ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৯
মিথুবুড়ি
‘বিদ্যুতের স্নায়ু জ্বালানো স্পর্শে বারবার ছটফট করে উঠছে ভিক্টরের শরীর। চেয়ারের সাথে বাঁধা হাতে পেঁচানো ইলেকট্রনিক তারের শিকল। প্রতি স্পন্দনে মাংসপেশি কুঁকড়ে উঠছে, চোয়ালে শিরা ফুলে উঠেছে, তবু একটুও নতি স্বীকার করছে না ভিক্টর। তাকবীর ঠান্ডা দৃষ্টি মেলে বসে আছে পায়ের ওপর পা তুলে। চোখে অনড় নিষ্ঠুরতা। যেন শিকারী তার আহত শিকারের শেষ আর্তনাদ উপভোগ করছে।
“দেখুন অফিসার আমি আইন মানি না। আইন আমার কাছে চরম উপহাস। আমাকে এরচেয়ে বেশি কঠোর হতে বাধ্য করবেন না।”
”ইউ আর জাস্ট আ পিস অফ শি”ট।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ঘৃণার একদলা থুতু ছুড়ে দেয় তাকবীরের মুখে।
‘তাকবীরের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় মুহূর্তেই। চোখে দাউদাউ করে ওঠে নিঃশব্দ অগ্নি। রক্তিম চোখ ফেরায় রেয়ানের দিকে। রেয়ান বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে রিমোটের বোতামে চাপ দেয়। মুহূর্তেই বিদ্যুতের প্রবাহে ভিক্টরের দেহ তিড়িং বিডিং করে কেঁপে ওঠে, পেশিগুলো অসহায় যন্ত্রণায় মোচড় খায়। বাতাসে পোড়া চামড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তবুও ভিক্টরের ঠোঁটের কোণে একরাশ উপহাস খেলা করে।
“সত্যি করে বল তোদের বাংলাদেশে কে আনিয়েছে? কি জন্য এভাবে পড়ে আছিস আমার পিছনে?”
‘ভিক্টরের চোখের কোণে অস্পষ্ট যন্ত্রণা তবুও কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের রেখা স্পষ্ট। বিদ্যুতের ঝটকায় শরীর ছটফট করলেও আত্মবিশ্বাসে একচুল টলেনি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমাদের বস জানলে তোকে জিন্দা দাফন করবে। তোর পতনের সময় হয়ে গিয়েছে।”
‘তাকবীর শব্দ করে হেসে উঠল। হাসির কম্পনে দেহ সামান্য কেঁপে উঠল। চোখে নিষ্ঠুর দ্যুতি জ্বলজ্বল করছে।
“তোর বস বেঁচে থাকলে তো আমার কবর খুঁড়বে? দুঃখের বিষয় এবার আমার হাতেই ওর কবর খোঁড়ার পালা!”
“এসব বলে তুই আমাকে ভয় দেখাতে পারবি না।”
‘তাকবীর একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভিক্টরের ওপর। ওর উরুর উপর হাঁটু চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
“তোর চোখে যদি আমার জন্য ভয়ই না দেখি, তো তোকে রেখে আমি কী করব?”
‘ভিক্টর কিছু বলার আগেই তাকবীর পকেট থেকে পিস্তল বের করে ওর কপালের ঠিক মাঝখানে চেপে ধরল। এক নিমেষে বিস্ফোরণের মতো শব্দ ছড়িয়ে পড়ল ঘরজুড়ে।গুলির তীব্র ঝাঁজ মস্তিষ্ক ভেদ করে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেল। দেয়ালে ছিটকে পড়ল রক্ত আর ভেসে যাওয়া টুকরো টুকরো ভাবনাগুলো। ভিক্টরের দেহ ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
‘তারপরও তাকবীরের চোখে কোনো তৃপ্তি নেই। ভিক্টরের নিথর শরীর ধপ করে মাটিতে পড়তেই ওর ঠোঁট কাঁপল! চোখ আগুনের মতো জ্বলছিল।বিস্ফোরণের মতো রক্ত ছিটকে এসে ওর মুখে লাগল, উষ্ণ, ধোঁয়া ওঠা রক্ত। তবু তাকবীর একটুও পিছাল না। বরং এক হাঁটু গেঁড়ে বসে ভিক্টরের রক্তাক্ত মুখটা দু’হাতে ধরে হিসহিস করে বলল,
“এত সহজে চলে গেলি? ভয় পেলি না একটুও? বেচারা …!”
‘কিন্তু মৃতেরা আর জবাব দেয় না। তাকবীর ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল। ওর হাতে ধরা অস্ত্রটা ধোঁয়া ছাড়ছিল তখনও। তবুও সেটাকে আরও শক্ত করে ধরল। বাতাসে এখনও বারুদের গন্ধ ভাসছে, মৃতদেহের আশপাশে রক্তের কুয়াশা জমেছে, তবে তাকবীরের চোখে কেবলই শূন্যতা। সে এখনও ধরতে পারছে এরিকের আক্রোশের কারণ। কেসের জন্য কেউ এভাবে পিছনে উঠেপড়ে লাগে না। সেদিন এলিজাবেথের কাছে তাকবীরের কুকীর্তি গুলো আর কেউ না এরিক ই পাঠিয়েছিল।
“বস, এসব করে আধেও কি কোনো লাভ হবে?”
‘তাকবীর ফাঁপা দৃষ্টিতে তাকাল রেয়ানের দিকে,”জানি না কতটুকু লাভ হবে। তবে ওর চোখের অবিশ্বাস আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।”
“জেনে-বুঝে আগুনে পা দিয়েছেন আপনি।”
‘তাকবীর শব্দ করে হাঁটল। গাড়ির চাবি আঙুলের ভিতর ঘূর্ণির মতো ঘূর্ণন তুলে সুর তুলে এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে।
“আগুন জেনেও পুড়লাম আমি, দিলাম তাতে ঝাপ… তোর আমার প্রেমে ছিল রে বন্ধু ছিল পুরোটাই পাপ,,,!
‘জঙ্গলের শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা ভেঙে গেছে, গনগনে ব্যথার দহনকষ্টে ইকবাল সাহেবের শরীর খিচিয়ে উঠছে। মুখে গুঁজে দেওয়া কাপড় চিৎকারকে গিলে নিচ্ছে। কেবল গলা দিয়ে বেরোচ্ছে ভীতিকর গোঙানি। রিচার্ডের চোখে উন্মত্ত জিঘাংসা, হাতে ধাতব চিমটি। এক এক করে লোম তুলে আনছে মাং’স ছিঁ’ড়ে। চাম’ড়ার নিচ থেকে তাজা র’ক্ত ঝরছে, উন্মুক্ত কো’ষ থেকে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছে জ্বা’লাধরা লাল’স্রোত। লুকাস সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাসিতে দেখছে, ন্যাসো হাসতে হাসতে পিঞ্চারে গরম মোম তুলে আনল।
“এইবার শুরু হোক নরকের আস্বাদ।”
‘গরম মোমের আচ্ছাদনে ইকবাল সাহেবের ক্ষত-বিক্ষত শরীর দাউ দাউ করে জ্বলছে। ধোঁয়া উঠছে পোড়া চামড়ার, নাকে এক অমানবিক উৎকট গন্ধ, চোখের পাতা কাঁপছে তীব্র যন্ত্রণায়। কিন্তু জল পড়ছে না। যেন চোখের সমস্ত জলও বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। রক্ত, মোম, পোড়া চামড়া এই নরকীয় সংমিশ্রণের মাঝে রিচার্ড লবণ-মরিচ মেশানো তরল ঢেলে দেয়। মুহূর্তেই শরীর খিঁচকে উঠল, শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে যাবতীয় যন্ত্রণা সইতে চাইল ইকবাল সাহেব। তবে তার চেয়েও ভয়াবহ অপেক্ষা করছিল—ব্লিচিং পাউডার।সাদা চূর্ণ ছড়িয়ে যাওয়া মাত্রই মাংস গলতে শুরু করে। দগদগে ক্ষত চ্যাপ্টা হয়ে যেতে লাগল, রক্ত-চামড়া-মাংস একসাথে মিশে গিয়ে এক বিভৎস কাদায় পরিণত হলো। ইকবাল সাহেবের শরীরের ত্বক যেন আস্তে আস্তে ঝলসে গিয়ে খুলে পড়ছে! অস্থি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
‘কিন্তু মৃত্যু এখনো দূরে। মৃত্যু এখনো বিলাসিতা। আগুনের হল্কা আলোয় ঝলসে উঠল রিচার্ডের ঠান্ডা, নির্দয় চোখ। টগবগে পানিতে মাংসের টুকরোগুলো নড়েচড়ে উঠছে। গাঢ় ধোঁয়া উঠে চারপাশে এক বিচিত্র উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।র’ক্ত, পোড়া চা’মড়া, সেদ্ধ মাং’সের বিকট সংমিশ্রণ তৈরি হয়েছে৷ ইকবাল সাহেবের পা থেকে সাবধানে কাটা মাংসগুলোর দিকে তাকিয়ে রিচার্ডের চোখে এক ধরনের পৈশাচিক তৃপ্তি ফুটে উঠল। ছুরির নিখুঁত আঁচড়ে হাঁটুর নিচ থেকে সমস্ত মাংস ছিলে নিয়েছে সে। কেবল উন্মুক্ত হাড়দুটো চকচক করছে আগুনের আলোয়। তীব্র যন্ত্রনায় শিউরে উঠলেও ইকবাল সাহেব চিৎকার করতে পারেননি! মুখে তখনও গুঁজে দেওয়া ছিল কাপড়। শরীর শুরু সাপের মতো বাঁকাচ্ছে।
‘সমুদ্র নীল চোখ ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাতেই ন্যাসো ও লুকাস সেই ভাষাহীন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল মুহূর্তেই। ন্যাসো ইকবার সাহেবের মুখ থেকে কাপড় সরাতেই লুকাস তার পেশিবহুল হাত দিয়ে লোকটার চোয়াল ছিন্নভিন্ন করে ফেলার মতো শক্ত করে ধরল। ইকবাল সাহেব তখনো বোঝার চেষ্টা করছেন এই বিভীষিকাময় মুহূর্তে আরও কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।
‘তারপর…
‘রিচার্ড ফুটন্ত পানির পাত্র থেকে এক টুকরো মাংস তুলল চপস্টিক দিয়ে। ধোঁয়া উঠছে, রসে ভেজা মাংসের টুকরোটা এখনো যেন জীবন্ত, শিরায়-শিরায় পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই সে ফুটন্ত মাংস ইকবাল সাহেবের মুখের ভেতরে গুঁজে দিল। সঙ্গে সঙ্গে দগদগে যন্ত্রনায় দেহটা খিঁচিয়ে উঠল। জিভ পুড়ে যেতে লাগল, গালের ভেতরের মাংস লাল-সাদা হয়ে ফুটতে লাগল গরমে। চিবানো দূরে থাক, ঠোঁট কাঁপছে, চোখ গড়িয়ে আসছে ফোঁটা ফোঁটা রক্তমাখা অশ্রু। ফেলাও মুশকিল! লুকাস তার মুখ চেপে রেখেছে, কোনো শব্দ বেরোনোর সুযোগ নেই।
গিলতেই হবে। ইকবাল সাহেব জানেন এই ছটফটানি, এই অগ্নিকুণ্ডের মতো জ্বালা চিরতরে শেষ করতে হলে গিলতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? সেই গরম, লালস্রোত ঝরতে থাকা নিজের গতরের মাংস কীভাবে নামবে তার খাদ্যনালী দিয়ে?তবুও, দীর্ঘতম এক যন্ত্রণার পর গিললেন তিনি। নিজের মাংস… নিজের দেহের টুকরো গিলে ফেললেন। তাকে গিলিয়েই ছাড়ল নৃশংস মানব রিচার্ড কায়নাত।
‘রিচার্ডের মুখে তখন এক পৈশাচিক হাসি। বিজয়ের হাসি। ক্ষমতার হাসি। নিষ্ঠুর আনন্দের হাসি।
“দেখেছো, মানুষ নিজেকে কত সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে?”
‘ন্যাসো আর লুকাস একসঙ্গে হেসে উঠল। জঙ্গলের নীরবতা আর কেঁপে উঠল সেই বিকট, অমানবিক হাসির প্রতিধ্বনিতে। লুকাস ছেড়ে দিল ইকবালের সাহেবের মুখ। সঙ্গে সঙ্গে গরগর করে বমি করতে থাকে ইকবাল সাহেব। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল,
“বলছি আমি, বলছি সত্যটা।”
‘পৈশাচিক উন্মাদনার শীর্ণ হাসি ফুটল কালচে অধর কোণে। ইকবাল সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই পিছন থেকে একটা গুলি এসে তার মগজ বেঁধ করে বেরুলো। সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ডলে পড়ল সে৷ শোনা গেল টায়ারের কর্কশ শব্দ। রিচার্ড বিদুৎবেগে বাইক নিয়ে ছুটে গেল গাড়ির পিছু পিছু। ন্যাসো, লুকাস আর গেল না। লুকাসের মুখটা কেমন যেন ভার। ন্যাসো তা চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল। ভুরিতে একটা নরম গুঁতো মেরে বলল,
“কি হয়েছে, লোকা?”
‘লুকাস চুপসানো গলায় বলল,”আজকে আমার মন ভালো নেই।”
“লোকার মন ভালো নেই! মানতে বলছ?”
“মজা নিও না ন্যাসো।”
“আচ্ছা। এবার বল তো কি হয়েছে?”
‘লুকাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন তার বুকে হাজার মণ ওজন চেপে আছে।
“আমি বিয়ে করতে চাই, তাও বসের আগে।”
“করো, কে আটকাচ্ছে? পাত্রী তো রেডি ই!”
“পাত্রী নিয়েই তো সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
‘লুকাস চোখ নিচে নামিয়ে বলল, “দুজনেই কালো। তাহলে বাচ্চারাও তো কালো হবে। ওদের কথা ভেবে আমি রাতে ঘুমাতে পারছি না।”
‘ন্যাসো এক মুহূর্ত চুপ থেকে চাপা হেসে বলল, “তুমি চাইলে আমি তোমাকে কিছু হোয়াইটনিং ক্রিম সাজেস্ট করতে পারি।”
“ধ্যাত! এসব কিছুতে হবে না!”
“কেন?”
“বাবা হিসেবে আমাকে আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে আগে!”
‘ন্যাসো কপাল চাপড়ে বলল, “এখনও বিয়ে করতে পারলে না, ওদিকে বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছ! আমার বউয়ের চিন্তাভাবনাও ছাড়িয়ে গিয়েছ তুমি!”
‘লুকাস কোনো জবাব দিল না। মুখ গোমড়া করে বসে রইল যেন গোটা দুনিয়ার মান-অভিমান একা সে বয়ে বেড়াচ্ছে। অমাবস্যায় আর কালরাত্রি নেমেছে। ন্যাসো ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে হুট করে লুকাসের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল,
“তোমার জন্য একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে!”
‘লুকাস ভ্রু কুঁচকে তাকাল,”কি গান?”
‘ন্যাসো গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীরভাবে শুরু করল,
“বিয়া সাদি খোদার হাতে, খোদার হুকুম লড়ে না…
খোদায় যারে কলম মারে, সে কলম আর ভাঙে না…
যার বউগা কালাাাাাাাাাাাাাাাাাাাা
কালা রে কালা, কালা রে কালা,,,,
যার বউগা কালা, তারই কপাল ভালা গো,
রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে কারোর নজর লাগে না!”
‘গান শেষ করেই ন্যাসো বিদ্যুৎ গতিতে দৌড় লাগাল! লুকাস মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে রইল। পরপরই মাটি থেকে একটা আধপোড়া কাঠ তুলে নিয়ে গর্জন করল,”ন্যাসো, দাঁড়াও। তোমার খবর আছে!” ন্যাসো হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছে, পেছনে লুকাস ধাওয়া করছে। একজনের গান, আরেকজনের রাগ আর মাঝখানে সন্ধ্যার বাতাসে ভাসতে থাকা নিখাদ দুষ্টুমির গন্ধ।
‘রিচার্ড বসে আছে সেন্ট মার্টিনের নির্জন সাদা বালির ওপর। সমুদ্রের গর্জন তার চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। এখানেই তো কিছু দিন আগে সে এলিজাবেথের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিল। তখন তাদের সন্তানও ছিল। আজ নেই। আজ কিছুই নেই। রিচার্ডের চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই মুহূর্ত—যখন সে সেই রহস্যময় আগন্তুককে ধরে ফেলার ঠিক আগে লোকটা ঠান্ডা মাথায় নিজের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনেছিল। এক সেকেন্ডও দেরি করেনি। কিসের এতো ভয় ছিল তার, যে ধরা পরার চেয়েও মৃত্যুকে সহজলভ্য করে নিল?
‘অচেতনভাবে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল রিচার্ড ফাঁপা দৃষ্টিতে। হঠাৎ পুরো দ্বীপ কেঁপে উঠল হেলিকপ্টারের গর্জনে। বাতাসে ধুলো উড়তে লাগল। রিচার্ডের চারপাশে মুহূর্তের মধ্যেই নামল কয়েকটি সিঙ্গাপুরিয়ান পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে! হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হলো তাকে। লাল ডটগুলো ওর শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। স্নাইপারদের নিশানা নিখুঁতভাবে বসেছে তার বুকে, মাথায়।
“হ্যান্ডস আপ মি. কায়নাত! ডোন্ট মুভ!”
‘এদের কথায় হাত তুলবে রিচার্ড কায়নাত? ফা’ক অফ।
রিচার্ডের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যেন তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। পুলিশরা জানে এই লোকটাই সিঙ্গাপুর হোটেল বিস্ফোরণের মূল পরিকল্পনাকারী। এটাও জানে রিচার্ড কায়নাতকে ধরা একপ্রকার অসম্ভব। তবু আজ সে কোনো প্রতিরোধ করছে না। তবে কি রিচার্ড সারেন্ড্যার করতে চাচ্ছে নাকি এটাও এক কৌশল? পুলিশের আঙুল ট্রিগারে চাপে ঠিক তখনই দুই দিক থেকে বজ্রগর্জনের মতো দুটো গাড়ি ছুটে এলো একরকম বালির ঢেউ তুলে। দ্রুতগতিতে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দুই জন।
‘ন্যাসো। লুকাস।
‘না কোনো কথা, না কোনো দেরি।সরাসরি বুলেটের ঝড় নামিয়ে দিল দুজনে। চারদিক থেকে পুলিশের চিৎকার ভেসে এলো, রক্ত ছিটকে পড়ল বালির ওপর। মাত্র বিশ সেকেন্ড। পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নিথর হয়ে পড়ে থাকল পুলিশদের মৃতদেহ। লুকাস আর ন্যাসো একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তারপর হাতে ধরা MK বন্দুক বালির ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে আগের মতোই। রিচার্ড এখনো বসে আছে সমুদ্রের ধারে! এক বিন্দু নড়েনি। আজ এই ধ্বংসযজ্ঞে তার কোনো ভূমিকা নেই।
‘ন্যাসো লুকাস রিচার্ডের পাশে গিয়ে বসতেই সে খানিকটা টলে উঠল। ন্যাসো ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“বস আপনার নেশা চড়ে গেছে?”
‘রিচার্ডের কণ্ঠ কেমন যেন শুনালো ভাঙা, ক্লান্ত। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“উমহু… মদ ছুঁয়েও দেখিনি আমি। আর কখনোই ছুঁবো না। কখনো না! এই মদের জন্যই আমার সন্তানকে হারিয়েছি আমি।”
‘ন্যাসোর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সন্দেহ হলো কিছু। হাত বাড়িয়ে রিচার্ডের কপালে ছোঁয়া লাগাতেই শরীর শিউরে উঠল তার।
“বস, আপনার শরীর তো জ্বরে পুড়ছে!”
‘রিচার্ড হঠাৎ কেঁপে উঠল! গলা ধরে এল তার,
“জানো ন্যাসো… আমি খুব ভয় পাচ্ছি।”
“কিসের ভয়?”
“তোমাদের ম্যামের সামনে যেতে ভয় পাচ্ছি। কীভাবে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো বলো? ও তো ঠিকই বলছে… আমার জন্যই আমার বাচ্চা মরে গেছে। ওর বাবা-ই ওর খুনি। খুনি… খুনি আমি। নিজের সন্তানের খুনি!”
‘ন্যাসো ছোট করে বলল,
“তবুও বস, আমার মনে হয় এই সময় আপনার ম্যামের পাশে থাকা উচিত। ম্যাম খুব কষ্ট পাচ্ছে।”
‘রিচার্ড তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“দূর! শালীরা ফ্যারফ্যার করে কাঁদতে জানে। কাঁদতে পারলে আবার কিসের কষ্ট? কষ্ট তো হচ্ছে পুরুষমানুষের, কারণ তারা কান্না করতে পারে না।”
‘ন্যাসো বলার মতো কিছুই পেল না। সত্যিই তো সবাই তো এটাই ভাবে পুরুষ মানুষ কাঁদে না মানে তাদের কষ্টও হয় না।
লুকাস কিছু বলতে চাইল,”বস, আপনি—”
‘রিচার্ড হাত তুলে থামিয়ে দিল। চোখে এক ধরনের শূন্যতা, ঠোঁটে তিক্ত হাসি।
“জানো লোকা, আমি জানি… আমি ওর সাথে যা করেছি, খারাপ করেছি। আমি তো খারাপই তাই না? ততদিন পর্যন্ত আমার ভেতর কোনো অনুশোচনা কাজ করেনি, যতদিন না আমি নিজের অনুভূতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছি।এখন মানছি, ভুল করেছি। এমনটা ঠিক হয়নি। তাই বলে কি মাফ চাইব? না! এসব চিপ জিনিস রিচার্ড কায়নাতের সাথে যায় না। তবে আমি চেয়েছিলাম ওর হারানো সবটা ওকে ফিরিয়ে দিতে, ন্যায্যতা পাইয়ে দিতে। যাতে অন্তত ঘৃণার পরিমাণটা কৃতজ্ঞতার আড়ালে একটু ঢাকা পড়ে। সেজন্যই তো আমি কঠোর ছিলাম।ওর পাশে থেকেও বুঝিয়েছি আমি নেই। কৌশলে ওকে গড়ে তুলছিলাম। তবুও এমনটা কেন হলো?
‘পাশ থেকে ন্যাসো বলল,”আড়ালে করার নাম নেই। আচ্ছা বস, আপনি কীভাবে জানলেন ম্যামের মা এখনো বেঁচে আছে? আর আপনি তো ম্যামকে বাগানবাড়িতে রেখে রাশিয়া গিয়েছিলাম মিস এলিসার খোঁজে আর লুকাসকে পাঠিয়েছিলেন ম্যামের বাবার খুনির খোঁজে। কিন্তু লুকাস কিছুই জানতে পারল না অথচ আপনি জেনে গেলেন কিভাবে? আর যদি জেনেই থাকেন তাহলে কে সে?”
‘রিচার্ড সামান্য হাসল, ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের রেখা।
“লুকাস একটু কম মাল-মসলা লাগিয়েছিল তাই জানতে পারেনি খুনি কে। মরহুম শ্বশুর বড়সড় চক্রে পড়ে গিয়েছিল। এক দেশ থেকে আরেক দেশে লাশ পাঠাবে উইদআউট এনি এক্সপ্লানেশন? আইনের লোক সব জানত কাদের হাত ছিল খুনের পেছনে। কয়েকটা মেরে দিয়েছি তারপরই মুখ খুলেছে।”
“আর মিস এলিসা যে দেশেই আছে সেটা জানলেন কিভাবে?”
“সেদিন মিস এলিসা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু পরে একটা কল আসাতে আবার নিজে থেকেই গাড়িতে উঠে গিয়েছিল। আনলাকিলি সেই রাস্তাগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। নাহয় এতদিনে কোথায় আছে সেটাও জেনে যেতাম।”
‘ন্যাসো বাঁকা হাসল, “বাহ বস! আপনি জিনিয়াস! কত আগের তথ্য কত সহজেই জোগাড় করে নিলেন, ঘাটতি ছাড়া বুদ্ধি দিয়ে!”
‘রিচার্ড হাসল। লুকাস মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“আমি ভুল না হলে নিশ্চয়ই আপনি কাউকে সন্দেহ করছেন?”
‘রিচার্ড গলা নিচু করল! চোখে শীতল ঝলক।
“সন্দেহ করে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। সেদিন সময় হবে একদম গেঁড়ে দেবো।”
‘ন্যাসো বুঝতে পারল রিচার্ডের হুঁশিয়ারির মানে। আড়চোখে চেয়ে বলল,”তাহলে এখন চুপ থাকার কারণ?”
‘রিচার্ড শান্ত গলায় বলল,
“কারণ আমার রেড। আমি চাই ওর মাকে সুস্থভাবে ওর কাছে ফিরিয়ে দিতে। সেজন্য এখন উত্তেজিত হলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় এগোতে হবে। আমার একটা ভুল পদক্ষেপ ওনার জীবন রিস্কে ফেলে দিতে পারে।”
‘ন্যাসো ঠোঁট কামড়াল,”আপনি কিন্তু চাইলে খুব সহজেই মিনিস্টারকে মেরে ফেলতে পারেন।”
‘রিচার্ড হাসল না বরং ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল,
“ওকে তো আমি জানে মারব না। ফাদারের কাছে কথা দিয়েছি আমি। রিচার্ড কায়নাত মানুষের জাতের মধ্যে না পড়লেও এক কথার মানুষ।”
‘এক মুহূর্ত থেমে, রিচার্ডের চোখে জ্বলে উঠল প্রতিশোধস্পৃহার দাবানল। দাঁত চেপে বলল,
“ওকে জানে নয়, তিলে তিলে মারব আমি।”
‘ন্যাসো বিদ্রুপ চোখে তাকাল রিচার্ডের দিকে। বলল,
“আর তার হাতিয়ার ম্যাম?”
‘রিচার্ড সহজলভ্য ভঙ্গিতে জবাব দিল,
“ও তাশের গুটি নয়। ভালোবাসা আমার।”
‘ঠোঁট কামড়ে হাসল লুকাস, ন্যাসো। রিচার্ডের বুক আবারও বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। চোখের গভীরে ভয় জড়ো হলো। ভীতিগ্রস্ত স্বরে বলল,
“সবকিছুই সুন্দর হতো, যদি জীবনে এতো তিক্ত অতীত না থাকত। আমাদের মাঝকার টানাপোড়েন হল আমাদের দগদগে অতীত। না ও আমার কাদাময় জীবনে জড়াতো, না আমি আমার লক্ষ থেকে বিচ্যুত হতাম।”
‘ওরা করুন চোখে তাকাল রিচার্ডের দিকে। জ্বরের কারণে ফর্সা অবয়ব কেমন ফ্যাঁকাসে লাগছে। রিচার্ড বালির উপর শুয়ে পড়ল। তারকাময় আকাশে চেয়ে আনমনে সুর ধরল,
“প্রেমের নামে কিনলাম আমি নিঠুর অভিশাপ,
তোর আমার প্রেমে ছিল রে বন্ধু,,,
ছিল পুরোটাই পাপ…!!
“কেমন করে সইবো আমি প্রেম আগুনের তাপ,,, তোর আমার প্রেমে ছিল রে বন্ধু ছিল পুরোটাই পাপ…!!”
‘হাসপাতালের সাদা বিছানার সঙ্গে যেন এক হয়ে গেছে এলিজাবেথের ক্লান্ত শরীর। চোখের পাতায় জমানো অশ্রু শুকিয়ে গেছে অথচ অপেক্ষা শেষ হয়নি। জানালার ওপারে আকাশ আজও নীল অথচ তার পৃথিবী রয়ে গেছে ধূসর। পনেরো দিন কেটে গেছে, দিন গড়িয়ে রাত আসে, তবু রিচার্ড আসে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে আপন মনে কিছু লাইন ফিসফিস করে আওড়ে যায়, হয়তো প্রার্থনা, হয়তো অভিমান। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা তাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। কখনো হুট করে বাচ্চার কথা মনে পড়লে বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে,কান্নায় ভেঙে পড়ে । তাকবীর বারবার ওকে সামলাতে আসে, প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। শেষে ডাক্তারদের সাহায্য নিতে হয়েছে। এলিজাবেথ তাকে শতবার নিষেধ করেছে আসতে তবু তাকবীর ফিরে যায়নি। কিছু সম্পর্ক দায়িত্বের ভারে বাঁধা পড়ে যায় কিছু ভালোবাসা কোনো নিষেধ মানে না।
“আপনার চোখে স্বচ্ছ পানির মতো ভালোবাসা থাকলেও, আমাকে দেওয়া সকল কষ্ট, সকল ক্ষত—আপনারই।”
‘অভিমানের ভারে মন একলা একলাই এই কথাগুলো আওড়ায়।যেন কোনো অব্যক্ত সত্য আবারও প্রতিধ্বনিত হয় নিজের ভেতরেই। চোখের পানি এই কদিনে শুকিয়ে গেছে অথচ বুকের ভেতরের ঝড় থামেনি। এলিজাবেথ ফোনটা আবারও হাতে নেয়।অশ্রুহীন দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওপাশ থেকে আজও কোনো রিপ্লাই আসেনি।
ধীরে ধীরে ঠোঁট ফেটে আসে, গলা শুকিয়ে যায়, হৃদস্পন্দন হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক গতি। এ যেন এক নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষার অবসান আসন্ন, কিংবা কোনো ভালোবাসার শেষ অধ্যায় লেখা হচ্ছে নীরবে, নিঃশব্দে।
“এমন মানুষের জন্য অপেক্ষা করে কী লাভ, যে তোমাকে ভালোই বাসে না? ভালোবাসলে কষ্ট দেওয়া যায় না।”
‘তাকবীর এসেছে। এলিজাবেথ পিছন ফিরল না। একইভাবে স্থির থেকে নিঃস্পৃহ স্বরে বলল,
“তার চোখে ছিল তো ভালোবাসা!”
‘তাকবীর এক মুহূর্ত চুপ থেকে উত্তর দিল, “আর মনে?”
“ছিল হয়তো!”
“হয়তো?”
‘এলিজাবেথ উপহাসভরা হাসিতে ফেটে পড়ল, “হয়তো!” পরক্ষণেই সেই হাসি শব্দে রূপ নিল। হেসে হেসেই সুর তুলে গুনগুন করল,
“বাসলে ভালো কেউ কি এমন পাষাণ হয়ে যায়,
যে নিজের সুখে মনের মানুষটাকেই মেরে যায়।
হায়রে বোকা মন আমার,শুনলি না বারণ!”
‘তাকবীর শক্ত ঢোক গিলে এলিজাবেথের পাশে বসে বলল,
“রিচার্ড বাংলাদেশেই আছে, আমি খোঁজ নিয়েছি।”
‘এলিজাবেথ চকিতে তাকাল তার দিকে। চোখে একরাশ আশা জ্বলে উঠল। অস্থির হয়ে উঠে বলল,
“তাহলে নিশ্চয়ই আজ আমার সাথে দেখা করতে আসবে, তাই না? আচ্ছা আমার জামা কোথায়? আমি শাওয়ার নিয়ে আসি, গা থেকে বাজে গন্ধ আসছে। আপনি সবাইকে বলে দেবেন, উনি এলে কেবিনের আশেপাশে কেউ যেন না থাকে। আমার বোঝাপড়া আছে লোকটার সাথে।”
‘তাকবীর গভীর নিশ্বাস ফেলল। তারপর ধীরে বলল,
“রিচার্ড সাতদিন ধরে বাংলাদেশে আছে।”
‘এলিজাবেথ থমকে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জোরপূর্বক হেসে বলল,
“হয়তো ব্যস্ত ছিল… আজকে নিশ্চয়ই আসবে।”
‘তাকবীর মাথা নাড়ল, “আসবে না।”
‘এলিজাবেথের গলা কেঁপে উঠে, “মানে?”
“রিচার্ড সেন্টমার্টিনে আছে ওর কাজে।”
‘এক মুহূর্ত আগেও চোখেমুখে যে উজ্জ্বলতা ছিল, তা নিমেষেই নিভে গেল। নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
“আসবে না সে?”
‘তাকবীর তাকিয়ে রইল ওর ক্লান্ত, নিরাশ চোখের দিকে। শান্ত গলায় বলল,
“আসার হলে কবেই আসত এলোকেশী।”
‘তাকবীর চুপ রইল। বাতাসের শব্দের চেয়েও ভারী ছিল নীরবতা। এলিজাবেথ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওর কাঁপতে থাকা কাঁধ, শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাত—সবটাই বলে দিচ্ছে যে ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
“আমি আর কাঁদব না আর অপেক্ষা করব না আমার সন্তানের খুনির জন্য।”
‘তাকবীর গভীর নিশ্বাস ফেলল। ধীরে বলল,
“এলোকেশী, রিচার্ড ওদের সকলকেই মেরে ফেলেছে। বাবারা কখনো সন্তানের খুনি হয় না।”
‘এলিজাবেথ এবার ঘুরে তাকাল। ওর চোখের আগুনে তাকবীর নিজেও একটু পিছিয়ে গেল।
“হ্যাঁ উনি খুনি। আমার সন্তান আজ দুনিয়ায় নেই তার জন্য। তার পাপের জন্য। আমার ভালোবাসা, আমার অপেক্ষা সবকিছু উনি গলা টিপে খুন করেছে। আমিও মানুষ। আমার ধৈর্য, ক্ষমতা, সহ্য করার একটা সীমা আছে। সেটা আপনারা ভুলে যাবেন না। আমি আর তার জন্য অপেক্ষা করব না। সে তার মতো থাকুক, থাকুক সারাজীবন ঘৃণিত হয়ে।”
“অপেক্ষা সেখানে মানায়, যেখানে প্রতিশ্রুতি থাকে। প্রতিশ্রুতি ছাড়া অপেক্ষা করা মানে শুধু নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া।”
‘তাকবীর গভীর আন্তরিক স্বরে বলল। এলিজাবেথের কান্না বেসামাল হতে থাকে। ঠুকরে উঠল। তাকবীর নিরেট ঠান্ডা গলায় বলল,
“হতে পারে তোমার আমার প্রতি কোনো অনুভূতি নেই। এটা স্বচ্ছ, নেই। কখনো ছিল না, কখনো হবেও না। কিন্তু আমি যে তোমার প্রেমে প্রতিনিয়ত ডুবে যাচ্ছি, সেটার কি কোনো মূল্য নেই?”
“কাউকে এতটা ভালোবাসবেন যে একটা সময় নিজের উপরই ঘৃণা এসে যায়।”
“তাকবীর ব্যথিত গলায় বলল, “সেই ঘৃণার তোড়েও যদি নিজের খুনি নিজেই হই, তবুও বলব—ভালোবাসি।”
‘এলিজাবেথ চুপ করে রইল। তাকবীর আবার অনুনয়ের সুরে বলল, “একবার তাকাও ভালোবাসার চোখে, দেখো না, কিছুই কি দেখতে পাও না এই তৃষিত চোখদুটোতে? চার বছরে চৌদ্দ হাজার ছয়শ পঁয়ষট্টি বার তোমার নামে ভালোবাসা শব্দ উচ্চারণ করেছি। প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে ভেবেছি, অনুভব করেছি। তবুও তোমার হৃদয়ে আমার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র প্রতিধ্বনি নেই? ভালোবাসো না জেনেও ছয়শো একানব্বই বার ‘ভালোবাসি’ বলেছি তোমাকে। একটুও কি মনে লাগেনি তোমার?”
‘এলিজাবেথ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,”আপনার এই অনুভূতিগুলো আমায় কষ্ট দিচ্ছে! অনুভব করাচ্ছে আমিও তো কাউকে সেভাবেই ভালোবেসেছি.. তবু সে এল না কেন? তার জন্যই তো ছিল আমার সমস্ত আয়োজন! সে বলেছিল, লাল শাড়িতে আমাকে মোড়াবে। অথচ দেখুন, আজ সাদা কাপড়ের সাথে মিশে যাচ্ছি আমি। ভালোবাসার বেলায় পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন?”
‘হঠাৎই তাকবীর ঝাঁপটে ধরল এলিজাবেথের হাত, কাতর কণ্ঠে বলল,”ও এলোকেশী, আমাদের মাঝে কেন অন্য কেউ আসছে? একবার আমার দিকে তাকাও, দেখো! আমার মতো করে আর কে ভালোবাসবে তোমায়?”
এলিজাবেথ ছাড়িয়ে নিল ওর হাত “চাই না আমি আর কারো ভালোবাসা।”
‘তাকবীরের কণ্ঠ কাঁপল। জোর গলায় ই বলল,
“ভালোবাসি আমি তোমাকে, কেন বুঝো না?”
‘এলিজাবেথ নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল তাকবীরের চোখে। গভীর হতাশায় বলল, “কিন্তু আমি বাসি না। কেন আপনি বুঝতে পারছেন না? বিরক্ত লাগছে এসব পাগলামি, জাস্ট বিরক্ত।”
‘বলে ধাক্কায় ঝটকা মেরে দূরে সরিয়ে দিল তাকবীর কে। তাকবীর হতভম্ব হয়ে রইল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে এলিজাবেথের মুখের দিকে। বুকের ভেতর কী যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার শব্দ হলো।যেন সমস্ত স্বপ্ন এক মুহূর্তে ধুলোয় মিশে গেল। সময় থমকে রইল কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তাকবীর। কাঠের পুতুলের মতো অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।ঠিক তখনই পিছন থেকে এলিজাবেথের কণ্ঠ ভেসে এল,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৮
“বিয়ে করবেন আমায়?”
‘তাকবীর থমকে গেল। পায়ের নিচের জমিন যেন সরে গেল এক নিমেষে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তারপর ধপ করে বসে পড়ল ফ্লোরে। তার চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল অশ্রুসিক্ত আলোয়।