ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৩
মিথুবুড়ি
‘ঘূর্ণন গতিতে টায়ারের কর্কশ গর্জন তুলে কালো মার্সিডিসটা থামল গুলশান-২-এর নির্জন রাস্তায়। শেষ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠল। তড়িঘড়ি করে নেমে ডোর খুলে দিল লুকাস। কোটের ভাঁজ ঠিক করতে করতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রিচার্ড। মার্সিডিসের সামনেই একটা কালো জিপ দাঁড় করা। তার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এরিক, আসমান আর তাকওয়া। আজ তাকওয়ার উজ্জ্বল মুখশ্রী ম্লান, চোখের গভীরেও কেমন যেনো চাপা অস্থিরতা। রিচার্ড একবার সোয়াট টিমের দিকে তাকিয়ে অধর এলিয়ে হাসল। অতঃপর ঠোঁটের এক কোণে শিস বাজাতে বাজাতে সামনে এগোল।
‘ঠিক তখনই তীব্র গতিতে ছুটে আসা একটা বাইক আচমকা এসে ব্রেক কষল তার সামনে। দক্ষ চালকের কারণে ধাক্কা লাগতে গিয়েও লাগল না। রিচার্ডের চিবুক মুহূর্তেই শক্ত হয়ে আসে। লেদার হেলমেট খুলে বাইক থেকে নেমে ছুটে গেল লাড়া রিচার্ডের কাছে৷ রিচার্ডকে ঝাপটে ধরার আগেই সে এক ধাপ পিছিয়ে গর্জে উঠল,
“ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি৷”
‘লাড়া কাছে যাওয়ার সাহস করল না। দূর থেকেই চোখ গেঁথে রাখল রিচার্ডের ওপর। এতোদিন বারবার চেয়েও রিচার্ডের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ আজ সব উপেক্ষা করে ছুটে এসেছে শুধুমাত্র রিচার্ডের জন্য। শক্ত, দৃঢ়চেতা লাড়া যার কথায় কাঁপন থাকত না, আজ তার ঠোঁট কাঁপছে। গলার স্বর ফাঁসির দড়ির মতো আটকে যাচ্ছে বুকে।
“রিদ, তুমি কিভাবে পারলে? আবারও… ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করতে?”
‘রিচার্ড রক্তঝরা ক্রোধে হুংকার দিয়ে উঠল,”ওয়াইফ! শি ইজ মাই ওয়াইফ, ঐ মেয়েটা না ওকে?”
‘লাড়ার ঠৌঁট তরতর করে কাঁপতে থাকে,”রিদ আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বাট আই লাভ হার।”
‘বেদনার কণ্টকময় পথ দিয়ে শূন্যতার ভার বয়ে গেল। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে ক্ষোভে, কষ্টে চেঁচিয়ে উঠল লাড়া,
“তাহলে আমার ভালোবাসা কোথায়? কিসের কমতি আছে আমার ভালোবাসায়?
‘রিচার্ডের ক্রোধ অনিয়ন্ত্রিত হতে থাকে ক্রমে ক্রমে। গুমোট পরিবেশে ঝংকার তুলল তার কণ্ঠ,
“লাড়া ডোন্ট ক্রোস ইউর লিমিট ওকে? আই’ম হ্যাপিলি আ ম্যারিড পার্সন৷”
“হ্যাপিলি? ওই মেয়েটা ভালোবাসে তোমাকে?”
‘থমকাল রিচার্ড, তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারল না। পরক্ষণেই বিলম্ব করল না উত্তর দিতে। আত্মবিশ্বাসে ভরা কণ্ঠে সে পূনরায় চেঁচিয়ে উঠল,
“ইয়েস শি লাভ মি। হার ফাস্ট লাভ ইজ মি এন্ড মাইন ইজি শি। আমরা এমন জোড়ায় তৈরী, যে জোড়ার বিচ্ছেদ নেই কখনো।”
“আমি বেঁচে থাকতে কখনোই তোমাদের এক হতে দিবো না।” বলে লাড়া আবারও রিচার্ড’কে জরিয়ে ধরতে গেলে রিচার্ড ওকে ঝাড়ি মারে। লাড়া ছিটকে গিয়ে পড়ল পুরুষালী সুবিস্তৃত,শক্তপোক্ত সুঠোম বুকে। ভেজা চোখে মাথা তুলল লাড়া। দেখতে পেলো একটা শক্ত হাত ওকে আগলে ধরে রেখেছে। প্রেম ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের দিকে৷ সে আলগোছে লাড়াকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে তেড়ে গেল রিচার্ডের কাছে৷
“ভালোবাসতে না পারলে কষ্ট দেওয়ার অধিকারও তোর নেই।”
‘প্রেমের আক্রোশপ্রসূত স্বরে বিপরীতে রিচার্ড ঠৌঁট কামড়ে হাসল। নিরব সংঘর্ষ হল তাদের মাঝে কিছুক্ষণ চোখে চোখে। কিছুপল পর প্রেম বুকভাঙা ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও খাদযুক্ত কণ্ঠে আওড়াল,
“শি ইজ টু মাচ রয়্যাল এবাউট হার ফিলিংস। ডোন্ট পুস হার এ্যাওয়ে। বন্ধু হিসেবে কথা দিয়েছি, ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিব না। প্লিজ ওকে কষ্ট দিস না।”
‘রিচার্ড এবারও ঠৌঁট কামড়ে হাসল৷ পরপর প্রেমের দিকে খানিকটা ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলল,”রয়্যাল? তোর রয়্যাল বান্ধবী যে আমার কাছে এসে দয়াল হয়ে যায়। এতোটাই দয়াল যে সবটা খুলে দ”,,,,,’বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রেম হিংস্র দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে খামচে ধরে রিচার্ডের কোটের কলার৷ রিচার্ডের মধ্যে কোনোরূপ অভিব্যক্তি দেখা গেল না। প্রেমের হাত রিচার্ডের চোয়াল বরাবর তীব্র এক ঘুষির অভিপ্রায়ে অগ্রসিত হওয়ার আগেই তার শরীর ছিটকে গিয়ে পড়ল পিচঢালা সড়কে। লুকাসের অতর্কিত জল্লাদীয় আক্রমণ এতোটাই দানবীয় ছিল যে চোয়াল ফেটে নাকের সরু পথ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। রিচার্ড ঠৌঁটের কোণে বিদ্রুপপূণ হাসি ঝুলিয়ে পকেটে হাত রেখে গিয়ে দাঁড়াল প্রেমের সামনে।
“ছাড়ের উপর ছাড় আছে, তবে বাপের উপর বাপ নেই। কথাটা মাথায় রাখবি।”
‘প্রেম আবারও ওঠে আক্রমণ করতে গেলে লাড়া গিয়ে ওকে ঝাপটে ধরে আটকিয়ে রাখে। রিচার্ডের ইশারায় লুকাস চুপ থাকল। লাড়ার একার পক্ষে সুঠাম দেহের অধিকারী প্রেমকে ধরে রাখা মুশকিল। বাধ্য হয়ে বিরক্তের তপ্ত শ্বাস ফেলে এগিয়ে এল এরিক। আসলাম ক্ষিপ্ত প্রেম’কে টেনে নিয়ে জিপে বসিয়ে দিল।পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকওয়া লাড়াকেও সাথে করে নিয়ে গেল। লাড়া ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু রিচার্ডের দিকে চেয়ে ছিল ফ্যালফ্যাল করে। চেঁচিয়ে বলে,
“আমায় ভালোবাসলে না কেন রিদ?”
‘রিচার্ডের মাঝে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। নিরেট ঠান্ডা চিবুকে দাঁড়িয়ে আছে। এরিক ফাঁপা নিশ্বাস ছেড়ে গিয়ে দাঁড়াল রিচার্ডের সামনে। জিপের দিকে ইশারা করে বিদ্রুপমাখা স্বরে বলল,
“ডিল অনুযায়ী আপনার ব্যাপারে আমি ইন্টাফেয়ার না করলেও ওই ক্ষ্যাপা ষাঁড়টাকে দেখছেন? ও কিন্তু এতো সহজে ছাড়বে না আপনাকে, যেখানে প্রেমে মত্ত হয়েছে প্রেম৷”
‘রিচার্ড রুক্ষ কর্কশ গলায় অর্নথক হাসি হেসে চাপা স্বরে বলে,”সময় হলে এটাকেই দেখে নিবো। রিচার্ড কায়নাতের পিছনে লাগতে আসা কারোরই ঠাঁই হয়নি ভুবনে আজ পর্যন্ত।”
‘থামল রিচার্ড। থেমে এরিকের চাপা ক্রোধ মিশ্রিত ছোট ছোট চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে শুধায়,
“তা ভালোবাসার জন্য আপনি কি কি করলেন?”
‘বুকের ভিতর তীব্র এক ধাক্কা খেল এরিক। কণ্ঠের কঠোরতা মূহুর্তেই ব্যর্থতায় তলিয়ে গেল,”অনেক কিছু করতে চেয়েও পারিনি আপনার জন্য। তবে আপনি যেই উপকার করেছেন তার ঋীণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না৷”
“চাইলেই অনেক কিছু করতে পারবেন না কারণ এই খেলার মেইন মাস্টারমাইন্ড আমি। আর খেলার মোড় আমার ইশারায় ই ঘুরবে।”
‘এরিক নিস্তব্ধ বিস্ময়ে প্রশ্নবিদ্ধ করল চোখে। রিচার্ড দারুণ হাসল।
“কুল ম্যান। কাহিনীতে টুইস্ট না আনলে মজা পাওয়া যায় না৷”
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি আপনার ওয়াইফ কে ঠকাচ্ছেন? চাইলেই কিন্তু খুব সহজে সবটা সামনে আনতে পারতেন।”
“একদমই না। ওকে গড়ে তুলছি! যাতে ধাক্কা গুলো একটু কম লাগে। ওই মেয়ের কষ্ট যে আমি একদমই নিতে পারি না। শুধুমাত্র কারিগরই জানে কিভাবে জিনিসটা গড়লে মজবুত আর লং লাস্টিং হবে৷”
‘এরিক বাঁকা হাসল,”এতে তো আপনার প্রতিশোধের মাত্রাও গাঢ় হচ্ছে। আপনি ভয়ংকর রকমের ডেঞ্জারাস মি.কায়নাত, মাস্ট আই হ্যাভ টু সেইড দ্যাট। কিভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে
তীলে তীলে শেষ করতে হয় সেটা আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হলে অজানাই থেকে যেতো। না মেরেও শেষ করে দেওয়ার মতো দূরান্তর খেলার বস আপনি৷”
‘হঠাৎই অযাচিত কারণে রিচার্ডের থমকে যাওয়া মস্তিষ্কটা ফিরে গেলো তার চিরাচরিত পৈশাচিক আত্মায়। গর্জে উঠল সে,
“আমার ভিতর আমি কি আগুন বইয়ে বেড়াচ্ছি সেটা শুধুমাত্র আমি জানি। আমি এখন চাইলেও অনেক কিছু করতে পারছি না।”
“সবটা সামনে নিয়ে আসুন।”
“অন্ধের সামনে আয়না ধরে মুখোশধারীর সৌন্দর্য দেখাতে দেখাতে ক্লান্ত আমি। সে নিজেই পৌঁছুক এবার সত্যের কাছে৷”
“আপনার স্ত্রী জানলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবে বিশ্বাসী মানুষের কাছ থেকে এতো বড় ধাক্কা খেয়ে।”
“তাইতো এতো সময় নিলাম৷”
“স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন তাই না?”
‘রিচার্ডের পাঁজরে মৃদু স্নিগ্ধ কাঁপন হল। ওষ্ঠপুটে মৃদু চঞ্চল হাসি রেখে অতি সাবলীল গলায় অবিলম্বে আওড়াল মৌন ভালোবাসার অন্তর্লীন কথা,
“আমার এলি জান, আমার রেড। কখনো কখনো তো ইচ্ছে করে ওর-ই জান নিয়ে নিই ওর বোকা বোকা ভুলের জন্য। কিন্তু আমি পারব না, খুব ভালোবাসি আমার স্ত্রীকে।”
“যাদের অস্তিত্ব অন্ধকারে গাঁথা, তাদের জন্য আলোর প্রতি আকর্ষণই সর্বনাশের সূচনা।”
‘এরিকের সুচারু কথায় চিবুক শক্ত হয়ে যায় রিচার্ডের। খাদযুক্ত কণ্ঠ নিমিষেই পরিবর্তিত হয়ে রুষ্ট কণ্ঠে রূপান্তরিত হল,”তোকে যে উদ্দেশ্যে ডাকা হয়েছে, তা শেষ করেই বিদায় হ। মনে রাখিস, তোকে এখানে আমি এনেছি। ১৩.২২৬.৭ কিলোমিটার দূর থেকে টেনে আনতে পারলে, তোর অস্তিত্ব মুছে ফেলাও আমার হাতের খেল। কাল ভোরের আলো ফোটার পর যেন আর তোদের টিমের কাউকে আমি এখানে দেখতে না পাই।”
‘এরিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল,”থ্রেড দিচ্ছেন?”
‘রিচার্ড ভ্রু নাচাল, ঠান্ডা গলায় বলল, “থ্রেড তারা দেয় যারা এক বাক্যে একশনে যেতে পারে না। তোকে যে অস্তিত্বের সন্ধানে এনেছি, সেটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে রিচার্ড কায়নাতের এক মিনিটও লাগবে না। হাতের ইশারাই যথেষ্ট।”
‘এরিকের হাসি মিলিয়ে গেল। চোখেমুখে ফুটে উঠল একদা হারিয়ে ফেলা ভয়। শুষ্ক কণ্ঠে বলে উঠল, “প্লিজ ডোন্ট, আই বেগ ইউ।”
‘রিচার্ড ঠোঁটের কোণে একটুখানি হেসে এগিয়ে এলো। এক হাতে পকেটের ভেতর কিছু খুঁজতে খুঁজতে আরেক হাতে এরিকের কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করল,
“একটা প্রমাণও যেন না থাকে।”
‘এরিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ওর দিকে৷ অতঃপর জিপে অবস্থানরত বাকি টিম মেম্বারদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রেমসীর জানের বিনিময়ে আমার সততার সঙ্গে প্রতারণা করলেও, ওদের দেখছেন? ওরা কিন্তু সঙ্গী হারিয়েছে। খুবই ভয়ংকর ওরা। গুলির নিশানা কখনো মিস যায় না। কেউ ছাড়বে না জানোয়ারটাকে।”
‘রিচার্ড থমকালো। তার কণ্ঠনালি বেয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তা দেখে এরিক তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বলল, “কি, মেরে ফেলব নাকি? রক্তের জন্য পুড়বে বুঝি?”
‘বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো রিচার্ড। এক ঝটকায় ধরে ফেলল এরিকের জ্যাকেট। লুকাস হতভম্ব। ওদের রহস্যময় কথার সূত্র কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
“কোনো টান নেই আমার। কোনো পিছুটান নেই আমার বুঝলি? অথবা এসব বলে নিজের হায়াত কমিয়ে নিস না।”
“তাহলে মেরে ফেলি?”
‘এক ধাক্কায় ওকে দূরে সরিয়ে দিল রিচার্ড। বিষধর সাপের মতো ফনা তুলছে ক্রোধে। হনহনিয়ে গাড়ির দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়ল বরফশীতল নির্দেশ, “ডো হোয়াটেভার ইউ ওয়ান্ট উইথ দ্যাট মাদারফাকার।”
‘গাড়ির কাছে যেতেই অকস্মাৎ রিচার্ডের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই চোখে রক্ত নামল রিচার্ডের। বজ্রপাতের ন্যায় গর্জন তুলে চেঁচিয়ে উঠল,”লোকা আমার বাপের কবরের পাশে দুটো কবর খুঁড়ো। সব ধ্বংস করে দেবো আমি আজ।”
‘লুকাস দৌড়ে গাড়ির দিকে এগোতেই রিচার্ড বিদ্যুৎবেগে স্থান ত্যাগ করল। ইঞ্জিনের ধোঁয়ার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকল লুকাস। থমথমে অবয়ব। এরিক ধুলোমাখা গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার জীবনের সবচেয়ে বড় মিশনের দিকে পা বাড়াল অস্থির ভঙ্গিতে। এরিক জিপের কাছে যেতেই তাকওয়া, আসমান, প্রেম আর লাড়াকে ছেড়ে দিল। লাড়া এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। হনহনিয়ে গিয়ে বসল বাইকে। পিছনে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়িয়ে চলে গেল। প্রেম তপ্ত শ্বাস ফেলে সে নিজেও গিয়ে বসল বাইকে। পিছু গেল জিপের। জিপের ড্রাইভিং সিটে ছিল এরিক। সে ফ্রন্ট মিরর দিয়ে একবার প্রেমের বাইকের দিকে তাকিয়ে শিস বাজিয়ে রেসের জন্য উসকাল। প্রেম নিজেও সাই দিল তাতে। শুরু হল যান্ত্রিক ইঞ্জিনের খেলা। ভরাট নিস্তব্ধতা চিরে ইঞ্জিনের গর্জন! গতি বাড়িয়ে দিল দুজনেই। রাস্তার বাতিগুলো ছুটে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে পেছনে। জিপের চাকায় ঘর্ষণের শব্দ, বাইকের গিয়ার বদলের ক্লিক, ধোঁয়ার মেঘ সবমিলিয়ে শহরের নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে এগিয়ে চলল প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন।
‘এরিক হঠাৎ স্টিয়ারিং বাঁয়ে ঘুরিয়ে রাস্তা কেটে নিল। প্রেমও গতি না কমিয়ে কাঁধ বাঁকিয়ে বাইক হেলিয়ে দিল৷ মিলিমিটার ব্যবধানে পাশ কাটিয়ে গেল জিপের। এরিক হাসল। প্রেমের ঠোঁটেও হাসির রেখা। এখন আর এটা শুধু রেস না, এটা যুদ্ধ। দূর থেকে ট্রাকের হেডলাইট! এরিক ঝটকা দিয়ে গতি বাড়াল! প্রেম মুহূর্তও দেরি করল না। জিপ ট্রাকের আগে গিয়ে ডান দিকে কেটে গেল। প্রেম সরাসরি ঢুকে পড়ল ট্রাকের নিচে! চকচকানো ধাতব দৈত্যের নিচে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে গেল প্রেম! তারপরই ভূঁউউউউষ! বাইকের চাকায় আগুনের মতো ঘর্ষণ! প্রেম বেরিয়ে এল অন্যপাশ দিয়ে গতি একটুও না কমিয়ে! এরিকের চোখে চমক স্পষ্ট। তাকওয়া বিস্ময়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে।
“শুধু স্পিড দিয়ে জেতা যায় না ভাই আমার!” প্রেম হেলমেটের নিচে ফিসফিস বলে আবারও সামনে এগিয়ে গেল। সামনে ব্রিজ, শেষ ল্যাপ। এরিক আর দেরি করল না। স্টিয়ারিং ধরে ডানদিকে চাপ দিল, প্রেমের বাইকের সামনে কাট মেরে গেল! ধুলো উড়ল চারপাশে। তবে বেপরোয়া প্রেম যে থামার ছেলে না। প্রেম এক ঝটকায় বাইক হেলিয়ে দিল, সামনের চাকা তুলে স্পিন! জিপের আলোয় প্রেমের চেহারাটা চকচক করে উঠল। একশো আশি ডিগ্রি! মুহুর্তেই এরিকের মুখ থমকে গেল, প্রেম বাঁকা হাসল। তারপর… শেষ গতি! ব্রিজ পেরিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়িয়ে সামনে ছুটে গেল প্রেম। এই রেসের রাজা প্রেম!
‘অপরদিকে রিচার্ডের সমস্ত ক্রোধ যেন বিস্ফোরিত হচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের উপর। উত্তেজনায় তার শরীর ঘামে ভিজে একাকার! ঘাড়ের পাশে ফুলে উঠেছে নীলচে শিরা। গৌড়বর্ণের হাতে চেপে ধরা স্টিয়ারিংয়ের শক্তির চাপে রক্তজালিকা স্পষ্ট হয়ে আছে। নিঃশ্বাস গুলো ভারী আর দৃষ্টি আগুনের মতো জ্বলন্ত। ফোন হাতে তুলে এক নম্বরে কল করল রিচার্ড। ওপাশে রিসিভ হতেই হিংস্র গর্জনে চেঁচিয়ে উঠল,
“কুত্তার বাচ্চা! আমি ফেরার আগে পালা… না হলে রক্তে ডুবিয়ে দেব সব! আমার রাজ্য থেকে আমার রাণী পালায় কিভাবে? সবগুলোর কবর খুঁড়ব আমি।”
‘কল কেটে সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনকে ফোন করল রিচার্ড। এবারও গলা তেতে ওঠা আগুনের মতো,
“শহরের প্রতিটা রাস্তা, এয়ারপোর্ট সিল করে দাও। আমার অনুমতি ছাড়া একটা মাছিও যেন বাইরে যেতে না পারে!”
‘কথা শেষ করে ফোনটা পাশের সিটে ছুঁড়ে মারল রিচার্ড। বুক ওঠানামা করছে দ্রুত! শ্বাস যেন বুনো জন্তুর গর্জনের মতো। হঠাৎ কী মনে হতেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটল।নিমিষেই তলিয়ে গেল সমস্ত ক্রোধ। গাড়ির গতি ধীর করে ঠৌঁটের কোণে ফিকে হাসি রেখে আওড়াতে থাকে,
“Run, hide, struggle all you want… it changes nothing. I will find you. I always do.
You thought you could slip from my grasp? Amusing.
But now… now you’ll learn what true suffering means.
I won’t just break you—I’ll shatter you jan”
“এলিজাবেথ তুই কি করতে চাইছিস? সত্যি করে বল।”
‘মায়াকে কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। দেয়ালে টাঙানো নিজের ছবিটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। এরপর দৃষ্টি ফেরাল ইবরাতের দিকে। কণ্ঠ করুণ, অনুনয়ের ছোঁয়া লেগে আছে,
“ইবরাত, প্লিজ বোন আমার, আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য কর। ম্যানশনে এখন ন্যাসো ভাই ছাড়া কেউ নেই,সকল গার্ড সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অল্প ক’জনের চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন কিছু না। পিছনে পুকুরপাড়ে কোনো গার্ড নেই আমি নিজে দেখেছি!”
‘ইবরাতের চোখেমুখে দ্বিধার ছায়া। কোলে ঘাপটি মেরে থাকা মাফির শরীরটা যেন আরও ভারী হয়ে এল। ঠোঁট নড়ল ইবরাতের! অস্ফুট স্বরে বলতে চাইল,
“কিন্তু…”
‘এর আগেই এলিজাবেথ হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। ইবরাতের হাত দু’হাতে চেপে ধরে মিনতি করে বলল,
“কোনো কিন্তু না আমি জানি তুই পারবি। বোন, প্লিজ…”
“তুই কি কাউকে সন্দেহ করছিস?”
‘এক মুহূর্তেই এলিজাবেথের উজ্জ্বল মুখ মলিন হয়ে গেল। বুকের ভেতর অস্থিরতা চেপে ধরে শ্বাস রুদ্ধ করে দেয়। গলাটা শুকিয়ে আসে, তবুও বলল,
“আমি খুব করে চাইছি আমার সন্দেহ যেন ভুল প্রমাণ হয়।”
“কার কথা বললি তুই?”
‘ইবরাতের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল এলিজাবেথ। তবে ইবরাত থামল না, পাল্টা ছুড়ে দিল,
“তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস?”
‘শরীরটা এক মুহূর্তে কেঁপে উঠল এলিজাবেথের। দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে আবারও চোখ গেল এলিজাবেথের। শিরশিরে অনুভূতি ভিজিয়ে দিল অন্তরাত্মা। ধীরেসুস্থে ইবরাতের উৎকণ্ঠিত চোখে চোখ রেখে বলল,
“তাকে আমি এত ভালোবাসি যে, তার জন্য নিজের জীবনও দিতে পারি।”
“তাহলে কেন দূরে থাকছিস?”
‘শাড়ির আঁচল বুকের কাছে টেনে এলিজাবেথ উঠে বসল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। কাল সারারাত ঘুম হয়নি! সকালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনাগুলো এখনো রক্তের ভেতর দোলা দিচ্ছে। যা ঘটনা ঘটেছে, তা তার নিজেরই হাতে। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর রিচার্ডকে আর দেখেনি এলিজাবেথ। সময়ের ভারসাম্য মেপে এলিজাবেথ ধীরস্থির ভাবে বলল,
“কখনো কখনো দূরত্ব বাড়াতে হয়, গুরুত্ব বুঝার জন্য।”
‘ইবরাত তেতে উঠল,
“যে মানুষটা তোর জন্য, তোর সকল বিপদে পাগলের মতো ছুটে যায় তাকে তুই গুরুত্ব বোঝাবি? জানিস, তোর জন্য ভাইয়া একটা মিনিস্টারের বাড়ির প্রতিটা কোণায় সিসিটিভি লাগিয়েছিল? বাড়ির ভেতর, বাইরের সব লোককে কিনে নিয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকায়? জানিস না, তুই যখন দেওয়ান মঞ্জিলে ছিলি তখন ভাইয়া একটা রাতও ম্যানশনে থাকেনি! দেওয়ান মঞ্জিলের বাইরে থেকেছে গাড়ির মধ্যে দিনের পর দিন শুধু মাত্র তোর জন্য! আর তুই সেই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে গুরুত্ব বুঝাতে চাস?”
“একটা নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য যে আমায় কঠোর হতেই হবে বোন।” মনে মনে আওড়াল এলিজাবেথ।
‘এলিজাবেথের নীরবতায় ইবরাত আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
“এলিজাবেথ ভাইয়া ফিরে তোকে না পেলে সব ধ্বংস করে ফেলবে।”
“উনি ফেরার আগে আমি ফিরে আসব। প্লিজ, আমায় সাহায্য কর। আমি আমার অতীতের রহস্য উন্মোচন করতে চাই।”
“কিন্তু ভাইয়ার কানে খবর পৌঁছাতে দেরি হবে না। যদি জানতে পারে তুই পালিয়েছিস?”
“যেখানে নিজের ইচ্ছায় এসেছি, সেখান থেকে পালাতে যাব কেন?”
‘চোখ বড় বড় হয়ে গেল ইবরাতে,”মানে? তুই তো রাশিয়া ফিরে যাচ্ছিলি?”
‘এলিজাবেথ মুচকি হাসল,”দ্যাৎ! আমি জানতাম কীভাবে ওনাকে আড়াল থেকে বের করতে হয়।”
‘ইবরাত হেসে মাফিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়,”ওকে, যাচ্ছি। সাবধানে ওকে?”
‘বলেই বেরিয়ে গেল ইবরাত। এলিজাবেথ এতোক্ষণ শক্ত ছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন সে নিজেও এবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল…উপ্তত্ত নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। মায়াকে কোলে নিতে গেলে সে নিজেও ছুটল তার অমাবস্যার মতো দেখতে স্বামীর পিছনে। তার পেটের ভিতরের ট্যাবলেটগুলোর বাপের কাছে এক দৌড়ে চলে গেল মালিক রেখে। হতভম্ব এলিজাবেথ। কই তার-ও তো জামাই আছে, কই সে তো এতো জামাইয়ের নেওটা না। আজব!
‘ইবরাত কাঁপা কাঁপা পায়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল ন্যাসো কেবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে। আজ রিচার্ড শুধু লুকাসকে নিয়েই বেরিয়েছে, ন্যাসোকে রেখে গেছে এলিজাবেথকে দেখার জন্য। ন্যাসোকে দেখামাত্র ইবরাতের ভিতরটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। কীভাবে বলবে মিথ্যা? যে মানুষটার জন্য তার জীবন এত রঙিন! যে লোকটা ভালোবাসবে না বলেই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে তাকে।লম্বা করে শ্বাস ফেলল ইবরাত। গলা খাঁকারি দিয়ে কায়কুঁই করে বলল,
“থাক, আমি চলে যাই।”
‘ন্যাসো তাকাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার অষ্টাদশী বউয়ের দিকে। নিদারুণ এক হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। সে হাতের কাজ ফেলে জানতে চাইল,
“আমাকে রেখে কোথায় যেতে চাও, রাত?”
‘ইবরাত সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে দু’হাত বুকে ভাঁজ করে অভিমানী স্বরে বলল,
“যেখানে গেলে কেউ আমাকে সারাক্ষণ কোলে তুলে রাখবে।”
‘ন্যাসোর চোখে মৃদু শ্লেষের ছোঁয়া,”বউয়ের বুঝি কোলে উঠতে ইচ্ছে করেছে?”
“হুমম…”
“জো আপকা হুকুম বেগম সাহেবা।” বলে টুপ করে ইবরাতকে কোলে তুলে নিল ন্যাসো। দীর্ঘদেহী ন্যাসোর বাহুডোরে ইবরাত যেন এক শিশুর মতো আর সেই শিশুটিও কী মধুর ভঙ্গিতে মিশে গেল তার ভেতর…ন্যাসো বুক-পাঁজরের সাথে মিশে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে সোজা বেডে গিয়ে হেলান দিয়ে বসল, তবুও ইবরাতকে কোলে নামায়নি। ইবরাতও নিরবে ঘাপটি মেরে রইল যেন ওর জায়গা এটাই। এভাবেই দুজন একে অপরের অস্তিত্বে মিশে থাকল। ভালোবাসার স্নিগ্ধ, মৌন বাতাস বইতে লাগল চারপাশে।
“রাত।”
‘ইবরাত তখনও ব্যস্ত ছিল স্বামীর শক্ত বুকের সবটুকু ঘ্রাণ শুষে নিতে। ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “হুমম।”
‘ন্যাসো চিলতে হেসে নাক ঘষে দিল ওর নাকে। নিগূঢ় কণ্ঠে বলল,
“এবার ফ্যামিলি প্ল্যান করলে কেমন হয়?”
‘চমকে মাথা তুলে তাকাল ইবরাত। চোখের গভীরতায় ঝলঝল করছে বিস্ময়। ন্যাসোর ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”আমার একটা বাচ্চা চাই ইবরাত। আমি বাবা হতে চাই।”
‘শুকনো ঢোঁক গিলল ইবরাত, “কিন্তু আমার তো পিরিয়ড চলছে।”
‘বউয়ের সরল স্বীকারোক্তিতে ফিক করে হেসে দিল ন্যাসো। শব্দ করে চুমু খেল ওর ললাটে। ইবরাতের চোখ বুজে এল আবেশে। ন্যাসো মেয়েটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে মৃদুস্বরে বলল, “এখন বলিনি! তুমি সুস্থ হও, তারপর।”
‘ইবরাত এবার সত্যিই বিপাকে পড়ল। মাথায় এই চিন্তাই আসেনি। তার মানে তো পুরো প্ল্যানই ফ্লপ!
নতুন কিছু ভাবতে থাকে ইবরাত… ভাবনার মাঝেই অন্যমনস্কভাবে আঙুলগুলো ন্যাসোর উরুতে আঁকিবুকি কাটতে লাগল। ন্যাসো নড়েচড়ে উঠল! ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস গরম হয়ে এল।
“রাত, স্টপ! আমি কিন্তু ভুলে যাব তুমি অসুস্থ এন্ড আই সোয়ার এটা তোমার জন্য অনেক কষ্টকর হবে।”
‘টনক নড়ল ইবরাতের। ভোলাবালার চেহারা করে মাথা তুলে তাকাতেই এক ঝাপটায় ওকে বিছানায় ফেলে দিল ন্যাসো! সঙ্গে সঙ্গেই নিজেও উপুড় হয়ে ঝুঁকল ওর ওপর। হতবিহ্বল ইবরাত তাকিয়ে রইল ন্যাসোর বাদামি চোখজোড়ায়—এই চোখে এখন শুধুই নেশা, কামনা, কোনো সংযম নেই, নেই নিয়ন্ত্রণ!ঘাবড়ে গেল ইবরাত। কিছু বোঝার আগেই ন্যাসো মুখ গুঁজে দিল ওর গ্রীবায়। শিউরে উঠল ইবরাত, বিছানা খামচে ধরল। দাঁতের ছোট ছোট কামড়ে বারবারই কুঁকড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। ন্যাসোর হাত অবাধ্য হতে থাকল, শরীর অনিয়ন্ত্রিত…বেসামাল ভাবভঙ্গি।বিপাকে পড়ে গেল ইবরাত। কূলকিনারা না পেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,
“আহহহহহহ!”
“ন্যাসো সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল। ইবরাতকে একটানে টেনে সোজা করে বসাল। অস্থির হয়ে উঠল সে,
“রাত, বেইব কী হয়েছে? আমি কি বেশি লিমিট ক্রস করে ফেলেছি?”
‘ইবরাত কোনো জবাব দিল না। পেটে হাত চেপে হু হু করে কেঁদে উঠল।
“ওটাকে এখনই বের করুন! এখনই! ফুটবল খেলা শুরু করে দিয়েছে আমার পেটের ভেতর! আহহহ… কী ব্যথা!”
‘তাজ্জব বনে গেল ন্যাসো। গলা শুকিয়ে এল।
“এটাকে বের করব মানে? কাকে?”
“বাচ্চাকে!”
‘ছিটকে সরে গেল ন্যাসো, যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে,”এসব কী বলছ? মাথা ঠিক আছে?”
‘ইবরাত থরথর কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“ভুল কী বলেছি, হুহ? আপনার বাচ্চা আমার পেটের ভেতর ফুটবল মাঠ বানিয়ে নিয়েছে! দেখুন কেমন দৌড়াচ্ছে—ওমামামমম!” জোরে চেঁচিয়ে উঠল ইবরাত। ন্যাসোর মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হলো না। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে ইবরাতের কাছে ফিরে গেল আবার।
“কিন্তু রাত আমি তো এখনও তেমন কিছুই করিনি…”
“তাহলে পেটে ব্যথা করছে কেন?”
‘ইবরাত ন্যাসোর হাত ধরে নিয়ে গেল নিজের তলপেটে। ঠৌঁট ভেঙে বলল,
“এখানে খুব ব্যথা করছে…”
‘ন্যাসোর বুকে পানি আসে। ভুল ইবরাতের নয়, ভুল তার… কেন এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করল?একটানে ইবরাতকে কোলে তুলে নিল ন্যাসো। বউয়ের তলপেটে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এই সময় এমন হয়। পেইন কিলার দিচ্ছি, এখনই ঠিক হয়ে যাবে, জান।”
‘ইবরাত নাক টানতে টানতে বলল,
“এগুলোতে হবে না। এগুলোর শক্তি কম। আপনি নতুন শক্তিশালী ওষুধ এনে দিন।”
‘ভড়কে গেল ন্যাসো। ওষুধ আবার শক্তিশালী হয় নাকি?” তার অবুঝ বউ হয়তো পাওয়ারফুল ওষুধের কথা বলছে। কথা বাড়াল না কারণ এই সময় মেয়েদের মেজাজ যে তুচ্ছ কথাতেই চটে যেতে পারে সেটা সে খুব ভালো করেই জানে।
“আচ্ছা আমি কাউকে দিয়ে ভালো ওষুধ আনাচ্ছি।”
‘হঠাৎই ইবরাত ঝড়ের মতো ন্যাসোর কোল থেকে নেমে গেল। চমকে উঠে ন্যাসো বলল,
“কি হলো?”
“আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন তাই না?”
“কী যা-তা বলছ?”
“তাহলে বললেন কেন যে কাউকে দিয়ে আনাচ্ছেন? দেখুন, আপনাদের শত্রুর অভাব নেই! যদি কেউ ব্যথার ওষুধের বদলে বিষ দিয়ে দেয় তখন?”
‘থমকে গেল ন্যাসো। এবারও কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না তার। উঠে পকেটে মানিব্যাগ গুঁজতে গুঁজতে বলল,
“হট ওয়াটারব্যাগ পাঠাচ্ছি, ওটা পেটে দিয়ে রাখো, কিছুক্ষণের জন্য অন্তত আরাম পাবে। আমি এখুনি আসছি।”
‘দরজার কাছে যেতেই পেছন থেকে ডেকে উঠল ইবরাত,
“I LOVE YOU.”
‘সেখানেই থমকে গেল ন্যাসোর পা। ধীরে পেছন ফিরল সে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল চিলতে হাসি। প্রতিউত্তর দিতেই যাচ্ছিল তখনই ইবরাত বলে উঠল,
“যাওয়ার আগে একবার বলে যান… এসে যদি দেখেন মরে গেছি?”
‘খুশিমেজাজ মুহূর্তেই হিংস্রতায় রূপ নিল। ন্যাসো বিদ্যুতের মতো ছুটে গিয়ে চেপে ধরল ইবরাতের গলা। ওর নিকষ বাদামি চোখ দাউদাউ আগুন হয়ে জ্বলছে। পুরো রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল ন্যাসো,
“আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ! নেক্সট টাইম মুখ থেকে এই শব্দটা বের হলে মাটিচাপা দিয়ে দেবো!”
‘বলেই হিংস্রতায় কামড়ে ধরল ইবরাতের ঠোঁট। যেখানে সবসময় ছুঁয়ে থাকত নিদারুণ কোমলতা আজ সেখানে শুধুই আগুন, রাগ আর প্রতিহিংসা। তবে ইবরাতের একটুও কষ্ট হলো না, রাগও না। বরং ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের সাথে টপটপ করে ঝরতে লাগল অশ্রু— প্রাপ্তির অশ্রু। নিজের সমস্ত আক্রোশ মিটিয়ে ন্যাসো ওকে ছাড়ল। চুলের মুঠি ধরে কপালের সাথে কপাল চেপে বলল কাঠকাঠ কণ্ঠে,
“I LOVE YOU INFINITY. যেদিন হারিয়ে যাবে, সঙ্গে করে নিয়ে যেও।”
‘বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল ন্যাসো। একটা শব্দও বের করল না ইবরাত। শুধু ঠোঁটের ফাঁক গলে ছুটে বেরিয়ে এলো এক প্রাপ্তির হাসি। সেই হাসি মিলিয়ে গেল বাতাসে, আকাশে। হঠাৎ দরজার পাশ থেকে উঁকি দিল এলিজাবেথ। ইবরাত হেসে মাথা নাড়াতেই এলিজাবেথ ছুটে গেল। ছুটে গিয়েও আবার ফিরে এল এলিজাবেথ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শাড়ির আঁচল দিয়ে ইবরাতের ঠোঁটের কোণের রক্ত মুছে দিয়ে কপালে নরম করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আবারও ছুটে চলে গেল। ফিক করে হেসে দিল ইবরাত।
‘প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এলিজাবেথ। পেছনে পুকুরের জলে ভাসছে পদ্মফুল! বাতাসে দুলছে কাঁপন তুলা কোমল পাপড়িগুলো। পরপর কয়েকবার গভীর শ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করল এলিজাবেথ। অতঃপর শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নিয়ে একলাফে পেরিয়ে গেল প্রাচীর। এটা তার প্রথমবার নয়। বহুবার এভাবে নিষিদ্ধ সীমানা অতিক্রম করেছে সে। তাই আজ আর তেমন সমস্যা হলো না। ওপাশে নেমেই হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কঠিন কণ্ঠে আওড়াতে আওড়াতে এগোতে থাকে সামনে,
“আমি জানি না মি. কায়নাত, আপনি আমাকে নিয়ে কী খেলা খেলছেন। তবে এবার এই খেলার শেষ আমি নিজেই করে ছাড়ব।”
‘হঠাৎ ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল এলিজাবেথের।গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি। এতক্ষণ স্বপ্নে আগের ঘটনাগুলো দেখছিল সে।ম্যানশন থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাব বুক করেছিল এলিজাবেথ। দু’হাতে চোখ কচলিয়ে জানালার বাইরে তাকাল এলিজাবেথ। রাস্তাগুলো হঠাৎ করেই চেনা চেনা লাগছে। চকিতে সামনে তাকাল সে। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা দৈত্যাকৃতি লোকটার কানের পাশের তীরের ফলার অনুকৃত ট্যাটু দেখামাত্র শিউরে উঠল পুরো শরীর।জবুথবু হয়ে কাঁপতে শুরু করল এলিজাবেথ। কণ্ঠে শব্দরা জমাট বেঁধেছে। তবু বহু করসতে আওড়াল,
“আ-আপনি?”
‘সামনে থেকে ভেসে এল ভারী, গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর। যেটা গভীর হলেও ছিল শীতল, ক্ষোভ-রাগবিহীন।
“Wanna go somewhere, Eli jan?”
“কণ্ঠনালি থরথর করে কাঁপতে থাকে এলিজাবেথের। রিচার্ডের ঠান্ডা গলায় শীতল স্রোত বইতে থাকে ওর শিরদাঁড়ায়। ক্রন্দিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
“গাড়ি থামান বলছি!”
‘রিচার্ড হাসল। ঠোঁটের কোণে গভীর, বিদ্রূপমাখা বাঁকা হাসি। ক্রোধের বিপরীতে এবারও গা ছমছমে হাস্কি টোনে বলল,
“You think you can just run away from me? Fu°ck, babe, you are mine. And I won’t let you go easily. So sit back, shut up, and enjoy the ride, darling!”
‘এই বলে স্টিয়ারিংয়ে চাপ বসাতেই দ্বিগুণ গতিতে ছুটে চলল গাড়িটা। তালে তাল মিলিয়ে পারল না এলিজাবেথ।
ছিটকে গিয়ে ধাক্কা খেল সিটে, শরীর কেঁপে উঠল ব্যথায়।
“প্লিজ, গাড়ি থামান! আমার ভয় করছে।”
“থামানো? ওকে, থামাচ্ছি।”
‘রিচার্ড হঠাৎই ব্রেক কষল তীব্র বেগে। গাড়ি স্থির হতেই সামনে থেকে পিছনে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এলিজাবেথের গলা চেপে ধরল। পরপরই বুনো জানোয়ারের মতো গর্জন করে উঠল,
“কুত্তার বাচ্চা তোর সাহস হলো কি করে পালানোর চিন্তা করার। আবারও পালানোর চেষ্টা করলি কোন সাহসে বল আমাকে?”
‘এলিজাবেথের নিশ্বাস আটকে আসছে। রিচার্ডের আঙুলের বাঁধন পাথরের মতো কঠিন। হঠাৎ, প্রচণ্ড আঘাতে রিচার্ড উইন্ডো মিররে ঘুষি বসাল। মুহূর্তেই কাচ ভেঙে ঝনঝনিয়ে পড়ল। হাতের চামড়া ছিঁড়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। সমুদ্র নীল চোখ দু’টোতে ঘনীভূত হচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত। শরীর অস্থিরতায় অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। তবুও থামল না। এবার এলিজাবেথের পাশের সিটে একের পর এক ঘুষি মারতে লাগল। সেই সাথে অদ্ভুত এক হিংস্র হুংকার ছাড়তে থাকে।
“এই আল্লাহর বান্দী এই! আমাকে শান্তিতে থাকতে দিতে তোদের কী এত সমস্যা হুহ? কুত্তার মতো ছুটে আসি বারবার তোর জন্য আর তুই পালানোর ধান্ধায়! খোদার কসম পারলে আজই তোকে জিন্দা দাফন করে দিতাম!”
‘এলিজাবেথ চুপ। অক্ষিপটে শুধু নিষ্পলক দৃষ্টি। আতঙ্ক নেই, প্রতিরোধও নেই—শুধু গভীর এক বোঝাপড়া। সে দেখছে রিচার্ডের উন্মত্ত বুকের ওঠানামা, শুনতে পাচ্ছে অস্থির হৃদস্পন্দনের প্রতিধ্বনি।
“কোন সাহসে তুই আবারও আমাকে রেখে পালানোর চেষ্টা করেছিস বল, বল আমাকে। কেন তোরা কেউ আমার কথা ভাবিস না৷”
‘হঠাৎই এলিজাবেথ হাত রাখল রিচার্ডের বুকে। মুহুর্তেই
রিচার্ডের চিৎকার গলায় আটকে গেল। একটা মুহূর্তের জন্য সময় থমকে দাঁড়াল। স্ফটিক অগ্নির মতোন ক্রোধে হুট করে নেমে আসলো বর্ষণ। পৈশাচিক উন্মাদনা নিমেষেই দমে আসতে থাকে! হৃদয়ের পাঁজর ছুঁয়ে প্রবাহিত হতে লাগল এক অদ্ভুত শীতলতা। ঝড় থেমে আসছে ধীরে ধীরে! শিকড় গাড়া গাছপালার মতো গভীর, নীরব কোনো শান্তি বয়ে গেল তার ভেতর দিয়ে…
“শান্ত হোন আমি পালাইনি।”
‘তবুও রিচার্ড থামে না। এলিজাবেথ চেপে ধরল রিচার্ডের হাত। বলল,”আমি সত্যি বলছি,আমি আপনার থেকে পালাতে চাইনি৷”
‘রিচার্ড এক ঝটকায় এলিজাবেথের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরল শক্ত করে, গভীরভাবে। এলিজাবেথ স্পষ্ট অনুভব করল বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয় আর অস্থিরতা। মুহূর্তের জন্য সেও হারিয়ে গেল সেই পাথরের মতো কঠিন অথচ থরথর করে কাঁপতে থাকা বুকখানায়।
“এখানে এত অস্থিরতা কিসের?”
‘রিচার্ড আজ কোনো লুকোচুরি করল না। কোনো প্রতিরোধ নয়! কোনো দ্বিধা নয়! শুধু একটিমাত্র সত্য উচ্চারণ করল স্বচ্ছ, নগ্ন কণ্ঠে,
“তোর জন্য।”
‘এলিজাবেথ মাথা তোলে। ওর দৃষ্টি আটকে যায় রিচার্ডের সমুদ্র-নীল চোখে। গভীর অথচ টালমাটাল ঢেউয়ে ভরা চোখগুলো।
“আমার জন্য এত অস্থিরতা কেন? আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না।”
‘রিচার্ড নিঃশ্বাস ফেলে। কপালে এক বিন্দু ঘাম জমে।
“সব কথা কি মুখে বলে দিতে হয়? বুঝে নিতে পারো না?”
“কি বুঝব?”
‘কোনো জবাব নেই। শুধু রিচার্ডের দুই বাহু আরও শক্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে এলিজাবেথকে। বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় গভীর এক আকুতিতে। একদম সাবলীল অথচ জলদগম্ভীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে,
“তুই জানরে…
আমার জানরে…
বেঁচে থাকার তুই কারণ।”
‘পিনপতন নিরবতায় ঘেরা গাড়ির ভিতর। শুধু শোনা যাচ্ছে বেগতিক হৃদয়ের উঠানামা। হলো কিছুক্ষণ শব্দহীন বোঝাপড়া। আত্মার প্রশান্তিময় শান্তিতে ডুবে আছে তারা একে অপরের মাঝে। রিচার্ড ঠৌঁট ছোঁয়াল এলিজাবেথের লাল কেশে।
“কি হল অনুভব করতে পারছ না কিছু?”
“আমি চাইলেও অনেককিছু অনুভব করতে পারি না, অতীতে করা আপনার পাশবিক নির্যাতন আর আপনার দেওয়া প্রত্যেকটা আঘাত আমাকে নাড়িয়ে তুলে৷”
‘রিচার্ড হঠাৎ করে এলিজাবেথকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে একটা গাছের কাছে নিয়ে গেল। তারপর গাছের শরীরে নিজের হাত রেখে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলিজাবেথের মাথা জোরে বারি খাওয়ালো গাছের সাথে। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় এলিজাবেথ। সামনের চুলগুলো সরিয়ে অবাক চোখে রিচার্ডের দিকে তাকাতেই সে বাঁকা হেসে ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,
“নাও গাছের সাথে বারি খাওয়া ডান। এবার বাংলা ছায়া ছবির মতো সমস্ত অতীত ভুলে যাও।”
‘হচকিয়ে গেল এলিজাবেথ। পরক্ষণেই রিচার্ডের মস্করা বুঝতে পেরে ঝাঁঝিয়ে উঠল,”পাগল আপনি?”
‘হনহনিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এলিজাবেথ। কিন্তু রিচার্ড ঝড়ের বেগে তেড়ে এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির গায়ে চেপে ধরল। এলিজাবেথ কিছু বলার আগেই রিচার্ড পকেট থেকে গান বের করে ওর মুখের ভেতরে গুঁজে দিল। শিউরে উঠল সে! সারা শরীর ঘৃণা আর ভয় মিশ্রিত অনুভূতিতে গুলিয়ে উঠল। রিচার্ডের থমকে থাকা দৃষ্টি মুহূর্তেই বদলে গেল এক ভয়ঙ্কর হিংস্রতায়।
“তুই দেওয়ান মঞ্জিলের দিকে কেন যাচ্ছিলি?”
‘গানের সরু নল এত গভীরে প্রবেশ করেছে যে এলিজাবেথ কথা বলতে পারছে ন। শুধু গোঙাচ্ছে।
“আ-আম…”
“চুপ! কোনো ব্যাখ্যা শুনতে চাই না আমি।”
‘রিচার্ড ঠাণ্ডা স্বরে বলেই মুখ থেকে গান সরিয়ে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ওর ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক হাতে গলা আঁকড়ে ধরে রাখল অন্য হাতে কোমরের নরম চামড়া খামচে ধরল বেপরোয়া শক্তিতে। মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে এলিজাবেথ, কিন্তু পারছে না। অবশেষে রিচার্ড নিজেই ওকে ছেড়ে দিল, ফেলে দিল গাড়ির ওপর। এলিজাবেথ হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে।
“প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আমার অনেককিছু জানার আছে ভালো মানুষের কাছ থেকে।”
‘বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে। সেই আলোয় ঝলসে উঠল রিচার্ডের চোখের আগুন।
“আর কি জানতে চাস তুই? জানতে চাস তার আসল পরিচয়?”বজ্রগর্জনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রিচার্ড গর্জে উঠল, “হি ইজ আ রাশিয়ান আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়া বস!”
‘তবে শেষের কথাগুলো এলিজাবেথের কানে পৌঁছাল না। পাশ দিয়ে এক ট্রাক হরেন বাজিয়ে ছুটে গেল আর ডেই গর্জনে ঢেকে দিল সব শব্দ। রিচার্ডের মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে আসে! চোয়াল মটমট শব্দে চেপে বসল। উন্মাদের মতো কয়েকবার ঘুষি বসাল গাড়িতে। হঠাৎই দপ করে এলিজাবেথের কবজি চেপে ধরল।
“আর লুকোচুরি না, সময় এসেছে সত্য সামনে আনার। চল।”
‘বলেই ওকে টেনে গাড়ির ভেতর ঠেলে দিল।’
বিটিআর ক্যাসিনো: অপারেশন ব্ল্যাকআউট
‘পুরো বিটিআর ক্যাসিনো এখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। চারপাশে ব্যারিকেড, আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ এবং মাটিতে সারিবদ্ধ পুলিশ ইউনিট৷ কিন্তু ভেতরে প্রবেশের অনুমতি কারও নেই। আজকের মিশনে একমাত্র সোয়াট টিমই প্রবেশ করবে। এরিক, তাকওয়া, আসমান, আরন—সকলেই গাড়ি থেকে নেমে সতর্ক পায়ে সামনে এগিয়ে এল। পকেট থেকে গান বের করে চারপাশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কয়েক সেকেন্ড। ভিতরে রয়েছে অসংখ্য আফ্রিকান গার্ড। যারা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্যাসিনোর সাধারণ মানুষদের হোস্টেজ হিসেবে আটকে রেখেছে।
‘সোয়াট টিম ক্যাসিনোর ভেতর ঢোকার আগে আবারও দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল চারপাশে। মুহূর্তেই নিজেদের মধ্যে সংকেত বিনিময় করল! কেউ কোনো শব্দ করল না!শুধু চোখের ভাষায় যুদ্ধের পরিকল্পনা ঠিক হয়ে গেল। প্রেম আর আরন পেছনের প্রবেশপথ ধরে এগিয়ে গেল, আসলাম পাইপ বেয়ে ছাদে উঠতে শুরু করল। রইল এরিক আর তাকওয়া! তারা সামনের প্রবেশপথ দখল করবে। তাকওয়া এরিকের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। হেসে হাতের এক ঝটকায় ছেড়ে দিল চুলগুলো। আজ নিজের মোহময় উপস্থিতি কাজে লাগানোর সময়। তাকওয়া এলোমেলো পায়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল ক্যাসিনোর প্রধান ফটকের দিকে। এরিক গান পজিশনে এনে দরজার আড়ালে লুকাল।
‘তাকওয়া দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে একজন দরজার ফাঁক দিয়ে তাকাল। তার চোখে চোখ পড়তেই তাকওয়া মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। মৃদু হাসল!লোকটা স্থির হয়ে গেল যেন সম্মোহিত! মুহূর্তের মধ্যেই সে তাকওয়ার ইশারায় দরজা খুলে দিল।
তারপর সবকিছু ঘটল বিদ্যুতের গতিতে! তাকওয়া ঢুকতে না ঢুকতেই গার্ডরা গুলি তুলল কিন্তু বুলেটের ঝাঁক শরীর স্পর্শ করার আগেই এরিক ছায়ার মতো বেরিয়ে এল দরজার আড়াল থেকে। একের পর এক নিখুঁত শটে কয়েকজন গার্ডকে নামিয়ে দিল সে। তাকওয়া নিজেও অস্ত্র বের করে গুলি ছুড়ল!
‘বুম__!!!!একটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো এক কোণায়। প্রেম, আসমান, আরন ভিতরে ঢুকে পড়েছে! মুহূর্তের মধ্যেই চারদিক থেকে শুরু হলো ভয়ংকর বন্দুকযুদ্ধ। গুলি ছুটছে, জানালার কাচ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ছে, চেয়ারের ওপর পড়ে থাকা কার্ডের ডেকগুলো বাতাসে উড়ছে। হোস্টেজরা আতঙ্কে টেবিলের নিচে লুকিয়ে আছে। সোয়াট টিম সংখ্যায় কম হলেও তাদের প্রশিক্ষণ আর দক্ষতা প্রতিটি মুহূর্তে প্রমাণ করে দিচ্ছে। তাকওয়া সুযোগ বুঝে এগিয়ে গিয়ে দ্রুত হোস্টেজদের বের করে দিল। বাইরে অপেক্ষারত পুলিশরা আহতদের উদ্ধার করতে শুরু করল। তবে ভিতরে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি!
‘বুম! বুম! বুম!
সাততলা ভবন কেঁপে উঠছে প্রচণ্ড গুলির শব্দে। একে অপরকে দমন করার চেষ্টায় লড়ছে সবাই! সোয়াট টিমকে ঠেকানো সহজ নয়। দাওয়া-পাল্টা দাওয়া, কভার ফায়ার, দ্রুত মুভমেন্ট! প্রতিটি মুহূর্ত যেন সিনেমার দৃশ্য! এ লড়াইয়ে এক পক্ষ টিকবে, আরেক পক্ষ ধুলোয় মিশে যাবে! আর শেষ পর্যন্ত টিকে যায় সোয়াট টিম। গুলির শব্দে দুলছিল সিঁড়ি। দ্রুত গতিতে ফায়ার করতে করতে সিঁড়ির কিনারায় চলে গিয়েছিল এরিক। হঠাৎ এক মুহূর্তের অসাবধানতায় পা হড়কে গেল! ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে নিলে শক্ত একটা হাত বিদ্যুৎগতিতে এসে তার কবজি আঁকড়ে ধরল। এরিক চমকে তাকিয়ে দেখল—প্রেম! ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপমাখা হাসি। চোখে সেই চিরচেনা তাচ্ছিল্য। তাদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে হলেও প্রেমের এই অপ্রত্যাশিত সাহায্যে হতবাক হয়ে গেল এরিক। প্রেম কোনো কথা না বলে স্রেফ এক ঝটকায় ওকে টেনে তুলে দাঁড় করাল৷ তারপর আর একবারও পেছন না তাকিয়ে হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। এরিক গভীর দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল।হঠাৎ বলে উঠল,
“তুমি সহযোগী হিসেবে ততটা খারাপ নও। এখনও সময় আছে, সত্য সামনে আসার আগে নিজে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসো। ভার কমবে পাপের।”
‘প্রেম এক মুহূর্তের জন্য থামল না৷ একবারও ফিরে তাকাল না। নিঃশব্দে বাহুর রক্ত মুছতে মুছতে সিঁড়ির উপরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। এরিক গভীর শ্বাস ছাড়ল। তপ্ত, ভারী, অজানা বোঝায় চাপা শ্বাস।
‘আহত শরীর, ক্ষতবিক্ষত কপাল, রক্তে ভেজা পোশাকে এরিক, আসমান, আরন, তাকওয়া, প্রেম একে একে গিয়ে দাঁড়াল রুফটপের লিফটের সামনে। তাদের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ছুটছে! চোখে ধকধক করছে উত্তেজনা। এটাই একমাত্র লিফট, যা সরাসরি বেজমেন্টে যায়। আরেকটা গোপন পথ আছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিন্তু তার খোঁজ শুধু তাকবীর আর রিচার্ড জানে। রিচার্ড জানলেও এরিককে কিছু বলেনি সে ব্যাপারে৷
‘সকলেই পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে শরীর কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলছে না। এরিক লিফটের কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড! ভুল পাসওয়ার্ড তিনবার দিলে চিরতরে লক হয়ে যাবে। সকলের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। সময় খুব কম। কিন্তু এখন ভুল করারও সুযোগ নেই। তাকওয়া আর আসলাম মেঝেতে পড়ে আছে, তাদের শরীর আর সাই দিচ্ছে না। বিশেষ করে তাকওয়া! ভিতরে ভিতরে সে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
‘এরিক জানে তাকবীরের অতীতের প্রতিটি অন্ধকার কোণ। সে চাইলে অনেক কিছু করতে পারত৷ সত্যগুলো সামনে এনে তাকবীরের জীবন এলোমেলো করে দিতে পারত। কিন্তু রিচার্ডের নির্দেশ পরিষ্কার ছিল,
“যতটুকু করতে দিচ্ছি, ততটুকুই। এর বেশি একদমই না।”
‘এরিক সীমা লঙ্ঘন করেনি৷ কিন্তু সে জানত সবকিছু কারণ এই অতীতের সমস্ত প্রতিটি ধূলিকণা সে নিজে খুঁড়ে বের করেছে। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে এরিক তাকবীরের জন্ম সাল দিল।
‘বিপ বিপ! অস্বীকৃতি।
‘এরপর এলিজাবেথের জন্ম সাল দিল।
‘বিপ বিপ! এখনও কাজ হল না।
‘এরিকের বুকের ভেতর অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সময় কমে আসছে। সকলে ভয়কাতর চোখে তাকিয়ে আছে এরিকের দিকে। শেষ চেষ্টা।এরিক কাঁপা কাঁপা হাতে দিল ছায়া মালতীর মৃত্যু সাল।
বিপ… টিং!
‘এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল লিফটের দরজা! সকলের চোখেমুখে আনন্দের ঝলক উঠল৷ এরিক এক পা পিছিয়ে লিফটে ঢুকল৷ দরজার ফ্রেমে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তাকাল তাদের দিকে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি। তারপর ঝট করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল! ওরা ছুটে গেল! কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লিফট নিচে নেমে যাচ্ছে একা এরিককে নিয়ে।
‘নিচে নামতেই এরিকের গা শিউরে উঠল। এটা কোনো মানুষের থাকার জায়গা হতে পারে? চারপাশে জমে থাকা আবর্জনার স্তুপ, দেওয়ালের গায়ে কালো ছোপ। পচা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। নেই কোনো জানালা, নেই আলোর কোনো চিহ্ন। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কোথাও থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। বুকের ভেতর ধপ করে উঠল এরিকের। সে এগিয়ে গেল৷ ভিতরে প্রবেশ করতেই পায়ের নিচে মাটি সরে গেল তার। চোখের সামনে যা দেখল তাতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ঠোঁট ফাঁক গলিয়ে আহত স্বর বেরিয়ে এল,
“নাশা…”
‘নাতাশা তখনও তলপেটে হাত চেপে ধরে গোঙাচ্ছে। কপাল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে গরম রক্ত। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীর, শুকিয়ে আসা ঠোঁট।সে অসহায়ভাবে তাকায় এরিকের দিকে। পানি ভেঙে গেছে, প্রসবের যন্ত্রণায় ফ্যাকাসে হয়ে গেছে একসময়কার লাবণ্যময় মুখ। এরিককে দেখামাত্র চোখের কোণে জল জমল নাতাশার। কণ্ঠের সমস্ত শক্তি একত্র করে ডাকল,
“রিক…”
‘এরিক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নাতাশার ফোলা পেটের দিকে। নাতাশা গর্ভবতী? নাতাশা প্রসবের যন্ত্রণায় আবারও চিৎকার করে উঠল,
“আহহহহহহ!”
‘আর সহ্য করতে পারল না এরিক। ছুটে গিয়ে ওকে জাপটে ধরল নাতাশাকে। শক্ত করে বুকে চেপে নিল। যেন এত বছরের দুরত্ব, সমস্ত দহন এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। নাতাশা এরিকের জ্যাকেট খামচে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
“আমি জানতাম রিক তুমি আসবে… আমাকে এই নরক থেকে মুক্ত করতে…”
‘এরিক কিছু বলল না। তার ঠোঁট নেমে এলো নাতাশার রক্তাক্ত মুখে। একের পর এক উন্মত্ত চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে সারা মুখ। নাতাশা কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“রিক, আমাদের বাচ্চাকে বাঁচাও…”
‘এক ঝটকায় মুখ তুলে তাকাল এরিক।
“আমাদের… বাচ্চা?”
“হ্যাঁ! আমাদের সন্তান… রিক, ওকে বাঁচাও!”
‘এই ভয়ানক পরিস্থিতির মাঝেও এরিকের বুকের ভেতর কেমন এক উষ্ণ ঢেউ খেলে গেল। আর এক মুহূর্তও দেরি করল না সে। নাতাশার মাথার নিচে বালিশ রেখে তাকে শুইয়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেল পায়ের কাছে। তারপর শুরু হল যুদ্ধ। নাতাশার আত্মার মতো কালো এই কক্ষে এরিক তার সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়ল। যন্ত্রণার পাহাড়ের নিচে পড়ে থাকা এক নারীকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনল। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ক্ষণিকের নীরবতার মাঝে, এক নরম, নিস্পাপ কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হল ঘরে।
‘একটি সুস্থ পুত্রসন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হয় নাতাশা। এরিক গায়ের গেঞ্জি খুলে তাতে মুড়িয়ে সন্তর্পণে শিশুটিকে তুলে নিল! তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাতাশার বুকে রাখল শিশুটিকে। নাতাশা শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে আবারও হুরমুড়িয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদল এরিকও। দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটল একরাশ কান্নায়। এরিক দু’জনকে একসাথে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।
‘মাছ ধরার জালের মতো চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে তাকবীরকে। সে সম্পূর্ণ বন্দি আজ চারদিক থেকে। পেছনে পড়ে আছে রেয়ানের নিথর দেহ। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে চেতনা হারিয়েছে সে। পায়ে গভীর ক্ষত, তাজা রক্তে মাটি লাল হয়ে আছে। যদিও এখন শুকিয়ে গিয়েছে। মাছি ভৌ ভৌ করছে রক্তের উপর। তাকবীর স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জঙ্গলের ফাঁক গলে দৃশ্যমান বিটিআর ক্যাসিনোর দিকে। ওপরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, ভেতরে আগুনের লেলিহান শিখা৷ সবকিছুই নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেল। সে এখানে থেকেও অনুভব করতে পারছে তার পাপের সাম্রাজ্যের পতন। ঠিক কি কি হচ্ছে ভিতরে।
‘তখন জঙ্গলে ছুটে আসার মুহূর্তে বিস্ফোরণের যে শব্দ কানে বেজেছিল সেটা আর কোথাও নয়, সেই গোপন সুরঙ্গ পথেই। আর তারপরই গাছের উপর থেকে ঝপ করে নেমে আসে জাল। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে যে তাকবীর কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক ভয়ঙ্কর শিকারির মতো ফাঁদে আটকা পড়ে যায় সে। রেয়ান কিছু করার আগেই অন্ধকারের মাঝে থেকে ভেসে আসে একটি গুলি। রেয়ানের পায়ের মাংস ছিঁড়ে ঢুকে গেল গুলিটা। আর তখন থেকেই তাকবীর জঙ্গলের মাঝে একা, পুরোপুরি অবরুদ্ধ। ঠিক যেমন শিকারি তার শিকারকে ফাঁদে ফেলে রিচার্ডও আজ তাকবীরকে তেমনই ফাঁদে ফেলেছে।
‘চোখের সামনে সবটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আগুনের লেলিহান শিখা, ধ্বংসস্তূপের গুঁড়ো ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে পরিচিত পৃথিবী। একে একে বেরিয়ে আসছে নৃশংস সব সত্য, রক্তের দাগ লেপ্টে যাচ্ছে বাতাসে। তবু তাকবীরের ভ্রূক্ষেপ নেই। এই মুহূর্তেও সে শুধু ভাবছে তার এলোকেশীর কথা।এই ভয়ংকর সত্যগুলো জানার পরও কি এলোকেশী তাকে মেনে নেবে? একবারও ফিরে তাকাবে? বিশ্বাস তো কবেই ভেঙে গেছে এবার কি তার চোখেও থাকবে না তাকবীরের কোনো অস্তিত্ব? সে অনেক কিছু ছেড়ে দিলেও পারেনি অনেক কিছু ছাড়তে। প্রতিশোধের আগুনে সে পুড়েছে, ছাই হয়েছে অথচ মুক্ত হতে পারেনি। এই প্রতিহিংসাই তাকে এলোকেশীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আজ। তাকে নিজের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
‘ছোটবেলা থেকেই তাকবীরের গানের গলা ছিল অপূর্ব। আজ এই বিভীষিকাময় মুহূর্তেও তার কেবলই গান গাইতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করল না নিজেকে মুক্ত করছে। ধ্বংসের ভয় তাকে এতটা কাবু করতে পারেনি, যতটা করেছে এলোকেশীকে হারানোর আশঙ্কা। বুকের গহীনে জ্বলে ওঠা শূন্যতার দহন মুছতে সে গেয়ে ওঠে,
“ও ভ্রমর রে…
কইও কইও কইও রে ভ্রমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যাইমু কৃষ্ণহারা হইয়া রে,
ভ্রমর কইও গিয়া…
‘হঠাৎ মাথার ওপর থেকে জালটা খসে পড়ল। তাকবীরের ভারি পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো নীরব রাস্তায়। এক পা, দুই পা… সামনে এগোতেই এরিক পথ রোধ করল। কোলে সাদা গেঞ্জিতে মোড়ানো এক নবজাতক। লাল টুকটুকে ঠোঁট, ছোট ছোট চোখগুলো একদম এরিকের মতো। বাচ্চাটার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে ফাঁপা দৃষ্টিতে তাকবীর চাইল এরিকের চোখে। তাহলে এটাই ছিল সোয়াট টিমের মিশন? পুরো ছক বুঝতে বেশি সময় লাগল না তাকবীরের। কিন্তু সে তো এই শিশুকে নিজের করে চায়নি! সে চেয়েছিল এই শিশুর হাত ধরে এলোকেশীর শূন্য কোল পূর্ণ করে তাকে নিজের করে নিতে। তাকবীরের ভিতর তখনও শুধু এলিজাবেথ’কে হারিয়ে ফেলার ই ভয়।
‘এরিক কোনো কথা না বলে হঠাৎ একটা নীল ফাইল ছুড়ে দিল তাকবীরের মুখের ওপর। তাকবীর সেটাকে হাতে তুলে নিল। শরীরটা যেন মৃতপ্রায়। এরিক শিশুটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
“মৃত্যু তোকে অনেক সহজ শাস্তি হতো। তাই তোকে জীবন দিয়ে গেলাম। তবু তুই বাঁচবি না। তোর পাপের শাস্তি তুই দুনিয়াতেই উপভোগ করবি।”
‘চলে গেল এরিক তাকবীরের শরীরের থুতু ছুঁড়ে। তাকবীর নিস্তেজ ভঙ্গিতে ফাইলের দিকে তাকাল। এক ঝটকায় যেন সমস্ত রক্তে শিহরণ বয়ে গেল। পায়ের তলানি কেঁপে উঠল। সেখানে দুটি রিপোর্ট—একটা ডেড সার্টিফিকেট, আরেকটা ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট। তার দৃষ্টি থমকে গেল মোটা করে লেখা “ডিএনএ পজিটিভ” শব্দের ওপর। হাত দুটো অসাড় হয়ে ঝুলে পড়ল। তাহলে কি তার এতদিনের সংগ্রাম ভুল মানুষের জন্য ছিল? পুরো জীবনই বৃথা গেল?
‘তাকবীর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নির্জন রাস্তায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসতে লাগল এক মালবাহী লরি। গাড়ির হর্ন তার কানে পৌঁছায় না। সে নিস্তেজ! একটা ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে যেন। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
“ভালো মানুষ, কি করছেন আপনি?”
‘এলোকেশীর সেই ডাকেও আজ সাড়া দিল না তাকবীর।এলিজাবেথ ছুটে আসছে! চোখে ভয়। পেছনে রিচার্ড গাড়ির ভেতর বসে শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাকবীরের দিকে। বৃষ্টি বাড়ছে, পিচঢালা রাস্তা ভিজে চকচক করছে। এলিজাবেথ পৌঁছে টানতে লাগল তাকবীরকে! ওকে রাস্তার মাঝখান থেকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তাকবীর নড়ে না। তার পা যেন আজ রাস্তার সঙ্গে শেকলবন্দি হয়ে গেছে ।
“আপনি এটা কি করছেন? আপনি এমনটা করতে পারেন না!”
“কি করছেন আপনি? কেন এমন করছেন? সরে আসুন!”
‘এলিজাবেথ শত চেষ্টা করেও এক ইঞ্চি সরাতে পারল না তাকবীরকে। কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“আপনি এভাবে মরতে পারেন না! আমার অনেক প্রশ্ন আছে আপনার কাছে! আমার ড্যাডের নাম ওই ফাইলগুলোতে কেন ছিল? বলুন না!”
‘তাকবীর যেন নিস্তব্ধতার গভীরে তলিয়ে আছে। রিচার্ড দূর থেকে দেখছে সব। তার অভিব্যক্তিতে চাপা ক্ষোভ।এলিজাবেথ এবার বাধ্য হয়ে তাকবীরের পেছনে দাঁড়াল ঢাল হয়ে। লরির তির্যক আলো চোখে পড়তেই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। ঠিক তখনই তাকবীর টলল। এলিজাবেথকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল লরির পথ থেকে। নিজেও ছিটকে পড়ে গেল। তাকবীরের মাথা গিয়ে আঘাত করল একটা ইটের ওপর। মুহূর্তেই কপাল চিরে গেল! গাঢ় লাল রক্ত গড়িয়ে নামল রাস্তায়। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যেতে লাগল সেই অভিশপ্ত রক্ত।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫২ (২)
‘এলিজাবেথ ছুটে গিয়ে তাকবীরের কাছে পৌঁছাল। মানুষটা যেন কাঁদার সাথে মিশে যাচ্ছে। শারীরিক ক্ষত ও মানসিক যন্ত্রণা এক হয়ে তাকে জর্জরিত করছে। এতো বড় ধাক্কা আর রক্তক্ষরণে ভার শরীর আর সইতে পারল না। এলিজাবেথ অবাক হয়ে তাকবীরের মাথা নিজের কোলে তুলে কাটা জায়গায় চেপে ধরল। তবুও রক্তক্ষরণ থামে না। হঠাৎ চোখ গেল পাশে পড়ে থাকা রিপোর্টটার দিকে। বৃষ্টির পানিতে উপরের লেখাগুলো মুছে গেলেও নিচের লেখা এখনও স্পষ্ট। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট দেখার সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথের হাত থেকে ফাইলটা ছিটকে পড়ল। অবাক হয়ে তাকাল তাকবীরের দিকে। রক্তের তোড় ক্রমশ বাড়ছে। রক্ত শূণ্যতায় তাকবীরের শ্যাম বর্ণ নীলাভ রূপ ধারণ করছে। রিচার্ড এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। এলিজাবেথ উঠে গিয়ে রিচার্ডের বাহু আঁকড়ে ধরল। আহাজারির স্বরে বলতে থাকল,
“প্লিজ, ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। লোকটা মারা যাবে! এত পাষাণ হবেন না। আপনারই তো ভাই!”