ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৬

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৬
মিথুবুড়ি

‘বাস্তব জীবনের এক জ্বলজ্যান্ত আজাব হলো জেল। চৌদ্দ সিকের জেল অন্ধকার ও ক্লান্তিকর। যেখানে সীমানা মেটে দেওয়াল আর সংকীর্ণ কক্ষগুলো মনে হয় যেন জীবনকে আটকে ফেলে। এখানে প্রতিটি দিন একটি নতুন লড়াই, প্রতিটি মুহূর্ত একে অপরের চেয়ে আরও নিঃসঙ্গ। বাইরে যে পৃথিবী ছিল, তা এক স্বপ্ন, আর এখানে সময়ের স্রোত থেমে থাকে।

‘স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে এক কোণে বসে ছিল দূর্বোধ্য এলিজাবেথ। গায়ে চাপানো জামাটিও কুঁচকে গিয়েছে, চেহারায় এক ধরনের হতবুদ্ধি ভঙ্গি।চারপাশে থমথমে পরিবেশ,নিঃশব্দেও শব্দের গুঞ্জন। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেল। তবে এলিজাবেথের মনে এখন সবচেয়ে বেশি এলোমেলো একটি চিন্তায়—তাকবীর। প্রতিদিন থেরাপি শেষে তাকবীর রাতে ফিরলেও, গতরাতে আর ফেরেনি। ফোনটাও বন্ধ। সারা রাত এলিজাবেথের চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসেনি। তাকবীরের অনুপস্থিতি ওকে এক ধরনের অজানা আতঙ্কে ভরিয়ে তোলে। রেয়ানের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে, তবে ব্যর্থ হয়। গভীর রাতের প্রতিটি মুহূর্ত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে, আর এলিজাবেথের ভেতর বেড়ে ওঠে অশান্তি। ভোর হতে না হতেই দরজায় কলিং বেলের শব্দ শোনা যায়। বুকে পানি আসা অনুভব করেছিল এলিজাবেথ। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে । কিন্তু যা দেখল, তা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত সকাল। দরজা খুলতেই পুলিশের হ্যান্ডকাপ আর কঠিন মুখের কয়েকজন রুমান কর্মকর্তার উপস্থিতি। এ-তো তার ভাবনা থেকে অনেক দূরের কোনো ঘটনা, নাকি সত্যিই তার সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্নের শুরু?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হোয়ার ইজ ইয়োর অ্যাটর্নি?” ~রুমান পুলিশের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের ধাক্কায় চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো এলিজাবেথ। সেকেন্ড অফিসার নতুন জয়েন করেছে আজই, তাই কেস সম্পর্কে কিছুই জানে না। তিন ঘণ্টা ধরে কাস্টডিতে বসে থাকা এলিজাবেথের জামিনের জন্য এখনো কেউ আসেনি। চিফ অফ হেড অফিসার চা খাচ্ছিলো। তিনি নিজে গিয়ে এলিজাবেথকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। নতুন অফিসারের কথায় অধর এলিয়ে হাসল। ড্যাস্কের ওপর চায়ের কাপ রেখে ধীর অথচ কঠোর গলায় বলল,

“মার্ডার কেস। এত সহজে কি জামিন হবে ?”
_থেমে বিদ্রুপ মাখা এক হাসি ফুটিয়ে যোগ করল,
“তা কোথায় তোমার ভালো মানুষ? এখনো যে এলো না!”
‘ কথাগুলো যেন তীর হয়ে বিঁধে যায় এলিজাবেথের বুকে। নিজের জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে তাকবীরের জন্য। কাস্টডিতে নেওয়ার পর থেকে এলিজাবেথ বহুবার অনুরোধ করেছে, এক মিনিটের জন্য তার ফোনটা দেওয়ার জন্য। কিন্তু যান্ত্রিক চোখে তাকিয়ে থাকা কেউ-ই সাড়া দেয়নি। অথচ এলিজাবেথের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাকবীর আসবে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলে গেছে, “ওর ভালো মানুষ আসবেই, নিতে আসবে।” কিন্তু সময় যেন পায়ের শেকল পরে থেমে আছে । কয়েক ঘণ্টা পার হলেও তাকবীরের দেখা নেই। এক চাপা বিষণ্নতা গ্রাস করে ফেলে এলিজাবেথকে। তনু-মনে ধাঁধা আর অস্থিরতা চেপে বসে।

‘হঠাৎ করেই থানা প্রাঙ্গণের আবহাওয়া উত্তেজনায় টইটম্বুর হয়ে উঠল। বিদ্যুৎ গতিতে কালো একটি ল্যাম্বরগিনি থানার সামনে এসে থামল, পিছু পিছু থামল কয়েকটি মার্সিডিজ। গাড়ি থেকে নেমে এলো কালো পোশাকধারী কিছু লোক, একেবারে মৌমাছির ঝাঁকের মতো। সকলের চোখে কালো সানগ্লাস, মুখে কঠিন ভাব, দেখে মনে হয় যেন কোনো রোবটিক সেনাদল। গার্ডরা তৎক্ষণাৎ দুই পাশে সারি করে দাঁড়িয়ে মাঝখানে রাস্তা তৈরি করে দিল, যেন এখানে কোনো হলিউড মুভির দৃশ্যের শুটিং চলছে। ল্যাম্বরগিনির ড্রাইভিং সিট থেকে লুকাস তাড়াহুড়ো করে নেমে দরজা খুলে দিল। সাথে সাথে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো রিচার্ড। তার ড্যাসিং উপস্থিতি পুরো জায়গা থমকে দিল মুহুর্তেই ঠান্ডা হাওয়ার মতো। প্রথমেই রোদে ঝলসে উঠল রির্চাডের গালের সেই কাটা দাগ, যা ওর ব্যক্তিত্বকে আরও ভয়ঙ্কর করে তোলে। থানার বাইরের পুলিশরা রিচার্ডকে দেখা মাত্র আঁতকে উঠল। রিচার্ড মানেই আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। রির্চাডের চোখের সানগ্লাসের আড়ালে স্পষ্ট ক্রোধ ঝলকাচ্ছে। নিরুদ্বেগ
ভঙ্গিতে কোটের ভাঁজ ঝাড়তে ঝাড়তে, সিঁড়ি পেরিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পদচারণায় বোঝা যাচ্ছিল—সে দেরি বরদাশত করার লোক নয়।

‘ রিচার্ডের পিছু পিছু যেতে থাকল সকল গার্ডরা। লক্ষ করলে দেখা যায়, রিচার্ডের সঙ্গে আসা কালো পোশাকধারী প্রত্যেকের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কাটা। এটি প্রথমে অদ্ভুত মনে হলেও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় বরং একটি সচেতন প্রক্রিয়া। যেন এটি তাদের বংশপরম্পরায় চলে আসা এক রহস্যময় রীতি, যা তাদের পরিচয়ের চিহ্ন বহন করে। রিচার্ডের সৈন্য সদস্যের চিহ্ন বহন করে। এই চিহ্ন তাদের সম্পর্কে এক নীরব বার্তা দেয়—তারা সাধারণ কেউ নয়, সাধারণ কোনো মানুষের সহকর্মী নয় তারা।
“এই মেয়ে, তুমি কি এতিম? এখনও তো কেউ আসল না। এজন্যই খুন করার আগে ভেবেচিন্তে করতে হয়। এখন জেলে পঁচে মর সারাজীবন।”
‘সবার মনে চাপা অস্বস্তি, এমন সময় বাইরে থেকে বিকট শব্দে দরজা খুলে এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“হিয়ার ইজ হার গার্ডিয়ান।”

‘মুহূর্তেই উপস্থিত সবাই পিছনে ঘুরল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের রিচার্ডকে দেখা মাত্রই হেড অফিসারের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। তার মুখ শুকিয়ে যায়, গলায় শুষ্ক ঢোক গেলার শব্দ শোনা গেল। পাশে দাঁড়ানো নতুন অফিসার যিনি মাত্রই সাহস দেখাচ্ছিলেন, তিনি নিজেও বেশ ঘাবড়ে গেলেন। রিচার্ডের ক্ষমতা সম্পর্কে সবাই জানে—একবার রেগে গেলে তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস কারোর নেই। বিধ্বস্ত, ধ্বংসযজ্ঞ।
‘ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে রিচার্ড এগিয়ে এল। থানায় এসেছে তাও লেশাবেশ দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিজনেস কনফারেন্সে এটেন্ড করতে এসেছে। রিচার্ড বন্দরে ছিল। আজকে এক শিপ মেয়ে ডুবাই পাচার করা হচ্ছে। তখনই এই খবর রিচার্ডের কানে গেলে সেখান থেকে ছুটে আসে। পুরো ঘর জুড়ে এক চাপা আতঙ্ক। হেড অফিসার তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালেন। রিচার্ড তার শক্ত চিবুকে দৃঢ়তা রেখে, এক ঝলক চোখ ফেরাল এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও, ওর দৃষ্টি নিস্তেজ হয়ে রিচার্ডের আগমনের কারণ খুঁজছিল। হঠাৎ রিচার্ডের উপস্থিতি ওর মনে আরও ভয় জাগিয়ে তুলল।

” স-সা- স্যার আপনি এখানে? আমাকে বললেই তো হতো, আমি নিজে চলে যেতাম।”
‘হেড অফিসারের গলা কাঁপছিল, শব্দগুলো আটকে আসছিল ভয়ে। রিচার্ড কোনো উত্তর দিল না। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির ছিল এলিজাবেথের ওপর। যেন সেই চাহনিতে লুকিয়ে ছিল অজানা প্রশ্ন আর অব্যক্ত ক্ষোভ । রিচার্ডের চোখজোড়া গভীরভাবে এলিজাবেথকে পরখ করছিল—পা থেকে মাথা পর্যন্ত। আশ্চর্য ভাবে আজ এলিজাবেথও সেই দৃষ্টির সামনে নত হয় না। ওর নিজের চোখেও ছিল এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা, যেন সেই দৃষ্টিতে সগর্বে প্রতিধ্বনি করছে রিচার্ডের চাহনি। মিশে রয়েছে নীল জোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর এক আড়ষ্ট নারীর সুগভীর নিকোষ কালো চোখের কাতর দৃষ্টি। একপাশে শীতল দৃঢ়তা, আরেক পাশে অসহায়তার নীরব আকুতি। এলিজাবেথের চোখ থেকে নিঃশব্দে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। রিচার্ডের মুখে কোনো পরিবর্তন না হলেও তার লম্বা দুটি হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল তাৎক্ষণিক। শিরাগুলো ফুলে ওঠে, গৌড় বর্ণের শক্ত বাহুগুলোর শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে ধকধক করতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে হেড অফিসারের শরীর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়তে লাগল। আতঙ্কে এক পা পেছনে সরিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনোমতে বলল,

” স্যার এই মেয়ে কি আপনার পরিচি,,
” কল হার ম্যাম বাস্টার্ড।
‘রিচার্ডের গর্জনে কেঁপে উঠল উপস্থিত সবাই, সঙ্গে কেঁপে উঠল এলিজাবেথও। হেড অফিসারের চোখে ঝিলমিল করে উঠল কৌতূহল, মিশে ছিল খানিকটা অবিশ্বাস। রিচার্ড কায়নাতের মতো একজন, যে মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না, সেই রির্চাড সামান্য একটা মেয়েকে “ম্যাম” ডাকতে বলছে।
” মা-মানে?”
” শি ইজ দ্য কুইন অফ ড্রাগন গ্রুপ।”
‘ নবীন অফিসার ফাঁকি দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ভেতরে ভেতরে সে ঠিকই বুঝতে পারছে, এখানে কিছু ভয়ংকর ঘটতে চলেছে। কিন্তু তার সেই আশা মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। রিচার্ডের গার্ডরা ইতিমধ্যেই পুরো থানা ঘিরে ফেলেছে। ভেতর থেকে একটা মাছিও বেরোনোর সাধ্য নেই। রিচার্ড এবার তার আগুনের মতো জ্বলন্ত নীল চোখ নিক্ষেপ করল অফিসারের মুখে। সেই এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরো অফিসের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। হঠাৎ করকর শব্দে ভাঙল নীরবতা—রিচার্ড দাঁতে দাঁত চেপে এক অদৃশ্য ক্রোধ দমন করছে। ওর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে।

” লেট হার গো। বাকি কথা পরে বলছি।”
‘অফিসার একধরনের হীনমন্যতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল, তার দু’পা দুই নৌকায়, আর দু’টো নৌকাই তার জন্য গলার কাঁটা। পালানোর কোনো পথ নেই। পানিতে ঝাঁপ দিলে নিশ্চিত মৃত্যু, কিন্তু এই মুহূর্তে মৃত্যু স্বয়ং তার সামনে দাঁড়িয়ে। অসহায়ভাবে এক কনস্টেবলকে ইশারা করল এলিজাবেথকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। লেডি কনস্টেবল তালা খুলতেই রিচার্ড তীব্র আগ্রহে এগিয়ে গেল। দাঁড়াল এলিজাবেথের সামনে। এলিজাবেথ তখনও মাথা নিচু রেখেছে। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

‘হঠাৎ, রিচার্ড ওর শক্তপোক্ত হাত অথচ গভীর অধিকারবোধ নিয়ে আঁকড়ে ধরল এলিজাবেথের হাত। এলিজাবেথ চকিতে মাথা তুলে তাকাল রিচার্ডের দিকে। সেই স্পর্শে ওর সারা শরীর বিদ্যুৎচমকের মতো শিহরিত হলো। প্রথমবারের মতো রিচার্ডের স্পর্শে কোনো কঠোরতা বা আগ্রাসন টের পেল না এলিজাবেথ। রিচার্ডের চিবুক শক্ত। এলিজাবেথের হাত খুবই অধিকারবোধের সাথে ধরে টেনে নিয়ে গেল ডেস্কের সামনে। ওকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও আরাম করে বসল, পায়ের উপর পা তুলে। হেড অফিসার পুরো পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে দেখছে—চোখে ভয় আর হতবাক ভাব। দৃশ্যটা সত্যিই বিদ্রূপাত্মক। আসামি বসে আর নিরাপত্তাকর্মীরা দাঁড়িয়ে। এলিজাবেথ তবু মাথা তুলল না, নিজের অস্তিত্বকেই আড়াল করতে চাইছে।
” অফিসারের নাম কি যেন?”

‘ রিচার্ড খুবই ভদ্র গলায় নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল ললাটে ঘষতে ঘষতে কিছু মনে করার ভঙ্গিতে জানতে চাইলো। জবুথবু করে কাঁপতে থাকে অফিসার রিচার্ডের ঠান্ডার গলার থ্রেডে আতঙ্ক আর চাপ সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ রিচার্ডের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল এলিজাবেথ। তবে রিচার্ডের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। বরং বিরক্তি প্রকাশ করল কপালের গভীর ভাঁজে। একজন লেডি কনস্টেবল কে ডেকে গমগম আওয়াজে বলল,
” গেস্ট রুম থেকে ওকে ফ্রেস করিয়ে নিয়ে আসুন।”
‘ কনস্টেবল তাই করল। এলিজাবেথও আর এসবে থাকতে চাইলো না। জড় বস্তুর মতো চলে গেল। এবার রিচার্ড ফিরে গেল তার নিজের বৈশিষ্ট্য।

” স্যার আমি যদি ডিউটি পালন করতে গিয়ে কোনো ভুল করে থাকি, মাফ করে দিন আমাকে।”
‘ রিচার্ড নিশ্চুপ। অকারণে মাথা উপরে তুলে চোখবুঁজে গ্রীবা ঘোরাতে থাকে। আরো ভয় বাড়তে থাকে অফিসারের। সহসাই কোনোরকমে আওড়াল,
” স্যার ম্যামের কি হোন আপনি?”
‘ রিচার্ডের বিলম্বহীন জবাব,” হার লাইফলং লাভ।”
‘ এবার কেঁদেই দিল অফিসার। সাদা চামড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। ” সরি স্যার সরি!! আমি জানতাম না ম্যাম সম্পর্কে।”

‘ রিচার্ডের কণ্ঠে তেজ নেই, তবে খুবই গম্ভীর, ” স্ট্যান্ড আপ।”
‘ অফিসার কোনোভাবে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। তার শরীর কাঁপছে ভেতরে ভেতরে। রিচার্ডের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর মনের গভীরে ভয়কে আরও গভীর করে তুলছে। প্রতিটি শব্দ পেরেকের মতো বুকে বিঁধছে। রিচার্ড এবার বিরক্তি লুকিয়ে রাখল না। তার কণ্ঠস্বর আরও কঠিন হয়ে উঠল।
“আই সেইড, স্ট্যান্ড আপ, স্টুপিড!”
‘শব্দগুলো বজ্রের মতো আছড়ে পড়ল, এবং অফিসার বুঝল, এবার উঠে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। উঠে দাঁড়ায়। রিচার্ড ওর তীক্ষ্ণ পূর্ণ দৃষ্টি দিল অফিসারের উপর। সর্দপে প্রশ্ন ছুড়ল,
” কিসের উপর ভিত্তি করে ওকে এরেস্ট করা হয়েছে?”
‘ অফিসারের গলায় কথা বেজে বেজে আসে,

” আসলে স্যার, কাল রাতেই হোটেলের পাশে একটি ডেড বডি পাওয়া যায়। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তি শেষবার ম্যামের অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে লুকিয়ে ঢুকেছিল। তার পরদিনই তার লাশ পাওয়া যায়। সেই সন্দেহের ভিত্তিতেই আমরা ম্যামকে গ্রেপ্তার করেছি।”
” লাশ !! কোথায় লাশ, কিসের লাশ?”
‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে পড়ল। চাপা উত্তেজনার মাঝেই বাইরে থেকে একজন কনস্টেবল দৌঁড়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু গার্ডরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে আটঁকে দিল। কনস্টেবলটি ছিল মর্গে পাঠানো লাশের দায়িত্বে। তার চোখ-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট, কপালে গভীর চিন্তার রেখা। অফিসার গার্ডটির দিকে তাকালেন। দু’টো খাদযুক্ত দৃষ্টি মিলে গেল। কনস্টেবলের চোখে ফুটে উঠল এক অসহায় ইঙ্গিত, যেন কোনো ভয়াবহ সত্যি জানাতে চায়। সেই ভাষা বুঝতে দেরি হলো না অফিসারের। মুহূর্তেই তার শরীর থেকে শক্তি হারিয়ে গেল। তার মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠল এক ভয়াবহ সত্য—মর্গে লাশ নেই, সেটি উধাও হয়ে গেছে। অফিসারের চুপসে যাওয়া অবয়ব দেখে এক অদ্ভুত বাঁকা হাসি দিল রিচার্ড। সেই হাসি বলে দিচ্ছিল, সবকিছু তারই পরিকল্পনার অংশ।
‘পকেটে হাত ভরে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রিচার্ড।

ওর চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। নবীন অফিসারের দিকে তাকিয়ে, একেবারে সাবলীল গলায় প্রশ্ন করল,
“আমার ব্যক্তিগত নারীর হাতে কে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিয়েছিল?”
‘ থতমত খেয়ে যায় সদ্য নতুন জয়েন করা অফিসার। আইঁটাই করে তেরছা নজরে তাকাল হেড অফিসারের দিকে। যে আগে থেকেই ভয়ে গুটিয়ে ছিল। সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল রিচার্ডের কাছে। হেড অফিসারের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আর বাকি সকলের উদ্দেশ্য গলা ছেড়ে বলল,
” এভরিওয়ান গেট আউট।”
‘ সকল পুলিশদের চোখে স্পষ্ট ভয়, একইসাথে কৌতুহল। নতুন অফিসারের এই কয়েক মিনিটেই ধারনা হয়ে গিয়েছে রিচার্ড কতটা ভয়ংকর। আমতাআমতা করে বলল,
” কে-কেন স্যার?”

‘ রিচার্ড এবার পা বাড়ালো। কাঁপতে থাকা অফিসারের কলার খোপ করে চেপে ধরে দাপুটে গলায় চেঁচিয়ে বলল,
“কারণ এই শা*লাকে আমি এখন কু*ত্তার মতো পেটাবো। আর এমনভাবে পেটাবো যে ওর আর্তনাদের শব্দে অন্যদের কানের সমস্যা হয়ে যাবে।”
‘ জীবন বাঁচানো ফরজ। সকলে তৎক্ষনাৎ হিরহির করে বেরিয়ে গেল। রিচার্ডের গার্ডরা থানার সকল দরজা জানালা লাগিয়ে দিয়ে দরজার বাইরে গিয়ে পাহারাদারের মতো দাঁড়ায়। ভিতরে শুরু হয়, “ঠাস ঠুস, ঠাসঠাস, ঠাস ঠুস “।
বাইরে ভেসে আসে, ” আহ, উহু, ওহ, স্যার আর পারছিনা, মাফ করে দেন।”

‘ম্যানশনের সামনের সেই সুবিস্তৃত জায়গাটি যেন এক টুকরো কাব্য। সুইমিং পুলের পাশে ছোট ছোট ঘাসের উপর রঙিন সাজানো কোণ, সকালের সোনালি রোদে গা ভিজিয়ে নাস্তা করার আদর্শ স্থান। কিন্তু এখানকার পরিবেশটা একেবারেই অন্য রকম। উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে বাতাসে। সেখানে নাস্তার বদলে টেবিলে রাখা রয়েছে নামি-দামি ওয়াইন, সোডা, আর তীব্র গন্ধের ব্ল্যাক কফি। ফাদার—যার বয়সের ছাপ তার শরীরে স্পষ্ট হলেও, চেহারার তেজ আর ব্যক্তিত্ব এখনো অটুট। সাদা পাকা মৃদু লম্বা দাড়ি আর শক্ত চোয়ালের ছায়ায় লুকিয়ে আছে এক দৃঢ় চরিত্র। হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে তিনি মৃদু ভাঁজপড়া কপাল উঁচু করে তেরছা নজরে তাকাচ্ছে লাড়ার দিকে। লুকাস, ফাদারের পাশে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ রিচার্ডের সাথে যায়নি লুকাস, বরং এখানে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ফাদারের কাছে এখনো বোধগম্য হয়নি লাড়ার হঠাৎ আগমনের কারণ। লাড়া, শত্রুপক্ষের মেয়ে, আজ স্বয়ং এসে হাজির হয়েছে সবথেকে ভয়ংকর শত্রুর সামনে। ওর উপস্থিতি এক ধাঁধা। লাড়ার পোশাকেও আজ এক অদ্ভুত সাধারণত্ব। কালো জিন্স আর ওভারসাইজ সোয়েটার, ঘাড় সমান চুল খোলা—সব মিলিয়ে তার স্বভাবের বিপরীত এক রূপ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,মদে ডুবে থাকা মেয়ে আজ ওয়াইনের সমাহারের মাঝে বসে, সে চুপচাপ কফি চুমুক দিচ্ছে।

‘ফাদার তাকিয়ে আছেন লাড়ার দিকে, এক দৃষ্টিতে লাড়ার প্রতিটি আচরণকে বিশ্লেষণ করছেন। লাড়ার নির্লিপ্ত মুখ আর পরিস্থিতির অস্পষ্টতা মিলিয়ে ঘনীভূত হয়েছে এক অদ্ভুত পরিবেশ। চারপাশে মৃদু রোদ ঝলমল করছে, অথচ বাতাসে টানটান উত্তেজনার আভাস। ফাদার খুসকো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল, পরপর গমগমে গলায় বলল,
” উদ্দেশ্য কি?”
‘ সরাসরি এহেন প্রশ্নে মোটেও অবাক হয়নি লাড়া। সে নিজেও একজন গ্যাংস্টারের মেয়ে। খুব ভালো করেই অবগত গ্যাংস্টারদের আচরণে। কফির মগ ছোট টেবিলে রেখে মিষ্টি হাসি দিল লাড়া। অতি আন্তরিক গলায় অকপটে বলে দিল, ” সম্পর্ক গড়তে চাই।”
‘ লুকাস ক্রমশ নিজের ক্রোধ দমিয়ে রাখতে চাইছে যথাসম্ভব। এই মেয়ের উদ্দেশ্য সে খুব ভালো করেই জানে। ফাদারের কপালের ভাঁজ আরো দৃঢ় হলো। জলদগম্ভীর গলায় বলল, কিসের সম্পর্ক?”
‘ লাড়া সবসময়ের মতো ঠৌঁট কামড়ে লাজুক হাসল। পরপর ফিসফিসিসে হাস্কি স্বরে বলল,” বউমা হতে চাই আপনার।”

‘মুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেল ফাদারের চিবুক। তার চোয়ালের পেশি শক্তি আর ধৈর্যের লড়াই করছে। তবে নিজের সংযমের সীমা এক বিন্দুও অতিক্রম করলেন না ফাদার। চেহারার শান্ত ভাবটা ঠিকই ধরে রাখলেন, যদিও ভেতরে রক্তে স্রোতের মতো টগবগ করছে। রিচার্ডের ব্যাপারে ফাদার বরাবরই অতিরিক্ত সংবেদনশীল। এটা রিচার্ড না জানলেও, ফাদার জানেন রিচার্ড তার কাছে রির্চাড কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই স্পর্শকাতর অনুভূতি বুকে লুকিয়ে রেখে, ফাদার গভীর, নিরেট ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন,
“রিদ চাই তোমাকে?”
‘লাড়া সামান্য থেমে গেল। সে ফাদারের প্রশ্নের ওজন বুঝতে পেরে মাথা উঁচু করে তাকাল। তবে চোখের দৃঢ়তা সরেনি এক বিন্দু, প্রবল আত্মবিশ্বাসের স্বরে বলল,
” এখন চাই না, তবে চাইতে কতক্ষণ?”

‘ লাড়ার জবাব শুনে ফাদার একটু থমকালেন। মনে ধরে ওর জবাব। ফাদারের ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির ছোঁয়া, যা অকপটে প্রকাশ করলেন না। ভেতরে ভেতরে গভীর ভাবে ভাবতে লাগলেন—লাড়ার চরিত্র অনেকটা রিচার্ডের মতো। দু’জনেই প্রবল আত্মবিশ্বাসী এবং নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল। তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য রয়েছে, যা ফাদারের নজর এড়ায়নি। কিছু সময় চুপ করে থাকলেন ফাদার, তার নিজের চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন।
‘লুকাসের জন্য এই নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠল। ফাদারের পাশে দাঁড়িয়ে লুকাসের ধৈর্য ফুরিয়ে আসে । বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। হঠাৎ লুকাসের চোখ পড়ল প্রধান ফটকের দিকে, আর সেকেন্ডের মধ্যেই তার অভিব্যক্তি বদলে যায়। অমাবস্যার মতো কালো মুখ ঝলমল করে উঠল। প্রধান ফটক দিয়ে এগিয়ে আসছে রিচার্ড পাঁজা কোলে এলিজাবেথকে নিয়ে।

ওদের উপস্থিতি ম্যানশনের এই টানটান পরিবেশে নতুন উত্তেজনার ঝড় বইয়ে দিল। লুকাস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ফাদারের সামনে থাকা ভুলে গিয়ে সে দুই হাতের তর্জনী মুখে ঢুকিয়ে জোরে একটি শিস বাজাল। ফাদার দ্রুত বিরক্ত হলেন। চোখে চাপা ক্ষোভ ফুটে উঠে, কিন্তু শিসের উৎস লক্ষ্য না করে তার দৃষ্টি সরাসরি লুকাসের দেখানো দিকে গিয়ে থেমে গেল। রিচার্ডকে দেখে মুহূর্তেই ফাদারের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায় । মুখের অভিব্যক্তি কেবল অভিজ্ঞ কেউই বুঝতে পারবে—সেখানে রাগ, দুশ্চিন্তা আর অন্য এক অদ্ভুত উত্তেজনা মিশে আছে। লাড়াও একই দিকে তাকাল। তার চোখেও স্পষ্ট বিস্ময় এবং ক্ষোভ উভয়। রিচার্ডের উপস্থিতি ওর মনে হাজারো প্রশ্ন আর অনুভূতির ঝড় তুলল।

‘ রিচার্ডের চোয়াল বরাবরের মতো আজও শক্ত, যেন পাথরের খোদাই করা। অভিব্যক্তিতে নেই কোনো ভাঙচুর সবকিছু নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণে। তবে আজ নজর কাড়ছে কোলে থাকা এলিজাবেথ। মেয়েটির স্বভাবসিদ্ধ ছটফটানি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কোনো কিল-ঘুষি নয়, কোনো চেঁচামেচি নয়—চুপচাপ ঘাপটি মেরে রয়েছে রিচার্ডের বুকে। এলিজাবেথের ফোলা ফোলা ঠোঁট আর মুখের অবস্থা দেখে সহজেই ধারনা করা যাচ্ছে, রিচার্ড তার স্বভাবসিদ্ধ বুনো ঝড় সামলানোর জন্য আসার আগেই “ছটফটনা নাশল মলম” যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করেছে। হয়তো সেটা ছিল রিচার্ডের ব্যক্তিগত কৌশল , কিংবা এমন কোনো অভিজ্ঞতা যা এলিজাবেথকে আজ অবশ করে রেখেছে।
” রিদ স্টপ৷”
‘ রিচার্ড পায়ের গতি থামায়। ফিরে তাকায় দূরে শক্ত অভিব্যক্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা ফাদারের দিকে। নিরুদ্বেগহীন সরু গলায় বলল,

” শি ইজ ফিজিক্যালি আনস্টেবল। শি নিডস রেস্ট। যা কথা হবে পরে।”
‘ দাঁতে দাঁত চেপে ধরে ফাদার। লাড়া একপ্রকার ছুটে আসে। রিচার্ডের সামনে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে বলল,” ফিজিক্যালি আনস্টেবল মানে? তুমি এই মেয়েকে কোলে কেন নিয়েছ রিচার্ড?”
” কারণ ও হাঁটছে পারছে না।”
” কেন ! কি হয়েছে ওর?”
” ওটা, যেটা হলে হাঁটা যায় না।~ বাঁকা হেসে বলল রিচার্ড।”
‘ লাড়া কিছু বলতে যাবে, তখনই ওর চোখ আটকে যায় রিচার্ডের কোলে মিইয়ে থাকা এলিজাবেথের ঘাড়ে। কালো ছোপ ছোপ দাগে ভরা সেই ঘাড় আর কুঁচকানো জামা দেখে বুকের ভিতর চাপ দিয়ে ধরে লাড়ার। ভেতরে এক অদ্ভুত ঝড় ওঠে, যা লাড়ার দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়। কিছু বলতে যাবে, কিন্তু রিচার্ড কোনো সুযোগ না দিয়ে গমগমে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। রিচার্ড যত ভেতরের দিকে যাচ্ছে, ততই বিস্মিত হতে থাকে এলিজাবেথ। ওর বড় বড় চোখের গোলক ম্যানশনের সৌন্দর্য আর ভিন্নতাকে গিলে খাচ্ছে। পুরো ম্যানশনে আধুনিকতার নিখুঁত ছোঁয়া—অসাধারণ কারুকাজে সজ্জিত প্রতিটি কোণ। কিন্তু এই আধুনিকতার মাঝেও এক রহস্যময় গাঁ ছমছমে ভাব রয়েছে স্পষ্ট। বাগান বাড়ির মতোই সম্পূর্ণ কালোতে আবৃত,আর অদ্ভুত। চারদিকে অদ্ভুত শোপিস, আর দেয়ালে টাঙানো আজব সব পেইন্টিং। রিচার্ড কোলে মাথা থাকা এলিজাবেথের বিস্মিত গোলগোল চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল, এই বিস্ময় তার কাছে খুবই স্বাভাবিক।

‘লিভিং এরিয়ায় পৌঁছে রিচার্ড সোফায় বসল, এলিজাবেথকে কোলে রেখেই। এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকা এলিজাবেথ একটু ধাতস্থ হলো। সরে যেতে চাইলে, রিচার্ড ওকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে । হঠাৎ করেই ম্যানশনের পরিবেশ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। একটা ঈগল পাখি তীক্ষ্ণ ডাক টেনে উড়ে এসে রিচার্ডের কাঁধে বসল। ঈগলটার চেহারা ভয়াবহতা আর গৌরবের মিশ্রণ। এই দৃশ্য দেখে এলিজাবেথ আরো কুঁকড়ে গেল, ভয় পেয়ে আবার রিচার্ডের বুকের গভীরে মুখ লুকাল। এরইমধ্যে শোনা যায় বিড়ালের মিউ মিউ ডাক। একটা কালো বিড়াল মৃদু পায়ে হেঁটে এসে রিচার্ডের উরুর উপর লাফ দিয়ে বসে পড়ল। এলিজাবেথের এত কাছাকাছি যে এলিজাবেথ চমকে উঠল। তবে বিড়ালটা দেখে ভিতরে বিস্ময় আরও বাড়ল। কালো রংয়ের বিড়ালের চোখের মনি ঠিক রিচার্ডের চোখের মতোই গভীর নীল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এলিজাবেথ রিচার্ডের বুক থেকে মাথা তুলে বিড়ালটার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকল। এই ম্যানশনের প্রতিটি ছোঁয়া রহস্যের এক নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছে এলিজাবেথের সামনে।
‘ বিড়ালটাকে এলিজাবেথের দিকে ঘেঁষতে দেখে রিচার্ড মৃদু হাসল। হাসিটা বরাবরের মতোই দেখা দিল না দন্তপাটে। বিড়ালের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

” টিগার ডু ইউ লাইক হার অ্যাজ দ্য কুইন অফ আওয়ার ম্যানশন?”
‘ কি জানি টিগার কি বুঝল। আরো বেশি করে নিজের শরীর ঘেঁষতে থাকে এলিজাবেথের সাথে। বোঝাচ্ছে সে এলিজাবেথকে তাদের ম্যানশনের কুইন হিসেবে পছন্দ করেছে। রিচার্ড আবারও অদৃশ্য হাসি দিল। অতঃপর কাঁধে থাকা ঈগলের তাকিয়ে চেয়ে আদেশের স্বরে বলল,
” ব্ল্যাকহক টেক হিম অ্যাওয়ে।”
‘ সঙ্গে সঙ্গে ঈগলটি ওর তীক্ষ্ণ আওয়াজে তুলে সুচালো ঠৌঁট ফাঁক করে টিগারের ঘাড়ে চেপে ধরে উড়াল দেয়। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম এলিজাবেথের,
” ওরা আপনার কথা বুঝে?”
‘ রিচার্ডের আত্মবিশ্বাসী স্বর,”পোষ মানাতে পারলে প্রাণীরাও মানুষের চেতনাকে ধারণ করে, অন্তর্নিহিত অনুভূতি বুঝতে শেখে।”

” আপনার মতো হৃদয়হীন একজন পশুপাখি পোষ মানাতে পারে? হাস্যকর।”
‘ এলিজাবেথের বিদ্রুপ মাখা স্বরের তাচ্ছিল্যের হাসি গায়ে মাখল না রিচার্ড, বলল ” সব পশুপাখি না, শুধু ওদের দু’জনকে,তাও বিশেষ গুণের কারণে। আর রিচার্ড কায়নাত যেটায় হাত লাগায় সেটাই পোষ মানতে বাধ্য।”
‘ শেষের কথার সাথে সাথে এলিজাবেথ নিজের কোমরের কোমল অংশে চাপ অনুভূত করল। ওর নরম হাত চেপে ধরল রিচার্ডের শক্ত হাতের উপর। চোখমুখ কুঁচকে রাশভারি আওয়াজে বলল,
” কি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ওদের?”
“ওদের বৈশিষ্ট্য আমার সাথে খুব যায়। যেমন ঈদল নিজের শিকার কখনো ছাড়ে না, শত কোষ ছুটে হলেও ছোবল মেরে ছাড়ে, আর বিড়াল আগাম বিপদের সংকেত বোঝে।”

” তারমানে আপনি জানতেন আমার উপর ঐ রাতে অ্যাটাক হবে, তাই সেদিন আমার কাছে ছুরিটা রেখে এসেছিলে?”
‘রিচার্ড কোনো জবাব দেয় না। এরইমধ্যে একজন মেল স্টাফ এসে নতজানু হয়ে বসে রিচার্ডের সামনে। এলিজাবেথের চোখ কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে। স্টাফটি ধীরে ধীরে রিচার্ডের জুতো খুলতে শুরু করে। এলিজাবেথের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়—একজন মানুষ কতোটা বিলাসী হলে জুতো খুলে দেওয়ার জন্যও লোক লাগে! স্টাফটি রিচার্ডের জুতো খুলে পাশে রাখে। এরপর যখন রিচার্ডের উরুর উপর থেকে শূন্যে ঝুলে থাকা এলিজাবেথের পায়ের জুতো খুলতে উদ্যত হয়, ঠিক তখনই রিচার্ডের চাপা গলার শব্দ শোনা যায়—
“উমহু।”

‘শব্দটি যেন বিদ্যুতিক শর্কের মতো লাগল স্টাফটির। ভুলের কোনো ক্ষমা নেই রিচার্ডের কাছে—এই সত্যটা খুব ভালো করেই জানে সে। স্টাফটি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানায় এবং ধীরে ধীরে চলে যায়। এরপর যা হলো, তা ছিল এলিজাবেথের জন্য অবিশ্বাস্য। রিচার্ড ঝুঁকল, স্বয়ং ওর নিজ হাতে নেমে গেল এলিজাবেথের পায়ের কাছে। একদম আলতোভাবে খুলে দিল এলিজাবেথের জুতো। বিস্ময়ের শেষ সীমানা পেরিয়ে গেল এলিজাবেথ। রিচার্ডের এই আচরণ এক অনাবিষ্কৃত অধ্যায় খুলে দিল তার সামনে।
” আপনার তো মনে হয় অনেকগুলো ফেসওয়াশ লাগে তাই না? এতোগুলা চেহারা।”
‘ সোজা হলো রিচার্ড। এলিজাবেথের খোঁচামূলক কথায় বাঁকা হাসল। হেসে এলিজাবেথকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বলল,

“চেহারা যতই বদলাক, আমার আদরের ছোঁয়া একই থাকে—যা ধীরে ধীরে তোমাকে গড়ে, তারপর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়।”
_থেমে,
” চলো তোমাকে তোমার চিরস্থায়ী স্থান দেখিয়ে আসি।”
‘ রিচার্ড একেবারে গিয়ে থামল ওর মাস্টার বেডরুমে৷ নজর বুলাতেই গাঁ শিউরে ওঠে এলিজাবেথের। রুমটি নীরব হুমকির প্রতীক। এটা যেন এক আধুনিক যোদ্ধার মন্দির। বাগানবাড়ির থেকেও ভয়ংকর এই কক্ষ। ড্রাগনের মাথার মতো বিছানার কেন্দ্র। বেডের ঠিক পেছনের দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে সাজানো বন্দু°ক, স্নাই°পার রাই°ফেল, এবং আধুনিক অ°স্ত্রের সম্ভার। দেয়ালে ঠিক বাগান বাড়ির মতো ড্রাগনের পেইন্টিং এবং এক কোণে হোলস্টারে অসংখ্য পিস্তল শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সাজানো। তাদের পাশে, টেবিলের ওপরে রয়েছে ট্যাক°টিক্যাল গ্যা°জেট এবং কার্তু°জের বাক্স। এ যেন কারোর ব্যক্তিগত রুম নয়, অস্ত্রের জাদুঘর। রুমে কোনো বাহুল্যের স্থান নেই। আলোর ব্যবস্থা মৃদু—ছায়ার সঙ্গে খেলছে যেন। এখানে প্রতিটি বস্তু তার মালিকের ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন—নিয়ন্ত্রিত, হিংস্র, এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ।এমন রুম শুধু অস্ত্রের নয়, এক গ্যাংস্টারের ক্ষমতা আর প্রাধান্যের চিত্র।

‘ এলিজাবেথকে কোল থেকে নামিয়ে দিল রিচার্ড। বিস্মিত চোখে ঘুরে ঘুরে নজর বুলিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে এলিজাবেথ। রিচার্ড নিজের টাই খুলতে খুলতে হাস্কি স্বরে বলল,
” পছন্দ হয়েছে বেডরুম?”
‘ এলিজাবেথ চকিতে রিচার্ডের দিকে ঘুরল। শক্ত গলায় বলল, ” বেডরুম মানে?”
‘ বিরক্ত হলো রিচার্ড। বাহু থেকে কোট খুলে সরু গলায় বলল,” আহ!! এখন কি তোমার বেডরুমের ক্লাসও নিতে হবে?”
” আপনি কথা ঘুরাবেন না। সত্যি করে বলুন, আপনি কি জানতেন আমার উপর আট্যাক হবে? আমাকে খুনি বানানোর জন্য ইচ্ছে করে ছুরি°টা রেখে এসেছিলেন, তাই নাহ?”
‘ রিচার্ড এবার সরাসরি তাকালো এলিজাবেথের দিকে। গম্ভীর হলো ওর কণ্ঠস্বর,
” তুই না চাইতেও এমন এক মরুভূমিতে পা দিয়েছিস, যেখানে প্রতিটি ছায়া ধোঁকা, প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর নিমন্ত্রণ। এখানে বাঁচতে হলে শিকার নয়, শিকারি হতে হবে। মনে রাখ, এখানে কেউ কারো নয়, তোকে বাঁচাতে কেউ আসবে না। নিজের জান বাঁচাতে হলে, তোর হাত রক্তে ভেজাতে হবেই। মারতে না পারলে মরতে হবে—এটাই এখানকার শেষ সত্য।”
” সবকিছুর জন্য দায়ি ; শুধুমাত্র আপনি। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছেন আমার জীবন।”
” থ্যাংকস মি লেটার।”
‘ বাকহারা হয়ে গেল এলিজাবেথ। শুকিয়ে যায় চোখের পানি। কিছু মুহুর্ত স্তব্ধ থেকে হঠাৎই করে বসল এককান্ড। ওর গলায় থাকা ওড়না ছুঁড়ে ফেলে দিল। রিচার্ডের উতপ্ত খরখরে মরুভূমির পানে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” এজন্যই তো সবকিছু? _ সপে দিলাম, নিজের চাহিদা পূরন করে মেরে ফেলুন আমাকে। মুক্তি দিন আমাকে এই রক্তের খেলা থেকে।”

‘ ক্রোধে রিচার্ডের চোয়াল মটমট করে , চোখের শূন্য দৃষ্টিতে জমে আছে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরি। একটাও শব্দ না করে হনহনিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় রিচার্ড । এলিজাবেথ হতবিহ্বল হয়ে দপ করে বিছানায় বসে পড়ে। অসহনীয় যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে কান্নায়। কিন্তু হঠাৎই দরজার শব্দে চমকে উঠে এলিজাবেথ। রিচার্ড যায়নি আবারও ফিরে আসে, যেন দুঃস্বপ্নের অতর্কিত ঝাঁপ। এটা রিচার্ড কায়নাত, নারীর কান্নায় মন গলে না তার, আর এতো সহজেও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় সে। কোনো কথা না বলে সোজা এলিজাবেথের কনুই ধরে একটানে দাঁড় করিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে। এলিজাবেথের শরীর কেঁপে ওঠে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো এক অনুভূতিতে। রিচার্ডের দৃষ্টি অন্যরকম। গভীর, আগ্রাসী, এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরা। হাত এগিয়ে আসে কাপড়ের পরত সরিয়ে। ধীরে ধীরে এলিজাবেথের উদরে আলতো স্পর্শ নিজের উপস্থিতি জানান দিতে থাকে রিচার্ড।
” আমার চোখের দিকে তাকাও। বেড’টা অনেক বড় নাহ ? চলো শেয়ার করি।”
‘ এলিজাবেথ নিজের বাক্য তৈরী করে কিছু শক্ত কথা শোনানোর জন্য। তখনই বাইরে থেকে শোনা যায় কারোর চিৎকার চেঁচামেচি।

‘ তাকবীর হন্তদন্ত হয়ে ম্যানশনের ভেতরে প্রবেশ করে, ওর তপ্ত কণ্ঠস্বর চারপাশে ধ্বনিত হতে থাকে। ফাদার তখন লিভিং রুমেই ছিল। আরামদায়ক সোফায় বসে ধৈর্যশীল ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছিলেন তাকবীরে জন্য। মুহূর্তে দু’জনের চোখাচোখি হলো। তাকবীরের গভীর, নিকষ কালো চোখ অগ্নিশিখা ছড়াচ্ছে। চোয়াল শক্ত, মুঠি বন্ধ, গর্জনের মতো পায়ের আওয়াজে ফাদারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকবীরের কণ্ঠস্বর ভারী, প্রতিটি শব্দ বিষ ছড়ানো তীরের মতো।
“আমার স্ত্রী কোথায়?”
‘ ফাদারের গম্ভীর, নিরেট ঠান্ডা স্বর, “গলার তেজ নামিয়ে। তোমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই জানানো হয়েছে তোমাকে। ”
‘তাকবীরের চোখের গভীরতা আরো বাড়ল । ফাদারের কানের পাশে মুখ নিয়ে , রুষ্ট গলায় বলল, “ইতিহাসের পূর্ণাবৃত্তি ঘটলে কিন্তু ধ্বংস আমার একার না। মরলে সবাইকে নিয়ে মরব আমি। আর আজকের রহস্য তো উন্মোচন হবেই।”

‘ফাদারের কণ্ঠ আরো শক্ত হলো, দ্বিগুণ তেজে বললেন,
“তোর মতো চনুপুটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে সময় লাগবে না আমার। শুধু চাই না রক্তে রক্ত সিক্ত হোক।”
‘তাকবীর, একটুও বিচলিত না হয়ে, আবারো নিজের স্থিরতা বজায় রেখে বলল, “আমাকে এতো সহজভাবে নেওয়া আপনার কতো বড় ভুল, সেটা আপনি নিজেও জানেন। তাই বলছি, আমি শান্ত আছি—আমাকে শান্ত থাকতে দেওয়া হোক।”
‘ফাদারের চোখে কিছুটা ভীতির ছাপ দেখা গেল, তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আমার রিদের কোনো ক্ষতি করলে দুনিয়া থেকে তোর নামই মুছে ফেলব আমি।”
” শা*লা তোর ভাগ্যের মতো তোর টাইম সেন্সও খুবই খারাপ। এমন মুহুর্তে এসে কে ডিস্টার্ব করে রে ?”
‘ রিচার্ড ইচ্ছেকৃত ভাবে খুলে আসা বোতাম, অহেতুক আজাইরা একটা ভাব নিয়ে লাগাতে লাগাতে এদিকেই আসছে। রিচার্ড কে দেখে দূরে সরে আসে ফাদার। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে সাবলীল ভাবে তাকবীরকে বললেন,
” তো আজকে কিন্ত পার্টিতে দেখা হচ্ছে রাতে। তুমিও কিন্তু হাইলি ইনভাইটেড তাকবীর।”

‘ তাকবীর ভিতরে চাপা ক্ষোভ নিয়ে আন্তরিক ভাবে মাথা নাড়ায়। তাকবীর কন্ঠ শোনা মাত্র ভিতর থেকে ছুটে আসে এলিজাবেথ। এলিজাবেথকে দেখতে পেয়ে অন্তরে প্রাণ ফিরে পায় তাকবীর। নিজেও ছুটে গেল। দু’টি শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এলো। রিচার্ড গিয়ে দাঁড়ায় ফাদারের পাশে। তেরছা নরজে দেখতে কিভাবে মুহুর্তেই এলিজাবেথের অবয়বের রঙ পাল্টে গেল তাকবীরের সান্নিধ্যে। তাকবীর যখন এলিজাবেথের হাত ধরল, তৎক্ষনাৎ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায় রিচার্ডের হাত। তাকবীর এলিজাবেথকে নিয়ে এসে ফাদারের সামনে দাঁড়াল। এলিজাবেথ নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে রেখেছে। তাকবীর রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,
” উপকারের জন্য ধন্যবাদ ছোট ভাই। এভাবেই বড় ভাবিদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে হয়। তবে চিন্তা নেই। আর কোনো বিপদই ছুঁতে পারবে না ওকে,আমি এসে গেছি। ”
‘ শোনা যায় রিচার্ডের দাঁতে দাঁত পিষার শব্দ। ফাদার সামনে তাই রিচার্ড নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছে ভিতরে ভিতরে। এটা সত্য, এই পৃথিবীতে ফাদারই একমাত্র একজন যাকে রিচার্ড মানে। তাকবীর ফাদারের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিল।

” আসছি ফাদার। রাতে দেখা হবে।”
‘ ছেড়ে দেওয়া হাত যখন আবারও ধরতে যাবে তখনই শোনা যায় বিকট শব্দ। কেঁপে উঠল এলিজাবেথ। আর সকলেই স্থীর। রিচার্ডের রিভল°ভার নিচের দিকে তাক করা। সরু নলের ভিতর থেকে বেরুচ্ছে গরম ধোঁয়া। ধাতব মেঝেতে ফাটল। ফাদার রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় শুধু বলল,
“রিদ।”
‘ তাকবীর রিচার্ডের চোখে চোখ রেখে এলিজাবেথের হাত আঁকড়ে ধরল। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘনীভূত হতে থাকা নীল চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। ফাদার নিজেও ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে ভিতরে চলে যায়। তাকবীর কয়েক কদম এগোতেই পিছন থেকে বেসে আসে কিছু অবাঞ্চনীয় শব্দ।

” হ্যালো লোকা! ডি.সি রোডের সিসিটিভি ফুটেজে চেক করে দেখবে একটা গাড়ি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছিল। ফুটেজ থেকে সেই কাঁপাকাঁপির সিনটা কেটে দিও।”
‘ ঠিক তখনই একজন গার্ড ভিতরে আসে। রিচার্ডের উদ্দেশ্য বলল, ” বস আপনার গাড়ি ওয়াশ করার সময় ভিতর থেকে এই হ্যান্ডকাফ টা পেলাম।”
‘ রিচার্ড ঠৌঁট কামড়ে হেসে বলল,” গাড়িটা খুবই ভালো করে ওয়াশ কর _যাও। বেচারার উপর আজ খুব ধকল গিয়েছে।
‘গার্ড নতজানু হয়ে বেরিয়ে গেল। লজ্জা আর অপমানের ভারে এলিজাবেথের গাল বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাকবীর ধীর স্থির রইল, কোনো উত্তেজনা ওর আচরণে স্পর্শ করতে পারল না। বরং ঠান্ডা মাথায় এলিজাবেথের দিকে ফিরে তাকাল। পকেট থেকে ফোন আর ব্লুটুথ বের করল। এলিজাবেথের কানে ব্লুটুথটি গুঁজে দিয়ে সোজা রিচার্ডের সামনে এগিয়ে গেল। রিচার্ডের চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা অথচ বিদ্রুপে মাখা স্বরে বলল,
“যৌন ক্ষমতা প্রতিটি পুরুষেরই থাকে। কিন্তু আগলে রাখার ক্ষমতা? সেটা সবার থাকে না। সত্যিকারের সুপুরুষ কখনো জোর করে না। এগুলো তোর মতো কাপুরুষদের চরিত্রেই সোভা পায়।”
‘ তাকবীরের কথার ভারে পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠল, আর রিচার্ডের চোয়াল হলো শক্ত । তবে রিচার্ড কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাকবীর বেরিয়ে গেল ম্যানশন থেকে এলিজাবেথের হাত ধরে।

‘ গাড়ি চলছিল নিজের গতিতে, ঘোর নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছিল ভেতরটা। এলিজাবেথ সেই কখন থেকে কাঁদছে, একটানা। তাকবীর আজ আশ্চর্যজনকভাবে কিছু বলছে না, এলিজাবেথের দিকেও তাকাচ্ছে না। ভেতরে শুধু শোনা যাচ্ছে এলিজাবেথের থেমে থেমে নাক টানার শব্দ। অবশেষে এলিজাবেথ বলল, কণ্ঠটা ক্ষীণ আর কাঁপা,
“বিশ্বাস করুন, আপনি যেমনটা ভাবছেন, তেমন কিছুই হয়নি। উনি শুধুমাত্র আপনাকে রাগানোর জন্য এসব বলেছেন।”
‘তাকবীর হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো। চিৎকার করে উঠল প্রথমবারের মতো। স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ঘুষি মারতে শুরু করল বারবার।
“আমার জন্য কি আর একটু অপেক্ষা করা যেত না? আমি কি আসতাম না? কেন যেতে হলো ওর সঙ্গে? আর উনি কে? এতো দিন তো জানো°য়ার ডাকতে। একদিন বাঁচিয়েই হিরো সেজে গিয়েছে তোমার কাছে হুহ?”

_তাকবীরে গলা ক্রোধে আর যন্ত্রণায় ভরে উঠল। “কুত্তার মতো ছুটে গিয়েছিলাম ম্যানশনে। মনে হচ্ছিল… মনে হচ্ছিল, আবার হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে।”
“মেরে ফেলুন না, আপনারা আমাকে মেরে ফেলুন। এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে আমি আর থাকতে পারছি না। একজন কপালে বন্দুক ঠেকাবে, আপনাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে সাথে নিয়ে যাবে, আরেকজন চিৎকার করে আমাকে দোষারোপ করবে । আমিও তো একটা মানুষ। সবাই আমার সাথেই কেন এমন করে বারবার? কেন নিয়ে এসেছিলেন আমাকে সেই আজাব থেকে? ওখানেই পড়ে থাকতাম, তীলে তীলে মরে যেতাম। অন্তত আপনি শান্তিতে থাকতেন।”

‘ তাকবীর হতবিহবল হয়ে গাড়ি সাইডে থামিয়ে রাখল। হঠাৎই ওর আচরণ অদ্ভুত হয়ে উঠল। চেহারার রঙ নিমিষেই বদলে গেল। পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকল। এলিজাবেথ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে তাকবীরের কার্যকলাপ দেখতে থাকল। হঠাৎ তাকবীর স্টিয়ারিং হুইলে নিজের মাথা আঘাত করতে শুরু করে।
এলিজাবেথ ভীত ও বিস্মিত হয়ে তাকবীরকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তাকবীর থামে না। নিজের মাথায় আঘাত করতে করতে অস্পষ্টভাবে বিরবির করতে থাকে,
“তুই সত্যিই অমানুষ। আঘাত করেছিস তোর এলোকেশীকে। মানুষ না তুই! তুই কখনোই একজন মানুষ হতে পারবি না।”
‘এলিজাবেথ তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইল। তাকবীরের কথা কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছিল না। হঠাৎ তাকবীর এলিজাবেথের হাত আঁকড়ে ধরল। এলিজাবেথ আতঙ্কিত হয়ে উঠল। তাকবীরের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এলো।
“এলোকেশী, বিশ্বাস করো আমাকে! আমি কখনোই তোমাকে কষ্ট পেতে দিতাম না। হসপিটাল থেকে ফেরার পথে কেউ পেছন থেকে আমার আর রেয়ানের মুখে স্প্রে মারে। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি থানায়ও গিয়েছিলাম, বিশ্বাস করো, আমি গিয়েছিলাম! কিন্তু তোমাকে খুঁজে পাইনি।”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৫

‘এলিজাবেথ ধীরস্থির ভাবে তাকবীরের হাতে আলতো করে হাত রাখল। গলায় দৃঢ়তা,
“আপনার প্রতি আমার যে বিশ্বাস, তা আজ পর্যন্ত কেউ অর্জন করতে পারেনি। আপনাকে অবিশ্বাস করার আগে আমার মরণ হোক।”
‘এই কয়েকটি শব্দই যথেষ্ট ছিল তাকবীরকে শান্ত করার জন্য। শান্ত হয়ে গেল তাকবীর।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৬ (২)