ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৮

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৮
মিথুবুড়ি

“আমার রূপ, গুন সবই আছে, যেটা নেই সেটা হল, কপাল।”
‘তাকবীরের হাত থমকালো। বিহ্বলিত হয়ে তাকাল এলিজাবেথের পানে। সেই অবিস্মরণীয় কালো রাতের পরে আজ আটদিন। এলিজাবেথ এখনও আগের মতোই, এখনও সন্তান হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শরীরের অবস্থা কিছুটা সহনীয় হলেও হৃদয় ভেঙে খন্ড, দ্বিখণ্ডিত। তাকবীর ফোঁস নিশ্বাস ফেলে কমলার খোসা ছাড়িয়ে এলিজাবেথের মুখের সামনে ধরল। বাকিগুলোর মতো এটাও ছুঁড়ে ফেলে দিল মৃতপ্রায় মেয়েটা।
“এভাবে আর কতদিন মুখে কিছু তুলবে না? মারা যাবে তো।”

“অন্তত আত্মহত্যা নামক মহাপাপ তো হবে না।” জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে নিস্তেজ স্বরে আওড়ালো এলিজাবেথ। তাকবীর নিমিষেহীন দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকল এলিজাবেথের বির্বণ মুখাবয়বে। কবুতরের মতো মখমলে গড়নে আর সেই উজ্জ্বলতা নেই, হাড্ডির সাথে মিশে চামড়া।
“উনি তো আমাকে সবসময় চোখে দেখে রাখল, তাহলে সেদিন কেন এল না সে? কোথায় ছিল তার লোকজন?”
‘এই আটদিনে এলিজাবেথ এই প্রশ্ন অজস্র বার করেছে তাকবীরকে। প্রতিবারই সে এড়িয়ে গেলেও আজ তা করল না। মলিন স্বরে বলল,
“সেদিন শুধু রিচার্ডের লোকজন না আমার লোকজনও ছিল তোমার চাচার বাড়ির আশেপাশে জালের মতো বিছানো। তবে কাদের সবাইকে আগেই সরিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্য কিংবা পরিস্থিতি কিছুই তোমার সান্নিধ্যে সেদিন ছিল না এলোকেশী।”
‘মুচড়ে যাওয়া এক অনুভূতি বুকের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেল।জমিয়ে রাখা অশ্রুকণা নিদারুণ গড়িয়ে পড়ল। এলিজাবেথ বিষাদময় কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তাও লোকটা কেন এল না তার সন্তানকে বাঁচাতে? সে তো একাই একশোজনকে মেরে ফেলতে পারে। তবে কি সে পাপী বলে কি পবিত্র সত্তাকে বাঁচাতে আসেনি, ইচ্ছে করে?”
‘তাকবীর নিরবে মাথা নুইয়ে ফেলল। ধীরে ধীরে কান্নার তোড় বাড়তে থাকে এলিজাবেথের। হাঁপাতে শুরু করল,
“তাকে জবাব দিতেই হবে। কেন সে বাঁচালো না আমার বাচ্চাটাকে? কে এল সে না। লোকটা কোথায়! এখনও আসছে না কেন?”
‘তাকবীর জড়তা, সংকোচ কাটিয়ে দু’কদম এগিয়ে গেল। ধাতস্থ গলায় শুধালো,
“এলোকেশী প্লিজ শান্ত হও।”

‘হাঁটুতে মুখ গুঁজে নির্বাক কাঁদছে এলিজাবেথ। অশ্রুগুলো শুকিয়ে আসলেও, বুকের ভেতর ঝড়ের তাণ্ডব থামেনি। তিনদিন পরই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় কিন্তু এলিজাবেথ নড়েনি। একই শর্ত বারবার—রিচার্ডকে আসতে হবে। তাকে উত্তর দিতে হবে। তবেই ফিরব। নইলে নয়।গত আটদিন ধরে তাকবীর নিরবে সহ্য করেছে এলিজাবেথের সকল উন্মাদনা। কিছুক্ষণ পরপরই ছটফট করে উঠত, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলত চারপাশে। কখনো তাকবীরের গায়ের দিকেও, কখনো নিজের দিকেই। একবার কাঁচের টুকরো মাথায় লাগলেও তাকবীর কিছু বলেনি নীরবে ক্ষতটা আড়াল করেছে। হঠাৎ তাকবীরের ফোন বেজে উঠল। তাকবীর একবার চেয়ে দেখল এলিজাবেথের দিকে শূন্য দৃষ্টি, ভেজা চোখ, তীব্র অথচ নির্বাক আকুতি। অতঃপর ফিনফিনে পাঞ্জাবির পকেটে ফোনটা রেখে পেছন ফিরে হাঁটল।
“খলনায়ক থেকে মহানায়ক হতে চেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবেন আপনি। তারচেয়ে ভালো নতুন কাউকে জীবনে ঠাঁই দিন।”

‘তাকবীর থমকে দাঁড়াল, তবে পেছনে ফিরল না। ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠে! নরম অথচ অনড় কণ্ঠে বলল,
“বিয়োগের ভয়ে যোগ করি না।”
‘বলে সাথে সাথে চলে গেল সে। তার সঙ্গেই যেন আলোটাও মিলিয়ে গেল ছোট্ট কেবিন থেকে। এলিজাবেথ ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানার সব বালিশ ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। তার কণ্ঠরোধ করা কান্না বিদীর্ণ করে দিল ঘরকে।
“আমি তো উপরওয়ালার কাছে দুনিয়াতেই নরকের শাস্তি চাইনি… তবে কেন? কেন আমার কোল খালি করে দিল?!”
‘এলিজাবেথ ভালো নেই। এমন ভালো নেই যে বুকের ভেতর কেবল শূন্যতা আর দহন। অভাগীর ভিতরের জ্বলন্ত লাভা ধীরে ধীরে ছাই করে দিচ্ছে সমস্ত অস্তিত্ব। কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বের হয় না তবুও ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে সে।যেন কোনো এক মহাশূন্যে বারবার প্রতিধ্বনি ফেলে যায় তার আর্তনাদ। চোখের সামনে ভাসে একরত্তি পায়ের ছোটাছুটি, বাচ্চার খিলখিল হাসি আর কান্নার মিশেলে তৈরি এক করুণ সিম্ফনি। যা বাস্তব নয় তবু তার চেতনায় ক্রমাগত বাজতে থাকে। হাতড়ে ফোন খুঁজে পায় এলিজাবেথ। অসংলগ্ন হাতে কিবোর্ডে আঘাত করতে থাকে উন্মাদনার মতো। চোখের সামনে সব ঝাপসা, হাত কাঁপছে, তবুও লিখে পাঠায় মায়াজাল নামক হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্টে,
“আপনি চাইলে সব হতো, আমাদের প্রেম হতো, সংসার হতো, ঘর হতো… কিন্তু আপনি চাইলেন না…!”

‘মেসেজ সেন্ড হলেও কোণায় সেই কাঙ্ক্ষিত দুটো চিহ্ন ওঠে না। এই আটদিন ধরে শত শত মেসেজ পাঠিয়েছে এলিজাবেথ রিচার্ডকে অথচ ওপাশ থেকে নিঃসীম নীরবতা। প্রতিবারই সে অপেক্ষায় থাকে, হয়তো এবার, হয়তো এইবার… কিন্তু প্রতিবারই উত্তরহীন শূন্যতা গিলে খায় ওকে। এলিজাবেথ এক ঝটকায় ফোন ছুঁড়ে দেয় দেয়ালের দিকে। প্রতিধ্বনির মতো ফোনের ভাঙা আওয়াজ ফিরে আসে তার কান পেরিয়ে হৃদয় পর্যন্ত। দেয়ালে মাথা ঠুকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।এ যেন ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কান্নায় সাড়া জাগাতে পারে রিচার্ডের নির্লিপ্ত আত্মায়।
‘এলিজাবেথ একা নয়—তার পাগলামির নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাকবীর। বাইরে থেকে সে দেখছিল অনুভব করছিল ওর দুঃসহ যন্ত্রণা। এলিজাবেথকে একা ফেলে যেতে পারে না তাকবীর আবার কাছে গিয়েও কিছু বলতে পারছিল না। তার ভিতরে ভয়! ভয় যদি এলিজাবেথ আর ফিরে না আসে বাস্তবতায়। তাই তো সে পর্যন্ত চারজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হয়েছে।
‘দু’জন নার্স ছুটে আসে কক্ষে। এলিজাবেথ ধস্তাধস্তি করতে থাকে, তাদের বাঁধা ভাঙতে চায়, চায় এই বদ্ধঘর, এই নির্মম বাস্তবতা থেকে ছিটকে পড়তে। কিন্তু নার্সদের শক্ত হাতে ধরা পড়ে যায় সে। এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায় তারপর হালকা চক্রাকার ব্যথা অনুভব হয় বাহুতে। ইনজেকশনের ওষুধ ধীরে ধীরে দখল নিতে থাকে তার শরীরের উপর। শরীর স্থবির হয়ে আসে। চোখ দুটো মনের ভারে বন্ধ হতে থাকে। শুধু একটা শূন্যতা ঘিরে ধরে এলিজাবেথকে। সাদা বেডে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে।

‘গাড়ি ছুটে চলেছে দিয়াবাড়ির উদ্দেশ্যে। রেয়ান নির্বিঘ্নে ড্রাইভ করছে পাশে বসে তাকবীর ফোনে দেশের আপডেট দেখছিল। হঠাৎই তার চেহারা কঠোর হয়ে উঠল, চোখে জ্বলল তীব্র ক্ষোভ। ফোনটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে রাগে ফুঁসতে লাগল।
“দেশে এসব কী শুরু হয়েছে! প্রশাসন কার বাল চাটছে?”
‘রেয়ান নির্বিকার ভঙ্গিতে স্টিয়ারিং ধরে রেখে বলল,
“জনগণ দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার। এখন আর তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা হবে কেন?”
‘তাকবীর ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে রেয়ানের দিকে তাকাল।
“তাহলে বসে থাকবো?”
‘রেয়ান গতি না কমিয়েই শান্ত স্বরে বলল, “বসে থাকার জন্য তো জন্ম হয়নি, তাই না?”
‘তাকবীর গভীর নিঃশ্বাস ফেলল, ফোনটা শক্ত করে ধরল।
“তাহলে খেলা হবে।”
‘থেমে শক্ত নীতিমালা দন্ডায়মান কণ্ঠে বলল,

“আজ থেকে আমার প্রতিটি কর্মী রাজপথে থাকবে। সাইবার টিমের সাথে যোগাযোগ কর,ওরা দ্রুত কাজ শুরু করুক। দল-মত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কিছু চক্র শনাক্ত করলেই আসল ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হবে। ধর্ষণ ও ডাকাতির মতো অপরাধ হঠাৎ করে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে না। এটা সোশ্যাল মিডিয়ার গা ভাসানো কোনো ট্রেন্ড না। এর পেছনে অবশ্যই সুসংগঠিত রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে। আমরা ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগোবো কোনো ষড়যন্ত্রকারীর জায়গা এ দেশে নেই।”
‘রেয়ানের ওষ্ঠপুটে উপহাসের হাসি ফুটে উঠল, চোখে চিরচেনা ব্যঙ্গ। তার বিরক্তির স্বরে স্পষ্ট সে মোটেও তাকবীরের পদত্যাগে সন্তুষ্ট নয়।
“গদি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন এত দেশের কথা ভেবে লাভ কী?”
‘তাকবীর গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। গলায় দৃঢ়তা স্পষ্ট,
“গদি ছাড়লেও ব্যক্তিত্ব রক্তে বহমান। রাজনীতি করেছি আদর্শের তাড়নায়, ক্ষমতার লোভে নয়। আমার লুকায়িত ব্যক্তিত্ব কখনো আমার দায়িত্বের পথে বাধা হয়নি। দেশকে অরাজকতার হাতে ছেড়ে দেব না। যারা ষড়যন্ত্রের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে তাদের একে একে টেনে বের করব। প্রত্যেক অপরাধীর অবস্থান আমার নজরে! আমি নিশ্চিত করব কেউ ন্যায়ের শাসন থেকে পালাতে না পারে।”

‘এক মায়ের আহাজারি,,,
“আমার মেয়েরে ধরে নিয়ে যাইতেছে আমি বলছি, বাবা আমার হাফেজ মেয়ে , পর্দা করে, জীবন ভিক্ষা দাও”। ওরা বলে “বাইর হো বাড়ি থেকে চুপচাপ। ওরা রুমে নিয়ে দরজা লাগায় দিছে। এই বাংলাদেশটা আশা করি নাই । ছোটবেলার থেকে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি এই কবিতাটি পড়ছি।”
‘মাদকের ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে চারপাশ, ঘন কুয়াশার মতো জমাট বেঁধেছে লাল রোশনাই লাইটের নিচে। ক্যারাম বোর্ডের তলে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আধপোড়া সিগারেট। সময়ের সঙ্গে নির্বিকারভাবে নেভে যায় একের পর এক। বখাটে আড্ডাখানায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অশ্রাব্য শব্দ। গালির স্রোতে মিশে গেছে সকলের স্বাভাবিক বাক্যালাপ। কী স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে যেন নিষিদ্ধ ভাষাই এখানে প্রচলিত নিয়ম।
“শালা মাল খাইয়া কি টাল হইয়া খেলার তাল হারায় ফেলতছ নাকি রে?আজ হারলে তোর বইন আমার।”
“মাঙ্গের নাতি সাবধানে কথাবার্তা কবি।”
“ক্যা বে?নিজের টা নিয়া কইলে এতো ফোসকা পড়ে যায় ক্যান শইলে?”
“খানকির পুত, আমার বোন কি রাস্তার মাগিগোর মতো? পর্দা করে আমার বইন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে ডেইলি।”
“তোর বোন সতীসাবিত্রী আর মাইন্সের বইন রাস্তার মাগি?”

“দেখ মেজাজ খারাপ করবি না কইয়া দিলাম।”
“কি করবি রে তুই?কার লগে চু’দা’ই’ন্না ভাব দেখাস?”
‘দু’জন যখন ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায়,তখন পাশের একজন বাঁধা দিল তাদের।
“এই তোরা কি অখন নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করবি নাকি।”
‘তাদের মধ্যে চতুর্থ জন নির্বিক হাসছে। এনজয় করছিল ওদের বিবাদ। ঘুটঘুটে কালো ছেলেটার চোখ রাগে ধিকিধিকি করছে। বোন নিয়ে কথা শুনে মাটি ফাটিয়ে গর্জে উঠল সে,
“এই মাগির পুতরে ক সীমায় থাইকা কথা কইত! নাইলে কাইত কইরা লামু কিন্তু!”
‘বিপরীত পাশের ছেলেটা মুখ খুলতেই এক প্রচণ্ড অট্টহাসিতে কেঁপে উঠল চারপাশ। ভারী, বিকট, কাঁপন ধরানো সে হাসি যেন শীতল নিশ্বাস ফেলে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। আধো-অন্ধকার ঘরটা মুহূর্তে আরও সংকুচিত হয়ে এল।।চারদিকে তাকিয়ে হাসির উৎস খুঁজতে লাগল তারা। গুদামঘরের সাটারের নিচের ফাঁক দিয়ে ফিল্টার হওয়া আবছা আলোয় স্পষ্ট হলো—সাটারের নিচে অন্ধকারের গাঢ় ছায়া নড়ে উঠছে।
“কে ওখানে?”
‘কক্ষের স্থিরতাকে ভেঙে কোনো এক অনুচ্চ স্বরে উত্তর এল,
“হারকিউলিস।”

‘নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ঘরের উষ্ণতাও নিঃশেষ হয়ে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তাদের। আতঙ্কের স্রোত চুইয়ে নামল শিরদাঁড়া বেয়ে। কাঁপা গলায় একজনে সাহস করে বলল,”মা-মানে?”
“তোদের পাপের যম।”
‘আতঙ্কিত চোখগুলো একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। একজন কাঁপা কাঁপা গলায় আওড়ালো,
“ক-কে তুই? সাহস থাকলে সামনে আয়।”
“বনের রাজা প্রথমে আড়ালে থেকেই শিকার বাছাই করে, তারপর ঝাপিয়ে পড়ে। আমি বেছে নিয়েছি আমার শিকার। এবার হবে ভোজনের পালা।”
‘কর্কশ শব্দে সাটার উঠে যায় ধীরে ধীরে। ধোঁয়াটে আলোয় এক দীর্ঘদেহী পুরুষ সটান দাঁড়িয়ে। তার মুখ অন্ধকারে ঢাকা শুধু হাতে ধরা অস্ত্রের ধাতব ঝলক দেখা যায়। শিকারদের পলায়নের পথ রুদ্ধ। চার ছেলেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ। দাঁড়িয়ে আছে পাপীদের যম,আরেক বিশুদ্ধ পাপী। সকলের চোখেমুখে আতঙ্কের দাবালন ছড়িয়ে পড়ে। পালানোর চেষ্টা করলে মরতে হবে আর দাঁড়িয়ে থাকলেও,,, একজন দৌড় দিল।
ঠাস!

‘প্রথম জন ধপাস করে পড়ে যায়। বাকিরা পেছন ফেরার আগেই,
ঠাস! ঠাস! ঠাস!
‘তিনটি দেহ আছড়ে পড়ে রক্তাক্ত মেঝেতে। নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে। ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে শিকারি ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে আস। তার জুতার নিচে রক্ত ছিটকে পড়ে।নিস্তব্ধতার মাঝেও তার পদক্ষেপে প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিশোধের সুর।
‘রাত। শহরের এক পরিত্যক্ত রাস্তা। একটি কালো জিপ অন্ধকার চিরে ছুটে চলছে। ইঞ্জিনের গর্জনেও মৃত্যুর সংগীত। পেছনের বাম্পারে বাঁধা দড়িগুলো টানটান হয়ে আছে। দড়ির শেষ প্রান্তে ঝুলছে চারটি মাথা রক্তস্নাত, নীরব, শূন্য দৃষ্টিতে ঝুলে থাকা একেকটি মুণ্ড। নগ্ন, ছিন্নভিন্ন চারটি দেহ পিচের রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে আছে। গাড়ির গতির সাথে সাথে তাদের চামড়া ছিঁড়ে যাচ্ছে, হাড় ঘষটে যাচ্ছে রুক্ষ পিচের উপর। ফ্যাকাসে মাং’স খুলে খুলে পড়ছে রাস্তায়, পেছনে রেখে যাচ্ছে লালচে-ধূসর এক বিভীষিকাময় পথচিহ্ন। বস্তির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে জিপ। মৃত্যুর বার্তা নিয়ে।

‘সকালের প্রথম আলো ফোটার আগেই বস্তির মানুষ কাজে বের হয়। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধ। পাবলিক টিউবওয়েলের সামনে লম্বা লাইন লাগে। কলসির পর কলসি ভরে মানুষ ছুটে যায় ঘরে ফেরার তাড়া নিয়ে। এক মহিলা ঠিক তেমনই জলভর্তি কলসি নিয়ে ফিরছিলেন। হঠাৎ এক ঘরের সামনে চোখ আটকে গেল তাঁর।মুহূর্তেই হাত ফস্কে কলসিটা মাটিতে পড়ল। ভাঙার শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এল তাঁর মুখ থেকে। সেই চিৎকারে ছুটে এল আশপাশের সবাই।

‘একটা ঘরের সামনে পড়ে আছে চারটে লাশ—ছিন্নভিন্ন, বিকৃত, রক্তমাখা। কোনো শরীরে এক টুকরো কাপড়ও নেই অথচ দৃষ্টিটা পোশাকহীনতার জন্য নয় অন্য কিছুর জন্য আটকে গেল সবার। চারজনেরই পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে! লাশগুলো উপুড় করে রাখা তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পিঠের অংশ এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত যে মনে হচ্ছে গো’শ’ত ছিঁ’ড়ে ছিঁ’ড়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। সবার চিৎকার চেঁচামিচিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সেই মা,যার আহাজারি গত কয়েকদিন সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে নিয়েছিল। এই লাশগুলো তাঁর ঘরের সামনেই ফেলে রাখা হয়েছে!
‘একজন পুরুষ সাহস করে একটা লাশ পা দিয়ে সোজা করতেই ভয়ে ছিটকে সরে গেল সকলে। মুখ দেখার পর শিউরে উঠল পুরো বস্তিবাসি। চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, ঠোঁট ছিঁ”ড়ে দেওয়া, গালের মাংস ফালা ফালা করে কাটা।

শরীরের চাম’ড়া কোথাও ধা’রা’লো কিছু দিয়ে খোঁ’চা’নো, কোথাও আগুনে পোড়ানো। চামড়ার ফাঁকা অংশ থেকে গলগল করে ফেনা উঠছে। শরীরের ভেতর কিছু একটার বিক্রিয়া এখনও চলছে তখনও। চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। কেউ বমি করল, কেউ চোখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু শুধু একজনের চোখেই আগুন জ্বলল—সেই মা!
‘এদের সে চিনতে দেরি করল না। ওরা সেই জানোয়ার, যারা তার ছোট্ট হাফেজা মেয়েটাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছিল। কোনো বিচার হয়নি। হবে না। মা মাটিতে তাকালেন কিছু একটা খুঁজলেন। হঠাৎই উঠে নিয়ে নিলেন একটা কাঠ, ঝাঁপিয়ে পড়লেন লাশগুলোর ওপর! একের পর এক আঘাত, প্রতিটা আঘাতে যেন নিজের দগদগে ক্ষত মেটাচ্ছেন। বস্তির লোকজনও থেমে থাকল না। একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল।হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে ভারী করে দিল প্রতিশোধের ভার। বেশিক্ষণ লাগল না মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। কেরোসিন ঢালা হলো। আগুন ধরানো হলো।
আগুনের শিখায় গলে যেতে লাগল বিকৃত মুখগুলো। মা বসে পড়লেন সেই আগুনের সামনেই, কাঁদতে লাগলেন অঝোরে। আর ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ধারা ধুয়ে দিল সব পুড়ে যাওয়া ছাই। প্রকৃতি যেন নীরবে জানিয়ে দিল—সুবিচার সে নিজেই দিয়ে গেল।

‘হঠাৎ সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডজুড়ে এক রহস্যময় পেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ফলোয়ারস মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায় অথচ সেখানে নেই একটিও পোস্ট। তবুও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ফলো দিতে! শুধুই কি নামের জন্য? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো অদৃশ্য প্রতিশোধের প্রতিধ্বনি?
‘হারকিউলিস’—একটি ভেরিফাইড পেজ হঠাৎ করেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। রক্তলাল প্রোফাইলের মাঝে জ্বলজ্বল করছে মাত্র একটাই বাক্য,
“Take justice into your own hands.”
‘তাহলে কি হারকিউলিস ফিরে এসেছে? কমেন্ট সেকশনে বয়ে যাচ্ছে জনতার স্রোত। শুষ্ক, হতাশাগ্রস্ত হৃদয়ে যেন দমকা হাওয়া লাগল। কেউ লিখছে, “এই সমাজের ঘুণপোকাদের জন্য অপেক্ষা করছি।” কেউ বলছে, “বিচার নেই যেখানে, সেখানে প্রতিশোধই একমাত্র পথ!” অন্ধকারে একটা ঝড় উঠে আসছে। এটা কি ন্যায়বিচারের? নাকি নরকের আগুনের? হাজারো রক্তগরম কমেন্টের মাঝে কিছু লেখা ছিল যা বাকিদের চেয়ে আলাদা, দৃষ্টান্ত।সোয়াট অফিসার তাকওয়ার কমেন্টটাই সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ল,

“নারী তুমি আগুন হয়ে জ্বলে ওঠো রোষে! ধর্ষকের হাত এবার পুড়বে তোমার চোখের শোলে। ভয় নয়, এবার প্রতিরোধ! রুখে দাও শক্ত হাতে৷ আর নয় নীরবতা, প্রতিবাদ হোক রক্তের পথে! বদনামের ভয়ে লুকিয়ে থেকে অন্যদেরও ক্ষতির মুখে ঠেলে দিও না। অন্যায় যখন ন্যায়কে দাবিয়ে রাখে তখন সামনে এসে দাঁড়ানোই সত্যিকারের যুদ্ধ! আমি সাহায্য করব সকল বোনদের—যারা যেকোনোভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছো, আমার সাথে যোগাযোগ করো। আমি তোমার পাশে আছি সুবিচারের জন্য। এই লড়াই শুধু একটা মানুষের নয় একটা সমাজের, নারীর ইজ্জতের লড়াই।
তোমাদের জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমি বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু একা পারব না। তাই, এগিয়ে আসো বাঘিনীরা! আমাকে সাহায্য কর, তোমার নিরাপদ হও৷”

‘এই কমেন্টের পর থেকেই পোস্টের নিচে যেন নতুন উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ল। কেউ প্রশংসায় ভরিয়ে দিল কেউ দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকিয়ে থাকল স্ক্রিনের দিকে। হারকিউলিস কি সত্যিই ফিরে এসেছে নাকি এবার অন্য কোনো শক্তি তৈরি হচ্ছে? কমেন্ট সেকশনে যেন বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। পুরুষতন্ত্রের শিকলে বন্দি সমাজে এমন কথা কেউ ভাবতে পারত না।অথচ এখন এই কথাগুলোই লাখো মানুষ শেয়ার করছে, লাইক দিচ্ছে, সমর্থন জানাচ্ছে।
‘একটা পরিচিত নাম‘বেপরোয়া, অশ্লীল পোশাকধারী লাড়া’ সে নিজেও সরব হলো,
“হেই লেডিস! ইজ্জত রক্ষার জন্য হাতে চুড়ি নয়, ছুরি ধরো। সেলফ-প্রটেকশনের জন্য অস্ত্র বা ট্রেনিং দরকার? ভয় পেয়ো৷ ফিল ফ্রি নক মি টু মাই অল সুইটহার্ট!

‘তবে সবচেয়ে আলোচিত কমেন্টটি এলো এক আইনের মানুষের কাছ থেকে। অফিসার প্রেম লিখল,
“আমার মা-বোনের ইজ্জত রক্ষার জন্য যদি আইনের পোশাক খুলতে হয়, খুলব! তোমার শক্তি তুমি নিজে কেউ আসবে না তোমাকে বাঁচাতে।তাই নিজেকে রক্ষা করো। ঝরুক রক্ত, পতন হোক নরপশুর! আইনের আশায় বসে থেকো না। ভাই হিসেবে ডাকলে আমি থাকব, তাহলে হয়তো আরও ভালোভাবে তোমাদের পাশে দাঁড়াতে পারব।”
‘এই কথাগুলো যেন অনেকের ভিতরকার ভয় দূর করে দিল। সবচেয়ে শেষ ও গুরুতর কমেন্টটা ছিল সোয়াট টিম লিডার এরিকের। সে সরাসরি তার টিমের সদস্যদের নাম্বার দিয়ে দিল কমেন্ট বক্সে,
“আপনারা যেই প্রান্তেই বিপদে পড়েন না কেন, এই নাম্বারগুলোতে কল করুন। কেউ এগিয়ে না গেলেও আমরা যাব আমাদের মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করতে!”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৭

‘সেখানে কোনো বাহুল্য শব্দ ছিল না ছিল শুধু দায়িত্ববোধের প্রতিধ্বনি। সবশেষে সেই রহস্যময় ‘হারকিউলিস’ প্রোফাইলটি শেয়ার করা হলো সাবেক সংসদ সদস্য তাকবীর দেওয়ানের অফিসিয়াল রাজনৈতিক প্রোফাইলে। সব কমেন্ট, প্রতিক্রিয়া, উত্তাল একটিভিটি দেখে বাঁকা হেসে ফোনটা নামিয়ে রাখল রিচার্ড। সে কাল রাতেই দেশে ফিরেছে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। গাড়ির চাবি তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিশ্চুপ, কিন্তু লক্ষ্যস্থির!

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৯