ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
পাঁচ তারকা হোটেলের একটা বিলাসবহুল, ঝকঝকে কক্ষ।
ঘরের মাঝ বরাবর বিশাল আকৃতির লম্বাটে টেবিল।
এটা মূলত একটা অতি আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মিটিং রুম।
টেবিলের একটি চেয়ারও ফাঁকা নেই। পুরো টেবিলের চার পাশ জুড়ে বসে আছেন সুট-বুট পরিহিত নানা ভিনদেশী লোক। এদের মধ্যে হয়তো দুই-একজন বাঙালি, বাকি সব নন-বেঙ্গলি।
বর্তমানে তাদের সকলের দৃষ্টি পতিত আছে টেবিলের মাঝখানে একটি ইলেকট্রনিক ম্যাপে, যেখানে লাল বিন্দু দিয়ে মার্ক করা হয়েছে বিশ্বের প্রধান প্রধান বন্দর, সীমান্ত, ট্রাফিকিং রুট।
টেবিলের মাথার দিকে বসে আছেন প্রণয় শিখদার।
তাদের সামনেই বসে আছে মধ্যপ্রাচ্যের সুনামধন্য অস্ত্র ব্যবসায়ী, আফ্রিকার মানবপাচার নেটওয়ার্কের শীর্ষ নেতা, রাশিয়ার কুখ্যাত সাইবার-ক্রাইম লর্ড।
আজ একটি গোপন বৈঠকের জন্য মূলত তারা সকলেই বাংলাদেশে এসেছে।
প্রণয় সবার দিকে ঠাণ্ডা গলায় বলল—
“আগামী সাত দিনের মধ্যে ৫০০০ কন্টেইনার ইটালি সহ ইউরোপের দশটা কান্ট্রিতে পাঠিয়ে দিতে হবে। আর কাজটা আগামী সাত দিনের মধ্যেই করতে হবে, এডভান্স নেওয়া হয়ে গেছে।”
প্রণয়ের পাশে বসা রাশিয়ান ডিলার সব শুনে বলল,
“বস, এবার যদি চালান ধরা পড়ে, আমাদের মিডল-ইস্ট ব্রাঞ্চ পুরোপুরি ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।”
প্রণয় তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল,
“আমার কনটেইনার যেখানে যায়, কাস্টমস চোখ বন্ধ করে। সরকারকে পকেটে রাখলে ভয়টা শখ হয়ে যায়।”
অন্য একজন মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই নতুন চালানে কী থাকছে, বস?”
প্রণয় উঠে দাঁড়াল, বাঁকা হেসে।
হাত দিয়ে ম্যাপ স্ক্রিনে স্পর্শ করতেই ভেসে উঠল—
> ● ২০টি হাই-এন্ড অ্যাসল্ট রাইফেল
● ৩৫ জন নারী পাচার — উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন লোকেশন অনুযায়ী ভাগ
● ৫ মিলিয়ন ডলার ব্ল্যাক মানি — ক্রিপ্টোতে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায়
একজন আফ্রিকান ডিলার ফাইল এগিয়ে দিল, বলল—
“লিবিয়া রুটটা খুলে দিলে, অর্গান ট্রাফিকিংয়ের সব ঝামেলা কমে যাবে। আমাদের সাপ্লাই আছে, কিন্তু ইউরোপে ঢোকার পথ চাই। কিডনি, লিভার, কর্নিয়া—সবই যাবে প্রথম শ্রেণিতে।”
প্রণয় চোখ সরিয়ে ম্যাপ স্ক্রিনে তাকাল।
“তোমার কাছে যে ১১টা কিশোরী ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের বয়স ঠিকঠাক? রোগ-টোগ নেই তো?”
লোকটা প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বলল,
“সব মেডিকেল ক্লিয়ার। তিনটে ৯ বছর বয়সী, বাকিরা ১২ থেকে ১৪।”
প্রণয় গম্ভীর মুখে বলল—
“ওদের অঙ্গ বিক্রি হবে—তাদের না। শরীরের দাম হয়, আত্মার না। পাঠাও, কাল রাতেই।”
ততক্ষণে একজন মধ্যপ্রাচ্যের আগ্নেয়াস্ত্র সাপ্লায়ার নতুন অস্ত্র দেখাতে শুরু করল।
“এগুলো বাচ্চাদের জন্য তৈরি—ছোট মেশিনগান। আফ্রিকান চাইল্ড আর্মির জন্য পারফেক্ট। দাম কম, মৃত্যু বেশি।”
প্রণয় তৃপ্ত গলায় বলল—
“মৃত্যু যেখানে পণ্য, সেখানে জীবন বিলাসিতা।”
দীর্ঘ কথোপকথন শেষে সবাই চুক্তিপত্রে সাইন করে তাদের বসের দিকে এগিয়ে দিলো।
প্রণয় চুক্তিপত্রে সাইন করতে নিলেই তার ফোন সশব্দে বেজে উঠলো।
প্রণয় একটু বিরক্ত হয়ে ফোন সামনে ধরতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
সামনের সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
প্রণয় এদের পাত্তা না দিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কী বললো, শোনা গেল না, তবে যা বললো তাতে প্রণয়ের চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল।
সে চিৎকার দিয়ে বললো, “হোয়াট! আমি এখনই আসছি!”
বলেই ঝড়ের গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে উপেক্ষা করে উন্মাদের ন্যায় ছুটে বেরিয়ে যেতে নিলে জাভেদ ভয় ভয় রাস্তা আটকে তুতলিয়ে বললো,
“স্যার, সাইন করে যান, নয়তো আপনার কয়েকশো কুটি টাকার লস হয়ে যাবে!”
প্রণয় রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো জাভেদের দিকে।
হাতের গানটা কপালে ঠেকিয়ে বললো,
“Money doesn’t mean sh*t to me.”
বলে ছুটে বেরিয়ে গেল।
সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখল তাদের বসের উন্মাদনা।
তারা তাদের বসকে এতটা পাগলামি করতে আগে কখনো দেখেনি। কী এমন হলো?
দুই ঘণ্টার রাস্তা হাই স্পিডে ড্রাইভ করে বিশ মিনিটেই শিকদার বাড়িতে এসে পৌঁছালো প্রণয়। ছেলেটার অবস্থা পাগল প্রায়।
শিকদার বাড়ি পুরো শুনশান।
প্রণয় ঝড়ের বেগে তিন তলায় উঠে গেল। ছুটে প্রিয়তার ঘরে গিয়ে দেখলো পরিচারিকা জুলেখা বানো বারান্দার দরজা ধাক্কাচ্ছে।
প্রণয়ের বুকে কাপন ধরল। সে বিদ্যুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজায় পরপর বেশ কয়েকটা লাথি দিলো।
এতে দরজা তো খুললো না, বরং ভেঙেই গেল।
প্রণয় এলোমেলো পা ভেতরে ফেলতেই চমকে উঠলো।
কলিজাটা মুচড়ে উঠলো মুহূর্তেই—প্রিয়তা এখনও একই ভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে!
প্রণয় হাঁটু গেড়ে বসে পাগলের মতো ডাকতে লাগলো,
“এই জান, কথা বল প্লিজ, আমার জান, আমার পাখি!”
কিন্তু নড়লো না প্রিয়তা।
প্রণয় গালে আলতো চাপড় মেরে ডাকলো, তবুও নড়লো না প্রিয়তা।
ভয় পেয়ে গেলো প্রণয়। ব্যতিব্যস্ত হাতে তাকে কোলে তুলতেই তার সফেদ রঙা শার্টটা লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে গেল।
এসব দেখলোই না সে। প্রিয়তাকে কোলে নিয়ে দ্রুত বিছানায় শুইয়ে দিল।
জুলেখা বানুর উদ্দেশ্যে চিৎকার দিয়ে বললো,
“ফার্স্ট, ডক্টরকে কল করো!”
জুলেখা বানু ছুটে চলে গেলেন ড্রয়িং রুমের দিকে।
প্রণয় ভয়ার্ত চোখে নিজের প্রাণটাকে দেখলো। তার হৃদপিণ্ড মনে হচ্ছে এখনই লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে।
সে কম্পনরত হাতে প্রিয়তার পালস চেক করলো, পালস চলছে তবে অনেক ধীরে।
প্রণয় পাশের জগ থেকে পানি নিয়ে চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল, গালে হালকা চাপড় মেরে আতঙ্কিত কন্ঠে ডাকলো,
“আমাকে আর মারিস না পাখি, এবার সত্যি সত্যি মরে যাবো, এর পর জালাবি কাকে! কথা বল, জান, কথা বল আমার সাথে, বল…”
বলতে বলতে বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো প্রণয়,
“এই জান, শুচ্ছিস?”
হালকা নড়ে উঠলো প্রিয়তা। নিভু নিভু চোখে তাকালো প্রিয় পুরুষের আতঙ্কিত মুখের পানে।
প্রিয় পুরুষকে আবার কাছে দেখে অভিমানে বুক ভারি হলো প্রিয়তার। চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রহেলিকার এলো মেলো অবস্থা।
তীব্র অভিমানীনে দূরে সরে যেতে চাইলে, কিন্তু ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।
প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে নিলো, কথা বলতে চায় না সে এই পুরুষের সাথে।
জ্ঞান ফিরেছে দেখে বুকটা শান্ত হল প্রণয়ের।
মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, তার জান তার উপর অনেক অভিমান করে আছে।
কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নয়।
জুলেখা বেগম পাশে এসে দাঁড়ালেন। ভয়ে ভয়ে বললেন,
“ডাক্তারকে বলে দিয়েছি বড় ভাইজান, ডাক্তার আসছে।”
প্রণয় শুনলো।
প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললো,
“ওকে চেঞ্জ করতে হেল্প করো।”
জুলেখা বানু প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ঢুক গিলে, ভয়ভয়ে বললেন,
“এখানেই করাবো?”
প্রণয় প্রিয়তাকে আবার কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে দিয়ে আসলো।
ওয়ারড্রোব থেকে নতুন জামা বের করে জুলেখা বানুর হাতে দিয়ে বললো,
“শেষ হলে আমাকে ডাক দেবে।”
জুলেখা বানু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, হাত থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন।
প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বেডশিটের দিকে তাকালো। সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
সে বেডশিট পাল্টে নতুন বেডশিট পেতে দিলো।
নিজের লাল হয়ে যাওয়া শার্টটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।
কিন্তু আবার কিছু একটা মনে পড়তেই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল, কপালের শিরা ফুলে ফেপে উঠলো।
ধপাধপ পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে গেলো।
ঘরে ঢুকে চারপাশে খুঁজলো প্রহেলিকাকে।
কিন্তু কোথাও পেলো না। বড় বড় শ্বাস ফেলে আপাতত নিজের বাড়ন্ত রাগটা গিলে নিলো।
ওয়ারড্রোব খুলে আবারো একটা সাদা শার্ট বের করে পরে নিলো।
জুলেখা বানু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ধীর কণ্ঠে বললেন,
“হয়ে গেছে বড় ভাইজান।”
প্রণয় ওয়াশরুমে ঢুকে আবার প্রিয়তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
জুলেখা বানুর উদ্দেশ্যে বললো,
“বাড়ির বাকি সব কোথায়?”
জুলেখা বানু নত কণ্ঠে বললেন,
“আম্মাজানরা গ্রামের কোথায় জানি দাওয়াত খাইতে গেছেন সেই সকালেই। আর তো বড় আপা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই।”
প্রণয় সব শুনে আদেশের সুরে বললো,
“সরিষার তেলে রসুন ভেজে নিয়ে এসো।”
জুলেখা বানু “আচ্ছা ভাইজান” বলে চলে গেলেন।
প্রণয় নরম চোখে তাকালো নিজের প্রাণটার দিকে,
ব্যথায় মলিন হয়ে যাওয়া সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল—
“যার জন্য বিষ খেয়ে বিষ হজম করতে হয়।
যাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রতিনিয়তো পুড়িয়ে মারতে হয়—
দিন শেষে তার কাছেই অপরাধী!
যাকে এক নজর দেখবো বলে সব কিছু হাসিমুখে সহ্য করি—
সেই বুঝে না আমায়।
আমার অভিমান করার জায়গা নেই, কষ্ট দেখানোরও জায়গা নেই।
কি করবো আমি এই জীবন নিয়ে?”
প্রিয়তা নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
দুই চোখ তার স্রোতস্বিনী নদী, যা কখনোই শুকায় না।
প্রণয় সইতে পারলো না প্রিয়তার এই বুবা কান্না।
প্রিয়তাকে জোর করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।
আলতো হাতে নরম গাল মুছিয়ে দিলো।
প্রিয়তা থাকতে চাইলো না প্রণয়ের বুকে।
চটফটিয়ে সরে যেতে চাইলে প্রণয় এক চুলও ছাড় দিলো না।
আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো।
রাগে তার সারা শরীর থরথর করে কাপছে।
সে তার প্রাণকে ছুঁয়ে শপথ নিলো—আজকের হিসাব সে অক্ষরে অক্ষরে নেবে।
প্রিয়তা কান্না করে দিয়ে অনেক কষ্টে ভাঙা কণ্ঠে বললো,
“স্পর্শ করবেন না আমায়, ছাড়ুন প্লিজ, দূরে যান।”
প্রণয় ছাড়লো না, বরং ধমকে বললো,
“একদম চুপ! আর একটা ও কথা বললে থাপ্পড়ে তোর গাল লাল লাল করে ফেলবো।”
ধমক খেয়ে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা, আরো জোরে কেঁদে দিলো। নিজের দুর্বল হাতের সর্বশক্তি দিয়ে প্রণয়ের পিঠ আঁকড়ে ধরল, বুকে মুখ গুজে বাদনহারা কান্নায় ভেঙে পড়লো।
জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে থেমে থেমে বললো,
“আপনি খুব খারাপ প্রণয় ভাই, খুব খারাপ। আপনি প্রিয়কে খুব কষ্ট দেন। কেন আমায় এত কষ্ট দেন প্রণয় ভাই?
আমি সইতে পারি না। সব কষ্ট হজম করে নিলেও আপনি অন্য কারো… এটা হজম করতে পারি না। প্রয়োজনে আপনি নিজেই আমায় মেরে ফেলুন, তবু এত কষ্ট দেবেন না।”
প্রণয় শক্ত করে বুকে আগলে নিয়ে কপালে ঠোঁট চেপে ধরলো।
প্রিয়তার কান্না মিশ্রিত এক একটা বাক্য প্রণয়ের হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে।
সে নিজের মনের সিদ্ধান্ত আরও পাকাপোক্ত করলো—ভেবে নিলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভিসা-পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলতে হবে।
তার জানকে আর এই নরকে রাখা যাবে না। একদমই যাবে না।
জুলেখা বানু গরম তেল নিয়ে এলো।
প্রণয় হাতে বাটি নিয়ে বললো,
“ডাক্তার আসছেন বড় ভাইজান, তাকে এখানে নিয়ে আসবো।”
“হুম।”
জুলেখা বানু চলে গেলেন ডাক্তার আনতে।
প্রণয় প্রিয়তাকে নিজ থেকে একটু আলগা করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“শান্ত হ, জান।”
তাদের কথার মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করলেন স্পেশাল গাইনোকলজিস্ট ডক্টর রাইমা শেখ।
তিনি এসে প্রিয়তার পাশে বসলেন। চশমা ঠেলে ভালোভাবে প্রিয়তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর রেগুলার চেকআপ করে প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বললেন,
— বয়স কত তোমার?
প্রিয়তা ডাক্তার রাইমার দিকে দুর্বল চোখে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে উত্তর দিল,
— ১৬।
ডাক্তার রাইমা শান্ত চোখে চেয়ে আবারো বললেন,
— তোমার রিপোর্ট সব আমি দেখেছি। সব রিপোর্ট একেবারেই নরমাল। কোনো ইনফেকশন নেই, কোনো সিস্ট নেই, কোনো প্রবলেম নেই। তোমার সমস্যাটা সম্পূর্ণ জেনেটিক। আমি চাইলে তোমাকে পেইনকিলার সাজেস্ট করতেই পারি, কিন্তু এটা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর।
তাই চেষ্টা করবে যেন সেটা না নিতে হয়। আমি একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, ব্যথা কমে যাবে।
আর কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি—ছয় মাস নিয়ম করে খাবে। তবেই তোমার মেনস্ট্রুয়াল ব্যথা কিছুটা কম হবে।
আর হ্যাঁ, মাংস আর ডিম একদমই খেতে পারবে না। শুধু শাকসবজি আর মাছ খাবে, কেমন?
প্রিয়তা কিছু বলল না।
ডাক্তার রাইমা ইনজেকশন ভেঙে মেডিসিনটা সিরিঞ্জে ভরতেই সূঁচ দেখে আঁতকে উঠল প্রিয়তা।
চিৎকার দিয়ে প্রণয়ের ডান হাত আঁকড়ে ধরল, কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে অনুরোধ করল,
— প্লিজ ডক্টর, এটা দেবেন না। আর যা কিছু দেবেন, সব খাবো।
ডাক্তার রাইমা এগিয়ে এসে পাশে বসে বললেন,
— তুমি শুধু একটু চোখ বন্ধ করো। প্রমিস, কিছু ফিল করবে না।
প্রিয়তা এবার আরো জোরে কান্না করে দিলো।
বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে প্রণয়ের কোমর আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— প্লিজ প্রণয় ভাই, উনাকে বারণ করুন।
ডাক্তার রাইমা আবার বললেন,
— এটা না দিলে ব্যথা কমবে না। বোঝার চেষ্টা করো।
প্রণয়ের বুক পুড়ছে।
সে প্রিয়তাকে টেনে তুলে কপালে চুমু খেলো।
দুই হাতের আজলায় মায়াবী মুখটা তুলে চোখে চোখ রেখে মোহনীয় কণ্ঠে বলল,
— আমার চোখে দেখ।
অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয়তা চাইলো প্রণয়ের বাদামি চোখে।
প্রণয় মুখটা আরও একটু এগিয়ে দিয়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,
— আমি তো তোর চোখ দেখেই মন বুঝে যাই জান, তুই কি একটু ও বুঝিস না?
কান্না বন্ধ হয়ে গেল প্রিয়তার। দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।
প্রিয়তা তলিয়ে যেতে লাগল ওই বাদামি চোখের গভীরে।
ওই চোখের ভাষা যেন অনেক কিছু বলে যায়, যা বোঝার সাধ্য বুঝি প্রিয়তার এই জনমে আর হবে না।
চোখে চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ ‘আহ’ করে উঠল প্রিয়তা।
সঙ্গে সঙ্গে প্রণয় তাকে বুকে জড়িয়ে নিল।
ডাক্তার রাইমা বললেন,
— নেন, হয়ে গেছে। একটু পরেই ব্যথা ছেড়ে দেবে।
ডক্টর রাইমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে এবার প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বললেন,
— শুনো প্রিয়তা, এখন তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি অনেক ডিপ্রেসড, অনেক বেশি চিন্তা করো।
কিন্তু তোমার যে বয়স, এটা স্ট্রেস নেবার বয়স না।
এটাই তো সময় জীবনটাকে অন্যভাবে দেখার, উপভোগ করার।
কিন্তু তোমাকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।
তোমার অতিরিক্ত ডিপ্রেশন তোমার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
And it’s too harmful. So, stay happy.
প্রিয়তা চুপচাপ সব শুনল, কিন্তু কিছু বলল না। কিবা বলবে সে?
ডাক্তার এবার প্রণয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
— স্যার, ওকে টেনশন ফ্রি রাখার চেষ্টা করবেন।
প্রণয় সম্মতি জানিয়ে উনার ফি মিটিয়ে দিল।
ডাক্তার রাইমা চলে গেলেন।
প্রণয় প্রিয়তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে অপরাধী কণ্ঠে বলল,
— আমি সরি, জান। আমার জানপাখি, খুব কষ্ট পেয়েছিস।
প্রিয়তা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়কে।
কষ্ট তো পেয়েছিল, পাবেও। এটা তোর আর নতুন কিছু নয়।
তবে যাই হোক, প্রণয় ভাইকে ছাড়া বাঁচা যাবে না।
প্রণয় মনে মনে ভাবল,
“এই কষ্ট আর কিছুদিনের পাখি… এর পর… এই টক্সিক মানুষ, এই টক্সিক পরিবেশ—সব কিছু থেকে অনেক, অনেক দূরে থাকবে তুই।
আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—কষ্ট দেওয়ার মতো মানুষটাই আর থাকবে না তোর জীবনে।
তুই ও ধীরে ধীরে ভুলে যাবি সবকিছু, সময়ের সাথে সাথে ছুঁড়ে ফেলবি মন থেকে। ফেলবি তো, জানপাখি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়ল তরল অশ্রু।
প্রিয়তা প্রণয়ের পিঠ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে বলল,
— দুঃখ, যন্ত্রণা দিয়েন, সমস্যা নেই। কিন্তু কখনো দূরে সরিয়ে দেবেন না। সহ্য করতে পারব না, মরে যাবো।
বুক কেঁপে উঠল প্রণয়ের। অস্তিত্বে মিশিয়ে নিয়ে শুধালো,
— কিছু খেয়েছিস?
প্রিয়তা দুই পাশে মাথা নাড়াল।
প্রণয় তাকে রেখে উঠে যেতে যেতে বলল,
— চুপচাপ খেয়ে রেস্ট নিবি, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
প্রিয়তা অসহায় মুখে তাকিয়ে রইল।
প্রণয় কিচেনে এসে ফ্রিজ থেকে ফ্রেশ ভেজিটেবলস বের করল।
শার্টের হাতা গুটিয়ে গ্যাস অন করল।
১০ মিনিটের মধ্যেই ভেজিটেবল স্যুপ বানিয়ে প্রিয়তার কাছে নিয়ে এল।
প্রিয়তার ব্যথা একটু কমে আসায় এখন খিদে পাচ্ছে।
প্রণয়কে বাটি হাতে এগিয়ে আসতে দেখে খিদেটা আরও বেড়ে গেল।
এগিয়ে গিয়ে উৎসুক কণ্ঠে বলল,
— কী রান্না করেছো, প্রণয় ভাই?
প্রণয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তার দিকে তাকাল। মনে মনে বলল,
— পাগলী।
প্রণয় মৃদু হেসে একটু স্যুপ চামচে নিয়ে প্রিয়তার মুখের সামনে ধরল।
স্যুপের বাটির দিকে তাকাতেই প্রিয়তার উচ্ছ্বসিত হাসি-হাসি মুখটা সহসাই ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।
নাক সিঁটকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
— ছ্যাহ! এইসব ঘাসপাতা আমি খাবো না!
প্রণয় গাল চেপে ধরে প্রিয়তার মুখ ঘুরিয়ে দিলো, ফুঁ দিয়ে প্রিয়তাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
— আগে টেস্ট কর। যদি ভালো না লাগে, খেতে হবে না।
প্রিয়তা নাক কুঁচকে খাবারটা মুখে নিল।
খাবারের স্বাদটা জিভে লাগতেই চোখ বড় বড় করে ফেলল।
প্রণয় আরেক চামচ ফুঁ দিয়ে মুখের সামনে ধরল।
— কেমন?
প্রিয়তা খাবারটা মুখে নিয়ে প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,
— অনেক মজা!
হাসল প্রণয়। পুরো বাটি খাইয়ে দিয়ে আদেশ করে বলল,
— আজ থেকে তোর হাবিজাবি খাওয়া বন্ধ!
প্রিয়তা মুখ অন্ধকার করে ফেলল, কিন্তু প্রিয়তার মুখভঙ্গিকে পাত্তা দিল না প্রণয়। বাটি নিয়ে চলে গেল।
প্রিয়তা প্রণয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল,
— আপনি বড়ই অদ্ভুত প্রণয় ভাই। নিজে কেটে ছিঁড়ে, নিজেই মলম লাগান।
আমি জানিনা আমার জীবনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তবে… এই তনয়া শিকদার প্রিয়তা তো শেষ!
পূর্ব আকাশে বিস্তৃত কালো মেঘ জমেছে, তার থেকে ক্ষণে ক্ষণেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। প্রকৃতির অবস্থা ভালো না, পুরো পৃথিবী অন্ধকার করে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ধরনিতে শ্রাবণ ধারা নামবে। ইতিমধ্যেই প্রবল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
এই দুর্যোগময় পরিবেশ দেখে পরিনিতার কলেজ আজ ১:৩০-এর মধ্যেই অফ হয়ে গেছে। কলেজে বন্ধ পড়তে হবে না, পরিনিতা তাই মহাখুশি। সে কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত মেলে ঝড়ো হাওয়া উপভোগ করছে।পূর্ণতা দৌড়ে ছুটে এসে ওর মাথায় গাট্টা মেরে তেতে উঠে বললো,
— “পরি, পুরো কলেজ ফাঁকা হয়ে গেছে, দুনিয়া অন্ধকার করে ঝড়-বৃষ্টি আসছে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? তাড়াতাড়ি চল।”পরিনিতা ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
— “সবাই চলে গেছে! তুই এখানে কী ডিমে তা দিতে আছিস, নাকি কাবাবের হাড্ডি হবি বলে থেকে গেছিস?
”পূর্ণতা ভুরু কুঁচকালো,
— “মানে?
”পরিনিতা দুষ্টু হেসে চোখ টিপ দিয়ে বললো,
— “তোর মতো জাত নিরামিষ বেডিরা এসব বুঝবে না! এর থেকে ভালো, ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর-সর্দি না বাঁধিয়ে তোর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তুই যা।
”পূর্ণতা রেগে বললো,
— “একদম না, পরি! কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, তুই কলেজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, নিশ্চয়ই বাড়িতে জানাসনি? চল, আমি তোকে ড্রপ করে তারপর যাবো।
”পরিনিতা লাফিয়ে উঠলো, পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আপত্তি জানিয়ে বললো,
— “মা আমার, তুই যা, আমি এখন যাবো না, প্লিজ!”পূর্ণতা দাঁত খিটমিট করে টানতে টানতে বললো,
— “চল বলছি।”পরিনিতা কোনোমতে ওর হাত ছাড়িয়ে উল্টো ঘুরে দৌড় দিতে দিতে বললো,
— “আমি যাবো না, টেপির মা!
”— “সাবধানে, পরি! পড়ে যাবি,”
—বলতে বলতেই পরিনিতা হোঁচট খেয়ে উলটে পড়লো।
— “পরিইইই…!
”পরিনিতা চোখ-মুখ কুঁচকে মাটিতে পড়ে ব্যথা পাওয়ার অপেক্ষা করলো, কিন্তু এক হাতে মাটিতে কিছুটা ঘর্ষণ অনুভব হলো, এছাড়া আর তেমন কিছুই অনুভূত হলো না।
কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন ব্যথা লাগলো না, তখন ভ্রু কুঁচকে ফেললো পরিনিতা। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই হা হয়ে গেলো
—আবিদ! ওর বাঁ-হাত টেনে ধরে কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রেগে আছে না কী, বোঝা যাচ্ছে না।
আবিদ ওর হাত ধরে সামনের দিকে টান দিলো। মনোযোগ হারানো পরি তাল সামলাতে না পেরে ঝড়ের বেগে আবিদের বুকে আছড়ে পড়লো। ততক্ষণে পূর্ণতা আর চিত্রলেখা ম্যাডামও দৌড়ে এসে গেছেন।
মাস্টারমশাই সামনে এলেই পরিনিতার পৃথিবী স্লো মোশনে চলতে থাকে, চারপাশে ভায়োলিন বাজতে থাকে, কিন্তু এই সুখ কারো সহ্য হলো না। কেউ এসে এক ঝটকায় পরিকে আবিদের কাছ থেকে আলাদা করে দিলো। তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো বাক্য ছুড়ে বললো,
— “তোমার কী কোনো ম্যানার্স জানা নেই, পরি? এভাবে কেউ স্যারের গায়ে পড়ে? ছাড়ো বলছি!
কলেজ শেষ হলে দেখি তুমি প্রায়ই স্যারের আশেপাশে চিপকে থাকো।
তুমি কী ভুলে যাও স্যার আর ছাত্রীর সম্পর্ক সম্মানের সম্পর্ক, সেখানে তুমি…
”পরিনিতার চোখে পানি চলে এলো, মাথা নিচু করে ‘সরি’ বলতে নিলেই, আবিদ ওর হাত মুঠো শক্ত করে চেপে ধরলো, নিজ দায়িত্বে পরিকে কাছে টেনে নিলো।
পূর্ণতা আর চিত্রলেখা ম্যাডামের চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল।
আবিদ নিজের রুমাল দিয়ে পরির হাতে লেগে থাকা মাটি মুছে দিতে দিতে নরম কণ্ঠে বললো,
— “কোথাও লেগেছে, অ্যাঞ্জেল?
”পরিনিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আবিদের দিকে তাকিয়ে দুই পাশে মাথা ঝাঁকালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
আবিদ পরিনিতার কলেজ ব্যাগটা ওর কাঁধ থেকে নিয়ে নিজের কাঁধে নিতে নিতে চিত্রলেখা ম্যাডামের দিকে তাকালো, শান্ত অথচ রাগী কণ্ঠে বললো,
— “কলেজ শেষ, ম্যাডাম, তাই এখানে স্যার-ছাত্রীর সম্পর্ক থাকবে নাকি অন্য কোনো সম্পর্ক থাকবে, সেটা ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা।
তাই পরি আমার গায়ে পড়বে বা কোলে উঠে বসে থাকবে, সেটা ওর আর আমার ব্যাপার। This is none of your business. And thanks for your concern, ম্যাডাম।
চলো, পরি।
”আবিদ পরিনিতার হাত শক্ত করে চেপে ধরে নিয়ে চলে গেলো।
পূর্ণতা আর চিত্রলেখা তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলেন দুজনের দিকে।
পূর্ণতা গোল গোল চোখে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,
— “তাহলে এ.আর স্যারই কী পরির সেই মাস্টারমশাই?
”চিত্রলেখা অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন পরিনিতার হাত ধরে থাকা পুরুষালী হাতের দিকে।
আবিদ তার ব্যবহারে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলো তার জীবনে পরির গুরুত্ব কতটা,
যেখানে চিত্রলেখার নামক কারো কোনো জায়গা নেই। কথা বলার সময় তার চোখের ভাষা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছিলো—সে পরিকে কতটা ভালোবাসে।
কিন্তু প্রথম দেখাতেই তো সে ও এই শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষকে মন দিয়ে বসেছে, আর না বুঝে এতদিন ভালোবেসেছে, তাহলে কী সব মিথ্যে?
চিত্রলেখা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।
পূর্ণতা আরো অবাক হয়ে গেলো,
— “এর আবার কী হলো?
যাই হোক, সে আর এগুলো নিয়ে বেশি ভাবলো না, পরে পরির থেকে সব জেনে নেবে।
”ইতিমধ্যেই আকাশের বুক চিরে অঝোর ধারায় টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আবিদ ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে পরিনিতার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে বললো,
— “উফ্, অ্যাঞ্জেল, ভিজে যাবে, তাড়াতাড়ি চলো, জোরে দৌড়ো!
”জোরে দৌড়ানো তো দূরের কথা, পরিনিতা সটান দাঁড়িয়ে পড়লো।
হাতে টান লাগাতে থেমে গেলো আবিদ, আবারো কাছে এসে তাড়া দিয়ে বললো,
— “কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে যে? তাড়াতাড়ি চলো, জান!
”পরি গেল না, বরং আবিদের পেটের কাছে শার্ট টেনে ধরে আবদারের সুরে বললো,
— “আপনিও যাবেন না।”
— “কেন?
”পরিনিতা মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারো আবদার করে বললো,
— “একসাথে ভিজবো, মাস্টারমশাই, প্লিজ!
”আবিদ কিছুক্ষণ শান্ত নয়নে তাকালো ওই মায়াবী চোখে। ওই চোখের আবদার সে কখনোই ফেলতে পারে না।
এই চোখের মালিক যদি তার কাছে তার কলিজাটা চায়, তাহলে ওহয়তো সে ওই অতি প্রিয় নারীর হাতে ছুরি তুলে দিয়ে বলবে, তুই নিজেই নিয়ে নে।
পরিনিতা আবিদকে কিছু বলতে না দেখে ঠোঁট উল্টালো, হাত ঝাঁকিয়ে বললো,
— “কী ভাবছেন, মাস্টারমশাই? ভিজবেন তো?
”আবিদ মায়াবী মুখটাতে হাত ছুঁইয়ে নরম গালে খসখসে বৃদ্ধাঙ্গুল স্লাইড করতে করতে আদরের সুরে বললো,
— “বৃষ্টিতে ভিজলে আমার অ্যাঞ্জেলের ঠান্ডা লেগে জ্বর চলে আসবে। জেদ করো না, চলো ছাউনির নিচে।
”পরিনিতা গেল না, বরং গাল ফুলিয়ে এবার আবিদের পেট জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আসুক! ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প, সাইক্লোন, সুনামি—সব আসুক, তবুও ভিজবো, বৃষ্টি বিলাস করবো একসাথে।
”চুপ হয়ে গেল আবিদ। নিরলস চেয়ে রইলো সেই সুন্দর মুখখানার দিকে।
পরিনিতা আবারো উৎসাহিত কণ্ঠে বললো,
— “নদীর পারে যাবেন, মাস্টারমশাই?
— “নদীর পারে কেন?”
— “বৃষ্টি বিলাসের জন্য নদীর পারই সেরা।
”পরিনিতা কথা শেষ করার আগেই তীব্র সাদা আলোর ঝলকানিতে মেঘলা আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সাথে সাথেই আতকে উঠলো পরিনিতা, ঝড়ের বেগে আছড়ে পড়লো আবিদের পুরুষালী বুকে।
পরিনিতাকে ভয় পেতে দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো আবিদ, মাথায় হাত রেখে বললো,
— “আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিকট শব্দ হবে।
”তাই হলো। সেকেন্ড পার হওয়ার আগেই কানে তালা পড়ে যাওয়ার মতো বিকট শব্দ হলো, কেঁপে উঠে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পরিনিতা।
পরিনিতার এই নরম-সরম স্বভাবের জন্য মাঝে মাঝে ভীষণ ভয় হয় আবিদের।
— “তোমাকে ইস্পাতের মতো শক্ত করতে হবে, আমার জান, না হলে তুমি সেই আঘাত সহ্য করতে পারবে না, যে আঘাত তোমার নিজের বাবা তোমায় দেবে। আমি না থাকলে আমাকে কী তুমি খুব বেশি মিস করবে, অ্যাঞ্জেল? আমাকে মেরে ফেললে তুমি কী খুব বেশি কষ্ট পাবে? খুব কী কাঁদবে?
তুমি কাঁদলে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না।
আমার অ্যাঞ্জেল কাঁদবে, এটা আমার সহ্যই হবে না।”
পরিনিতা বুক থেকে মাথা তুললো। আবিদ তার নাক টেনে দিয়ে বললো,
— “আকাশের অবস্থা ভালো না, এখন নদীর পারে গেলে বাজ সোজা আমাদের মাথায় পড়বে।
”কেঁপে উঠলো পরিনিতা, একটু ভয় পেলেও নিজের জেদ বজায় রাখলো।
জেদি কণ্ঠে বললো,
— “যাবই যাবো, চলুন।
”পরির জেদের কাছে হার মানলো আবিদ।
ততক্ষণে বড় বড় ফোঁটায় ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুজনে ভিজে সপসপে হয়ে গেলো।
১০ মিনিটের হাঁটার পর তারা নদীর কাছে পৌঁছে গেলো।
পরিনিতার কথাই সত্য হলো
—বৃষ্টির আসল সৌন্দর্য নদীর পারেই পাওয়া যায়।
পরিনিতা একছুটে নদীর পারে পৌঁছে গেলো।
নদীর পানিতে পড়া বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো অপরূপ সুন্দর লাগছে।
পরিনিতা চোখ বন্ধ করে দুই হাত মেলে দিলো।
আবিদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো পরির কাছে।
পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নিজের প্রাণপাখিটার দিকে। কই, তার চোখে তো বৃষ্টিকে সুন্দর লাগছে না,
তার দৃষ্টি তো কেবল তার পরিতেই নিবদ্ধ, আশেপাশের সব কিছু তাকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ।
পরিনিতার গায়ের নীল-সাদা রঙের কলেজ ড্রেসটা ভিজে শরীরের সাথে আটোসাটো হয়ে চিপকে আছে।
দুধে-আলতা বর্ণের শরীরে গাল-গলা বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা মুক্তোদানার ন্যায় চকচক করছে।
গোলাপের পাপড়ির ন্যায় প্রস্ফুরিত ঠোঁটজোড়ায় পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে লোভনীয় দৃশ্য লাগছে।
আবিদের ভীষণ হিংসা হলো বৃষ্টিকণার ওপর, তারা কেমন অবাধে বিচরণ করছে তার পরির সর্বত্র।
আবিদের ভীষণ ইচ্ছা হলো ওই সিক্ত দেহের প্রতিটি জলবিন্দু নিজের ওষ্ঠ দ্বারা শোষণ করতে।
নিজের এসব লাগামছাড়া ভাবনায় নিজেই তাজ্জব বনে গেলো আবিদ,
ভেতরে-ভেতরে হাসফাস করে উঠলো নিজের হাল খারাপ হয়ে যাওয়া দেখে, ঢোঁক গিললো।
পরিনিতা ফিরে তাকালো আবিদের দিকে।
সাদা শার্টটা ভিজে পুরুষালী দেহের সাথে লেপ্টে আছে।
কিন্তু পরিনিতা আবার ওতো লুচু নয়, অতো গভীরভাবে চাইলো না, ছুটে গেলো আবিদের কাছে।
বায়না ধরে প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো,
— “কোলে নিন, মাস্টারমশাই।”পরিনিতার কথায় ঘুর কাটলো আবিদের, ধীরে ধীরে তার নেশা চড়ে যাচ্ছে।
সে পরিনিতার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসলো।
চোখে চোখ রেখে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
— “কোলে নিলে কী পাবো?
”পরিনিতা জবাব শুনার অপেক্ষা করলো না, আবিদের পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে গলায় ঝুলে পড়লো।
হাসলো আবিদ।
নরম তুলতুলে আদুরে দেহখানার ভার নিজের অস্তিত্বে নিল।
নিজেকে শূন্যে অনুভব করতেই গলা জড়িয়ে পুরুষালী বুকে মাথা রাখলো পরিনিতা।
দুজনেই আকাশের পানে মুখ করে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখতে লাগলো।
পরিনিতা আবিদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে ডাকলো,
— “মাস্টারমশাই।”
— “হুম্, পাখি?
”পরিনিতা নেশাগ্রস্ত চোখে তাকালো আবিদের দিকে,
কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই সিক্ত গলায় শব্দ করে তপ্ত চুমু খেলো, গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখেই।
তীব্র আসক্তি মেশানো কণ্ঠে বললো,
— “অনেক ভালোবাসি আপনাকে।
”থমকে গেলো আবিদ।
তার হৃদপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে দ্রুতগতি বিট করতে শুরু করলো।
পরিনিতা আবার বললো,
— “চিত্রলেখা ম্যাডাম আপনাকে ভালোবাসে, আপনি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেবেন আপনি শুধু আমার, শুধু আমার আর কারো নয়। আমি আপনাকে কাউকে এতটুকুও দেবো না।
”কিন্তু এসব কথা আবিদের কান অবধি পৌঁছালো না, সে তো থমকে গেছে।
পরিনিতার একটা তপ্ত চুমু তার ধৈর্যের পাহাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সংযম ছুটে গেছে।
সে গভীর দৃষ্টিতে চাইলো পরিনিতার পানে।
এতক্ষণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকা পরিনিতার কলিজা ধক করে উঠলো।
এই চোখের ভাষা প্রাণঘাতী।
যা পরিনিতার আত্মা অবধি নাড়িয়ে দেয়।
পরিনিতার দেহের সকল সিস্টেমকে নিজের আয়ত্তাধীন করে নেয়,
এই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলালে নিজেকে পাগল পাগল লাগে পরিনিতার।
তাই সে আর বেশিক্ষণ ওই চোখে তাকিয়ে থাকতে পারলো না, দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।
আবিদ এক হাতে পরিনিতাকে সামলে, অন্য হাতে পরিনিতার রক্তলাল ঠোঁটে হাত ছুঁইয়ে কেঁপে উঠলো পরিনিতা।
নেশাগ্রস্তের মতো পরিনিতার ওষ্ঠের কাছে নিজের ওষ্ঠ এগিয়ে নিতেই পায়ের নিচের কাদায় স্লিপ খেয়ে দুজনেই উলটে পড়লো নদীর পাড়ের নরম কাদা-মাটিতে।
পরিনিতা নিচে থাকায় তার উপরে পড়েছে আবিদ।যদিও ব্যথা পায়নি পরিনিতা, কিন্তু পড়ে গিয়েও আবিদের দৃষ্টির এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি।
ঝুমঝুমিয়ে পড়া বৃষ্টির মধ্যে আবিদের তীক্ষ্ণ সুচালো চাহনি দেখে ঢোঁক গিললো পরিনিতা। আবিদের তপ্ত গরম নিশ্বাস এসে আছড়ে পড়ছে পরিনিতার চোখে-মুখে।
আবিদ পরিনিতার নরম গালে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে স্লো ভয়েসে বললো,
— “তোমাকে একটু আদর করি, পরি।
জানো, তুমাকে দেখলেই আমার খালি আদর আদর পায়।
তুমি জানো তুই কতো সুন্দর?
তুমি জানো তুমার ঠোঁট দুটো কত সুন্দর?
উফফ, আমার তো কামড়ে খেয়ে ফেলতে মন চায়।
তুমি জানো গাল দুটো কত সুন্দর?
সারাদিন চুমু খেতে মন চায়।
”পরিনিতা বুঝলো তার মাস্টারমশাই আর নিজের মধ্যে নেই, কিন্তু উনার বলা কথাগুলোতে পরিনিতা শেষ হয়ে যাচ্ছে।
উনি কী আজ তাকে মেরে ফেলবেন?
আবিদ দেখতে দেখতেই পরিনিতার ওড়না খুলে ছুঁড়ে ফেললো।
সাথে সাথেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো পরিনিতা। তীব্র আসক্তির তাড়নায় চোখের পলক ফেলার আগেই পরিনিতার সিক্ত নরম গলায় পরম আবেশে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো আবিদ।
পুরুষালী পুরো ঠোঁটের স্পর্শ নিজের অস্তিত্বে পেতেই চমকে উঠলো পরিনিতা।
আবিদের গভীর আদরে পরিনিতার দেহের নার্ভগুলো অবশ অবশ লাগছে।
আবিদের আদরের তীব্রতা সইতে পারলো না পরিনিতা।শক্ত করে খামচে ধরলো আবিদের পিঠের শার্ট।
পরিনিতার এমন রিঅ্যাকশনে আরো কন্ট্রোলেস হয়ে পড়লো আবিদ।
ত্রস্ত হাতে পরিনিতার চুরিদারের শুরুর দিক থেকে দুটো বোতাম খুলে ফেললো। উন্মুক্ত ফর্সা ত্বকে লাল তিলটায় দৃষ্টি স্থির হতেই মাথা নষ্ট হয়ে গেলো আবিদের।
ঝড়ের বেগে হামলে পড়লো সেটার ওপর। পরিনিতা দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো।
এই লোকটা কেনো বোঝে না, এই লোকের গভীর স্পর্শ পরিনিতা একদম সইতে পারে না।
স্পর্শকাতর মেয়েটা পুরোটাই স্পর্শকাতর। এর ওপর আবিদের এমন লাগামহীন আদরে পরিনিতার প্রাণপাখি ছটফটিয়ে উঠছে।
সে এই বেসামাল স্পর্শের হাত থেকে বাঁচতে একটু সরতে চাইলো।
তাতে বোধ হয় ডিস্টার্ব ফিল করলো আবিদ। সাথে সাথেই পরিনিতার আঙুলের ভাঁজে আঙুল পুরে দিয়ে বালিতে চেপে ধরলো।
জড়িয়ে যাওয়া অসহায় কণ্ঠে বললো,
— “Don’t move, angel… প্লিজ, আমার কাছে থাকো। একটু আদর করতে দাও,নাহলে মরে যাবো আমি।
”আবিদের এমন আদরমাখা আবদারে কর্ণ কুহরে আসছে। পরিনিতার দেহ শিউরে উঠলো।
পরিনিতা ছটফট করতে চাইলে, ও… আবিদের হাতে মুঠোয় বন্দিনী সে এক চুলও নড়তে পারছে না সে।
আর না পারছে এমন বেসামাল স্পর্শ গায়ে মাখতে।
আবিদের চুমু খেতে খেতে নজর পড়লো লাল টকটকে কম্পনরত ঠোঁটজোড়ায়।
রক্ত লাল ঠোঁট জোড়া নিজের মুখে পুরে নিতে নিতে হাস্কি টোনে বললো,
— “I want to taste your lips—they’re like chocolate flavour.
”আবিদের এমন নেশাজড়ানো কণ্ঠে সাথে পুরুষালী ওষ্টের অস্তিত্ব অনুভব করতেই পরিনিতার দম আটকে এলো।
শরীরে ভয়ংকর সব প্রাণঘাতী অনুভূতিগুলো বেসামালভাবে ছুটে চলেছে।
আবিদ দুই সেকেন্ডের মধ্যেই পরিনিতার নরম ঠোঁটের ভাঁজ থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিলো
শান্ত চোখে চাইল পরিনিতার কম্পনরত দেহের পান।
পরিনিতাকে দেখে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত উনুন থেকে কেউ কাঠকয়লা বের করে নিয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে তার বুক উঠানামা করছে। আবিদের হঠাৎ থেমে যাওয়া সহ্য হলো না পরিনিতার।
আবিদের হাত ছাড়িয়ে, বিদ্যুতের বেগে আবিদের চুল টেনে ধরলো। মাথা নিচু করে পুরুষালী ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিলো।
প্রেয়সীর এমন উন্মাদনা দেখে মনে মনে হাসলো আবিদ।
কোমর জড়িয়ে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। পছন্দের অমৃতসুধা শুষে নিতে থাকলো প্রিয়সীর কোমল ওষ্ঠ হইতে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পরিনিতার ঠোঁটের ওপর নিজের রাজত্ব চালানোর পর হাঁপিয়ে উঠলো পরিনিতা, ছটফটিয়ে উঠলো। কিন্তু আবিদ তাকে ছাড়লো না, বরং আরো শক্ত হাতে চেপে ধরলো।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঠোঁট সরিয়ে নিলো।পরিনিতা ছাড়া পেয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই আচমকাই ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। আরো কয়েক মিনিট ডিপ কিস করে পরিনিতার ওপর থেকে সরে পাশের বালিতে শুয়ে পড়লো।
তাদের এই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে প্রকৃতিও লজ্জা পেলো।
আবিদ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ওপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে।
নিজের নার্ভগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
এই পরি তাকে না জানি কবে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
যদিও সে তো পাগলই, তার প্রাণ যে এই মেয়েটা।
এই মেয়েটাকে একটুখানি ভালোবাসতে সে তার জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েছে।
মৃত্যুর জন্যও সে প্রস্তুত, তবে এই মেয়ের থেকে দূরে সে কোনো কিছুর বিনিময়েই যাবে না।
পরিনিতা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আসক্তিময় পুরুষটার দিকে তাকালো। লোকটা সরে গেছে দেখে পরিনিতার অভিমান হলো। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সে নিঃশব্দে আবিদের ওপর শুয়ে, বুকের দিক থেকে তিনটা বোতাম খুলে উন্মুক্ত বুকে মাথা রাখলো।
কোমল কণ্ঠে বললো,
— “আমার থেকে কোনোদিনও আলাদা হয়ে যাবেন না তো, মাস্টারমশাই?
বিশ্বাস করুন, পরি আপনাকে ছাড়া একটা দিনও বাঁচবে না।
”প্রশস্ত হাসলো আবিদ। পরিকে নিজের বক্ষে অনুভব করে অপার শান্তিতে চোখ বন্ধ করে নিলো। শক্ত করে পরির পিঠ জড়িয়ে ধরে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
— “এই আবিদ রাফাত নিজের শেষ নিঃশ্বাসটা শুধুই তার পরির নামে লিখে দিয়েছে।
তুমি আমার মৃত্যু চেয়ো,
পরি—তবুও বিচ্ছেদ নয়।
আমি সেটা কোনোদিনও তোমাকে দিতে পারবো না।
জীবনের যতই জটিল পরিস্থিতি আসুক,
আমার ওপর একটু বিশ্বাস রেখ—
আমার হাত ছেড়ে দিও না।
তুমি হারালে আমি সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যাবো,
আর যদিও বা কখনো একান্তই আমাকে ছাড়তে হয়,
তবে আমাকে তুমার হাতে শেষ করে দিও, পরি।
কারণ তুমি ছাড়া তোমার মাস্টারমশাই একদিন তো দূরের কথা,
একটা সেকেন্ডও বাঁচবে না।
I love you more, my angel… you’re only mine…
”পরিনিতার বুকটা ভালোলাগায়, ভালোবাসায় ভরে গেলো। সে উন্মুক্ত বুকে গভীর চুমু খেয়ে বললো,
— “পরি আপনাকে কতটা ভালোবাসে, সেটা বুঝি মুখে বলতে হবে, মাস্টারমশাই?
”ব্যথাতুর হাসলো আবিদ। মাথায় চুমু খেয়ে মনে মনে বললো,
— “তোমার সাথে শত বছর বাঁচতে ইচ্ছে হয়, পরি আমার… পরি।
সন্ধ্যা ৭টা।
পরিণীতা আর প্রিয়তা ৩ তলার মাঝারি ছাদের কাউচে বসে গল্প করছে, হাসাহাসি করছে। আশেপাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, বেশ ভালই লাগছে।
প্রিয়তা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— “বেশি হেসো না, আপু! জানো তো, যত হাসি, ততো কান্না। বড়োআব্বু সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তুমি যদি HSC-তে ভালো মার্কস না পাও বা ফেল করো, তুমি তো শেষ! তোমাকে নাকি মুকলেশ চাচার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন। যদি মুকলেশ চাচাকে বিয়ে করতে না চাও তবে পড়ায় মন দাও, আপু।”
পরিণীতা হা করে শ্বাস ফেলল, গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,
— “উফফ! প্রিয় বোন আমার, এই সব অশালীন কথা-বার্তা বাদ দে, বোন। ভালো কিছু বল। এই পড়ে পড়ে তোর মাথাটা গেছে, এরা তোর ব্রেইন চিবিয়ে খেয়েছে…”
“আমাকে দেখে খাই-দাই, চিল করি, তুইও কর! এমনি তেই যতই পড়ো, সেই তো বিয়ে করে হাঁড়ির নিচের কালি মাজতে হবে! তাহলে যে সময়টা জীবনে বাঁচার জন্য পেয়েছি, তা ধরাধরি করাকরি নামক অশালীন কাজে নষ্ট করব কেন? এইসব পড়াশোনা, রান্না—কোন কাজে লাগবে, শুনি?”
পরিণীতার লজিক শুনে লজিক মারা গেল।
প্রিয়তা হার মেনে নিয়ে বললো,
— “মুকলেশকে কাল থেকে দুলাভাই ডাকা শুরু করে দেব।”
পরিণীতা নাক সিঁটকে বললো,
— “ছিঃ প্রিয়! তোর রুচি এত খারাপ?”
ভ্রু কুঁচকালো প্রিয়তা।
পরিণীতা আবার ভাব নিয়ে বললো,
— “তোর দুলাভাই অনেক শিক্ষিত হবে, লম্বা হবে, সুদর্শন হবে।”
সেই জায়গায় মুকলেশ— “ওয়াক!”
প্রিয়তা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ ঝড়ের বেগে ছুটে এলো তন্ময়।
ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— “আপু! আপু!”
প্রিয়তা আর পরিণীতা একত্রে তাকালো তন্ময়ের দিকে।
প্রিয়তা খেঁক করে উঠে বললো,
— “মোটু, তোর কি পেট খারাপ হয়েছে? এভাবে মুচড়া-মোচড়ি করছিস কেন?”
এবার পরিণীতা প্রিয়তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
— “নাকি তোর হবু বউকে অন্য কেউ বিয়ে করে নিয়ে গেছে? থাক ভাই, কাঁদিস না। বড়ো হ, তার পর ‘কলা-বেগুনের’ মতো একটা বউ নিয়ে আসবো। তারপর ভাই-বোন মিলে একসাথে গাইবো— সাদা সাদা, কালা কালা…!”
তন্ময় বোনদের উপর বিরক্ত হল। এই লেজছাড়া বানরগুলা কিভাবে তার বোন হলো, সেটাই বুঝে পায় না তন্ময়।
তন্ময় নিশ্চিত, এগুলো তার গুড়ো দুধ চুরি করে খাওয়ার পাপ!
প্রিয়তা আবার বললো,
— “চকলেট চাইতে আসছিস? দিবো না! যা!”
তন্ময় এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
— “চাই না তোমাদের চকলেট। তোমাদের একটা ভালো খবর দিতে এসেছিলাম। শুনতে যেহেতু চাও না, চললাম।”
বলে দৌড় দিতে নিলে পরিণীতা পেট ধরে আটকে ফেললো। ধমকে বললো,
— “বেয়াদব! বড় আপুদের সাথে বেয়াদবি! সেফটি পিন দিয়ে তোর গ্যাস বেলুন ফুটো করে দিবো।”
তন্ময় আপুদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
প্রিয়তা এবার সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— “আচ্ছা, বল! কী বলতে চাস?”
পরিণীতা ও ভাইয়ের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।
তন্ময় এবার একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দুই বোনের দিকে তাকিয়ে প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো,
— “জানো আপু, ছোট দাদান একদম তোমাদের মতো সুন্দর, একদম পরির মতো একটা টুকটুকে বউ নিয়ে এসেছেন! একখুনি নিচে দেখে এলাম।”
পরিণীতা আর প্রিয়তার মাথায় মনে হয় বাজ পড়লো!
দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে চিৎকার করে বললো,
— “কীইইইই???”
প্রিয়তা তন্ময়ের কান টেনে ধরে বললো,
— “বড়ো আপুদের গল্প বানিয়ে বলিস?”
তন্ময় চিৎকার দিয়ে নিজের কান ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
— “যদি বিশ্বাস না হয়, তো নিজের চোখেই দেখে আসো!”
প্রিয়তা-পরিণীতা ঢোক গিলে তন্ময়কে ছেড়ে তাড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
অতঃপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছুট দিল নিচে।
তন্ময় বোনদের এভাবে যেতে দেখে ব্যঙ্গ করে বললো,
— “দুটোই বাদর!”
শিকদার বাড়ির ড্রয়িংরুমে বিশাল জটলা।
অনুস্রী বেগম, তনুস্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থি বেগম, প্রেরণা, থিরা, থোরি, রাজ, প্রীতম—সবাই হা করে তাকিয়ে আছে লাল শাড়ি পরিহিতা, দুধে-আলতা বরণের ১৪-১৫ বছর বয়সী মেয়েটার দিকে।
পাশেই প্রেম বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, কেউ তাকে জোর করে তেতো খাইয়ে দিয়েছে।
অরণ্য নতুন বউকে দেখে ফিদা হয়ে গেল।
সমুদ্রের পেটে গুঁতো মেরে সুর তুলে বলল,
— “একি নারী, নাকি পরী? বিধিই নিজেই করবে ভুল?
আমি তো হায়, একটি মানুষ ভেবে পাই না কোন কুল!”
সমুদ্র দাঁত খিটমিট করে তাকালো অরণ্যের দিকে। খেঁক করে উঠে বলল,
— “চোখ সংযত কর, বেয়াদব! উনি আমাদের ছোটো ভাবি, মাতৃস্থানীয়া!”
‘ছোটো ভাবি’ কথাটা কানে আসতেই অরণ্যের মুখটা এই টুকুনি করে ফেলল।
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে রাগে গজগজ করে বলল,
— “ছোড়দা আমাদের সাথে কত বড় মীরজাফরি টাই না করল!
শুধু ছোড়দা কেন, আমাদের বড় ভাইরাই আমার সাথে যেভাবে মীরজাফরি করছে, মীরজাফরও তার ভাইয়ের সাথে এভাবে মীরজাফরি করেনি!
পৃথিবীর সব সুন্দরী সুন্দরী মেয়েগুলো আমার ভাইয়েরা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিচ্ছে? জালিম সবকয়টা!
আমার জন্য একটা ও ছাড়ছে না?
ছোড়দাকে ভালো ভাবেছিলাম, অথচ মেজদা-সেজদাকে টপকে ছোড়দাই সবার আগে ছক্কা হাঁকিয়ে দিলো!”
অরণ্যের ফালতু প্যাচাল শুনে বিরক্ত হলো সমুদ্র।
অনুস্রী বেগম গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছেন ছোটো ছেলে ও তার সদ্য নববিবাহিতা স্ত্রীর দিকে।
মেয়েটার চোখে-মুখে তীব্র ভয়ের ছাপ।
মেয়েটা আরষ্ট হয়ে প্রেমের পেছনে লুকিয়ে আছে।
অনুস্রী বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “কি নাম তোমার, মেয়ে?”
মেয়েটা ভীতু হরিণী চোখে একবার প্রেমের দিকে তাকালো।
অতঃপর সামনের সবার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালো।
এত মানুষ আর সবার অবাক দৃষ্টি নিজের উপর দেখে বিব্রত হল মেয়েটা।
পরিণীতা আর প্রিয়তা ও দৌড়ে নিচে নেমে এলো। ছুটে সদর দরজার কাছে যেতে তারা ও থমকে গেল। চোখ গুলগুল করে চেয়ে রইল প্রেমের পাশের মেয়েটার দিকে।
অনুস্রী বেগম বুঝলেন, মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। তাই তিনি এবার একটু নরম হলেন। কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “কি নাম তোমার, মা?”
মেয়েটা টলমলে চোখে তাকালো অনুস্রী বেগমের দিকে। কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল,
— “ঊষা।”
রিনরিনে চিকন মিষ্টি গলার স্বর।
সবাই আরেকবার মুগ্ধ হলো।
তনুস্রী বেগম বললেন,
— “দেখে তো তোমাকে আমাদের প্রিয়র বয়সি মনে হচ্ছে। বয়স কত তোমার, মা?”
ঊষা আবার মাথা নিচু করে নিলো।
নিচু কণ্ঠে জবাব দিলো,
— “১৫।”
সবাই আরও অবাক হলো।
মেয়েটা প্রিয়তার চেয়েও ছোট!
অনুস্রী বেগম নতুন বউকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসালেন, কিন্তু প্রেম দাঁড়ালো না।
ধপাধপ পা ফেলে ওপরের দিকে চলে গেল।
পরিণীতা আর প্রিয়তা পা টিপে টিপে প্রেরণার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আমি ঠিক দেখছি তো, আপু? কীভাবে কী হলো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
প্রেরণা ঊষার দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
— “সেই তো! আমি ও কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু জানি, এই অতি সুন্দরী মেয়েটা আমাদের ভাবি।”
— “কিন্তু বিয়েটা কীভাবে হলো, আপু? আমার ভাইয়ের বিয়ে হলো আর আমিই জানলাম না!”
— “ছোড়দা বেশি কিছু বলে নাই। শুধু কয়েক লাইনে বলেছে, ছোট ভাবি ঊষা ছোড়দার স্কুলের কোনো এক মাস্টার মশায়ের নাতনি। ঊষার নাকি বাবা-মা কেউ নেই। তাই ঊষার চাচারা মিলে তাকে জোর করে টাকার লোভে কোনো এক বৃদ্ধ লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল।”
— “তারপর?”
— “তারপর ছোড়দা প্রায়ই ওই মাস্টার মশায়ের খোঁজখবর নিত। আজ নিজের নাতনির জীবন বাঁচাতে নিরুপায় হয়ে ছোড়দার মাস্টার মশাই ছোড়দাকে ফোন করে ইমার্জেন্সিতে যেতে বলেছিল। ছোড়দা কিছু না বুঝেই অফিস থেকে ছুটে মধুপুর গ্রামে যায়। সেখানে গিয়ে এমন অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যায়। পুলিশে ফোন করবে—গ্রামের লোক চড়াও হয়ে যায়। তারা বিয়ে ভাঙতে দিতে চায় না। গ্রামের লোকের দাবি, একবার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলে আর তাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তাই হয় ঊষার বিয়ে ওই বৃদ্ধ লোকটার সাথেই হবে, না হয় ছোড়দাকে বিয়ে করতে হবে। তাই শেষমেশ ছোড়দার মাস্টার মশাই তার পায়ে ধরে মিনতি করতে শুরু করেন—তার নাতনির জীবন বাঁচানোর জন্য। তাই ছোড়দাও আর না করতে পারেনি। একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছে…”
পরিণীতা আর প্রিয়তা ঊষার দিকে তাকিয়ে হা করে এসব কথা গিলছিল।
অনুস্রী বেগমের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, উনার ছেলের বউকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এমনকি ঊষার নম্রতা, ভদ্রতার উপরও তিনি ভীষণ মুগ্ধ হয়েছেন। অনুস্রী বেগম ঊষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “তোমার বাবা-মা নেই, তাই না, আম্মু?”
ঊষা অশ্রুসিক্ত নয়নে অনুস্রী বেগমের দিকে তাকিয়ে উপরে-নিচে মাথা ঝাঁকালো।
অনুস্রী বেগম ওকে হেসে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “সম্পর্কে শাশুড়ি হলেও, কিন্তু আমি তোমার শাশুড়ি নই, আমি তোমার মা। প্রেম যেমন আমায় আম্মু ডাকে, তুমিও তাই ডাকবে। এই যে, এদের দেখছো—এরা সবাই আমার ছেলে-মেয়ে। আজ থেকে তুমিও আমার মেয়ে, এদের মতই একজন। একদম সংকোচ করবে না তুমি। তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী। এটা আজ থেকে তোমার পরিবার, তোমার সংসার।”
ঊষা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো সামনে বসা সুন্দরী মহিলার দিকে।
উনি তাঁর মা? তাঁকে ‘মা’ ডাকবে?
এতগুলো মানুষ—এরা সব ওর নিজের আপনজন?
এটা ওর পরিবার?
এটা ভাবতেই আনন্দে ঊষার চোখে পানি চলে এলো।
সে একঘর ভর্তি লোকের সামনে অনুস্রী বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
অনুস্রী বেগমের মাতৃহৃদয় বুঝতে পারলো।
তিনি মেয়েটার মাথায় আবারও হাত বুলিয়ে দিলেন।
এবার তনুস্রী বেগম, অনন্যা বেগম আর অর্থি বেগম ঊষার পাশে গিয়ে বসলেন।
তারা ঊষার মাথায় হাত রেখে বললেন,
— “এই যে মেয়ে, শুধু বড়ো আপাই নয়, আমরা ও তোমার মা বুঝলে? আমাদেরকে ও ‘মেজো মা’, ‘ছোটো মা’ বলে ডাকবে।”
ঊষা সবার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো।
একদিনে তার জীবন এভাবে বদলে যাবে, সেটা সে কখনো ভাবতে পারেনি। এতিম সে কখনোই পরিবারের আদর পায়নি।
যা পেয়েছে, সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
একমাত্র এতিমরাই বুঝে—বাবা-মা ছাড়া বড় হওয়া কত কষ্টের।
যারা কখনও মা-বাবার স্নেহ পায়নি, তারা জানে এই পৃথিবীতে ভালোবাসা কত মূল্যবান!
এবার প্রেরণা, পরিণীতা, প্রিয়তা, থিরা, থরি আর তন্ময় দৌড়ে এসে ঊষাকে দুই পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো।
একসাথে ডেকে উঠলো,
— “ছোটো ভাবি!”
‘ছোটো ভাবি’ ডাকটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে ফেললো ঊষা।
অনুস্রী বেগম পরিণীতা আর প্রিয়তাকে আদেশ দিলেন,
— “ছোটো ভাবিকে তোমাদের ছোড়দার ঘরে নিয়ে যাও।”
ওরা ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হলো।
ঊষাকে নিয়ে ছুটে চলে গেলো ওপরে।
তনুস্রী বেগম বললেন,
— “মেয়েটা কি মিষ্টি, তাই না আপা? একেবারে আমাদের পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গেছে।”
অনন্যা বেগম বললেন,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৮
— “আমাদের প্রেমের সঙ্গে কত সুন্দর মানিয়ে গেছে দেখেছো?
আল্লাহ যা করেন, ভালো জন্যই করেন।
আল্লাহর বানানো জোড়া সবসময় সবার সেরা।”
অনুস্রী বেগমও হাসলেন।
কিন্তু তাঁর মনে অজানা একটা ভয় বাসা বেঁধেছে।
প্রেমের এই বিয়ে নিয়ে সাদমান শিকদার যে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন—সেটাই ভেবেই ঘাম ছুটছে ওনার।