামনের এক পা এগোতেই তন্ময় এক লাফে উড়ে এসে প্রিয়তার কোমর জড়িয়ে ধরল, গাল-নাক ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— “আই’ম সরি, আপু। আমি আর কখনো তোমার সাথে শয়তানি করব না, আপু…
আর কখনো তোমাকে জ্বালাব না। তুমি যা বলবে, সব শুনব। তবুও আমাদের ছেড়ে আর কোথাও যেও না, আপু।”
প্রিয়তা সবার এমন অদ্ভুত আচরণে তাজ্জব বনে গেল।
প্রিয়তার কানে এসে পৌঁছাল টিভিতে বলা বিশেষ প্রতিবেদন।
এতক্ষণে সে বুঝতে পারল কী হয়েছে।
তন্ময় তার চিরচেনা ছন্দে এবার গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল। এ যে সে কান্না নয়— লা কানে তালা পড়ে যাওয়ার মতো কান্না।
প্রিয়তা নরম চোখে তাকাল তন্ময়ের দিকে।
কাঁদতে কাঁদতে গুলুমুলু বাচ্চাটার কী অবস্থা হয়েছে!
তন্ময়কে কোলে নিয়ে, তুলতুলে গালে চুমু খেয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “এই ভাই, দেখ… আমি ঠিক আছি তো! আর কাঁদিস না।”
তন্ময় শক্ত করে আপুর গলা জড়িয়ে ধরল।
এইসব ফ্যামিলি মেলোড্রামা দেখতে শুদ্ধ মোটেও ইন্টারেস্টেড নয়, তাই সে ধপাধপ পা ফেলে ওপরে চলে গেল।
সবাই প্রিয়তাকে সুস্থ দেখে কিছুটা শান্তি পেল।
কিন্তু…
প্রণয়?
পরিণীতা ছুটে গিয়ে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরল।
অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “আমার ভাই কোথায়?”
প্রিয়তার আবারও মনে পড়ল প্রণয় ভাইয়ের কথা!
সে নিচু কণ্ঠে জবাব দিল,
— “আসেননি।”
পরিণীতা ভয় পেয়ে গেল।
আরও উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
— “আসেনি মানে? কোথায়?”
প্রিয়তা সবাইকে কাল রাত থেকে শুরু করে আজ সকাল পর্যন্ত সকল ঘটনা খুলে বলল, তবে বিশেষ কিছু ঘটনা চেপে গেল।
আশ্চর্য হয়ে গেল সবাই।
সাথে ভয় তাদের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল— কত বড় বিপদের মধ্যে পড়েছিল!
তবে আল্লাহর রহমতে দুজনেই ঠিক আছে দেখে সবাই একটু স্বস্তি পেল।
কিন্তু একটা কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল পরিণীতার।
শুদ্ধের উপর হওয়া সন্দেহটা এবার তার বিশ্বাসে পরিণত হলো।
সে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল—
— “তার মানে কি, যা ভেবেছিলাম, তাই ঠিক? শুদ্ধ ভাইয়া আর বড়দাদার মধ্যে সকল তিক্ততার কারণ… ভালোবাসা?”
অনুশ্রী বেগম চোখ মুছে বললেন,
— “অনেক ধকল গেছে তোমার উপর। যাও, নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে আসো।
খেয়ে বিশ্রাম নেবে।”
তিনি বাকি সব ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশে বললেন,
— “তোমরাও খেতে আসো, খাবার দিচ্ছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, এখনো কারো পেটে কিছু পড়েনি।”
ওরা সবাই সম্মতি জানাল।
প্রিয়তাও মাথা নাড়ে ওপরে চলে গেল।
প্রিয়তা নিজের ঘরে গিয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
নিজের ঘরের শান্তিই অন্যরকম। সেই প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
সাথে সাথেই স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল গতকাল রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘটে চলা সকল ঘটনা…
মিস করতে লাগল প্রণয় ভাইয়ের সাথে কাটানো এক একটা মুহূর্ত।
প্রণয় ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই মন আবার অস্থির হয়ে পড়লো।
বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেও আর শান্তি মিলল না।
ধুর!
সে দ্রুত উঠে বসে বিছানা হাতড়ে ফোন খুঁজল। কিন্তু বিছানায় নেই।
হাসপাতালে যাওয়ার সময় সে নিজের ফোনটা বাসায় ফেলে গিয়েছিল।
এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে নজর পড়ল পড়ার টেবিলে।
সে দ্রুত পায়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নিল।
প্রণয় ভাইয়ের ফেসবুক আইডিতে ঢুকে প্রত্যেকটা ছবি মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল।
প্রত্যেকটা ছবিই পারফেক্ট আর ফরমাল লোকের।
প্রত্যেকটা ছবিতে ইন করা সাদা বা কালো শার্টের সাথে ফরমাল প্যান্ট, হাতে ব্র্যান্ডেড ওয়াচ আর মুখে সেই চিরাচরিত গাম্ভীর্য।
একটা ছবিতেও সেই এলোমেলো ব্যাপারটা নেই, যেটা প্রিয়তা খুঁজছে।
মন শান্ত করতে ছবিগুলো দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রত্যেকটা ছবির কমেন্ট বক্স পড়ে প্রিয়তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
প্রত্যেকটা ছবির কমেন্ট বক্সেই মেয়েদের উপচে পড়া ভিড়, আর এক একজনের কমেন্টের কী বাহার!
এসব প্রিয়তার মোটেও সহ্য হলো না।
এদের সাথে ঝামেলা করার জন্য মুখ, হাত-পা নিশফিস করতে লাগলো।
তাই সে দ্রুত নিজের ফেক আইডি লগ-ইন করে একটা মেয়েকে রিপ্লাই করল—
— “ছেলে ধরা ডাইনি কোথাকার! সুন্দর ব্যাটা দেখলেই ছুকচুক করতে মন চায় শালি, অন্যের বাচ্চার বাপের দিকে নজর দিস! লজ্জা করে না?
ফকিন্নি তোদের তো ফিনাইল-হারপিক এসব খেয়ে মরা উচিত!”
এই কমেন্টটা কপি করে সে আরও কয়েকজনকে দিল।
ইচ্ছে ছিল সবাইকে দেওয়ার, কিন্তু এত হাজার হাজার কমেন্টের মধ্যে সবাইকে দেওয়া সম্ভব না।
তাই বেছে বেছে কয়েকজনকে দিল।
এবার একটু ভালো লাগছে।
ভীষণ হিংসা হয় প্রণয় ভাইয়ের আশেপাশে কাউকে দেখলে, প্রণয় ভাইকে নিয়ে কেউ ভালো-মন্দ বললে সহ্য হয় না।
অথচ চোখের সামনে প্রণয় ভাইয়ের বউকে সহ্য করতে হয়।
অসহায় চোখে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
প্রিয়তা এবার প্রণয়ের নম্বরে ডায়াল করল।
কিন্তু ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে ভেসে এলো—
— “আপনি যে নম্বরটিতে ফোন করেছেন, সেটি বর্তমানে পরিষেবা সীমানার বাইরে রয়েছে।”
মন খারাপ হলো প্রিয়তার।
আরও দুই-একবার ফোন করে হতাশ হলো সে।
ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করল—
প্রণয় ভাই কিভাবে গলা থেকে ওড়নাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন!
তখনকার প্রণয় ভাইয়ের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই লজ্জায় প্রিয়তার কান গরম হয়ে গেল।
সে গলা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
প্রণয় ভাইয়ের পাগলামোর গভীর চিহ্নগুলো এখনো গলায়-ঘাড়ে জলজল করছে।
ধবধবে ফর্সা চামড়ায় কামড়ের দাগগুলো বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
প্রিয়তার লজ্জায় হাত কাঁপছে।
সে কুর্তাটা টেনে একটু নিচের দিকে নামাল।
গলা থেকে বেশ খানিকটা নিচে আরও কয়েকটা কামড়ের দাগ—সেগুলোতে হাত ছোঁয়াতেই মনে পড়ল তখনকার প্রণয় ভাইয়ের বলা একটা কথা—
“একটু খাই জান, প্লিজ।”
লজ্জায় প্রিয়তা দুই হাতে মুখ ঢেকে নিল।
চোখের সামনে ভেসে উঠল ওইসব মুহূর্তগুলো।
সে এক ছুটে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
বিকেল ৪টা ২০।
প্রণয় এখনো ফিরে নি।
ওরা ভাইবোনেরা এখনো তাদের বড় ভাইয়ের অপেক্ষা করছে।
তাদের ভাইকে চোখের সামনে না দেখা পর্যন্ত তারা স্বস্তি পাচ্ছে না।
আরও ৩০ মিনিট পর কলিং বেল বেজে উঠল।
থিরা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজার ওপারের ব্যক্তিকে দেখে খুশিতে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সে ছুটে গিয়ে আনন্দিত কণ্ঠে সবাইকে বলল—
“বড় দাদান এসেছেন!”
ওরা সবাই বসা থেকে লাফিয়ে উঠল।
ততক্ষণে প্রণয় ড্রয়িংরুমে চলে এসেছে।
তাকে দেখতে ভীষণ ক্লান্ত ও দুর্বল লাগছে, চোখ দুটো হালকা লাল।
পরিণীতা এক ছুটে গিয়ে বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
থমকে দাঁড়াল প্রণয়।
পরিণীতা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বলল—
“কোথায় চলে গেছিলে, দাদান?”
পর পর প্রেরণা, প্রিথম, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র, থিরা, থোরি, তন্ময়—
ওরা সবাই এগিয়ে গিয়ে একসাথে বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরল।
ওরা যে তাদের দাদানকে কত ভালোবাসে, তা ওই পাপিষ্ঠরা কোনোদিনও ধারণা করতে পারবে না।
কথায় আছে—
বড় ভাই, মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো।
আর ওরা সেটা খুব ভালো মতোন মানে।
সবাই মিলে প্রণয়কে জড়িয়ে ধরে অভিযোগ করতে লাগল।
এতক্ষণে কিঞ্চিত হাসি ফুটল প্রণয়ের ঠোঁটে।
সে ও ভাইবোনকে আগলে নিয়ে স্নেহভরা কণ্ঠে বলল—
“হয়েছে, এবার ছাড়! ঠিক আছি তো আমি।”
সবাই ছাড়ল।
প্রণয় পুনরায় সবার দিকে একবার তাকিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল—
“এত চিন্তা করিস না আমাকে নিয়ে।”
বলে দ্রুত পায়ে ওপরে চলে গেল।
প্রিথম, প্রেমে আর পরিণীতা—সবই বুঝল, মনে মনে ভীষণ কষ্টও পেল।
তারা তো জানে, তাদের ভাই ঠিক কতটা যন্ত্রণা আর ভালোবাসা বুকে চাপা দিয়ে বাঁচে আছে।
এভাবে কি মানুষ বাঁচে?
প্রণয় ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢুকে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল।
পরণের শার্ট খুলে খালি গায়ে বিছানায় বসে পড়ল।
খালি গায়ে চওড়া কাঁধসহ বলিষ্ঠ দেহের মাংসপেশিগুলো ফুলে উঠেছে।
প্রণয়কে ঘরে আসতে দেখে প্রহেলিকা ছুটে এলো।
ঘরে ঢুকতেই প্রণয়কে এমন হট লুকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চোখ দিয়ে গিলে খেলো।
তারপর মনে পড়ল—
চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার কী দরকার?
সে চাইলে তো আস্তই গিলে খেতে পারে!
সে ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে প্রণয়ের পাশে বসলো।
হাত জড়িয়ে ধরে বেশ মায়াভরা কণ্ঠে অভিযোগ করে বলল—
“আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে, তাই না প্রণয়?
কেন এত চিন্তা দিলে আমায়? জানো তো, তোমার কিছু হলে শেষ হয়ে যাব আমি।”
বলতে বলতে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার চেষ্টা করল।
প্রহেলিকাকে এমন গায়ের উপর উঠে আসতে দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো প্রণয়।
মনে মনে চিরবিঁড়িয়ে উঠল—
“এমনিতেই নিজের জ্বালায় বাঁচি না, এর উপর এই গায়ে পড়া মেয়েটা!”
প্রণয় নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না।
সে প্রহেলিকাকে নিজ থেকে সরিয়ে দিল।
যথাসম্ভব কণ্ঠ শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল—
“ঠিক আছি আমি।
ভীষণ গরম লাগছে, দূরে সরে বস।”
এমন প্রত্যাখ্যানের ক্ষোভে প্রহেলিকার মুখ লাল হয়ে গেল।
প্রণয় তাকে রেগে যেতে দেখে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করল না।
উঠে নিজের মত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।
প্রহেলিকা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
“এক রাতেই তোমাকে এমন কী দিয়েছে, যা আমি দিতে পারি না?
কি এমন দেয়, যে আমার ছোঁয়া তোমার ভালো লাগে না?
ওই মেয়েটার শরীরে কি আছে, যেটা আমার নেই? আমি কি কম সুন্দরী?”
“তবে তুমি যতই চেষ্টা করো,
যাই হয়ে যাক—
এই প্রহেলিকা শিকদার-এর হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই!”
“তোমাকে এমনভাবে আমার সাথে জড়িয়ে ফেলবো,
যে এই জনমে তুমি আর মুক্ত হতে পারবি না।”
হঠাৎ কিছু একটা ভেবে বিরক্ত হলো প্রহেলিকা।
মনে মনে বিড়বিড় করে বলল—
“এতগুলো মাস হয়ে গেল, পিল অফ করে দিয়েছি।
তবুও কিছুতেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না!
আমাকে ভালো ডক্টর কনসাল্ট করতে হবে at any cost।
তোমাকে আমার থাকতেই হবে।”
সে আবার ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল—
“খুব তাড়াতাড়ি আমাদের সম্পর্কের সুতো আরও মজবুত হবে, স্বামী।”
কিছু একটা ভেবে তার মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টে গেল।
ভ্রু বাঁকিয়ে বলল—
“তার আগে আমাকে দেখতে হবে, এক রাতে পানি কতদূর গড়িয়েছে আর কী কী হয়েছে।
আমি ওকে এক চুলও বিশ্বাস করি না।”
সন্ধ্যা ৬টা। পূর্ব আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা।
প্রিয়তা নিজের মন, প্রাণ, আত্মা—সব এক করে দিয়ে পড়ছে।
পড়াশোনা নিয়ে কোনো কথা হবে না।
জীবনে যাই চলুক, যাই ঘটুক—প্রিয়তার কখনই পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হওয়ার অভ্যাস নেই।
সে জান লাগিয়ে পড়ছে। কিন্তু কিছু একটা তাকে ডিস্টার্ব করছে।
একটু পরপরই পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে।
এরকম আরও দুই-একবার হতেই মনোযোগ ছুটে গেল প্রিয়তার।
বিরক্তিতে কপালে দুই-একটা ভাঁজ পড়ল।
সে বিরক্ত মুখে কপাল কুঁচকে টেবিলের নিচে দৃষ্টিপাত করতেই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল।
মুহূর্তেই বিরক্তির ছাপ সরে গিয়ে খুশিতে মুখ দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে গেল।
সে থাবা মেরে সাদা বিড়াল ছানাটাকে টেবিলের নিচ থেকে বের করল।
এই বিড়াল ছানাটাই এতক্ষণ ওর পায়ে ঘষাঘষি করছিল।
বিড়ালটা কোলে নিতেই খুশিতে প্রিয়তার মন বাকবাকুম হয়ে গেল।
এটা ওই বিড়াল ছানাটা, যেটাকে প্রিয়তা বাঁচিয়েছিল।
প্রিয়তা পড়া-টড়া সব চুলায় দিয়ে বিড়ালটাকে নিয়ে বিছানায় পা ভাঁজ করে বসলো।
ছানাটার চোখ আর প্রিয়তার চোখ একদম এক—গাঢ় নীল।
ছানাটা গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—
“তোকে এখানে কে এনেছে, বাবু?”
বিড়ালটা কী বুঝল, কে জানে—
শুধু হাতে মাথা ঘষে দিয়ে একবার “মিউ” বলল।
প্রিয়তা হাসল, বুঝল কে এনেছে!
প্রিয়তা আবারো বিড়ালটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—
“তোর অনেক খিদে পেয়েছে, তাই না বাবু?”
বিড়ালটা এবারও “মিউ” বলল।
প্রিয়তা ধরে নিল, ওর খিদে পেয়েছে।
সে ছানাটাকে কোলে নিয়ে উঠে যেতে যেতে বলল—
“আজ থেকে তুই আমার মেয়ে, আর আমি তোর মা।
আম্মু ডাকবি।
চল, আম্মু তোকে দুধ-ভাত খেতে দেব।
কিন্তু আমার মেয়েটার তো একটা নাম দিতে হবে।
কি নাম দেব তোর?”
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ভেবে বলল—
“আজ থেকে তোর নাম Coco।
My baby!”
বলে বিড়ালকে চুমু খেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।
দূর থেকে এসব কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল প্রণয়।
মা হওয়ার খুব শখ!
সে উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই শব্দ করে ওর ফোন বেজে উঠল—
দাঁড়িয়ে পড়ল প্রণয়।
ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই তার মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টে গেল।
সে শুধু এক বাক্যে বলল—
“আসছি।”
জাভেদ আরও কিছু বলতে নিলেই ‘কট’ করে ফোন কেটে দিল।
পরিণীতার মনটা বেশ ফুরফুরে। সে সুন্দর মতো সেজে-গুজে আবিদের সামনে বসে আছে—ভাবখানা এমন, যেন সে পড়তে বসেনি, প্রেম করতে বসেছে।
আবিদ ওকে একটার পর একটা অংক বুঝিয়েই যাচ্ছে, কিন্তু ওসবের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।
তার একটাই কথা—এসব করা-করি ধরাধরিতে সে নেই।
তার এখানে বসে থাকার মূল আকর্ষণই হচ্ছে তার মাস্টারমশাই।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাঁকা চোখে ওর মতিগতি লক্ষ্য করছে আবিদ।
সে হঠাৎই অংক বোঝানো বন্ধ করে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“বুঝেছো, কি বুঝিয়েছি?”
পরিণীতা লাজুক হেসে মাথা নাড়লো।
আবিদ ভ্রু কুঁচকালো।
সে একটা অ্যালজেব্রা খাতায় লিখে পরিণীতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা একটু আগেই ৫ বার করিয়েছি, তাই ৫ মিনিটের মধ্যে সলভ করে দাও।”
খাতায় লিখে দেওয়া হিজিবিজি জিনিসটার দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিললো পরিণীতা।
এতক্ষণ মনে আকাশে উড়তে থাকা ফানুসগুলো টুসটাস করে ফেটে পড়ল।
পরিণীতা একটু লাজুক হেসে লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলল,
“কাল করে দিলে হবে না, মাস্টারমশাই?”
আবিদের ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেল।
সে পাশের বেতটা হাতে তুলে নিলো।
হাতে বেত নিতে দেখে চোখ বড় বড় করে ফেললো পরিণীতা।
ঢোঁক গিলে তটস্থ কণ্ঠে বললো,
“এখনই করে দিচ্ছি!”
আবিদ শান্ত চোখে হাত ভাঁজ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
পরিণীতা মিনিট দশেক কলম চিবিয়ে, পায়ের ঘাম মাথায় ফেলে চেষ্টা করলো—তবু কিছু বুঝলো না, কিছু লিখতেও পারলো না।
আবিদ ওর খাতা টেনে নিয়ে দেখলো—একটা দাগ পর্যন্ত নেই।
ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো আবিদের।
এক ঘণ্টা ধরে সে দুটো মাত্র অংক বুঝাচ্ছে, কিন্তু এই গর্ধব মেয়েটা একটা অংকও ঠিকমতো বোঝার চেষ্টা করছে না।
আবিদ রাগান্বিত কন্ঠে ধমকে বললো,
“হাত পাতো!”
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল পরিণীতার।
সে ভয়ে-ভয়ে বললো,
“কালকে করে দেবো, মাস্টারমশাই, প্রমিস!”
কিন্তু আবিদ এসব কোনো কথায় কান দিলো না।
ধমকে বললো,
“তোমাকে হাত পাততে বলেছি, অ্যাঞ্জেল!”
পরিণীতা ভয়ে ভয়ে হাত পাতলো।
সাথে সাথেই চটাশ চটাশ করে দুই হাতে ৪টা করে ৮টা বেত মারলো আবিদ।
তুলতুলে ফরসা হাতখানা মুহূর্তেই রক্তবর্ণ ধারণ করলো।
চোখ দিয়ে নিঃশব্দে টুপটাপ করে পানি পড়তে লাগলো।
আবিদ রাগে-দুঃখে ধমকে বললো,
“এমন ডাব্বা মার্কা ছাত্রী আমার জীবনে আর দুটো দেখিনি!
তোমার তো পড়াশোনায় কোন মন নেই! তাহলে পড়তে বসো কেন?
পড়াশোনা একেবারে বন্ধ করে দিলেই পারো!
আমি যা দেখছি, তোমার দ্বারা জীবনে কিছু হবে না।”
পরিণীতা মাথা নিচু করে নিলো।
চোখ দিয়ে টপটাপ করে পানি পড়তে লাগলো।
আরও কিছুক্ষণ বকা-ঝকা করে শান্ত হলো আবিদ।
পড়ানোর সময় শেষ।
সে নিজেকে শান্ত করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পরিণীতার দিকে।
ক্রন্দনরত লাল মুখখানি দেখে ভিতরটা কাঠ কয়লার মতো জ্বলে উঠলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বই-খাতা বন্ধ করে দিলো, পরিণীতাকে টেনে তুলে কোলের উপর বসালো।
অভিমানে উঠে যেতে চাইলে পরিণীতার পেট জড়িয়ে ধরে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে বসালো।
পরিণীতা কিছু না বলে যার কাছে বকা খেয়েছে, তারই গলা জড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আবিদের মন নরম হলো।
পরিণিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, সুন্দর মুখ খানা দুই হাতে আজলায় তুলে ধরলো, ব্যথাতুর নয়নে তাকালো।
পরিণীতার এবার আরও জোরে কান্না পাচ্ছে।
ভীষণ খারাপ লাগলো আবিদের।
সে দুই হাত চোখের সামনে মেলে ধরলো।
মারার দাগগুলো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।
সে দুই হাত একত্রিত করে হাতে তালুতে ঠোঁট চেপে ধরলো।
সাথে সাথেই কান্না বন্ধ হয়ে গেল পরিণীতার।
ভেজা চোখে তাকালো শ্যামবর্ণের পুরুষটার দিকে।
আবিদ দুই হাতের তালুতে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“তুমি এত ফাঁকিবাজি কেন করো, অ্যাঞ্জেল?
তুমি তো জানো, এভাবে চললে তুমি পাশ করতে পারবে না!
পড়াশুনায় একটু মন দাও।
জীবনে তো কিছু একটা করতে হবে!”
মায়াভরা নজরে চেয়ে রইলো পরিণীতা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও আবিদের বাহু জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বললো,
“কি হবে এত পড়াশোনা করে!
এত পড়ে আমি কি টাকা কামাবো?
আমি এখন আব্বুর পয়সায় খাচ্ছি,
এরপর আপনার পয়সায় খাবো।
এসব পড়াশোনা-টড়াশোনা সংসারের কোন কাজে লাগবে শুনি?
আমি পড়ব না।
আমি সংসার করবো আপনার সাথে!
আমি পড়া চাই না, আমি মাস্টারমশাইকে চাই।”
বড় করে হতাশার শ্বাস ফেললো আবিদ।
“এই মেয়েকে মানুষ করা তার কর্ম নয়!
তবুও তো চেষ্টা করতে হবে!”
সে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বুঝিয়ে বললো,
“তুমি পরীক্ষায় ফেল করে আমাকে বিয়ে করলে লোকে কী বলবে?
যে মাস্টার নিজের বউকে পড়াতে পারে না, সে অন্যকে কী পড়াবে?”
পরিণীতা এসব কানে তুললো না।
আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কে কি বলল তাতে আমাদের কী?
আমরা তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সুখেই সংসার করবো!
আর আমার এত পড়ে আজ নেই?
সেই তো বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করবো।”
আবিদ অদৃশ্য হাতে নিজের কপাল চাপড়ালো।
পরিণীতাকে হুমকি দিয়ে বলল,
“বাচ্চা পালার খুব শখ! দেখব, বিয়ের পর কয়টা বাচ্চা সামলাতে পারো!”
পরিণীতা একটু লাজুক হেসে মাস্টারমশাইয়ের গালে চুমু খেয়ে বলল,
“আপনি যে কয়টা দেবেন।”
পরিণীতার বাক্য কর্ণগোচর হতেই কাশি উঠে গেল আবিদের।
পরিণীতা আবার বললো,
“চলুন!”
আবিদ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“কোথায়?”
পরিণীতা আবারও লাজুক কণ্ঠে বলল,
“বিয়ে করতে!”
এবার আবিদের ঠোঁটে ও হাসি ফুটল।
বাঁকা হেসে বলল,
“ঠিক আছে, চলো। তবে আগে তোমার বাবা আর ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতিটা নিয়ে আসি।”
বাপ-ভাইয়ের কথা কানে যেতেই ভয়ে পরিণীতার মুখের রং উড়ে গেল।
সে ভয়ার্ত চোখে তাকালো আবিদের দিকে।
আবিদের চোখে-মুখে দুষ্টুমি।
পরিণীতা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আমার আব্বু-ভাইয়ার সামনে আমাকে বিয়ের কথা বলতে তোমার ভয় করবে না?”
এমন কথা শুনে স্বচ্ছ হাসলো আবিদ।
পরিণীতার নরম গালে নাক ঘষে দিয়ে ভালোবাসা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“যদি মৃত্যুকে ভয় করতাম, তবে তোমাকে ভালোবাসতাম না, অ্যাঞ্জেল।”
চমকে উঠল পরিণীতা।
আবিদের মুখ চেপে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“এসব কি অলুক্ষণে কথাবার্তা! এসব কথা কক্ষনো বলবেন না!
আমি বাঁচলে আপনার সাথেই বাঁচবো, আর মরলে আপনার সাথেই মরবো!”
পরিণীতার আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসলো আবিদ।
পরিণীতা বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর হঠাৎ বলল,
“একটা প্রশ্ন করি, মাস্টারমশাই?”
আবিদ পরিণীতার চুলে হাত ভোলাতে ভোলাতে নরম কন্ঠে বলল,
“করো।”
পরিণীতা বুক থেকে মাথা তুলে আবিদের চোখের পানে চাইল।
কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আরষ্ট কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“আমাকে ভালোবাসা বিপদ জেনে ও আমাকে কেনো এতো ভালোবাসেন, মাস্টারমশাই?”
আবিদ মৃদু হাসলো।
পরিণীতার মাথাটা টেনে আবারো বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।
প্রিয়তমার কানের কাছে ঠোঁট নামিয়ে তপ্ত কন্ঠে গুনগুন করে গাইলো—
“একবার তোকে বুকে নিয়ে
একথা আমি বলে যেতে চাই,
তুই জানরে, আমার জানরে—
বেঁচে থাকার তুই কারণ।
ওরে জানরে, আমার জানরে—
ভুলে জানা সব বারণ।”
একটা পুরনো ফ্যাক্টরির পুরনো গুদামঘরে অজ্ঞাত পরিচয়ের ত্রিশোর্ধ্ব দুইজন ব্যক্তিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। জায়গাটা বেশ বড় ও আধুনিক ধাঁচের। ফ্যাক্টরি পুরনো হলেও এখানে ব্যবহৃত প্রযুক্তি আধুনিক।
ঘরটা বিশাল বড়। উপরে ঝুলছে হাই-পাওয়ার এলইডি লাইট—তার তীব্র আলোয় চারপাশ চকচক করছে। দেয়ালগুলো ধূসর প্যানেলের; সেখানে ঝুলছে ডিজিটাল ডিসপ্লে, কন্ট্রোল বোর্ড আর বায়োমেট্রিক স্ক্যানার। ঘরের মেঝেটাও পালিশ করা, চকচকে।
ঘরের তিনদিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের তাক—তাতে স্তরে স্তরে সাজানো আছে রাইফেল, ট্যাজার, ছুরি, পেপার স্প্রে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাটার, বড়-ছোট দড়ি, নাইফ, হাতুড়ি, কয়েক ধরনের রাইফেল ও রিভলভার। তার পাশেই অটোমেটেড টুল শেলফ—যেটার বাটন চাপলেই বেরিয়ে আসে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, যেমন—ইলেকট্রিক কাটার, হাই-স্পিড ড্রিল বা ওয়েল্ডিং গান।
তার পাশেই বড় একটা ফটো ফ্রেম ঝুলছে, যেখানে দুজন ব্যক্তির ছবি।
এক কোণায় হাই-টেক মনিটরিং স্টেশন—যেখানে তিনটা বড় স্ক্রিন, সেগুলোর মধ্যে দিয়ে ক্যামেরা ফিড চলেছে ফ্যাক্টরির প্রতিটি অংশ থেকে।
রুমের মাঝখানে মেটাল অপারেশন টেবিল—উঁচু, পরিষ্কার। তার পাশেই রিমোট-কন্ট্রোলড মেকানিকাল আর্ম, যা দিয়ে বন্দিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। টেবিলের নিচে বিল্ট-ইন হাতকড়া।
ঘরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার ও ঠান্ডা। এই জায়গা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবেন—জায়গাটা প্রফেশনাল। বাতাসে হালকা কাঁচা রক্তের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে—হয়তো কিছুক্ষণ আগেই কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ঘরের চারদিকে স্পেশাল ২০ জন গার্ড রোবোটিক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েক মুহূর্ত পর ঘরের দরজা অটোমেটিকভাবে খুলে গেল। রুমের উজ্জ্বল সাদা আলোয় দুটো অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল। তাদের মধ্যে একজন কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো মাস্ক পরা—ছ’ফুট এক উচ্চতার সুঠাম দেহী, বলিষ্ঠ পুরুষ।
তাদের প্রখর হাঁটাচলার ধরনে ঈগল চোখের চাহনি, যাতে স্পষ্ট ফুটে উঠে কর্তৃত্বের চাপ। সে ঘরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই গার্ডরা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে ফেলল। তার নজর বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ—যে চোখে চোখ রাখলে মৃত্যু নিশ্চিত।
সে সোজা হেঁটে গিয়ে লোক দুজনের সামনের চেয়ারে পা তুলে বসল। জাভেদকে হাত দিয়ে ইশারা দিতেই সঙ্গে সঙ্গে দুই জন গার্ড এসে তাদের মাথায় দুটো বালতি ঠান্ডা পানি ঢেলে দিল।
কয়েক সেকেন্ড পর লোক দুটি চোখ পিটপিট করে তাকালো, আশেপাশে নজর বুলিয়ে বুঝার চেষ্টা করল—এটা কোথায়, কী হচ্ছে তাদের সাথে।
প্রণয় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে।
মিস্টার শেঠ হুঁশ ফিরতেই সামনে নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুকে দেখে বুঝে নিলেন, তার সময় আর বেশি বাকি নেই।
মিস্টার শেঠের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভয়ে ভয়ে বলল, “আমার কী অপরাধ, স্যার? আমাকে ধরে এনেছেন কেন?”
প্রণয় শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
লোকটি আবার মিনতি করে বলল, “যা ভুল করেছি, তার জন্য দয়া করে মাফ করে দিন, স্যার!”
প্রণয় মিস্টার শেঠের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোরে এখন কী করব বল… তোর কলিজা টেনে ছিঁড়ে নিলেও তো আমার কলিজা ঠান্ডা হবে না।
তোর ভাই আমাকে মারার চেষ্টা করেছে—আমি কিছু বলিনি।
আমার কোম্পানির দিকে তোর বহু বছরের নজর, তবুও তোকে কিছু বলিনি, ছাড় দিয়েছিলাম।
কিন্তু তুই এটা কী করলি…?”
লোকটা অগ্নি চোখে তাকাল প্রণয়ের দিকে। এসটি কোম্পানির অনার সে। সে ও ভয় পাওয়ার পাত্র নয়।
আর যেখানে শত্রুর হাতে মৃত্যু নিশ্চিত, সেখানে ভয় পেয়ে অযথা সম্মান নষ্ট করার মানেই হয় না।
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে সে বলল,
“যা করেছি, একদম ঠিক করেছি। ওটাই তো তোর আসল দুর্বলতা, তাই না?
তোকে মারা যাচ্ছে না, তাই ওকে মেরে দিতে চাইলাম। খেতে চাইলে তো দিবি না… উফ্ কী মাল! একবার যদি খেতে পারতাম…”
প্রণয়ের শান্ত চোখ ভয়ংকর লাল হয়ে গেল।
লোকটার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভয়ে ভয়ে বলল, “কি বলছেন স্যার, এসব…!”
লোকটা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“যা বলেছি, একদম ঠিক বলেছি। আবারও বলব—যা! এখান খাসা মাল! উফ্… অন্তত একবার না খেলে জীবনটাই বৃথা!”
সে আরও কিছু বলতে নিচ্ছিল, কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের করার আগেই হাত মুঠো করে নাক বরাবর সজোরে পাঞ্চ বসিয়ে দিল প্রণয়।
এত জোরে ঘুষি খেয়ে লোকটা তাল সামলাতে পারল না—সঙ্গে সঙ্গেই উল্টে মুখ থুবড়ে পড়ল।
প্রণয় নিজের কালো শার্টের হাতা গুটিয়ে বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়াল।
লোকটার চুল মুঠি করে শক্ত করে ধরল। পরপর আবারও সজোরে নাক বরাবর ঘুষি মারল।
এবার গলগল করে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এলো।
লোকটা কিছু বলতে চাইল, তার আগেই প্রণয় জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
মাথায় আবারো খুন চেপে বসেছে তার। প্রতিটা আঘাতে লোকটার একটা একটা করে হাড় ভাঙছে।
প্রত্যেকটা মারের সাথে সাথে জাভেদ কেঁপে কেঁপে উঠছে, ভয়ে তার রীতিমতো হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে।
প্রায় দশ মিনিট ধরে পিটিয়ে লোকটার শরীরের সব হাড়গোড় ভেঙে ফেলল।
এসব দেখে লোকটার অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর ভয়ে মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে।
হঠাৎই প্রণয় গর্জে উঠল,
“ফাস্ট!”
কেঁপে উঠে জাভেদ দৌড় দিল। দুই সেকেন্ডের মাথায় ফিরে এলো লাল টকটকে আগুনে পুড়ানো ছুরি নিয়ে।
কাঁপা হাতে সেটা প্রণয়ের হাতে দিলো।
প্রণয়ের শার্ট ততক্ষণে রক্তে লাল হয়ে গেছে। হাতে গরম ছুরি দেখে লোকটার কলিজা শুকিয়ে গেল।
প্রণয় দুই গার্ডের দিকে তাকাতেই তারা দৌড়ে এসে লোকটার মুখ হা করে ধরল। আরেকজন জিভ বের করে টেনে ধরল।
প্রণয় চুল মুঠি করে ধরে বিশ্রী গালি দিতে দিতে বলল,
“তোর মরার রেসিপির কথা… মৃত্যুর পর নরকে গিয়ে শোনাস।”
এই বলে একটানে জিভ আলাদা করে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা গলাকাটা মুরগির মত ছটফট করতে করতে চিৎকার দিতে লাগল।
জিভ না থাকায় মুখ দিয়ে শব্দের বদলে গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে।
প্রণয় বাঁকা হেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে।
এবার লোকটা ভয় আর যন্ত্রণায় জোরে জোরে কাঁপতে লাগল। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এতক্ষণে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।
প্রণয় একটু ঝুঁকে গিয়ে লোকটার কলার চেপে ধরল, বাঁকা হেসে বলল—
“আজকে আমি নিজের হাতে তোকে আবার মু…স…ল…মা…নি করাব।”
লোকটা এবার আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল।
প্রণয় লোকটার প্যান্টের চেইনে হাত দিতেই তার ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।
থেমে গেল প্রণয়।
পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরতেই স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠল—
“রক্তজবা”
সাথে সাথেই নিভে গেল সে।
সকল হিংস্রতা হারিয়ে গিয়ে সেথায় কোমলতা জায়গা করে নিলো।
মাথা তুলে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
“মুখ থেকে যদি একটা ‘ওহ’ শব্দ বের করেছিস, এক্ষুনি জানে মে…রে ফেলবো।”
লোকটা যন্ত্রণায় গোঙাতে চাইলে ও প্রানের মায়ায় চুপ করে রইলো।
প্রণয় ফোন রিসিভ করতেই প্রিয়তা সুমিষ্ট কণ্ঠে ডাকলো,
“প্রণয় ভাই!”
প্রণয় না চাইলেও হেসে ফেললো।
“বল জান।”
প্রিয়তা আব্দারের সুরে বললো,
“যেখানেই গেছেন, আসার সময় আমার জন্য ফুচকা আর ঝালমুড়ি নিয়ে আসবেন!”
“উফ্! এসব আনহেলদি খাবার তোকে খেতেই হবে?”
প্রিয়তা জেদ দেখিয়ে বললো,
“প্লিজ প্রণয় ভাই!”
“ঠিক আছে, এখন রাখি।”
“না, আগে বলুন, আসার সময় নিয়ে আসবেন!”
“আচ্ছা বাবা, নিয়ে আসবো।”
“মনে থাকে যেন!”
বলেই ফোন কেটে দিল প্রিয়তা।
ফোন কাটতেই পুনরায় হিংস্র হয়ে উঠলো প্রণয়।
লোকটা এতোক্ষণে চেপে রাখা যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠলো।
এবার এক টানে লোকটার প্যা*ন্ট খুলে ফেললো সে।
লোকটা আরো জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো—হয়তো মিনতি করছে।
একজন গার্ড এসে লোকটার ভবিষ্যতের বাত্তি তুলে ধরলো।
প্রণয় বাঁকা হেসে লোকটার মুখের দিকে তাকাল।
একটু ঝুঁকে গিয়ে বলল,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৫
“বাই বাই ডার্লিং।”
বলে সোজা মাঝ বরাবর এক কোপে ভবিষ্যতের বাত্তিতে লোডশেডিং করিয়ে দিল।
লোকটা কয়েকবার ঝাঁকুনি খেয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল।