ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
পরিণীতা, প্রিয়তা, থিরা, প্রেরণা, চিত্রা, পূর্ণতা, ইনায়া—সবাই আশন পেতে বসেছে প্রিয়তার খাটের উপর।
বিছানার চারদিকে বিভিন্ন ডিজাইনের এক্সপেন্সিভ শাড়ি, জুয়েলারি, মেকআপ ছড়িয়ে আছে।
ওরা সব কিছু ছড়িয়ে নিয়ে বসে খুশ গল্পে মেতে আছে।
পূর্ণতা আর চিত্রা ও এসেছে।
উষা আর প্রেমের বিয়ের পর আজ প্রথম শিকদার বাড়িতে পা রাখলো চিত্রা।
সে অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে আটকে রাখার, কিন্তু ওই যে বেহায়া মনটা, ভালোবাসার মানুষকে একটিবার দেখার জন্য আরও বেহায়া হয়ে উঠেছে।
চিত্রা অবশ্য নিজের মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে—যা তার হবার নয়, তার উপর সে আর কোনো আশা রাখবে না।
রাখেও না।
শুধু একটু মানসিক শান্তির জন্য এসেছে, শুধু একটিবার মন ভরে দেখে চোখের তৃষ্ণা নিবারণ করতে চায়।
কারো সংসারে বা হাত ঢুকানোর কোন মানসিকতা তার নেই।
সে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু ছোটলোক নয়।
তাই আত্মমর্যাদা আর বিসর্জন দেবে না সে। আর সত্যিই তো যতই হোক প্রেম তার ছোট বোনের স্বামী। বোনের স্বামীর কাছে ভালোবাসা দাবি করা ছিহ।
তাই যতটা সম্ভব, নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছে চিত্রা।
প্রিয়তা, পরিণীতা আর প্রেরণা ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মিঠিমিঠি হাসছে, আর ইনায়া বেচারি লজ্জায় লাল, নীল, হলুদ, সবুজ হয়ে যাচ্ছে ওদের এক একটা কথায়।
প্রিয়তা ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বললো—
“ভাবীজি, এখনো কি আমাদের ভাইবোনের রক্ত চুষে খাওয়ার পরীকল্পনা আছে নাকি বাতিল করেছেন? মনে তো হচ্ছে…”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রিয়তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পরিণীতা ও দুষ্টু হেসে বললো—
“মনে হচ্ছে খুব আদরে কেউ বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র এঁকে দিয়েছে।”
প্রিয়তা দের মামাতো বোন মেঘা রশিকতা করে বলল—
“ভাইয়ার ভালোবাসার ডোজটা বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে গেছিলো তাই না ভাবি। এখন এতো ভালোবাসা ঢাকতে গিয়ে আমাদের নাকানিচুবানি খেতে হবে না জানি কয়টা কনসিলার শেষ করতে হয়।”
পূর্ণতা আরও এক ধাপ এগিয়ে, প্রত্যেকটা ক্ষতচিহ্ন ধরে ধরে গভীর ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে আর একটু পর পর দুঃখ প্রকাশ করে বলছে—
“ইস্! কতটা যখম হয়ে গেছে! খুব ব্যথা পেয়েছিস তাই না ইনু?”
পূর্ণতার কথায় বিরক্ত হলো পরিণীতা। তেতো কণ্ঠে আফসোসের সুর তুলে বললো—
“ছ্যাহ পূর্ণা! তোর মধ্যে রসকষ আর কোনোদিনও হবে না। না জানি তুই কোন শালার ভাগ্যে আছিস!সেই শালার জন্য আমার পক্ষ থেকে এক বালতি সমবেদনা। তোকে যে শালা বিয়ে করবে সে তো শেষ। আরে ছাগলী! সব ব্যথা কষ্টের হয় না।”
পরিণীতা আবারো ইনায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বললো—
“কিছু ব্যথা হয় পরম সুখের। সেটা তোদের মতো গাধীরা কোনোদিনও বুঝবে না! আগে বিয়ে কর, তারপর থিওরির প্রয়োজন পড়বে না, প্র্যাক্টিক্যালি সব বুঝে যাবি।”
ইনায়ার গলায়, বুকে, হাতে, কাঁধে, গায়ে—এক কথায়, পুরো শরীরজুড়ে গভীর গভীর জখমের দাগ, লাভ বাইটগুলো দেখে পরিণীতার মামাতো বোন শুভ্রতা নিজের বুকে হাত চেপে বললো—
“হায়! এমন দিন আমার কবে আসবে!”
ওদের কথার মধ্যেই প্রিয়তার ঘরে প্রবেশ করলো শ্বেতা।
মেয়েটা যদিও বিদেশে মানুষ, তবুও ওর কথা-বার্তা, চাল-চলন, পোষাক-আশাক—সব অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও মার্জিত, প্রিয়তা-পরিণীতা-দের মতোই।
শ্বেতা এসে প্রিয়তার পাশ ঘেঁষে বসলো। শুভ্রতা কে পিঞ্চ মেরে বললো—
“তোর দুধের দাঁত পড়েছে! এখনই এই দিনের জন্য লাফাচ্ছিস! আগে হরলিক্স-টর্লিক্স খেয়ে বড় হ !”
শুভ্রতা মুখ ভেঙ্গালো। ইনায়া, পূর্ণতা আর চিত্রা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো শ্বেতার মুখের দিকে।
শ্বেতাকে তারা আগে দেখেনি। মেয়ে অদ্ভুত রকম সুন্দরী। মুখের গড়নে ৬০% শুদ্ধ শুদ্ধ ভাইব দেয়।
শুদ্ধের মতোই অসাধারণ সুন্দর্যের অধিকারিনী—ধূসর বর্ণের চোখ, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, পানপাতা মুখ, আর মাধুর্য মিশ্রিত একটুকরো মিষ্টি হাসি।
কেউ শ্বেতা আর শুদ্ধকে পাশাপাশি দেখলে চোখ বন্ধ করে বলে দেবে—এরা এক মায়ের পেটের ভাইবোন!
দু’জনের চেহারার সবটাই প্রায় এক রকম।
শ্বেতা ইনায়াকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, ইনায়ার ফুল ফুল গাল টেনে দিলো।
মিষ্টি হেসে বললো—
“বাহ্! প্রিথম ভাইয়ার বউ তো খুব মিষ্টি! বেশ গোলুমোলু, আদুরে!”
লজ্জা পেয়ে গেল ইনায়া।
শ্বেতা প্রিয়তার হাত জড়িয়ে ধরে বললো—
“ভাবি, এখন সাজানো শুরু করো।”
সকলেই সুন্দরভাবে গুছিয়ে বসলো।
থিরা বললো—
“কিন্তু আপুরা, ছোট ভাবি তো এখনো আসেনি!”
এবার সকলের খেয়াল হলো—আসলে উষা এখানে নেই।
প্রিয়তা থিরাকে বললো—
“যা, ভাবিকে ডেকে নিয়ে আয়।”
থিরা মাথা নেড়ে উঠে দৌড় দিলো।
প্রিয়তা-পরিণীতা-দের মুখে “ভাবি” ডাকটা চিত্রার সোজা হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত আনে।
এদের মুখে এই ডাক শুনার জন্য সে কতটা ব্যাকুল ছিল সে!
অথচ চিত্রা ও উঠে গেলো, ঘর থেকে বেরিয়ে থিরাকে পেছন থেকে ডেকে উঠলো—
“থিরা!”
দাঁড়িয়ে পড়লো থিরা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো চিত্রার দিকে।
চিত্রা ছুটে এসে বলল বললো—
“আমি উষাকে ডেকে আনছি… তোমাকে কুহু খুঁজছে।”
থিরা কুহুর কথা শুনে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো—
“কোথায় কুহু আপু?”
চিত্রা হাসার চেষ্টা করে বললো—
“আছে, নিচে কোথাও খুঁজে দেখো।”
থিরা ও মাথা নেড়ে চলে গেলো।
চিত্রা কম্পনরত পায়ে চারতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। প্রতিটা কদমে কদমে তার হৃদপিণ্ড ছলাত ছলাত করছে, গলা শুকিয়ে কাট হয়ে আসছে।
ঊষা বিছানায় পা ভাজ করে প্রেমের এক গাদা শার্ট নিয়ে বসেছে। সেগুলো বোতাম লাগাতে লাগাতে মনে মনে বিরবির করছে,
“অদ্ভুত লোক! পুরুষ মানুষ এতো অগোছালো হয়? প্রতিদিন শার্টের বোতাম ছিঁড়ে দেয়, আর প্রতিদিনই সেটা আমাকে সেলাই করতে হয়। উফ্! এতটা অধৈর্য মানুষটা! বাড়ি ফিরে একটু ধীরে-সুস্থে শার্টগুলো খুললে কী হয়?”
ঊষার ভাবনার মাঝেই প্রেম ভিতরে প্রবেশ করলো। বাহিরে সবার পেমেন্ট করে দিয়ে এসেছে , সব কাজ শেষ। এখন সে নিশ্চিন্ত। এবার একটু শান্তিতে বিশ্রাম নেওয়া যাবে। আজ প্রচুর খাটুনি গেলো, হাড়-হাড্ডি মোচড়াচ্ছে।
প্রেম শার্টটা টেনে খুলতে যাবেই, এমন সময় ঊষা চিৎকার দিয়ে উঠলো—
“একদম ওটা টেনে হিচড়ে খুলবেন না, ধীরে ধীরে খুলুন!”
ঊষার কথায় থেমে গেল প্রেম। শার্টের বোতাম থেকে হাত সরিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো বউয়ের দিকে।
আজকাল প্রেম বুঝে উঠতে পারে না—এই ঘরটা আসলে তার, না তার বউয়ের।
বউ তার আর আগের মতো নরম-সরম নেই, ভয়-ডরও তেমন নেই।
সব কাটিয়ে এখন পাক্কা গিন্নি হয়ে গেছে।
ঊষা আবার বললো—
“আপনি প্রতিদিন শার্টের বোতাম ছিঁড়বেন, আর আমি সেলাই করবো? এটাতো আর প্রতিদিন মানা যায় না। ধীরে-সুস্থে খুলুন।”
প্রেম শার্ট খুললো না, বরং দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল ঊষার দিকে।
ধপ করে পাশে বসে পড়লো, এসির পাওয়ার বাড়িয়ে ঊষার দিকে এগিয়ে এলো।
প্রেমকে এগিয়ে আসতে দেখে চমকে উঠলো ঊষা।
প্রেম আরও কাছে গিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে বললো—
“আমি এত ইন্সট্রাকশন ফলো করতে পারবো না। আমার কাজ পছন্দ না হলে নিজেই করে দেবে।”
ঊষা চোখ পিটপিট করে চাইল।
প্রেম নিজেকে এগিয়ে দিয়ে বলল—
“নাও, এখন যেভাবে পারো খুলে দাও। অনেক গরম লাগছে।”
ঊষা প্রেমের বুকে-পিঠে হাত ঠেকিয়ে দেখলো, পুরো শার্টটা ঘামে ভিজে জেব জেবে।
ঊষা সুই-সুতা ফেলে দ্রুত হাতে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো।
ঠিক তখনই ধীর পায়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো চিত্রা।
কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলার আগেই তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল,অক্ষি যুগল টলমলে হয়ে উঠল।
পায়ের নিচের জমিন যেন সরে গেল, অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইলো সামনে…
ঊষা দ্রুত হাতে সাদা শার্টটা খুলে পাশে রাখলো।
উজ্জ্বল ফরসা, পুরুষালি দেহটা গরমে ঘামে ভিজে লাল হয়ে আছে।
প্রেম দুই হাত পেছনে দিয়ে হেলান দিলো—
এখন আরাম লাগছে।
ঊষা প্রেমের পিঠে হাত ঠেকিয়ে দেখলো, পুরো শরীর বরফের ন্যায় হিম শীতল। বুক-পিঠ বেয়ে ঘামের বিন্দুগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে, পুরো শরীর ভিজে।
ঊষা নিজের গলার ওড়নাটা দিয়ে প্রেমের ঘর্মাক্ত পেটানো শরীরটা ধীরে ধীরে মুছিয়ে দিতে লাগলো।
এখন আর ঊষা কাঁপাকাঁপি করে না, এই মানুষটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
ভীষণ মায়া ও জন্মে গেছে।
আচমকাই ঊষা কে হতভম্ব করে দিয়ে প্রেম তার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো—উদ্দেশ্য, একটা লম্বা ঘুম।
প্রেমের হঠাৎ স্পর্শে আলতো কেঁপে উঠল ঊষা।
প্রেমের চোখ থেকে চশমাটা খুলে পাশে রাখলো, কোমল হাতে প্রেমের সিল্কি চুলগুলো টেনে দিতে দিতে ডাকলো—
“এই যে শুনছেন…”
জবাব দিলো না প্রেম।
ঊষা আবার ডাকলো—
“এই যে শুনছেন…”
প্রেম কথা বলতে চাচ্ছে না, তবু ও ক্লান্ত কণ্ঠে বললো—
“ডিস্টার্ব কোরো না বউ, আই নিড টু স্লিপ…”
প্রেমের মুখে “বউ” ডাকটা সবসময় এর ন্যায় এবারও ঊষার বুকে তীরের মত বিধলো।
তবু ও ঊষা কোমল কণ্ঠে বললো—
“প্লিজ, উঠে গোসল সেরে ঘুমান। বাইরে থেকে এসেছেন, এভাবে ঘুমাবেন না। প্লিজ…”
প্রেম বিছানা হাতরে চশমাটা চোখে পড়ে নিল, মাথা তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকালো ঊষার দিকে।
মেয়েটা মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে।
প্রেম শরীর টানটান করে উঠে দাঁড়ালো, ঊষার দিকে তাকিয়ে বললো—
“ওয়ারড্রোবের নিচের তাকে আরও কুড়িটার মতো বোতাম ছাড়া সাদা পাঞ্জাবি আছে, ওগুলোতে একটু লাগিয়ে দিও প্লিজ…”
ঊষা ঠোঁট উল্টে তাকালো।
প্রেমের হাসি পেয়ে গেল।
ঊষার কোমল গাল ধরে টেনে বললো—
“তুমি যদি না করে দাও, তাহলে কে করবে বলো? আমার কি আরও ২-৪টা বউ আছে?
তুমি যদি আমার অগোছালো জিনিস গুছিয়ে না দাও, তাহলে বাধ্য হয়ে হয়তো আমাকে আরেকটা বিয়ে…”
প্রেম কথাটা শেষ করার আগেই লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো ঊষা।
চোখের পলকে ওয়ারড্রোব খুলে পাঞ্জাবি গুলো নিয়ে আসলো।
ঊষার কাণ্ডে হেসে ফেললো প্রেম।
ঊষার সেলাই করা শার্টগুলো থেকে একটা তুলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো—
“এই তো ভালো বউ!”
প্রেমের মুখে দ্বিতীয় বিয়ের কথা ঊষা এখনো হজম করতে পারছে না, তার হৃদস্পন্দন অদ্ভুত ভাবে বেড়ে গেছে মনের মধ্যে কেমন প্রচন্ড হিংসে কাজ করছে।
না পৃথিবী উল্টে গেলেও, ঊষা তার স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারবে না আর সব থেকে বড় কথা দেবেও না।
চিত্রার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
ভালোবাসার মানুষ সুখে আছে—এটা তো ভালো কথা।
তবে সে আমার সাথে নয়, অন্যের সুখে আছে—এই দৃশ্যের যন্ত্রণা এত প্রখর কেন?
চিত্রার গলা কাঁপছে, কিন্তু সে এসব থেকে আর পালাবে না।
চিত্রা বার বার দুই হাতে চোখের পানি মুছবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে, তবু চোখের পানি গুলো বেহায়ার মতো নতুন উদ্যমে ভরে উঠছে।
চিত্রা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে মনের আগুনে ছাই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
দ্বিতীয়বার চোখ মুছে ঘরের দরজায় নক করলো।
ততক্ষণে পিছনে তাকালো ঊষা।
চিত্রাকে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে তার চোখে পানি চলে এলো।
ছুটে গেল চিত্রার কাছে।
আনন্দিত কণ্ঠে বললো—
“তুমি এসেছো, আপু! বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।”
বলে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলো চিত্রাকে।
চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো।
এই ঘরটা দেখে এখন আর কেউ বলবে না যে এটা একটা পুরুষ মানুষের ঘর।
প্রেমের আগের ঘরের সাথে এখনকার ঘরের কোনো মিলই নেই।
পুরো ঘরের চিত্রই পাল্টে গেছে—পুরো কক্ষে এখন মেয়েলি মেয়েলি একটা ব্যাপার আছে।
ঊষা বললো—
“দাঁড়িয়ে আছো কেন, আপু? বসো। তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো না কেন?”
চিত্রা মিথ্যে হাসার চেষ্টা করে তাকালো ঊষার দিকে।
মেয়েটা বোধহয় আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছে।
চিত্রা কথার জবাব না দিয়ে আচমকাই বললো—
“তুই অনেক সুখে আছিস, তাই না বোন?”
ঊষা প্রশস্ত হাসল।
চিত্রা মুগ্ধ চোখে দেখলো সেই হাসি, যা শব্দের থেকেও বেশি।
চিত্রা আবার প্রশ্ন করলো—
“তোর বর তোকে অনেক ভালোবাসে, তাই না?”
ঊষা লজ্জা পেল। এবার তার গালের রক্তিম আভা চিত্রার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো।
আবার চোখ ভরে উঠছে চিত্রার।
সে আর কথা না বাড়িয়ে বললো—
“প্রিয়তা তোকে ডাকছে, বোন।”
চিত্রার কথায় মনে পড়লো ঊষার—সে তো সব ভুলেই বসে ছিল।
ঊষা যত দ্রুত সম্ভব প্রেমের জামাগুলো গুছাতে গুছাতে বললো—
“একটু দাঁড়াও, আপু।”
ঊষাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এই ঘরের মালকিন আর চিত্রা সামান্য অতিথি।
আর এটাই তো বাস্তব সত্যি।
ঊষা জামাকাপড়গুলো গুছিয়ে আলমারিতে তোলার সময় চিত্রা সুযোগ বুঝে প্রেমের কিছুক্ষণ আগের খুলে রাখা ঘামে ভেজা শার্টটা তুলে নিলো।
আর কোনোদিকে না তাকিয়ে প্রেমের ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।
ঊষা জামাকাপড় গুছিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখলো—চিত্রা কোথাও নেই।
আশ্চর্য হয়ে গেল ঊষা।
সে কাপড়গুলো রেখে এসে ধোয়ার জন্য প্রেমের ঘামে ভেজা শার্টটা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু একি! কোথায় গেল শার্টটা?
ঊষার কপাল কুঁচকে গেল।
সে সব জায়গায় খুঁজেও সেই সাদা শার্টটা পেল না।
এর মধ্যেই প্রিয়তা ডাকতে চলে এলো।
দৌড়ে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো—
“তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি, ভাবি! তাড়াতাড়ি চলো।”
বলে হাত টেনে নিয়ে চলে গেল।
আর কিছু ভাবার সময় পেল না ঊষা।
চিত্রা ছুটে এসে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে পড়লো।
দরজা বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।
চোখের নদীতে তার বাঁধ ভেঙেছে অনেক আগেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
সে প্রেমের ঘামে ভেজা শার্টটা নাকে-মুখে চেপে ধরলো—
ড্রাগ নেওয়ার মতো বুকভরে পুরুষালী দেহের ঘ্রাণটা হৃদপিণ্ডে ভরে নিতে লাগলো।
পুরুষালি দেহের গন্ধের সাথে পারফিউম আর ঘামের মিশ্র গন্ধ একাকার হয়ে উঠেছে।
শার্টটা থেকে একটা মাদকীয় ম্যানলি ঘ্রাণ আসছে।
চিত্রা প্রেমের দেহের গন্ধটা নিজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুষে নিতে লাগলো।
প্রেমের গায়ের গন্ধে মনে হচ্ছে, প্রেম তার খুব কাছেই আছে।
চিত্রা কাঁদছে, তবে শব্দ করে নয়।
সে এই অনুভূতি আর কাউকে দেখাবে না।
এই ভালোবাসা তার একার।
তাই এই যন্ত্রণা সে আর কারোর সাথে ভাগাভাগি করতে চায় না।
এই ভার সে একাই বইবে।
চিত্রা প্রেমের শার্টটা গায়ে পরে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললো—
“চাইলাম না তোমায়, প্রেম! তোমায় আমার হতে হবে না।
তবু তুমিই সুখী হও।
আমি না-হয় দূর থেকেই ভালোবাসবো তোমায়।
তোমার প্রেম আমার কপালে সইলো না।
তাই বলে আমি তোমায় কখনো অভিশাপ দেবো না।
আমি চাই তুমি জীবনে সর্বোচ্চ সুখী হও।
আল্লাহ্ আমার ভাগ্যের সব সুখ তোমাকে দিক,
তোমার সব কষ্ট আমাকে দিক।
তুমি খুব খুব সুখী হও, প্রেম।
এইটুকুই চাই…”
চিত্রার চোখের কোণে ভেসে যায় নুনা পানির স্রোতে।
বুক গভীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তিব্র যন্ত্রণার বিষ।
তবুও সে নীরব।
আজ থেকে সমস্ত বিষ সে একাই হজম করে নেবে, নীরবে নিঃশব্দে।
রাত ৮টা।
প্রহেলিকা চুপচাপ বসে আছে চেম্বারের বাইরের করিডোরে, পাতলা কাঠের চেয়ারে।
চারপাশে নিঝুম নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে পাশের রুম থেকে হালকা পেইজার টোন, আর নার্সদের জুতা টুপটাপ শব্দ ছাড়া তেমন কিছু শোনা যাচ্ছে না।
তার মনে এলোমেলো ঝড় বয়ে চলেছে।
অস্থিরতায় তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।
গত এক সপ্তাহ সে ঠিকমতো খেতে পারেনি, ঘুমাতে পারেনি, অস্বস্তিতে নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত নিতে পারে নি ঠিকমতো।
তার খালি মনে হচ্ছে, তার হয়তো নতুন কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, কারণ গত এক মাসের সব কথা সে সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।
শত চেষ্টা করেও একটা বাক্যও মনে করতে পারেনি।
গত এক মাসে কী কী ঘটেছে, তার কিছুই মনে নেই প্রহেলিকার।
এমনকি দিন দিন তার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটেই চলেছে।
প্রহেলিকা মাথা চেপে ধরে ভাবলো—
আমার ধারণা, যদি খুব ভুল না হয়, তাহলে কেউ তো আছে, যে আমার পিঠে খুব সন্তর্পণে ছুরি বসাচ্ছে।
আর সেই ঘর শত্রুটা কে,—সেটা তো আমাকে জানতেই হবে।
একবার যদি বুঝতে পারি, বিশ্বাসঘাতকতাটা কে করছে, তাহলে তাকে হারে হারে বুঝিয়ে দেব, এই প্রহেলিকা শিকদার আসলে কি জিনিস।
প্রহেলিকা সব ভাবনা-চিন্তা এক পাশে ফেলে আবারো মনস্থির করে ভাবলো—
না না, আগে নিজেকে এই মেন্টাল ট্রমা থেকে রিকভার করাটা জরুরি।
আগে আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে, তার পর প্রত্যেককে বুঝাব, এই প্রহেলিকা শিকদারের সাথে ডাবল রোল প্লে করার ফল।
তার ভাবনার মধ্যেই একজন মধ্যবয়সি নার্স এসে ডেকে ওঠলেন—
“মিসেস প্রহেলিকা শিখদার?”
প্রহেলিকা ধাতস্থ হতে একটু সময় নিলো, তারপর চোখ তুলে তাকালেন নার্সের দিকে।
নার্স একরাশ ক্লান্তি মাখা মুখে পেশাদার ভঙ্গিতে বললেন—
“আপনি ভিতরে গিয়ে বসুন। স্যার আসছেন একটু পরেই।”
প্রহেলিকা কোনো কথা না বলে ধীরে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
ধীর পায়ে চলে গেল ডক্টরের চেম্বারের দিকে।
চেম্বারের দরজার ওপরে প্লেটে লেখা—
ড. আবির্ভাব রায়চৌধুরী
Dr. Abhirbhav Raychaudhuri (M.B.B.S, M.D. in Psychiatry)
এর নিচে ছোট অক্ষরে লেখা—
“Healing is a process, not an event.”
এই ডক্টর কানাডার মোস্ট পপুলার মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একজন।
তিনি এই এক বছর হল বাংলাদেশে চিকিৎসা শুরু করেছেন।
প্রহেলিকা অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এই ডঃ এর এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে।
প্রহেলিকা দরজা ঠেলে ভেতরে পা বাড়াতেই প্রহেলিকার মনে একটা শীতল বাতাস দোলা দিয়ে গেল।
তার মনে হলো—এটা কোনো ডাক্তারখানা না, এখানে অন্য কিছু ও আছে, যা মস্তিষ্ককে নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে নেয়।
প্রহেলিকা আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে কক্ষটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
ঘরের প্রবেশ পথের মেঝেতে ধূসর-নীল রঙা নরম কার্পেট।
দরজার পাশে একটা ম্যাটে লেখা—
“Take a breath. You’re safe here.”
প্রহেলিকা ডান পাশে তাকালো।
ডান দিকের জানালার সাদা-ধূসর রাঙা পর্দার ফাঁক গলিয়ে একফালি হলুদ আলো জানালার সামনের মেঝেতে পড়ছে।
পুরোটাই যেন আলো-আঁধারের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তির মেলা।
ঘরের বাঁদিকে বিশাল বুকশেলফ—অনুপ্রেরণা, স্নায়ুবিজ্ঞান, থেরাপি, মনের ভেতরের জটিলতা নিয়ে লেখা বই।
বাংলা-ইংরেজির এক মিশ্র ভাণ্ডার।
বইয়ের পাশে কাচের কিউরিও কেসে রাখা রাবার ব্রেন, নিউরনের ছোট্ট মডেল, বালি-পাল্টানো টাইমার, আর একটা ছোট স্নোগ্লোব—ভেতরে এক চিমটি তুষার ঘূর্ণি।
ডানদিকে পরিপাটি কাঠের ডেস্ক।
ওপরেই ল্যাম্প, একটা নামফলক, ধাতব ঘড়ি, কলমদানি, আর নথিপত্র।
পেছনের দেয়ালে বিমূর্ত চিত্রকর্ম—রঙ যেন মনের জটলা।
পাশে রাখা DSM-5, থেরাপির পাঠ্যবই।
ডক্টরের চেয়ারটা এখনো ফাঁকা। কেউ নেই।
ঘরটা নিঃসঙ্গ। তবে শান্ত, হালকা শীতল।
দেয়াল, আলো, বই—সব মিলিয়ে একরকম নির্ভরতা তৈরি করে যেন।
নাকে এসে লাগছে মৃদু ল্যাভেন্ডারের গন্ধ, আর কোথাও থেকে কফির খুব হালকা গন্ধও যেন ভেসে আসছে।
প্রহেলিকা ধীরে ধীরে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়লো।
চোখ নামিয়ে রাখলো টেবিলের দিকে।
কপালে হাত ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
হাজার প্রশ্ন তার মনে—
এসেছে তো ঠিক আছে, কিন্তু ডক্টরকে বলবে টা কি?
কোনটা বলবে আর কোনটা বলবে না—সেটাই বুঝতে পারছে না প্রহেলিকা।
“অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন বুঝি?”
হঠাৎ একটা পুরুষালী মোলায়েম কণ্ঠ কানে এল।
ছ্যাঁত করে প্রহেলিকার ভাবনার সুতো কেটে গেল।
প্রহেলিকা চোখ তুলে তাকালো সামনে।
কিছু মুহূর্ত থমকে রইলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে একজন—২৮-২৯ বছর বয়সী, বেশ সুদর্শন যুবক।
চোখে এক অন্যরকম আত্মবিশ্বাস।
তার অধরের কোনে মৃদু সৌজন্যমূলক হাসি।
তিনি নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন—
“আপনার গভীর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য দুঃখিত।”
“তবে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি কোনো এক বিষয়ে বেশ চিন্তিত, উদ্ভ্রান্ত। এত চিন্তা শরীর-মন—দু’টির জন্যই বেশ ক্ষতিকর, আপনি জানেন তো?”
প্রহেলিকা অনুভব করল, এই ডক্টরের কথায় ও এই ঘরের ন্যায় আলাদা একটা ব্যাপার আছে, যা অতি সহজেই মানুষের মস্তিষ্ককে কন্ট্রোল করতে পারে।
ডক্টর আবারো মৃদু হেসে বললেন, “আমি ড. আবির্ভাব রায়চৌধুরী।
আজ আমরা একসাথে কিছুটা সময় কাটাবো।
মনে করেন, এই ঘরটা আপনার—আপনার ভাষায়, আপনার চুপ করে থাকার মধ্যেও।”
প্রহেলিকা চুপ।
আবির্ভাব বুঝলো, প্রহেলিকার মনের অস্বস্তি, তাই সে আরো কিছুটা কোমল কন্ঠে বলল, “আপনি যদি এখনই আপনার সমস্যা বলতে প্রস্তুত না থাকেন, সেটাও ঠিক আছে।
আমি তাড়াহুড়ো করবো না। ধীরে-সুস্থে সব শুনবো।”
প্রহেলিকা এবারও চুপ করে রইলেন।
সে তো অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু কথাগুলো ডক্টর কিভাবে নেবে, সেটাই বুঝতে পারছে না।
কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে—সব নিয়ে কনফিউজড?
ড. আবির্ভাব কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ প্রহেলিকা দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অতঃপর, হালকা ভ্রু নাড়িয়ে বললেন—
“ঠিক আছে। সমস্যার কথায় পরে আসা যাবে।
আমরা একে অপরকে এখনো চিনি না।
তাই শুরুটা হোক একদম ছোট কিছু দিয়ে।
আপনি চাইলে শুধু আপনার নাম বলুন।
অথবা এমন কিছু, যেটা বলা আপনার জন্য সহজ মনে হয়।
চাইলেই বলতে পারেন—আপনার গত এক সপ্তাহ কেমন কেটেছে।”
প্রহেলিকা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অভির্ভাবের দিকে।
সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছোট করে বললো, ‘‘আমি প্রহেলিকার শিকদার।’’
আভির্ভাব মৃদু হাসলো। ধীর, স্থির কণ্ঠে বললো, ‘‘বেশ, তা আপনি এখানে নিজেই এসেছেন, না কেউ পাঠিয়েছে?’’
প্রহেলিকা আবারো ধীর কণ্ঠে বললো, ‘‘না, নিজেই এসেছি।’’
আভির্ভাব তীক্ষ্ণ নজরে সামনে ২৫-২৬ বছর বয়সী তরুণীকে নিরীক্ষণ করলো।
প্রহেলিকাকে দেখে তার প্রচণ্ড রহস্যময় ও অদ্ভুত লাগছে।
আর সে এটা বেশ বুঝতে পারছে—এই রহস্যই যত সমস্যার মূল কারণ।
আভির্ভাব বললো, ‘‘তাহলে এখন আমি জানতে পারি, যে কী এমন বিষয় নিয়ে আপনি এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?
বা এমন কিছু, যা আপনি ভুলতে পারছেন না?
আপনি সময় নিন, কোনো তাড়া নেই। আমি সব শুনবো।’’
প্রহেলিকা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বড় নিঃশ্বাস নিলো।
ধীরে বলতে শুরু করলো, ‘‘আমার কিছু দিন ধরে কিছু অদ্ভুত সমস্যা হচ্ছে।’’
আভির্ভাব ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল, ‘‘কীরকম সমস্যা?’’
প্রহেলিকা মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘‘কিছু দিন হলো, আমার মধ্যে কেমন অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে।
আমি গত এক মাসের সব কথা ভুলে গেছি।
একটু আগের কথা বা একটু পরের কথা কিছুই মনে থাকছে না।’’
আভির্ভাব অনুজ্ঞাসূচক চোখে পর্যবেক্ষণ করলো প্রহেলিকাকে।
শান্ত, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘‘আপনি নিশ্চিত, এটাই আপনার প্রধান সমস্যা?’’
প্রহেলিকা কিছুটা হতভম্ব চোখে তাকালো অভির্ভাবের দিকে।
আভির্ভাব মৃদু হেসে বললো, ‘‘আপনার চোখ দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
আপনার চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যে আপনার জীবনের হয়তো এমন কিছু কথা, হয়তো কিছু ঘটনা বা এমন কোনো সমস্যা — যা নিয়ে আপনি অনেক ডিপ্রেসড, অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
আর এই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার জন্যই, দিন দিন আপনার মানসিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটছে।’’
প্রহেলিকার খানিক অস্বস্তি হলো।
এই জন্যই সে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসতে চায় না।
কিন্তু…
প্রহেলিকার মুখের ভঙ্গিমা দেখে হাসলো আভির্ভাব।
মৃদু হেসে বললো, ‘‘সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে না আসলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
আমরা ডাক্তার।
আমাদের দায়িত্ব — আমাদের পেশেন্টকে চিন্তামুক্ত থাকার উপায় বলা।
বন্ধুর মতো তার সকল ভালো-মন্দ, সকল কথা শোনা — উইদাউট এনি জাজমেন্ট।’’
প্রহেলিকা একটু অবাক হয়ে তাকালো।
আভির্ভাব আবার বললো, ‘‘আপনি যদি চান, তো একদম নিশ্চিন্ত মনে আমাকে আপনার সব কথা বলতে পারেন।
আমি একটুও জাজ করবো না, কারণ পেশেন্টের সমস্যার কথা শুনে, তার যথাযথ চিকিৎসা করা আমার কাজ।
তাকে জাজ করা আমার কাজ নয়। এমনকি আমি জাজ করার ও কেউ নই।’’
প্রহেলিকা একটু চিন্তায় পড়ে গেল।
আভির্ভাব আবার সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে বললো, ‘‘একটা কথা জানেন তো—সব জায়গায় চুপ থাকলেও,
ডাক্তার আর উকিলের কাছে চুপ থাকতে হয় না।
সমস্যার সমাধান পেতে গেলে তাদের সব বলতে হয়।
You take a breath or take a time — আমি এখানেই আছি, সব শুনবো, যদি আপনি বলতে চান।’’
প্রহেলিকার আরো অস্থির লাগছে।
মন বলছে, হয়তো এত দিনে মনের ভার একটু হালকা হবে…
আবার ভয়ও হচ্ছে — যদি এই ডাক্তার তাকে কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দেয়!
আভির্ভাব প্রহেলিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘‘একদম ওরকম চিন্তা-ভাবনা মনে আনবেন না।
পেশেন্টদের প্রাইভেসি লিক করা এক ধরনের ক্রাইম,
আর পেশেন্টদের প্রাইভেসি প্রাইভেট রাখা আমাদের পেশায় শর্তসাপেক্ষ।
এই মুহূর্তে আপনি আমার পেশেন্ট, আর আমি আপনার ডাক্তার।
ডাক্তারের কাজ তার পেশেন্টের ভালো-মন্দ দেখা, তাকে সস্তি দেওয়া।
তার কাজ নিয়ে আলোচনা করা নয়।
So relax.
আপনার প্রাইভেট কথা প্রাইভেটই থাকবে।’’
প্রহেলিকা অশান্ত চোখে তাকালো টেবিলের উপরের কলমদানির ওপর।
আভির্ভাব আবার বললো, ‘‘আপনার ল্যাভেন্ডার কালার অনেক পছন্দের।’’
প্রহেলিকা অবাক চোখে তাকালো।
আভির্ভাব বললো, ‘‘আপনি বারবার ওই ল্যাভেন্ডার প্যানটার দিকে তাকাচ্ছেন, আর মানুষের চিন্তিত অবস্থায় তার মস্তিষ্ক প্রিয় কিছুই দেখতে চায়, যা তাকে মানসিক সস্তি দেয়।’’
প্রহেলিকা মনে আশার আলো দেখলো।
ভেতর থেকে অনুভব করলো, এই ডাক্তারই হয়তো তাকে সকল মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি দিতে পারবে।
তাই সে কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
‘‘আমি বলবো সব।’’
আভির্ভাব এর ঠোঁটের মৃদু হাসি প্রসারিত হলো।
শান্ত কন্ঠে বললো,
‘‘কাম ডাউন, কোনো তাড়া নেই, ধীরে সুস্থে সব শুনবো।’’
প্রহেলিকা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
‘‘আমার মানসিক অবস্থার অবনতির অনেক জটিল কারণ আছে, আমি আসলে—’’
তাকে আর বলতে না দিয়ে থামিয়ে দিল আভির্ভাব।
বসা থেকে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে বললো,
‘‘চলুন।’’
প্রহেলিকা এহেন কাণ্ডে হতবম্ভ হয়ে গেলো,
অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘‘কোথায় যাবো?’’
আভির্ভাব মুচকি হেসে বললো,
‘‘আপনার কথা শুনতে চলুন আমার সাথে।’’
প্রহেলিকা যদিও একটু ইতস্তত করলো,
তবুও সে আভির্ভাব এর পিছু নিলো।
আভির্ভাব তাকে পাশে একটা রুমে নিয়ে গেলো।
রুমটা পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার।
শুধু মাঝখানের কাঠের টেবিলের উপর টিমটিমে আলো জ্বলছে।
দূর থেকে দেখতে জায়গাটাকে ভুতুড়ে লাগছে,
কেমন তামিল মুভির হরর ভাইব দিচ্ছে।
আভির্ভাব তাকে সামনের চেয়ারে বসতে বললো,
নিজেও বসলো।
কাঠের টেবিলের মাঝখানে একটা সাদা গোলাকৃতির বল,
তবে সেটার দিকে বেশিক্ষণ তাকালে কেমন ঘোর লেগে আসছে।
জায়গাটায় কেমন মস্তিষ্ক ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো,
তবে একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে।
আভির্ভাব এবার শান্ত চোখে তাকালো প্রহেলিকার দিকে,
মসৃণ কণ্ঠে বললো,
‘‘সামনের বলটার দিকে পলক না ফেলে তাকান।’’
প্রহেলিকা ও তাই করলো।
আভির্ভাব আবার বললো,
‘‘ভুলেও এক মিনিট পলক ফেলবেন না।’’
প্রহেলিকা ও তাই শুনলো।
এবার আভির্ভাব ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘‘তো, মিসেস প্রহেলিকা সিকদার, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি পার্সোনাল লাইফে হ্যাপি না। এটা কি ঠিক?’’
প্রহেলিকা ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
‘‘হ্যাঁ।’’
‘‘এই জন্যই কি আপনি এত চিন্তিত? মানে আপনার সব মেন্টাল প্রেসারের কারণ কি পার্সোনাল প্রবলেম?’’
প্রহেলিকা আবারও শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
‘‘হ্যাঁ।’’
‘‘তাহলে আপনার সমস্যাটা কী নিয়ে? আপনার হ্যাপি না হওয়ার আসল কারণটা কী?’’
প্রহেলিকার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো।
সে ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করলো,
আচ্ছা ডক্টর ধরেন আপনি পুরো পৃথিবীতে শুধু একটা জিনিসই চান, খুব করে চান, ভীষণভাবে চান, আপনি মনে করেন আপনি ওই জিনিসটা ছাড়া একদমই থাকতে পারবেন না, চলতে পারবেন না, বাঁচতে পারবেন না, ভীষণভাবে আসক্ত।
কিন্তু ওই জিনিসটা আপনার না।
আপনি সেটার সাথেই আছেন, সেটা আপনার কাছেই আছে, অথচ এটার মালিক আপনি না, অন্য কেউ।
এমনকি যেটাকে আঁকড়ে ধরে আপনি বাঁচতে চান, সেটা ও আপনার কাছে থাকতে চায় না, আপনাকে ভালোবাসে না।
তখন আপনি পারবেন ভালো থাকতে? শান্তিতে থাকতে?
আবির্ভাব অবাক না হয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘‘অবশ্যই না।’’
প্রহেলিকা নির্জীব কণ্ঠে আবার বললো,
‘‘আমি ও আমার জীবনে সে ব্যতীত অন্য কিছু চাইনি।
সেই তো ছিলো আমার ভালো থাকার কারণ, আমার সুখ, আমার শান্তি, আমার ভালোবাসা—সে আমার প্রণয়।
আমার শুধু সে হলেই চলতো।’’
প্রহেলিকা আবারো আকুল কণ্ঠে বললো,
‘‘বিশ্বাস করুন ডক্টর, তার ভালোবাসা ছাড়া এই জীবনে আমি আর কিচ্ছু চাইনি।’’
আভির্ভাব বেশ মনোযোগি দৃষ্টিতে তাকালো,
কৌতূহল নিয়ে বললো,
‘‘কে হয় সে আপনার?’’
প্রহেলিকা তাচ্ছিল্য নিয়ে বললো,
‘‘আমার স্বামী।’’
আবির্ভাব একটু অবাকত্ব নিয়ে বললো,
‘‘তাহলে কি সমস্যা?
সে তো আপনার স্বামী, যাকে এত ভালবাসেন, তাকেই স্বামী রূপে পেয়েছেন, এটা তো সুখের।’’
প্রহেলিকা তাচ্ছিল্য হেসে তাকালো।
প্রহেলিকার হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল আবির্ভাব।
কিছুটা কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘‘আপনাদের বিবাহিত জীবন সুখের নয়?
আপনার হাজব্যান্ড কি আপনাকে ভালোবাসে না?’’
ভালোবাসার কথা শুনতেই প্রহেলিকার অধর কোনে তাচ্ছিল্যময় হাসিটা আরো প্রশস্ত হল।
আবির্ভাব শুধু শান্ত চোখে দেখলো।
প্রহেলিকা হাসতে হাসতে বললো,
‘‘প্রণয় ভালোবাসবে… তা ও আমাকে।’’
প্রহেলিকা হঠাৎ করেই পাগলের মতো হেসে উঠলো।
অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেলো।
চোখ দুটো তার ভিজে উঠলো মুহূর্তেই।
সে ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
‘‘সে যদি আমাকে এইটুকু ও ভালোবাসতো না ডক্টর, আমি সারাজীবন দাসীর মতো তার পায়ের কাছে পড়ে থাকতাম, ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কিছু দাবি করতাম না।
সে যদি একটুও ভালোবাসতো, ধন্য হয়ে যেত এ জীবন।
সে যদি একটু আমাকে বুঝতো, তাহলে আজ এত কিছু হতোই না।’’
আবির্ভাব এক দৃষ্টিতে দেখলো, প্রহেলিকার যন্ত্রণার কিছুটা এমন কিছু
সে আগেই আন্দাজ করেছিলো।
‘‘তার মানে আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসে না?’’
প্রহেলিকা আবারও তাচ্ছিল্য কণ্ঠে বললো,
‘‘না, ভালোবাসে না।
আমার প্রতি তার এক আকাশ পরিমাণ ঘৃণা।
ভালোবাসা তো দূরের কথা, সে যদি পারত তো কবেই আমাকে শেষ করে দিত।
নেহাতি নিজের হৃদয়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে—
বড্ড ভালোবাসে যে নিজের প্রাণ ভোমরাকে।
আমাকে মারলে তার প্রাণ ভোমরা ও বাঁচবে না।
আমার জন্য সে তার জীবনের সব থেকে ভালোবাসার জিনিস হারিয়েছে।
হারিয়েছে তার জীবনের লক্ষ্য, বাঁচার উদ্দেশ্য।
আমি যেমন আমার ভালোবাসা পাইনি, সেও তার ভালোবাসা পায়নি।
আমার থেকে তার অবস্থা আরও বেশি করুণ।
আমি তো আমার ভালবাসাকে যেকোন ভাবে আমার করে নিয়েছি, কিন্তু সে তো সেটাও করতে পারবে না।’’
বেচারা বড্ড অসহায়,
যার জন্য সব হারিয়েছে,
তাকে কি আর ভালোবাসা যায়?
প্রহেলিকার কথায় আভির্ভাব বেশ অবাক হলো।
প্রহেলিকার কথায় সে গভীর রহস্যের আভাস পাচ্ছে।
সে ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘‘মানে, সে অন্য কাউকে ভালোবাসে?’’
প্রহেলিকা উপর-নিচ মাথা নাড়ালো।
‘‘তাহলে আপনাকে কেন বিয়ে করলো?
যার জন্য জীবনে এত কিছু হারিয়েছে, তাকে কেন বিয়ে করবে?’’
প্রহেলিকা আভির্ভাব এর কথায় রহস্যময় হাসল।
রহস্যময়ী কণ্ঠে বললো,
‘‘বিয়ে কি আর এমনি এমনি করেছে ডক্টর?
কলে পড়েছিলো, তাই করেছে।
বাধ্য হয়েছে, তাই করেছে।
বাধ্য করেছিলাম তাকে আমার হতে।
কারণ সে শুধুই আমার।
আমি যদি তাকে না পেতাম, তবে অন্য, কাউকে কিভাবে পেতে দিতাম?
সে আমার ভালোবাসা।
আমি তাকে ভালোবাসি।
তার ভালোবাসার ওপর, তার সব কিছুর উপর শুধুই আমার অধিকার।
সে চাইলে ও আমার, না চাইলেও আমার।
তাই তো তাকে সব কিছু উলট-পালট করে হলেও আমার করেছি।’’
আবির্ভাব শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘‘এতো কিছু করে লাভ কি হয়েছে? কিছু কি পেয়েছেন?’’
প্রহেলিকা চুপ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘‘সব কিছু থাকতেও আমার কিছু নেই।
আমি তাকে পেয়ে ও পাইনি।
তার সাথে আমি এক ঘরে, এক বিছানায় থাকি, তবু যেন আমাদের মধ্যে শত আলোকবর্ষের দূরত্ব বিরাজ করে।
সে আমার সাথে থাকে, প্রতিনিয়ত আমাকে মিথ্যে ভালোবাসা দেখায়, মুখে ভালোবাসি বলে।
ভালোবাসার অভিনয় করে, অথচ তার মনের আশেপাশেও আমি নেই।
তার মনের সবটা জুড়ে অন্য কেউ।
আমি যাকে ভালোবাসি, সে অন্য কাউকে নিজের মন, প্রাণ, আত্মা উজার করে দিয়ে ভালবাসে।
আমি তার কেউ না, কিছু না, আমার এক পয়সারও ভ্যালু নেই।
আমি তার বউ মরলাম, কী বাঁচলাম, তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
সে আমাকে পথের কাঁটা মনে করে ডক্টর আর এটাই আমার প্রাপ্তি, হোক আমি এভাবেই থাকতে চাই, তবুও ও শুধু আমার থাকুক।’’
আভির্ভাব শান্ত চোখে চেয়ে আছে।
প্রহেলিকা আবার বললো, ‘‘জানেন ডক্টর, আমার জীবনটা এমন ছিল না।
আমি ও এমন ছিলাম না।
আমার জীবনে এত জটিলতা ও ছিল না।
এক সময় হাসি-খুশিতে ভরে ছিল আমার জীবন।
ভালোবাসা ও ছিল শুধু আমার।
আজ আমার জীবন অন্য রকম হতে পারতো ডক্টর। কিন্তু…’’
আভির্ভাব ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘‘কিন্তু কী?’’
প্রহেলিকা পাগলের মতো হাসতে হাসতে কান্না করে দিয়ে বললো,
‘‘আমার খুশিতে, সুখ-শান্তিতে, ভালোবাসায় সব কিছুতে গ্রহন লেগেছিলো ডক্টর।
“কিভাবে…”
প্রহেলিকা চোখের পানি মুছে বলতে শুরু করলো, ‘‘আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে, খুব ছোট ছিলাম, আমি তখন ১০ কি ১১ বছরের।
হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমার সেজো আম্মু প্রেগন্যান্ট।
তার যমজ বাবু হবে।
সেদিন আমাদের পুরো বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিলো।
জানেন ডক্টর, সব থেকে খুশি কে হয়েছিলো?’’
‘‘কে?’’
‘‘আমি।
আমি সেদিন সবার থেকে বেশি খুশি হয়েছিলাম,
যখন ডাক্তার বলেছিলো আমার সেজো আম্মুর যমজ মেয়ে হবে।
কত খুশির খবর!
আমার দুটো বোন আসবে!
তখন এক সেকেন্ডের জন্যও ভাবিনি,
এই খুশিই আমার চিরদিনের কান্নায় পরিণত হবে,
কেড়ে নেবে আমার হাসি খুশি জীবন,
কেড়ে নেবে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে।
জানেন ডক্টর, তখন ভালোবাসা কী বোঝার বয়স হয়নি, বুঝতাম ও না।
তবুও আমার পছন্দের মানুষ ছিল —
ভালোবাসা কি না বুঝলেও তাকে প্রচন্ড রকম পছন্দ করতাম।
আমার খেলার সাথী সে, আমার কোন আবদার সে অপূর্ণ রাখত না।
সে ছিলো আমার ভালো লাগার কারণ,
আমার ভালো থাকার কারণ — আমার বড়ো আব্বুর বড়ো ছেলে, প্রণয়।
ভালোবাসা কী, সেটা তো বুঝতাম না,
তবে এটুকু বুঝতাম, তাকে আমার খুব ভালো লাগে।
তার সাথে খেলতে ভালো লাগতো,
সময় কাটাতে ভালো লাগতো।
এমনকি সে ও আমাকে অনেক পছন্দ করত, গুরুত্ব দিতো।
আমার সাথে সব কথা শেয়ার করতো,
আমার সাথে থাকতো, খেতো, ঘুমাতো।
আমরা তিনজন ছিলাম — সে, আমি আর আমাদের ফুফাতো ভাই।
আমি তখন সুখের স্বর্গে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম।
কিন্তু একদিন স্কুল থেকে আমি, প্রণয় আর শুদ্ধ বাসায় এসে জানতে পারি —
আমাদের সেজো আম্মু নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
তাকে নাকি এমারজেন্সি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
তার নাকি আজি বাবু হবে।
এই কথা শুনে আমাদের তিনজনের খুশি অন্ত ছিল না।
এমনকি বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ অত্যন্ত খুশি ছিলো।
আমাদের বাসায় ভাই-বোন অনেকগুলো ছিল,
তবে সবাই ছোট ছোট।
আমরা তিন-চারজন ছিলাম সবার বড়।
একসাথে বায়না ধরে ছিলাম —
না না, বায়না নয়, রীতিমতো জেদ ধরে বসে ছিলাম বাবুকে দেখতে যাওয়ার।
বাসায় নিয়ে আসা পর্যন্ত আমাদের তরসই ছিল না।
সেদিন আমাদের জেদের কাছে সবাই পরাজিত হয়েছিল।
সেদিনও আমি এক সেকেন্ডের জন্য বুঝিনি,
ওটাই হয়তো ছিল আমার জীবনের শেষ খুশি।’’
আবির্ভাব ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘‘কেন?’’
কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো প্রহেলিকা।
আবারও বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
‘‘সেদিন হসপিটালে গিয়ে জানতে পারি —
সেজো আম্মুকে ও.টি তে নেওয়া হয়েছে।
সবাই ভীষণ চিন্তিত, তো আমি ছোট মানুষ — চিন্তার থেকে বেশি আনন্দ হচ্ছিলো,
দুটো বোন আসবে আমার।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার একটা সাদা তুয়ালে প্যাঁচানো বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
তার মুখে হাসি ছিল না।
তিনি বাচ্চাটা সেজো আব্বুর কোলে তুলে দেন।
সবাই অস্থির হয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে দেখতে।
ডাক্তার জানান — পেটে চাপ পড়ায় যমজ বাচ্চার মধ্যে একটা গর্ভেই মারা গেছে।
সবার কেমন রিঅ্যাকশন ছিল মনে নেই,
সবাই বাচ্চাটাকে কোলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
তবে সেদিন সবার আগে সেজো আব্বুর কোল থেকে বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নেয় প্রণয়।
বাচ্চাটার মুখ দেখতেই তার কী যেন হয়ে যায় বুঝতে পারিনা,
সে আর এদিক ওইদিক কোন দিকেই তাকায় না।
সকলেই বাচ্চাটাকে কোলে নিতে চায়,
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে প্রণয় সেদিন অদ্ভুত বিহেভিয়ার করতে শুরু করে।
বাচ্চাটার জন্য অনেক প্রটেকটিভ হয়ে ওঠে।
হঠাৎ করেই সে অনেক পজেসিভ হয়ে যায়।
আমি ও কোলে নিতে চাই, কিন্তু সে নিতে দেয় না।
অতি যত্নে বাচ্চাটাকে আগলে নেয় নিজের বুকে।
সেদিন তেমন কিছু মনে হয়নি —
ভেবেছিলাম, হয়তো অনেক বেশি খুশি হয়েছে, তাই এমন করছে।
কিন্তু আমার এই ভুল ধারণা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
হঠাৎ করেই পাল্টে যেতে থাকে প্রণয়ের আচার-আচরণ, ব্যবহার, চলাফেরা, জীবনধারা।
কয়েক মাস পেরোতেই সে একেবারে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে।
ওই বাচ্চাটার ছাড়া তার জন্য নিশ্বাস নেওয়ার উপায় নেই,
কারও সাথে বেশি কথা বলতো না,
শুধু ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে থাকতো।
বাচ্চাটাকে আদর করে খাওয়াতো, ঘুম পাড়াতো, কাঁধে নিয়ে ঘুরতো সারা গ্রাম — কাউকে হাত লাগাতে দিতো না।
একটা বাচ্চার যত কাজ থাকে, তার সব সে একাই করতো।
সে নিজেকে এবং ওই বাচ্চাটাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছিলো।
তার জন্য যেন আমি একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছিলাম।
আমার সাথে আগের মতো আর কথা বলতো না, খেলতো না, ব্যস্ত হয়ে গেছিলো খুব।
তখন তার ভালোলাগা-মন্দ সবকিছু কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই ছোট্ট বাচ্চাটা।
খুব খারাপ লাগতো —
যখন দেখতাম, আমার পছন্দের মানুষটার আমার সাথে একটু কথা বলারও সময় নেই,
আমার দিকে তাকানোর সময় নেই।
সে তার বন্ধুর সাথে দিন রাত মারামারি করতো ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য।
ওরা দুজন রীতিমতো মেরে একে অপরকে রক্তাক্ত করে দিতো।
এই ভাবেই দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়।
আর প্রণয় ধীরে ধীরে পুরোপুরি পাল্টে যায় — যেন এক নতুন মানুষ।
সে তার পড়াশোনা সময়টা ব্যতীত পুরোটা সময় বাচ্চাটার সাথে কাটাতো।
এমনকি — ওই বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে লেখা-পড়া করতো।
দিন দিন আমাদের মধ্যাকর দূরত্ব আকাশ সম বাড়তেই থাকে।
আর ভালোবাসার মানুষটার থেকে এত দূরত্ব আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না।
খুব কষ্ট হতো —
অভিমানে, কষ্টে, যন্ত্রণায় ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম,
তবু ও সে দেখতে আসতো না, আগের মত কথা বলতো না।
বয়সের সাথে সাথে যখন ভালোবাসা কী বুঝলাম,
তখন থেকে তার জন্য আরো বেশি পাগল হয়ে গেলাম,
আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করলাম।
অথচ আমার জন্য তার মনে কোনো অনুভূতি থাকা তো দূরের কথা,
আমাকে নিয়ে ভাবার সময়টা ও তার ছিল না।
সে একটা ছোট্ট বাচ্চার মাঝে তার সমস্ত সুখ খুঁজে পেতো।
ওই বাচ্চাটা ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকম সুন্দর ছিল।
জানেন ডক্টর — একবার দেখলে আপনি ওই চোখ ফেরাতে পারতেন না।
আমার খুব হিংসে হতে শুরু করে ওই বাচ্চাটার ওপর।
সে এতটুকু হয়ে কীভাবে আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিলো!
দিন দিন আমার এই মানসিক অস্থিরতা, অশান্তি, মনের জ্বালা-পোড়া বাড়তে থাকে।
আমি অনেক হতাশ হয়ে পড়ি, ডক্টর —
খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না, নিঃশ্বাস নিতে ও কষ্ট হতো।
আমার ভালোবাসার মানুষের চোখে স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পেতাম —
কিন্তু সেই এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসার এক শতাংশও আমার জন্য ছিল না।
তার সবটাই বরাদ্দ ছিল একটা ছোট্ট বাচ্চার জন্য।
তার আমরণ আসক্তি জন্মে গেছিলো ওই বাচ্চার প্রতি।
আর এটাই আমি মেনে নিতে পারতাম না।
দিন দিন তার প্রতি আমার ভালোবাসা আর আসক্তি দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
কিন্তু তার কাছে আমি যেন একেবারে অদৃশ্য।
সে বুঝতো আমার অনুভূতি,
তবুও অবহেলা করতো, দেখেও দেখত না, বুঝেও বুঝত না।
তার কাছে তার দুনিয়া ছিল ওই বাচ্চা মেয়েটা।
সে অতি ভালোবাসায়, আদরে, যত্নে, কোলেপিঠে মানুষ করতে থাকে ওই বাচ্চাটাকে —
যাকে সে কাউকে দিত না।
সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়েও —
একটা ৮–১০ বছরের বাচ্চার জন্য যে পাগলামি করতো,
আমি একদম সহ্যই করতে পারতাম না।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ করে হিংস্র হয়ে ওঠে প্রহেলিকা,
তার চোখে-মুখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে,
তীব্র ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে বলতে থাকে —
‘‘আমি ওই মেয়েটাকে প্রচুর ঘৃণা করি,
দুই চোখে দেখতে পারি না।
সে আমার কাছ থেকে আমার ভালোবাসার মানুষ কেড়ে নিয়েছে।
তাকে অনেক বার শেষ করে দিতে চেয়েছি,
কিন্তু এখানে ও আমার কপাল মন্দ ছিল।
কিন্তু ও এত সহজে আমার প্রণয়কে নিয়ে যাবে,
আর আমি এটা হতে দেবো —
কখনোই না।
প্রণয় শুধুই আমার।’’
অবির্ভাব এতক্ষণ শান্ত চোখে তাকিয়ে মনোযোগী ভঙ্গিতে সব শুনছিলো।
তার কাছে সত্যিই প্রহেলিকাকে মানসিকভাবে অসুস্থ লাগছে,
আবার প্রহেলিকার এই তীব্র ভালোবাসার প্রখরতা দেখে খারাপ ও লাগছে।
কতটা যন্ত্রণাময় দিন ছিল সেগুলো…
সে এবার শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো —
‘‘তাহলে আপনার বিয়েটা কীভাবে হলো?
আপনি আপনার হাজবেন্ডের যে ভালোবাসার বর্ণনা দিচ্ছেন,
সেটাকে মেডিক্যাল সায়েন্সের ভাষায় Limerence বলে —
যা আসক্তির চরম পর্যায়।
যেখানে সেই ভালোবাসার মানুষ যদি বেঁচেও না থাকে,
তবু সেই ব্যক্তি move on করতে পারে না।
আর আপনার হাজবেন্ড যেহেতু তাকে একদম ছোট থেকে বড় করেছে —
তাই ব্যাপারটা আরও বেশি ডিপ।
সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বিয়ে করা —
It’s next to impossible.’’
প্রহেলিকা অবির্ভাবের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসলো —
যা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো আবির্ভাব।
প্রহেলিকার চোখ মুখ দেখে সে বড় ধরনের crime এর আভাস পাচ্ছে।
প্রহেলিকা কিছুক্ষণ চুপ থাকে,
বলে —
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৮
‘‘প্রহেলিকা সিকদার এর ডিকশনারিতে ‘impossible’ বলে কোনও শব্দ নেই।
আপনি জানতে চান এই ‘impossible’ কীভাবে possible করলাম?’’
অবির্ভাব কৌতূহলী চোখে তাকালো,
তার ভীষণ curiosity কাজ করছে।
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বলতে শুরু করলো —
‘‘আজ থেকে ৫ বছর আগে…’’
অতীত…