ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫১

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫১
মিথুবুড়ি

‘চেতনা ফিরতেই নিজেকে শক্ত করে বাঁধা চেয়ারে আবিষ্কার করল এলিজাবেথ। বুকের নিচ থেকে হাঁটু পর্যন্ত সাদা তোয়ালে জড়ানো। বাকিটুকু উন্মুক্ত। যেখানে উদীয়মান বেল্টের আঘাতে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। শরীর জুড়ে জ্বালা করছে, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। আবছা দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল এটা একটা স্টোররুম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কারণ ঠোঁটের উপর শক্ত করে সিল দেওয়া ট্যাপ।

‘হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ। রিচার্ড এসেছে। তাকে দেখামাত্রই গত রাতের দৃশ্য বিদ্যুৎচমকের মতো মনের পর্দায় ফুটে উঠল। এলিজাবেথ রাগে, ঘৃণায় রিচার্ডের মুখের উপর স্পষ্ট বলে দিয়েছিল—সে তাকবীরকে ভালোবাসে। সেই কথা শোনামাত্র রিচার্ডের চোখে নেমে এসেছিল এক অন্ধকার ঝড়। নিজের সংযমের শেষ সীমাটুকু হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার উপর। তারপর যখন সেই নরপশু শান্ত হলো, তখন রক্তাক্ত এলিজাবেথকে দেখে শিউরে উঠেছিল নিজেই। কাঁপা কাঁপা হাতে তাকে ছুঁয়ে নিজেকে বলেছিল অপরাধী, সাইকো, নরঘাতক! তাই তো মুক্ত করে দিয়েছিল ওকে। তবে এলিজাবেথ পারেনি মুক্ত হতে। হয়তো এটাই নিয়তির এক অনিবার্য বন্ধন, যেখান থেকে পালানো অসম্ভব।
‘রিচার্ড এসে দাঁড়াল এলিজাবেথের সামনে। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে। রিচার্ড নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আলতো করে আঙুলের ডগায় তুলে নিল সেই অশ্রুজল। ছুঁইয়ে দিল নিজের ঠোঁটে। কেঁপে উঠল এলিজাবেথ স্পর্শে। এলিজাবেথ ধীরে মাথা তুলে তাকাল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ডের মুখে আজ এক অদ্ভুত স্থবিরতা। যেন এক চাপা বেদনায় ঢেকে গেছে সব। পকেট থেকে মলম বের করল সে, নরম হাতে লাগিয়ে দিল দগদগে ক্ষতের ওপর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘হঠাৎ, কোনো পূর্বসংকেত ছাড়াই মুখের ট্যাপ খুলে দিয়ে এলিজাবেথের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রিচার্ড বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত অবস্থায়। দুই হাতে ওর পা তুলে নিয়ে অসীম যত্নে পায়ের তালুতে মলম ঘষতে থাকল। যেন এই স্পর্শের মাঝেই ওর সমস্ত অপরাধের ক্ষমা লুকিয়ে আছে। এলিজাবেথ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল।
“তবে কি আমি অন্ধ ছিলাম এতোদিন?”
‘রিচার্ড ধীরে মাথা তুলল! চোখে চোখ রাখল ওর। এলিজাবেথ এক মুহূর্তের নিঃশব্দ বিসর্জনের পর চাপা কণ্ঠে বলল,
“ভালোবাসলে তো এভাবে কষ্ট দেওয়া যায় না…”
‘রিচার্ড কোনো জবাব দিল না। এলিজাবেথের গলা কাঁপছিল। তবুও শব্দগুলো তার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়ছে,
“আমি যখনই আপনাকে ভালোবাসতে চাই, তখনই আপনি ঘৃণায় পরিণত হন কেন? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। বলুন না, কেন আমাকে সবসময় দোটানায় ফেলে দেন?”
‘রিচার্ড নিস্পৃহ কণ্ঠে, একদম পাথরের মতো শীতল স্বরে বলল, “অতিরিক্ত ঘৃণা জমলে মন পাথর হয়ে যায়, তাই।”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নিভৃত স্বরে বলল,”তাহলে তো আপনার ক্ষেত্রেও একদিন আমার মন পাথর হয়ে যাবে, তখন?”
‘রিচার্ড সামান্য হেসে বলল, “হোক। তো তুমি শক্ত হও। তোমার মন খুব নরম। বেশি নরম হলে মানুষ সহজেই ভেঙে দিতে পারে।”

‘এলিজাবেথের চোখে একরাশ অভিমান জমে উঠল,
“আমাকে ভাঙার কারিগর তো আপনিই।”
‘কোনো জবাব না দিয়ে রিচার্ড ওর পায়ের কাছে বসে পড়ল। একহাতে আলতোভাবে উরুর উপর রাখল ওর পা। কিন্তু স্পর্শের মধ্যে কোনো জোর ছিল না, ছিল শুধু স্থিরতা। নিঃশ্বাস চেপে বলে, “উমহু। গড়ার কারিগর। এক মুদ্রার যেমন দুই পিঠ থাকে, তেমনি আমার কাজেরও দুই দিক আছে। নিজেকে দেখো কোনো পরিবর্তন টের পাচ্ছো? তুমি আজ কান্না করছ না। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলাচ্ছো, আমার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলছো।”
“পরে তো একদিন আপনিও আফসোস করবেন, কেন আমাকে এত শক্ত বানালেন।”
“আমি আফসোস করি না।”
“করবেন।”
“ভুল ধারণা।”

‘এলিজাবেথ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আমার সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ যদি আমি নেই?”
‘রিচার্ড হাসল সেই ঠান্ডা, নিঃসঙ্গ হাসি,”সেটাই তো চাই।”
“সবচেয়ে বেশি অন্যায় তো আপনিই করেছেন।”
‘রিচার্ড এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর খুব ধীর স্বরে বলতে যাচ্ছিল, “তোমার যা শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে, দাও। তবুও…”
‘কথাটা শেষ হওয়ার আগেই এলিজাবেথ বলল, “তাহলে আমাকে যেতে দিন।”
‘রিচার্ড কিছুক্ষণ চুপ। আজ তার কণ্ঠে সেই চিরচেনা কঠোরতা নেই। কেমন যেন এক অদ্ভুত, লুকানো অনুশোচনা মিশে আছে। গভীর, ভারী স্বরে বলল,
“এত বড় শাস্তি আমি নিতে পারব না।”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট কামড়ে চোখ বুজল। মুক্তির কথা বলা যতটা সহজ, পাওয়া ততটাই অসম্ভব এটা সে বুঝে গিয়েছে। রিচার্ড ধীরস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। একে একে খুলে দিল এলিজাবেথের হাত-পায়ের বাঁধন, সরিয়ে দিল মুখের ট্যাপ। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“জানতে চাও সেই পরিত্যক্ত অতীত, যা কেউ জানে না?”
‘এলিজাবেথ নীরবে চেয়ে রইল ওর চোখে। এক মুহূর্ত পেরিয়ে বলল,”হ্যাঁ।”
‘রিচার্ড ধীরে হাঁটু গেঁড়ে বসে এলিজাবেথের সামনে। তার ঠান্ডা অথচ বিস্ময়কর কোমলতায় তুলে নিল ওর হাত। নিজের গালে ছুঁইয়ে দিয়ে বিবর্ণ স্বরে বলল,
“এখানে দাগটা দেখতে পাচ্ছো? এটা আমার প্রথম খুনের সাক্ষী।”
‘এলিজাবেথের তাকাল সে দগদগে ক্ষতে,”কে ছিল?
‘রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে এক নিষ্ঠুর হাসির ছায়া খেলে গেল।
“আমার মা… না, সরি। সেই নিকৃষ্ট মহিলার পরকীয়া প্রেমিক।”
‘ফ্যালফ্যাল করে তাকাল এলিজাবেথ রিচার্ডের দিকে। বুকের ভিতর যেন মোচড় খেল। রিচার্ড উঠে দাঁড়ায়। অভিব্যক্তি পাথরের ন্যায়৷

“His past was just like the lyrics of this song….
I was Broken from
A young Age
Taking my Sulking
To the Masses
Writing my Poems
For the Few That
look at me, Took to me,
Shook to me,
Feeling me Singing from the Pain
Taking my Message From
the Veins Speaking
my Lesson From the Brain
Seeing the Beauty Through the…
Pain!
You made me a
You Made me a Believer
Believer

‘অভাব মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। রিচার্ডের পরিবারও সেই কঠিন বাস্তবতার শিকার। তার বাবা মি. রেয়ান পক্ষাঘাতে স্থবির হয়ে পড়ার পর সংসারের ভার যেন থমকে যায়। অন্নসংস্থানের পথ সংকীর্ণ হয়ে আসে, জীবন থেকে রঙ মুছে যেতে থাকে। দু’বেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না অথচ অসুস্থ বাবার জন্য প্রয়োজন দামি ওষুধ। অবশেষে সংসারের দায় কাঁধে তুলে নিতে রিচার্ডের মা আয়েশা বেলি গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। স্বভাবগত সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব তাকে আলাদা করে তোলে।আর তা চোখ এড়ায় না এক বিদেশি বায়ারের। পুরুষের মন বড় সহজেই দুর্বল হয় এমন সৌন্দর্যের কাছে। বিশেষত যখন স্বামী অসুস্থ, সংসার টালমাটাল তখন তো সুযোগ হাতছাড়া করাই বোকামি।

‘প্রথমে নিছক সৌজন্য তারপর প্রশংসা, একসময় বাড়তি সুবিধা। এভাবেই ফাঁদ বিছাতে থাকে বায়ার। আয়েশার বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়, দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা, ছোট ছোট অনুকম্পার আড়ালে ক্রমশ কুয়াশার মতো ঘনিয়ে আসে প্রলোভনের জাল। শেষমেশ আয়েশা হারিয়ে যায় সেই মোহে।ভুলে যায় অসুস্থ স্বামীকে, অবহেলায় ফেলে রাখে ছোট্ট রিচার্ডকে। সংসারের দায়িত্ব, মায়ের স্নেহ সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে আসে নতুন এক নিষিদ্ধ সম্পর্কের ছায়ায়।
‘বাসায় খাবার থাকত কিন্তু ছোট্ট রিচার্ডের পেটে তা জুটত না। কারণ সে নিজের হাতে খেতে পারত না। তার মা এখন বদলে গিয়েছেন৷ আগের মতো আর সময় দেন না, বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়ান না। রাত করে ফেরেন, কখনো কখনো ফেরেনই না। শিশুসুলভ কান্না, অভিমানের চাপা দীর্ঘশ্বাস কিছুই স্পর্শ করত না তাকে। অযত্ন আর উপেক্ষার মধ্যে ধীরে ধীরে রিচার্ড শিখে নেয় একা বাঁচতে। নিজেই নিজের খাবার জোগাড় করে, বাবার সেবা করতে শেখে। অথচ পক্ষাঘাতে নিস্তেজ রেয়ান সাহেব শুধু চুপচাপ চোখের জল ফেলত। স্ত্রীর এই বদলে যাওয়া তার চোখে ধরা পড়েছে অনেক আগেই স্ত্রী যে তার পরকীয়ার মতো ভয়ংকর রোগে আসক্ত হয়েছে কিন্তু করার মতো কিছুই নেই। নিজের অসহায় শরীরের মতোই তাকেও মেনে নিতে হয় নিঃশব্দ এক পরাজয়।

‘বেলির লোভই একদিন তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। প্রেমিকের সঙ্গে বারবার গোপন অভিসার, নতুন পোশাক, দামি ব্যাগ, ঝলমলে গয়নার মোহে সে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকেই। কিন্তু এক রাতে এক রিসোর্টে নিয়ে গিয়ে সেই প্রেমিকই তাকে ছলনার ফাঁদে ফেলে। সেদিন সে কেবল এক ব্যক্তির নয় বরং হিংস্র কয়েকজনের লালসার শিকার হয়েছিল। শারীরিক সুখের মোহে যে খেলায় নেমেছিল সেদিন সেই খেলাই তার সর্বনাশের কারণ হয়। বাড়িতে ফেরা হয়নি টানা সাতদিন। রিচার্ড অপেক্ষার প্রহর গুনেতে থাকে দরজার সামনে বসে।তার অসুস্থ বাবা দুশ্চিন্তায় আরও কঙ্কালসার হয়ে পড়েছে। খাবার ফুরিয়েছে, বিদ্যুৎ চলে গেছে, অন্ধকারের সঙ্গী হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছে তারা। তবু মা ফিরে আসেনি। ফিরেনি স্বার্থপর বেলি।

‘দিনের আলো ফুরিয়ে চাঁদের আলো জ্বলে উঠে। তবে ক্ষুধা কি আর অপেক্ষা করে? উপায়ন্তর না পেয়ে প্রচন্ড ক্ষিধায় রিচার্ড ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেয়েছে। তবে বাবার মুখে তো তা তুলে দেওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে সে ক্লাসের এক সহপাঠীর ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করতে যায়। সেখানেও ধরা পড়ে যায়। সবার সামনে হেডস্যার তার কান ধরে ওঠবস করায়। পরবর্তীতে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়। সেই দিনই চুরমার হয়ে যায় রিচার্ডের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন।তবু তো বাঁচতে হবে! বাবাকে বাঁচাতে হবে! এবার সে চুরি করতে যায় রুটির দোকানে। কিন্তু সেখানেও ধরা পড়ে। দোকানদার রাগে উন্মত্ত হয়ে তার কোমর গরম তাওয়ার ওপর চেপে ধরে রাখে। চামড়া পুড়ে যায়, ব্যথায় দেহটা কেঁপে ওঠে কিন্তু আর্তনাদ শোনার কেউ ছিল না। সেদিনই রিচার্ডের শরীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠে। প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে একা শুয়ে ছিল, যত্ন করার কেউ ছিল না, সান্ত্বনা দেওয়ারও কেউ ছিল না। এভাবেই দিন যাচ্ছিল অযত্নে, অবহেলায়।
‘অনেকদিন পর বেলি ফিরে এল। তবে সে আর আগের বেলি ছিল না। এই নারী রিচার্ডের মা নয়, রেয়ানের স্ত্রীও নয় যাকে তিনি ভালোবেসে ঘরে তুলেছিলেন। এই বেলি ছিল এক নিষ্ঠুর, লোভী দানবী, যে নিজের ধর্ষকদের সাথেই ব্যবসা শুরু করল। রেয়ানের সেই ছোট্ট কুটির একদিন হয়ে গেল এক পতিতালয়। বিদেশি কাস্টমার আনত তার সেই প্রেমিক আর বেলি টাকার মোহে সবকিছু বিসর্জন দিল। যে টাকায় একদিন সংসার চলত, সেই টাকাই এখন ভাসিয়ে নিচ্ছে তার মানবিকতাকে। দিনশেষে সেই টাকা দিয়েই তারা দু’জন আনন্দে মেতে উঠত আর কুটির ভেসে যেত কলঙ্কের আঁধারে।

‘চোখের সামনেই সব ঘটছিল তবুও ছোট্ট রিচার্ড কিছুই বুঝতে পারত না। শুধু ক্ষুধার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত।হয়তো আশা করত একটুখানি স্নেহের। কিন্তু বেলি তাকিয়েও দেখত না, দেখলেও বুঝতে চাইত না। যেন সেই ক্ষুধার্ত, অবহেলিত শিশুটির অস্তিত্বই তার কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছে। রিচার্ড অসহায়ের মতো দেখত কিভাবে তার মা অন্য পুরুষদের স্পর্শ সয়ে নেয়। তার ক্ষুদ্র হৃদয় তা মেনে নিতে পারত না। চিৎকার করত, কান্নায় গলা ফেটে যেত, তবুও তাকে একা বন্দি করে রাখা হতো অন্ধকার এক ঘরে। দরজায় অনবরত ধাক্কিয়ে গলা শুকিয়ে যেত কিন্তু কারও হৃদয় গলত না। একদিন রাগে, ক্ষোভে সে এক পুরুষের মাথায় ফুলদানি ছুড়ে মেরেছিল শুধু মাকে ছোঁয়ার অপরাধে। কিন্তু শাস্তি হয়েছিল ভয়ংকর। সেদিনও তাকে আঁটকে রাখা হয় সেই অভিশপ্ত ঘরে। আর সেখানে যা ঘটেছিল তা কোনো শিশুর ভাগ্যে থাকা উচিত ছিল না। পরদিন প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপতে থাকে রিচার্ড।

‘বেলি কিছুটা আন্দাজ করেছিল। সন্দেহের বশে এই নিয়ে প্রেমিকের সাথে ঝগড়াও করেছিল। লোভে অন্ধ হলেও তার ভেতরে তখনো কিছুটা মাতৃত্ব টিকে ছিল। কিন্তু সেই লোকটি সেটা বুঝতে পেরে জ্বলে উঠল। সেই রাগ গিয়ে পড়ল রিচার্ডের ওপর। এবার অত্যাচারের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। যখন বেলি ঘরের ভেতর অন্য পুরুষদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকত তখন তার ছেলেও হয়ে উঠত এক নিষ্ঠুর নরকের শিকার। একটা অবুঝ, নিরপরাধ শিশু যে বুঝতেও পারত না কেন তার ভাগ্যে এ যন্ত্রণা লেখা হলো। কেন তাকে এভাবে যৌন,,,,,,

এভাবেই অভিমানে একদিন মায়ের কাছে যাওয়া ছেড়ে দিল রিচার্ড। মানিয়ে নিতে থাকল সেই পরিস্থিতিতে।
‘তবুও তো সে বেঁচে ছিল। তবে তার কোমল আত্মার মৃত্যু ঘটেছিল সেদিন। যেদিন দরজার আড়াল থেকে ছোট্ট রিচার্ড দেখেছিল তার মা,যার হাতে সে একসময় ঘুমিয়ে পড়ত,সে-ই এখন বাবার বুকে বসে কুড়াল চালাচ্ছে। কটকট শব্দে হাড় ভাঙছে, মাংস ছিঁড়ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে কাঠের মেঝে। রিচার্ড নড়ল না। এতো রক্ত দেখে ভয়ে সে এগোল না। শুধু তাকিয়ে রইল শূন্য চোখে। তারপর ভেসে এলো একটা মৃদু, কাতর কান্না। সে চমকে ঘুরে দাঁড়ায়। তার ছোট বোন! যাকে ক’দিন আগেই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল সে পড়ে আছে রান্নাঘরের মেঝেতে। তার ছোট্ট শরীরের নিচে জমাট বাঁধছে উষ্ণ, কালচে রক্ত। রিচার্ডের পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল। সে চিৎকার করতে পারল না, কাঁদতেও না। শুধু এক দণ্ড দাঁড়িয়ে রইল নিস্তব্ধ এক শোকস্তব্ধ প্রতিমার মতো। হঠাৎ টের পেল কেউ ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বাইরে। সে মুখ তুলে তাকাল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার মা। রক্তমাখা কুড়াল তার হাতে।মুখে এক অচেনা, বিভৎস ছায়া। রিচার্ডের গলা থেকে সেদিন শুধু একটি মাত্র যে শব্দ বের হয়েছিল,

“তুমি না মা?”
‘মানুষের বিবেক যখন মরে যায় তখন সে কেবল একখণ্ড মাংসপিণ্ড হয়ে বেঁচে থাকে নির্বিকার, নিষ্ঠুর। বেলিও একদিন ভালোবাসতে জানত তবু লোভের অন্ধকারে সে নিজের আত্মাটাই হারিয়ে ফেলল। তার চাওয়া ছিল ক্ষমতা, প্রাচুর্য। আর সেই পথ দেখাল তার পরকীয়া প্রেমিক লেহিয়ান।রেয়ান সাহেবের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে তারা পরিকল্পনা করল। কাপড়ের ব্যবসার আড়ালে গড়ে তুলবে নারীমাংসের হাট। বাঁধা শুধু রিচার্ড আর তার বাবা। কিন্তু বেলি তো আর পুরোনো প্রেমের মায়ায় আবদ্ধ নেই। একরাতের ভালোবাসা দিয়ে কি জীবনের লোভ পূরণ হয়? তাই এক রাতে গভীর অন্ধকারে বেলি হাতে তুলে নিল কুড়াল। যে বুক একদিন তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ছিল সেখানেই সে বসিয়ে দিল নৃশংস আঘাত।

‘রিচার্ড তখন অনেক দূরে, একা। মা-বাবা থাকতে সে এতিম হয়ে গেছে বহু আগেই। নিজের খাবার নিজেকেই জোগাড় করতে হয়। বাবার মুখে তুলে দিতে হতো একমুঠো ভাত। আর সেই পথেই একদিন এক ঝড়জলের রাতে, সে দেখল একরত্তি মেয়ে ফুটপাতে কাঁপছে। তার ক্ষীণ দেহ, শূন্য চোখ রিচার্ডের হৃদয়ের কোথায় যেন একটা শূন্যতা তৈরি করল। সে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এল নিজের ছোট্ট দুনিয়ায়।এতে অবশ্য তেমন সমস্যা হয়নি। মেয়েটাও এতিম রাস্তায় থাকত। রিচার্ড একটা সঙ্গী পেল, মেয়েটাও একটু আশ্রয় পেল। তার পরিবার বলতে তখন ছিল তিনজন৷ সে তার ছোট বোন আর তার অসুস্থ বাবা। কিন্তু এই নিষ্পাপ আশ্রয়ে নজর পড়ল নরপিশাচদের।বেলি মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দিতে চাইলে বহুদিন পর রিচার্ড মায়ের কাছে গিয়েছিল। বেলির পায়ে মাথা রেখেছিল, কেঁদেছিল। সেদিন বেলি হয়তো খানিকটা গলে গিয়েছিল কিন্তু তার প্রেমিকের বরফ-হৃদয়ে ফাটল ধরেনি। বরং সুযোগ পেলেই সে আদরের নাম করে শিশুটার কোমল শরীরে তার নোংরা হাত রাখত।

‘রিচার্ডের ভিতরটা ধ্বংস হয়ে যেতে চাইত এসব দেখে। তাই সে বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকত আর বোনকে বাবার পাশে বসিয়ে যেত। সে ভাবত বাবার সাথে থাকলে অন্তত বোনটাকে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু সে জানত না জানোয়ারেরা যখন মানুষ সেজে বসে থাকে তখন তাদের নখর সবচেয়ে ধারালো হয়। তার অসহায় বাবা চোখের সামনে দেখেছে কীভাবে জানোয়ারগুলো বাচ্চা মেয়েটাকে স্পর্শ করেছে তবু কিছু বলতে পারেনি। পঙ্গু শরীর, অথর্ব আত্মা৷ সে কেবল শূন্য চোখে চেয়ে থেকেছে, আর মেয়েটা চুপচাপ সহ্য করে গেছে। কারণ সে শিখে গেছে চিৎকার করেও লাভ নেই। আর রিচার্ড? সে জানতই না তার অস্তিত্বের সবচেয়ে কোমল অংশটা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একদিন যখন সত্যিটা জানবে, তখন হয়তো তার বুকের ভেতর যে মানুষটা বাস করে সে-ও মরে যাবে। তখন আর সে মানুষ থাকবে না—হয় সে পিশাচ হবে, নয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে এক কঠিন প্রতিশোধের আগুনে।

‘বেলি প্রথমে মারতে চায়নি রেয়ান সাহেবকে। তার পাপাচারী প্রেমিক আর সেই শয়তানের দল তাকে এমন এক ফাঁদে ফেলেছিল যেখানে বিকল্প বলতে কিছুই ছিল না। তারা তার বিবেককে এতটাই অন্ধ করে দিয়েছিল যে সে ভুলে গিয়েছিল কে বন্ধু, কে শত্রু। কেবল একটাই কথা তার মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছিল স্বামীকে মারতে পারলেই রিচার্ড বাঁচবে। রিচার্ড তখন বাইরে খাবারের সন্ধানে। তার ছোট্ট বোনের আবদার ছিল একটুকরো কেক। কিন্তু যখন রিচার্ড কেক হাতে হাসিমুখে বাসাশ ফিরল তখন তার চোখে আনন্দের আলো নয় বরং এক বিভীষিকার ছায়া। রক্তমাখা ঘর, নিথর পড়ে থাকা বাবার দেহ, আর কাঁপতে থাকা তার মা সবকিছু মিলিয়ে এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বেলিকে ওরা শিখিয়েছিল স্বামীর মৃত্যু মানেই ছেলের জীবন। অথচ সেদিনও ওরা প্রতারণা করল। রিচার্ডকে ছাড়বে বলেছিল কিন্তু তাকে তারা ইতালির অন্ধকার জগতে বিক্রি করে দিল। বেলির পৃথিবী তখন পুরোপুরি ভেঙে গেল। স্বামীকে তো এমনিতেই হারিয়েছে এখন ছেলেকেও হারাল। শূন্য হাতে বসে রইল সে কর্মফলের এক নির্মম শাস্তি নিয়ে।

‘কিন্তু ভাগ্য রিচার্ডের গল্পটা অন্যভাবে লিখেছিল। তার ভাগ্য তাকে ছুঁড়ে ফেলেছিল ইতালির মাফিয়া বস (ফাদারের) কাছে। তার হওয়ার কথা ছিল দাস, সে হয়ে উঠল রাজা। কারণ তার ভিতরে ছিল দুঃসাহস, এক অসীম জেদ, যা তাকে ধ্বংসের বদলে নতুন এক পরিণতির দিকে টেনে নিল।রিচার্ডকে যখন অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল তখন তার নীল চোখে দাউ দাউ আগুন। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেই লোকটার দিকে—যে তার মা’কে অচেনা করে ফেলেছিল, যে তার পরিবার ধ্বংসের কারিগর, যে তাকে লাঞ্ছিত করেছে, যে জানোয়ার তার পাঁচ বছরের ছোট বোনকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে।

‘রিচার্ড শান্ত দৃষ্টিতে আশপাশ তাকিয়ে দেখল। এক গার্ডের কোমরে ঝুলে থাকা ছুরিটা তার চোখে পড়ল। পর মুহূর্তেই ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। আট বছরের শিশুটিকে সেদিন কেউ থামাতে পারেনি। উন্মত্ত রিচার্ড একের পর এক আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিল সেই জানোয়ারকে।সেই রক্তাক্ত মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল তার গালে লেগে থাকা ছুরির ক্ষতচিহ্ন। প্রথম খুনের স্মৃতি হয়ে সেই দাগ আজও তার সঙ্গে বয়ে চলেছে। ফাদার সেদিন নিরবে দেখেছিল রিচার্ডের চোখের আগুন। সে আগুন যে কোনো অগ্নিসম্ভাবনার মতো ছিল। জ্বলন্ত, ক্ষুদ্র অথচ ভয়ংকর। যেখানে সকল বাচ্চারা ভয়ে কাঁপছে, সেখানে সে বর্বর হত্যাকাণ্ডে মেতেছে। সেদিনই ফাদার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রিচার্ডকে তার রাজ্যের রাজা বানাবে। তবে রাজা হতে হলে তেজ এবং যোগ্যতা প্রয়োজন। তা রিচার্ডের মাঝে ছিল যতটা অগোচরে, ততটাই ভয়ঙ্কর। তবে কোনো সাধারন রাজা নয়, তাকে তৈরি করতে হবে এক নৃশংস জানোয়ার, এক নিঃসঙ্গ শিকারি। যে জীবিত থাকতে চায় শুধু নিজের জন্য আর মৃত্যু হবে তার জীবনের সবচেয়ে মধুর আস্বাদ।

‘রিচার্ডকে আটকে রাখা হলো, এক অন্ধকার গহ্বরে।যেখানে শুধু ধোঁয়া, কালো অন্ধকার আর ভেজা মাটির গন্ধ। আটাইশ হাতের এক কবরস্থানে যেখানে জীবন ছিল এক নিঃস্বাসের মতো। শ্বাস নিতে গেলে গলায় স্যাঁতস্যাঁতে ভয়। ঘরটাই খালি দুই হাতে একটা দরজা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর মেঝে? রক্তে ভেজা, শুকিয়ে গেলে উপরের থেকে ঝরত নতুন রক্ত প্রতিদিন। কখনো থামত না। সেখানেই তাকে থাকতে হবে, প্রতিদিন রক্তে স্নান করতে হতো। ওকে আক্রমণাত্মক ভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রতিদিনই ভিন্ন জাতের বন্য পশু ছেড়ে দেওয়া হতো অন্ধকারে সেই আটাইশ হাত ঘরের ভিতর। শুরুতে ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠত রিচার্ড। শরীর ক্ষত-বিক্ষত হতো। কিন্তু প্রতিদিনের শিকার তাকে শক্তিশালী করে তুলছিল। ঘরে শুধু ছোট একটা ধারালো চাকু। চাকুটির ছোট্ট ধার, সেই ধারই ছিল তার একমাত্র অস্ত্র। প্রথমে যখন তার হাতে চাকু আসত সে আহত হতো, রক্তাক্ত হতো। কিন্তু সে ছিল এক পিশাচ। যে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নিজেকে শিকারি রূপে গড়ে তুলতে লাগল। এই ঘর তার জন্য ছিল মৃত্যু ও জীবনের মাঝখানে। প্রতিদিন একে একে হায়না, বন্য পশু, মানুষ—সব কিছুই তার শিকার হতে আসত। সেই অন্ধকার ঘর থেকে কেউ আর বের হতে পারত না। তাদের রক্তের বন্যা গড়িয়ে পড়ত রিচার্ডের হাতে।

‘তার শরীর, তার মনে, কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। শুধু বন্যতা। ঘরটিতে মাংসের গন্ধে ভরা থাকত, পঁচা, কাঁচা, সব একাকার। দুইদিনে খাবার দেওয়া হতো। ক্ষিধের তাড়নায় সে খেতো মাংস তবুও তার ক্ষুধা কখনো মেটেনি। তার ক্ষুধা ছিল শুধু রক্তের, প্রতিশোধের৷ আর সেই পুরো সময়জুড়ে, ফাদার তার প্রশিক্ষণের নির্মম প্রক্রিয়া চালিয়ে গিয়েছিল তার উপর দিয়ে। শারীরিক, মানসিক, আবেগিক—কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারত না। এভাবেই রিচার্ডের ভিতর থেকে সব কিছুই মুছে গেল৷ মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট ছিল না। সে ছিল শুধুই এক অমানবিক অস্ত্র, যাকে তৈরি করা হয়েছিল একদিনে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য।

‘বারো বছর পর সেই ঘর থেকে বের হয়ে রিচার্ড বের হয়ে আসল—এক প্রাণী, এক দানব। তার মধ্যে শুধু ক্রোধ, হিংস্রতা, আর ক্ষুধা ছিল। মাটির নিচের আটাইশ হাত ঘরে সে রেদোয়ান হয়ে ঢুকেছিল বের হয়েছিল রিচার্ড হিসেবে। পরবর্তীতে সমাজের কাছে তার নতুন পরিচয় গড়ে উঠে গ্যাংস্টার বস রিচার্ড কায়নাত নামে। মুক্ত হওয়ার পর তার প্রথম কাজ ছিল সেই বিকৃত মস্তিষ্কের মহিলাকে খুন করা যার কারণে সে এভাবে তৈরি হয়েছে। বারো বছর পর দেশে এসেছিল রিচার্ড। কিন্তু পায়নি সে মহিলাকে। তার নিয়তি তাকে বহু আগেই টেনে নিয়েগিয়েছিল।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫০

‘এভাবেই তৈরি হয়েছিল এক ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ—যে জানোয়ার। যার মধ্যে আবেগ, বিবেক, আর মনুষ্যত্ব কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। রিচার্ড কায়নাত ইতালির এক কুখ্যাত গ্যাংস্টার। যে একসময় ছিল বাংলাদেশের একজন সাধারণ ছেলে পরবর্তীতে তার অভিশপ্ত অতীত ই তাকে পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ানক প্রাণীতে পরিণত করেছিল। আর সেই থেকেই শুরু হয়েছিল নারী বিষেদ। সে সেদিন দূর্বল ছিল, ভীতু ছিল বলে এগিয়ে যায়নি। বাঁচায়নি তার বাবাকে। তাইতো দূর্বলের প্রতিও তার এতো তিক্ত মনোভাব।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫১ (২)