ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রহেলিকা চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার সামনের দুনিয়াটা ঝাপসা হতে শুরু করল। সে প্রণয়ের দিকে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আহত কণ্ঠে বিবৃত করল,
“সব মিথ্যা হলেও আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো না প্রণয়… আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি…”
‘প্রণয়’ বলতে বলতেই নিস্তেজ হয়ে গেল প্রহেলিকা।
তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল প্রণয়, ঘাড় থেকে সিরিঞ্জটা টেনে খুলে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে মারল প্রণয়।
ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ তির তির করে কাঁপছে। কপালের শিরাগুলো ধপ ধপ করছে।
শুদ্ধ দরজার কাছে পা ভাজ করে দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখার ভঙ্গিতে সকল দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আয়েশি ভঙ্গিতে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। ঠোঁটের কোনে লেগে তার চির পরিচিত সেই বাঁকা হাসি।
সে প্রণয়কে ধীরে ধীরে আরো রেগে যেতে দেখে বাঁকা হেসে এগিয়ে এলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“কুল ডাউন ইয়াং ম্যান। এত হাইপার হওয়া হার্টের জন্য মোটেও ভালো না। আর আমি একজন রেসপন্সিবল হার্টের ডাক্তার হয়ে এসব অনাচার মেনে নিতে পারি না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রণয় ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো শুদ্ধের দিকে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো।
শুদ্ধ ওর অবস্থা দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসল। কফির মগে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
“বহু বছরের পুষে রাখা রাগ কি আর দুটো থাপ্পরে যাবে? আরো দুটো লাগিয়ে দিতি। কিন্তু আফসোস, তুই চাইলে ওকে এর থেকে বেশি আর কিছু করতে পারবি না,
‘Cause she is very dangerous’.
আমি যতই বলি, ওর মাথা গুঁ ভর্ত্তি।
কিন্তু তুই আর আমি—আমরা দুজনেই জানি, ও আসলে কী এবং কী কী করতে পারে।
So, be careful। ওর একটা ইশারায় তোর, আমার, সবার জীবন জাস্ট চোখের নিমিষে শেষ হয়ে যাবে। আর আমাদের বসে বসে সেটা দেখা ছাড়া কোন গতি থাকবে না।”
প্রণয় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধর হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে তাতে লম্বা চুমুক দিল। হাসলো শুদ্ধ। দুজন প্রহেলিকাকে অভাবেই ফেলে রেখে চলে গেলো।
প্রণয় যেতে যেতে বলল,
“তোর এতো উত্তেজনা কিসের? ডেস্ট্রয় করলে আমার লাইফ, ডেস্ট্রয় করে দিয়েছে! তোর তো আর কিছু করেনি। বরং এতে তো তোর সুবিধাই হয়েছে।”
শুদ্ধ আবারো প্রণয়ের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে তাতে চুমুক দিল। রহস্যময় কণ্ঠে বলল,
“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। ও যা করেছে, তাতে আমার লাভ ছাড়া বিশেষ কোন লস নেই,
আফটার অল, she is my crime partner.
কিন্তু ভয় যে একটা জায়গাতেই—
আমার প্রাণ পাখিটা যে ওর কাছেই বাধা।
ওকে বোকা বানিয়ে রাখতে পেরেছি বলেই এখনো আমার প্রাণ পাখি অক্ষত রেখেছে। নাহলে ও যা হিংসেপরায়ণ, তাতে তোকে পেতে শেষ করে দিতো আমার সুইটহার্টকে।
তখন তুই ও মরতি, আমি ও মরতাম।
আর এসব তোকে বলছিই বা কেনো?
“তবে ভাই তোর ধৈর্য আছে মানতেই হবে, তোর যা ধৈর্য, তার এক পারসেন্টও আমার নাই। কিভাবে এমন একটা জিনিসকে হ্যান্ডেল করিস ভাই?
এই যে তুই দিন রাত ওর সাথে হ্যাপি কাপল-এর অভিনয় করিস, তোর হাফ ধরে না বিরক্ত লাগে না?”
প্রণয় ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে তমসাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকালো। নিকষ কালো আঁধারের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার জানকে বাঁচানোর জন্য এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই। এটা আমার জীবন হয়ে গেছে।
বাঁচলে আমাকে এভাবেই বাঁচতে হবে। এর থেকে আমার মুক্তি নেই। এই আবরার শিকদার প্রণয় সম্পূর্ণ ফেঁসে গেছে।
ও যদি কোনভাবে একটু ও কিছু আচ করতে পারে, তো এর পর ডিরেক্টলি ব্ল্যাকমেইল করা স্টার্ট করে দেবে।
আর আমায় ও তখন যা যা চাইবে তাই তাই করতে হবে। তখন আর এইসব চলচাতুরি কোন কাজে আসবে না।”
প্রণয়ের কথায় হঠাৎই শুদ্ধের ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি খেলে গেল। সে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ও তো তোর টাকা পয়সা কিচ্ছু চায় না। শুধু তোর দেহ চায়!
তোর কি কপাল ভাই!”
প্রণয় তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালো।
শুদ্ধ আবারো দুষ্টু হেসে বলল,
“বন্ধ ঘরে সাবধানে থাকিস ভাই।
তুই ওই ঘরে থাকিস, আর এই ঘরে আমার ভয়ে কলিজা লাফায়।
খালি মনে হয়, কখন জানি তোর ইজ্জত লুটে নিল!
কখন জানি তোকে কে খেয়ে ছেড়ে দিল!
যতই হোক, বিয়েটা তো আর সত্যি নয়।
এখনই তোর ইজ্জত লুটে নিলে পরে তোকে কে বিয়ে করবে?”
শুদ্ধের এমন সিরিয়াস টাইমে রসিকতায় প্রচন্ড হতাশ হলো প্রণয়।
শার্টের হাতা গুটিয়ে ধপাধপ শুদ্ধের পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ভার্জিনিটি নিয়ে তোকে এত চিন্তা করতে হবে না।”
পিঠ ধরে কোঁকিয়ে উঠলো শুদ্ধ।
এর পর কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব রইলো।
শুদ্ধ আকাশ পানে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার এখনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না, তুই এত সহজে আমার সুইটহার্টকে আমার জন্য ছেড়ে দিলি।”
‘প্রিয়তা’ কে ছেড়ে দেওয়ার কথাটা কানে যেতেই প্রণয়ের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো।
সে শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“যে আমার রক্তের ফোঁটা ফোঁটায় প্রবাহিত হয়, তাকে ছেড়ে দিবো?
তাকে ছাড়লে প্রণয় শিকদার বাঁচবে না।
তাকে আমি ছাড়েনি, শুধু তার সুরক্ষার জন্য নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।
আর তোকে তার ভালো-মন্দের দায়িত্ব দিয়েছি। কারণ আমি ব্যর্থ। আমি অক্ষম তাকে রক্ষা করতে।
তাই তাকে আমার বাহু থেকে মুক্ত করে দিয়েছি।
ওর বিষয়ে আমি একটা ছোট রিক্স ও নিতে পারবো না।
তাই আমার জানটার কখনো অমর্যাদা করিস না।
ও এক চুল পরিমাণ আঘাত পেলেও আমার হৃদয় তা সহ্য করতে পারবে না।”
ফিচেল হাসল শুদ্ধ।
প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ করছিস?
আমি যদি না থাকতাম, প্রহেলিকা কি তোকে ছেড়ে দিত?
তুই কি তখন পারতি প্রিয়তাকে আপন করতে?
আমি তোর প্লাস পয়েন্ট!
তুই আমাকে বিশ্বাস করিস কারণ তুই জানিস—
তাকে তুই যতটা চাস, তুই যতটা ভালোবাসিস, ঠিক ততটাই আমিও চাই, আমিও ভালবাসি।
ও যেমন তোর জীবন, ও তেমন আমার জীবন।
আর আজ আমি যদি নাও থাকতাম,
তবু ও তোর জীবনে এই পরিস্থিতি আসতো।
তখন তুই কী করতি?
কাকে ট্রাস্ট করতি?”
থেমে গেল প্রণয়।
শুদ্ধ আবার বলল,
“তবে সবশেষ একটাই কথা—
দিলে পুরোটাই দিবি।
অধিকার রেখে দিবি না।
ভালো করে ভেবে নিবি।
তাকে একবার আমার নামে লিখিয়ে নিলে, এই জীবনে তো দূর—আখেরাতেও তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে দেব না।
She is only mine।”
প্রণয় শান্ত চোখে দেখল শুদ্ধর চোখের দীপ্তিময় আগুন।
শুদ্ধের এই কথাগুলোতে তো তার মন সন্তুষ্ট হওয়ার কথা—
তবু বুকটা এত পুড়ছে কেন?
সে ব্যথাতুর হেসে বলল,
“ আমি তার মালিক নই।
তাই তোকে দেওয়ারও কেউ নই।
তকে নিজেই অর্জন করে নিতে হবে।
আমি তাকে স্বাধীনভাবে, মুক্ত চিন্তাধারায় মানুষ করেছি।
আমি কখনোই তার উপর জোর-জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দেইনি, দিতে পারবোও না।
এমনকি তোকে বিয়ে করার জন্য জোর ও করতে পারবো না।”
শুদ্ধ সামনের দিকে তাকিয়েই বলল,
“জানি আমি। তুই এসব করতে পারবি না। তোকে করতে ও হবে না।
তুই just তোর সব অধিকার তুলে নে আমার সুইটহার্টের উপর থেকে।
তারপর বাকিটা আমি বুঝে নেব।”
প্রণয় শান্ত চোখে শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখলো—
তার চোখে মুখে দুষ্প্রাপ্য সেই ভালোবাসা পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
তার বলা এক একটা কথা প্রণয়ের হৃদপিণ্ডের ঠিক কোথায় লাগছে, সেটা যদি শুদ্ধ একবার দেখতে পেত,
তবে হয়তো আর কখনোই প্রিয়তা কে পেতে চাইতো না।
যদিও শুদ্ধ বুঝে না এমনটা নয়—সে সবকিছু বুঝে,
তবু হয় না—
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ বড্ড স্বার্থপর।
শুদ্ধর, ও হয়েছে তাই।
শুদ্ধ আবার বলল,
“কলেজের কী খবর?”
প্রণয় কফির কাপ রেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করলো।
লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেটটা কালচে লাল ঠোঁটে চেপে ধরল।
দীর্ঘনিঃশ্বাসে ধোঁয়াগুলো ফুসফুসে টেনে নিতে নিতে বলল,
“কনফার্ম।”
“আর ভিসা, পাসপোর্ট…”
“২ মাস টাইম লাগবে।”
শুদ্ধ ও একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিজের গোলাপি ঠোঁটে চেপে ধরল।
সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে মিশিয়ে বলল,
“ওকে কানাডা পাঠিয়ে দিচ্ছিস, ভালো কথা।
কিন্তু ও যতদিন কানাডা থাকবে, আমার কানাডা যাওয়া বারণ কেন?
আমার তো দুদিন পরপরই মেডিকেলের কাজে কানাডা যেতে হয়!”
প্রণয় নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে বললো,
“বললাম না, আমি আমার পুতুলের ওপর কিছু চাপাতে চাই না।
ওর সব কিছু ভুলে নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন।
আর তুই কানাডা গেলে, আমার অনুপস্থিতিতে কি কি করতে পারিস, তা আমার খুব ভালো মতো জানা আছে।
আমি চাই না, আমার পুতুলটার উপর কোন চাপ দিতে।
ও এখন কোনভাবেই তোকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবে না।
আর ও তোকে অ্যাকসেপ্ট না করলে, আমি ও কিছুই করতে পারবো না।
তাই এটা আমাদের প্রথম শর্ত, যা সবার উপরে—
ও যতদিন কানাডায় থাকবে,
তুই কানাডায় পা রাখবি না।”
হাসলো শুদ্ধ। আফসোস করে বলল,
“এসবের চক্করে আমি বুড়ো না হয়ে যাই!
বয়স তো প্রায় ত্রিশের কাছাকাছি!
তবে বুড়ো হলেও আমার সুইটহার্টকেই লাগবে।”
মলিন হাসলো প্রণয়। মনে মনে বললো,
“জান, তুই কি কখনো তোর প্রণয় ভাইকে ক্ষমা করবি?
আমি কি তোর উপর জুলুম করছি?
কিন্তু আমার যে আর কোনো রাস্তা নেই জান।
তোর প্রণয় ভাই যে বড্ড অসহায়।
সে চাইলে নিজের ইচ্ছায় মরতেও পারবে না।
আর বেঁচে থাকতে আমার জানকে এভাবে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখতে পারবো না।
তোকে ভালো রাখার জন্য,
তোর প্রণয় ভাই সব সহ্য করে নেবে।
শুধু তুই ভালো নেই—এটা সহ্য করতে পারবে না।
জানি, তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস।
আমার থেকে দূরে গেলে হয়তো আমার জন্য খুব কাঁদবি।
কাঁদ, সমস্যা নেই, দূরে থেকেই কাঁদ।
আমি তো আর দেখবো না—আমার কথা ওর নেই।
কিন্তু তুই যদি আমার সামনে থেকে প্রতিদিন কাঁদিস,
আমি স্থির থাকতে পারবো না রে।
তখন সবার আগে তুই শেষ হয়ে যাবি।
তাই আমাকে ক্ষমা করে দিস জান।
দূরে থাক বা কাছে থাক, সব সময় মনে রাখবি—
তুই তোর প্রণয় ভাইয়ের প্রাণ ভোমরা।
কাছে থাক বা দূরে, তোর ভালোবাসা,
প্রণয় ভাই তার মৃত্যু অব্দি শুধু তোর জন্যই রাখবে।”
শুদ্ধ প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“আমি জানি, তোর কোথায় কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু আমার কিছু করার নেই ভাই।
আমি এই জায়গায় বড্ড স্বার্থপর—আমার যে, তাকে চাই চাই।”
প্রিয়তা এসিতে ফুল পাওয়ার দিয়ে খাটের মাঝখানটায় এলোমেলো ভঙ্গিতে চিটপটাং হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার এক হাত খাটের বাইরে, এক পা খাটের বাইরে। দীঘল চুলের অর্ধেকটা মুখের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর বাকি অর্ধেকটা মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। ফোনটা ও পিঠের নিচে পড়ে আছে।
ঘুমানোর সময় তার হুশজ্ঞান বলে কিচ্ছু থাকে না। ঘুমানোর স্টাইলটা অরণ্য আর সমুদ্রের থেকেও বিচ্ছিরি—তবু ও সুন্দর লাগছে।
তার সামনের কাউছে কেউ পায়ের উপর পা তুলে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তার মনোযোগ অন্য কোনোদিকে নেই, দৃষ্টি স্থির—সে কেবল তার চোখে তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত। তার দৃষ্টির আকুলতা বলে দিচ্ছে, এই নারীটা তার কত আপন। এই নারীর সঙ্গে দূরত্ব মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই নারীকে হারালে সে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে।
তবু ও এই নিষ্ঠুর নিয়তি তার থেকে এই নারীকে কেড়ে নেবে।
এই নারীকে তাকে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে হবে।
ব্যক্তি যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন, সময় আর পরিস্থিতি কখনোই তার কথায় চলে না। সময়ের কাছে একজন নিষ্ঠুর মানুষও পরাজিত হয়, পরিস্থিতির নিষ্ঠুরতার কাছে তার সকল নিষ্ঠুরতাই ফিকে পড়ে যায়। যার অন্যের কলিজা ছিড়ে নিতে মায়া হয় না, সময় তার থেকেও তার কলিজাটাও ছিঁড়ে নিবে।
সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। যত্নসহকারে তাকে সোজা করে শুইয়ে দিল। পিঠের নিচ থেকে ফোনটা বের করে পাশে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলো। পাশে বসে আলতো হাতে মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল। নরম চোখে চেয়ে রইলো অতিপ্রিয় নিষ্পাপ মুখখানার পানে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কপালে সময় নিয়ে উষ্ণ পরশ এঁকে দিল।
সাথে সাথেই প্রিয়তা খপ করে তার টি-শার্ট ধরে ফেললো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“আপনি এসেছেন, প্রণয় ভাই…”
বলে ঘুমের ঘোরেই মাথাটা বালিশ থেকে তুলে প্রণয়ের কোলে দিল। দুই হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে আবার গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল।
নিজের সাথে জড়িয়ে থাকা ছোট্ট দেহটার দিকে তাকিয়ে, কিঞ্চিৎ হেসে ফেললো প্রণয়। মেঝেতে পড়ে থাকা চুলগুলো তুলে বেণি করতে করতে বিড়বিড় করে বললো,
“এভাবে চললে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন তুই ও আমার মতো হয়ে যাবি। তোর এই আশক্তি আমি কিভাবে কমাবো বল, জান?
তুই অচেতন অবস্থাতেও আমার উপস্থিতি অনুভব করিস। এত ভালবাসিস কেন? এত ভালোবাসা নিয়ে কিভাবে বাঁচবি তুই? আমার ভীষণ ভয় করছে জান—তুই তো আমাকে ছাড়া কিছু বুঝিস না। তাহলে কোন বর্ষায় আমি তোকে দূরদেশে পাঠাবো? কিভাবে তোকে সেফ করবো আমি? কিভাবে তোকে একটা সুস্থ জীবন দেবো?”
একদিন তোকে চোখে চোখে রাখতে পারিনি বলে আমাদের পুরো জীবনটাই পাল্টে গেল।
চুলের বেনিটা সযত্নে প্রিয়তার বা পাশের কাঁধে রেখে আবার গভীর অনুভূতিতে ললাটে গভীর ভালোবাসার ছোঁয়া দিলো।
Coco প্রিয়তার পাশে বসে গোল গোল চোখে প্রণয়ের কার্যক্রম দেখছিলো। প্রণয় তাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“এভাবে চোখ বড় বড় করে কি দেখছিস তুই? তোর মায়ের বাচ্চা তুই,আর তোর মা আমার বাচ্চা।”
Coco কি বুঝল কে জানে!
প্রণয় আবারো Coco-কে প্রিয়তার পাশে শুইয়ে দিল।
এসির পাওয়ার কিছুটা কমিয়ে দিয়ে প্রিয়তাকে আলতো হাতে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো। গায়ে হালকা চাদর টেনে দিয়ে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “Good night, my princess …”
বলে ঘরের সব লাইট অফ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাত ১১টা ৫০।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শিকদার বাড়ির প্রায় সবাই নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করেছেন।
ঊষা পরিচারিকাদের সঙ্গে মিলে রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়তি সব খাবার-দাবার ফ্রিজে তুলে রেখে, যত বাসন-কোসন ছিল সব যথাযথভাবে গুছিয়ে রেখে ঘরে এল।
তার ভেতরটা ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।
যদিও এই বাড়িতে শীত-গরম তেমন একটা অনুভব করা যায় না, তবু ঊষার ভেতরটা অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করছে।
পিঠ, কাঁধ, গলা, পেট—সব অসহ্যরকম চুলকাচ্ছে।
সে দরজা ভেজিয়ে প্রেমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসল।
প্রেম ঘরে নেই!
ঊষা আয়নার সামনে বসে নিজের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকালো।
তার নিজের কাছেই নিজেকে আজকাল অপরিচিত লাগে।
বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবনের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
এসব ভোগবিলাসিতা, আভিজাত্য, চাকচিক্যের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয় সে।
এত সম্মান, ভালোবাসা, আদর-যত্নের সাথেও পরিচিত নয় সে।
জন্মের পর থেকে প্রয়োজনটুকুই সে ঠিকমতো পায়নি। আর কারো থেকে আদর-ভালোবাসা পাওয়া তো দূর, কটুকবাক্য ছাড়া কিছুই জোটেনি কপালে।
অথচ হঠাৎ করেই একটা মানুষের আগমনে তার গোটা জীবনটা রূপকথার গল্পের মতো সম্পূর্ণ বদলে গেল।
সামান্য একটু আদর, যত্ন আর সম্মান পাওয়াতেই তার নিজস্ব সৌন্দর্য কলি থেকে পরিপূর্ণ পুষ্পে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।
এই বাড়ির মানুষজন যেভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলে, ওভাবে কেউ কখনো সম্মান দেবে, ভালোমতো কথা বলবে—তা কল্পনাও করতে পারেনি ঊষা।
কিন্তু গায়ের চুলকানি বাড়াতে ভাবনাটা আর বেশিদূর এগোতে পারল না।
সে গা থেকে আঁচলটা একটু সরাতেই চমকে গেল।
গলায়, বুকে, কাঁধে, হাতে ছোট ছোট লাল লাল কি সব বেরোচ্ছে।
ভয় পেয়ে গেল ঊষা।
বেশি চুলকাতে গেলে জ্বালা করছে।
ঊষা বুঝলো—এসব ভারী শাড়ির প্রভাব।
পিঠটাও কী চুলকাচ্ছে!
সে খোলা চুলগুলো পিঠ থেকে সরিয়ে কাঁধের এক পাশে এনে পিঠ চুলকাতে লাগলো।
এর উপর পিঠে ভীষণ ব্যথা—হাতটা ও ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না।
তার এমন আপ্রাণ প্রচেষ্টার মধ্যেই দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো প্রেম।
ঘরে পা রাখতেই তার দৃষ্টি আটকাল ড্রেসিং টেবিলের সামনে ভ্রু কুচানো প্রেমে—ঊষা বাঁকা হয়ে পিঠ চুলকানোর চেষ্টায়।
প্রেম দরজা বন্ধ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে? এমন ছটফট করছো কেন?”
প্রেমের কণ্ঠ কানে আসতেই চমকে লাফিয়ে উঠলো ঊষা।
সাথে সাথেই শরীরের আঁচল ঠিক করে চুলগুলো দিয়ে পিঠ ঢেকে ফেলল।
দরজা বন্ধ করে ঊষার কাছে চলে এলো প্রেম।
পাশ থেকে টুল টেনে ঊষার পাশে বসতে বসতে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি সমস্যা?”
ঊষা প্রেমের দিকে না তাকিয়ে তৎক্ষণাত আপত্তি জানিয়ে বলল,
— “কিছু না।”
প্রেম কিছু না বলে চেয়ে রইলো ঊষার দিকে।
মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। এত করে বলার পরও এই মেয়েটা তাকে কিচ্ছু বলতে চায় না।
সে আর কিছু না বলে ঊষার টুল ধরে ঘুরিয়ে দিলো।
চমকে উঠলো ঊষা।
প্রেম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
আলতো হাতে ঊষার পিঠ থেকে চুল সরিয়ে এক পাশে রাখলো।
সাথে সাথেই চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো ঊষা।
প্রেম পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ঊষার পিঠের দিকে।
যদিও ওর ব্লাউজের পিঠ অতটাও বড় নয়, মোটামুটি।
প্রেম কাঁধ, গলা, পিঠ ভালো মতো দেখলো।
ফর্সা ত্বকে লাল লাল র্যাশ বেরোচ্ছে।
প্রেম কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো।
কিছু একটা দেখে তার চেহারার অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলো।
ভালোমতো খুটিয়ে দেখলো—ফর্সা পিঠের উপর বেশ বড়সড় একটা কালছে নীল দাগ।
প্রেম আলতো হাতে সেটা ছোঁতেই
— “আহ!” করে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো ঊষা।
ঊষার আর্তনাদে হালকা কেঁপে উঠলো প্রেম।
আরও মনোযোগ দিয়ে দেখলো—এটা আঘাতের দাগ।
আবারও ঊষার পাশে টুলে বসে পড়লো প্রেম।
ঊষাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
— “কে মেরেছে?”
ঊষা মাথা নিচু করে রইলো।
উত্তর দিলো না।
প্রেম ঊষাকে ভালোভাবে দেখে দু’হাতের আজলায় ঊষার মুখখানা তুলে ধরলো।
ঊষার চোখে পানি দিয়ে টলমল করছে।
প্রেম অবাক হলো।
কণ্ঠ কিছুটা নরম করে শুধালো,
— “কে মেরেছে বলো আমায়? তুমি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলে—আমার কথার অবাধ্য হবে না।”
প্রেমের উষ্ণ আদরে প্রশ্রয় পেল ঊষার কান্নারা।
সে ফুঁপিয়ে উঠে আচমকাই প্রেমের বুকে আছড়ে পড়ল।
হতবম্ব হয়ে গেল প্রেম।
ঊষা প্রেমের টি-শার্ট খামচে ধরে মৃদু ভাবে ফুঁপাতে লাগলো।
মেয়েটা প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজের কান্না আটকে রাখার।
তাকে ব্যথা দেওয়ার মানুষের তো অভাব ছিল,
কিন্তু ব্যথা পাওয়ার পর একটু সান্ত্বনা দেওয়ার, একটু স্বস্তি দেওয়ার—বুকে মাথা রাখতে দেওয়ার—মানুষের বড়ই অভাব ছিল।
প্রেম নিজেকে ধাতস্থ করলো।
ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো ঊষার চুলে।
কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শুধালো,
— “শহহহহ… কাঁদে না, আমাকে বলো সব।”
ঊষা প্রেমের বুক থেকে মাথা তুললো না।
বুকে মাথা রেখেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো…
বড় চাচি খুন্তি গরম করে পিঠে চেপে ধরেছিল।
ঊষার বাক্যে আশ্চর্য হলো প্রেম। এতটা নিষ্ঠুর মানুষ কীভাবে হতে পারে!
সে ঊষার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে অত্যন্ত আদুরে স্বরে বললো,
— “কেন?”
ঊষা প্রেমের টি-শার্টে নাকের পানি মুছে বললো,
— “বিয়ের দিন সকালে রান্নাঘরে বসে চাচি অনেকক্ষণ ধরে ওই লোকটার সাথে বিয়ে করে নেওয়ার বলছিল, কিন্তু আমি রাজি হচ্ছিলাম না বলে প্রথমে অনেক মেরেছে। তার পরও রাজি না হয় খুন্তি গরম করে পিঠে চেপে ধরেছিল।”
এমন নির্মম অত্যাচারের কথা শুনে কেঁপে উঠলো প্রেমের বুক।
সে ঊষাকে নিজের আরো কাছে টেনে নিলো।
কিছুক্ষণ ঊষাকে কাঁদতে দিল।
অতঃপর ঊষার মুখ তুলে, আলতো হাতে নরম গাল মুছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললো,
— “আজ তোমার স্বামী তোমায় ওয়াদা করছে, ভবিষ্যতে আর কেউ, কোনোদিনও একবারের জন্যও তোমার গায়ে হাত তুলবে তো দূরের কথা, অসম্মানজনক একটা বাক্যও বলবে না।
তোমাকে কিছু বলার আগে তাদের তোমার স্বামীর মুখোমুখি হতে হবে।
আগে তুমি একা ছিলে, তোমাকে রক্ষা করার মতো কেউ ছিল না—
এখন থেকে বাকি জীবন তোমার সাথে আমি থাকবো।
আর এই আহনাব শিকদার প্রেম তার স্ত্রীর চোখে একটু পানি দেখতে চায় না। তাই আর কেঁদো না।”
ঊষা একটু ধাতস্থ হল।
প্রেম বসা থেকে উঠে গিয়ে অয়েলমেন্ট নিয়ে আসলো। আবারো উষার পিঠ থেকে চুল সরিয়ে সযত্নে ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে লাগলো। প্রেমের প্রতিটা স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে উষা। প্রেম অয়েলমেন্ট লাগিয়ে নরম চোখে তাকালো উষার দিকে, ধীর কণ্ঠে বললো,
“কাল সকালের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে, আর এক দিনের মধ্যে দাগটা ও মিলে যাবে। তুমি আর ওসব পুরনো কথা কখনো ভাববে না।”
উষা স্নিগ্ধ চোখে তাকালো প্রেমের দিকে। সত্যিই, আল্লাহ যাকে দেন, দুই হাত ভরেই দেন। তিনি পরম দয়াবান, তিনি কখনোই কাউকে আজীবন কষ্টে রাখেন না। তাই উষাও বুঝেছে, এত বছর আল্লাহ কষ্ট দিয়ে তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন, আর সামনে মানুষটা, তার অগাধ ধৈর্যের ফল।
তাই অতীতে করা কষ্ট নিয়ে আর আফসোস নেই ঊষার।
প্রেম উষাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বললো,
“এসব কী পরেছো? প্রোবলেম হচ্ছে না? এগুলোর জন্যই তো তোমার গা দিয়ে র্যাশ বেরোচ্ছে। যাও, কমফর্টেবল কিছু একটা পরে আসো।”
প্রেমের কথায় আবারো মুখ কালো করে ফেললো উষা। ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“আর কী কমফর্টেবল পরবো? আরো যে দুটো শাড়ি আছে, ওগুলো তো এরকম ভারী, প্রায় একই রকম।”
অবাক হলো প্রেম। উষার দিকে তাকিয়ে বললো,
“মানে, তোমার কোনো থ্রি-পিস, টু-পিস নাই?”
দুই পাশে মাথা নাড়ালো উষা।
প্রেম ভাবলো, সত্যি তো—উষাকে এগুলো কিনে দেওয়া হয়নি। সে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে, কাল সকালে আমার সাথে শপিং মলে যাবে। আমি তোমাকে তোমার প্রয়োজনীয় যা লাগবে, সব কিনে দিবো।”
উষা সম্মতি জানাতেই আবার হাত চুলকাতে লাগলো। প্রেম লক্ষ্য করলো, উষার গায়ের র্যাশ বাড়ছে। সে দ্রুত উষাকে নিয়ে নিজের ওয়ারড্রোবের সামনে দাঁড় করালো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার উষার হাইট মেপে নিলো।
উষা তার বুক থেকে একটু নিচে। সে ওয়ারড্রোব খুলে নিজের একটা ফুল হোয়াইট ফর্মাল শার্ট উষাকে দিলো।
উষা গোল গোল চোখে তাকালো শার্টটার দিকে, বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“এটা দিয়ে কী করবো?”
প্রেম সোজা তাকালো উষার চমকিত মুখের দিকে, স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো,
“যা পরেআছো, ওগুলো ছেড়ে এটা পরে আসো। না হলে সারা রাত ঘুমাতে পারবে না। আর তাছাড়া, এক-দুই ঘণ্টার মধ্যে এমন চুলকানি শুরু হবে, যে এমনি তেই এগুলো খুলে ফেলতে বাধ্য হবে। এর থেকে ভালো, না কম থাকতে থাকতে এগুলো পালটে নিলে।”
উষা ভেবলার মতো তাকিয়ে রইলো প্রেমের মুখের দিকে। প্রেম যদিও কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেছে।
উষা শার্টটা হাতে নিয়ে তার ভাঁজ খুলে দেখলো—এই শার্টের মধ্যে ওর মতো আরো দুজন অনায়াসেই ফিট হয়ে যাবে। সে শার্টটা দেখে একটু ইতস্তত করে বললো,
“শুধু এটা পরবো? কিভাবে? প্যান্ট কোথায়?”
উষার কথায় প্রেমের হাসি পেলো। উষার হাইট দেখে দুষ্টু হেসে বললো,
“তুমি আমার প্যান্ট পরবে?”
উষা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। প্রেম মুচকি হেসে নিজের একটা ট্রাউজার বের করে উষার হাতে দিয়ে বললো,
“যাও, পরে আসো।”
উষা চোখ তুলে তাকালো প্রেমের দিকে। উষার কেন জানি মনে হচ্ছিল, এই লোকটা তাকে নিয়ে রসিকতা করছে।
প্রেম ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?”
উষা প্রেমের দিক থেকে চোখ সরালো, আর বেশি না ভেবে প্রেমের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
উষা যেতেই প্রেমের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে গেল। ঊষার বাড়ির লোকের প্রতি তীব্র থেকে তীব্রতর ঘৃণার জন্ম হলো। ঘৃণিত কন্ঠে বলল,
“ওরা কি আসলেই মানুষ? এতো ছোট একটা মেয়েকে কীভাবে আঘাত করে?”
প্রেম বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হয়ে শুল।
কিন্তু মিনিট কুড়ি পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন উষা ওয়াশরুম থেকে বের হলো না, এবার ভুরু কুঁচকে ফেললো প্রেম।
শুয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে ডাকলো,
“উষা, আজ রাতটা কি ওয়াশরুমেই থাকার প্ল্যান আছে?”
সে মুখের কথা শেষ করার আগেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল।
প্রেম তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো সেদিকে।
উষা দুই হাতে প্রেমের ট্রাউজার উঁচুতে তুলে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে কোনোরকমে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। প্রেমের শার্টটা ঝুলছে তার হাঁটুর নিচে। দেখে মনে হচ্ছে, এক পা সামনে দিলেই উষ্টা খেয়ে পড়বে। আর তাই-ই হলো।
প্রেমের দিকে এক পা বাড়াতেই প্রেমের ট্রাউজারে পা পেঁচিয়ে ধপাস করে পড়ে যেতে নিলো।
সাথে সাথেই ছুটে এসে হাত টেনে ধরলো প্রেম।
সোজা দাঁড় করিয়ে ভুরু নাচিয়ে বললো,
“এইজন্যই প্যান্ট দিতে চাইনি। এবার যাও, এটা খুলে আসো।”
প্রেমের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিললো উষা।
নিচু কণ্ঠে বললো,
“না থাক।”
প্রেম চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“ওকে, তাহলে ছেড়ে দিই।”
বলেই ছেড়ে দিল।
সাথে সাথেই আতকে উঠে প্রেমের টি-শার্ট আঁকড়ে ধরলো উষা।
করুণ চোখে তাকালো প্রেমের দিকে।
প্রেম ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো, “যাও, প্যান্টটা ছেড়ে আসো।”
উষা করুণ চোখে তাকিয়ে প্রেমের ট্রাউজার টেনে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
উষা ভেতরে ঢুকতেই ফিক করে হেসে দিল প্রেম।
সে অনেক কষ্টে এতক্ষণ হাসি চেপে রেখেছিল।
ঊষা কে দেখে ভীষণ ইচ্ছে করছিল এভাবে উষার একটা ছবি তুলে রাখতে, কিন্তু ছবি তুলতে গেলে বেচারী লজ্জা পেতো।
প্রেমের ভাবনার মধ্যেই আবারো ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল।
উষা ওয়াশরুমের বাইরে এক পা দিতেই প্রেমের মুখ হা হয়ে গেল, চোখ দুটো স্বাভাবিকের মাত্রায় কিছুটা বড় হল।
উষা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে কাঁচুমাচু হয়ে প্রেমের সামনে এসে দাঁড়ালো।
প্রেমের সাদা রঙের শার্টটা উষার হাঁটুর একটু নিচে, ফলে তার তুলতুলে নরম ফরসা পা গোঁড়ালি থেকে অনেকটা উপরে পর্যন্ত দৃশ্যমান, যা অত্যন্ত আকর্ষণীয় লাগছে।
গলার কাছে সামনে দিক থেকে প্রথম দুটি বোতাম খোলা।
হালকা ঢেউ খেলানো খোলা চুলগুলো হাঁটুর নিচে দুলখাচ্ছে।
উষাকে দেখতে ভীষণ হট লাগছে।
উষা প্রেমকে নিজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় আরও খানিকটা মিইয়ে গেল।
সামনের খোলা চুলের কয়েকটা বা হাতে কানের পিঠে গুঁজে বললো, “এবার ঠিক লাগছে?”
উষার কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো প্রেমের, সে মুখ বন্ধ করে নিল।
টেনে হিঁচড়ে নিজের দৃষ্টি নামালো।
মনে মনে ঢোক গিলে আওড়ালো,
“মারাত্মক!”
উষা আবার বললো,
“কি হলো? কিছু বলছেন না যে?”
প্রেম ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
“হুম, ঠিক লাগছে। তুমি কমফর্টেবল ফিল হচ্ছো তো?”
উষা ওপর-নিচে মাথা নাড়ালো।
প্রেম মৃদু হেসে বললো,
“তাহলে যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
উষা ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
প্রেম বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে ঘরের সব লাইট অফ করে দিল।
অন্ধকার হওয়ার সাথেসাথেই আবারো
“ভূত! ভূত!” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো উষা।
প্রেম লাইট অফ করে দ্রুত ছুটে এলো ওর কাছে।
বিছানায় বসতে বসতে বললো,
“কোথায় ভূত?”
অন্ধকারে প্রেমের কণ্ঠ পেয়ে, কালকের মতো আজো এক লাফে প্রেমের বুকে চলে গেল উষা।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রেম।
এসি-র পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে হালকা চাদরটা দু’জনের উপর টেনে দিল।
বালিশ দুটো একসাথে যুক্ত করে উষাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো।
উষা দুই হাতে প্রেমের পেট জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।
শান্তিতে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে ও পড়লো।
প্রেম চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে চাইল, “সবাইকে ভালো রেখো, মাবুদ। আমি আর কোন জটিলতা চাই না …”
রাত ১২টা বেজে ৫ মিনিট। পরিনিতা নিজের বাড়িতেই চোরের মতো উঁকি-ঝুঁকি মারছে। সে ধীরে পায়ে হেঁটে হেঁটে পুরো বাড়িতে সতর্ক দৃষ্টি বুলাচ্ছে। শিকদার বাড়ি বিশাল, সেটা পুরোটা ঘুরে ঘুরে দেখা বিশাল ঝামেলা, তাই পরিনিতা সেই ঝামেলায় গেল না। কেবল আশপাশটা সূক্ষ্ণ নয়নে চেয়ে অনুভব করল—হয়তো এই মুহূর্তে পুরো বাড়িই তন্দ্রাচ্ছন্ন। পুলকিত হলো পরিনিতার মন। সে ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ত্রস্ত হাতে কল লাগাল তার প্রিয় মাস্টার মশাইয়ের নাম্বারে।
প্রথমবার রিং হতে হতে কেটে গেল। ফোন রিসিভ হচ্ছে না দেখে একটু অধৈর্য হলো পরিনিতা। আবার কল করল। এবার কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো।
ফোন রিসিভ হতে দেখে আনন্দিত হলো সে, তবে কিছু না বলে চুপ করে ফোন কানে ধরে রাখল। ওপাশ থেকে আবিদ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ডাকল, “অ্যাঞ্জেল!”
আবিদের ঘুমু ঘুমু কণ্ঠটা সোজা পরিনিতার হৃদয়ে আঘাত আনল। আবিদ আবার ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলল,
“পেঁচার মতো জেগে না থেকে ঘুমিয়ে পড়ো, সোনা।”
পরিনিতা এবারও চুপ করে রইল। আবিদ অসহায় কণ্ঠে বলল,
“এখন ঘুমাই প্লিজ, অ্যাঞ্জেল। প্রমিস, কাল তোমাকে এক্সট্রা ২০ মিনিট কোলে নিয়ে বসে থাকব। এখন ঘুমাতে দাও।”
এবার পরিনিতা কথা বলল। মিষ্টি কণ্ঠে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“কিসের ঘুম? এখন কোনো ঘুম-টুম হবে না! এক্ষুনি, মানে এক্ষুনি আমার বাসার নিচে আসুন!”
আবিদ কিছু বলতে চাইল, তার আগেই পরিনিতা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“না থাক, একটু সময় নিয়ে আসুন। কিন্তু ১ ঘণ্টার মধ্যেই আসবেন।” বলেই আবিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কট করে ফোন রেখে দিল।
আহত হলো আবিদ। ঘুমে তার পুরো দুনিয়া মাথার উপর ঘুরছে। ঘুমিয়েছে মাত্র ২০ মিনিট হলো, এর মধ্যেই পরি ফোন করে ঘুমের ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। আবিদ কোনো রকম শরীরটা টেনে তুলে বসলো। হাই তুলে বলল,
“যেমন বাপ তার, তেমন মেয়ে। বাপ আমায় জানে মারাতে চায়, আর মেয়ে ভালোবাসার ওভারডোজ দিয়ে মারতে চায়!”
আবিদ বিছানা হাতড়ে চশমা খুঁজে চোখে পরে নিল। বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
পরিনিতার ফোন রেখে গুল হয়ে বসলো। তার কী যে ভালো লাগছে আজ! যদিও ও মাস্টার মশাইয়ের কাচা ভাঙিয়ে দেবার জন্য কিছুটা খারাপ লাগছে, তবুও সে তার মন বুঝ দিল—বড় বড় কাজের জন্য মাঝে মাঝে ছোট ছোট ত্যাগ করতে হয়।
সে ফোন রেখে উঠে বসলো। ওয়াশরুম থেকে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে এল। নিজের পুরো ওয়ারড্রোব ঘেঁটে একটা সুন্দর কালো রঙের হালকা শাড়ি বের করল। আয়নার সামনে গিয়ে নিজের গায়ে ধরে দেখল কেমন লাগে। শাড়িটা গায়ে ধরতেই পরিনিতার ফর্সা ত্বকের সাথে কালো রঙটা ঝট করে মিশে গেল। হাসলো পরিনিতা। শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, পেটিকোট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। পাক্কা ১০ মিনিট লাগিয়ে শাড়িটা পরিপাটি করে পরে বের হলো। আবার ধীরে পায়ে হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল।
দুধে আলতা দেহে কালো রঙটা নজর কাড়ছে। পরিনিতা নিজেই নিজেকে দেখে লজ্জা পেল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে শাড়ির সাথে ম্যাচিং কালো চুড়ি বের করে পরে নিল। হাঁটু ছুঁইছুঁই চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে অতি সাধারণভাবে হাত খোপা করে নিল। কানে একজোড়া মাঝারি সাইজের অক্সিডাইজ ঝুমকা পরে নিল। চোখে হালকা কাজল দিয়ে হাতে ডার্ক একটা লিপস্টিক তুলে নিল। অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে লিপস্টিকটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে বদলে একটা পিঙ্ক টিন্ট লাগিয়ে নিল। সবশেষে টিপের পাতা থেকে কপালে ছোট্ট কালো একটা টিপ পরে আবার আয়নায় নিজেকে দেখল।
মেয়েটা শুধু নামেই পরি নয়, আসলেই পরি!
পরিনিতা আয়নার দিকে তাকিয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল, “আপনার কাছে সুন্দর লাগবে তো, মাস্টার মশাই?”
নিজের দিকে চেয়ে চেয়ে থাকতে থাকতেই পরিনিতার মনে পড়ে গেল সেদিনকার মাস্টার মশাইয়ের বলা কথাগুলো। সাথেসাথেই লজ্জায় গাল লাল হতে লাগল। কিন্তু আবার কিছু একটা মনে পড়তেই লাফিয়ে উঠল পরিনিতা। ফোন হাতে নিয়ে ছুটল নিচে। পরিনিতা এদিক-ওদিক দেখে সাবধানে ডাইনিং টেবিল ক্রস করে রান্নাঘরে গেল।
রান্নাঘরের সব কিছু উষা পরিপাটি করে রেখে গেছে। পরিনিতা ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করে ক্যাবিনেটের উপর রাখল। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে গ্যাস অন করল। তাতে স্টিলের হাঁড়িতে বসিয়ে সে ১ লিটার পরিমাণ দুধ জ্বাল দিতে দিল। পাশের ছোট একটা পাত্রে গোবিন্দভোগ চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখলো।
কিছুক্ষণ পর দুধ ফুটে উঠলে, তাতে ধীরে ধীরে চাল দিয়ে দিল। একটু সাবধানে হাঁড়ির ধারে ধারে জমে থাকা ক্রিম নেড়ে দিতে লাগলো কাঠের চামচ দিয়ে।
কিছুক্ষণ পর দুধ-চালের মিশ্রণে চিনি, এলাচ, বাদাম, কিসমিস ভালোভাবে মিশিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পায়েশের মিষ্টি গন্ধে গোটা রান্নাঘর মৌ মৌ করতে লাগলো।
পরিনিতা পায়েশটা হাতে নিয়ে মুখে দিতে গিয়ে থেমে গেলো। শুধু হাত দিয়ে দেখলো রান্না হয়েছে কিনা, ধিমে আছে। আরও কিছুক্ষণ রান্না করে নামানোর আগে উপর থেকে একটু ঘি ছড়িয়ে দিল।
পরিনিতা বাঁ হাতের উলটো পিঠে ঘাম মুছে পায়েশের হাঁড়িটা নামিয়ে অন্য পাশে রাখলো।
ব্যস্ত হাতে অন্য একটি পাত্রে দুটো ডিম ভেঙে তাতে চিনি গুঁড়া করে দিয়ে ডিমের সঙ্গে ফেটাতে লাগলো। বিটারের শব্দ হবে বিধায় চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে ফেটাতে লাগলো।
মিশ্রণটা ভালোভাবে মিশে গেলে তাতে তেল, দুধ আর ভ্যানিলা এসেন্স মিশিয়ে দিলো। ময়দা আর বেকিং পাউডার ছেকে নিয়ে অল্প অল্প করে ব্যাটারে যোগ করলো।
ওভেনটা আগে থেকেই প্রি-হিট করে রেখেছিল। তাই ব্যাটারটা কেক মোল্ডে ঢেলে ওভেনে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
২৫ মিনিট পর ওভেন খুলতেই যে ঘ্রাণটা বের হলো—তাতে পরিনীতার মুখের উজ্জ্বলতা বেড়ে গেলো। কেকটা বের করে একটা বড় টিফিন বাটির মধ্যে ঢাললো। উপর থেকে অনভিজ্ঞ হাতে ক্রিম দিয়ে লিখে দিলো—হ্যাপি বার্থডে মাস্টার মশাই।
রান্না শেষ। পরিনিতা আরেকটা টিফিন বাটিতে বেশ অনেকটা পরিমাণ পায়েশ নিলো। দুটি বাটির ঢাকনা লাগাতেই পরিনীতার ফোন বেজে উঠলো। পরিনিতা ত্রস্ত হাতে ফোন রিসিভ করতেই আবিদের মোলায়েম কণ্ঠ—
“মশার কামড় খাওয়ার জন্য ডেকে এনেছো অ্যাঞ্জেল?”
আবিদের কথায় পরিনীতার একটু কষ্ট হলো। সে ত্রস্ত কণ্ঠে বললো—
“একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসছি।”
আবিদ ছোট করে বললো—
“হুম।”
পরিনিতা টিফিন বাটি দুটো একটা পলিথিনে ভরে ভালোভাবে গিট দিয়ে নিলো। যদিও দুটি বাটি অনেক গরম, পরিনিতা পলিথিন ব্যাগটা নিয়ে ধীর পায়ে চুপি চুপি শিকদার বাড়ির মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।
পরিনিতা যতই ভাবুক, তাকে কেউ দেখেনি। কিন্তু কেউ একজন ঠিকই দেখতে পেয়েছে, যা তার পূর্বের ক্রোধকে আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি করলো। সে ফোন বের করে কারো নাম্বারে কল লাগালো।
পরিনিতা চুপি চুপি পদ্ম পুকুর পেরিয়ে সেই পেয়ারা গাছটার কাছে এলো। পলিথিন ব্যাগটা গাছের ডালে ঝুলালো।
এই শাড়ি পরে সে এখন গাছে উঠবে কিভাবে?
তবু শাড়ির কুঁচি ধরে জুতো ফেলে কোনো মতে গাছে উঠে গেলো।
শিকদার বাড়ির ১২ ফুট উঁচু পাঁচিল। এখান থেকে লাফ দিতে প্রতিবার পরিনীতার কলিজা কাপে।
সে গাছের ডাল থেকে পলিথিন ব্যাগ না নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আল্লাহর নাম নিয়ে লাফ দিতেই সেকেন্ডের মধ্যেই কারো উষ্ণ বুকে আঁচড়ে পড়লো। নিজেকে কারো বুকে অনুভব করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো পরিনিতা।
মানুষটার গা থেকে ভেসে আসছে সেই পরিচিত পুরুষালী গন্ধ, যা পরিনিতার মনকে শান্ত করলো।
পরিনিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো আবিদের দিকে।
আবিদের চোখ মুখে ঘুমের রেশ এখনো লেপ্টে আছে। কী ভীষণ আদুরে লাগছে! পরিনিতার তো টপাটপ কয়েকটা চুমু খেতে মন চাইলো!
সে ভ্রু কুঁচকে পরিনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
তাকে নিজের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরিনীতার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে নিজের মনের ইচ্ছা দমন না করে টুক করে বাঁ গালে চুমু খেয়ে নিলো।
পরিনীতার চুমুতে ধ্যান ভাঙলো আবিদের।
সে আস্তে আস্তে পরিনীতাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিলো।
আবারো পরিনীতার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালোভাবে স্ক্যান করল। সন্দিহান কণ্ঠে বললো—
“কি ব্যাপার?”
পরিনিতা মাথা তুলে তাকালো আবিদের দিকে।
আবিদ দুই পা এগিয়ে এসে বললো—
“খুন করার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছো কেন?”
আবিদের কথায় আহাম্মক হয়ে গেলো পরিনিতা।
কপাল কুঁচকে বললো—
“কাকে খুন করবো? আর কেনই বা খুন করবো?”
আবিদ জবাব দিলো না, শুধু অস্থির চোখে তাকিয়ে রইলো।
পরিনিতার কৌতূহলী চোখের দিকে তাকিয়ে আবিদের ডান বাহু জড়িয়ে ধরে বললো—
“এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন? যদি উপর থেকে কেউ দেখে ফেলে?”
আবিদ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো—
“নিলে নিবে, ভালোবাসতে ভয় না করলে মার খেতে ও ভয় পাওয়া উচিত নয়।”
পরিনিতা তার হাত টেনে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বললো—
“আমি থাকতে আমার মাস্টার মশাইকে কে মারবে, শুনি? আমি থাকতে আমার মাস্টার মশাইকে কাউকে ছুঁতে দেবো না।”
হেসে ফেললো আবিদ।
পরিনিতা পায়ে পা মিলিয়ে বললো—
“দেখা যাবে।”
পরিনিতা আত্মবিশ্বাসি কণ্ঠে বললো—
“দেখেনিয়েন।”
জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের আলোয় পথঘাট সব আলোকিত, সুস্পষ্ট।
পরিনিতা তাকে নিয়ে উল্টো দিকের রাস্তা ধরলো।
আবিদ খানিক অবাক হলেও কোনো প্রশ্ন করলো না, শুধু নিশ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো।
পরিনীতার মায়াবী মুখের পানি—
আসলে, সুন্দরী নারী যত ধ্বংসের মূল!
এই যেমন মধ্যরাতের পূর্ণ চন্দ্রের আলোয় এই সপ্তদশী কি জানে, তাকে কতটা মোহময়ী লাগছে?
এই সপ্তদশী কি জানে, তার সরলতা কোমলায় সামনের পুরুষটা ঠিক কতটা ঘায়েল, কতটা দুর্বল করে?
আবিদের ভাবনার মাঝেই পরিণীতা এসে থামলো একটা বাঁশের তৈরি রেস্টুরেন্টের সামনে।
যদিও এটা অত্যন্ত সাধারণ একটা রেস্টুরেন্ট, বাঁশের তৈরি, এখানে গ্রামের লোকজন এসে খাওয়া-দাওয়া করে।
আবিদ বন্ধ রেস্টুরেন্টটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো—
“এখানে কেন এসেছো অ্যাঞ্জেল? এটা ১০টার সাথেসাথেই বন্ধ হয়ে যায়। আর এখন তো রাত প্রায় ২টা।”
মিষ্টি হাসলো পরিণীতা।
আবিদের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে তাকে নিয়ে এগিয়ে গেলো রেস্টুরেন্টটার দিকে।
আলতো হাতে দরজা ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেলো।
কিছুটা আশ্চর্য হলো আবিদ।
ভিতরে হালকা আলো জ্বলছে।
কিন্তু ভিতরে দাঁড়ালো না পরিণীতা।
আবিদকে টেনে নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্টের উল্টো দিকে, আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আলতো হাতে দরজাটা খুলে দিলো।
আবিদ শুধু বিস্মিত চোখে পরির কাণ্ডকারখানা দেখছে।
পরিণীতা আবিদকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে পা রাখতেই অত্যন্ত আশ্চর্য হলো আবিদ—
এই রেস্টুরেন্টের উল্টো দিকটা খোলা একটা ছোটো পার্কের মতো। জায়গাটা বেশ ছোটো, কিন্তু অনেক বেশি সুন্দর ও মনমুগ্ধকর লাগে।
কিন্তু এখন জায়গাটা কে স্বর্গরাজ্যের কোনো এক উদ্যান লাগছে আবিদের কাছে।
জায়গাটা পুরোটা ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো, খোলা জায়গাটা স্বপ্নের মতো সুন্দর।
জায়গাটার ঠিক মাঝখানে একখানা ছোট্ট গোল টেবিল, সাদা কাপড়ে ঢাকা। উপরে কাঁচের বাটি ভর্তি গোলাপ পাপড়ি। তার পাশে দুটো কাঠের চেয়ার।
আবিদের ভাবনার মধ্যেই তার মুখের সামনে কেক ধরল পরি।
আবিদ অবাক চোখে চেয়ে রইল তার পরির দিকে।
পরি সামনে কেক ধরে মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“জানি, আপনার জন্মদিনের আসল সময় পেরিয়ে গেছে, তবুও… এই পরির পক্ষ থেকে তার মাস্টারমশাইয়ের জন্য ছোট্টো ভালোবাসা।”
আবিদ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল পরির মায়াবী মুখের দিকে।
কিছুটা আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,
“আজ আমার জন্মদিন তুমি মনে রেখেছো? অথচ আমি নিজেই মনে রাখি নি।”
পরিণীতা মৃদু হাসলো, কেকটা টেবিলের উপর রেখে আবিদের হাতে ছুরিটা তুলে দিয়ে বলল,
“জানি তো, আপনার মনে নেই। থাকবার দরকারও নেই। আমি তো আছি। আপনি আমার, তাই আমার মাস্টারমশাইয়ের ছোটো বড়ো সবকিছুর খেয়াল আমি নিজেই রাখবো। তার বিনিময়ে আপনি শুধু আমাকে অফুরন্ত ভালোবাসা দিবেন। এই পরি আপনার কাছে আর কিছু চায় না।”
তৃপ্ত চোখে তাকালো আবিদ।
ছুরিটা পাশে রেখে আচমকাই পরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
কিছুটা হতবাক হলো পরি, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করলো না।
চুপ করে অনুভব করতে লাগলো মাস্টারমশাইয়ের ভালোবাসা।
আবিদ শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরলো নিজের প্রাণকে।
কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“তোমার ভালোবাসায় তোমার মাস্টারমশাই নিঃস্ব হয়ে গেছে অ্যাঞ্জেল। আমার ভীষণ ভয় হয়, এত ভালোবাসা দিয়ে যদি তুমি দূরে হারিয়ে যাও—তখন আমি কী নিয়ে বাঁচবো? তোমার সামনে আমার মৃত্যু হলে… ওটা একটু কষ্ট করে সহ্য করে নিও প্লিজ। তবুও নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যেও না।”
পরিণীতা অনুভব করলো আবিদের হৃদয়ের ধ্বনি।
তার খালি মনে হয় মাস্টারমশাই তার কাছ থেকে কিছু একটা গোপন করে, কিছু একটা নিয়ে সে আজকাল ভীষণ চিন্তিত থাকে।
তবুও এখন এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করল না পরিণীতা।
সে সন্তর্পণে বুক থেকে মাথা তুলে আবিদের দিকে তাকালো।
পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ালো।
মাথার চুল টেনে ধরে, মাথা নিচু করে নামালো, কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল—
“আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাবো মাস্টারমশাই। আপনি আমার সেই আশক্তিময় মাদক, যা পরি দিনে অন্তত একবার পান করতে না পারলে ছটফট করতে থাকে। আপনার একটু স্পর্শ, আপনার একটু ভালোবাসা, আপনার একটু বকা শোনার জন্য চাতকের মতো বসে থাকে। আমি জানি, আপনার ভয়টা কোথায়। কিন্তু এত ভয় পাবেন না। আমার আব্বু অতটাও খারাপ মানুষ না। ঠিক আমাদের মেনে নেবেন।”
পরিণীতার কথায় আঘাত পেলো আবিদ।
পরিণীতা তার ললাটে দীর্ঘ চুম্বন করে বলল,
“এবার কেকটা কাটেন।”
হাসলো আবিদ।
পরিণীতাকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটলো।
কেকের প্রথম টুকরোটা পরির মুখে দিলো।
পরিণীতাও একটু আবিদকে খাইয়ে দিল।
পরিবেশ হালকা করতে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে হেসে বলল,
“আজ আপনার ২৬ থেকে ২৭-এ প্রমোশন হলো মাস্টারমশাই। আপনি নিশ্চয়ই অনেক খুশি।”
পরিণীতার পাগলামি দেখে হাসলো আবিদ।
কেকের উপর থেকে একটু ক্রিম নিয়ে পরিণীতার গালে লাগিয়ে বলল,
“এটাকে প্রমোশন বলে না ম্যাডাম, ডিমোশন বলে।”
আবিদের কথায় পরিণীতা চোখ ছোট ছোট করলো।
“কেন?”
আবিদ আরেক গালে ক্রিম লাগাতে লাগাতে বলল,
“যদি কোনোভাবে ২৬ থেকে ২৫-এ যাওয়া যেতো, তবে সেটা হতো প্রমোশন।”
পরিণীতা কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কীভাবে?”
আবিদ বলল,
মানুষের বয়স বাড়া মানে আনন্দের কিছু নয়, “অ্যাঞ্জেল, একদিন জীবন থেকে গেলেই হিসেবের সময় থেকে একদিন কমলো—মানে কী দাঁড়ালো? যে দিন বাড়ছে না, দিন কমছে।”
পরিণীতা বোকা চোখে তাকালো আবিদের দিকে।
আবিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“বুঝতে পারনি তো?”
পরিণীতা দুইপাশে মাথা নাড়ালো।
আবিদ হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“তোমাকে এসব বলে লাভ নেই। যে পড়াশোনাকে অশালীন মনে করে, সে এসব কীভাবে বুঝবে? পৃথিবীর সব দিকে যেমন নজর, তেমন পড়াশোনায় ও যদি একটু দিতে, ধন্য হতাম।”
পরিণীতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আবিদের দিকে, অভিমানি কণ্ঠে বলল,
“আজকের দিনেও আপনি পড়াশোনা নিয়ে আমাকে অপমান করছেন?”
আবিদ আরেকটু ক্রিম পরিণীতার গলায় লাগাতে লাগাতে বলল,
“তাহলে কী করবো?”
পরিণীতা মুখ বাকালো।
পায়েসের বাটিটা হাতে নিলো, তার থেকে এক চামচ আবিদের মুখের সামনে ধরলো।
মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, করুন।”
আবিদ পরির হাত থেকে বাটিটা নিয়ে আগে পরিকেই খাইয়ে দিয়ে নিজে খেতে লাগলো।
এক চামচ মুখে দিয়ে বলল,
“তুমি বানিয়েছো?”
পরিণীতা লজ্জা মিশ্রিত হেসে মাথা নাড়ালো।
আবিদ পুরো বাটি খালি করে টেবিলের উপর রাখলো।
পরিণীতা লাজুক কণ্ঠে বলল,
“আপনার জন্য এত কিছু করলাম। আমার রিটার্ন গিফট দিবেন না?”
আবিদ পরিণীতার চোখে চোখ রেখে বলল,
“হুকুম করো।”
পরিণীতা একটু লাজুক হেসে বলল,
“কোলে নিন।”
আবিদ চেয়ার টেনে বসে পরিকে এক টানে নিজের কোলে বসালো।
চুলের খোপায় মুখ ডুবিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে, কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“এই যে তুমি সবসময় বাচ্চাদের মতো কোলে উঠার বায়না ধরো, তুমি কি এখনো ছোট আছো?”
পরিণীতা আবিদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপনার কোন সন্দেহ আছে?”
আবিদ ভালো মতো চোখ বুলিয়ে বলল,
“কোন দিক দিয়ে ছোট, আমি তো দেখি না।”
আবিদের কথায় লজ্জা পেলো পরিণীতা।
তবে দমে না গিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আপনার চোখের পাওয়ার বেড়েছে। চশমা পাল্টান। আমি এখনো বাবু।”
আবিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার চোখের পাওয়ার বেড়েছে?”
পরিণীতা উপর-নিচ মাথা দুলাল।
পরিণীতার লজ্জা মিশ্রিত মুখ দেখে আবিদের ভিতরটা ধক ধক করতে শুরু করল।
মেয়েটা এত মায়াবী কেন?
মনে মনে সাদমান শিকদারের প্রশংসা করে বললো,
“ব্যাটা ক্রিমিনাল হোক আর যাই হোক, বেটার ফ্যাক্টরির প্রোডাক্টগুলো A+।”
আবিদের কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে।
আবিদ একটু অস্থির কণ্ঠে বলল,
“চলো, তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি।”
সঙ্গে সঙ্গেই পরিণীতা বিরোধিতা জানালো, অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলল,
“এখন যাবো না।”
অভিমানি কণ্ঠে বলল,
“আপনার কাছে এলেই শুধু তাড়াতে চান কেন?”
আবিদের শরীর খারাপ লাগছে।
ওইদিনের মতো, আজকাল এই মেয়েটা কাছে থাকলেই তার সবকিছু এলোমেলো লাগে।
গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে মন চায়, আর মেয়েটাও তো বাধা দেয় না।
পরিণীতা কোলে বসে বসে উশখুশ করছে।
আবিদ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ছটফট করছো কেন?”
পরিণীতা আহত চোখে তাকালো আবিদের দিকে।
উঠে যেতে যেতে অভিমানি কণ্ঠে বলল,
“কিছু না।”
আবিদ স্পষ্ট বুঝলো, পরিনিতার চোখের ভাষা।
সে আবার চেপে কোলে বসিয়ে দিলো। দুই হাতে পেট জড়িয়ে কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে নেশাক্ত কণ্ঠে বলল,
“এমন করোনা, অ্যাঞ্জেল। এত বেপরোয়া হওয়া ভালো নয়। মানুষের জীবন—বলা যায় না কখন কী হয়। আজ তোমাকে ছুঁয়ে, কাল যদি মরে যাই? হয়তোবা অতটা গভীরে ছুলাম না, তবু ও কিছুটা স্পর্শ তো লাগেই যাবে। সেদিন হয়তো ভুলবশত হয়ে গেছিলো। কিন্তু সবসময় জেনে বুঝে তো এগুলো করতে পারি না। আর এগুলো বড় সাংঘাতিক নেশা, অ্যাঞ্জেল, যা একবার পেলে বারবার পেতে ইচ্ছা হয়। আর তা সবসময় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেশি কিছু হয়ে যায়, তখন কি করবে? তাই নিজেকে সামলে নাও। আমাকে মেরো না।”
পরিনিতা এসব কিছুই শুনল না, সে শুধু স্থির হয়ে আছে আবিদের মুখে “মৃত্যু” শব্দটায়। তার চোখে পানি টলমল করে উঠলো। সে কোলে থেকে ছটফট করে উঠে বললো,
“ছাড়ুন, আপনার সঙ্গে কোনো কথা নেই।”
বলতে বলতে কেঁদে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আবিদ মেয়েমানুষের কাঁদতে ১ সেকেন্ডও লাগে না—মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“উফ, কাঁদছো কেন, অ্যাঞ্জেল?”
পরিনিতা অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি খুব খারাপ। ছাড়ুন আমাকে।”
আবিদ অসহায় চোখে তাকালো পরিনিতার দিকে। মেয়েটা মনে কষ্ট পেয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবিদ। মেয়েটা ভবিষ্যৎটা শুনতেই চায় না।
চোখের সামনে যখন দেখবে, তখন কিভাবে সহ্য করবে?
আবিদ পরিনিতার মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“আমার পাগলি, কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়।
তেমনি কোন কিছুর উপর এতো মায়া রাখতে নেই।”
পরিনিতা অশ্রুশিক্ত চোখে তাকালো। আবিদ আরও কিছু বলতে গেলে, পরিনিতা আচমকা তার টি-শার্ট টেনে ধরে পুরুষালি ওষ্ঠে ওষ্ঠ মিলিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু শান্ত হয়ে গেলো। আবিদ দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল—এই মেয়েটা তাকে স্থির থাকতে দেবে না। নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে, আবিদ ও প্রেয়সীর কোমর জড়িয়ে ধরে উষ্ণ ভালোবাসার বিনিময় করতে লাগলো।
কয়েক মিনিট পর ছেড়ে দিলো পরিনিতা। আবিদ বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,
“চলো, এখন তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
পরিনিতা গেলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
আবিদ বুঝলো, পরিনীতার ভাব ভালো নয়। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে মেয়েটা থাকে উন্মাদ করে দেবে। সর্বনাশ ঘটে যেতে বেশি সময় নেবে না। তাই সে কিছু একটা ভেবে আবার বসে পড়ে, পরিনিতাকে চেপে কোলে বসালো। গাল ধরে মুখ উঁচু করে তুলে, চোখে চোখ রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আমাকে পেতে চাও? ঠিক আছে। তাহলে চলো, বিয়ে করে নেই। তারপর দিনরাত যত চাইবে, তত পাবে। আনলিমিটেড। সঙ্গে বিয়ের এক বছর ঘোরার আগেই তোমার শখের বাচ্চা-কাচ্চাও পেয়ে যাবে। বলো, রাজি?”
আবিদের কথায় পরিনিতা চোখ বড় বড় করে তাকালো তার দিকে।
আবিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কাল না! চলো, এখনই কাজির বাসায় গিয়ে বিয়ে করে নেই। তারপর বাকি রাতটা তোমার।”
পরিনিতা আবিদের কথায় ঢোক গিলল।
এই লোক কি বলতে চাচ্ছে? সে কি লুচু?
আর বড় দাদান আর আব্বুর অনুমতি ছাড়া বিয়ে করার মতো কলিজা পরিনিতার নেই।
আবিদ আবার বলল,
“বলো, রাজি?”
পরিনিতা আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
“চলুন, বাসায় যাই।”
বাঁকা হাসলো আবিদ। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“Good girl!”
আবিদের স্পর্শে শিহরিত হলো পরিনিতা। বসা থেকে উঠে, পরিকে কোলে নিয়ে হাতটা ধরলো।
বাড়ির রাস্তায়, পরিনিতা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।
এই আধার রাত তাদের ভালোবাসার কিছু মুহূর্তের সাক্ষী হল।
সকাল ১১টা।
শুদ্ধের গাড়ি ছুটে চলে গেছে সিলেটের বিখ্যাত উত্তর সুরমা উপজেলার জালালাবাদ হাইওয়ের উপর দিয়ে।
তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সামনে পেলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।
সে ভীষণ তিক্ত, বিরক্ত।
কাল সারারাত ড্রাইভ করে সে সিলেট এসেছে মূলত একটি মেডিকেল ক্যাম্পিংয়ের জন্য।
সে এই ক্যাম্পিংয়ে কিছুতেই আসতে চায়নি—সে একজন সার্জন, আর সার্জনদের ক্যাম্পিংয়ে কোনো কাজ থাকেনা।
তবুও কর্তৃপক্ষ এমনভাবে অনুরোধ করলো যে, ফেলতে পারে নি শুদ্ধ।
মেডিকেল ক্যাম্পিং-এর উদ্দেশ্যে কালকেই সবাই সিলেট চলে এসেছে, কিন্তু শুদ্ধর কাল গুরুত্বপূর্ণ দু’টো সার্জারি থাকায় সে দলের সাথে আসতে পারেনি।
শুদ্ধ গুগল ম্যাপস দেখে গাড়ি ড্রাইভ করছিলো।
তার মধ্যেই ফোন বেজে উঠলো।
শুদ্ধ গাড়ি ব্রেক করে ফোন রিসিভ করলো। গাড়ি থেকে নেমে কথা বলতে শুরু করলো।
ডাঃ শর্মা বিনয়ী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনি কোথায়?”
শুদ্ধ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রবল বেগে ছুটে এসে কেউ একজন তার সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো।
অমনোযোগী থাকা শুদ্ধ তাল সামলাতে না পেরে আগন্তুককে নিয়ে পাশের ফুটপাতে উল্টে পড়লো।
হাতে ধরা ফোনটাও দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো।
পিচঢালা রাস্তায় পড়ে শুদ্ধ মাথা-পিঠে হালকা ব্যথা পেলো।
আগে থেকেই বিরক্ত ছিল শুদ্ধ, তার উপর মেয়ে মানুষ উড়ে এসে গায়ে পড়েছে—বুঝতে পেরে, তার ঘেঁটে থাকা মেজাজ সামলে পারলো না।
নিজের উপর পড়ে থাকা মেয়েটাকে ঝাড়া মেরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো।
শুদ্ধ আচমকা ঝাড়া মেরে উঠে যাওয়ায়, মেয়েটা ফুটপাতের নুরি পাথরে পড়ে হাতে কুনুইতে ব্যথা পেলো।
ততোক্ষণে তার বান্ধবীরাও চলে এসেছে।
মেয়েটা ‘আহ! আহ!’ শব্দ করতে করতে কুনুই ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উঠে দাঁড়ালো।
শুদ্ধ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। সে কণ্ঠে পাঁচ বালতি বিরক্তি আর রাগ ঢেলে ঝাঁঝিয়ে বললো,
“এই মেয়ে! চোখ কী বাসায় রেখে রাস্তা নেমেছো? যে অন্ধের মতো যাকে-তাকে ধাক্কা মেরে দিচ্ছিস?”
মেয়েটার হাত গড়িয়ে রক্ত পড়ছে।
কিন্তু শুদ্ধর অপমানজনক তীক্ষ্ণ বাণী কানে আসতেই মেয়েটা ক্ষুব্ধ হল, তার রক্তে আগুন ধরে গেলো।
সে শুদ্ধের দিকে না-তাকিয়ে তির্যক কণ্ঠে বললো,
“তা আপনি কোন দেশের প্রেসিডেন্ট, যে আপনাকে ধাক্কা দেয়া যাবে না? বেশ করেছি ধাক্কা দিয়েছি, আবার দেবো!”
মেয়েটার কণ্ঠটা কানে আসতেই শুদ্ধ থমকালো।
গলার স্বরটা কি ভীষণ চেনা লাগলো তার কাছে!
কিন্তু এসব পাত্তা দিলো না।
মেয়েটার বলা কথায় তার রাগ চড় চড় করে মাথায় উঠলো।
সে ধমকে বললো,
“বড়দের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়, সেটা ও জানো না, বেয়াদব মেয়ে?”
মেয়েটার বান্ধবীরা আতকে উঠলো।
রুহি বললো, “প্রিয়স্মিতা যদি এখন এই ব্যাটাকে মেরে দেয়, তখন কি হবে? এপ্রোন দেখে তো মনে হচ্ছে, এই ব্যাটা ডাক্তার?”
জারা ও ভয়ে ভয়ে তাকালো প্রিয়স্মিতার দিকে।
প্রিয়স্মিতার হাতের মুঠো শক্ত।
সে অগ্নি চোখে শুদ্ধর দিকে তাকাতেই তার পৃথিবী থেমে গেলো।
আশেপাশের পাশের দুনিয়া স্টপ হয়ে গেলো।
দৃষ্টির ক্রুদ্ধ সেকেন্ডেই গায়েব হয়ে গেলো।
প্রবল রোদের তাপে শুদ্ধর অতি সুদর্শন চেহারা খানা কিছুটা রক্তিম।
তার উপর তার বিরক্তি মাখা মুখের গা-ঝালানো এক্সপ্রেশনে প্রিয়স্মিতা মাথা ঘুরে গেল।
মুহূর্তেই শুদ্ধের রূপের আগুনে ঝলসে গেলো।
শুদ্ধ তখনও নন-স্টপ ধমকেই যাচ্ছিলো। ধমকাতে ধমকাতে হঠাৎ শুদ্ধের দৃষ্টি আটকালো মেয়েটার চোখের দিকে। সাথে সাথেই থমকে গেলো শুদ্ধের শব্দগুচ্ছ। মেয়েটা কলেজ ড্রেস পরে আছে। কাঁধে কলেজ ব্যাগ, মুখে কালো মাস্ক। দুই পাশে বেণী, দু’টো হাঁটু নিচ অবধি ঝুলছে। কিন্তু এসবের দিকে দৃষ্টি আটকালো না শুদ্ধের। সে থমকে গেছে সেই চিরচেনা, পরিচিত, প্রিয় নীলাভ অক্ষিযুগলের — সেই প্রিয় চোখ দু’টো’র চাহুনিতে। শুদ্ধের বুকে ভিতরে হাতুড়ি পিটাতে শুরু করলো। কিন্তু সেই নীলাম্বরী এখানে আসবে কীভাবে? আর এই মেয়েটার ঝাঁজের এক শতাংশও সেই হৃদয় হরণীর মধ্যে নেই। সেতো কোমল।
শুদ্ধের ধূসর বর্ণের চোখের চাহনিতে মুহূর্তে ঘায়েল হয়ে হুঁশ করে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যেতে নিলো প্রিয়স্মিতা। সাথে সাথেই শুদ্ধ নিজের অজান্তেই তার কোমর আঁকড়ে ধরলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো।
রুহি দৃষ্টি-বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“এমন টানটান উত্তেজনার মধ্যে কেউ অজ্ঞান হয় !”
শুদ্ধ কোমর আঁকড়ে ধরে অতি মনোযোগ সহকারে চেয়ে আছে মেয়েটার বন্ধ চোখের দিকে। এই চোখের পাপড়িগুলোও প্রচণ্ড চেনা লাগছে। সে কৌতূহলবশত মেয়েটার মাস্কে হাত দিতে যেতেই পেছন থেকে তুহিনা চিত্কার দিয়ে ডাকলো,
“শুদ্ধ ভাই!”
তুহিনার কথায় থেমে গেলো শুদ্ধ। আচমকাই মেহরিমার কোমর ছেড়ে দিলো। সাথে সাথেই ধরে ফেললো জারা।
ডাঃ রেজা, ডাঃ শর্মা আর তুহিনা ছুটে এলেন। ডাঃ শর্মা বললেন,
“এই কী! স্যার, আপনি এখানে? আর অ্যাপ্রনটা এভাবে নষ্ট হলো কীভাবে?”
শুদ্ধ নিজের অ্যাপ্রনের দিকে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো। ডাঃ রেজা বললেন,
“স্যার, আপনি চলুন এখান থেকে, এই রোদের মধ্যে থাকবেন না।” শুদ্ধ সম্মতি জানালো। তুহিনা শুদ্ধের ফোনটা কুড়িয়ে এনে দিলো। জারার কাছে থাকা প্রিয়স্মিতার দিকে তাকিয়ে সন্দেহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? আর মেয়েটা-ই বা এভাবে পড়ে আছে কেন?”
কিন্তু শুদ্ধ তুহিনাকে ৫ পয়সারও গুরুত্ব দিলো না। ডাঃ শর্মা বললেন,
“স্যার, আর গাড়িতে যেতে হবে না।”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“কেন?”
ডাঃ রেজা বললেন,
“হাসপাতাল অথরিটি থেকে এই পাশের কলেজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
শুদ্ধ আশ্চর্য কণ্ঠে বললো,
“হোয়াট?”
ডাঃ রেজা ভয়েই ঢোক গিললেন, গলা ভিজিয়ে বললেন,
“ইয়েস, স্যার।”
শুদ্ধ উল্টো ঘুরে যেতে যেতে বললো,
“ইম্পসিবল! আমি কলেজে থেকে ক্যাম্পিং করতে পারবো না। আই উইল ব্যাক টু ঢাকা!”
ডাঃ রেজা আর ডাঃ শর্মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কর্তৃপক্ষকে ফোন লাগালেন। সকলে গেটের কাছেই ছিলেন। শর্মার কল পেয়ে একপ্রকার ছুটে এলেন। সুদ্দো গাড়ির দরজায় হাত দিতেই হেড এসে অনুরোধ করতে শুরু করলেন,
“প্লিজ স্যার, এই ক্যাম্পেইনে আপনার উপস্থিতি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট। প্লিজ স্যার, আপনার জন্য এক্সট্রা হোটেল বুকিং করে রেখেছি।”
শুদ্ধ শান্ত চোখে তাকালো অথরিটি হেডের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে গাড়িতে বসতে বসতে বললো,
“অ্যাড্রেস সেন্ড করবেন। আই নিড টু রেস্ট।”
বলে শু করে চলে গেলো। হেড হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
তুহিনাকে এখনো সন্দেহদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়স্মিতার দিকে। ডাঃ শর্মা বললেন,
“চলুন, মিস চৌধুরী।”
তুহিনা আর না ভেবে পা বাড়ালো কলেজের দিকে। রুহি পাশের দোকান থেকে পানি এনে মাস্ক সরিয়ে মেহরিমার চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরলো মেহরিমার। জারা বললো,
“হঠাৎ করে ওই ডাক্তারে দেখে জ্ঞান হারালি কেন?”
রুহি বললো,
“ওই ডাক্তার তোকে কতগুলো কথা শুনালো, অথচ তুই কিছু না বলেই জ্ঞান হারালি!”
শেম, প্রিয় — প্রিয়স্মিতা এবারও কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলো না। তার বুকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, তোলপাড় চালাচ্ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে মনের থির। চোখের সামনে ভাসছে শুদ্ধের রাগান্বিত মুখ।
প্রিয়স্মিতাকে হ্যাং হয়ে যেতে দেখে ওরা বিস্ফোরিত চোখে একে অপরের দিকে তাকালো। জারা হাতে পানি নিয়ে প্রিয়স্মিতার মাথার তালুতে দিয়ে বললো,
“তুই ঠিক আছিস ভাই?”
প্রিয়স্মিতা জারার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তোড়াক করে বসা থেকে উঠে পড়লো। মাথা ঝেঁড়ে বললো,
“হেই শালিরা, বাই বাই, কাল দেখা হবে।”
বলে বাঁকা হেসে উল্টো হাঁটা দিলো।
রুহি চিত্কার দিয়ে বললো,
“প্রিয়! রিভেঞ্জ নিবি না? দাঁড়া, শুন—!” কিন্তু কারো কোনো কথা না শুনেই চলে গেলো প্রিয়স্মিতা। তার পানপাতা মুখে লেগে আছে রহস্যময় হাসি।
রুহি বললো,
“এটা কী হলো?”
জারা ও আশ্চর্য হয়ে অবাক কণ্ঠে বললো,
“এই প্রথম বার ও কাউকে আস্ত ছেড়ে দিলো!”
সৃষ্টি বললো,
“তোর কী মনে হয়?”
নুহা বললো,
“তোরা ওইসব বাদ দে। ওই ডাক্তারটাকে দেখেছিস কি হট অ্যান্ড সেক্সি? আর অ্যাটিটিউড দেখেছিস?
হায়, দিল পানি পানি হো গয়া!”
রুহিও একই ভঙ্গিতে,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪১
“হে ইয়ার! এত হট ডাক্তার! আমার হোল লাইফে — আর একবারও দেখিনি!”
রুহি সন্দেহজনক কণ্ঠে বললো,
“তোদের কী মনে হয়, প্রিয় ওই ডাক্তারের হটনেস দেখে টাসকি খেয়েছে?”
জারা পাত্তা না দিয়ে বললো,
“ইম্পসিবল! ও কোনো ছেলেকে দেখে টাসকি খাবে — এটা হতেই পারে না!”
রুহি বললো,
“তাহলে জ্ঞান হারালো কেন?”
সৃষ্টি একটু ভেবে বললো,
“সে তো ওই ভালো বলতে পারবে…”