ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৩ (২)
মিথুবুড়ি
‘সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে ডক্টর সাবিহা ফাইল হাতে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর চোখে একনিষ্ঠভাবে রিপোর্টের পৃষ্ঠা ওলটাচ্ছে। পাশে উৎকণ্ঠিত তাকবীর কখনো ডক্টরের মুখের ভাব পড়তে চেষ্টা করছে, কখনো দৃষ্টি ফেলছে হাসপাতালের সাদা বিছানায় নিথর শুয়ে থাকা এলিজাবেথের দিকে। একসময়ে ডক্টর সাবিহা ফাইল বন্ধ করে চোখ তুললেন এলিজাবেথের দিকে। পরপরই আবারও তাকালেন রিপোর্টের দিকে। এলিজাবেথের উদ্দেশ্য গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল,
“হ্যাভ ইউ মিসড ইউর পি’রি’য়ড?”
‘চাপা ভয় কামড়ে ধরল হৃদয়কপাটে। এলিজাবেথ নিরবে দু’পাশে মাথা নাড়াল। ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে চোখ থেকে পাওয়া গ্লাস খুলে ফেলল ডক্টর সাবিহা।
“আই সি! ডোয়ান্ট ওয়ারি, অনেক সময় এমন হয়ে থাকে।”
‘পাশ থেকে ছটফটিয়ে উঠল তাকবীর,”কি হয়েছে ডক্টর? ইস দিস সিরিয়াস ম্যাটার? ও হঠাৎ সেন্স হারালো কেন? সবটা খুলে বলুন আমাকে।”
‘হেসে ফেলল ডক্টর সাবিহা। চোখ দু’টো খুব বড় বড় করে অবিস্মরণীয় ভঙ্গিতে বললেন,”হয়েছে তো! অনেক বড় একটা মিরাকল হয়ে গিয়েছে।”
“মানে?”
“শি ইজ থ্রি মান্থস ইনটু হার প্রেগনেন্সি। কংগ্রাচুলেশন মিনিস্টার তাকবীর।”
‘উলটপালট বাতাসে তীব্র ধাক্কায় এক কদম পিছিয়ে গেল তাকবীর। হঠাৎ যেন বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল শূন্যতার গর্জনে। তাকাল এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। অভিব্যক্তি পাথরের ন্যায়, কোনো অনুভূতির ছায়া নেই।
“এটাকে ক্রিপটিক প্রেগনেন্সি। ক্রিপটিক প্রেগনেন্সি মূলত এমন এক ধরনের গর্ভধারণ, যেখানে একজন নারী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বুঝতেই পারে না যে তিনি গর্ভবতী। সাধারণত মা’সিক চলতে থাকা, গর্ভধারণের সাধারণ লক্ষণ না থাকা বা হরমোনজনিত কারণে পরীক্ষায় প্রেগনেন্সি ধরা না পড়ার ফলে এটি ঘটে।”
‘তাকবীর অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল ডক্টর সাবিহার দিকে। ভদ্র মহিলার চোখ জ্বলজ্বল করছে। বলতে থাকলেন,
“সত্যিই এটা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। আমার জীবনে এমন রেয়ার কেস খুব কমই দেখেছি। ওনার শারীরিক অবস্থা এবং যে ভয়াবহ বিপদের মধ্য দিয়ে তিনি গিয়েছেন, তাতে বাচ্চাটার টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ছিলই না। কিন্তু কথায় আছে, ‘রাখে আল্লাহ, মারে কে?’ আজ তা নিজ চোখে দেখলাম। ছোট্ট শিশুটা যেন সব বাধা অতিক্রম করেই পৃথিবীতে আসার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হি অর শি ইজ ডেফিনিটলি সো স্ট্রং।”
“কতদিন চলছে?” বিবর্ণ স্বরে জানতে চাইল তাকবীর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“থ্রি মান্থ। আপনাদের এই স্পেশাল মূহুর্তটা একান্তে ভাগাভাগি করে নিন। আসছি আমি।”
‘আন্তরিক হেসে চলে গেল ডক্টর সাবিহা। ফেলে গেল বেদনাময় নিরবতা আর নিরবধি যন্ত্রণা। চার দেয়ারের ছোট্ট এক কক্ষে যেন বিষন্নতার অন্ধকার নেমে এসেছে। কারোর মাঝে কোনো উৎফুল্লতা নেই, মোহাবিষ্টতা নেই। শুধু অশ্রবিহীন আর্তনাদ আর অশ্রুসিক্ত অপেক্ষা। নিরবতার সুতো ছিঁড়ল তাকবীর নিজেই ভারি শ্বাসের টুকরো, টুকরো কথার সুরে,
“তুমি জানতে তাই না?”
‘নিশ্চুপ এলিজাবেথ। তার সকল ধ্যান-জ্ঞান দেয়ালে নিবিষ্ট।
“স্পিক আপ এলিজাবেথ।”
‘লোকটার কণ্ঠে গাঢ় অভিমান স্পষ্ট। সে তো কখনো নাম ধরে ডাকে না। তবে আজকে কেন? খুব বড় ধাক্কা খেয়েছে বুঝি নাকি রাগ করেছে? এবার গুমরে ওঠা যন্ত্রণার ভার এলিজাবেথের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। আরও ছটফটিয়ে উঠল তাকবীর,
“তুমি শুরু থেকে সবটা জানতে তাই না? তাইতো রাশিয়া চলে যাওয়ার জন্য হঠাৎ এতো ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলে রাইট?”
“সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু তা প্রকাশ করার সুযোগ পরিস্থিতি আমাকে দেয়নি। প্রকৃতি যে আমার প্রতি বরাবরই নির্মম।”
“কেন এতো ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল দূরে যাওয়ার জন্য? বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার চিন্তা করছিলে? প্লিজ ডোন্ট টেল মি দ্যাট ইউ আর হ্যাভিং সেকেন্ড থটস অ্যাবাউট অ্যাবরশন।”
“হুমম!”
“এলিজাবেথ।” আজ প্রথম বারের মতো শক্ত হল তাকবীরের কণ্ঠস্বর। ক্রোধে শরীরের শিরা-উপশিরা কঙ্কালের নৃত্যে মজেছে। হঠাৎই ফিক করে হেসে ফেলল এলিজাবেথ। গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল তাকবীরের জ্বলন্ত লাবায়।
“পাপ তো আমি করেছি, সে তো নিষ্পাপ। তবে সে কেন পাপের শাস্তি পাবে?”
“তাহলে কি চাইছিলে তুমি?”
“ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে। সেখানে কোনো অশুভ ছায়া পড়বে না ওর নিষ্পাপ সত্তার ওপর।”
“পারতে একা একটা সন্তান মানুষ করতে?”
‘মলিন হাসল এলিজাবেথ,”আমার সন্তান আমার শক্তি হয়ে এসেছে। কেন পারব না হুঁ? আর না পেরে যেতামই বা কোথায়? আমার তিন কূলে-ই বা আছে কে? আমি তো এক অন্তহীন মরিচীকা, যেখানে দিনে দিনে শুধু ছলনার জঞ্জাল জমছে আর ঝুরঝুরে হয়ে পড়ছে সবকিছু।”
‘বাক্যে গভীরতা বুকে কাঁটার মতো গিয়ে বিঁধল তাকবীরের। বসল এলিজাবেথের বেডের পাশে। আলগোছে ওর একটা হাত মুঠে নিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমাকে আর একটু আপন ভাবা গেলো না এলোকেশী? আমি শুধু তোমার দায়িত্ব নেয়নি, তোমার সকল কিছুর দায়িত্ব নিয়েছি আমি। তুমি ওখানে আর ফিরে যেতে না চাইলে ওকে ফাইন। তুমি আমার কাছে থাকো। তোমার অস্বস্তি হয় এমন কিছু বলব না আমি, কোনো দিন না।ও আমার না হোক, তবুও আমি ওর দায়িত্ব নিতে চাই। ওকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যেও না এলোকেশী প্লিজ।”
‘হাত সরিয়ে নিল এলিজাবেথ। ধারালো কণ্ঠে বলে,”ওর ওপর আমি আপনার বা ঐ লোক, কারোর ছায়া পড়তে দিব না। আপনারা দুজনেই সমান পাপী।”
“শুদ্ধ হয়ে এলে দিবে? আমার হতে হবে না তোমাদের। তোমাদের ভালো রাখার দায়িত্ব দিবে আমায়?”
‘এলিজাবেথ তাকাল তাকবীরের কৃষ্ণগহ্বরে। চোখেমুখে নেই কোনো জড়তা, দ্বিধা। কতোটা সাবলীল গলায় বলে দিল এতো বড় একটা কথা। কিভাবে পারে একটা মানুষ এতো নিঃস্বার্থ আর ত্যাগী হতে?
“কীভাবে শুদ্ধ হবেন?”
“আত্মা শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে।”
“কীভাবে নির্মল হবেন?”
“আত্মধ্বংসের মাধ্যমে।”
“আত্মহত্যা?”
“হ্যাঁ! তবে আত্মার না পাপের হত্যা।”
“কিভাবে?”
“সেটা নাহয় আমার উপরেই ছেড়ে দাও। ভয় পেও না। সব তোমার মনের মতোই হবে। রেস্ট কর এখন। আমি আসছি।”
‘তাকবীর দু’কদম এগোতেই পিছন থেকে হাত আঁকড়ে ধরল এলিজাবেথ। ঘুরল তাকবীর, কাঁদছে মেয়েটা। এলিজাবেথ ব্যথায় ভেজা নিঃশব্দে বলল,
“আপনার সাথে সাক্ষাৎ রিজিকে ছিল কিন্তু আপনার সাথে সংসার রিজিকে ছিল না। আমাকে অভিশাপ দিবেন না।”
“তোমারে ছাড়া যে আমি সুখের লাগাল টুকুও পায় না। এ কেমন রিজিক! খোদা কেমনে পারল এতো পাষাণ হইতে?”~মনের কথা মনের মধ্যেই পিষে দিল তাকবীর। এক গাল হেসে বসল এলিজাবেথের পাশে। ওর মাথায় আলতো করে হাত রেখে নরম গলায় বলে,
“সবার তো হ্যাপি এন্ডিং ই পছন্দ তাই না? তবে এমনটা তো সবসময় হয় না। এই উপন্যাসে নাহয় আমি অপূর্ণ রয়ে গেলাম। উপসংহারে দাগ কেটে থাকুক আমার অপূর্ণতা সকলের মনে।”
‘এলিজাবেথ এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। খামচে ধরল তাকবীরের হাত,”আদালত তো আপনার ফাঁসির রায় দিবে।”
‘তাকবীরের ঠৌঁটের কোণে প্রশান্তিময় হাসির অস্পষ্ট ঝলকানির। জীবন কতো সুন্দর। এলোকেশী তার মৃত্যু কে ভয় পাচ্ছে। তাকবীরের ঠোঁট গহ্বরের ফাঁক গলে ছুঁটে চলল প্রাপ্তির হাসি। সেই হাসি মিশে গেল আকাশে বাতাসে। তাকবীরের কণ্ঠে জড়িয়ে আসছিল।
“মরণে ও ক্ষতি নাই, ক্ষতি শুধু তোমারে না পাইলে।”
‘বলে তৎক্ষনাৎ পালিয়ে গেল তাকবীর। কার্নিশের বাঁধ যে ভাঙ্গছিল। পিছনে ফেলে গেল দূর্বোধ্য এলিজাবেথকে।
‘গাড়ি চলছে নিদিষ্ট গন্তব্যে। রেয়ান ড্রাইব করছে। পাশেই বসে আছে তাকবীর। পিনপতন নিরবতার সুতো ছিঁড়ল রেয়ান।
“বস আপনি কি সত্যি সত্যি সারেন্ডার করার কথা ভাবছেন?”
“হুম! এছাড়া আর কোনো উপায় নেই রেয়ান।”
“কিন্তু বস এতে তো আপনার মৃত্যু সুনিশ্চিত। এভাবে তো ম্যাম কেও পাবেন না।”
“ওর চোখের ঘৃণা থেকে তো বাঁচতে পারব তাই না?”
“বস আপনি বুঝতে পারছেন না। ম্যামের কাছে যেই প্রমাণ গুলো রয়েছে সেগুলো কোটে পেস করলে ফাঁসির রায় ছাড়া গতি থাকবে না।”
“সেটাই তো বললাম। প্রমাণ পেস করলে ফাঁসির রায় আসবে,তাছাড়া নয়।”
‘থমকাল রেয়ান। তাকবীরের দিকে তাকাতেই তাকবীর গ্রীবা বাঁকিয়ে হাসল। ইঙ্গিত বুঝতে আর বাকি থাকল না রেয়ানের। তাকবীর কাউকে কল করতে করতে রেয়ানে উদ্দেশ্য বলল,”তুমি কি ভেবেছিলে রেয়ান? এতো সহজে ময়দান ছেড়ে পালাবো আমি?”
“না বস! আপনি তো ম্যামের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
‘তাকবীর মাথা নাড়িয়ে বলল,”হ্যাঁ! সিরিয়াস ই তো। সে চাইছে আমি আত্মসমর্পণ করি। অবশ্যই করব। তবে আত্মসমর্পণ করার পরের ব্যাপার তো আর ওর বা আমার কারোর হাতেই নেই।”
“আমাদের হাতে আছে বস! খেলার পাসা উল্টে দেওয়ার।”
‘একসাথে হো হো করে হেসে উঠল দুজনেই। এরিমধ্য কল রিসিভ হলো। তাকবীর ফোন কানে তুলে কাউকে শাসাতে থাকে,”শা’লা কে আস্তানাতেই বেঁধে রাখো, আমি আসছি। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হুহ।”
‘কল কেটে রাগে র র র করতে থাকে তাকবীর। রেয়ানের কণ্ঠটা এবার বেশ চিন্তিত শোনালো।
“কিন্তু বস যত যাই করি এতো কিছুর পর কি আর ম্যাম আপনাকে মেনে নিবে?”
‘লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাকবীর। সিটে গাঁ এলিয়ে দিল। চোখে দাউদাউ করছে প্রতিহিংসার আগুন৷
“এজন্যই এবার অন্য চাল চালতে হবে। ঐ কাতর চোখের ঘৃণায় শেষ হতে চাই না আমি।”
‘হসপিটাল মানেই বিরক্তিকর এক জায়গা। শুয়ে থাকতে থাকতে যে কখন চোখ লেগে গিয়েছিল টেরও পায়নি এলিজাবেথ। হঠাৎ গভীর ঘুমের মধ্যে অনুভব করল পেটের উপর ভারি কোনো বস্তু। চোখের পাতায় এক রাজ্যের ঘুম ভর করেছে আজ। আড়ম্বরপূর্ণ ঘুমের দফারফা করতে হাত ছড়িয়ে শরীর নড়াতে চাইল এলিজাবেথ। তবে পারল না, কি যেন শক্ত করে ধরে রেখেছে হাত দু’টো। পেটের উপরের চাপটাও ক্রমশ বাড়ছে, কমছে। পিটপিট করে চোখ মেলল এলিজাবেথ। তবে যা দেখতে পেল তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না ও। রিচার্ড বেডের পাশে বসে আছে,ভাবভঙ্গি কেমন অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক লাগছে। একটু পরপর ঝুঁকে পেটের উপর মাথা ছোঁয়ায়, আবার সরে আসে। কেমন আইঁটাই করছে। শক্ত হাতগুলোও নিশপিশ করছে।
“আপনি?”
‘চমকে উঠল রিচার্ড, ঠিক যেন চোর হাতেনাতে ধরা পড়েছে। শুষ্ক কণ্ঠে ঢোক গিলল কয়েকবার। হঠাৎই ঝাঁপিয়ে পড়ে এলিজাবেথের মুখে কোসস্টেপ চেপে ধরল। হতভম্ব এলিজাবেথ! আতঙ্কে দৃষ্টি ছুটল হাতের দিকে। ওর যে হাতে স্যালাইনের সুচ,সেই হাতটাই ওড়না দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হাসপাতালের বেডের সঙ্গে। অপর হাত হ্যান্ডকাফে বন্দি। বেরোনোর পথ নেই…
‘রিচার্ড আবারও গিয়ে বসল এলিজাবেথের পেটের কাছে। আশ্চর্যজনক ভাবে হাত কাঁপছে রিচার্ডের। কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখল ওর পেটের উপর। শিউরে উঠে এলিজাবেথের ভেতরটা,শ্বাস আঁটকে এল। ছটফটে অবস্থায় দেখতে থাকল রিচার্ডের অদ্ভুত আচরণ। রিচার্ড কেমন যেন একগুঁয়ে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এলিজাবেথের পেটে ৷ গলা কাঁপছে হৃদয়হীন গ্যাংস্টারের।
“এ এলি জান! এখানে আমি আছি’ বলে দ্রুত দু’পাশে ঘন মাথা ঘুরিয়ে বাক্য সংশোধন করে নেয়,”এখানে আমার অস্তিত্ব আছে তাই না?”
‘রিচার্ডের শরীর কাঁপছে। বুকে ঢেউ উঠছে থেমে থেমে। এলিজাবেথের পেটে বারবার হাত রাখছে, আবার সরিয়ে নিচ্ছে। সাহস করে ছুঁতেও ভয় পাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে একের পর এক। গলা যেন শুকিয়ে কাঠ আজ। এ কেমন অনুভূতি কি? কেন এমন নিঃশক্তি লাগছে? হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে।
“এলি? ও এখানে আছে, না? আমার বাচ্চা… আমার রক্ত… আমার অস্তিত্ব… তোর গর্ভে।”
‘এলিজাবেথ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের দিকে। এ এক অন্য রিচার্ড। অপরিচিত, না দেখা, না বোঝা এক রিচার্ড। যাকে এমন কখনো দেখেনি কেউ। রিচার্ড হাঁটু গেঁড়ে বসলো বেডের পাশে। এলিজাবেথের কাঁপতে থাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পরপর নিঃশব্দে ঝুঁকে ঠোঁট ছোঁয়াল পেটে। স্বর ভেজে ভেজে আসছে,
“এই এলি জান! এই অনুভূতিটা কেমন? আমার তো শক্ত মন, তাই ঠিকভাবে বুঝতে পারছি না। আমার কি খুব খুশি হওয়া উচিত?”
‘এলিজাবেথ মোচড়ামুচড়ি করছে মুক্ত হওয়ার জন্য।
ছটফট করছে, গোঙাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। রিচার্ড বিরক্ত হলো। সে তো এই মুহূর্তটা একান্তে উপভোগ করতে চায়। তাই তো আগেই সাবধানতা নিয়েছে। হাত-পা, মুখ সব বেঁধে রেখেছে। এই মেয়ের কথায় জোর না থাকলেও গলায় জোর প্রচণ্ড। আজ কোনো কিছুই গায়ে মাখল না রিচার্ড। সেই কখন থেকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেখানটাই, যেখানে ওর অস্তিত্ব রয়েছে, ওর রক্ত, ওর সন্তান।
‘রিচার্ড কায়নাত তার জীবনে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল সেদিন, যেদিন জানতে পেরেছিল সে বাবা হতে চলেছে। তার রক্ত, তার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসতে চলেছে। সে তো চেয়েছিল এমটাই হোক, প্রথম থেকেই চেয়েছিল। তবে এত ঝড়-ঝাপটার পরও যে তা সম্ভব হবে তা ভাবতে পারেনি কখনো। সেদিন রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ছিল রিচার্ড। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল কাগজের দিকে, শব্দহীন, নিঃস্তব্ধ। পরপর অজান্তেই হেসে ফেলেছিল। তবে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। কেউ দেখার আগেই আবার মুখোশ পরে নিয়েছিল সে।
‘সিলেটের দুর্ঘটনার পর হাসপাতাল থেকে তাকবীর যখন এলিজাবেথকে নিয়ে গিয়েছিল, তখনও রিচার্ড চুপচাপ ছিল বটে। কিন্তু পরে ঠিকই একে একে এলিজাবেথের সমস্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করেছিল। আর সেদিনই জানতে পারে এই খুশির সংবাদ। তারপরই খুব দ্রুত গুছিয়ে ফেলেছিল স্বপ্নের নকশা। কেমন হবে তার সন্তানের ভবিষ্যৎ? কিভাবে এলিজাবেথকে আর তার সন্তানকে এই অন্ধকার জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? সব পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছিল রিচার্ড। তাই তো সেদিন ফার্মহাউজে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত মার্কোর হাতে ধরা পড়ে গেলেও রিচার্ড নিজের কৌশলে ঠিকই এলিজাবেথকে বাঁচিয়ে গিয়েছিল সবসময়ই। নিজে সমঝোতায় এলিজাবেথকে আঘাত করে এমনভাবে পরিস্থিতি সামলেছিল যাতে মার্কোর আঘাত থেকে ওকে রক্ষা করতে পারে। তবে সেদিন নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও আজ পারছে না রিচার্ড কায়নাত।
‘রিচার্ড উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে ঝুঁকে এলিজাবেথের মুখের খুব কাছে এল। ওর উষ্ণ, অস্থির নিঃশ্বাস গুলো এলিজাবেথের ত্বকে আঁচড় কাটছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এলিজাবেথের। অস্বস্তিতে দু’পাশে মাথা নাড়াতে লাগল বারবার। রিচার্ড পকেট থেকে কিছু বের করল,একটা ছোট বাক্স। খুলতেই চকচক করে উঠল একটা ডায়মন্ড রিং। কোনো কিছু না বলেই নিঃশব্দে, আলতোভাবে এলিজাবেথের আঙুলে পরিয়ে দিল সেটি রিচার্ড। অতঃপর? ঠিক যেখানে রিংটা বসেছে সেখানে ঠোঁট ছোঁয়াল। এঁকে দিল গভীর এক ছোঁয়া। আবারও অনড়ভাবে ঝুঁকল এলিজাবেথের ওপর। মনোমুগ্ধকর দৃষ্টি আটকে রইল এলিজাবেথের ভেজা চোখে। রিচার্ড হঠাৎই গভীর এক চুম্বনে আবদ্ধ করল এলিজাবেথের ললাট। শক্ত করে ঠোঁট চেপে ধরে রইল কিছুক্ষণ। এলিজাবেথ নিঃশব্দে চোখ বুজে নিল। চারপাশে নিস্তব্ধতার এক ঝড় নেমেছে। শূন্যতা, অথচ পূর্ণতায় ভরা এক মুহূর্ত। রিচার্ড ধীরে ধীরে মুখ নামাল, এলিজাবেথের কানের লতির ঠিক পাশে ফিসফিস করে বলল,
“আজ আমি খুব খুশি এরিদের মাম্মা।”
‘হৃদয়ের কপাটে শক্ত করে কামড়ে ধরল কী যেন। অজানা এক অনুভূতি ছুঁয়ে গেল অন্দরমহল। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রু। তবে সেটা খুশির, না দুঃখের সে রহস্য একমাত্র এলিজাবেথই জানে। রিচার্ড নড়ল না। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওর মুখের দিকে। জিভ দিয়ে শুষে নিল সমস্ত বেদনার জল। আজ যে খুশির দিন, আজ বেদনার জায়গা নেই। আলিঙ্গনের স্নিন্ধতার সুভাস প্রতিটি কোণে কোণে। রিচার্ডের মাঝে আজ কোনো হিংস্রতা নেই,নেই কোনো তাড়াহুড়ো। দু’হাতের আজলায় চেপে ধরল এলিজাবেথের গাল। নরম-গরম ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দিল ওর গাল, ললাট, চোখ… অতঃপর, ঠোঁটে এক গভীর দীর্ঘস্থায়ী স্পর্শ রেখে দিল। সোজা হয়ে দাঁড়াল রিচার্ড। এক পা, দুই পা… ধীরে ধীরে গেল এলিজাবেথের পায়ের কাছে। পায়ের পাতায় ছুঁয়ে দিল সেই একই নরম-গরম স্পর্শ। তিরতির করে কেঁপে উঠল এলিজাবেথের গড়ন। শরীরের প্রতিটি কোষে জানান দিল গ্যাংস্টার বসের আগমন ঘটেছে।
‘রিচার্ড এবার এক ঝটকায় খুলে দিল এলিজাবেথের মুখ। মুক্ত করল তার হাত, পা। এলিজাবেথ হাপাতে হাপাতে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল রিচার্ডের দিকে তাকাতেই বাঁকা হাসল রিচার্ড। পরনে এখনও সেদিনের কালো টাইট-ফিটিং টি-শার্ট রক্তমাখা,বুকে এঁটে আছে একদম। হাতের মাংসল শরীরে টান টান হয়ে বসে আছে। বাহুর শিরাগুলোও ফুটফুট করছে। গলায় ঝুলে ধাতব ডগ ট্যাগ আর জ্বলজ্বল আলো বের হচ্ছে কোমরের বেল্টে গাঁথা অস্ত্র থেকে। লিফট বন্ধ থাকায় দৌঁড়ে বারো তলা সিঁড়ি বেয়ে উঠার কারণে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ঝুলে পড়ে আছে কিছু অংশ। রিচার্ড কুটিল হেসে দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে তর্জনী তুলে গুনতে শুরু করল,
“ওয়ান…
“টু…
“থ্রী…
_ঠাসসসসসসসসসসসসসস!
‘হঠাৎ ভয়ংকর বিস্ফোরণের মতো শব্দে কেঁপে উঠল পুরো হসপিটাল। এলিজাবেথ কেঁপে উঠে দু’হাতে কান চেপে ধরল। চারপাশ গমগম হয়ে ওঠে ফেলুন ফোঁটার শব্দে। হুট করে তীব্র শব্দে ভেজে উঠল গাটা অনলি সং। এটা কি কোনো হসপিটালের পরিবেশ হতে পারে? চমকিত এলিজাবেথ হুড়মুড়িয়ে ছুটল জানালার দিকে। পর্দা সরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেল৷ যেন স্বয়ং আকাশ থেকে ঝরছে অগণিত নীল কনফেটি, নীল রঙের বেলুন উড়ছে বাতাসে। পার্কিং লটের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল সারি সারি রিচার্ডের গার্ডরা দাঁড়িয়ে হাতে ফুল নিয়ে। চারপাশ সাজানো ফুলে আর বেলুনে, এক অসম্ভব সুন্দর আয়োজনে। আমেরিকান সংস্কৃতির মতো করে করা হয়েছে জেন্ডার রিভিলের আয়োজন! এলিজাবেথ হতবাক হয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো
“এগুলো… এসব কী?”
“রিচার্ড কায়নাত বাবা হতে চলেছে৷ একটু তো সেলিব্রেশন করাই যায়, তাই না?”
‘নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল হৃদস্পন্দন। এত দ্রুত, এত নিখুঁতভাবে সবকিছু সাজানো। কিভাবে সম্ভব?
এবার এলিজাবেথ গম্ভীর দৃষ্টিতে চারপাশের সাজসজ্জা লক্ষ্য করল। চারিদিকে নীলের রাজত্ব। বিস্ময় ঘেরা চোখ তুলে তাকাল রিচার্ডের দিকে।
“ব্লু?”
‘রিচার্ড ঠোঁটের কোণে সেই পরিচিত বিজয়ী হাসি এনে বলল,”ইয়েস, বিকজ ইটস আ বয়।”
‘এলিজাবেথের সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে গেল রিচার্ডের দিকে। খামচে ধরল টি-শার্ট। গর্জনমিশ্রিত কণ্ঠ কাঁপছে থরথর করে,
“কি করেছেন আপনি আমার সাথে? আমার সবকিছু আগে থেকে আপনি কিভাবে জেনে যান? এমন টা কেন হল! এটা তো হবার কথা ছিল না! সমাজ কি বলবে,লোকে কি বলবে? ওর কি পরিচয় দিবো আমি। কেন করলেন এমনটা?
‘এলিজাবেথ হাঁপিয়ে উঠে। রিচার্ড কোনোরূপ প্রত্যুত্তের বিপরীতে ওকে নিয়ে বেডে বসাল। গম্ভীর গলায় বলল,
“লোকে কেন কিছু বলবে?”
“কি বলবে জানেন না আপনি? আমার সাথে সাথে আমার গর্ভকেও কলঙ্কিত করেছেন আপনি। এই বাচ্চার কোনো পরিচয় নেই সমাজে। রাখতে চাই না আমি ওকে।”
‘এলিজাবেথ ছিটকে গিয়ে পড়ল বেডে। রিচার্ড বিদুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে চেপে ধরল কণ্ঠনালি।
“কি বলেছিস তুই আবার বল?”
‘দমে না এলিজাবেথ। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলে,”রাখব না আমি এই বাচ্চা।”
‘ঠাস করে একটা চড় পড়ল গালে। পরপর বৃষ্টির মতো পড়তেই থাকে। চোয়ালে দাগ বসে যায় পাঁচ আঙুলের। তবুও এলিজাবেথ বারবার বলতে থাকে,
“হ্যাঁ! হ্যাঁ! রাখব না আমি এই সন্তান। পিতৃ পরিচয়হীন অবৈধ,,,,
‘রিচার্ড ক্ষুধার্ত হিংস্রের মতো গর্জন দিয়ে উঠল,” ও আমার সন্তান। আমি ওর বাবা। অবৈধ না সে। আমার আর তোর হালাল বন্ধনে ওর আগমন। এই সমাজের কারোর রাইটস নেই ওর পরিচয় নিয়ে কথা বলার।”
“মানে?”
“মানে ও মি.কায়নাত এবং মিসেস.কায়নাতের সন্তান। তুই আমার লিগ্যাল ওয়াইফ। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
“ওয়াইফ?”
‘কক্ষ কাঁপিয়ে চেঁচাল রিচার্ড,”হ্যাঁ, হ্যাঁ! তুই আমার ওয়াইফ! এই রিচার্ড কায়নাতের ওয়াইফ তুই! তোকে কিনে আনিনি আমি। সেই স্বাক্ষর ছিল তোকে হালাল করে আমার করার স্বাক্ষর !”
‘এলিজাবেথ ধাক্কা দিয়ে রিচার্ডকে ওর উপর থেকে ফেলে দিল,”কি যা-তা বলছেন? আমি উনার,,,,
‘আবারও অতর্কিত আক্রমণে কুঁকড়ে গেল এলিজাবেথ। রিচার্ড এসে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল,”তোর জীবনে আমিই একমাত্র পুরুষ ছিলাম, আর আমার জীবনে একমাত্র নারী তুই। কারোর ঠাঁই নেই আমাদের মাঝে। তোর বিয়ে আমার সাথে হয়েছে, শুধুমাত্র আমার সাথে। আমার প্রতিটা ছোঁয়ায় বৈধতা ছিল। তোকে ছোঁয়ার এবং বাচ্চার উপর পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে আমার। তোরা দু’জন শুধু আমার আর কারোর না। ইউ আর মাই পার্টনার, নাউ অ্যান্ড অলওয়েজ,থ্রু এভরি মোমেন্ট, এভরি ব্রেথ,বাউন্ড বিয়ন্ড টাইম, ফরএভার ইউরস।”
‘এলিজাবেথ অবিশ্বাস্য নজরে চেয়ে আছে রিচার্ডের দিকে। নেত্রদ্বয়ে চকচকে কৌতুহল লেপ্টে,”তাহলে সেদিনের বিয়ে?”
‘হাসতে হাসতে দূরে সরে আসল রিচার্ড। এলিজাবেথের পা সযত্নে বেডে তুলে দিয়ে ওর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
“রিচার্ড কায়নাত—এক রহস্যের মরুদ্যান৷ যেখানে কেউ আজও পৌঁছাতে পারেনি। যেখানে আমি মাত্র পঁচিশ মিনিটেই যার প্রতিটা অধ্যায় উল্টে, তাকে নিজের বলে মেনে নিয়েছি! অস্থির এক ঝড়ে পড়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সে অন্য কারোর হবে? অসম্ভব! তুই আমার ছিলি, আমার আছিস, আমারই থাকবি। আর যদি কেউ তোকে ছিনিয়ে নেওয়ার সাহস করে। তবে তাকে মাটির নিচে চাপা দিতে আমি এক মুহূর্তও দেরি করব না!”
‘এলিজাবেথ রিচার্ডের উপর উৎসুক হয়ে ঝুঁকে আছে। চোখগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে রিচার্ডকে। রিচার্ড চোখ উল্টে তাকাল ওর দিকে। গলায় ঝুলে থাকা সেই রিং এর চেইন স্পর্শ করল আলতো করে।
“সেদিন তোকে শুধু এই আংটিটা দিইনি,আমার পুরো অস্তিত্ব অর্পণ তোর মাঝে!”
‘রিচার্ড বলতে শুরু করল সেদিনের কথা। রিচার্ড শুরু থেকেই জানত এলিজাবেথ কোথায় আছে। আংটিতে রিচার্ড এমন কিছু লুকিয়ে রেখেছিল যা দিয়ে সহজেই এলিজাবেথের লোকেশন ও শরীরের তাপমাত্রা অনুভব করা যেত। তবে রিচার্ড কেন এত কিছু জানার পরেও চুপ ছিল, তার কারণ ছিল তাকবীর। তাকবীরের সাথে রিচার্ডের পুরোনো শত্রুতা ছিল। কিন্তু রিচার্ড কেন তাকবীরকে এত ঘৃণা করতো সেটা তাকবীর নিজেও জানত না। রিচার্ড ছিল স্বৈরাচারী। এলিজাবেথ তার গণ্ডি পেরিয়ে চলে গিয়েছে এটা রিচার্ড মেনে নিতে পারেনি। তাই তো সুযোগ পেলে সে এলিজাবেথকে কাছে টানেনি, বরং ইচ্ছাকৃত ভাবে কষ্ট দিয়ে কঠোরভাবে সাহসী বানানোর চেষ্টা করেছে।এলিজাবেথকে দিয়ে সব রহস্য ভেদ করতে চেয়েছিল রিচার্ড। চেয়েছিল ওর জীবনের যোগসূত্র ও নিজেই বের করুক।
‘রেয়ান হিংস্র হলেও বিয়ান ছিল ভীতু। বিয়ান শুধুমাত্র হ্যাকিং করত। তাকবীরের অন্য কোন কাজে সাহায্য করত না। সেদিন রাতে যখন বিয়ান কাজী আনতে বেরিয়েছিল, রাস্তায় তার সাথে রিচার্ডের দেখা হয়। আর সেখান থেকেই খেলার গুটি বদলে যায়। যেই উকিল বিয়ের জন্য এসেছিল সে রিচার্ডের ই পাঠানো লোক ছিল।
“তুমি চাইলে সেদিনের সকল পেপারস আমি দেখাতে পারি। ওখানে ফেইক রেজিষ্ট্রি পেপার ছিল। বিয়ানের কাছে এখনও সবকিছু আছে।”
‘এলিজাবেথের শরীর কেমন জড় বস্তুর মতো লাগছে। সবকিছু যেন অবাস্তব, কাল্পনিক। তবে বিয়ানের কথা শোনা মাত্র মস্তিষ্কে এক ধাক্কা গেল।
“ওয়েট ওয়েট। বিয়ানের কাছে আছে মানে? উনি তো মারা গিয়েছে।”
‘উচ্চশব্দে হেসে ফেলল রিচার্ড। হাসির তালে শরীরের কাঁপনে প্রকম্পিত হচ্ছে বেড। এলিজাবেথ চোখ ছোট ছোট করে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে। রিচার্ড যেন খুব মজার হাস্যরস্য কিছু শুনেছে, এভাবে হাসছে।
“আমার জন্য যে যার জানের এতো বড় রিস্ক নিয়েছে তার জান এতো সহজেই শেষ হয়ে যেতে দিবো আমি? বিয়ান বেঁচে আছে, সেভ আছে।”
‘তাকবীরই যে রেয়ানকে দিয়ে বিয়ানকে মারতে চেয়েছিল, সেটা চেপে গেল রিচার্ড। হঠাৎ করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল এলিজাবেথ। রিচার্ডের চোখ-মুখ কুঁচকে এল। গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। এ হাসি নয়—তাচ্ছিল্য! হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমে উঠল।
“আপনি কি ভেবেছেন চালাক শুধু আপনি একাই? আমি সবটা জানি শুরু থেকে!”
‘রিচার্ড শক্ত গলায় জানতে চাইল, “কি জানো তুমি?”
“আমাদের বিয়ের কথা।” ঠান্ডা বিদ্রুপ ঝরে পড়ল এলিজাবেথের কণ্ঠে। “ভালো মানুষ সে-ই সেদিন সব বলে দিয়েছিল। আপনি দিনের পর দিন আমাকে আঁধারে রেখেছিলেন, কিন্তু তিনি পারেনি।”
‘রিচার্ড অবাক না হয়ে উল্টে বক্র হাসি দিয়ে কাছে গেল এলিজাবেথের। ওর শরীরের হাতের বিচরণ ছেড়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,”সবটা জেনেও এতোদিন নাটক করে গিয়েছ নাহ? এটা কি ঠিক হলো ওয়াইফি?”
‘ছিটকে দূরে সরে গেল এলিজাবেথ। বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
“মানি না আমি এই বিয়ে! আপনি আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন! আপনার সঙ্গে থেকে নিজের জীবন আর কলঙ্কে ডুবাতে চাই না আমি।”
‘রিচার্ডের সংযম তখনো নিয়ন্ত্রণে। কণ্ঠে শুধু শীতল কাঠিন্য ঝরে পড়ল,
“হালাল সঙ্গী আর সঙ্গীর ছোঁয়ায় কলঙ্ক থাকে না রেড। বরং তা সমস্ত কলঙ্ক মুছে দেয়।”
“আপনার মতো একটা অমানুষের জীবনসঙ্গী হয়ে বেঁচে থাকাও যে পাপ!”
‘ঠুকরে উঠল এলিজাবেথ। রিচার্ড আজ যেন ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষায় নেমেছে। এক ঝটকায় এলিজাবেথকে টেনে বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরল। কণ্ঠে গাঢ় দৃঢ়তা,
“আমি কোনো মিথ্যের আশ্রয়ে তোকে নিজের করতে চাই না। আমি যেমন, তেমনভাবেই ভালোবাসবি আমাকে। ভালোবাসায় কোনো শর্ত থাকে না! তুই আমার।”
‘এলিজাবেথ রিচার্ডের বুকের ওপর দুমদাম ঘুষি চালাতে থাকে। কাঁপা কণ্ঠে চিৎকার করে গেল শুধু,
“আমি ভালোবাসি না আপনাকে! ঘৃণা করি! আপনার জন্যই আমার জীবন আজ ধ্বংসের পথে!”
‘রিচার্ড ওর মুখ বুক থেকে টেনে তুলে, চোখে চোখ রাখল। কণ্ঠ অস্থির, ভয়ংকরভাবে নিচু,
“কি! তুই ভালোবাসিস না আমাকে?”
‘এলিজাবেথের চোখে জেদ। ঠোঁট কাঁপলেও কথায় দৃঢ়তা বেশ,”না, বাসি না! ভালোবাসি না! ছেড়ে দিন আমাকে, দয়া করে! আমি অনেক দূরে চলে যেতে চাই!”
‘রিচার্ড আবারও ওর ছটফটে শরীর নিজের সাথে চেপে ধরল। কণ্ঠ গাঢ় ও দাবিদার,
“ওকে ভালোবাসতে হবে না। তবুও আমার হয়ে থাক। আমার ভাগ্য সম্ভবত তোর সাথেই জুড়ে আছে। তাই তো বারবার ছুটে আসি!”
“পরনারী আসক্ত পুরুষ আমার কাছে মৃত! আর মৃত মানুষের ভাগ্য ওপারেই নির্ধারিত হয়!”
‘রিচার্ডের ললাট গম্ভীর ভাঁজে সংকুচিত হলো। কণ্ঠ বিস্ময় আর ক্ষোভে কাঁপল,
“হোয়াট দ্য হ্যাক! পরনারী? এই আল্লাহর বান্দী এই,কি বলছিস তুই? হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর ফা’কিং কমনসেন্স?”
‘তারপর যা হলো তা রিচার্ড একদমই আশা করেনি। এলিজাবেথ হঠাৎ ঝুঁকে রিচার্ডের বুকের মাঝ টা-ই দন্ত বসিয়ে দিল। তীব্র ক্ষোভে জড়জড়িত কণ্ঠ,”আপনি! আপনি ছুঁইয়েছেন লাড়া’কে।”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে হাসে, “জ্বলছে?”
“ছাড়ুন আমাকে!”
‘রিচার্ড ছেড়ে দিল। এলিজাবেথ সোজা হয়ে বসে হাঁপাতে থাকে, বুক উঠানামা করছে দ্রুত।
“আমি তোকে দু’টি বিশুদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ চোখ দিতে পারব এলি জান। যা তুই ছাড়া অন্য বেগানা নারীর দিকে তাকাবে না।”
‘থামল রিচার্ড। নীল দু’টি আঁখিদ্বয় খাদে নামল। আবারও বলল,”প্রকৃত পুরুষ মানুষ হতে ব্যাক্তিত্ব লাগে। টাকাওয়ালা পুরুষ তো বাজারে নাচনেওয়ালির সাথেও নাচে।”
‘এলিজাবেথ তাকাল রিচার্ডের দিকে। বুকের গভীরে কোথাও চিনচিনে এক সুখ অনুভূত হলো, অজানা, অনির্বচনীয়।
“নায়ক সবসময়ই দু’জন নারীর প্রেমে পড়ে। কিন্তু ভিলেন? সে প্রেমে পড়ে শুধু এক নারী।”
‘এলিজাবেথ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “দু’জন?”
‘রিচার্ড মাথা ঝাঁকাল, “হুম। সহধর্মিণী আর জন্মদাত্রী।”
“আপনি ভালোবাসেন না আপনার জন্মদাত্রীকে?”
‘রিচার্ড হুট করেই হেসে উঠল,”জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। সে ছিল মা, তবে মা হতে পারেনি।”
“আমি জানতে চাই আপনার পরিবার সম্পর্কে। কোথায় আপনার মা?”
‘রিচার্ড ঠৌঁট গোল করে ফোঁস নিশ্বাস ছাড়ল,”বাপ কবরে। ঐ মহিলা কবরেও ঠাঁই পায়নি।”
“মানে?”
‘হঠাৎ করে রিচার্ড ছটফটিয়ে উঠল। হুড়মুড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল এলিজাবেথের কোমর।
“আমি দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি, কিন্তু তা নিয়েই মরতে চাই না। আমার জন্ম এমন একজন ঘৃণ্য নারীর গর্ভে, যার নামও উচ্চারণ করতে ঘৃণা হয়। কিন্তু আমি চাই আমার সন্তান যেন এমন ভাগ্য নিয়ে জন্ম না নেয়। তার একটা ভালো মা দরকার একজন মর্যাদাপূর্ণ, যত্নশীল, প্রকৃত মা। তাই তোমাকে আমার হতে হবে।তুমি ছাড়া এই চক্র আমি ভাঙতে পারব না। তুমি ছাড়া এই নরক থেকে আমি আমার রক্তকে মুক্তি দিতে পারব না।”
‘এলিজাবেথের বুকটা ভারি হয়ে উঠল।নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে নাকের পাটাও কাঁপছে তিরতির করে। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল রিচার্ডের চুলে! আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরল গভীর মায়ায়।
“আমি জানতে চাই আপনার অতীত। বলুন না, কী এমন বেদনা লুকিয়ে রেখেছেন সেখানে?”
“আড়ালে থাকা অতীত আড়ালেই থাকুক, রেড। সব অতীত সহনীয় হয় না।”
“তবুও বলুন…”
‘রিচার্ডের ঠোঁট কাঁপল।কিছু বলতে যাবে তখনই দরজা ধাক্কা দিয়ে এক নার্স ঢুকে পড়ল।
“ম্যাম, আপনার—”
‘রিচার্ডকে এলিজাবেথের কোলে দেখে হকচকিয়ে থেমে গেল নার্স। জিভ কামড়ে উল্টে ঘুরে গেল। বিরক্তিতে ঠোঁট চেপে উঠে বসল রিচার্ড। গাল ছেড়ে মুখ ফিরিয়ে ডাকল,
“লোকা! লোকা!”
‘লুকাস আশেপাশেই ছিল, তড়িঘড়ি ছুটে এল। নার্সকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তীব্র স্বরে বলল, “কী হয়েছে?”
‘রিচার্ড এক নিঃশ্বাসে ঝাঁঝিয়ে উঠে, “এই মুহূর্তে কাজি নিয়ে আসো! খুঁজে দেখো, এখানে কে কে এখনো বিয়ে করেনি। সবগুলো রাস্কেলের বিয়ে দিয়ে ছাড়ব আজ! দেনমোহরের সব টাকা আমি দেব! নিজেদের নেই বলে এরা অন্যদের প্রাইভেসি বুঝে না।”
‘নার্স হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছু কিছু অদ্ভুত প্রাণী আছে পৃথিবীতে যাদের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে৷ তেমনি এই আর এক বিরল প্রাণী এই নার্স। ভয় পেয়েও সাহস করে জবাব দিল, “স্যার, এটা তো হাসপাতাল। এখানে প্রাইভেসি…”
‘রিচার্ড তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে, “স্বামী-স্ত্রীর যেখানে দরকার, সেখানেই প্রাইভেসি! তারা কোনো বাঁধা মানে না!”
“কিন্তু এটা তো—”
“লুকাস, একে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও! মেরে ফেলব কিন্তু!”
‘লুকাস ঝটপট নার্সের হাত টেনে বলল, “এই মেয়ে চলো, চলো, বেশি কথা বলো না! বিয়ে করলেই বুঝবে, মুড যখন-তখন, যেখানে-সেখানে চলে আসে!”
‘লুকাস মেয়েটার হাত টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“শুনো মেয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী। আর স্বামী-স্ত্রীর মুডের সঙ্গে হাসপাতাল-টসপিটাল যায় না! শুরু হয়ে যায় যেখানে, সেখানে, যখন, তখন—যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে!”
‘মেয়েটা একগাল বিস্ময়ে বলে, “ওহ, আচ্ছা।”
‘লুকাস মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বলল, “হুম, এসব এখন বুঝবে না। আগে বিয়ে করো, তারপর বুঝবে। সেই স্বাধ।”
“বুঝার জন্য বিয়ে করতে হবে? কী স্বাধ?”
“ওই যে বললাম বিয়ে কর। নাহয় বুঝতে পারবে না।”
‘মেয়েটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে মলিন স্বরে বলে, “কিন্তু মা তো বলে আমাকে নাকি কেউ বিয়ে করবে না। কারণ আমার মাথার একটা তারের সমস্যা আছে। আপনি করবেন আমাকে বিয়ে? তারপর না হয় ধীরে-সুস্থে দেখিয়ে-শুনিয়ে সব বুঝিয়ে দিলেন?”
‘লুকাস থমকে গেল, চোখ কপালে উঠে গেল তার।
“হোপ মেয়ে!
যা বাবা! আমি তোমাকে এডভাইস দিলাম, আর তুমি আমার সর্বনাশ করার চেষ্টা করছ? এজন্যই মানুষের ভালো করতে নেই। খাইতে দিলে শুইতে চায়!”
“ছিঃ! এসব কী বলছেন আপনি? আমি কেন আপনার সর্বনাশ করতে যাব?”
‘লুকাস নাক টানল, “আরে মেয়ে যা করার তা তো করেই ফেলছ! তুমি জানো তোমার একটা কথায় আমার শরীর থেকে কয় ফোঁটা পুষ্টিকর পানি বিসর্জন হলো? কতটুকু শক্তি হারিয়ে ফেললাম?”
‘মেয়েটা অবাক হয়ে তাকাল,”ওমা কোথায় পানি? আশ্চর্য ঘাম ঝড়বে কেন? এখানে তো এসি চলছে!”
‘লুকাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “এটা ঘাম না, সিস্টার! তাই তো বললাম বিয়ে করো। বুঝতে পারবে সবই! গেলাম আমি, এখন আমার সুইটিকে খুব দরকার!”
‘এই বলে লুকাস ছুটতে ছুটতে পকেট থেকে ফোন বের করল, সুইটিকে কল করতে করতে গলা ছেড়ে গান ধরল,
“আইনা করি ফোস্টিনোষ্টি,
দেখতে নোনতা, খেতে মিষ্টি!
ও সুইটি, ও সুইটি,
ও সুইটি, কাছে আসো না…!”
“এলি আমি খুব তৃষার্ত অনুভব করছি। এই মুহূর্তে তোকে আমার খুব দরকার, খুব করে। প্লিজ, কনসিডার মাই বয়। ইউর ড্যাডি ব্যাডলি নিডস ইউর মম।”
‘রিচার্ড দরজা আঁটকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে থাকে। এলিজাবেথ শুকনো ঢোক গিলে, ভয়ে পিছিয়ে যায়। শরীরের প্রতিটি কণা সরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
“Something about you,
Do you feel the way I do?
There is magic in the room
Tell me, do you feel it too?”
‘এলিজাবেথের গলা ভয়ে আটকে যায়, কথা যেন আর বের হয় না,”না না না, আমি ফিল করি না। কিচ্ছু ফিল করি না।”
“ফা’ক! হু কেয়ারস? আমি ফিল করছি। জাস্ট বি আমার লেডি সুইটহার্ট।”
“একদম কাছে আসবেন না!”
“আসব, খুব কাছে আসব। খুব গভীরে মিশে যাবো।”
“আমি ওর্য়ান করছি কাছে আসবেন না। আমি চেঁচাব।”
‘রিচার্ড গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল এলিজাবেথের পাশে। গলায় ছিল পুরুষালি ও হাস্কি,
“চেঁচাও। তোমার চিৎকার, চেঁচামেচি যদি আমাকে আটকাতে পারত তাহলে তোমার পেটে আমার অস্তিত্ব থাকত না। সে কিন্তু এমনি এমনি আসেনি…”
‘এলিজাবেথের দেহ থরথর করে কাঁপছে। অতীতের ঘা যেন নতুন করে ফুটে উঠল তার চামড়ার নিচে৷ সেই তীব্র অপমান, সেই অসহায় আর্তনাদ, সেই রাতগুলোর নিঃসঙ্গতা। রাগে, কষ্টে, হতাশায় হাতের তুলোর বালিশটা ছুঁড়ে মারল রিচার্ডের মুখে।
“আর কতবার ভাঙবেন আমায়? কেন বারবার ফিরে আসেন? আজ বউ বলে দাবি করছেন নাহ? এতদিন কোথায় ছিলেন? আমার সন্তানের ভাগ নিতে এসেছেন এখন তাই না? না! না, ওকে আমি আপনাকে দেব না! ও শুধু আমার! আপনার কালো ছায়া ওর গায়ে পড়তে দেব না আমি!”
‘রিচার্ড কাছে আসতে গেলে এলিজাবেথ পেছিয়ে যায়। ওর চোখে ভয় আর তীব্র ঘৃণা। রিচার্ড শান্ত কণ্ঠে বলল,
“এলি জান লিসেন…”
“কী বলবেন? নিজের পাপ ধুয়ে ফেলতে চান? আপনারা পুরুষরা তো এটাই পারেন! একবার কাছে টেনে নেন, বিশ্বাস গড়ে তোলেন, তারপর বিন্দুমাত্র ভাবনা ছাড়াই ছুঁড়ে ফেলেন! আমায় কি কখনও মানুষ মনে হয়নি? একবারও মনে হয়নি আমিও কষ্ট পাই? কী ভেবেছেন, আমি সব ভুলে গেছি? সেদিন আমি পায়ে পড়েছিলাম আপনার, বলেছিলাম আমার সঙ্গে আসতে… তবু আপনি গেলেন না। কেন? কেন আমায় এতগুলো দিন পরিত্যক্ত করে রাখলেন? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, কিন্তু আমার শরীরের প্রতিটা ক্ষতচিহ্ন বহন করে আপনার হিংস্রতার স্মৃতি! আমি বা আমার সন্তান আমাদের কেউই আপনার কাছে নিরাপদ না!”
‘রিচার্ডের চোখে অনুশোচনার ছায়া। নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“আমরা নতুন করে শুরু করতে পারি রেড। যা করেছি, সব তোমার ভালোর জন্য করেছি। প্লিজ, একবার চান্স দাও…”
‘এলিজাবেথ চোখে পানি সমেত হাসল। চোখের জল মুছে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“নতুন করে? আপনি কোনো দ্বিতীয় সুযোগ ডিজার্ভ করেন না মি.রিচার্ড। কিছু ভাঙলে, তা জোড়া লাগলেও দাগ রয়ে যায়। আর আমার হৃদয়ে যে ফাটল ধরিয়েছেন তা কোনোদিনও সারবে না…”
“রেড প্লিজ আন্ডারস্ট্যান্ড।”
“তালাক চাই আমি।”
“রেড আই’ম লুজিং মাই পেশেন্স।”
“হ্যাঁ! হ্যাঁ আমি তালাক চাই।”
‘রিচার্ডের চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“খুদার কসম আল্লাহর বান্দী আর একবার তালাকের কথা বললে তোর পেটে যে আমার সন্তান আছে সেটা মাথায় রাখবো না। একদম উপরে পাঠিয়ে দিবো।”
‘এলিজাবেথের চোখে আগুন জ্বলছে। ভয় নেই, এক বিন্দু দ্বিধাও নেই। অনবরত বলে যেতে থাকল,
“থাকব না আমি আপনার সাথে! এমন মানুষের সঙ্গে সংসার হয় না! আমি তালাক চাই, আমি মুক্তি চাই!”
‘রিচার্ডের ধৈর্যের শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে গেল। হিংস্র পশুর মতো হাত ছুটে গিয়ে চেপে ধরল এলিজাবেথের গলা।
“যেখানে কোনো মেয়ের আংশিক দৃষ্টিভঙ্গি অব্ধি আমার দৃষ্টি কাড়তে পারেনি, সেখানে এক দেখাতেই তুই আমার হৃদয় দখল করে নিয়েছিলি। আর সেই তুই কিনা আজ তালাক চাইছিস?”
‘এলিজাবেথ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়ও একই তেজ নিয়ে বলল,”কোনো মেয়ের দিকে না তাকালেও তো আমার সতীত্ব ঠিকই আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। নারীর অনুমতি ব্যতিত শরীর স্পর্শ করাকে ধর্ষণ বলে।”
“হ্যাঁ আমি তোর সতীত্ব হরণ করেছি। এটাই আমার স্বভাব, এটাই আমার চরিত্রের সঙ্গে যায়। আমি বদলাতে পারব না নিজেকে। অনুমতি চাওয়া, নরম আদর এগুলো যাই না আমার সাথে। আমি যেমন, তেমনই থাকব। তবে একটা জিনিস আমি পারব সেটা হল তোকে স্বীকৃতি দেওয়া। তুই আমার নাম বহন করবি, আমার পরিচয়ে বাঁচবি।”
“মানে?”
‘রিচার্ড ছেড়ে দিল এলিজাবেথের গলা। কিছুটা দূরে সরে এসে নিরেট ঠান্ডা স্বরে বলল,”তোকে আবার বিয়ে করব। এবার পুরো শহর জানবে।”
‘বিস্ময়ে শব্দ করে উঠল এলিজাবেথ,”কিহ!”
“শরিয়ত মোতাবেক পুরুষের চারটি বিয়ের অনুমতি রয়েছে। আমিও চারটি করব। তবে কনে প্রতিবার একজনই থাকবে। প্রথমবার না জানিয়ে করেছি, দ্বিতীয়বার জোর করব, তৃতীয়বার তোমার ইচ্ছেতে করব।
‘মাঝখান থেকে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করল, “আর চতুর্থবার?”
‘রিচার্ড চোখ সরু করে এলিজাবেথের দিকে চাইল। ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছে। ভ্রু নাচিয়ে ধীরস্বরে বলল,
“চতুর্থবার কোলে চারটে বাচ্চা নিয়ে করব।”
‘তলপেটে কি যেন ছুটে গেল। নড়চড় বসল এলিজাবেথ। তবুও কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে,”এগুলো আপনার স্বপ্ন ই থেকে যাবে সারাজীবন। আমি কখনোই আপনার মতো পাপীকে জেনেশুনে বিয়ে করব না।”
‘রিচার্ড হাসল,”তো কাকে করবে, তোমার সো কল্ড ভালো মানুষকে?”
“হে,,!”
‘এই একটা শব্দই যথেষ্ট ছিল রিচার্ডের থমকে যাওয়া মস্তিষ্ককে ফিরিয়ে নিতে তার পৈশাচিক আত্মায়। এক হিংস্র গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিচার্ড এলিজাবেথের ওপর। বালিশ চেপে ধরল মুখে। হিংস্রতার প্রভাবে ফিসফিস করে উঠল পৈশাচিক, সাইকোপ্যাথ মস্তিষ্ক,
“তুই আমার হবি না তো কারোর হবি না।”
‘হাত-পা ছুঁড়ে ছটফট করতে লাগল এলিজাবেথ অথচ রিচার্ডের মধ্যে তখন ভর করেছে এক অশুভ ছায়া। ওর হাত শক্ত, দৃষ্টি উন্মাদ, শরীরে কাঁপুনি, তবু সে থামছে না যতক্ষণ না এলিজাবেথের হাত-পা শিথিল হয়ে পড়ে। সমুদ্র-নীল চোখে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত জমাট বাঁধছে।এলিজাবেথ যখন নিস্তেজ হয়ে গেলে রিচার্ডের হুঁশ ফিরে। বালিশ সরিয়ে নিতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠল। এলিজাবেথের মুখ নীল হয়ে গেছে। রিচার্ড অস্থির হয়ে পড়ল। বারবার ডাকতে থাকে এলিজাবেথকে, সাড়া দেয় না এলিজাবেথ।
‘রিচার্ড এলিজাবেথকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকল। ট্যাবের নিচে বসিয়ে দিল ওকে, কপালে হাত রেখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিল মুখে। একটা কাশি, অতঃপর ধীরে ধীরে চোখ খুলল এলিজাবেথ।রিচার্ডের শরীরে প্রাণ ফিরে এলো মুহূর্তেই। গভীর শ্বাসে কেঁপে উঠল বুক, দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরল ওকে।
“এলি… এলি জান, আই’ম সরি… জান, তুই ঠিক আছিস তো? আমি সরি, সরি।” শব্দগুলো কাঁপছে। রিচার্ডের নিঃশ্বাসে আতঙ্ক, আঙুলে ব্যাকুলতা। “তুই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বললেই আমার কী যেন হয়ে যায়… আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না… কষ্ট হচ্ছে? আমি ডাক্তারকে ডাকছি।”
‘এলিজাবেথ স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে রিচার্ডের বেসামাল হৃদস্পন্দন। ওর নিজের শরীরে বালির মতো সামান্য শক্তিও অবশিষ্ট নেই। ঠায় রয়ে গেল রিচার্ডের বুকে লেপ্টে। গলার ভেতর থেকে বেরোল কর্কশ এক গোঙানি। দূর্বল কণ্ঠে বলল, “আমি ঠিক আছি।”
‘রিচার্ড যেন পাগল হয়ে গেছে। অঝোরে চুমু খেতে লাগল ওর মাথায়, কপালে, চোখে। এলিজাবেথকে কোলে তুলে নিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। ওর মাথাটা বুকের সাথে এমনভাবে চেপে রাখল যেন ছেড়ে দিলেই কোথায় হারিয়ে যাবে। এভাবে নীরবে একে-অপরের সাথে মিশে কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। এলিজাবেথ তখনও রিচার্ডের বুকের সাথে লেপ্টে, নিস্তেজ গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস এত দ্রুত ছুটছে কেন? ভালোবাসেন আমাকে?”
“নাহ।”
‘এলিজাবেথ হাসল ফিকে, বিষাদমাখা এক হাসি। রিচার্ড শক্ত করে ওর মাথায় ঠোঁট চেপে ধরে। ক্ষণিক বাদেই ওর শুকনো মুখটা তুলে শক্ত স্বরে বলল,
“কাঁদছিস কেন?”
‘কোনো উত্তর এল না। এলিজাবেথের চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। রিচার্ড আটকালো না, ক্ষিপ্ত ও হল না। জলদগম্ভীর কণ্ঠে আওড়াল,
“কাঁদ, চিৎকার কর, ছটফট কর। তাতে কিছুই বদলাবে না। যা চাপিয়েছি, তা বইতে হবে। কাঁদতে কাঁদতে মরলেও, এখানেই মরতে হবে। রিচার্ডের নিয়ম ভাঙার সাধ থাকলে ভুলে যা। কায়নাতের আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেই চূর্ণ হয়ে যাবি। মরতে হলে মর। কিন্তু আমার আয়ত্তে থেকেই।”
‘এলিজাবেথ ক্লান্ত স্বরে বলে “দয়া করে ছেড়ে দিন না আমাকে।”
‘রিচার্ড ওর হাত ধরে এনে রাখল পেটে। চাপ দিয়ে বলল,
“ওখানে কেউ আছে, এলিজাবেথ। সে আমার অংশ। তোমার কোনো অধিকার নেই ওর থেকে ওর বাবাকে আলাদা করার।”
“এই পৃথিবীতে পাপ-পূণ্যের সংসার হয় না। কেন বুঝতে পারছেন না?”
“আমি কিছু বুঝতে চাই না, কিছু শুনতে চাই না। তুই শুধু আমার৷ এটাই হবে শেষ কথা। আমরা কাল আবার বিয়ে করছি।”
“আপনার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে কেন জড়াতে চাইছেন আমাদের?”
“আমার আলোর দুনিয়া হবে তোমরা। সেই দুনিয়ায় আমার অন্ধকার জগতের ছায়া প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
“আপনি সারেন্ডার করুন। ও তো আপনার। বাচ্চাটার কথা ভেবেও কালো জগৎ থেকে বেরিয়ে আসুন।”
“আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলছ?”
“হুম।”
রিচার্ড হাসল,”আমি অন্ধকারের শিকলকে ভয় পাই না, রেড, আর না তো মৃত্যুকে।”
“তবে ধরা দিতে কিসের ভয়?”
“আমি ভয় পাচ্ছি না, রেড। আমি তো প্রকাশ্যেই আছি। আইনের লোক আসুক প্রমাণ নিয়ে, ধরে নিয়ে যাক।”
“আপনাকে ধরা বুঝি এতোই সোজা?”
‘রিচার্ডের মুখে খেলা করল এক গভীর হাসি। কথাটা ওর ভালো লেগেছে। টুপ করে চুমু খেল এলিজাবেথের গালে।
“এতক্ষণে লাইনে এসেছ।”
“যদি কখনো এমন হয়, আপনার সব রাস্তা বন্ধ? আইনের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো উপায় নেই? তখন কী করবেন?”
“শান্ত সমুদ্র থেকে কখনো দক্ষ নাবিক তৈরি হয় না, রেড। বরং অশান্ত সমুদ্রই তৈরি করে তাদের৷ যারা সাঁতার জানে, স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিতে পারে, কিন্তু ডুবাতে পারে না।”
“”আমার যে খুব শখ আপনাকে ডুবানোর।”
“তাই?”
“হুম।”
“আচ্ছা।”
“কি আচ্ছা?”
“আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমাকে সুযোগ দেওয়ার, আমাকে ডুবানোর।”
‘এই বলে রিচার্ড এক ঝটকায় এলিজাবেথকে কোলে তুলে নিল, সোজা গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
“আপনাকে ধ্বংসের অস্ত্র আসছে, মি. কায়নাত।”
‘রিচার্ডের চোখ একবার নামল এলিজাবেথের উদরের দিকে। গভীর দৃষ্টি নিয়ে বলল,
“তোরা মেয়ে জাত এত খারাপ কেন রে? বল তো? নিজেদের স্বার্থের জন্য এই নিষ্পাপ সত্তাগুলোকেও ব্যবহার করতে পিছুপা হস না।”
“ওর বাপের ভালোর জন্য যে ওর মাকে একটু স্বার্থপর হতেই হবে।”
“তাহলে বিয়ের জন্য রাজি হয়েই গেলে?”
“আপনাকে ধ্বংস করার জন্য যে আমাকে আপনার খুব কাছে থাকতে হবে।”
“দিন দিন চালাক হয়ে যাচ্ছ রেড। দিস ইজ নট ফেয়ার।”
“প্রস্তুত হোন তবে।”
“আমি এমনিতেই ধ্বংস। আমাকে ধ্বংস করতে আসলে ধ্বংস করতে পারবে না তুমি। উল্টে জ্বলসে যাবে।”
“চেষ্টা করে তো দেখায় যায়।”
“হেরে যাবে।”
“যেদিন হেরে যাব, সেদিন থেকে আর চেষ্টা করব না। মেরে ফেলব আপনাকে, সাথে নিজেও মরে যাব। মুখের কথা না, আমি করে দেখাব।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথের পাশে এসে বসল,”সাথে মরবে? কেন, একা থাকতে কষ্ট হবে বুঝি?”
“না। স্বচক্ষে দেখতে চাই নরকের কোথায় ঠাঁই হয় আপনার। আপনার মৃত্যু আমার হাতেই হবে, রিচার্ড কায়নাত।”
‘রিচার্ড হাসল গভীর, নিঃশব্দ। অথচ তাতে এক ধরনের শীতল সম্মতি লুকিয়ে ছিল।
“সঙ্গী যদি হও তুমি, তবে মৃত্যু কবুল।”
“ওকে! ডিল?”
“না।”
“কেন?”
“ডিল হোক, তোমার হাতে আমার মৃত্যু তবে উপসংহারে তুমি থাকবে বেঁচে।”
“কেন?”
‘রিচার্ড হাত রাখল এলিজাবেথের গালে। খাদযুক্ত কণ্ঠে বলল,”মাই ওউন ডেথ ডাজন্ট স্কেয়ার মি, ডার্লিং। বাট ইয়োরস? ওহ, আই ক্যান্ট ইভেন ইমাজিন। দ্য থট অফ লুজিং ইউ< আনবেয়ারেবল।”
‘মানুষটা এমন কেন? চোখ ভরা ভালোবাসার আর্তি, কণ্ঠে হারানোর ভয়। তবুও প্রকাশে এত সংকোচ কেন? কিসের ভয়? এলিজাবেথ উঠে আঁচড়ে পড়ল রিচার্ডের বুকে। সেও তো একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিল, স্বপ্ন দেখেছিল ভালোবাসার। ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেললেও তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না, ছিল না তার বিশ্বাসে। তবুও কেন বারবার আঘাত পেতে হয় ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে? কেন এত বড় ধাক্কা খেল সে বিশ্বাসী মানুষটার কাছে?
‘রিচার্ড নিজের সাথে মিশিয়ে নিল দূর্বোধ্য, ভঙ্গুর মেয়েটাকে। সে এত চেষ্টা করেও পারেনি ওকে শক্ত করতে। খুব বেশিই নরম এই মেয়ে। আর এটাই তো তাকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিল।
“এই যে দেখ, এলি। বিশ্বাস কর। কাঁদার জন্য হলেও তোর আমার এই শক্ত বৃক্ষপট দরকার।”
‘এলিজাবেথ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলতে থাকে,”আমি কেন বারবার ঠকে যাই? কেন আমার সাথেই এমন হয়? যাকে আমি আগলে ধরতে চাই, সেই আমাকে ছলনা দিয়ে পিষে দেয়। কেন???
‘রিচার্ড বুঝতে পারল, এলিজাবেথ কী নিয়ে কথা বলছে। গাড়িতে থাকতেই সে সব দেখেছিল।
“আরও যে অনেক কিছুই তোমার অজানা রেড। সেগুলো সামলে আসলে কীভাবে সহ্য করবে তুমি? তোমার জন্য যে আমি প্রতিবার লক্ষ্যে পৌঁছেও পিছিয়ে যাচ্ছি। এর নৃশংস প্রতিশোধের প্রভাব যে তোমার কোমল মনের উপরও পড়বে…” মনে মনে আওড়াল সে।
“আমার যে আর বিশ্বাসের কেউ রইল না। একলা হয়ে গেলাম আমি।”
‘বুকের সাথে আরও শক্ত করে মিশিয়ে নিল রিচার্ড।
“তোর রিচার্ড এখনও বেঁচে আছে এলি জান। তোকে যে কষ্ট দেবে তার কলিজা হাত দিয়ে টেনে বের করে আনব আমি।”
‘এলিজাবেথ বুক থেকে মুখ তুলে রিচার্ডের দিকে চাইল। চোখেমুখে নিঃশব্দ তিরস্কার, চাপা অভিমান৷
“তাই বুঝি? তাহলে ওনাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন? উনিও তো আমার দিকে তাকায়, আমাকে ভালোবাসে, কাছে পাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে। আমাদের মধ্যে কি যোগসূত্র রয়েছে যা আমি জানি না? কেন আপনাদের মধ্যে এই শত্রুতা? আমি জানি এর কারণ শুধু আমি নই।”
‘রিচার্ডের চোখে প্রতিহিংসার আগুন দাউদাউ করে উঠল।
“যাকে মারার কথা বলছিস, তার মৃত্যু অনিবার্য। তবে অস্ত্রের মৃত্যু তার জন্য খুব সহজ হয়ে যায়। তার জন্য ভয়ংকর মৃত্যু অপেক্ষা করছে। তাকে আমি মারব না, সে মরবে৷ মরার আগে তার আত্মা ছুটে পালাতে চাইবে।”
“মানে?”
‘রিচার্ড চোখ নামাল না, বরং আরও তীক্ষ্ণ হলো ওর দৃষ্টি।
“আমি ক্ষমায় বিশ্বাসী নই। আমি গিভ অ্যান্ড টেকে বিশ্বাসী। ধাক্কা দিলে, ধাক্কা খেতেই হবে। রক্ত ঝরালে, রক্তের বন্যা বইয়ে দেব আমি। আমার প্রতিশোধ সবসময়ই একটু এক্সেপশনাল হয়। যেখানে প্রতিটি ক্ষত চিরকাল মনে থাকে, প্রতিটি প্রতিশোধ হয়ে থাকে এক অগ্নিপথ।”
‘সে যেন কেন চাইলেও লোকটার ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারে না, শুধু পাপগুলো দেখেও ভুলতে পারে না তার হৃদয়ের গভীরতা। এই জগতটাই এমন, সারাজীবন ভালো থাকলেও, একটুখানি ভুলের জন্য মানুষ সারা জীবনের গুণ ভুলে যায়, আর বদনাম ছড়িয়ে যায়। কিন্তু এই লোকটা, যিনি মুখে ভালোবাসি বলে না কখনও তবুও যত্নের কোনো শেষ নেই। সাথে না রাখলেও বিপদে পড়লেই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
‘এই যে, যে লোকটা সবসময় কাজে মগ্ন থাকে, যার স্বাচ্ছন্দ্য সবসময় কাজের মধ্যে। যে কখনোই নিজের জন্য এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় করে না সে লোকটায় বসে আছে এক ছোট্ট, চারকোণা দেয়ালে আবদ্ধ কক্ষে৷ শুধু এক অমূল্য মুহূর্তের জন্য। হ্যাঁ, হয়তো হাতে গোনা কয়েকটা কথা ছাড়া কিছু বলেনি, তবে যত্নের এক বিন্দু কমতি নেই। খাইয়ে দিল, মাথায় মৃদু হাতে স্পর্শ করল। কিছু বলছে না, তবে একটু পরপর শুধু হুটহাট পেটে চুমু খাচ্ছে। বাবা হলে কি মানুষ এতটাই ভঙ্গুর হয়ে যায়? এই যে রিচার্ড এলিজবেথকে এখনই কোলে করে ওয়াশরুমে নিয়ে যাচ্ছে, হাঁটতে দেয়নি এক মুহূর্তের জন্যও এখনও পর্যন্ত। এলিজবেথও বাঁধা দেয়নি, বরং সুযোগ দিয়েছে তার বাবার হয়ে ওঠার আনন্দ অনুভব করার। কিন্তু সে লোক তো ভাঙবে না। আচরণে গম্ভীর ভাব রয়ে গেছে, তবুও নজর সব দিকে।
‘দু’পায়ের মাঝে এলিজাবেথকে চেপে বসিয়ে রেখেছে রিচার্ড, যেন নড়তে না পারে। আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছে মেয়েটার চুলগুলো খুব এলোমেলো। এই মেয়ে বড়ই উদাসীন নিজের যত্নে। বাধ্য হয়ে রিচার্ড নিজে বসে পড়ল হাতে চিরুনি নিয়ে। যদিও এলিজাবেথ মহাকাশে পৌঁছে গিয়েছিল বিস্ময়ে। তবে ধীরে ধীরে সয়ে নেয়। চুপ করে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরাচ্ছে এলিজাবেথের।
“এই আপনি যাবেন কখন?”
‘রিচার্ড ভারি গলায় বলল, “কেন?”
“কেন মানে? শুধু বাচ্চার কথা ভেবে বিয়েতে রাজি হয়েছি, আর আপনি হসপিটালে আসন পেতে বসে গেছেন।”
‘রিচার্ড মৃদু হাসল মনে মনে। সে জানে এলিজাবেথ বাচ্চার কথা ভেবে রাজি হয়নি, তার আসল উদ্দেশ্য রিচার্ড’কে ধ্বংস করা। ফোঁস নিশ্বাস ছাড়ল রিচার্ড।
“আমাকে রিজেক্ট করার কোনো এক্সকিউজ ই নেই। সো রাজি হতেই হতো।”
‘এলিজাবেথ একটু বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকাল।
“ইসসস! আপনার মধ্যে কি এমন আছে যে আপনাকে বিয়ে করতেই হবে?”
‘রিচার্ড এলিজাবেথকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল,
“Mature.
Unfriendly.
Loyal.
Gentleman.
Family man.
Rude spoken.
Patient.
Taller than you.
Act of service.
Respectful.
Protective
Man of God.
Pays attention to the little things. আর কি চাও তুমি?”
“Love,, নীল চোখে চোখ রেখে বলল এলিজাবেথ।
‘থমকাল রিচার্ড। কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল হাত। উঠে যেতে নিলে এলিজাবেথ পিছন থেকে বলে উঠল,
“প্রেম সাত ধাপে হয়ে থাকে।”
‘রিচার্ড ঘুরে তাকাল এলিজাবেথের দিকে।
“সাত ধাপ,
১.আকর্ষণ
২.মায়া
৩.ভালোবাসা
৪.বিশ্বাস
৫.উপাসনা
৬.পাগলামি
৭.মৃত্যু।
‘এড়িয়ে যেতে চাইল রিচার্ড। এলিজাবেথ আবার পিছন থেকে কাতর কণ্ঠে বলল,
“আপনার আগমন আমার জীবনে আর সকল হিরোদের মতো কেন হলো না?”
‘রিচার্ড পিছু ফিরে শান্ত গলায় জবাব দিল,
“এই গল্পের ভিলেন আমি কখনোই ছিলাম না। তোমার জীবনে আমার অপ্রত্যাশিত এন্ট্রি ছিল হিরো রূপে। তবে মাঝখানে এল এক খলনায়ক। যে নিজেকে হিরো ভাবতে শুরু করল আর তখনই হিরোকে ভিলেন হতে হলো।”
“এই হিরো ভিলেনের সংঘর্ষে যদি হেরে যান?”
‘উপহাস করে হাসল রিচার্ড,”হারা আমার জন্য নতুন শব্দ। খুবই বিস্মিত হলাম। বাকিটা ভাবতে ইচ্ছে হল না। আমি মানুষের মতো জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি না। কথা হবে ময়দানে।”
“যদি এই সংঘর্ষে আমি বিহীন হয়ে যাই?”
‘কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে রইল রিচার্ড। আবারও গিয়ে বসল এলিজাবেথের পাশে। কণ্ঠে কি যেন ছিল,
“সেদিন সত্যি সত্যি হেরে যাবো আমি।”
“কষ্ট পাবেন না?”
“আর ইউ টিসিং মি?”
‘এলিজাবেথ ভ্রু নাচিয়ে বলে দিল অনায়াসে, “ইয়েস আই এম।”
‘ড্রাগনের ট্যাটু খচিত হাত গিয়ে আঁকড়ে ধরল কোমল গ্রীবা।
“হেই বিউটিফুল লেডি। আই’ম লায়ন লাভার। এন্ড জানোই তো বনের রাজা হিংস কেন? তোর একটা চুলও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, অন্তত এই রিচার্ড কায়নাত বেঁচে থাকতে। অবশ্য পরেও পারবে না। কারণ আমি মরলে তোকে নিয়েই মরব।”
‘এক অদৃশ্য থাবার অনুভূতি গভীরভাবে কাজ করছে তাদের মনে। দু’টি খাদযুক্ত দৃষ্টি মিশে গেল একে অপরের মধ্যে,। নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে খোয়াল। অলিন্দের গুপ্ত প্রেমের জোয়ারে চোখে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত ন্যায়। রিচার্ডের উষ্ণ হাতের উপর এলিজাবেথের হাত ছোঁয়ালো।
“মরতে পারবেন আমার জন্য?”
‘রিচার্ডের নিরুদ্বেগ গলার আওয়াজ,
“না, সুন্দর একটা সংসারের খুব শখ। জীবনের প্রথম এমন এক অদ্ভুত শখ জাগল, যা আমি কখনো ভাবিনি, কিন্তু…”
‘একটু থেমে, গভীর চোখে এলিজাবেথকে লক্ষ্য করল। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক রহস্যময় হাসি। রিচার্ডের কণ্ঠে ভয়ঙ্কর গর্জন,
“তবে মারতে পারব। যাতে, তাকে, ক্ষণিকের মধ্যে, ভাবনা চিন্তা ছাড়ায়।”
“এভাবে আর কতজনকে মারবেন?”
‘রিচার্ড হাত রাখল এলিজাবেথের হাতের উপর। রাশভারী আওয়াজে বলল,
“যখন কেউ কারোর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা অনুভব করে, তখন পুরো দুনিয়া এক হয়ে যায় তাদের আলাদা করতে। শুধুমাত্র ভিলেনই পারে পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, সমস্ত বাধা ভেঙে তার আশিকীকে নিজের করে নিতে। আর আমি? আমি তার জন্যই প্রস্তুত।”
‘এলিজাবেথ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড কপাল কুঁচকে টুরি বাজালো চোখের সামনে।
“ঐ মেয়ে আমাকে ভয় পাও না? আর কোনোদিন যেন আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে না দেখি৷”
‘থতমত খেয়ে গেল এলিজাবেথ। তবুও দমল না। উল্টে কণ্ঠ ভরা তেজ নিয়ে বলল,”আমি কারোর বাপ কেও ভয় পায় না।”
‘রিচার্ড কাউকে কল করতে করতে ভাবহেলিশ জবাব দেয়,”কারোর বাপ কে ভয় না পেলেও তোমার ছেলের বাপকে ঠিকই পেতে হবে।”
“তখন থেকে দেখছি শুধু ছেলে ছেলে করছেন। আপনি কি করে জানেন ছেলেই হবে? মেয়েও তো হতে পারে।”
‘পকেটে ফোন রেখেও রিচার্ড আবারও গেল এলিজাবেথের কাছে। একটু ঝুঁকে পেটে ঠৌঁট ছুঁইয়ে দিল,
“আমি জানি ছেলেই হবে। আমার বিশ্বাস এটা। দ্বিতীয় কোনো নারীকে আমার জীবনে ঠাঁই দিতে চাই না।”
‘বলে এলিজাবেথের কপালেও পরশের ছোঁয়া একেঁ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। এলিজাবেথ নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল দরজার পানে। হঠাৎই ঠৌঁটের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে এল,
“গুনাগার সবসময় ফিরে যায় সেই জায়গায়, যেখানে সে গুনাহ করেছে। আর আশিক? সে ফিরে আসে তার আশিকীর ঠিকানায়, যেখানে তার হৃদয় বাঁধা পড়ে আছে। এবার দেখা যাক, কে জেতে_আপনার না বলা ভালোবাসা, নাকি আমার তীব্র ঘৃণা।”
“পুরো হসপিটালের সকল কে যেন মিষ্টি খাওয়ানো হয় ওকে?”
“জি বস। গার্ডরা ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে প্যাকেট।”
‘রিচার্ড ন্যাসোর সাথে কথা বলতে বলতে হসপিটাল থেকে বেরুচ্ছিল। পার্কিং লটে পা রাখতেই হঠাৎ মুখোমুখি হলো তাকবীরের। একসঙ্গে শক্ত হয়ে উঠল দুটি চিবুক। দুই চোখে নীরব সংঘর্ষ চলল কিছুক্ষণ। তাকবীর হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট সমেত দু’কদম এগিয়ে এয়ে সটান দাঁড়াল রিচার্ডের সামনে। ঠোঁট কামড়ে হাসতে হাসতে মিষ্টির কাটুনটা রিচার্ডের দিকে এগিয়ে দিয়ে ঠাট্টা-তামাশার স্বরে বলল,
“নে মিষ্টি মুখ কর। আফটার অল আজকে খুশির দিন। তুই তো অলওয়েজ লেট।”
‘ কথায় স্পষ্ট উপহাস। রিচার্ড চোখের গোল মনি ঘুরিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করল। তাকবীরের লোকেরা আশপাশের সবাইকে মিষ্টি বিলিয়ে দিচ্ছিল। রিচার্ডের আনা মিষ্টিগুলো এখনও গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছিল। ওর মস্তিষ্কে আবারও নাড়া দিয়ে উঠল সকালে তাকবীরের এলিজাবেথকে বলা সমস্ত কথাগুলো। গাড়িতে বসে সেগুলো শুনেছিল রিচার্ড। আজ আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না রিচার্ডের। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়। ঠৌঁট কাপড়ে হেসে তাকবীরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে নিরেট স্বরে বলল,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৩
“মানলাম তুই একটা জমিতে মালির দায়িত্বে নিয়োজিত আছিস। এখন সেই জমির ফলনে ফল ধরেছে। আর সেই ফল তুই একাই খাবি, আমাকে দিবি না। কিন্তু কথা হচ্ছে, যেই জমির ফল তুই একা খাওয়ার চিন্তা করছিস, সেই জমিতে তো ঘাম ঝড়েছে আমার, বীজ বুনেছি আমি।”
‘তৎক্ষনাৎ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল তাকবীরের হাত। হেসে উপেক্ষা করে গমগমে পায়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল রিচার্ড। রিচার্ড গাড়ির কাছে যেতেই ডোর খুলে দিল ন্যাসো। গাড়িতে উঠতে গিয়েও উঠল না রিচার্ড। তার চোখ চলে গেল রাস্তার পাশে বসে থাকা এক মিগী রোগীর দিকে। মাত্রই রিচার্ডের গার্ড তাকে মিষ্টি দিয়ে এসেছে, কিন্তু লোকটা কাঁপতে কাঁপতে খেতে পারছে না। রিচার্ড মনোযোগ দিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। তাকে সেদিকে যেতে দেখেই কপাল কুঁচকাল ন্যাসো। রিচার্ড লোকটার সামনে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসতেই লোকটা কেঁপে উঠল। চোখে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে রিচার্ড, ঠান্ডা হতে বলল। নিজের হাতে একটা মিষ্টি তুলে ধরল লোকটার মুখে। লোকটা কিছুটা ইতস্তত বোধ করছিল। রিচার্ড হালকা হাসি ও মাথা নেড়ে খেতে বলল লোকটাকে। প্রশান্তিময় হাসি দিয়ে বলল
“আজ আমি খুব খুশি।”