ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৪

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৪
মিথুবুড়ি

‘ফিনফিনে সাদা চাদরের বিছানায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে তাকবীর। মাথার দগদগে ক্ষত ব্যান্ডেজে মোড়ানো! যার ওপর লাল ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বেঁধেছে। এখনো চেতনা ফেরেনি তাকবীরের। বেডের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে এলিজাবেথ, হাতে ভেজা রিপোর্টটি এখনো শক্ত করে ধরা। কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিচার্ডের মুখে অস্বাভাবিক এক টান। কেমন ফ্যাকাসে অথচ অভিব্যক্তি পাথরের মতো শক্ত। হঠাৎ এলিজাবেথ মুখ ফিরিয়ে তাকাল রিচার্ডের দিকে। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“আপনি জানতেন না উনি আপনার ভাই?”
‘রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল৷ নিমিষেই দৃষ্টিতে কঠোরতা নেমে এলো। দীর্ঘদিন পর এই দৃষ্টি ফেরাল রিচার্ড এলিজাবেথের দিকে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“সে আমার ভাই না।”
‘এলিজাবেথ হাত তুলল উপরে। রিপোর্টের নিচের অংশটি রিচার্ডের চোখের সামনে মেলে ধরল। কাগজের ওপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা,
DNA Sibling Test Report
Tested Individuals: Richard [Last Name] & Takbir [Last Name]
RESULT: Probability of Full Sibling Relationship = 99.99% (Strong evidence supports that they are full biological siblings)
‘এলিজাবেথ চিবুক উঁচিয়ে এতোটাই ঠান্ডা স্বরে পড়ল যেন প্রতিটি শব্দ রিচার্ডের বুকের ভেতর ছুরি হয়ে বিধে যায়।হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে কালো পোশাকধারী কয়েকজন প্রবেশ করল কেবিনে। সকলের হাতে মরণশীল অস্ত্র। এরা রাশিয়ান মাফিয়া। রাজায় ক্ষমতা ততক্ষণই যতক্ষণ মাথায় মুকুট থাকে। তাকবীর মাফিয়া জগত থেকে বেরিয়ে এসেছিল, যখন সে তার এলোকেশীর জন্য সমস্ত কালো ব্যবস্থা বাদ দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ পাপ ছাড়লেও, পাপ মানুষকে ছাড়তে চায় না। আজ তাকবীরের শত্রুপক্ষ তাকে হিসাব চুকানোর জন্য হাজির হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন রিচার্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের সবাইকে একবার দেখে নিল রিচার্ড। সামনের লোকটি নতজানু হয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“Hey dude, we have no issue with you… This is our personal matter. Let us take him with us.”
‘রিচার্ড কোনো উত্তর দিল না। এলিজাবেথ ঘাবড়ে গিয়ে ছুটে গেল তাকবীরের কাছে। কিন্তু রিচার্ড ওর হাত চেপে ধরে শক্ত করে। চেঁচিয়ে উঠল এলিজাবেথ। কয়েকজন এগিয়ে গেল তাকবীরের বেডের দিকে। রিচার্ড ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক অথচ পাথরের মতো কঠিন। শূন্য দৃষ্টিতে জমে থাকা ক্রোধের পাহাড় স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। একজন যখন তাকবীরের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরল ঠিক তখনই বিকট শব্দে কেঁপে উঠল করিডর। রেলিং থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো সিমেন্ট ঝরে পড়ছে। রিচার্ডের রিভলভার ওপরে তাক করা। লোকগুলো কেঁপে উঠে। রিচার্ড বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“Don’t touch him. He is my blood”

‘এলিজাবেথ প্রকম্পিত দৃষ্টিতে তাকাল রিচার্ডের দিকে। লোকগুলো একবার ঠান্ডা ঢোক গিলে আবারও তাকবীরকে তুলতে এগিয়ে এলো, কারণ তাদের বসের অডার এটা। আবারও তারা তাকবীরের কলার টেনে ধরল, ঠিক তখনই এক দলা মস্তক ছিটকে গিয়ে পড়ল সাদা দেয়ালে। লোকটার হাত তাকবীরের কলার থেকে আলাদা হয়ে শরীর ছিটকে পড়ল মেঝেতে। কার্নিশ কোণে সরু ছিদ্র থেকে ধোঁয়া বেরোল। চারপাশ মুহূর্তেই রক্তে সিক্ত হয়ে যায়। পরপর হতে থাকে একের পর এক বিকট শব্দ। এলিজাবেথ মুখ গুঁজে রিচার্ডের বাহুতে। চারজন পড়ে রইল মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায়৷ প্রাণপাখি ছটফট করার সুযোগটুকুও পায়নি । গুলির শব্দে রিচার্ডের গার্ডরা ছুটে এল ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে সকলে বন্দুক তাক করে বাকি মাফিয়াদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ফেলে। রিচার্ড ধোঁয়া বের হতে থাকা বন্দুকের নলে ফুঁ দিয়ে সেটি পকেটে রাখতে রাখতে গার্ডদের উদ্দেশে বলল,
“তাদের বিশেষ খাতিরযত্নের ব্যবস্থা কর। শ্বশুরবাড়ির দেশের লোক, অনেক দূর থেকে এসেছে। শ্লারা রিচার্ড কায়নাতের রক্তকে সহজ ভেবে বসেছিল।”

‘গার্ডরা লাশ সরিয়ে বাকিদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। রাত গভীর হতে থাকে। রিচার্ডের চোখে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে জমে রইল। এলিজাবেথ এবার সরাসরি গিয়ে দাঁড়াল রিচার্ডের সম্মুখে।
“এখনও বলবেন আপনি কিছু জানেন না?”
‘রিচার্ড স্তব্ধ। দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ে থাকে এলিজাবেথের দিকে। চোখে দগদগে আগুন। তবে এলিজাবেথ আজ একটুও পিছুপা হয় না। গা ভর্তি দৃঢ়তায় সে এগিয়ে যায় রিচার্ডের কাছে। উঁচু গলায় বলে,
“আপনি সত্যটা শুরু থেকে জানতেন, তাই না?”
‘বিপরীত পাশ থেকে এবারও কোনো জবাব আসে না। এলিজাবেথের ধৈর্য হারিয়ে যায়। সে চেঁচিয়ে উঠল,
“চুপ করে থাকবেন না। সত্যিটা বলুন—একটুও কষ্ট হচ্ছে না আপনার নিজের রক্তকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে?”
‘রিচার্ড সটান দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় গম্ভীর কণ্ঠে আওড়াল,

“নিজের রক্তের খুনির জন্য কষ্ট হয় না কারোর ।”
‘এলিজাবেথ চমকে উঠে, “রক্তের খুনি মানে?”
‘রিচার্ড এবার তেড়ে গিয়ে এলিজাবেথের কব্জি চেপে ধরল। আঙ্গুলগুলো প্রবল শক্তিতে খেঁচে যাচ্ছিল। কণ্ঠ ক্রমে আরও হিংস্র হতে থাকে, “তুই জানিস, কার জন্য মায়া দেখাচ্ছিস তুই? সে একটা রেপিস্ট, খুনি, নিজের মায়ের খুনি।”
‘এলিজাবেথের পা পিছিয়ে যায়, “নিজের মায়ের খুনি মানে?”
‘রিচার্ড আরও শক্ত করে চেপে ধরে এলিজাবেথের কব্জি। নখ গেঁথে যায় এলিজাবেথের চামড়ায়।
“এই জানোয়ারটা নিজের মায়ের খুনি।”
‘এলিজাবেথের পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। চোখে অন্ধকার! কণ্ঠে যেন দম আটকে যায়। সে কি শুনছে?
“মা—মানে?”

‘রিচার্ডের চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। রক্তের ক্ষুধায় জ্বালা করা কণ্ঠে হুংকার তুলল, “আমাকে রেপিস্ট বলতি তাই নাহ? জানিস এই জানোয়ার কি করেছে?” হাত তুলে তাকবীরের দিকে দেখাল। এলিজাবেথ পেছনে তাকাল। তাকবীরের দিকে—একবার, দুটি—তিনটি দৃষ্টিতে।
“সে একটা রেপিস্ট। রেপ করেছে একটা গর্ভবতী মেয়েকে, দিনের পর দিন।”
‘এলিজাবেথের শরীর শিথিল হয়ে যায় সেখানেই। রিচার্ডের কথাগুলো যেন শরীরে তিরের মতো বিঁধে যাচ্ছে। কান, মস্তিষ্ক, হৃদয়—সব কিছু ভেঙে পড়তে থাকে। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে আহত স্বর, “কি-কিহ?”
‘রিচার্ড ঝাড়ি মেরে এলিজাবেথের হাত ছেড়ে দিল। এলিজাবেথ ছিটকে গিয়ে পড়ল সোফায়। রিচার্ডের কালচে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। এলিজাবেথের চোখের পানি শুকিয়ে আসে, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের দিকে। তার দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় রিচার্ডের অস্তিত্ব।রিচার্ড হাঁপাচ্ছে। গা থেকে তাপ নির্গত হচ্ছে। এলিজাবেথের অবিস্মরণীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে থাকল অজানা রহস্যময় অতীতের সমাপ্তীতে কি ঘটেছিল।

‘তাকবীরের ধ্বংসের কারিগর ছিল তাজুয়ার। স্ত্রীর মৃত্যু তাকে এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে সন্তানের কথা ভাবারও ফুরসত মেলেনি। নিজ হাতে গড়ে তুলেছিল এক ভয়ংকর পশু—তাকবীর। যে কখনো এমন হতে চায়নি, তাকে এমনটা বানানো হয়েছে। প্রথমদিকে প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হয়েই একের পর এক খুন করেছিল তাকবীর। কিন্তু তখনও তার ভেতরে কোমল একটা হৃদয় ছিল। তাজুয়ার সেই হৃদয়টাকে নিজ হাতে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। তাকবীর যখনই রক্ত ঝরাতে অস্বীকার করত, যখনই তাজুয়ারের আদেশের বিরুদ্ধে যেত তখনই তাকে বন্দি করে রাখা হতো সেই ভয়ংকর ‘ঠিকানা’ নামক ঘরে। দিনের পর দিন, আলোহীন অন্ধকারে। সেখানে দেয়ালে ঝুলত মা-বোনের রক্তমাখা ছবি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত তাকবীরের, সে চিৎকার করত, খিদেয় কাঁদত, তবুও দরজা খোলা হতো না যতক্ষণ না সে তাজুয়ারের কথা মেনে নিত। এভাবেই ধাপে ধাপে তাকবীর হয়ে উঠেছিল ভুবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষ।

‘এই নৃশংসতা থেকে যেন সে কখনো বের হতে না পারে তাই তাজুয়ার তাকে বেঁধে রাখল প্রতিশোধের শেকলে। সেই ভয়াবহ দৃশ্যগুলো যেন কখনো মুছে না যায় তাই সেই রক্তমাখা ছবি জুড়ে দিয়েছিল তাকবীরের অস্তিত্বের সাথে।দেওয়ান মঞ্জিলে এলিজাবেথ যেদিন বালিশের নিচ থেকে সেই ভয়ংকর ছবিটা খুঁজে পেয়েছিল তখনও তাকবীর তা বয়ে বেড়াচ্ছিল নিজের হিংস্রতাকে ধরে রাখার জন্য। যখনই তার পৈশাচিক সত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হতো, যখনই একটু মানবিকতা উঁকি দিত তখনই সেই অতীতের বিভীষিকাময় স্মৃতি তাকে শেকল পরিয়ে দিত ছবিটির মাধ্যমে। ছায়া-মালতির নিথর দেহ… উরুর মাঝে পড়ে থাকা নিষ্পাপ শিশু আলো… সেই দৃশ্য নরকযন্ত্রণার মতো তাড়া করত তাকবীরকে।

‘তাই তো একসময় সে স্বাচ্ছন্দ্যে সেই ছবিটাকে নিজের সঙ্গী করে নিয়েছিল তাকবীর। তবে যখন ভালোবাসার কোমল পরশ তার শুষ্ক হৃদয়ে প্রথম স্পর্শ রাখল তখনই পরিবর্তনটা শুরু হলো। সে ছবিটা আর পকেটে রাখত না বরং স্থান বদলে চলে গিয়েছিল বালিশের নিচে—একটা ধীর পরিবর্তনের নিঃশব্দ স্বাক্ষী হয়ে। তাকবীর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছিল সমস্ত পাপ থেকে। সে ফিরতে চেয়েছিল অন্ধকার থেকে আলোতে।তবে এক জিনিস তখনও ছাড়তে পারেনি প্রতিশোধের আগুন। আর সেই আগুনে জ্বলছিল এক নাম নাতাশা। নাতাশা ছিল সেই ওসির মেয়ে যে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল ছায়া মালতিকে সঙ্গে তার গর্ভের শিশুটিকেও। তাকবীর ওসির পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেও পারেনি নাতাশাকে স্পর্শ করতে। কারণ সে তখন ছিল নানা বাড়িতে।

‘যেদিন ওসির পুরো পরিবার রহস্যজনকভাবে একসঙ্গে মারা যায় সেদিন থেকেই চারপাশে ভয় আর সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে। ওসির চরিত্র আগেই কলঙ্কিত ছিল তাই সবাই বুঝতে পেরেছিল এটা কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়। ভয় আর শঙ্কায় নাতাশাকে তার মামার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ায়। তারপর নাতাশা আর কখনো দেশে ফেরেনি।তাকবীর খুঁজেছে তাকে, বহুবার। পাগলের মতো খুঁজেতে প্রতিশোধস্পৃহায়। যখন তাকে কোথাও পেল না তখন প্রতিশোধের নেশায় জ্বালিয়ে দিয়েছিল নাতাশার নানা বাড়ি। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল নাতাশার নানা-নানি।

এরপরই শুরু হয় লুকিয়ে থাকার খেলা। আত্মরক্ষার জন্য নাতাশার পরিচয় মুছে ফেলা হয়। নাতাশা থেকে হয়ে ওঠে নাশা। এই পরিকল্পনা ছিল নাতাশার মামার শুধুমাত্র নাতাশাকে রক্ষা করার জন্য।
‘এভাবেই কেটে যায় বহু বছর, শান্তিতে, নিঃশব্দে। তবে সেই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অতীত কখনো সত্যিকারের শান্তি দেয় না বরং অপেক্ষা করে একটা সঠিক সময়ের যখন সে আবার ছায়ার মতো ফিরে আসে,ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতিকে আবারও জাগিয়ে তুলতে। আট মাস আগে নাতাশার খবর পেয়ে তাকবীর ওকে তুলে নিয়ে আসে বাংলাদেশে। বন্দি করে সেই অন্ধকারে ঘেরা বেজমেন্টে। নাতাশার দুঃস্বপ্নের শুরু সেদিন যেদিন তাকবীর প্রথমবার তাকে বেজমেন্টে নামিয়ে নিয়ে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা নাতাশার ক্লান্ত, শঙ্কিত চোখের দিকে তাকিয়ে তাজুয়ারের মনে জেগে ওঠে অতীতের এক রক্তাক্ত স্মৃতি ছায়া মালতীর অসহায় মুখ, রক্তাক্ত আলো। আর সেই রাতেই নাতাশার উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। তাজুয়ার, যে তার ছায়া মালতীকে হারানোর পর পরিণত হয়েছিল এক নরখাদকে পরবর্তীতে নিজে সে গড়ে তোলে আরেক নরখাদক—তাকবীর দেওয়ান। পৈশাচিক আনন্দে তাকবীরকে উসকে দেয়! ফিসফিস করে প্রতিশোধের বিষ ঢেলে দেয় তার রক্তে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি তাকবীর। নরপিশাচের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নাতাশার উপর। তবে সেটাই ছিল প্রথম ও শেষ। এরপর আর কখনো সে স্পর্শ করেনি নাতাশাকে। তবে নির্যাতনের পরিসমাপ্তি ঘটেনি।

‘সময়ের সাথে বদলে যেতে থাকে নাতাশা আর একদিন প্রকাশ পায় সেই নিদারুণ সত্য—নাতাশা গর্ভবতী। এই সংবাদ শুনে তাকবীর বিষণ্ণ হয়ে পড়লেও তাজুয়ারের চোখে জ্বলে ওঠে উন্মাদ উল্লাস। সময় যেন ঘুরে ফিরে এসেছে! সাতাশ বছর আগে যেমনটি ঘটেছিল ছায়া মালতীর সঙ্গে এবার তা পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে নাতাশার জীবনে। গর্ভবতী অবস্থায়ও তার উপর নেমে আসে তাজুয়ারের পাশবিক নির্যাতন। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন একই গল্পের নির্মম পুনরাবৃত্তি। তবে তাকবীর বদলে যাচ্ছিল। তখন তার মনে এলিজাবেথের প্রতি তার মনে জন্ম নিয়েছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ—এক ধরনের শুদ্ধ, পবিত্র অনুভূতি। নিজেকে মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করে তাকবীর। লক্ষ ওই লাল চুলের মেয়েটার জন্য তার হিংস্র হৃদয়ে অস্থিরতা কাজ করে। এক লাস্যময়ী শীর্নকায় নারীর সংস্পর্শে স্তম্ভিত হয়েছিল তাকবীর। ধীরে ধীরে কোমল হতে থাকে তার হৃদয়। কিন্তু সেই কোমলতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। অতীত যখন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যেত, সে আবার ফিরে আসত বেজমেন্টে, পৈশাচিক উন্মাদনায় ঝাঁপিয়ে পড়ত নাতাশার উপর। নানান ভাবে অত্যাচার করত।

‘এই শহরের জৌলুসের আড়ালে কেউ জানতেও পারেনি এক বিশাল ক্যাসিনোর অন্ধকার গহ্বরে কী ভয়াবহ অধ্যায় রচিত হচ্ছে। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে, নরখাদক হয়ে ওঠা তাজুয়ার আর তাকবীর সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের নির্মম প্রতিশোধ। তবে খেলার গুটি উল্টো ঘুরে তখন যখন রিচার্ড মাঠে নামে। রিচার্ড শুরু করল তার খেলা। বাপ-ছেলে তাকবীর আর তাজুয়ার বুঝতেই পারল না কখন তাদের বিরুদ্ধে চাল চলে গেছে। তবে প্রশ্ন দাঁড়াল রিচার্ড কিভাবে জানতে পারল সেই সত্যটা। রিচার্ড যেদিন বিটিআর ক্যাসিনোতে কাদেরকে ধরতে গিয়েছিল সেদিন ভাগ্যের এক অদ্ভুত খেলায় ভেতরে পাঠানো হিডেন ক্যামেরাগুলোর একটি পৌঁছে যায় বেজমেন্ট পর্যন্ত।

এমনটা হওয়ার কথা ছিল না,সম্ভবও ছিল না।কিন্তু পাপ যেন নিজেই মুখোশ খুলে সামনে আসতে চেয়েছিল। লুকাস যখন সেই ফুটেজ দেখায় রিচার্ডের দৃষ্টি আটকে যায় বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত এক মেয়ের মুখে। মুহূর্তেই চিনে ফেলে ‘নাতাশা’! কিন্তু সবচেয়ে বেশি স্তব্ধ করে দেয় নাতাশার ফোলা পেট। সব হিসাব যেন ওলট-পালট হয়ে যায় এক মুহূর্তে। সেই রাতেই রিচার্ড সিদ্ধান্ত নেয় তাকবীরকে ধরার খেলা আর আগের মতো হবে না। এবার শুরু হবে তার নিজের খেলা।তাকবীরের জীবন, তার নাড়িভুঁড়ির প্রতিটি বাঁক রিচার্ডের মুখস্থ ছিল। তাকবীরের অতীত ঘাঁটতে গিয়েই রিচার্ড জেনেছিল নাতাশার ব্যাপারে। জানতে পারে যে নাতাশা মাসের পর মাস নিখোঁজ। গোপনে লোক লাগিয়েও কোনো খোঁজ পায়নি এতদিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সত্য নিজেই এসে ধরা দিল তার হাতে। কিন্তু রিচার্ড নিজে মাঠে নামেনি। মাঠে নামায় সোয়াট টিম। বিশেষ তত্ত্বাবধানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টাকা খাইয়ে বাংলাদেশে আনায় সোয়াট টিম, বিশেষ মিশনের উদ্দেশ্য। সোয়াট টিম যে বিশেষ মিশনে এসেছে সেটা বুঝতে পারেনি কেউ। কারণ সেই মিশন একেবারে গোপন আর সেটার পেছনে ছিল রিচার্ড নিজে। উদ্দেশ্য একটাই নাতাশাকে উদ্ধার করা।
‘আর এই টিমের লিডার? এরিক। নাতাশার হাসবেন্ড।

একই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করত তারা। সেখান থেকেই পরিচয়, বন্ধুত্ব, প্রেম—তারপর বিয়ে। নাতাশা তখন জার্নালিজম নিয়ে পড়ছিল আর এরিক ছিল সিক্রেট এজেন্ট। তাদের সংসার ভালোই চলছিল। নাতাশা কখনোই এরিককে তার অতীত বলেনি আর এরিকও কখনো জানতে চায়নি। তার কাছে নাতাশা মানেই ভালোবাসা আর কিছু না।কিন্তু সেই ভালোবাসার গল্পটা এক মুহূর্তে বদলে যায় যখন হঠাৎ একদিন নাতাশা হারিয়ে যায়।এরিক পাগলের মতো খুঁজেছে নাতাশাকে।একবার নয়, বারবার বাংলাদেশেও এসেছে কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায়নি নাতাশাকে। কারণ তাকবীরের প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল নিখুঁত, এতটাই নিখুঁত যে এরিকের মতো একজন সিক্রেট এজেন্টও তার নাগাল পায়নি।

‘কিন্তু এবার খেলা বদলে গেছে। এবার চাল দিচ্ছে রিচার্ড।রিচার্ড চাইলে নিজেই নাতাশাকে উদ্ধার করে সব সত্য সামনে আনতে পারত। কিন্তু সে তা করেনি। বরং কৌশলে সোয়াট টিমকে তাকবীরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তাকে ব্যস্ত করে ফেলে। এতে করে সে নিজের মতো করে এলিজাবেথের পাশে থাকতে পারে, ধীরে ধীরে তাকে শক্ত করতে পারে, যাতে একসঙ্গে সব সত্য সামনে এলে সে ভেঙে না পড়ে। এবং নিজেদের মধ্যেকার দূরত্ব মোচন করতে পারে।

‘তাকবীরের অতীতের প্রতিটি অন্ধকার অধ্যায় যেন এলিজাবেথের সামনে পর্দার মতো একে একে উন্মোচিত হয়, তাই রিচার্ড পরিকল্পনা করে সোয়াট টিমকে কাজে লাগানোর। তাদের কাজ ছিল কেবল তাকবীরের গোপন সত্য উদ্ঘাটন করা। কিন্তু এমনভাবে যাতে সাপও না মরে, লাঠিও না ভাঙে। এরিক, যে নাতাশাকে খুঁজতে গিয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠেছিল একদিন আচমকা রিচার্ডের ফোন পায়। এরিক ঠান্ডা মাথার হলেও ভয়ংকর ছিল, তাই রিচার্ড প্রথমেই শর্ত জুড়ে দেয়।
“তারা শুধু তাকবীরের অতীত তুলে ধরবে, এলিজাবেথের সামনে একে একে উন্মোচিত করবে। কিন্তু আমার পথে আসবে না। নাতাশাকে উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে দেশ ছাড়তে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাকবীরকে তারা মারতে পারবে না।”

‘প্রথমে এই শর্তে রাজি হতে চায়নি এরিক। তার ক্ষোভ ছিল প্রবল কিন্তু নাতাশার জন্য বাধ্য হয়। তাই এরিকের চোখে ক্ষোভের দাহ জ্বলতে থাকলেও সে রিচার্ডের শর্ত মেনে নেয়। রিচার্ড তাদের পথের দিশা দেখিয়ে দেয়, সেই পথ ধরে শেষ অবধি যাওয়া ছিল সোয়াট টিমের কাজ। অবশেষে সোয়াট টিম তাদের কাজ শুরু করে। একে একে তারা খুঁজে বের করে তাকবীরের অতীতের ভয়ংকর অধ্যায়। সেই সব অন্ধকার সত্য গুছিয়ে, প্রমাণসমেত পার্সেল করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এলিজাবেথের কাছে। তখন থেকেই অপেক্ষা শুরু হয়।এলিজাবেথ কতটা প্রস্তুত এই ধাক্কা সহ্য করার জন্য এবং তাকবীর, যে এতদিন নিজের অতীত আড়ালে রেখেছিল সে কীভাবে এই সত্যের মুখোমুখি হবে। ধীরে ধীরে এরিক তাকবীরের সকল পাপ প্রকাশ্যে আনতে শুরু করে। আঠার মতো লেগে যায় তাকবীরের পিছনে। এভাবেই একদিন নাশতার সন্ধান পায় এরিক। আর সেই লোমহর্ষক অতীতের বহনকারী চিহ্ন মুছে দেওয়া হয়।

‘এরিক চাইলে আরও আগেই নাতাশাকে উদ্ধার করতে পারত. কিন্তু সে অপেক্ষা করছিল রিচার্ডের অডারের। রিচার্ড আশ্বাস দিয়েছিল নাতাশার উপর আর কোনো অত্যাচার হবে না কারণ সে নিজেই তাজুয়ারকে শেষ করে দিয়েছিল। এছাড়া রিচার্ড জানত এলিজাবেথ তাকবীরের জীবনে আসার পর তিন মাসের ভিতর একদিন তাকবীর বেজমেন্টে যায়নি। রির্চাড অপেক্ষা করছিল সঠিক মুহূর্তের, যখন সব প্রমাণ একসঙ্গে সামনে আনা যাবে। কিন্তু সেই সময়ের মাঝেও দ্বিধার অন্ধকার রিচার্ড’কে গ্রাস করেছিল। সবকিছু যেন ঝুলে ছিল এক অজানা সিদ্ধান্তের দোটানায়।কিন্তু হঠাৎ করেই সব বদলে যায়। এমন কিছু ঘটে, যা রিচার্ডকে আর অপেক্ষা করতে দেয়নি। সে একরাতে এরিককে জানায় সময় শেষ। আজ রাতেই তাকবীরের অতীত ও তার ভয়ংকর কাজ সামনে আনতে হবে। যে সত্য এতদিন অন্ধকারে ছিল আজ তা জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠবে।

‘আর বাকি রইল, বাচ্চাটার কথা। রিচার্ড কেন সেদিন বলেছিল,
“যাকে নিজের সন্তান ভাবছিস, আদৌও তার শরীরে তোর রক্ত বইছে নাকি?”
‘এই প্রশ্নের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ংকর সত্য। যা তাকবীর কখনো কল্পনাও করেনি।এই সন্তান ছিল এরিকের!কিন্তু রিচার্ড তা জানল কীভাবে? নাতাশা অপহৃত হওয়ার আগের মুহূর্তেই সে জানতে পারে তার শরীরে নতুন প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়েছে। মাতৃত্বের কিছু ধাঁচ নিজের মধ্যে লক্ষ করে ক্লিনিকে গিয়ে টেস্ট করানোর পর জানতে পেরেছিল সে মা হতে চলেছে! আর এই খবরটা সে প্রথমে একমাত্র এরিককেই জানাতে চেয়েছিল, চমকে দিতে চেয়েছিল তাকে। এরিক তখন ছিল ইরাকে, একটি মিশনে। কিন্তু সেদিনই সব পাল্টে গিয়েছিল। ক্লিনিক থেকে বেরোনোর পরই অপহরণের শিকার হয় নাতাশা। সত্য চাপা পড়ে যায় অন্ধকারের অতলে। সেই দিনের রেকর্ড ঘেঁটেই রিচার্ড বের করে ফেলেছিল আসল সত্য। কিন্তু নাতাশা কখনো বলেনি, বলতে পারেনি। ভয় ছিল যদি তারা জানতে পারে তবে এই নিষ্পাপ প্রাণও তাদের রক্তচক্ষু থেকে রেহাই পাবে না। তাকবীর এবং তাজুয়ার কখনো সন্দেহই হয়নি। তারা ধরেই নিয়েছিল এই বাচ্চা তাকবীরেরই।

‘কিন্তু তাকবীর কখনো বাচ্চাটাকে নিজের সন্তান বলে মেনে নিতে পারেনি। শিশুটির প্রতি তার এক বিন্দুও টান ছিল না। তবে পরিস্থিতি বদলে গেল এলিজাবেথের সন্তান হারানোর পর। শূন্য কোল, শূন্য হৃদয় নিয়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল এলিজাবেথ। তাকবীর দেখল, অনুভব করল, আর সিদ্ধান্ত নিল এই সন্তান সে এলিজাবেথকে দেবে। ওর শূন্যতা পূরণ করবে, ওর শোক মুছে দেবে। আর এর বিনিময়ে? সে ফিরে পাবে তার এলোকেশীকে। ভেবেছিল মাতৃত্বের টান তাকে রিচার্ডের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকবীরের বুকে এনে ফেলবে। ভালোবাসার এক অন্ধ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল তাকবীর। ভুলে গিয়েছিল,

“ভালোবাসা কখনোই শর্তে বাঁধা যায় না। ভালোবাসা কিনতে গেলে, একদিন সে ধূলিসাৎ হয়েই ফিরে আসে।”
‘ধপ করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ হল। রিচার্ড চকিতে পিছন ফিরে। এলিজাবেথ মেঝেতে বসে পড়েছে। মাথাটা নিচু।আঁখি দু’টো টইটম্বুর। কিন্তু এক ফোঁটাও পড়তে দিচ্ছে না। যেন চোখের কান্না আটকে রাখার শেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। তবুও দূর্বোধ্য শরীরের ভাষা যেন বলে দিচ্ছে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। পায়ের তলাটা কাঁপছে, ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে শরীর। রিচার্ড তপ্ত শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। এক হাঁটু গেড়ে বসল এলিজাবেথের সামনে। কব্জি ধরে শক্ত গলায় বলল,

“রেড উঠো।”
‘এলিজাবেথের শরীর যেন জমে গেছে মেঝেতে। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ! ঠোঁটের কোণে শূন্যতার ছায়া। হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল পুরো শরীর। সারা শরীর কাঁপছে, দাঁতে দাঁতে ঠোক্কর লেগে এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি হয়। একবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল পিছনে। ঝাপসা দৃষ্টিতে ঠিকঠাক কিছুই দেখা যাচ্ছে না কেবল একজোড়া পা। তাকবীরের পা!এলিজাবেথ আবার ফিরল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ডের অভিব্যক্তি বরাবরের মতোই কঠিন, নিরপেক্ষ, এক ধূসর দেয়ালের মতো। হাসি নেই, রাগ নেই, দুঃখও নেই।
এলিজাবেথ ফিসফিস করল নিঃশেষ কণ্ঠে,
“সম্পূর্ণ করুন।”

‘রিচার্ডের চোখ সংকীর্ণ হয়ে এল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ হল এলিজাবেথের মুখে। এলিজাবেথ আবার বলল, এবার আরও স্পষ্ট আরও শূন্যতায় মোড়া কণ্ঠে,
“আপনাদের মধ্যেকার রক্তের সম্পর্ক… উনি আপনার ভাই।”
‘রিচার্ডের আজ আর কিছুই গোপন করতে ইচ্ছে করল না।

সে এলিজাবেথকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতীতের সব অমীমাংসিত রহস্য আজ আর গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। রিচার্ড বলতে শুরু করল এক গল্প, যা এতদিন শুধু রক্তের গভীরে চাপা ছিল।
‘রিচার্ড ও তাকবীরের অতীত যদিও আলাদা তবুও তাদের জন্ম ছিল এক নারীর গর্ভে। রিচার্ডের জন্মের আগে তার যেই ভাই জন্মগ্রহণ করেছিল সে আর কেউ ছিল না, সে তাকবীর। তবে ভাগ্যের পরিহাসে সে বাচ্চা মারা যায়নি বরং কোল পরিবর্তন হয়েছিল। সেইদিনে ছায়া মালতি নামে এক নারী যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, কাকতালীয়ভাবে একই দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আয়েশা বেলীও। ছালা মালতি জন্ম দিয়েছিলেন মৃত সন্তানে আর বেলী পেয়েছিলেন সুস্থ, সুন্দর এক সন্তান। ছালা মালতি ছিলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। সন্তান হারানোর শোক সে কোনোদিন তিনি মেনে নিতে পারত না। তাইতো সেই রাতে তাজুয়ার স্ত্রীর কোল ভরাতে গিয়ে অন্য এক মায়ের কোল খালি করে দিয়েছিল। ঘটনাটি রাতের অন্ধকারে ঘটে গিয়েছিল আর সেই সত্য কেউ জানতে পারেনি। এই গোপন সত্য রিচার্ডও কখনো জানত না কিন্তু অবশেষে তা উদ্ঘাটন করে এরিক।রিচার্ড পেয়েছিল তার মায়ের উজ্জ্বল, ফর্সা ত্বক, আর তাকবীর পেয়েছিল মি. রেয়ানের গায়ের শ্যাম বর্ণ। তাদের ভাগ্য কখনোই সহায় ছিল না তাদের প্রতি। তবে ভাগ্য যেন বিশেষভাবে তাকবীরের প্রতি অমঙ্গলের হাত বাড়িয়েছিল।

‘তাকবীর,যে মাকে নিজের মা ভেবে বড় হয়েছে এবং যেই মায়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হয়েছিল, সেই মা তার আসল মা নয়। আর সবচেয়ে বড় চমক হলো সে নিজেই খুন করেছে তার জন্মদাত্রী মা’কে। শুনতে অবাক লাগলেও ভাগ্য এতোটাই কঠোর ছিল তাকবীরের ওপর। রিচার্ডকে হারানোর পর বেলী তার সমস্ত ভুল বুঝতে পেরেছিল। পাপের ফলস্বরূপ,সৃষ্টিকর্তা তাকে দুনিয়াতেই শাস্তি দিতে শুরু করলেন। বেলীর প্রেমিক সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে নিজ দেশে চলে গিয়েছিল। মাথার উপর শেষ ছাউনি হারিয়ে বেলী ছিল নিঃস্ব। ছেলের শোক, স্বামীর শোক, অপরাধবোধ সবকিছু মিলে তার মানসিক ভারসাম্য ভেঙে যায়। পথেই ঘুরে বেড়াতো বেলী। আর এভাবেই একদিন তাকবীরের চোখে পড়ে যায় বেলী।

‘তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাকবীর নিজের মায়ের পেটে ছুরি চালানোর আগ পর্যন্ত, সে জানত না যে যাকে সে মারতে যাচ্ছে সে, তার জন্মদাত্রী মা। এই পৃথিবীতে তার আগমন সেই মায়ের শরীরে বহমান এক কুড়ি রক্তের প্রবাহে। বেলীকে খুন করার পর তাকবীর তার শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে দেয়। প্রকৃতি কাউকেও ছাড় দেয়নি। বেলী তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছিল। আর তাকবীর নিজেও তার পাপের শাস্তি পেয়েছে নিজের জন্মদাত্রী মাকে হত্যা করে। হয়ত তখন সে জানত না। কিন্তু যখন সত্যটা জানবে তখন তার কী অবস্থা হবে?
“আমি আমার মায়ের খুনি?”

‘আহত কণ্ঠস্বরে পিছন ফিরে তাকাল রিচার্ড। তাকবীর উঠে বসে আছে! চোখে জল চিকচিক করছে। রিচার্ডের চোখের দিকে তাকাতেই তাকবীরের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দুটি অশ্রুবিন্দু। আজ সত্য তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। নির্মম, নির্দয় সত্য, যা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দুই ভাইকে। তাদের চোখ যেন আজ বহু বছরের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে এই মুহূর্তে।অকস্মাৎ তীব্র আঘাতে তাকবীরের চোয়ালে পড়ল এক চড়। প্রচণ্ড ধাক্কায় ঘাড় কাত হয়ে গেল তার। তবুও তাকবীর নির্বাক। একটা যান্ত্রিক পুতুলের মতো ঘুরে তাকাল এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথের ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে।পুরো শরীর শিউরে উঠছে বেদনার ভারে। হঠাৎই এলিজাবেথ খামচে ধরল তাকবীরের কলার। চোখে অগ্নিগর্ভ। কণ্ঠস্বর তীব্র বেদনায় বিদীর্ণ।

“আপনি আবারও শর্ত ভাঙলেন। বন্ধুত্বের শর্ত! বিশ্বাসঘাতকতা! কেন? কেননননন??”
‘তাকবীর যেন এখানে থেকেও নেই। তার মাথায় শুধু ঘুরছে রিচার্ডের বলা কথাগুলো। কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে তার। সব শুনেছে সে। প্রতিটি শব্দ বিষের মতো গেঁথে গেছে বুকের গভীরে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কণ্ঠনালি থেকে কোনো শব্দ বের হতে চাইছে না। এলিজাবেথের হাত কাঁপছে। সেই কাঁপা হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরল তাকবীরের কলার। চোখে ঝলসে উঠল ক্রোধ, হতাশা, আর এক নিঃশেষিত ভালোবাসার শেষ চিহ্ন।
“আপনি আত্মসমর্পণের মাঝেও মিথ্যে রেখেছিলেন? এটাই আপনার আত্মার শুদ্ধিকরণ? বলুন, কথা বলুন!”
‘এলিজাবেথের গলা ভেঙে আসে। কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁকাতে থাকে তাকবীরকে।
“এখন চুপ করে থাকবেন না! কিভাবে পারলেন একটা মেয়ের সাথে এমন করতে? একটা মায়ের থেকে তার সন্তানকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিলেন?”

‘কক্ষজুড়ে নেমে আসে এক অস্বাভাবিক নীরবতা। তাকবীর তাকিয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। তার চোখেও জল জমেছে। কিন্তু সেই অশ্রু কোনো মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে না। শুধু গুমরে ওঠা অপরাধবোধ, এক নিদারুণ যন্ত্রণা হয়ে জমাট বেঁধে থাকে বুকের ভেতর।
“এই বিশ্বাসঘাতক এই! কেমন করে পারলেন আমাকে আঁধারের কারাগারে বন্দী করে রাখতে? আমি তো বিনাবাক্যে আপনার সকল অন্যায় মেনে নিয়েছিলাম। সুযোগ দিয়েছিলাম আপনাকে। তবুও কেন আমাকে আজ এই নির্মম যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হলো? কেন আমার অস্তিত্ব এই নিঃসীম কষ্টের ভারে ভারাক্রান্ত? জবাব দিন! আপনাকে জবাব দিতেই হবে!”
‘তাকবীরের কানে কোনো শব্দই পৌঁছাল না। হুট করে তার ঝাপসা দৃষ্টির কেন্দ্রে এলিজাবেথের লাল শাড়ি জ্বলে উঠল দহনশিখার মতো। নিভু স্বরে ফিসফিসিয়ে উঠল তাকবীর,
“তুমি লাল শাড়ি কেন পরেছ এলোকেশী?”
‘তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে এক সুতোয় গেঁথে নিল এলিজাবেথের পা থেকে চুলের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। মুহূর্তখানেক স্তব্ধ থেকে এক গভীর শ্বাস টেনে বলল,
“আজ তোমাকে বরাবরের থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে এলোকেশী। এত সুন্দর যে মৃত্যু এলেও দৃষ্টি সরাতে পারব না।”

‘আরেকটি তীক্ষ্ণ এক চড় প্রতিধ্বনিত হলো ঘরের দেয়ালে। ধূলোর নিচে চাপা পড়া প্রতিটি দুঃখ আজ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এলিজাবেথের কণ্ঠস্বর ফাটল ধরল। কান্না আর রাগে বিদীর্ণ হলো প্রতিটি শব্দ,
“স্রষ্টার নামে কসম কেটেও আপনি মিথ্যে বলেছেন! আপনি মানুষ নন, আপনি এক নির্মম নরখাদক!”
‘নিঃশ্বাস দমকে উঠে। বুকের ভেতর শ্বাস আটকে এল। প্রতিটি নিশ্বাস বিষাক্ত আগুনের শিখায় পরিণত হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে এলিজাবেথ ছটফট করতে থাকে। এতোক্ষণে এগিয়ে এল রিচার্ড। শক্ত হাতে এলিজাবেথকে টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে। এলিজাবেথ তবুও চেঁচিয়ে উঠল। হাত-পা ছুঁড়ে, ছটফট করে! তবু কণ্ঠরোধ হলো না,
“যে বারবার বিশ্বাসে আঘাত করে, তার সঙ্গে কথা বলার তৃষ্ণায় যদি মৃত্যু আসে, তবে আসুক! আমি তবু পিপাসিতই থাকব! তবুও আপনার মুখ দেখতে চাই না।”

‘রিচার্ড এলিজাবেথকে বাইরে বের করে ভিতর থেকে দরজা আটকে দিল। দরজা লক করে রিচার্ড পিছন ঘুরে তাকাল তাকবীরের দিকে। আজ তাকবীরের দৃষ্টি কেমন নিভে আসা কোনো প্রদীপের মতো, ক্লান্ত, মলিন। রিচার্ড ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিটি পদক্ষেপে জুতোর ভারী শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো ঘরজুড়ে। সেই শব্দে যেনো কেঁপে উঠল তাকবীরের বুকের পাঁজর। হঠাৎ ঝড়ের মতো রিচার্ড ঝাঁপিয়ে পড়ল তাকবীরের ওপর। সজোরে এক ঘুষি বসাল তাকবীরের চোয়ালে। ভারসাম্য হারিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল তাকবীর। রিচার্ড কোনো সময় নষ্ট না করে তাকবীরের কলার চেপে ধরে টেনে তুলল। গহীন অরণ্যে লুকিয়ে থাকা হিংস্র শ্বাপদের মতো গর্জে উঠল,
“তোর বোঝা উচিত ছিল, আমার হাতে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তোকে কেন এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি।”
‘তাকবীর এবার প্রথমবারের মতো গভীর দৃষ্টিতে চাইল রিচার্ডের দিকে। আশ্চর্যের বিষয় আজ তার কাছে রিচার্ডকে অচেনা মনে হচ্ছে না। তাদের চেহারায় এক ধরনের সাদৃশ্য পাচ্ছে সে। তার নিজের নিকষ কালো চোখ আর রিচার্ডের সুনীল দৃষ্টি—দুটো আলাদা হয়েও যেন কোথাও গিয়ে এক হয়ে গেছে। রিচার্ড তাকবীরের নাক থেকে গড়িয়ে পড়া
একফোঁটা রক্ত তর্জনীতে তুলে নিল। চোখে গভীরতা! কণ্ঠে নিঃসঙ্গ প্রতিধ্বনি,

“তোকে চাইলে কবেই শেষ করে দিতে পারতাম। জানিস কেন দিইনি?”
‘রিচার্ড এক মুহূর্ত থামল। পরপরই তাকবীরের রক্তের ফোঁটাটি দেখে তাকবীরের চোখের সামনে তুলে ধরল।
“এই রক্তের জন্য! এই রক্তে আমার বাপের অস্তিত্ব আছে। তোর শিরায় বইছে কায়নাত বংশের ধারা। তাই তোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। সময় দিয়েছি, সুযোগ দিয়েছি, যাতে আমাদের রক্ত টিকে থাকে এই পৃথিবীতে। কিন্তু তুই আমার যে-ই বড় ক্ষতি করেছিস, তার জন্য তোকে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। তুই মরবি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মৃত্যু অপেক্ষা করছে তোর জন্য। তবে তোর রক্ত আমি নিজে ঝরাব না। আমি পারব না তোর মতো রক্তের মাঝে রক্ত ঝড়াতে। মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে গেছে। আর সময় নেই।”

‘ বলে তাকবীরকে শেষবারের মতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রিচার্ড। কেবিন থেকে বেরিয়েই রিচার্ড কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই এলিজাবেথকে কোলে তুলে নিল রিচার্ড। আজ মেয়েটার চোখের পানি থামছেই না। কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করছে, এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি বসাচ্ছে রিচার্ডের বুকে। তবে রিচার্ড নির্বিকার। সে লিফটের দিকে না গিয়ে সিঁড়ির অভিমুখে পা বাড়াল। লিফটে গেলে সময় কম কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে গেলে মেয়েটাকে দীর্ঘক্ষণ কোলে রাখতে পারবে। পুরুষ মানুষ তো আবার বরাবরই সুযোগ সন্ধানী। এমনিতে তো বউ তার শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে তার এই অবাধ্য নারীকে স্পর্শ করা যাবে না। আর এখন,এই মুহূর্তে নিষেধের দেয়াল ঠেলে নিজেই অনিচ্ছুক এক আশ্রয়ের মতো ঝিমিয়ে আছে রিচার্ডের বুকে। ধীরে ধীরে নামতে নামতে রিচার্ড নিদারুণ সুরে ডাকল,
“এলি জান।”

‘এতোক্ষণে ছটফটানি খানিক কমেছে এলিজাবেথের। নাক টানতে টানতে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলল, “হুমমম।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠ আশ্চর্যভাবে খুবই নরম হল যেন বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ওপর এক পশলা মায়ার বৃষ্টি,
“চলো তৃতীয়বারের মতো বিয়ে সেরে ফেলি, এবার তোমার মতামত নিয়েই।”
‘হিংস্র কণ্ঠের বিপরীতে এই অপ্রত্যাশিত কোমলতা ভগ্ন হৃদয়ে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দিল। এলিজাবেথ মুহূর্তেই মিইয়ে গেল। নাকের সর্দি রিচার্ডের বুকে ঘষে, মেখে ঠোঁট উল্টে ফিসফিস করল, “তারপর?”
‘গা ঘিনঘিনিয়ে উঠলেও রিয়েক্ট করল না রিচার্ড। এক পলক এলিজাবেথের ফোলা মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। অতঃপর খুঁতখুঁতে স্বভাব ভুলে গিয়ে এলিজাবেথের লাল রেশমি চুলে ঠোঁট ছোঁয়াল।

“সংসার।”
“তারপর?”
“দুজন বন্দি সংসারের মায়ায়। ভয়ের কিছু থাকবে না, হারিয়ে যাওয়ারও না।”
‘বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল এলিজাবেথের। চকিতে তাকাল রিচার্ডের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে।
“আপনি সংসারের মায়ার বাঁধনে পড়ার ছেলে?”
‘গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বিলম্বে উত্তর দিল রিচার্ড,
“যেখানে আস্ত তুমি’টার মায়ায় পড়ে গেছি, সেখানে ‘সংসার’ তো নিছক চার অক্ষরের একটি শব্দ মাত্র।”
“যদি আমি ব্রেকআপ করে দিই?”
‘রিচার্ড থমকে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকালো। এলিজাবেথ নিজে থেকেই নিজের কথার ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটল। রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে হাসল। ভুল সংশোধন না করে প্রশ্নের জবাব দিল একেবারে নিজের ধাঁচে,
“WTF is breakup? We will end up breaking beds.”
‘তলপেটে মোচড় দিয়ে উঠল লাস্যময়ী মেয়েটার। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মেয়েটা জোরে ঘুষি বসাল রিচার্ডের বুকে।

“ছিঃ! অসভ্য লোক, লাগাম টানুন আপনার কথায়।”
‘রিচার্ড ভ্রু উঁচিয়ে হাসল, “লাগাম মুখে নয়, ঠোঁটে টানতে হয়। আর তার জন্য তোমার ঠোঁটের প্রয়োজন। ওয়েল, ইউ অ্যালাও মি টু ডু দিস?”
“কখনো না! নোংরা লোক!”
“ছিঃ, রেড! আমি নোংরা না, একদম ফ্রেস ছিলাম।
নিজে টেস্ট করেও যদি এমন অপবাদ দাও, তাহলে কিন্তু আমি সহ্য করতে না পেরে সব শর্ত ভুলে গিয়ে প্র্যাকটিক্যালি লাইভ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ব!”
‘দু’হাতে কান চেপে ধরল এলিজাবেথ।
“থামুন, অসভ্য লোক!”
‘রিচার্ড অদৃশ্য হাসি হেসে এলিজাবেথকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও পাশে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। গ্রীবা বাঁকানোর সাহসও পেলো না৷ এলিজাবেথ সোজা হয়ে বসতে না বসতেই হঠাৎ রিচার্ড ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমি জানি আমি যা ফিল করছি এই মুহূর্তে, তুমিও ঠিক তাই ফিল করছ। আমি কি কাছের কোনো হোটেল/রিসোর্টের সাউন্ডপ্রুফ রুম বুক করব?”
‘ধাক্কা দিয়ে রিচার্ডকে দূরে সরিয়ে রক্তগরম চোখে তাকাল এলিজাবেথ। রিচার্ড ওর তপ্ত দৃষ্টির দিকে চেয়ে চোখ টিপল। এলিজাবেথ গাড়ির দরজার কিনারা ঘেঁষে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“আপনার মতো অসভ্য লোককে বিয়ে করাও একটা বড়সড় পাপ!”
‘রিচার্ড সামনে ঝুঁকে ফ্রন্ট মিরর ঠিক করে আবার সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল,
“সেই পাপ তুমি ইতিমধ্যে দু’বার করে ফেলেছ জান, আরও দু’বার করবে।”
‘তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এলিজাবেথ বলল, “আপনার মতো কুৎসিত চরিত্রের লোককে আবারও? নেভার!”
‘রিচার্ড গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এমন কথা বোলো না, যে কথা ঘুরে গিয়ে তোমার ওপরও পড়ে।”
“মানে?”

‘হঠাৎ রিচার্ডের হাত বিদ্যুতের গতিতে ছুটে গিয়ে চেপে ধরল এলিজাবেথের চোয়াল। একটানে ওকে টেনে আনল সান্নিধ্যে। ওর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গিয়ে আঁচড়ে পড়ল এলিজাবেথের কাঁপতে থাকা ঠোঁটে।
“Virgin deserve virgin. Leftover deserve leftover. End of debate.”
“মা-মানে?”
‘এলিজাবেথের কপালে কপাল ঘষল রিচার্ড। ঘন শ্বাস ফেলে গাঢ় স্বরে বলল,
“মানে, আমাদের প্রথম স্পর্শের দাবিদার আমরাই ছিলাম, আমরাই হয়েছি। কেউ কুৎসিত চরিত্রের নয়।”
“দেহের প্রথম স্পর্শের দাবিদার আপনি হলেও হৃদয় স্পর্শের নাও হতে পারেন?”
‘মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল রিচার্ডের চওড়া চিবুক। সোজা হয়ে এলিজাবেথের নিষ্প্রল চাহনিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,”মানে? কি বুঝাতে চাচ্ছো?”

‘প্রত্যুত্তের বিপরীতে নিরব রইল এলিজাবেথ। চোখে ঝলঝল করছিল ধূর্ততা। রিচার্ডের ভিতর বাড়তে থাকে অস্থিরতা। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল হাত। যথাসম্ভব নিজ রক্তঝরা ক্রোধ সংবরণে রেখে চাপা গলায় বলল,
“ডোন্ট সে দ্যাট তুমার মনে ঐ জান,,
‘বাক্য পূর্ণতা পাওয়ার আগেই শোনা গেল এলিজাবেথের উপহাসের স্বরে ঝনঝনে হালির কলতান। এলিজাবেথ চাইল রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখে।
“আমার কাছে প্রেমের চেয়ে বড় আত্মসম্মান। তেজ, জেদ, সাহস, সততা—এগুলোই আমার গৌরবের অলংকার!”
‘থেমে,

“আর প্রবল আত্মসম্মানে বেষ্টিত নারীরা সবসময় এক পুরুষে আসক্ত হয়। এই মনে এক পুরুষের ঠাঁই হয়েছিল, আর সেই পুরুষ ভাগ্যে ঠাঁই পেলো। না হোক সুপুরুষ, তাতে কি হয়েছে?”
‘পৈশাচিক ক্রোধ তরতরিয়ে বেড়ে উঠা হিংস্রতা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিল, তবে শেষ বাক্যটি শোনার সাথে সাথেই চোখের কোণে সুপ্ত আলোর মতো দপ করে জ্বলে ওঠা স্বস্তির ছায়া মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল! স্থির হলো শূন্যতায়। বউদের কাজই বুঝি সুযোগ বুঝে খোঁচা মারা? রিচার্ড মনে মনে ‘শালি’ বলে গালি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। ঠোঁট কামড়ে হাসল এলিজাবেথ! নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করেছে তার খোঁচা।
‘পিনপতন নীরবতা কাজ করল কিছুক্ষণ গাড়ির ভেতর। এলিজাবেথের কোমল হৃদয় আবারও তলিয়ে গেল বিষণ্নতায়। রিচার্ড স্থির দৃষ্টি সামনে রেখেই আলগোছে ওর হাত ধরতে গেলে, ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দিল এলিজাবেথ।
ঝাঁঝিয়ে উঠল তীব্র স্বরে,

“সরুন! একদম ছুঁবেন না। সারাক্ষণ শুধু ছোঁয়ার ধান্দা!”
‘রিচার্ড বুঝতে পারল এই রাগের কারণ। অতীতের সব ঘটনার জন্যই এলিজাবেথ এখন সুযোগ পেলেই খোঁচামূলক কথা বলে। জোড়াজুড়ি করল না সে। গা থেকে কোট খুলে অনর্থক শার্টের গোটা কয়েক বোতাম খুলে সিটে শরীর ছেড়ে দিল। হঠাৎই জলদগম্ভীর স্বরে বলতে লাগল,
“শুনো, অভিমানী বোকা মেয়ে, তোমাকে বুঝতে হবে কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা শুধুই চাহিদা! কোনটা শাসন আর কোনটা ব্যক্তিত্বহীনতা! কোনটা জীবন আর কোনটা জীবনের অংশ! আমি তোমার স্বামী, মানো আর না মানো, যা-ই করি তোমার ভালোর জন্যই করি। শুরু থেকে ভালো ভেবেই করে আসছি, এখনও করছি, ভবিষ্যতেও করব। তোমার ভালোর জন্য যদি সাময়িক কষ্টেও ফেলতে হয় তোমাকে, তাও করব। এত মায়া কাজ করে না আমার ভিতর!”

“লাগবে না আপনার ভালো। ঘৃণা করি আমি আপনাকে!”
‘রিচার্ড নিরুদ্বেগহীন ভাব নিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে বলল,
“করতে থাকো, আমি তো আর নির্বাচন করব না যে সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে।”
‘ভড়কে গেল এলিজাবেথ। পরক্ষণেই ভেংচি কেটে আরো জানালার কাছে সরে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন।”
‘রিচার্ড একই ভঙ্গিতে উত্তর দিল নরম গলায়, “আর দেবো না।”
“এতোদিন তো দিয়েছেন। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দেবো।”
“কি বিচার দিবা? দোষ আমার না, দোষ তোমার।”
‘এলিজাবেথ অকস্মাৎ দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরল,
“হে আল্লাহ, যদি উনি দোষী হয় তাহলে ওনাকে তুলে নাও, আর যদি আমি দোষী হই, তাহলে আমাকে বিধবা করে দাও।”

‘চকিতে উঠে বসল রিচার্ড। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চাইল এলিজাবেথের দিকে। ললাটে গভীর তিনটি ভাঁজ। এলিজাবেথ মুখে হাত চেপে হাসতে থাকে। রিচার্ড ফিচলে হাসল। তবে সেই বরাবরের মতোই দন্তপাটের আড়ালে চাপা পড়ে গেল সে হাসি। ভ্রু নাচাতে নাচাতে হিসহিসিয়ে বলল,
“তুমি বেয়াদবি করবে দিনে, আর আমি সব বেয়াদবির ডোজ একসাথে দেবো রাতে।”
‘গোটা কয়েক বাক্যই যথেষ্ট ছিল এলিজাবেথকে স্তব্ধ করে দিতে। মিইয়ে গেল এলিজাবেথ। রিচার্ড বাঁকা হেসে উইন্ডো নামিয়ে দিল। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই এলোমেলো করে দিল এলিজাবেথের চুল। খোঁচা খোঁচা চুল এসে আঁচড়ে পড়ল রিচার্ডের মুখে। প্রশ্রয়ময় আশ্লেষে চোখ বুজল রিচার্ড। সরাল না মুখের ওপর থেকে।

দীর্ঘক্ষণ পর চোখ খুলতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। শাসানোর সুরে মৃদু চেঁচাল,
“রেড, ডোন্ট। বাইরে মাথা দেবে না।”
‘এলিজাবেথ মাথা ভিতরে আনল না, বরং আরেকটু ঘাড় বাড়িয়ে সতেজ হাওয়া গায়ে মেখে নিল। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ টেনে বলল,
“কেন? ক্রিমিনাল হাজবেন্ড?”
“অপজিট দিক থেকে গাড়ি এলে লেগে যাবে।”
‘এলিজাবেথ অবাক চোখে তাকাল রিচার্ডের দিকে। চোখ বড় বড় করে বলল,
“ওহ! রিয়েলি? আমাকে এটা বিশ্বাস করতে হবে? আপনি পাশে থাকা অবস্থায়ও কোনো গাড়ি এসে আমার কল্লা কেটে নিয়ে যেতে পারবে?”

“বিশ্বাস করতে হবে না। তবে আমি এক মিনি সেকেন্ডও রিস্ক নিতে চাই না, গট ইট? সো কাম ক্লোজার।”বলে একটানে এলিজাবেথকে আঁচড়ে এনে ফেলে দিল নিজের নগ্ন, লোমশ বুকে। পাঁজরের মাঝে নাকের ডগা ছোঁয়া মাত্রই শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল এলিজাবেথের রক্তস্রোতে। রিচার্ডের পারফিউমের কড়া ঘ্রাণ ওকে অস্থির করে তুলল। নারীত্বে যেন ঝড় উঠল। একটা শক্ত হাত পিঠ পিছ দিয়ে কোমরে আঁকড়ে ধরে ওর শরীরটা সুযোগ বুঝে একদম মিশিয়ে নিল মেয়েটাকে নিজের সাথে৷ এলিজাবেথ মোচড়ামুচড়ি করে মাথা তুলতে গেলে রিচার্ড নিঃশব্দে এক হাতে ওর মাথা বুকের সাথে লেপ্টে দিল। হাত বিলি কাটতে লাগল চুলে।
“শর্তের কথা ভুলে যাবেন না।”

‘এলিজাবেথের ধুকপুকানো বুকে হালকা হাসি ঝরাল রিচার্ড।সবটুকু অধিকার নিয়ে বলল, “কাল থেকে সব শর্ত মানব। আজ… অন্যরকম মুডে আছি। চুপ! একদম নড়বে না।”
‘তবুও ছটফট করতে থাকে এলিজাবেথ। শরীর জুড়ে রিচার্ডের তীব্র উপস্থিতি ওর প্রতিটি কোষে যেন দাবানল জ্বলছে। ওর নড়াচড়াতে বিরক্ত হয়ে উঠল লোকটা। সে এই মুহূর্তের রোমাঞ্চ নষ্ট হোক চাই না। তাই তো নিঃশব্দে পকেট থেকে ঠান্ডা ধাতব অস্ত্র বের করে এলিজাবেথের কোমরে গুঁজে ধরল। কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“হুসস! আমি চাই, এই মুহূর্তটা ঠিক এমনই থাকুক। যদি তা না হয়… তুমি যা চাও না, তার চেয়েও বেশি হবে।”
‘হিম হয়ে গেল এলিজাবেথ। কোনো প্রতিরোধ নয়, কোনো নড়াচড়া নয়। নিঃশব্দে গুটিয়ে গেল স্বামীর উষ্ণ আবরণে। হৃদয়ের অস্থিরতা থিতিয়ে এল ধীরে ধীরে। সময় থেমে গেল মৌন ভালোবাসার বয়ে যাওয়া মুহূর্তে। রিচার্ডের আঙুল মায়ার পরশে চুলে ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়াল এমনভাবে যেন ওর অস্তিত্বের প্রতিটি বিন্দু আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়…
‘ভোর তখন ঠিক ফোটার অপেক্ষায়। চারপাশে আবছা আলো, ঘুম আর জাগরণের সন্ধিক্ষণ। এলিজাবেথের চোখ বুজে আসছিল। স্বামীর বুকের উষ্ণতায় ছোট্ট বিড়ালছানার মতো লুটিয়ে ছিল সে এতোক্ষণ। হঠাৎ সিগন্যাল পড়তেই গাড়ি থামল। মৃদু ঝাঁকুনিতে চোখ খুলল এলিজাবেথ। উইন্ডো দিয়ে তাকিয়ে দেখে বাইরের শহর অন্ধকার আর আলোয় মিশে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে রিচার্ডের দিকে তাকাতেই থমকাল। লোকটা কি ঘুমায়নি? রিচার্ডের কি গভীর, অদ্ভুত এক দৃষ্টি। মায়াবী, অথচ দাবদাহের মতো তীব্র। সেই চোখের গভীরতা এলিজাবেথকে কুঁকড়ে দিল।

“দৃষ্টি নামান।”
‘রিচার্ড একগুঁয়ে দৃষ্টিতে চেয়েই বলল, “কেন?”
“এই নীল চোখের চাহনি ভয়ংকর।”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে একপাশে তাকাল যেন নিজের ভেতরকার উৎফুল্লতা চেপে রাখতে চাইছে। কতক্ষণ ধরে এভাবে চেয়ে আছে সে, তবু যেন চোখের তৃষ্ণা মিটে না। আবারও এলিজাবেথের মাথা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল,
“ঘুমাও, রেড। তোমার বিশ্রাম দরকার।”
“আমি ঠিক আছি।”
“না! তুমি অসুস্থ।”
“অসুস্থ” শব্দটা কানে আসতেই বুকের ভেতর ধাক্কা খেল এলিজাবেথ। তাকবীরের কথা মনে পড়ল। নিচু গলায় বলল,
“সুস্থ আমি।”
‘এলিজাবেথ জানে না নিজের শরীরের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা। রিচার্ড এখনই বলতে চাইল না ওসব। কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল,

“ভুলে গেছো, শরীর থেকে কতটা রক্ত গিয়েছিল?”
‘এলিজাবেথ চোখ বন্ধ করল। শূন্যতা তাকে আরও শুষে নেয়। চোখের কোণে জল জমে এল। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর ছিঁড়ে যেতে থাকল কিছু একটা। এলিজাবেথ কাঁদছে বুঝতে পেরে ভারি নিশ্বাস ফেলে রিচার্ড। এলিজাবেথের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছিল তখনই ওর মুখ থেকে অপ্রত্যাশিত, তীক্ষ্ণ গালি বেরিয়ে এল,
“শালি, খা-ন-কি!”
‘রিচার্ড হতবাক। এটা কি হলো?

হঠাৎই এলিজাবেথ ওর বুকের আরও গভীরে মুখ গুঁজে দিল। ঠোঁট ছোঁয়াল উন্মুক্ত চামড়ায়। রিচার্ড যেন সপ্তম আকাশে। বিভ্রান্ত হয়ে এলিজাবেথের দৃষ্টি অনুসরণ করল। পাশের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা একটা মেয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে। ব্যস, পুরো ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেল রিচার্ডের কাছে। ঠোঁটে খেলে গেল প্রাপ্তির হাসি।সে নিজেও মেয়েটার দিকে একঝলক তাকিয়ে এলিজাবেথকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিল। একেবারে আড়াল করে ফেলল তার প্রশস্ত বুকে। সিগন্যাল মিলে যেতেই গাড়িটা এগিয়ে গেল এক বুক হতাশা অপমান নিয়ে। গাড়িটা চলে যেতেই এলিজাবেথ রিচার্ডের বাঁধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। রাগে নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠেছে। রিচার্ড সুযোগ বুঝে ঝট করে নাকে চুমু খেয়ে নিল।

ঝাঝিয়ে ওঠে এলিজাবেথ,
“উফফ, ভাল্লাগে না!”
‘রিচার্ড হাসল। এলিজাবেথের কোমর টেনে এনে আবারও আঁকড়ে ধরল। মুখের সামনে ঝুলে পড়া চুল সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে বলল,
“একটু তাকিয়েছে, তাই বলে গালি দিবে? তাকালেই কি কেউ খারাপ হয়ে যায়?”
‘বিষ্ময়কর কান্ড করে বসল এলিজাবেথ। হঠাৎ রিচার্ডের নাক কামড়ে ধরল।
“আমার স্বামীর দিকে তাকানো প্রতিটা মেয়েই খারাপ। মানে সোজা, সুপুষ্ট ভাষায় খা-ন-কি।”
“এত জেলাসি ভালো না, ওয়াইফি। সুন্দর জিনিসের প্রতি সবারই টান থাকে।”
‘এলিজাবেথ বুঝতে পারে রিচার্ড তাকে জ্বালানোর জন্যই এমন বলছে। সেও কম গেল না। কণ্ঠে মধুর শীতলতা এনে বলল,

“ওহ, তাই বুঝি? তাহলে ছেলেদেরও নিশ্চয়ই আমার ওপর লোভ আছে। আফটার অল, আই’ম হট, বিউটিফুল এন্ড সেক্সি।”
‘ মুহূর্তেই রিচার্ডের চিবুক শক্ত হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“জাস্ট জবাই করে দেবো সকলকে, যাদের দৃষ্টি পড়লে আমার ব্যক্তিগত নারীর ওপর।”
‘এলিজাবেথ ভয় না পেয়ে চোখ বাঁকাল।
“ওহ রিয়েলি? কতোজন জবাই করবেন আপনি শুনি?”
‘রিচার্ডের মস্তিষ্কে যেন একটা বিস্ফোরণ হলো। হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। গলা চেপে ধরে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো গর্জে উঠল,

“এই পৃথিবীর আটশো নয় কোটি মানুষও যদি একসাথে তোর দিকে তাকায়, তবে শুধু মানুষ নয়—পুরো পঞ্চান্ন কোটি দশ লাখ বর্গকিলোমিটারের এই পৃথিবীকেই ছাই করে দেবো। জমিন ভেঙে চুরমার হবে, মহাসাগর জ্বলবে, আকাশ কালো হবে এই রিচার্ড কায়নাতের ধ্বংসের ধোঁয়ায়।
‘এবার ভয় ফুটে উঠল এলিজাবেথের চোখে। ছলছল দৃষ্টিতে চাইল রিচার্ডের মুখে। শক্ত করে ঢোক গিলল। এটাই রিচার্ড চেয়েছিল। ওর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল এলিজাবেথকে ভয় পেতে দেখে। এবার গলায় গাঢ় স্বর বেঁধে বলল,

“I let the world burn for you. Let the world burn for you.”
‘বলেই রিচার্ড মুখ গুঁজে দিল এলিজাবেথের গলায়।
এলিজাবেথের শরীর বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠল। নিঃশ্বাস আটকে এল! শিরদাঁড়া বরফ হয়ে গেল। রিচার্ডের হাত শক্ত হয়ে মুখ চেপে ধরল। যেন কোনো শব্দ বের না হয়। চোখ ভয়ার্ত অথচ গালে রক্তিম লালিমা ছড়িয়ে পড়ছে।
রিচার্ডের নিঃশ্বাস গ্রীবায় গলে গেল। সেথায় মগ্ন অবস্থায়ই রিচার্ডের ঠান্ডা, স্থির কণ্ঠ এলিজাবেথের কর্ণকুহরে ঢুকে কাঁপিয়ে দিল,
“তোর ওপর আমার অধিকার প্রশ্নাতীত, অবিসংবাদিত। তুই শুধু আমার।”
‘ক্রোধের বশবতী হয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে থাকে রিচার্ড আড়ষ্ট মেয়েটার কোমল গ্রীবা। কিছুক্ষণ বাদেই আবারও বলল,

“আমি খারাপ, ভয়ংকর খারাপ, রেড। যদি কখনো টের পাই তোর চোখ—যে চোখ কেবল আমাকেই দেখা উচিত,সেই চোখ অন্য কোনো পুরুষের দিকে গেছে। বিশ্বাস কর, তোকে মেরে ফেলতেও আমার হাত একটুও কাঁপবে না। বরং উপভোগ করবো। তোর শেষ নিঃশ্বাসটাও আমার হবে।”
‘চামড়ায় গভীর কামড়ের যন্ত্রণা ধীরে ধীরে দহন হয়ে উঠছে। এলিজাবেথের আঙুল রিচার্ডের শার্ট মুঠো করে ধরে। নখে গেঁথে রাখল রিচার্ডের অস্তিত্ব। যন্ত্রণায়, শিহরণে, ভালোবাসায়… নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগল এলিজাবেথ। ফুরিয়ে আসছিল নিঃশ্বাস।

‘আট বছরের এক শিশু, যার জীবন ছিল স্বচ্ছ জলের মতো। কোনো দাগ ছিল না, ছিল না কোনো কলঙ্ক। সে স্বপ্ন দেখেছিল বড় হওয়ার, ভালো মানুষ হওয়ার। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তাকে পরিণত হতে হলো এক হত্যাকারীতে।কার জন্য? নিজের জন্মদাত্রী মায়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে। ছোট্ট হাতে তুলে নিতে হলো অস্ত্র। রঞ্জিত হতে হলো রক্তে। এক নিষ্পাপ আত্মা ক্রমে ডুবে গেল অপরাধের অন্ধকারে। কোমল হৃদয় পাথর হয়ে গেল, পৈশাচিক ক্রোধে আচ্ছন্ন হলো তার অস্তিত্ব।

‘কার জন্য? শুধুমাত্র সেই নারীর জন্য যাকে সে মা ভেবেছিল, যাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা জানিয়ে দিল সে রক্তের সম্পর্কে বাঁধা কেউ ছিল না, ছিল কেবল মায়ার বন্ধনে জড়ানো। অথচ সেই মায়ার টানেই সে নিজ হাতে হত্যা করল তার জন্মদাত্রীকে। যাঁর গর্ভে তার সূচনা। নিয়তির নিষ্ঠুরতা কি এখানেই শেষ? না! সে লড়ে গেল দিনের পর দিন তার শত্রু—যে রক্তের সম্পর্কের ভাই তার বিরুদ্ধে। কিসের জন্য? সেই এক নারীর জন্য যে তাকে কখনো ভালোবাসেনি। সব বৃথা! তার ভালোবাসা, তার শুদ্ধ আত্মার বিলীন, তার আত্মত্যাগ—সব এক নিষ্ফল পরিণতির দিকে ধাবিত হলো। সে পুরো জীবন পার করে দিল ভুলের পেছনে ছুটতে ছুটতে।
‘পাপ কি কাউকে ছাড়ে? না, ছাড়ে না! তার পাপ তাকে তার মায়ের হত্যাকারী বানিয়ে দিল। অথচ সে তো ভালো সন্তান হতে চেয়েছিল! মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল! আর সেই প্রতিশোধের আগুনেই সে নিজেকে পোড়াল। নিজ হাতে শেষ করল নিজের অস্তিত্বের মূলকে। যার স্নেহের স্পর্শও পায়নি সে। আর ভাবতে পারে না তাকবীর। শেষে বুকের ভেতর এক অজানা ভার অনুভব করে তাকবীর। চিন্তার ভারে তার মস্তিষ্ক বিপর্যস্ত, হৃদয়ের গহীনে পাঁজরের হাড়গুলো কটকট শব্দে জানান দিচ্ছে চাপা কষ্টের। দু’ফোঁটা অশ্রু নীরবে গড়িয়ে পড়ে তাকবীরের গাল বেয়ে।

‘হঠাৎ কাঁধে এক স্পর্শ অনুভব করে চমকে ওঠে তাকবীর। দ্রুত চোখ মুছে পিছনে ফিরতেই দেখতে পায় তাকওয়া দাঁড়িয়ে আছে। একসময় যার মুখশ্রী ছিল উজ্জ্বল আজ তা বিবর্ণ, দুঃখে ঢেকে গেছে তার পুরো অস্তিত্ব। তাকওয়া তাকবীরের সামনে একট ফাইল এগিয়ে দিল। তাকবীর শূন্য দৃষ্টিতে চাইল ফাইলটার দিকে। বুঝতে দেরি হলো না এটার ভেতর কী আছে। তাকওয়ার শ্বাস ভারী হয়ে উঠল। গলা শুকিয়ে আসে। তবু কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমি আপনাকে নতুন জীবন দিতে চাই। চলুন, অনেক দূরে পালিয়ে যাই।”
‘তাকবীর গভীর, শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার সততা?”

‘তাকওয়ার গলার ভেতর কান্না দলা পাকিয়ে উঠছে। আরও একবার কঠিন করে ঢোক গিলল সে।
“এই পর্যায়ে এসে উপলব্ধি করলাম, আইনের শক্তির চেয়েও প্রবল ভালোবাসার টান। আমি পারিনি আমার টিমের সাথে ফিরে যেতে, আমি ছুটে এসেছি কেবল আপনার জন্য। প্লিজ, আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। হয়তো আমি আপনার প্রথম ভালোবাসা নই কিন্তু শেষ ভালোবাসা হতে চাই!”
‘তাকবীর চোখ নামিয়ে নিয়ে হালকা হেসে বলল,”আর প্রেম নয়, কারণ আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম— সে-ই আমার শেষ প্রেম।”
“তাহলে দ্বিতীয় প্রেমের হাত ধরে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাই?”
“দ্বিতীয় প্রেম হয় না।”

“কে বলেছে? দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে গেলে আরও বেশি সাহস লাগে।”
‘তাকবীর আন্তরিক হাসল। কিন্তু সে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল অব্যক্ত বেদনা। “আমি ভীতু, খুব বেশি ভীতু।”
“ছেলেমানুষী করবেন না। যে আপনার নয়, তাকে পাওয়ার আশায় কেন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন?”
“ফিরে যান আপনি।”
“ফিরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে এসেছি, কেবল আপনার জন্য। আপনার রবের দোহাই, আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো!”
‘তাকবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তৃতীয় ব্যক্তিরাই সুখী সবথেকে সুখী। কেন কারণ তারা আমাদের প্রিয়জনদের বিনা সাধনাতেই পেয়ে যায়!”
“আপনি কেন শুধু নিজের কথাই ভাবছেন? একবার আমার কথাও ভাবুন! দেখুন আমার চোখের জল, এই প্রতিটি ফোঁটা কেবল আপনার জন্য।”

“একটা ধ্বংসস্তূপের সাথে নিজেকে জড়াতে চান?”
“আমি আপনাকে নতুন জীবন দিতে চাই।”
“যে জীবনে আমার এলোকেশী থাকবে না, সে জীবন নিয়ে কী করব?”
‘শক্ত ধাঁচের তাকওয়া কান্নায় ভেঙে পড়ল,”আপনি কেন আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন? আমি তো শুধু আপনার জন্যই এসেছি! আপনার অতীত আমি জানতে চাই না। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে। আমি সেই কালো অতীতটাকে সাতরঙা ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে চাই। প্লিজ, আমার হোন!”
‘তাকবীর উদাসীন ভঙ্গিতে তাকওয়ার কথাগুলো উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো বলে চলল,
“ভাগ্য কি জানেন? সবাই সব কিছু পায় না। এই দুনিয়া যারে দেয়, দু’হাত ভরে দেয়।”
‘তাকওয়া দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “যাকে পাবেন না, তাকে পাওয়ার আশা করছেন কেন? এখানে তো দুনিয়ার দোষ নেই।”
‘তাকবীর হঠাৎ হেসে দু-লাইন গেয়ে উঠল,

“ওই প্রেম যে করে, সে জানে, আমার মনের মানুষেরও সনে।”
‘তাকওয়া বিস্মিত হলো। সে জানত না তাকবীরের গলার স্বর এত মধুর। আবেগে আপ্লুত হয়ে জানতে চাইল,
“আপনার গানের গলা অসাধারণ! গায়ক হওয়ার শখ ছিল বুঝি ?”
‘তাকবীর করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেন বুকের ভেতর জমে থাকা হাজারও যন্ত্রণা সেই এক নিঃশ্বাসে বেরিয়ে এলো। তাকওয়ার বুকে আবারও ব্যথা চেপে বসল। সে জানে তাকবীরের জীবন কী নিদারুণ পরিহাসের শিকার। পাপী হয়তো সে, কিন্তু তার ভাগ্যই সবচেয়ে নির্মম ছলনা করেছে তাকে। তাকওয়া এক কদম এগিয়ে এল। কণ্ঠে গভীর আর্তিতে বলল,

“চলুন, আমার সঙ্গে অনেক দূরে। সেখানে নতুন পরিচয়ে নিজেকে গড়ে তুলবেন। আমি আপনার পাশে থাকব।”
‘এই বলে তাকওয়া প্যান্টের পকেট থেকে দুটো পাসপোর্ট বের করল। তাকবীর একবার তাকাল পাসপোর্টের দিকে তারপর তাকওয়ার চোখে। লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
“ফিরে যান।”
‘বিষণ্নতা মিলেমিশে চারপাশ ভারী হয়ে উঠল। শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার বাস্তবতা যেন শেকড় ছিঁড়ে ফেলা কোনো বৃক্ষের যন্ত্রণার মতো। তাকওয়া নিশ্বাস টেনে আরেক কদম এগিয়ে যেতে থাকা অবস্থায় বলল,
“আপনি তো দুনিয়ার থেকেও পাষাণ।”
‘তাকবীর ম্লান হেসে পিছিয়ে গেল, “পাষাণ? হাহাহা… সত্যিই পাষাণ আমি। কিন্তু পারিনি কেবল তার ক্ষেত্রেই। পারলে হয়তো আজ আমার এলোকেশী আমারই থাকত।”
“তাহলে কি আমি আপনাকে পাবো না?”
“আমি কি তাকে পেয়েছি?”

‘তাকওয়া ব্যথা পিষে বলল, “আপনি পাননি বলে আমাকেও শূন্য রাখবেন?”
‘তাকবীরের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল, “আমি কেন শূন্য হয়ে রইলাম? কেন পরিপূর্ণ হতে গিয়েও হতে পারলাম না?”
“কারণ সে বিবাহিত। তার স্বামী আছে।”
“কিন্তু ওর জীবনে তো আমি আগে এসেছিলাম। বেশি ভালোবেসেছি আমি।”
“কোথাও হয়ত কমতি ছিল।”
“ছিল না।”
“এত আত্মবিশ্বাস?”
“প্রমাণ লাগবে?”
“কি প্রমাণ দেবেন?”

“আমার জীবনের চেয়ে বড় কিছু তো নেই। যদি বলেন, এটাও দিয়ে দিই। তবুও এই স্বার্থপর পৃথিবী জানুক, কেউ একজন তার এলোকেশীকে ভালোবেসেছিল, ভীষণভাবে ভালোবেসেছিল। এর চেয়ে বেশি ভালোবাসা হয় না।”
‘তাকওয়া কান্না গলায় চেপে হুট করে বলে উঠে চিৎকার করে, “আমি ভালোবাসি আপনাকে, মিনিস্টার সাহেব।”
‘তাকবীরের কাঠকাঠ কণ্ঠে বিলম্বহীন জবাব, “আমি আমার এলোকেশীকে ভালোবাসি।”
‘তাকওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল তাকবীরের পায়ের উপর। এবার সত্যিকারের অসহায় কণ্ঠে অনুনয় করল, “আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না? সে আপনার জন্য না! আমাকে একটু আপন করে নিন না! ফিরে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই আমার। আমি সকল শর্ত ভেঙে এসেছি!”

‘তাকবীর নির্বিকার, “আমি তো নিয়ম গড়েও তাকে পাইনি।”
‘তাকওয়া আহাজারি করতে থাকল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে থাকে,
“আমি ভালোবাসি আপনাকে… ভালোবাসি আপনাকে…”
“মিস তাকওয়া, প্লিজ পা ছাড়ুন। উঠুন।”
‘তাকওয়া দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল তাকবীরের পা। মাথা চেপে ধরল পায়ের গাঁয়ে, কাঁপা কণ্ঠে গুনগুন করে বলে,
“বুকে জায়গা না-ই পেলাম, পায়ে একটু আশ্রয় দিন। এতদিন একা কান্না করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি আমি… আমার একটা আশ্রয় দরকার। ঠেলে দেবেন না, প্লিজ!”
“আমি আমার অনুভূতিকে সম্মান করি, মিস তাকওয়া। প্লিজ উঠুন। ভালোবাসা পায়ে ফেলার জিনিস নয়।”
‘তাকওয়া ঘাড় তুলে চাইল তাকবীরের দিকে। একবুক যন্ত্রণার সহিত বলল, “খুব কি অন্যায় হতো, যদি আমি আপনার হতাম?”

‘তাকবীর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সত্যিটা বলব?”
“মিথ্যে বলে যদি আমার অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারেন, তবে তাই করুন…”
‘তাকবীর পা ছাড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিধ্বস্ত তাকওয়ার সামনে। গভীর, শান্ত কণ্ঠে বলল,
“সত্যিটাই বলি।”
‘তাকওয়া ভেজা চোখ তুলে চাইল তাকবীরের শ্যামলা মুখে। এই মুখের মায়ায়ই তো ধ্বংস হয়ে ছুটে এসেছে সব ফেলে। মায়াতে বেষ্টিত পুরোটা। ঠোঁট কামড়ে উপরে-নিচে মাথা নাড়াল তাকওয়া।
‘তাকবীর ফিচলে হাসল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“যদি পারতাম, সত্যিই কখনো ফিরিয়ে দিতাম না। আমি খুব কাঙাল… ভালোবাসার কাঙাল। পারলে এই ভালোবাসা আমি নিজের কাছে যত্ন করে রেখে দিতাম। কিন্তু ক্ষমা করবেন, আমি পারব না।”
‘তাকওয়া কান্নার দমকে কেঁপে উঠল। কষ্টের পাহাড় লোকাতে আলগোছে হাত রাখল তাকবীরের মাথার ব্যান্ডেজের উপর, যেখানে ভেসে আছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।

“যদি সাধ্য থাকত, নিজেকে বিক্রি করে আপনাকে কিনতাম…”
‘তাকবীর ম্লান হাসে,”দিয়েছেন তো নিজের সততাকে। ফিরে যান, মিস তাকওয়া।”
তাকওয়া এবার স্পর্শ করল তাকবীরের চোখে,চোখের পাপড়িতে। চোখ বুজে ফেলে তাকবীর। তাকওয়া ধীরে ধীরে পুরো মুখে হাত বুলাতে থাকে,
“আপনি তো আমার ছিলেন না… তবুও কেন এত মায়া হচ্ছে?”
‘তাকবীরের চোখের সামনে ভেসে উঠে এলিজাবেথের চেহারা। সে আশ্লেষে চোখ বুজা অবস্থায় প্রত্যুত্তর করল,
“যে আমার ছিল, তার কেন মায়া হলো না আমার জন্য?”
‘তাকওয়ার কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে আসে , “মিলিয়ে নেবেন… আমার মতো এত যত্ন করে কেউ ভালোবাসবে না আপনাকে।”

‘তাকবীর তিক্ত হেসে বলল, “সে-ও কি পারবে মেলাতে?”
‘ওরা যেন আজ নিজেদের দুঃখের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। তাকওয়া ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি টেনে বলল,
“আপনি রাখতে চাচ্ছেন না, অথচ আমি থাকতে চাইছি বারবার… ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। ঠাঁই না পেয়ে আমাকেও ঠাঁই দিলেন না।”
“আমি আপনার ভালো চাইছি মিস তাকওয়া।”
‘তাকওয়া হেসে ফেলল। ভাঙা গলায় শুধালো,
“কত ভয়ংকর আপনি! ভালো চাইলেন না শেষ করে দিলেন! আজও বুঝতে পারলাম না!”
‘তাকবীর চুপ। এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তার কাছে নেই। তাকওয়া আবার বলল,
“কতোটা মূল্যহীন হয়ে ফিরে যাচ্ছি আমি…”

‘তাকবীর নিচু গলায় বলল, “উপরওয়ালা কখনো কাউকে মূল্যহীন করে পাঠান না। আমরা মূল্যহীন তখনই হয়ে পড়ি, যখন ভুল জায়গায় নিজেকে বিনিয়োগ করি।”
‘তাকওয়া তিক্ত হাসল, “আপনারা পুরুষ জাতি কি ভয়ংকর… নিরব খুনি। ভুল জায়গায় ঠকে, সঠিক জায়গায় ঠকান।”
‘অকস্মাৎ চিবুক শক্ত হয়ে যায় তাকবীরের। দৃষ্টি তুলে কঠিন চোখে তাকাল তাকওয়ার দিকে। দৃঢ় কণ্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে
“সে তো আমাকে কখনো ভালোই বাসেনি। ঠকাবে কী? আমার এলোকেশী এমন না।”
‘একটা চড় আঁচড়ে পড়ল তাকবীরের চোয়ালে। থরথর করে কাঁপছে তাকওয়ার ঠোঁট। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না মেয়েটা। উচ্চস্বরে বলে উঠল,

“আপনি একটা মানসিক রোগী! কখন থেকে শুধু একই কথা বলে যাচ্ছেন। আপনার ট্রিটমেন্ট দরকার। এভাবে কেউই থাকতে পারবে না আপনার সঙ্গে। কখন থেকে শুধু ওই মেয়েটার কথায় বলে যাচ্ছেন, আমার দুঃখ চোখে বাজে না?”
‘তাকবীর নির্বিকার। নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল,
“জানি তো। তাই তো গিয়েছিলাম ইতালি নিজেকে সুস্থ করতে। তবে শেষ মুহূর্তে… সৃষ্টিকর্তাও বোধহয় চাননি আমি সুস্থ হই।”

‘হঠাৎই তাকওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল তাকবীরের বুকে। বাঁধা দিল না তাকবীর। কাঁধ ভিজে গেল চোখের জলে। তাকওয়া ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। একটু পরপর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে শরীর। সোজা হয়ে, দু’হাতের তালুতে চেপে ধরল তাকবীরের মুখ। যেখানে কিছুক্ষণ আগেই আঘাত করেছিল সেখানেই হঠাৎ শব্দ করে চুমু খেল। এবারও বাঁধা দিল না তাকবীর। নিথর দাঁড়িয়ে রইল যেন তার ভেতরকার অনুভূতিগুলো একে একে নিভে যাচ্ছে।
‘তাকওয়া উঠে দাঁড়াল, দাঁড়াল তাকবীরও। শেষবারের মতো শক্ত করে তাকবীরকে আবারও জড়িয়ে ধরল তাকওয়া। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শরীর কেঁপে উঠছে আড়ষ্ট মেয়েটার , সেই কাঁপুনির স্রোতে কেঁপে উঠছে তাকবীর নিজেও। কিছুক্ষণ পর সোজা হয়ে ফাইলটা হাতে তুলে নিল তাকওয়া। যেখানে আছে তাকবীরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল পাপের প্রমাণ। অনেক চেষ্টার পর এরিক সেগুলো খুঁজে বের করেছিল। আর তাকওয়া সেইগুলোই নিয়ে এসেছিল সকলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। হঠাৎ করেই তাকওয়া এক টানে ছিঁড়ে ফেলল সব কাগজ। বাতাসে উড়ে গেল টুকরোগুলো। ছড়িয়ে পড়ল তাকবীরের মুখের উপর। তাকওয়া নিভে আসা কণ্ঠে যাবার আগে বলে গেল,
“শূন্য হাতে ফিরে গেলেও আপনাকে দিয়ে গেলাম গোটা একটা জীবন।”

‘চোখের জল মুছতে মুছতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল তাকওয়া। তাকবীর স্থির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসিতে একাই বলে উঠল,
“শ্লারার কেউ-ই বুঝল না এ বুকের যন্ত্রণা।”
‘একটা নম্বরে কল করল তাকবীর ‘ওসি’ নামে সংরক্ষিত। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই গভীর গলায় বলল,
“আমি আজই সারেন্ডার করতে চাই নিজের সকল দোষ স্বীকার করে।”
‘কল কেটে গেল। তাকবীর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ফোনের স্ক্রিনে। ওয়ালপেপারে এখনো ষোলো বছরের সেই ছোট্ট মেয়েটার ছবি। দূর থেকে তোলা একটা মুহূর্ত—রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে গোলগাল এক মেয়ে, বড় হিজাবে আপাদমস্তক ঢাকা। হঠাৎ দমকা বাতাসে উড়ে যায় হিজাবের অংশ, উন্মুক্ত হয় লালচে চুলগুলো। মেয়েটার চোখে আতঙ্ক, সেই আতঙ্ক এখনো বন্দি রয়েছে ফোনের পর্দায়। যত্ন করে রাখা হয় বুকের বাঁ পাশে। তাকবীর মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল,

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৩

“পরের জন্মে কষ্ট হলেও আমার হইও।”
‘মিথ্যা শান্তনায় যদি কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায় তাতে ক্ষতি কী? মিনিটের ব্যবধানে কেবিনে ঢুকল কয়েকজন আইনরক্ষক। তাকবীর নিজে থেকেই এগিয়ে গেল। তার সামনে যখন চকচকে লোহার হ্যান্ডকাফ তোলা হলো, সে মলিন হেসে তাকাল। বন্দি হতে যাচ্ছে সে। সে পারেনি নিজের অবাধ্য মনকে বন্দি করতে। এবার নিজেকেই বন্দি করবে। নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দিল তাকবীর।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫