ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৮

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৮
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

সকাল ৭ টা।
সেথ কাঁচের জানালা গলিয়ে সকালের মিঠের রোদ্দুর এসে ঠিকরে পড়ছে বিছানায়।
কখনো কখনো জানালায় টানানো ভারী মোটা পর্দাগুলো উত্তরের এলোমেলো বাতাসে দোলে উঠছে।
সেই সুযোগে একফালি রোদের ছটা কিছুক্ষণ পরপরই প্রিথমের শুভ্ররঙ্গ মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে।
রোদের ঝিলক চোখের মণিতে লাগতেই ঘুমের মধ্যেই চোখ মুখ খিঁচে ফেলছে প্রিথম।
কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো বোধহয়।
বেচারা ঘুমিয়েছে মাত্র ঘন্টা দুই-এক, তার মধ্যে এত জ্বালাতন কি আর সহ্য হয়!
প্রিথম পাশ ফিরে তুলতুলে কিছু একটা বুকে জড়িয়ে আরেকটু আরামে চোখ বন্ধ করতে নিলো, নতুন উদ্যমে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে নিতেই—

ধড়াম ধড়াম করে বিকট শব্দের দরজায় করাঘাত পড়লো।
একবার, দু’বার, বেশ কয়েকবার।
এত জোরালো শব্দ শুনেও না শোনার ভান করে প্রিথম ও ইনায়া মটকা মেরে পড়ে রইল।
চোখে তাদের রাজ্যের ঘুম।
তবে তাদের এই নিরবতায় বোধ হয় ওপাশের ব্যক্তি খানিক অধৈর্য হল।
এবার আরো জোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো।
চিৎকার দিয়ে ডাকলো—
ভাইয়া ভাইয়াআআআআআ!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এত তীব্র চিৎকার কর্ণকুহরে পৌঁছতেই, একযোগে শুয়া থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো প্রিথম, ইনায়া।
চমকে উঠে দুজন দুজনের মুখের দিকে ভয়ার্থ চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
ঘুম তাদের পালিয়ে গেছে।
ইনায়ার দৃষ্টি নিজের দিকে যেতেই নিজের বর্তমান অবস্থা দেখে লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।
প্রিয়তা আবার দরজা ধাক্কা দিয়ে ডাকলো,
“ভাইয়া ভাইয়া দরজা খুলো ভাইয়া! আম্মু বড় আম্মুরা এখনই ভাবিকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
বাহির থেকে তন্ময় আর প্রিয়তার গলা পাওয়া গেল।
প্রিথম এবার ইনায়ার অবস্থা দেখে শুয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো।
ফ্লোর থেকে শার্টটা কুড়িয়ে গায়ে জড়ালো।

বাম হাতে চোখ ঢলে, ধীরে পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
কিন্তু প্রিয়তা দের ভেতরে উকি মারার সুযোগ দিল না।
মূর্তির মতো দরজা আগলে সটান হয়ে দাঁড়ালো,
এক ভুরু তুলে বললো,
“আমার দরজা ভাঙার জন্য কার কাছ থেকে সুপারি নিয়েছিস?”
সকাল সকাল ভাইয়ের এমন কথায় আহাম্মক বনে গেলো প্রিয়তা।
বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“সুপারি কেন নেবো! আম্মু বড় আম্মুরা ভাবিকে রেডি করে নিয়ে যেতে বলেছে। এই দেখো শাড়ি, গয়না ও দিয়ে পাঠিয়েছে।”

বলে হাতের দিকে ইশারা করলো প্রিয়তা।
প্রিথম বোনের হাতের দিকে চেয়ে আচমকাই সেগুলো প্রিয়তার হাত থেকে নিয়ে নিলো।
প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগে দরজা বন্ধ করতে করতে বললো,
“৩০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে আসবে। এর আগে ডিস্টার্ব করবি না বোন। একটু পর তোকে স্পেশাল ট্রিট দেবো।”
বলেই দরজা বন্ধ করে দিলো।
প্রিথমের কাজে আশ্চর্য হয়ে দরজার বাহিরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা।
অতঃপর কিছু একটা ভেবে মিঠিমিঠি হেসে চলে যেতে নিলে—
তন্ময় প্রিয়তার ওড়নার কোনা টেনে ধরল।
গাল ফুলিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,

“আমি কি হেঁটে হেঁটে নিচে নামবো প্রিয় আপু?”
তন্ময়ের দিকে তাকাতেই, তন্ময়ের অতিমাত্রায় কিউট ফেসটা দেখে প্রিয়তার হাতটা নিশফিশ করে উঠলো কিছু করার জন্য।
প্রিয়তা ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না।
তন্ময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার গালের উপর হামলা করে দিলো।
রসগোল্লার মতো দুই গাল চটকে, পটকে, জুড়ে কামড়ে দিলো।
তন্ময় টলমলে চোখে ঠোঁট উল্টে তাকালো প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তা বুঝলো, সুনামি, সাইক্লোন, বন্যা, ভূমিকম্প—
একসাথে তার দিকে ধেয়ে আসছে, খুব শীঘ্রই।
তাই ভাইকে ফেলে দৌড় দিতে নিলে—

আবারো তার ওড়না খপ করে ধরে ফেললো তন্ময়।
প্রিয়তা চোখের পলক ঝাপটানোর আগেই,
আসমান-জমিন কাঁপিয়ে বিকট শব্দে কেঁদে উঠলো তন্ময়।
প্রিয়তা বুঝলো, এখন তাকে ঝাড়ি খাওয়ার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
প্রিয়তা তন্ময়ের হাত থেকে ওড়না ছাড়াতে চাইলে,
তন্ময় আরো শক্ত করে চেপে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো।
তার কান্নার তীব্রতায় প্রিয়তার কানে তালা পড়ে যাওয়ার উপক্রম।
প্রিয়তা কাঁদো কাঁদো ফেসে তন্ময়ের দিকে এগিয়ে এলো।
চটকে দেওয়াতে তন্ময়ের ফুলফুল ফর্সা গাল দুটি আপেলের মতো লাল টকটকে হয়ে আছে।
বড় একখানা দাঁতের দাগ গালে বসে গেছে।

প্রিয়তা কাঁদো কাঁদো মুখে তন্ময়ের লাল লাল গালে চুমু খেয়ে বললো,
“চুপ করে যা ভাই। তুই যা বলবি, তোকে তাই দিবো। তবু ও বকা খাওয়াস না।”
সাথেসাথেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না অফ করে দিলো তন্ময়।
প্রিয়তা বোধহয় একটু আশার আলো দেখলো।
তন্ময় কয়েক সেকেন্ড আপুর দিকে তাকিয়ে, ভ্রু বাকিয়ে ভাবলো,
“আপু কি তাকে কোনভাবে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করছে?”
কিন্তু না।

তন্ময় তো সামান্য ঘোষের সন্তুষ্ট হবে না।
তার লক্ষ্য আরো মহৎ।
তাই প্রিয়তাকে বিষ্ময়ে চান্দে পাঠিয়ে দিয়ে,
আরো জোরালো শব্দে কেঁদে উঠলো।
এবার প্রিয়তার ও ভয় করছে।
প্রিথমের ডান পাশের ঘরটা প্রণয়ের,
বাম পাশের ঘরটা প্রেমের।
এখন যদি দুজনের মধ্যে কেউ একজন ও চলে আসে,
তাহলে আজ শেষ প্রিয়তা।
আর তাই হলো।

প্রিয়তার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই,
ঘুমো ঘুমো গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ কানে আসলো।
আধো আধো ঘুমো ঘুমো নেশালো কণ্ঠস্বরটা কানে আসতেই,
প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জরে হালকা কাপন ধরল।
সে ঢোক গিলে পেছন ফিরে তাকাতেই,
তার ডাগর ডাগর ভীতু হরিণী চোখ জোড়া সহসাই স্থির হয়ে গেলো।
তার থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়।
পরনে কাল রাতের সেই অফ-হোয়াইট কালারের টি-শার্ট,
যা এখন অনেক জায়গায় কুঁচকে আছে।
বড় বড় সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে কপালের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
গারো বাদামি চোখ দুটো হালকা লাল—
দেখে মনে হচ্ছে ঘুমের রেশ এখনো ভালোই আছে।
বড্ড কিউট আর বাচ্চা বাচ্চা লাগছে দেখতে।

কি আশ্চর্য ওভার ২৯ দামড়া ব্যাটা নাকি বাচ্চা লাগছে দেখতে।
সামনের পানে হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে,
প্রিয়তার মনের ভেতর আরো ভয়ংকর এক ইচ্ছা জাগলো।
মনের কোন এক কোনা থেকে শয়তান বললো,
“দেখ প্রিয়তা, পুরাই চকলেট-মিল্ক-স্ট্রবেরির মিক্স কম্বিনেশন লাগছে।
এই গালগুলো চটকে দিতে পারলে হেব্বি মজা লাগবে!
সাথে দুই একটা কামড় দিতে পারলে তো এক্কেবারে সোনায় সোহাগা!”
প্রিয়তার নিজের এমন ভয়ংকর ভাবনায়,
নিজেই ভয়ে ঢুক গিললো।

সে নিশ্চিত, তাকে শয়তানে আছর করছে।
তন্ময় প্রণয়কে দেখে প্রশ্রয় পেল,
আরো জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে প্রণয়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো।
ভাঙ্গা কণ্ঠে নালিশ জানালো,
“নিজের গাল দুটো…”
প্রণয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
“ও বড় দাদান, দেখো না প্রিয় আপু আমার গালের কী অবস্থা করেছে! খুব ব্যথা করছে।”
বলে আবারো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
তন্ময়ের কথায় ঘোর কাটলো প্রিয়তার।
সে ভয়ার্থ চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় কপাল কুঁচকে তন্ময়কে কোলে নিলো।
তার গাল দুটো এপিঠ ওপিঠ করে দেখে,
প্রিয়তার দিকে তাকালো।
কণ্ঠের শীতলতা বজায় রেখে বললো,

“তুই ওর গাল চটকে দিয়েছিস?”
প্রিয়তা ঢোঁক গিলে মাথা নিচু করে নিলো।
প্রণয় প্রিয়তাকে মাথা থেকে পা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।
প্রিয়তা পায়ের গোড়ালি থেকে বেশ কিছুটা উপর পর্যন্ত একটা লং ওয়ান পিস পড়েছে,
ফলে তার ফর্সা আকর্ষণীয় পা দুটো দৃশ্যমান ।
গাল দুটো ও অসম্ভব লাল।
প্রণয় আবার ও গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“চুপ করে আছিস কেন?”
প্রিয়তা মৃদু কেঁপে উঠে উপর-নিচ মাথা ঝাকালো।

প্রণয় এবার তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর গাল চটকে দিয়েছে, তাই না? ব্যথা পেয়েছিস?”
তন্ময় ও অশ্রু চোখে উপর-নিচ মাথা ঝাকালো।
প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, “এখন যদি তোর আপুকে বকে দেই, তাহলে তো কোনো সমাধানই হবে না। সে তো আর বুঝবে না তুমি কতটা ব্যথা পেয়েছিস।”
তন্ময় ন্যায়বিচারের আশায় তাকালো বড় দাদানের দিকে।
প্রণয় তন্ময়ের লাল হয়ে যাওয়া গালে অলতো চুমু খেয়ে বললো, “বল, তোর আপুকে কী শাস্তি দিতে চাস? তুমি যা বলবি, তাই হবে।”
প্রিয়তা ভীতু চোখে তাকালো প্রণয় এর দিকে, তার এবার হালকা হালকা ভয় লাগছে।
তন্ময় আপুর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসলো। মনে মনে ভাবলো, “অনেক জ্বালিয়েছো আপা, এখন তার একটা মক্কম বদলা নিবো।”
সে গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আপু যেহেতু আমার গাল চিপেছে, তাই আমি ও আপুর গাল চিপতে চাই।”

তন্ময় এর কথায় চোখ বড় বড় করে ফেলল প্রিয়তার।
প্রণয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে তন্ময় কে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়ি ভাজ করে বললো, “ঠিক আছে, তোর যতক্ষণ ইচ্ছে গাল চিপে দে, কেউ কিছু বলবে না।”
প্রণয় এর কথায় ভয়ে ঢুক গিললো প্রিয়তা।
তন্ময় অসম্মতি জানিয়ে বললো, “আমার ছোটো ছোটো হাতে চিপে দিলে আপু ব্যথা পাবে না।”
তন্ময় এর কথায় মনে মনে চিরবিরিয়ে উঠলো প্রিয়তা। ভাইয়ের দিকে কট মট চোখে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “এক মাঘে শীত যায় না, আমারও সময় আসবে বুটকু, তখন তোমাকে দেখাবো মজা!”
প্রণয় ভুরু কুঁচকে বললো, “তাহলে কী দিয়ে চিপতে চাস?”
তন্ময় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে দিলো। প্রণয়ের বলিষ্ঠ হাত ধরে বললো, “তোমার হাতগুলো অনেক বড়ো দাদান, তুমি আচ্ছা করে চিপে দাও।”

তন্ময় কথায় বুক কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। সে বিস্ফারিত চোখে তাকালো প্রণয় এর দিকে।
প্রণয় এক দৃষ্টিতে কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।
তন্ময় আবার নালিশ করে বললো, “আপু আমাকে অনেকক্ষণ চিপে দিয়েছে, তার পর কামড়েও দিয়েছে, তুমি ও তাই করবে দাদান?”
তন্ময়ের বলা কথায় প্রিয়তার গা কাটা দিয়ে উঠলো।
সে অস্থির চোখে তাকালো প্রণয় এর দিকে।
প্রণয় ও এবার শয়তানি হেসে এক পা, দুই পা করে এগিয়ে এলো প্রিয়তার কাছে।
তন্ময় এতদিনের বদলা নিতে পারার আনন্দে মনে মনে বাকবাকুম হয়ে গেলো।
প্রণয় কাছে আসতে আসতে আবারো সেই ঘুমোঘুমো নেশালো কণ্ঠে বললো, “মানুষের গাল চিপে দিতে খুব ভালো লাগে, তাই না জান, কামড়ে দিতেও মন চায়।”

প্রিয়তা পা দিয়ে মেঝে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
এখন কি প্রণয় ভাই সত্যি সত্যিই তাকে কামড়ে দেবে? ভয়ে তীর তীর করে কাপন ধরেছে প্রিয়তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে?
প্রণয় তন্ময় এর দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি প্রিয়তার মসৃণ কোমল গাল দুটি হালকা চিপে ধরলো। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তার গভীর নীলাভ চোখে চোখ রাখল।
তবে এতে ব্যথা পেলো না প্রিয়তা, সে ডুবে যেতে লাগলো প্রণয়ের ওই ঘুমঘুম নেশালো চোখ দুটির অতল গভীরে।
ওই চোখগুলো যেন প্রিয়তার জন্য গুলকধাঁধা, যার সমাধান করতে ওই ছোট্টো কিশোরী কখনো সক্ষম হয় না।
প্রণয় প্রিয়তার চোখের গভীরে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
প্রিয়তার দিকে নিজের গাল এগিয়ে দিয়ে বললো, “তোকে একদিন বলেছি জান, আমি বেঁচে থাকতে কখনো মনের আশা অপূর্ণ রাখবি না।”

প্রণয় এর কথায় কিছুটা অবাক হলো প্রিয়তা।
ঝট করে চোখ নামিয়ে নিয়ে ইতস্তত করতে লাগলো।
মনে মনে ভাবলো, প্রণয় ভাই কি মনের কথা শুনে ফেলেছেন?
প্রিয়তার প্রশ্নের উত্তর ভেসে এলো— “হুম, শুনে ফেলেছি।”
আবার মৃদু কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।
তন্ময় রেলিং দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো, থরি তাদের রুমে যাচ্ছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তন্ময়ের।
সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নিচে দৌড় লাগালো।
না হলে থরি তার জমানো সব চকোলেট এক নিমেষেই ফিনিশ করে দেবে! তার বড়ো দাদান এর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, তাই নিজের চকোলেট বাঁচাতে দৌড়ালো তন্ময়।

প্রণয়ের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে প্রিয়তার গাল দুটো গোধূলি বেলার রক্তিম আকাশের ন্যায় রক্তিম হয়ে উঠলো।
প্রিয়তার দুই গালে লজ্জা মিশ্রিত গোলাপী আভা দেখে তৃষ্ণার্ত হল প্রণয়।
সত্যি, সত্যি এগিয়ে এসে তন্ময়ের কথার মতো প্রিয়তার লজ্জা রাঙা গাল কামড়ে ধরলো।
আচমকা এহেন কাণ্ডে কেঁপে উঠে প্রণয়ের পেট খামচে ধরলো প্রিয়তা।
অন্নমনস্কভাবে বিড়বিড় করতে করতে উপরের সিড়িতে পা রাখতেই থিরার চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। হাঁটুর জোড়ায় কাপন ধরল সহসাই।
চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় করে সামনে তাকিয়ে রইলো। আপনা আপনি ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল।
সেদিনকার ন্যায় আজও থিরার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।

প্রিয়তার লাজে রাঙা মুখটা দেখে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না প্রণয়।
কোনো সতর্কতা ছাড়াই এক ঝটকায় তাকে টেনে নিলো, গা ঘেঁষে দেওয়ালে ঠেসে ধরলো।
প্রিয়তার নিঃশ্বাস আটকে এলো। প্রনয়ের স্পর্শের তাপটা সারা শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
প্রণয় এক হাতে গলার একপাশে রেখে বৃদ্ধাঙ্গুল তুলে প্রিয়তার নরম ত্বকে আলতো করে বুলাতে লাগলো — যেন স্পর্শ নয়, ভালোবাসা এঁকে দিচ্ছে নিঃশব্দে।
আবেশে প্রিয়তার চোখ বুঁজে এলো। বুকের ভেতর যেন উত্তপ্ত সমুদ্র উথলে উঠছে, না দেখেই প্রণয়ের দৃষ্টির ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারছে সে।
জানে— এই মুহূর্তে ওই চোখে চোখ রাখলে নিমিষেই তার নিজস্ব সত্তা গলে যাবে।
প্রনয় বৃদ্ধাঙ্গুল স্লাইড করেতে করতে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো।
তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে আছড়ে পড়ছে প্রিয়তার গলায়, কাঁধে।
প্রণয় তৃষ্ণার্ত চোখে চেয়ে নিজের মুখটা এরেকটু এগিয়ে নিল, গালে নাক স্পর্শ করে অসহায় কন্ঠে বলল—

“জীবনের সবথেকে পছন্দের জিনিসগুলো
হয়তো অবৈধ, নয়তো নিষিদ্ধ…
হয়তো অনেক দামি, নয়তো অন্য কারো।
এমন কেন জান?
আর যদি তাই হবে তবে মন কেনো মানতে চায়?
মন কেনো পাপ জেনেও পাপি হতে চায়?
নিশ্চিত মৃত্যু যেন ও, কেন নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়?
কেনো মায়া কমে না, বল জান?”
প্রত্যেকটা শব্দের ধ্বনি গভীরভাবে আঁচড় কাটলো প্রিয়তার কোমল হৃদয়ে।
অজানা কারণে আচমকাই চোখ দুটো টলমল করে উঠলো।
সে চোখ তুলে তাকালো সেই মায়াময় চোখে— যা তাকে নিঃশব্দে অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু অক্ষম সে, সেই শব্দগুচ্ছ সাজাতে ব্যর্থ হয়।

প্রণয় তার কালচে লাল ঠোঁট দুটো ধীরে ধীরে এগিয়ে আনলো প্রিয়তার দিকে।
নিঃশ্বাস আটকে চোখ বন্ধ করে নিল প্রিয়তা।
সাথে সাথে চোখের কোণে জমে থাকা বেদনা, উষ্ণ নোনা জলের ধারা স্বরূপ গাল বেয়ে নামতে চাইলো।
কিন্তু তা মাটিতে পড়ার আগেই—
প্রণয় তার ওষ্ঠ দ্বারা শুষে নিলো তা নিঃশব্দে।
কোনো কথা নয়,
কোনো অনুমতি নয়—
তবু যেন সব বলে দিল সেই নিঃশব্দ মুহূর্তটা।
পিঠ খামছে ধরল প্রিয়তা।
তার কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে, প্রণয় বোধহয় বুঝলো সেটা।
আলগোছে প্রিয়তাকে আশ্রয় দিল নিজের অশান্ত বক্ষে।
নিজেদের শরীরের মধ্যকার সব ফাঁকফোকর ভরাট করে দিল।
শক্ত করে আবদ্ধ করল নিজের বাহু বন্ধনে।

সুখ যে তাদের কপালে নেই, সেটা প্রণয় ঢের ভালো জানে।
হঠাৎ পায়ের একটা শব্দে চমকে উঠলো প্রিয়তা।
ভয়ার্ত চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে—
কিন্তু প্রণয় তখনও বিভোর।
সে মুখ নামিয়ে প্রিয়তার গলার কাছে সেথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো আচমকা।
“আহহহ!” বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল প্রিয়তা।
প্রণয় সেথায় ঠোঁট চেপে ধরে তপ্ত কণ্ঠে ফিশফিশিয়ে বলল,
“এই জন্যই তোকে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলি। নাহলে কবে তোকে কামড়ে খেয়ে ফেলবো তার ঠিক আছে…”
বলে সজরে আরেকটা কামড় বসালো।
এবার ব্যাথার তীব্রতায় প্রিয়তা প্রনয়ের বাহুতে ধারালো নখ গেঁথে দিল, তবে সেসবের পরোয়া করলো না প্রণয়।
প্রিয়তার রক্তিম ঠোঁট জোড়া তীর তীর করে কাঁপছে, অনবরত—
যা দেখে প্রনয়ের দেহের প্রতিটা রক্তবিন্দু টগবগ করে ফুটছে।
অচেনা অনুভবে ঢেকে গেছে চেতনা।
প্রিয়তার রক্তিম ঠোঁটজোড়া যেন প্রণয়কে বলছে,

“তুমি কেমন পুরুষ প্রণয়?
তুমি তো আমাদেরকে ভালোবাসো…
তাহলে কেন আমাদেরকে দেখেও না দেখার ভান করো?
কেনো বারবার আমাদের দিকে তাকিয়ে ও চোখ ফিরিয়ে নাও?”
প্রণয় ঢোঁক গিলে প্রিয়তার কম্পনরত ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে দিলো—শুধু একবার।
অতঃপর আচমকার প্রিয়তা কে ছেড়ে ঘরে ঢুকে ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দিল।
প্রিয়তা যেন প্রণয় ভাইয়ের ঘোর কাটাতেই পারছে না।
প্রণয় যেতেই উল্টো দিকের দরজা খুলে বের হলো প্রেম।
নিজের ঘরের সামনে বোনকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো প্রেম।
মাথায় হাত রেখে বললো,

“এভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বোন?”
প্রিয়তা ভেবলার মতো তাকালো প্রেমের দিকে।
প্রেম কিছু বলতে নিলেই তার নজর পড়লো প্রিয়তার গালে।
ফর্সা নিটোল গালে দাঁতের দাগ স্পষ্ট।
প্রেম হতবিহবল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে আবার কে কামড়ে দিয়েছে?”
প্রেমের প্রশ্নে প্রিয়তার স্তম্ভিত ফিরলো।
সে চমকে তাকালো প্রেমের দিকে।
প্রিয়তাকে চমকাতে দেখে প্রেম বললো,
“নিশ্চয়ই তন্ময়ের কাজ! বেটা বাঁদরটাকে এবার হাতে পাই!”
প্রেম আবার আদুরে কণ্ঠে বললো,
“বেশি ব্যথা পেয়েছিস বোন?”
কিন্তু প্রেমের কথায় প্রিয়তা হ্যাঁ না কিছুই জবাব দিতে পারলো না,
শুধু কথা কাটাতে বললো,

“ছোটো ভাবি কই?”
প্রেম “ও আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে” বললো,
“ঊষা তো নিচে চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে আম্মুদের হেল্প করতে।”
প্রিয়তা “ও” ঝটপট উল্ট ঘুরে যেতে যেতে বললো,
“আমি ও যাই ছোড়দা বলে,”
আর প্রেমকে কিছু বলতে না দিয়ে প্রেমের সামনে থেকে কেটে পড়লো প্রিয়তা।
প্রেম ও আর বেশি না ভেবে ঘরে চলে গেলো।
সে সাওয়ার নিয়ে আসছে, এখন রেডি হয়ে বাহিরে মেহমানদের অ্যাটেন্ড করতে হবে।
প্রিয়তার হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
গাল দুটো পূর্বের তুলনায় আরো অনেক বেশি রক্তিম।
সে সিঁড়ির কাছে আসতেই থমকে গেলো,

থিরা এখনও চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।
থিরার এক্সপ্রেশন দেখে ভরকে গেলো প্রিয়তা।
মনে মনে ভাবলো, ‘আজও দেখে নিয়েছে নাকি?’
প্রিয়তা কিছু বলার আগেই থিরা এগিয়ে এলো,
প্রিয়তার হাত টেনে ধরে সজোরে চিমটি কাটলো।
প্রিয়তার ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠলো,
বিশাল জোরে ধমকে বলল,
“আহহ চিমটি কাটছিস কেন?”
এবার চোখ দুটো বিস্ময়ে আরো বড় বড় করে ফেললো থিরা।
দুবার চোখের পলক ঝাঁপটালো,
প্রিয়তাকে গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে বললো,
“আজ তো আমি শুরু থেকে শেষ অব্দি সব দেখেছি।
এখন তুমি কি বলে বোকা বানাবে ছোট আপু!”
প্রিয়তা ঢোঁক গিলে তুতলিয়ে বললো,

“ম্মানে—”
থিরা এবার বুকে হাত গুঁজে এক ভ্রু তুলে বললো,
“তোমাকে যে ‘ঝিন ভূত’ কিছু ধরে নি, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত!
আর কি ধরেছে সেটাও দেখে নিয়েছি। সত্যি!”
প্রিয়তা ভয় ভয় তাকালো থিরার দিকে,
কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“কি দেখেছিস?”
থিরা আবারও চোখ বড় বড় করে বললো,
“সব!”
থিরার কথায় প্রিয়তা আরো ভয় পেয়ে গেলো।
থিরা আবার বলতে লাগলো,
“ওইদিন তুমি বড়ো দাদানকে চুমু খাচ্ছিলে,
আর আজ বড়ো দাদান তোমাকে জ—”
থিরা কথা শেষ করার আগেই প্রিয়তা মুখ চেপে ধরলো,
ধমকে বললো,

“দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস!
বড়ো বোনের সামনে কি বলছিস হুঁশ আছে?”
প্রিয়তার কথায় ভ্রু কুঁচকালো থিরা।
এক ভ্রু তুলে বললো,
“শাক দিয়ে মাছ ঢেকে লাভ নেই ছোটো আপু!”
প্রিয়তা ঢোঁক গিলে বললো,
“সকালে খাসনি তাই উল্টা পাল্টা বলছিস! চল খাবি!”
থিরা গেলো না।
প্রিয়তার গলার কাছ থেকে ওড়না সরিয়ে দেখলো,
সেখানে লালচে দুটো দাগ।
অতিরিক্ত ফর্সা চামড়ায় দাগ দুটো খয়রি হয়ে গেছে।
ঢোঁক গিললো থিরা।
আবারও কিছু বলতে নিলে ঊষা চলে এলো সেখানে।
ঊষাকে দেখে চুপ হয়ে গেলো থিরা।
ঊষা এসে হন্তদন্ত কণ্ঠে বললো,

“প্রিয় আপু তুমি এখনও এখানে!
ওদিকে সেজো আম্মু তোমাকে খুঁজছেন!”
ঊষাকে দেখে প্রিয়তার জানে পানি হলো।
সে দ্রুত ঊষাকে চেপে ধরে বললো,
“আমি তো নিচেই যাচ্ছিলাম, চল ভাবি,”
বলে থিরার দিকে আর একবারও তাকালো না,
ঊষার হাত ধরে কেটে পড়লো।
থিরা প্রিয়তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বললো,
“যা বোঝার আমি বুঝে গেছি!”
কিন্তু একটা ব্যাপারে থিরার খটকা লাগলো—
“বড়ো দাদান তো বড়ো আপুর স্বামী!
তাহলে কিভাবে কি?”
আর আমরা বড়ো দাদানকে যতটুকু চিনি,

বড়ো দাদানের মতো মানুষ এই বাড়িতে আর একজনও নেই!
তাহলে… কিভাবে… কি?
থিরার সব গুলিয়ে গেলো।
সে আবার অনুভব করলো,
সে সত্যি ছোটো মানুষ,
এত মারপেঁচ বোঝা তার কর্ম নয়।
তাই সে আর বেশি না ভেবে নিচে চলে গেল।
ইনায়া কমফর্টারের মধ্যে একদম নিজেকে প্যাকেট করে নিয়েছে।
লজ্জায় তার মাটি ফুড়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
সে কিছুঁতেই ওই লুচু বেটার চোখে চোখ রাখতে পারবে না, কিছুতেই না।
সে না চাইতে, ও! কাল রাতের দৃশ্যগুলো সিনেমার মতো চোখের সামনে লাইভ চলছে।
পৃথম দুষ্টু হেসে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো।
ইনায়ার একটা চুলও দেখা যাচ্ছে না।
পৃথম ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

বাম হাত দিয়ে এক টান দিতেই কমফর্টারটা ইনায়ার হাতের মুঠো থেকে ফসকে গেল।
হঠাৎ এমন হওয়াতে চমকে গেল ইনায়া, লজ্জায় আরো মিইয়ে গেল।
পৃথম ইনায়ার পাশে বসলো, কমফর্টার সমেত ফোল্ড করে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মতো ইনায়াকে কোলে নিয়ে বসলো।
লজ্জায় ইনায়া সহসাই মুখ লুকালো পৃথমের বুকে।
পৃথম ইনায়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো, ইনায়ার লজ্জা রাঙা মুখশ্রীকে আরও একটু রাঙিয়ে দিতে বললো—
“উফ্‌! মাই ডিয়ার রসগোল্লা! কাল সারারাত আদর করেছি, মন ভরেনি। আবার আমায় উসকে দিচ্ছো! এখন ধরলে আবার দিন ঘুরিয়ে রাত হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি আর ছাড়া পাবে না, তাই আমার সামনে লজ্জা পেয়ে আবার নিজের সর্বনাশ ডেকে এনো না। আমি ভালো ছেলে, আমাকে ভালো থাকতে দাও।”

পৃথমের কথায় কেঁপে উঠলো ইনায়া, বুকে থেকে মাথা তুলে ভয়ার্থ চোখে তাকালো।
ইনায়ার লজ্জা পালিয়ে গেছে দেখে হেসে ফেললো পৃথম।
ইনায়া গুলগুল চোখে তাকিয়ে আছে দেখে পৃথমের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো।
সে রসগোল্লার মতো ফুলে ফুলে গালে টপাটপ বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো—
“উফ্‌ ইয়াম্মি ইয়াম্মি! রসগোল্লা এত টেস্‌টি হবে আমি তো স্বপ্নেও ভাবিনি! উফ্‌! এখন থেকে উপরে না যাওয়া পর্যন্ত সকাল, বিকেল, দুপুর, রাত— অলটাইম আমার মুখের সামনে রসগোল্লা ধরে থাকবে! এটা তোমার স্বামীর আদেশ।”
মুখ গম্ভীর করে বললো পৃথম।
ইনায়া আবার নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
মনে মনে বললো— “আস্তাগফিরুল্লাহ্‌! এ আমি কার হাতে পড়লাম আল্লাহ!”
পৃথম মুখ ভেংচি দিয়ে ইনায়াকে কমফর্টারসহ কোলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
যেতে যেতে বললো— “স্বামীর নামে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে লাভ নাই বউ, এটা আমার ফাইনাল ডিসিশন! ডায়াবেটিক না ধরানো পর্যন্ত থামবো না। কঠোর থেকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কাজে ফাঁকি দেওয়া প্রীতম শিকদারের ধাঁচে নেই।” বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

শিক্ষদার বাড়িতে অনুষ্ঠানে মহিলাদের রান্নার জন্য বাড়ির কিচেন লাগোয়া বিশাল বড় একটা সাবেকি আমলের রান্নাঘর রয়েছে।
যার মাঝ বরাবর বিশাল বড় বড় দুটো মাটির চুলা।
এই ঘরের মেঝে-মাটির, এখানে টাইলস বসানো হয়নি।
রান্নাঘরের থাকে থাকে সাজানো হরেক রকম বিশাল বড় বড় থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল— যার বেশির ভাগই কাশার।
পুরো রান্নাঘর জুড়ে মহিলাদের প্রচণ্ড ভিড়।
সারাবাড়িতে এসি থাকলেও, ওই ঘরে কোনো এসি নেই।
তবে বড় বড় দুটো জানালা আছে।
তবে এত ভিড় আর এত গরম যে জানলা দিয়ে একফোঁটা বাতাস পর্যন্ত আসছে না! এত মানুষের ভিড়ে ঘরের টেম্পারেচার বাড়ছে হুহু করে।

এর উপর এই ভ্যাপসা গরমে সকলে ঘেমে নেয়ে সেদ্ধ।
অনুস্রী বেগম এক উনুনে বিশাল পাতিল বসিয়ে তাতে পোলাও রান্না বসিয়েছেন।
তনুস্রী বেগম ও অনন্যা বেগম বড় বড় আলু ‘ডুমডুম’ করে কাটছেন মাংস রান্নার জন্য।
প্রিয়তা,পরিনীতা, ঊষা, প্রেরণা, ইনায়া, থিরা— আরও মেয়েরা সবাই মিলে রুটি বেলছে।
রুটি বেলতে বেলতে শিকদার বাড়ির আলালের ঘরের দুলালিদের অবস্থা একেবারে নাস্তানাবুদ।
ঘাড়-হাত-পা সব টনটন করছে তাদের, তবু ও কোন ছাড় নেই। অনুস্রী বেগমের আদেশ— কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।

তাই এই অসহ্য রকমের ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছে ওরা।
মুখগুলো চেরি ফলের মতো লাল হয়ে উঠছে।
ইনায়া নতুন বউ বলে ও কোনো ছাড়া পায়নি।
বাড়ির বউ মানে এই বাড়ির সদস্য, তাই বাড়ির সকল কাজে তোমায় এক্ষুনি হাত লাগাতে হবে— এটাই সিকদার বাড়ির কর্তী অনুস্রী বেগমের আদেশ।
নতুন ভাবিকে কে বাসর নিয়ে যে একটু পিঞ্চ মারবে, সেই সুযোগও পাচ্ছে না ওরা।
অনুস্রী বেগম শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছে প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন—
“আম্মু, ওই রান্নাঘর থেকে নারকেল কুরানো আছে, ওটা একটু নিয়ে আসো।”
অনুস্রী বেগমের কথায় প্রিয়তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
বসা থেকে লাফিয়ে উঠে চলে গেল নারকেল আনতে।
টায় বসে থাকতে থাকতে মেয়েটার হাত-পা-ঘাড় মটমট করছে।

প্রিয়তা ওই ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের রান্নাঘরে আসতে আচমকাই তার পদযুগল থমকে গেল।
বিস্ময়ে চোখ দুটো বৃহৎ হয়ে গেল, খুশিতে মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসে আপনাআপনি।
সেকেন্ড পার হওয়ার আগেই প্রিয়তা নারকেল-টারকেল ফেলে একপ্রকার লাফিয়ে গিয়ে—
মেহজাবিন চৌধুরীর বুকে পড়লো।
৫০ ঊর্ধ্বা সুন্দরী মহিলার পিঠ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
খুশিতে প্রিয়তার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে, সে ভীষণ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ডাকলো—
“ফুপ্পি!!”

মেহজাবিন চৌধুরী হেসে প্রিয়তাকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিলেন।
প্রিয়তার গাল-মুখে হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললেন—
“কেমন আছে আমার বৌমা? একি তুমি এমন ঘেমে নেয়ে ভিজে আছো কেন আম্মু?”
প্রিয়তা খুশিতে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
সে মেহজাবিন চৌধুরীকে ধরে ড্রইং রুমের সোফায় বসিয়ে দিলো।
অভিমানী কণ্ঠে অভিযোগ করলো—
“ফুপ্পি, তুমি আসবে একবারও বললে না আমায়!”
মেহজাবিন চৌধুরী হেসে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—
“সারপ্রাইজ!”

তাদের কথার মধ্যেই শ্বেতা প্রিয়তার পাশে ধপ করে বসলো।
প্রিয়তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো—
“সব ভালোবাসা বুঝি মমের জন্য। আমি আর আমার ভাই তো নদীর জলে ভেসে আসছি— কেনরে, আমাদের কেও একটু দেখ!”
প্রিয়তা ভুরু কুঁচকে তাকালো, শ্বেতার দিকে মুখ বেঁকিয়ে বললো—
“তুমি জানো না, ননদিনীদের সাথে ভাবীদের শত্রুতা চিরকালের!”
শ্বেতা ও দুষ্টু হেসে বললো—

“আমার কপালটাই বুঝি মন্দ!
এই জন্যই তো কপালে ভালো ভাবি জুটলো না।
কোথা থেকে এক দরজাল মহিলা এসে
আমার সোনামুখো নিরীহ ভাইয়ের কপালে এসে জুটেছে!
আর আমার বেচারা ভাইটা?
সে তো দিনে দিনে যেন শোষণের শিকার—
শুকিয়ে যাচ্ছে… একেবারে সজনে ডাঁটার মতো!”
আর প্রিয়তা?
সে-ই বা কম কিসে!
চোখ টিপে, দুষ্টু হেসে বলল,

“তোমার ভাইয়ের কপাল তো বাঁধিয়ে রাখার মতো কপাল, ননদিনী!
আমার মতো এত সুশীল, সুন্দরী, রূপবতী, গুণবতী, লাবণ্যময় বউ পেয়েছে!”
প্রিয়তা আরেকটু ভাব নিয়ে বলল—
“আসলে কী জানো, কুটনি ননদিনী,
আমার রূপের এতটাই তেজ
যে তোমার ভাই সেটা সহ্যই করতে পারছে না!
তাই তো শুকিয়ে যাচ্ছে!
এখানেও যদি আমার দোষ হয়, তাহলে কীই বা বলার থাকে?
আসলে কী বলো তো, ননদিনী?
ইতিহাস সাক্ষী—
ননদিনীরা কখনো ভাবিদের ভালো চোখে দেখতে পারে না!”
পেছন থেকে ভারী পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—

“তা তো অবশ্যই!
এত সুন্দরী বউ আমার!
আর তার রূপের তেজ থাকবে না— এ আবার হয় নাকি?
এই আগুনে জ্বলে পুড়ে মরব বলেই তো বেঁচে আছি!
বউয়ের রূপে যদি এমন তেজ থাকে,
তাহলে শুধু জ্বলে নয়, ছাই হয়ে উড়ে যেতে ও রাজি আছি!
তাও তো গর্বের কথা— আমার সোনা বউ!”
হঠাৎ কারো কণ্ঠে পিলে চমকে উঠলো প্রিয়তার।
সে তড়াক করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।
শুদ্ধ ফোন পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে।
ঠোঁটে লেগে আছে সেই চিরাচরিত বাঁকা হাসি।
তার সাথে প্রণয়ও আছে, তবে সে একদমই নীরব, নিশ্চুপ, নির্বিকার—তার চোখ মুখে কোনো অনুভূতি নেই।
শুদ্ধর কথায় চরম লজ্জা পেলো প্রিয়তা।

মনে মনে ভাবলো, ছি ছি, শুদ্ধ ভাই কি ভাবলেন!
আবার প্রণয়ের দিকেই তাকিয়ে সামান্য ভয় ও হলো—প্রণয় ভাই কি ভাবলেন!
শুদ্ধ আর প্রণয় এগিয়ে এসে মাহজাবিন চৌধুরীকে সালাম করলো।
শুদ্ধকে দেখে শ্বেতা ফট করে প্রিয়তার পাশ থেকে উঠে পড়লো।
ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে ইশারা করলো।
শুদ্ধ ও দুষ্টু হেসে সাথেসাথেই প্রিয়তার পাশে বসে পড়লো।
শুদ্ধকে নিজের পাশে বসতে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো প্রিয়তা।
শ্বেতা বললো,

— “এই দাদা, ভাবির দিকে চেপে বস! আমি ও তো বসবো, না হলে ফ্যামিলি ফটো উঠবে কীভাবে?”
শুদ্ধ প্রিয়তার ইতস্তত মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।
এবার একদম প্রিয়তার গায়ের সাথে চেপে বসলো।
এবার অস্বস্তিতে প্রিয়তা ঘামতে শুরু করেছে।
শ্বেতা আর মাহজাবিন চৌধুরী মুগ্ধ চোখে তাকালেন শুদ্ধ আর প্রিয়তার দিকে।
সত্যি বলতে অসাধারণ সুন্দর মানিয়েছে, দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে এই জুটি একে অপরের জন্য।
শ্বেতা ও শুদ্ধের পাশে বসে পড়লো।

এতক্ষণ প্রণয়ের চোখ মুখ সব স্বাভাবিক থাকলেও,হাত দুটো শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে।
অতি শান্ত চোখ দুটোতে যদি কেউ নিবিড় ভাবে তাকিয়ে থাকত তবে দেখতে পেত,
পুরুষের হৃদয় জ্বালিয়ে দেওয়া সেই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড বুকের গভীটা ঠিক কতখানি অগ্নি ধগ্ধ হচ্ছে।
কপালের শিরাগুলো আস্তে আস্তে ফুঁলে উঠছে।
প্রিয়তা আসছে না দেখে অনুশ্রী বেগম প্রেরণাকে পাঠিয়েছিলেন নারকেল নিতে।
প্রেরণা ও রান্নাঘরে এসে সামনের দিকে তাকাতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো,
সব ফেলে ছুটে গেলো ড্রয়িং রুমে।
মাহজাবিন চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরতে নিতেই শ্বেতা বাগড়া দিয়ে বললো,
— “প্রেরণা আপু, ভালোবাসার বোম পরে ফাটিয়ো, আগে আমাদের একটা ফ্যামিলি ফটো তুলে দাও।”
বলে নিজের ফোন এগিয়ে দিলো।
প্রেরণা ফোনটা হাতে নিতে নিতে ভ্রু কুঁচকে বললো,

— “ফ্যামিলি ফটো?”
শ্বেতা এবার চমৎকার হেসে বললো,
— “হ্যাঁ! তুমি জানো না? আমি, আমার মম, আমার দাদা আর আমার সুন্দরী ভাবী—এটাই তো আমাদের ফ্যামিলি।”
প্রেরণা ও এবার দুষ্টু হেসে বললো,
— “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আমি তো ভুলেই গেছিলাম।”
বলে সবার একটা সুন্দর ছবি তুলে দিলো।
ফোনটা শ্বেতার হাতে দিয়ে মাহজাবিন চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরলো।
শুদ্ধর ছোঁয়া লাগাতে প্রিয়তার অস্বস্তি বাড়ছে।
সে চাইছে উঠে যেতে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না, যদি বেয়াদবি হয়ে যায়।
এবার মাহজাবিন চৌধুরী শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “মাই সান, আমি কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র ইনফর্ম করলাম তোমায়। এর মধ্যেই তুমি চলে এলে!”
শুদ্ধ হেসে বললো,
— “মম, তোমার আগে কোনো কাজ নয়! কিন্তু আমি তো তোমার সাথে কালকে কথা বললাম তুমি তো বলেছিলে একমাস পরে আসবে, তাহলে আজ চলে এলে?”
মাহজাবিন চৌধুরী স্মিত হেসে বললেন,

— “সারপ্রাইজ, মাই সান।”
হাসলো শুদ্ধ ও, তবে একটু ইতস্তত করে বলল,
— “আমি কাল আবার সিলেট ব্যাক করবো মম। তুমি এসেছো বলে ইমারজেন্সি এসেছি।”
মেহজাবিন চৌধুরীর কিছুটা রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
— “কাল নয় বেটা, দুইদিন পর যাও। কাল একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে, আই নো তুমি বুঝতেই পারছ।”
মেহজাবিন চৌধুরীর কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলল প্রণয়।
কেমন সন্দিহান চোখে তাকালো মেহজাবিন চৌধুরীর দিকে।
এবার ফুপ্পির উপস্থিতিতে কেন জানি সে খুশি হতে পারছে না সে।
মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সিকদার বাড়ির প্রায় সকলেই আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলেন।
অনুশ্রী বেগম ননদকে দেখে খুশি হলেন, হেসে বললেন,

— “কেমন আছো, আপা? আসবেন যে বললেন না তো গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম!”
মাহজাবিন চৌধুরী আন্তরিকভাবে বললেন,
— “এত ব্যস্ত হবেন না বড় ভাবী, আমি সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
মাহজাবিন চৌধুরী বসা থেকে উঠতেই সুযোগ পেয়ে গেলো প্রিয়তা।
লাফিয়ে শুদ্ধর পাশ থেকে উঠে পড়লো।
হন্তদন্ত কণ্ঠে বললো,
— “ফুপ্পি, আমি তোমাদের জন্য শরবত নিয়ে আসি।”
বলে কেটে পড়লো।
প্রিয়তাকে পালাতে দেখে হেসে ফেললো শুদ্ধ।
প্রিয়তার সাথে যে হাতটা টাচ লেগেছিল সেটা নাকের কাছে নিয়ে লম্বা শ্বাস টানলো।
সেই পরিচিত মাদকীয় সুগন্ধ…
সে আরও দুবার শ্বাস নিয়ে বললো,

— “পালাচ্ছো? পালাও! এখন সময়টা তোমার…
কিন্তু সুইটহার্ট, যখন সময় আমার হবে তখন শুধু নিশ্বাসে নিশ্বাসে শুদ্ধর নাম জপবে,
নিশ্বাস নেয়ার ও সুযোগ পাবে না… প্রমিজ!”
প্রণয় ও উঠে কোনো রকম কথা-বার্তা ছাড়াই উপরে চলে গেলো।
সাদমান সিকদার হৈ হট্টগোল শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
ড্রয়িং রুমে এসে আদরের বোনকে দেখে ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন।
মাহজাবিন চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে সাদমান সিকদারকে সালাম করলেন।
বিনয়ী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— “ভালো আছেন বড় ভাইজান?”
সাদমান সিকদার হেসে বললেন,
— “ভালো আছি বোন।”
সাদমান সিকদার হাঁক দিয়ে রুহমানকে ডাকলেন,
— “রুহমান! রুহমান!”
এক মিনিটের মধ্যেই হাজির হলো এই বাড়ির পুরোনো কাজের লোক রুহমান।
সাদমান সিকদার তাকে আদেশ দিয়ে বললেন,

— “আমার বোন এসেছে, হাটের সব থেকে বড় গরু আর খাসি এনে জবাই দাও।”
রুহমান সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।
মাহজাবিন চৌধুরী, শুদ্ধ আর শ্বেতা আরো কিছুক্ষণ সবার সাথে কথা বলে উপরে চলে গেলেন।
মাহজাবিন চৌধুরীকে দেখে পুরো সিকদার বাড়ি গরম হয়ে গেছে,
কারণ মাহজাবিন চৌধুরী চার ভাইয়ের একমাত্র বোন, সাদমান সিকদারের প্রচণ্ড আদরের।
আর এই বাড়ির ছেলে-মেয়েরা ও ফুপ্পি বলতে অজ্ঞেন!
আর প্রিয়তাকে তিনি ছোট থেকে ছেলের বউ মনে করেন, তবে প্রিয়তা সেটা কে নিতান্তই মজা হিসেবে নেয়।
দুপুর একটা শিন্নি প্রস্তুত।

শিকদার বাড়ির পাশের মাঠে বিশাল বড় করে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে।
পুরো রায়পুরের বাচ্চা, যুবক, বুড়ো—সকল পুরুষ হাজির।
প্রথমে পুরুষদের শিন্নি বিতরণ করা হবে, পরে মহিলাদের।
শিখদার বাড়ির নিয়ম অনুসারে, মেহমানদের আপ্যায়ন বা শিন্নি বিতরণ—এসবই শিকদার বাড়ির ছেলেরাই করে।
সেই অনুযায়ী প্রণয়, পৃথম, শুদ্ধ, প্রেম, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র—সবাই জোর কদমে কাজে লেগে পড়লো,
দুপুরের তপ্ত গরমে ঘেমেনেয়ে ষেদ্ধ।

বিকেল ৪টা পর্যন্ত শিন্নি বিতরণ করা হয়েছে, হুজুরদের দাওয়াত খাওয়ানো হয়েছে।
বাড়ির নারী-পুরুষ, কারোর এক ফোঁটা দম ফেলার ফুসরৎ মেলেনি।
সন্ধ্যা ৭টা। এতক্ষণে শিকদার বাড়ির সব কাজকর্ম মিটেছে।
সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
বাড়ির অতিরিক্ত লোক সমাগম, ভীড়ভাট্টা অনেকটাই হালকা।
শিখদারদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া বাইরের লোক প্রায় নেই বললেই চলে।
তবে বাড়ির পরিবেশ মোটেও শান্ত নয়,
কারণ প্রণয়দের মামার বাড়ির সকলে এসেছেন তাঁদের পরিবার নিয়ে।
বাড়ির বড়রা সকলে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছেন,

বাড়ির ছেলেরা বাইরের দিকটা সামলে ক্লান্ত হয়ে ডাইনিং টেবিল জুড়ে বসেছে,
উদ্দেশ্য— একাই বাড়ির সব খাবার সাফ করে দেওয়া।
অরণ্য টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ফাটা গলায় চিৎকার দিয়ে ডাকলো,
— ‘‘মর্জিনার মা… এই মর্জিনার… আরে… সখিনার মা… কইরে মরে গেলি নাকি!’’
রান্না ঘরে প্রিয়তা আর ঊষা, বাড়ির বড়রা আর মেহমানদের জন্য চা-নাস্তা-কফি বানাচ্ছিল।
ঊষা চা বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করলো,
— ‘‘প্রিয়ো আপু, তোমাদের পরিবারে এত মানুষ?’’
প্রিয়তা আটা মাখতে মাখতে মৃদু হেসে বললো,
— ‘‘আরও আছে… এই তো… ওনাদের চা-নাস্তা দিয়ে তোমাকে আর ইনুকে রেডি করবো… উনারা তো নতুন বউ দেখতে এসেছেন।’’
লজ্জা মিশ্রিত হাসলো ঊষা।
প্রিয়তা আবার বললো,
— ‘‘চা বানানো শেষ হলে আপুর ঘরে চলে যেও ভাবি, ওখানে সাজাবো তোমাদের।’’
ঊষা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
এর মধ্যেই অরণ্যের এমন সাঁড়ের মতো চিৎকার শুনে বিরক্ত হলো প্রিয়তা।
অরণ্য আবার ডাকলো,

— ‘‘কইরে মোকলেসের বউ, আকলেসের বউ!’’
অরণ্যের এমন উদ্ভট নামে ডাক শুনে প্রিয়তার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
সে আটা মাখানো হাত না ধুয়েই বের হলো রান্নাঘর থেকে।
ডাইনিং রুমে পা রাখতেই প্রিয়তার মুখ হাঁ হয়ে গেল।
পৃথম, প্রেম, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র—তাদের মামাতো, খালাতো ভাই সাদিফ, রাদিফ, অভ্র, শুভ্র — সবাই ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে।

অরণ্য প্রিয়তাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো, ‘‘মোকলেসের বউ, তাড়াতাড়ি খেতে দে আমাগো। সারাদিন সেবা করতে করতে আত্মসেবা করার সময় পাই নাই… ধর… ক্ষুধায় আমার যদি by any chance কিছু হয়ে যায়, আমার না-হওয়া বউ বিধবা হয়ে যাবে, যা হবে চরম অন্যায়… একবার ভাব, আমার দুনিয়াতে না আশা আন্ডা বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে যাবে। তুই কি এটা চাস, মুখলেসের বউ?’’
অরণ্যের ফালতু বকবকানি শুনে ধমকে উঠলো প্রেম, দুর্বল গলায় বললো, ‘‘আরেকটা উল্টো পাল্টা কথা বললে আগামী ৭ দিন তোকে খেতে দেবো না।’’ আর বিয়ে ওটা হওয়ার তো কোন চান্সই নেই।
এতক্ষণ সবার অসহায় মুখগুলো দেখে, মায়া হলেও অরণ্যের বাজে বকা শুনে প্রিয়তার মেজাজ খারাপ হলো।
সে ঘুরে সামনে তাকিয়ে দেখলো, প্রণয় আর শুদ্ধ ফোন টিপছে।
তাদের মুখদুটোও শুকনো, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না।
প্রিয়তা আরেকবার সবাইকে দেখে দৌড়ে রান্নাঘরে গেল।
ত্রস্ত কন্ঠে ঊষাকে বললো, ‘‘ভাবি, চা হয়ে গেলে সাবধানে দিয়ে আসো আর আসার সময় আপু আর ইনুকে ও ডেকে এনো।’’

ঊষা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, মাথার ঘুমটা টা আরও একটু মাথায় টেনে, চায়ের ট্রেটা নিয়ে চলে গেল।
প্রিয়তা দ্রুত হাতে ভাত তরকারি বাড়তে লাগলো।
ইতিমধ্যে পরিণীতা ও এসে উপস্থিত হলো।
প্রিয়তা পরিণীতার হাতে বড় তরকারির বাটিটা দিয়ে বললো, ‘‘আপু, এগুলো নিয়ে যাও, ভাইয়াদের অনেক খিদে পেয়েছে।’’
পরিণীতা ও নিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে ঊষা আর ইনায়া ও এলো।
সকলে মিলে হরেক রকমের খাবার দাবার টেবিলে সাজাতে লাগলো।
সাধারণ দিনের তুলনায় আজ আরও অনেক বেশি রান্না হয়েছে।
খাবারের গন্ধে তরুণ শিকদারদের পেটে ইঁদুর লাফাতে শুরু করলো।
প্রিয়তা আর পরিণীতা ভাইদের খাবার বেড়ে দিতে লাগলো।

ভাত তরকারি প্লেটে পড়তেই হালুম হুলুম করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো অরণ্য, সমুদ্র, পৃথম, প্রেম, রাজ।
প্রিয়তা এবার শুদ্ধর প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে লাগলো।
শুদ্ধ তো দুনিয়া ভুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার সুন্দর মুখের দিকে।
তার ব্যস্ত দৃষ্টি, দ্রুত পদচারণা, সব ঝড় তুলছে যেন শুদ্ধর বুকে।
প্রিয়তার হাটার তালেতালে তার লম্বা বেনুনিটা দোলছে হাঁটুর নিচে।
হায়! এই দৃশ্যতে শুদ্ধ যেন একদম খুন হয়ে যাবে।
যে শুদ্ধ চৌধুরীকে নারী জাতি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, সেই শুদ্ধ চৌধুরী কোন এক কিশোরী কন্যার জন্য এত পাগলামি করে—এটা জানলে সমাজ কি তাকে মেনে নেবে?

প্রিয়তার লাবণ্যময়ী চেহারা দেখে শুদ্ধের অর্ধেক খিদে মিটে গেল।
প্রণয় শুধু শান্ত চোখে দেখলো শুদ্ধর চোখের মুগ্ধতা।
কেন জানি না চাইতে ও প্রণয়ের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।
সে চায় সবটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে, কিন্তু সামান্য এটুকুই তার হৃদপিন্ডের জন্য প্রচন্ড ভারী পড়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
যতই সব মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে ততোই হৃৎপিন্ডের ব্যাথাটা হু হু করে বাড়তে থাকে।
প্রিয়তা শুদ্ধকে ছেড়ে প্রণয়ের প্লেটে ভাত দিতে নিলেই প্রণয় তেজি কন্ঠে খানিকটা চিৎকার দিয়ে বলল, ‘‘খিদে নেই।’’
হাত থেমে গেল প্রিয়তার। চোখ তুলে তাকালো প্রনয়ের দিকে।
প্রণয় পুনরায় পরীকে ডেকে বললো, ‘‘পরী, এক গ্লাস পানি দিয়ে যা।’’
প্রণয়ের চাপা ধমকে ও যেন পুরো ডাইনিং টেবিল হালকা কেঁপে উঠল।সকলে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।

সারাদিন এত খাটার পর নাকি খিদে নেই!
অরণ্য তো মুখ ফস্কে বলেই বসলো, ‘‘কেন দাদান… তোমাকে তো সারাদিন পানি ছাড়া আর কিছু খেতে দেখি নাই… কত কাজ করেছো!’’
প্রণয় শুধু শান্ত চোখে তাকালো অরণ্যের দিকে, তাতেই চুপ হয়ে গেল অরণ্য, আর কিছু বললো না।
শুদ্ধ ভাতের লুকমা মুখে তুলতে তুলতে বললো, ‘‘খিদে পেয়েছে, জানি… খেয়ে নে।’’
প্রণয় কিছু বললো না।
শুধু প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, ‘‘পেট ভরা।’’
বলে উঠে চলে গেল ডাইনিং রুম থেকে।
পরিণীতা পানি নিয়ে এসে পিছন থেকে ডাকলো, ‘‘পানি টা খেয়ে যাও দাদান।’’
কিন্তু প্রণয় দাঁড়ালো না।

তাজ্জব বনে গেল সবাই।
প্রিয়তা মনে কষ্ট পেল।
প্রণয় কথায় সে স্পর্শ বুঝেছে, এগুলো করে প্রণয় ভাই তার উপর রাগ ঝেড়ে গেলেন।
কিন্তু কী করেছে সে?
শুদ্ধ… সবই বুঝলো।
কিন্তু ওই যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের কিছু করার থাকে না, না চাইতেও স্বার্থপর থাকে… হতেই হয়!
আর বাকিরা কেউ তেমন কিছু মাইন্ড করলো না।
অরণ্য মুরগির ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে কথা পারলো, বিশেষ করে বোনদের উস্কে দিয়ে বললো, ‘‘মেজদা আমাদের ভাইদের পারিশ্রমিক দেয়নি। তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু আমার মোকলেসের বউদের ভাগটা ও মেরে দেবে—এটা কিন্তু চরম অন্যায়।’’
অরণ্যের কথায় সবাই খাওয়া থামিয়ে দিল।
ভুরু কুঁচকে ফেললো পৃথম।

অরণ্য আবার দুঃখি দুঃখি মুখে বললো, ‘‘কাল রাত হারভাঙা খাটুনি খেটে মেজদার জন্য নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ফুল কিনে ৪ ঘণ্টা লাগিয়ে ঘর সাজালাম। বিনিময়ে হরি মটর পেলাম।
আমার কুদ্দুস মোকলেসের বউয়েরা তাদের আটা ময়দা নষ্ট করে ভাবিকে সাজালো।
তার বিনিময়ে কী পেলো? হরি মটর!
এটা আমাদের উপর চরমভাবে শোষণ হয়েছে!
আমরা শোষিত হয়েছি! এই অবিচার কিছুতেই মানছি না, মানবো না।’’
অরণ্যের কথায় সবার মুখের এক্সপ্রেশন পালটে গেল।
সকলেই অরণ্যের কথায় তাল মিলিয়ে বললো, ‘‘মানছি না, মানবো না!’’
অরণ্য আবার বললো, ‘‘আমাদের দাবি মানতে হবে এক্ষুনি! কমপক্ষে ২ লাখ দিয়ে আমাদের পাওনা গণ্ডা মিটাতে হবে!’’

প্রেরণা আর থিরা ও চলে এলো।
রাজ বললো, ‘‘এটা কিন্তু ভারী অন্যায়, মেজদা! তোমার জন্য আমরা কত কিছু করলাম…’’
ওদের কথায় ইনায়া লজ্জায় শেষ।
পৃথম একবার হাইব্রিড বাঁদরগুলোর দিকে তাকিয়ে ইনায়াকে ডাকলো, ‘‘একটু এদিকে আসোতো, রসগোল্লা!’’
সবার সামনে এমন সম্বোধনে কেঁপে উঠলো ইনায়া।
ওরা একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘‘হাএএএয়!’’
অরণ্য আবার দুষ্টু কণ্ঠে বললো, ‘‘I wish… আমারও যদি এমন কোনো চমচম বা রসমালাই থাকতো!’’
রাজ মুখ বাঁকিয়ে বললো, ‘‘তোর কপালে বাসি মিষ্টিও জুটবে না।’’
ইনায়া ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পৃথমের কাছে।
পৃথম হাত এটো তাই ইনায়া কে পকেটের দিকে ইশারা করে বললো, ‘‘ওয়ালেট বের করে বাঁদরগুলোকে আমার কার্ডটা দিয়ে দাও।’’

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৭

ইনায়াও তাই করলো। পৃথমের ক্রেডিট কার্ড বের করে অরণ্যের হাতে দিল।
অরণ্য সেটার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো, ‘‘চলো ভাই লোক, এটা দিয়ে কাল পার্টি করবো।’’
ওদের সকলের চোখ-মুখ উজ্জ্বলতায় চেয়ে গেল।
পৃথম বিরক্ত কণ্ঠে বিরবির করলো, ‘‘বাঁদর যত গুলো।’’

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৯