ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৫

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৫
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

রাজ, প্রেম, অরণ্য, সমুদ্র—সবাই গিয়ে ধপাস ধপাস করে ভাই ভাবীর দুই পাশে বসে পড়লো।
অরণ্য ফোন ক্যামেরা অন করে প্রীতমকে বললো,
“মেজদা, তোমার শান্তির দিন শেষ। এবার মেজ ভাবির দিন শুরু হবে। তাই এই আনন্দে আসো, একটা গ্রুপ সেলফি তুলি। এখানে পরি, নেই, না হলে এই ডিপার্টমেন্টটা ওর।”
অরণ্যের কথায়…
রাজ কপাল কুঁচকালো, কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,

“কেনো, কেনো? শান্তির দিন শেষ হবে কেনো? এখন তো মেজদার সুখের দিন শুরু। সবে তো বিয়ে হলো, এর পর আরও কত কিছু হবে। আমরা চাচ্চু হবো, মেজদা বাবা হবে। সুখ আর সুখ—দুঃখের কী?”
প্রীতম কঠিন চোখে তাকালো ভাইদের দিকে, কিন্তু ওরা সেটার থোড়াই না কেয়ার করলো।
অরণ্য আবার বুজুর্গদের মত মাথা নাড়িয়ে বলল,
“পুরুষ মানুষের জীবনচক্র বড়ই বিচিত্র। তাহারা কখনোই নিজেদের ইচ্ছার স্বাধীন থাকিতে পারেনা। তাহাদের জীবন বড়ই করুন—যাহা সুখ করিবার তাহা বিবাহের আগ পর্যন্ত করিয়া নিতে হয়। কারণ, জীবনে পত্নীদেবির আগমন ঘটিলে সুখ শান্তি নিজ দায়িত্বে হইতে বিদায় নিয়া চলিয়া যায়।”
অরণ্যের কথায় প্রীতম ও প্রেম চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অরণ্যের দিকে।
সমুদ্র চিন্তায় পড়ে গেলো, ভাবুক কন্ঠে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেমন?”
অরণ্য এবার গম্ভীর হলো। প্রেমকে দেখিয়ে বললো,
“এই যে বৎস, এই বালকের দিকে চাহিয়া দেখ। এই যে কয়দিন মাত্র হইয়াছে বিবাহ করিয়াছে, ইহার মধ্যে তাহার চেহারার পরিবর্তন হইতে শুরু করিয়াছে।”
তিন ভাই একসঙ্গে তাকালো প্রেমের দিকে।
প্রেম বিরক্ত।
কিন্তু অরণ্য প্রেমের বিরক্তিকে তোয়াক্কা করল না, আবারো বলতে লাগলো,
“বিবাহের পর এই বালকের কলিজার সাহস যেন পাঁচ কেজি হ্রাস পাইয়াছে। আর সুখ-শান্তির কথা তো ছাড়িয়াই দিলাম। মুখখানটি দেখো—পূর্বে যেমন ছিল, এখন আর তেমনটি নাই। আজ এই দশা, মেজদারও খুব তাড়াতাড়ি হইতে চলিয়াছে তাই! সুখের জীবনের অন্তিম সেলফি।”

প্রেম এতক্ষণ ওর বদরামো শুনছিলো, এবার অরণ্যের কান টেনে ধরে বললো,
“আচ্ছা, আমাদের সুখের জীবনের সমাপ্তি হয়ে গেছে—তা তুই এত কিছু জানিস কিভাবে? আমাদের না বলে কয়টা বিয়ে করেছিস?”
অরণ্য চিৎকার দিয়ে কান ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
“উফফ! লাগছে ছোড়দা! আচ্ছা ঠিক আছে, এর পর থেকে আর সত্যি কথা বলবো না! উফ, আজকাল সত্যি বলে ও শান্তি নেই।”
প্রীতম এবার সবাইকে ধমকে বললো,

“বদরামো শেষ হলে থাকলে আমরা বাড়ি যেতে পারি।”
প্রীতমের কথা শুনে না চাইলেও অরণ্যের নিষ্পাপ মনে দুষ্টু দুষ্টু চিন্তারা উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করলো।
সমুদ্র ওর মুচকি মুচকি হাসতে দেখে কপাল কুঁচকে বললো,
“আবার হাসছি কেনো?”
অরণ্য প্রীতমের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপ দিয়ে বললো,
“মেজদার তাড়াহুড়োটা দেখেছিস, তর সইছে না যেন। চল ভাই, ফুল কিনতে যাই।”
অরণ্যের কথায় এবার রাজ আর প্রেমও মুচকি হাসতে শুরু করলো।
ইনায়া লজ্জায় মাথা নীচু করে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে।
প্রীতম আবার অরণ্যের কান টেনে ধরে বললো,

“এই মুখ দিয়ে যদি আরেকটা বাজে কথা বেরিয়েছে, তো এখানেই কান টেনে ছিড়ে নেবো!”
অরণ্য আবার চিৎকার দিয়ে কান ছাড়িয়ে নিলো।
সমুদ্রকে টেনে তুলে বললো,
“চল ভাই, তাজা ফুল কিনে নিয়ে আসি। ভাই হিসেবে আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে—না হলে পরে দেখা যাবে, ছোড়দার মতো মেজদাকেও বাগানের খালি গোলাপ আর বেলি দিয়ে কাজ সারতে হবে!”
এবার প্রেম মারতে নিলে, ওরা দৌড় দিলো।
প্রেম বললো,

“তাহলে বাড়ির দিকে যাওয়া যাক মেজদা!”
প্রীতম সম্মতি জানালো।
ইনায়ার হাত শক্ত করে ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“চলো, তোমার নিজের বাড়ি। আজ থেকে ওটাই তোমার আসল ঠিকানা।”
ইনায়া অশ্রু চোখে তাকালো প্রীতমের দিকে।
প্রীতম, প্রেম, রাজ আর ইনায়া গিয়ে গাড়িতে বসলো।
অরণ্য আর সমুদ্র সত্যি সত্যিই ফুল কিনতে চলে গেছে।
শিকদার পরিবেশ বেশ চুপচাপ ও থমথমে।
কোনো প্রকার কোনো ফুসফাসের শব্দ আসছে না।
শিকদার বাড়ির সকলে বর্তমানে শিকদার বাড়ির ড্রইংরুমে উপস্থিত।

এই বাড়ির কর্তা সাদমান শিকদার ও তার দুই ভাই গম্ভীর মুখে ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছেন।
অনুস্রী বেগম, তনুস্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থি বেগম চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রেরণা, পরিনীতা, প্রিয়তা, থিরা, থোরি, ঊষা, তন্ময়, পূর্ণতা—ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে।
প্রণয় সোহেব শিকদার-এর পাশে সিঙ্গেল সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে।
তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছে।
শিকদার বাড়িতে আসা মহিলারা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত।
শিকদারদের পারিবারিক বিষয়ে বাইরের মানুষের চর্চা নিষিদ্ধ।
তাই শিকদাররা কী করলো না করলো—তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
প্রিয়তা ভায়ার্ত মুখে পরিনিতার বাহু ঝাঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার কিন্তু একটা বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে আপু।”

পরিনিতা ও ভীষণ ঘাবড়ে আছে।
প্রিয়তার কথায় তার স্তম্ভিত ভাব ফিরলো।
প্রিয়তা আবার বললো,
“আমি আমার ভাইকে যতটুকু চিনি, বড় কিছু না হলে সে অত সহজে মাথা গরম করে না আপু, নিশ্চয়ই বড় কিছু হয়েছে।”
পরিনিতা ভুরু কুঁচকালো,
“তাহলে কি বলতে চাস?”
প্রিয়তা ভয় ভয় বললো,
“তুমি একটা খবর জানো তো?”

“কি?”
প্রিয়তা আবার ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভাইয়া আর ইনায়া একে অপরকে ভালোবাসে। আর ইনায়া কাল থেকে একদম লাপাত্তা হয়ে গেছে। ফোন ধরে না, দেখা-ও করে না, কলেজে-ও আসে না, একদম হারিয়ে গেছে যেনো। তার মাঝে আজ ভাইয়া ‘রসগোল্লা’ বলে চিৎকার দেওয়াটা শুনেছো?”
প্রিয়তার কথায় পরিনিতা অবাক হলো না, কারণ সে এসব আরও কয়েক বছর আগে থেকেই জানে, কিন্তু ভয়ে আর চিন্তায় আজকের ব্যাপারটা অত গভীরে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি।
সে ছোট করে বলল,
“হুম, শুনেছি।”
প্রিয়তা আবার বললো,
“ভাইয়া ইনুকে অনেক ভালোবাসে আপু, অনেক মানে অনেক ভালোবাসে। আর ভালোবেসে ‘রসগোল্লা’ বলে ডাকে—এটা ইনুই আমায় বলেছে। তো আমার মনে হচ্ছে ওর জন্যই ভাইয়া ওভাবে বেরিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই ওর কিছু হয়েছে আপু।”

পরিনিতা ও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো।
সে ড্রইং রুমে লাগানো বড় ঘড়িটার দিকে দেখলো—রাত ৮টা বেজে ৫১ মিনিট।
পরিনিতা আবারো বাকি সব ভুলে গেলো, তার ভিতরটা চটফট করে উঠলো।
আজকে মাস্টার মশাই পড়াতে আসেননি আর এখনও ফোন তুলছেন না, পরিনিতা অতিরিক্ত চিন্তায় ঘামতে শুরু করলো।
কিন্তু পরিনিতার চিন্তা ভাবনা বেশি দূর এগোবার আগেই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো।
কলিং বেলের শব্দে পুরো ড্রইং রুমে মৃদু কম্পন হলো।
সকলেই ভয়ার্থ দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে সাদমান শিকদারের দিকে তাকালেন।
অর্থি বেগম ভয় ভয় গিয়ে সদর দরজা খুলে দিলেন।

সকলেই ছুটে গেলেন সদর দরজার দিকে।
দরজার বাইরে প্রীতম, প্রেম আর রাজ দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের দৃষ্টি শান্ত।
ছেলের চিন্তায় অনন্যা বেগমের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল,
কিন্তু এখন ছেলেকে অক্ষত দেখে মাতৃ মনে স্বস্তি পেলেন।
ছুটে গিয়ে প্রীতমের চোখ মুখ হাত ভুলালেন।
স্নেহ মাখা কণ্ঠে বললেন,

“তুই কাউকে কিছু না বলে ওভাবে কোথায় গেছিলি বাবা?
মায়ের চিন্তা হয় তো!”
সকলেই প্রশ্ননির্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন প্রীতমের দিকে।
ভয়ে প্রিয়তা আর পরিনিতার বুক ডিপ ডিপ করছে।
প্রণয় শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে।
অনন্যা বেগম আর কিছু বলবেন, তার আগেই প্রীতম পিছন থেকে ছোট একটা হাত টেনে ধরে সামনে আনলো।
বিস্ময়ে সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন।
ইনায়া সবার দৃষ্টিতে ভয়ে রীতিমতো মৃদু কাঁপছে।
ঘোমটা মাথায়, লাল শাড়ি পরিহিতা নববধূরূপী ইনায়াকে প্রীতম পাশে দেখে পুরো ড্রইং রুমে যেন নিঃশব্দে বজ্র পড়লো।

সকলের অক্ষি স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
কয়েক সেকেন্ড পার হওয়ার আগেই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেলেন ড্রইং রুমে উপস্থিত প্রত্যেকে—
শুধু নির্বিকার চারজন:
সাদমান শিকদার, খালিদ শিকদার, প্রণয় শিকদার আর প্রীতম শিকদার।
রাজ আর প্রেমও মনে মনে হালকা হালকা ভয় পাচ্ছে।
প্রেম শক্ত করে ইনায়ার হাত চেপে ধরে বাড়ির ভিতর এক পা দেওয়ার সাথেসাথেই হুংকার দিয়ে উঠলেন সাদমান শিকদার,
“দাঁড়াও!”
হুংকারের শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো শিকদার বাড়ি।
কেঁপে উঠলেন প্রত্যেকে।
প্রিয়তা আর ঊষা ভয়ে চেপে ধরলো পরিনিতার দুই হাত।
সাদমান শিকদার ও খালিদ শিকদার গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেলেন প্রীতমের দিকে।
প্রীতম এখনও নির্বিকার,

কিন্তু ইনায়া রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে।
সাদমান শিকদার এগিয়ে এসে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলেন প্রীতমের বা গালে।
আবারো ভয়ার্থ চোখে তাকিয়ে কেঁপে উঠলো প্রত্যেকে।
সাদমান শিকদার রাগে ক্ষোভে ফুসে উঠলেন।
কাঁপতে লাগলো উনার পুরো শরীর।
তিনি এবার প্রীতমের ডান গালে সজোরে আরেকটা চড় মেরে চেঁচিয়ে বললেন—
“এই দিন দেখার জন্য তোমাদের মাথায় করে ছোট বড় করেছি?
এই দিন দেখার জন্য তোমাদের প্রতিটা চাওয়া-পাওয়া মিটিয়েছি?
এই দিন দেখার জন্য?

তোমরা খুব ভালো করে জানো এই সাদমান শিকদারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার বংশ মর্যাদা।
আর তোমরা বারবার সেই জায়গায় আঘাত করো—
যে মান মর্যাদা আমাদের বংশীয় প্রতীক, যাকে আমাদের পূর্বপুরুষরা রক্ষা করেছে এত বছর নিষ্ঠার সাথে, মেনে চলেছে বংশীয় প্রত্যেকটা নিয়ম কানুন।
আর তোমরা এভাবে সেটা কে পায়ে পিষলে?

তোমাদেরকে ভালোবেসে বড় করার প্রতিদান হিসেবে আমাকে এভাবে সমাজের সামনে অসম্মান করলে?
তোমাদের প্রত্যেককে ছোট থেকে বোঝানো হয়েছে এই শিকদার বংশের রীতি-নীতি, আদব কায়দা।
তার পরও তোমার একবারও মনে পড়লো না, বিয়ের আগে আমার থেকে অনুমতি নেওয়া উচিত, কুলাঙ্গার সন্তান?”
মাথা নিচু করে নিল প্রীতম।
সাদমান শিকদার রাগে কাঁপতে কাঁপতে আবার বললেন,
“তুমি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।
এই সাদমান শিকদার তোমার মুখটা ও আর দেখতে চায় না!”
তিনি এবার প্রেমের দিকে তাকালেন।
একইভাবে হুংকার ছেড়ে বললেন,

“তুমিও আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।
তোমার মুখ ও আমি দেখতে চাই না!”
সাদমান শিকদার এবার গলা ফাটিয়ে চিত্কার দিয়ে বললেন,
“বেরিয়ে যাও তোমরা আমার বাড়ি থেকে!
আমার শিকদার বাড়িতে যেন আর কোনোদিনও তোমাদের পা না পড়ে!”
সাদমান শিকদারের কথায় অনুস্রী বেগম ও অনন্যা বেগম আতকে উঠলেন।
অনন্যা বেগম এক প্রকার ছুটে গিয়ে সাদমান শিকদারের পা জড়িয়ে ধরলেন।
কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে অনুরোধ করে বললেন,

“দয়া করে এমন করবেন না ভাইজান, আমার একটা মাত্র ছেলে ভাইজান,
আপনার ভাই ও বাসায় নাই ভাইজান, দয়া করে আমার ছেলে কে আমার থেকে দূরে করে দেবেন না!
আমি আমার ছেলে কে ছাড়া থাকতে পারবো না!”
প্রীতম আর চুপ থাকলো না।
ছুটে এসে মা কে তুললো।
সাদমান শিকদারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নত কণ্ঠে বললো—
“আমি জানি আমি আপনার বংশের মান-মর্যাদা ডুবিয়েছি।
কিন্তু এর জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো না, কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি।
আপনার সম্মান ও নষ্ট করিনি।

জীবনটা আমার—
তাই আমি যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করেছি।
আপনার বংশে থাকার জন্য, এই অদৃশ্য ইগো রক্ষা করার জন্য…?
আর যাই হোক—
এই প্রীতম শিকদার তার ভালোবাসার আহুতি কখনোই দিত না।
আমার জীবন—
আমি কাকে বিয়ে করবো, না করবো, সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।
ঠিক আছে, আপনার কথাই থাকলো—
থাকলাম না আপনার বাসায়, থাকলাম না আপনার শিকদার বাড়িতে।
এমনিতেই আমি আপনাদের পয়সায় খাই না।

আমার যথেষ্ট সামর্থ্য আছে আমার স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ দেওয়ার,
এমনকি আমি যদি আপনার বাড়িতে থাকতাম, তবুও আপনার পয়সায় আমার বউ পালতাম না।”
প্রীতমের দুঃসাহস দেখে উপস্থিত প্রত্যেকেই ভয়ে ঢোক গিললেন।
প্রেম ঊষাকে ডাকলো—
“ঊষা, এদিকে এসো।”

ঊষা ও আশেপাশে না দেখে, সামীর ডাক অনুযায়ী প্রেমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রেম বললো—
“আমরা আর এখানে থাকবো না।”
ঊষা শুধু তাকালো,
কিন্তু কিছু বললো না।
কারণ প্রেম তাকে যেখানে নিয়ে যাবে, সে সেখানেই যাবে।
অনুস্রী বেগম আর অনন্যা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
অনুস্রী বেগম স্বামীকে মিনতি করে বললেন,
“অনুগ্রহ করে এমন করবেন না।”
প্রেম আর প্রীতম নিজেদের স্ত্রীর হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে,
প্রণয় পিছন থেকে কঠিন কণ্ঠে বললো,

“দাঁড়া।”
সঙ্গে সঙ্গে দুই ভাই থেমে গেলো।
আবার সামনে ঘুরে তাকালো বড় ভাইয়ের দিকে।
প্রণয় এতক্ষণ নির্লিপ্ত চোখে সবই দেখছিল।
অনুস্রী বেগম ও তনুস্রী বেগমের চোখ আশায় চিকচিক করে উঠলো।
অনুস্রী বেগম ছুটে এলেন প্রণয়ের কাছে,
অশ্রু চোখে ছেলের হাত ধরে মিনতি করে বললেন,
“বাবা, দয়া করে তোর ভাইদের থামা। ওদের যেতে দিস না।”
প্রিয়তা অশ্রু চোখে আশা নিয়ে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় দুই ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,
শান্ত কণ্ঠে বললো,

“কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
প্রীতম মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“এই বাড়িতে থাকবো না, দাদান খুঁটা শুনে বাচার মানসিকতা নেই আমার।”
প্রণয় আবার ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
“কে খুঁটা দেবে শুনি?”
সাদমান শিকদার রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছেন প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় বাঁকা হেসে সাদমান শিকদারকে দেখিয়ে বললো,
“উনি।”
সবাই আরেক দফা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো।
প্রণয় আবার বললো,
“এই বাড়ি, এই সম্পত্তি এগুলো কি উনার?
এগুলো থেকে বের করে দেওয়ার উনি কে?
এগুলো সব কি উনার নিজের অর্জন করা?

এই বাড়ি, ব্যবসা, এই বিশাল সম্পত্তির কিছুই উনার একার নয়।
এটা যৌথ সম্পত্তি মানে সবার, উনার যেমন শেয়ার আছে, তেমনি তোদের সবার ও আছে।”
প্রণয় এবার প্রীতমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই বাড়িতে উনার যতটুকু অধিকার, সেজো চাচ্চুর—ও, ঠিক ততোটুকুই অধিকার।
তুই সেজো চাচুর ছেলে তোকে বের করে দেওয়ার উনি কে?
তুই এই বাড়িতেই থাকবি—
এটা তোর অধিকার।
তুই কাকে বিয়ে করবি না করবি—
এটা তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার।
সেখানে মতামত দেওয়ার বা কথা বলার উনি কে আশ্চর্য?”
প্রণয় ঠান্ডা মাথায় করা অপমানগুলো গরম কড়াইতে পানিতে ছিটা দেওয়ার মতো কাজ করলো।
সাদমান শিকদার প্রণয়ের দিকে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বললেন,
“বেশি বাড়াবাড়ি করো না প্রণয়, তোমার জন্য ভালো হবে না।”

প্রণয় বাঁকা হাসলো।
সাদমান শিকদারের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার আর কী খারাপ করবেন?
আর কি কেড়ে নেবেন?
সব তো কেড়ে নিয়েইছেন।
আমার জীবনে আর হারানোর কি বা বাকি আছে, তাই আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবুন।
আমার জীবনে হারানোর মতো কিছু না থাকলেও,
আপনার জীবনে অনেক কিছু আছে।

এই যে এদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে চান,
এরা দুজন আপনার কোম্পানির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভুলে গেলেন?
এরা আমার কোম্পানি থেকে চলে গেলে,
আপনার কোম্পানি জাস্ট মুখ থুবড়ে পড়বে।
এতে লসটা কিন্তু আপনারই হবে, আমার কী!
আপনি মরলে ও তো আমি দেখতে আসবো না।”
প্রণয় কথা শেষ করে প্রীতমদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার যা বলার বললাম, বাকিটা তোদের ব্যাপার।”
বলে প্রণয় ভাবলেশহীনভাবে উপরে চলে গেলো।
প্রীতম আর প্রেম ভাবলো—সত্যি তো!
তারা কেন চলে যাবে?

এটা তো তাদের অধিকার।
প্রীতম সাদমান শিকদারের উদ্দেশ্যে বললো,
“এই বাড়ি আমাদেরও, তাই বড় দাদান যা বললো তাই।
আমরা কোথাও যাবো না।
চল রসগোল্লা।”
বলে ইনায়ার হাত টেনে নিয়ে উপরে চলে গেলো।
ঊষাও গেলো।
অনুস্রী বেগম ও তনুস্রী বেগম কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন।
এবার একে একে সকলে ড্রয়িং রুম ছাড়তে লাগলেন।
শুধু ছাড়লো না পরিণীতা।

সাদমান শিকদারের বলা এক একটা কথা পরিণীতার বুকে বিষের ছুরির ন্যায় আঘাত করেছিল।
সাদমান শিকদারের বলা এক একটা কথায় পরিণীতার পায়ের জমি একটু একটু করে সরে গেছে।
আজ পরিণীতা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে, মাস্টারমশাইয়ের অতিরিক্ত চিন্তার কারণ।
আজ পরিণীতা সত্যি সত্যি বুঝলো—
পরিণীতা ভালোবেসে জীবনে কত বড় ভুল করেছে।
এই ভুলের মৃত্যু ব্যতীত কোনো ক্ষমা নেই।
নিজের ভালোবাসা পেতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিলেও,
সাদমান শিকদারের মন গলবে না।
তিনি কোনোদিনও তার আর তার মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্ক মেনে নেবেন না।
পরিণীতার চোখে মণি পানিতে টলমল করে উঠলো।
বুকের ভিতরে খুব গভীরে বিষাক্ত যন্ত্রণার নীল বিষ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে শংকিত হতে লাগলো হৃদয়।
সে ছুটে চলে গেলো ড্রয়িং রুম থেকে।

এবার খালিদ শিকদার এসে বাঁকা হেসে সাদমান শিকদারের কানে কানে বললেন,
“আপনার একটু একটু করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য আপনার চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে ভাইজান।
দেখছেন, এই প্রজন্মের একটা ছেলে-মেয়ে ও আমাদের মতো নয়।
প্রীতম আর প্রেম চোখের নিমিষেই হাতছাড়া হয়ে গেলো।
আর আপনি ও খুব ভালো করে জানেন, আজ না হোক কাল, পরী ও এমনটাই করবে।
এরা ছেলে বলে আপনার সম্মান বেশি নষ্ট হয়নি কি?
কিন্তু পরী যখন ওই বিখিরি কুল-মর্যাদাহীন ছেলেটার সঙ্গে চলে যাবে,
তখন গ্রাম লোক আপনাকে দেখে হাসবে ভাইজান।
থুথু দেবে আপনার মুখে।

জুতার মালা পরাতে আসবে বাড়ি বয়ে।
আপনার দম্ভ, গৌরব—সব নষ্ট হয়ে যাবে।
আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না ভাইজান।
আপনি আমার কথায় খারাপ নেবেন না।
পরীকে এখুনি প্রনমীর কাছে পাঠিয়ে দিন।
ও মেয়ে আমাদের কোনো কাজে লাগবে না।
তার থেকে ভালো, না সম্মান নষ্ট করার আগেই শেষ করে দিলেন।”
খালিদ শিকদারের কথায় সাদমান শিকদারের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো।
রক্তলাল চোখে তাকালেন খালিদের দিকে,
দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,

“আমার মেয়েকে নিয়ে যে শেষে কথাগুলো বললি, তার পুনরাবৃত্তি যদি আর কোনদিন করেছিস, তবে আমি নিজের হাতে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।
আর আমার মেয়ের চিন্তা তোকে করতে হবে না।
তুই তোর মেয়ের চিন্তা কর।
আর ওই ফকিন্নির ছেলের ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি।
ওকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই।”
বলে সাদমান শিকদার চলে গেলেন।

খালিদ শিকদার দাঁতে দাঁত চেপে অপমান হজম করে নিলেন।
মনে মনে পণ করে বললেন,
“তোমাদের যদি আমি ধ্বংস করে দিতে না পারি, তবে আমি ও খালিদ নই।”
কিন্তু একটা কথা শুনে খালিদ শিকদার থমকালেন।
ওই ছেলেটার ‘ব্যবস্থা’ করে ফেলেছে—মানে?
কি করে ফেলেছে?
মেরে টেরে ফেলেছে নাকি?

যদি ও মেরে ফেললে মন্দ হবে না।
ওই মেয়ের যা তাল দেখলাম, ওই ছেলেটার যদি কিছু হয়, তবে ওই মেয়েও বাঁচবে না।
ঠিক ওর বোনের মত।
আমি নিশ্চিত, ওই ছেলেটা মরে গেলে—
ও নিজের বোনের মতো গলায় দড়ি, কলসি নিয়ে পদ্মপুকুরে ডুবে মরবে।
তবে আপাততঃ উনি উনি পরিনিতার ভাবনা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিলেন,
উনার মাথায় তো অন্য কিছু চলছে।
কিছু একটা ভেবে বাকা হেসে ফোন লাগালেন সাজিদ শিখদার এর নাম্বারে।

সাজিদ শিকদার
তৃপ্তি বেগম বসে আছেন ডাইনিং টেবিলে।
সাজিদ শিখদার প্রিয়শ্মিতা কে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছেন,
তৃপ্তি বেগম পাশে বসে নয়ন ভরে দেখছেন সেই দৃশ্য।
যদিও উনি নিজের কাছে পরিষ্কার না,
নিজেকে বড় অপরাধী লাগে মাঝে মাঝে।
সাজিদ শিখদার প্রিয়শ্মিতার মুখে ভাতের লুকমা তুলে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“মাম্মা তোমার নামে আবার আমার কাছে নালিশ আসছে,
তোমাকে না কতদিন বলেছি তুমি বড় হচ্ছো,
এখন একটু চালচলন পাল্টাতে হবে।”
প্রিয়স্মিতা খাবার চিবোতে চিবোতে ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
“সবগুলো যাত মিথ্যাবাদী পাপ্পা আমি কিছু করি নাই।”
সাজিদ শিখদার আর কি,

মেয়ের মায়া ভরা মুখ দেখে গলে গেলেন।
তবুও ও কিছুটা শক্ত থাকার ভান করে বললেন,
“তবে যে ছেলেটার বাবা আমার কাছে বিচার দিল,
তুমি নাকি মেরে তার ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছো?”
প্রিয়শ্মিতা সাথে সাথে দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো,
কষ্ট পাওয়ার অভিনয় করে বললো,
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না পাপ্পা,
আমার থেকে তোমার কাছে কার না কার ছেলের কথা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
তৃপ্তি বেগম খেক করে উঠে বললেন,
“বাপ বেটির ঢং দেখে বাঁচি না,
বাপের শাসনের নামে খেজুরের আলাপ দেখলে গা জ্বলে যায়
বেশি কথা না বলে চুপ খাও দুজন।”

প্রিয়শ্মিতা আর সাজিদ শিখদার অসহায় মুখে একে অপরের দিকে তাকালেন।
প্রিয়শ্মিতা সাজিদ শিখদার কানে কানে মিনমিন করে বললো,
“বিয়ে করার জন্য বাংলাদেশে আর কোন মহিলা পাও নাই পাপ্পা?
এই দর্জাল মহিলা কোথা থেকে আমার জন্য বয়ে নিয়ে আসলে?”
মেয়ের কথায় হেসে দিলেন সাজিদ শিখদার।
খাবারের শেষ লুকমা মেয়ের মুখে দিয়ে বললেন,
“সব আমাদের কপালের দোষ মাম্মা,
তুমি একটু ভাবো কোনভাবে এটা রিপ্লেস করা যায় নাকি।”
প্রিয়শ্মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“না থাক, প্রতিদিন দুই বেলা ঘ্যানঘ্যান শুনতে, ভালোই লাগে।”
তৃপ্তি বেগম আবার ধমকে বললেন,

“কি গুজগুজ ফুসফুস হচ্ছে?”
সাজিদ শিখদার হাত ধুতে ধুতে বললেন,
“এটা আমাদের সিক্রেট, তোমাকে কেন বলবো, তাই না মাম্মা?”
প্রিয়শ্মিতা তাল দিয়ে বললো,
“একদম।”
সাজিদ শিখদার মেয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
“যাও মাম্মা, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
প্রিয়শ্মিতা প্রফুল্ল হেসে সাজিদ শিখদার দুই গালে দুটো চুমু খেয়ে বলল,
“গুড নাইট পাপ্পা।”
হাসলেন সাজিদ শিকদার,
মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“গুড নাইট প্রিন্সেস।”
প্রিয়স্মিতা দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

তৃপ্তি বেগম স্বামীকে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
“দাও দাও আরো লাই দাও মেয়েকে বেটা ছেলে বানিয়েছো!
এই বেটা ছেলে কোন বেটার ঘাড়ে ঝুলাবে ভাবছো?”
সাজিদ শিখদার তৃপ্তি বেগমের গাল টেনে বললেন,
“আমার বউ, আমাদের বাবা মেয়ের উপর খালি খালি রাগ করে।”
সামান্য এই কথায় তৃপ্তি বেগম গলে পানিপানি হয়ে গেলেন,
লজ্জা মিশ্রিত হেসে বললেন,
“আপনার বয়স যে ৫৫, এটা মনে আছে তো বুড়ো?
বুড়ো বয়সে এত রস কই পান?”

সাজিদ শিখদার দুষ্টু হেসে বললেন,
“আমাকে দেখে কেউ বলবে ৫৫?
সাজিদ শিকদার এখনো তরুণ সুদর্শন দেখতে,
এখনো ৩৫, কুমারী মেয়েরা বিয়ের প্রপোজাল দেয়।”
তৃপ্তি বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
“ঢং!”
তৃপ্তি বেগম আবার কিছু বলতে গেলে অনুভব করলেন কিছু।
থেমে বললেন,
“আপনার ফোন মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে ভাইব্রেট করছে।”
তৃপ্তির কথায় সাজিদ শিখদার সিরিয়াস হলেন।
রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে আরো সিরিয়াস হয়ে গেলেন।
তৃপ্তি বেগম এসে পাশে দাঁড়ালেন।
সাজিদ শিখদার একদম স্বাভাবিকভাবে ফোন রিসিভ করে সালাম দিলেন।

খালিদ শিখদার সালামের উত্তর দিয়ে কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
“তুই সিলেটে কি করতে যাস?”
খালিদ শিখদারের কথায় চমকে উঠলেন সাজিদ শিখদার।
তবুও ও নিজেকে শান্ত রেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“কিছু কি হয়েছে মেজ ভাইজান?”
খালিদ শিখদার এবার কিছুটা চেচিয়ে বললেন,
“তুই কি সিলেটে গিয়ে মরে গেছিস?
তোর বউ, ছেলে-মেয়েদের কোন খবর রাখিস তুই…”
সাজিদ শিখদার কিছুটা অবাক হলেন।
অবাক কণ্ঠে বললেন,

“কেন? কি হয়েছে ওদের? আমি সকালেরই তো আমার আম্মুর সাথে কথা বলেছি।”
খালিদ শিখদার আরো তিক্ত কণ্ঠে বললেন,
“তোর মেয়ের কথা বলিনি।”
খালিদ শিখদারের এত তিক্ত কথা শুনে সাজিদ শিখদারের মোটেও ভালো লাগলো না।
মেজ ভাইজানের ওযতা মেজাজ তিনি কেন সহ্য করবেন?
তাই কিছুটা রূঢ় কণ্ঠে বললেন,
“কিছু বলার থাকলে বলুন ভাইজান, আমার অনেক কাজ আছে।”
সাজিদ শিখদারের কথায় অপমানিত বোধ করলেন খালিদ শিখদার।
মনে মনে চটে গিয়ে বললেন,
“যেমন বাপ, তেমনি ছেলে-মেয়ে।”

খালিদ শিখদার এবার সোজা বললেন,
“তোর ছেলে একটা সামান্য কৃষকের মেয়ে কে বিয়ে করে এনেছে জানিস তুই?”
খালিদ শিখদারের কথায় তাজ্জব বনে গেলেন সাজিদ শিখদার।
বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,
“মানে?”
খালিদ শিখদার বুঝলেন কাজ হয়েছে। এবার তিনি রশিয়ে রশিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, তোর ছেলে বিয়ে করেছে।
তাও একটা সাধারণ চাষার মেয়ে কে!
আমার বংশের মান মর্যাদা দুলয় মিশিয়ে দিয়েছে…”
সাজিদ শিখদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“আমার ছেলে প্রাপ্ত বয়স্ক, অ্যাডাল্ট ভাইজান।
সে ইচ্ছা স্বাধীন, তাই তার যাকে পছন্দ তাকে বিয়ে করেছে।
এখানে আমার কোন সমস্যা নেই।
আশা করি আমার ছেলে কে নিয়ে আপনাদের ও কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।
আর ছেলেটা যেহেতু আমার,

তাই আশা করি আপনারা কেউ তাকে কোন কটু বাক্য বলবেন না।
আল্লাহ হাফেজ ভাইজান, শুভ রাত্রি।”
বলে ফোন কেটে দিলেন সাজিদ শিখদার।
সাজিদ শিখদার এর কথায় রাগে সারা শরীর জলে গেলো খালিদ শিখদার এর।
“কত বড় সাহস! যেমন ছেলে, তেমন বাপ! সবগুলো বিষাক্ত!”
তিনি রাগে গোজ গোজ করতে করতে বললেন, “তুই আমার বিজনেস কেড়ে নিয়েছিস, তোর মেয়ে আমার মেয়ের জীবনের সব সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। তোর ছেলে ও তাই, তোর মতো! তোরা এক একজন আমার জীবনের কাল সাপ! সব কয়টাকে আমি নিজের হাতে মারবো।”
বলে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলেন।
সাজিদ শিখদার কে চিন্তিত দেখে তৃপ্তি বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “এত চিন্তিত কেন? ওই বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? আপনার ছেলে মেয়ে ভালো আছে?”

সাজিদ শিখদার উত্তর দিলেন না, কল করলেন অনন্যা বেগমের নম্বরে। কয়েক বার রিং হতেই কল রিসিভ করলেন অনন্যা বেগম। সালাম দিয়ে ভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি সেটা জানতে? ও তো কোনোদিন ফোন দেন না। আজ নিশ্চয় ছেলের খবর নিতে ফোন দিয়েছেন?”
তৃপ্তি বেগম শুনলেন অনন্যা বেগমের কথাগুলো।

স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত কথা শোনার মতো নিচু মানসিকতা উনার নেই, তাই তিনি ব্যালকনিতে চলে গেলেন।
অনন্যা বেগমের কাঁপা কণ্ঠস্বর স্পষ্ট বুঝলেন সাজিদ শিখদার, তবু তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বললেন,
“প্রিথম কাকে বিয়ে করেছে আমি জানতে চাই না। ও আমার ছেলে, আমার ওর ওপর বিশ্বাস আছে। তুমি শুধু বলো, ও নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে তো?”
সাজিদ শিখদারের কথায় অনন্যা বেগমের বুকের ভার কয়েক গুণ ভারি হলো। সত্যি, মানুষটা তার জন্য একটু ভাবেও না?
কান্না আটকে রাখতে দুই হাতে মুখ চেপে ধরলেন অনন্যা বেগম।
সাজিদ শিখদার আবার বললেন,
“কি হলো? শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর দাও। আমার ছেলেকে, কেউ জোর করে বিয়ে দেয়নি তো?”
অনন্যা বেগম কান্না ধরে রাখতে পারলেন না, শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। থমকালেন সাজিদ শিখদার
আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।

অনন্যা বেগম আর কিছু না শুনে ফোন কেটে দিলেন।
বালিশে মুখ গুঁজে বাধনহারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“আমার ত্রিশ বছরের সংসার, সব মিথ্যে, সব, সব, সব মিথ্যে ছিল। পুতুল খেলার সংসার ছিল। সংসারে সত্যতা বলে কিছু নেই।
এই মানুষটা আমাকে ভালবাসেনি কোনদিনও।”
তিনি আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমার জীবনটা এমন কেন হলো? কেন আপনি আমায় ভালোবাসলেন না? কেন ভালোবাসলেন না? আমি তো আমার সবটা দিয়ে আপনাকেই ভালোবেসেছিলাম! তবে আমার ভালোবাসায় কি এমন কমতি ছিল যে আমি আপনার ভালোবাসা পেলাম না?”
অনন্যা বেগম চোখ মুছে উঠে বসলেন।
বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আয়নায় হাত ছুঁয়ে বললেন,
“কোথায় কমতি আমার?”
৪৫ বছর বয়সী অনন্যা বেগমকে দেখতে মোটেও ৪৫ লাগে না।
যে কেউ এক দেখাতেই বলবে ৩১ কি ৩২-এর বেশি নয়।
এখনো তরতাজা যৌবন, টানটান দেহের চামড়া, পানপাতা মুখে গভীর নিলাভো একজোড়া চোখ – যা নিঃসন্দেহে অতীব আকর্ষণীয়।

তবু, তার ‘স্বামী’ নামক মানুষটিকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, তাঁর হয়তো পুরো জীবনটাই ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ।
যে নারীকে তার স্বামী ভালোবাসে না।
সেই নারীর জীবনের প্রাপ্তির খাতায় বিরাট বড় একটা শূন্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
সাজিদ শিখদারের চোখে পানি চিকচিক করছে।
তিনি দ্রুত চোখ মুছে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তৃপ্তি বেগম আকাশ পানে চেয়ে আছেন।
সবার জীবনে পরিপূর্ণতা থাকে না।
তার জীবনে ও নেই।

সামির অফুরন্ত ভালোবাসা পেলে ও ওনার জীবন সুখ-শান্তি, ভালোবাসা—সব কারো দয়া।
ওনার জীবনের প্রাপ্তির খাতায় ও বিরাট শূন্য।
তিনি জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন অপরাধবোধের বোঝা কাঁধে নিয়ে।
সত্যি কি তিনি এক নারীর সব কিছু কেড়ে নিয়েছেন?
তার স্বামী, সন্তান সব?
কিন্তু তিনি তো কারো জীবনে ঢোকেননি। কারো স্বামী ও কেড়ে নেননি।
স্বামী তো উনার। উনি এসেছেন প্রথমে।
তবু ও কেন বুকের পাথরটা দিন দিন ভারী হচ্ছে?
কেন মনে হয়, তিনি এক নারীর সব কেড়ে নিয়ে তাকে দুঃখের সাগরে ছুঁড়ে মেরেছেন?
তিনি যেদিন জানতে পেরেছিলেন তাঁর পক্ষে কোনোদিন ও মা হওয়া সম্ভব না, তাঁর কি উচিত ছিল সেদিনি সাজিদ শিখদারের জীবন থেকে সরে যাওয়া?
কিন্তু সাজিদের অফুরন্ত ভালোবাসার লোভ তিনি সামলাতে পারেননি।
থেকে গিয়েছিলেন।

আর বুকে পাথর চেপে স্বামীর ভাগ দিয়ে দিয়েছিলেন অনন্যা বেগমকে।
বিনিময়ে অনন্যা বেগমের…
ভাবনা সম্পূর্ণ করার আগেই পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো।
মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
“আবারো কাঁদছো তৃপ্তি, তুমি তো জানো আমার জীবনে তুমি প্রথম ভালোবাসা ছিলে আর তুমি শেষ। আমি আর কাউকে জীবনে জড়াতে চাইনি, তুমিহীনা কাউকে ভালোবাসিনি। তবুও যা করেছিলাম বাধ্য হয়ে করেছিলাম। তোমাকে বাঁচাতে করেছিলাম। তুমি তো সব জানো তৃপ্তি, তবু ও কেনো কাদো?”
তৃপ্তি বেগম ঘুরে তাকালেন সাজিদ শিখদারের দিকে।
উনার ৩৫ বছরের সংসার জীবনে এই মানুষটার প্রতি ভালোবাসা কমতো দূরের কথা, দিনকে দিন ক্রমান্নয়ে বেড়েই গেছে।

তৃপ্তি বেগম সাজিদ শিখদারের বুকে মাথা রেখে বললেন,
“আমার খুব খারাপ লাগে জানেন? আমি হয়তো বিশাল বড় পাপ করেছি, কারো জীবনের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছি, স্বামী সন্তান কেড়ে নিয়েছি।
আমি মরলে হয়তো জাহান্নামে ও ঠাঁই পাবো না সাজিদ।
আমি কারো কাছ থেকে, তার অজান্তে, তার গর্ভের সন্তান কেড়ে নিয়েছি।
সে আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে—নিজের জীবনের সুখ শান্তি, ভালোবাসা, স্বামী, সন্তান – সব দিয়ে গেছে।
আমি কী দিয়েছি? অশান্তি, হতাশা, দুঃখ, কষ্ট – আর কিছু না।”
সাজিদ শিখদার তৃপ্তির মাথা বুকে চেপে ধরে বললেন,
“তোমাকে না কতদিন বারণ করেছি এসব নিয়ে ভাবতে? তুমি কারো কিছু কেড়ে নাওনি তৃপ্তি। এগুলো প্রথম থেকেই তোমার ছিল। আর প্রিয়স্মিতা, শুধু তোমার মেয়ে, আমাদের মেয়ে। আর কারো নয়।
তুমি কারো কিছু কেড়ে নাওনি।”
তৃপ্তি বেগম গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন সাজিদ শিখদারের দিকে।
ঠান্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“আপনি কি সত্যি তাকে কখনো একটু ও ভালোবাসেননি?”
থেমে গেলেন।

সাজিদ শিখদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে, তিনিও আকাশ পানে চেয়ে বললেন,
“তোমার কাছে গোপন করার বা মিথ্যে বলার কিছু নেই।
ভালবাসি কিনা জানিনা, তবে মনের খুব গভীরে সূক্ষ একটা টান অনুভব করি।
তার সাথে আমার এত বছরের সংসার, একটা মায়া তো আছেই।
সে আমার তিন সন্তানের মা, অস্বীকার করে লাভ নেই। ভালোবাসার কিছুটা তো আছেই।
তবে তুমি আমার জীবনের প্রথম তৃপ্তি। আর তুমি শেষ।
আমি একসাথে দু’জনকে ঠকাতে চাই না, তাই তার সাথে যোগাযোগ রাখি না,
তার সাথে গভীরভাবে আত্মার সম্পর্ক গড়ি না।
হতে পারে তাকে বিয়ে করতে চাইনি, কিন্তু করেছিলাম তো।
তাকে বিয়ে করেই আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার গুলো পেয়েছি—আমার কলিজার টুকরো তিন সন্তান এর বাবা হয়েছি।

আমার চাঁদের টুকরোর মতো ছেলে-মেয়ে—সবই তো তার দান।
তার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।
তবে সবাইকে আমরা চাইলেই সবকিছু দিতে পারি না, ঠিক তেমনই আমি ও অনন্যাকে সুখের সংসার দিতে পারিনি।
স্ত্রী করেছি ঠিকই, গৃহিণী করতে পারিনি।”
সাজিদ শিখদারের কথায় তৃপ্তি বেগমের মনের গভীরে কোথাও একটা ব্যথা লাগলো।
তবু ও কিছু বললেন না।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৪

তাদের জীবনগুলো এমনভাবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যা হয়তো আর ঠিক হবার নয়।
জীবনের অর্ধেকটা তো চলেই গেছে।
সাজিদ শিখদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৃপ্তি বেগমকে জড়িয়ে ধরলেন।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৬