ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫
মিথুবুড়ি

‘দুইদিন পেরিয়ে গেছে। ম্যানশনের নিস্তব্ধতা যেন ঘনিয়ে আসা অমাবস্যার মতো। এক অদৃশ্য ভারে চাপা পড়ে আছে চারপাশ। এই দুইদিনে এলিজাবেথ আর রিচার্ড কেউ একে অপরের সাথে কোনো কথা বলেনি। না বলা জরুরিও মনে করেছে। দু’জনেই নিজেদের ভেতরের টানাপোড়েন মেটাতে ব্যস্ত। তবে পরিবেশের পালাবদল স্পষ্ট। তবে এখন ম্যানশনে একটা পরিবর্তন বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। রিচার্ডের কড়া নির্দেশ—এলিজাবেথ যেন বাড়ির কোনো কাজ না করে শুধু সকালে তার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করা ছাড়া। এলিজাবেথ তর্ক করেনি, নিঃশব্দে মেনে নিয়েছে। প্রতিদিন সকালে রিচার্ডের জন্য খাবার বানায়।

আর বাকিটা সময় রিচার্ডের আশপাশ ছুঁয়েও দেখে না। লাঞ্চ কিংবা ডিনারের সময় রিচার্ড বেশিরভাগ সময় বাইরেই কাটায় তাই এই বিষয়ে এলিজাবেথকে কোনো চাপ দেয়নি রিচার্ড।
‘রিচার্ড একদম রেডি হয়ে নিচে নামতেই কিচেন থেকে আসা বাসনের টুংটাং শব্দ তাকে স্বাগত জানায়। কিচেনে একপাশে দাঁড়িয়ে সবিতা বেগম সকলের জন্য রান্নায় ব্যস্ত আর অন্য কোণে নিঃশব্দে কাজ করছে এলিজাবেথ শুধু রিচার্ডের জন্য। রিচার্ড চুপচাপ গিয়ে টেবিলে বসতেই লুকাসও তার পাশে এসে জায়গা নেয়। বিয়ের পর ন্যাসো আর ইবরাত বেশ বেলা করে ঘুমায়। তাই নাস্তার টেবিলে তাদের উপস্থিতি বিরল। কিন্তু রিচার্ড তার সময়ানুবর্তিতা আর স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে বরাবরই কঠোর। আর ভোজনরসিক লুকাস, তার তো আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয় না। পেটের টানে সে টেবিলে ছুটে আসে বারংবার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘এলিজাবেথ একদম অভিজ্ঞ গিন্নির মতো আঁচল কোমরে গুঁজে ব্যস্ত হাতে রান্না করছে। প্রতিটি পদক্ষেপেই গৃহিণীদের মতো এক অদ্ভুত মগ্নতা। রিচার্ড স্থির চোখে তাকিয়ে আছে এলিজাবেথের দিকে দীর্ঘ, নিমিষেহীন, একগুঁয়ে দৃষ্টিতে। অভিব্যক্তি শূন্য অথচ সেখানে যেন হাজারো অব্যক্ত কথা লুকিয়ে আছে। ওদিকে সবিতা বেগমের অবস্থা নাজেহাল একসাথে এতো মানুষের রান্না করতে গিয়ে। স্বাস্থ্যও খানিকটা কমেছে রিচার্ডের টর্চারে। হঠাৎ লুকাসের ফোনে কল আসতেই সে তড়িঘড়ি করে লিভিং এরিয়ায় গিয়ে টিভি ছাড়ল।
‘এদিকে এলিজাবেথ প্লেটে করে সবকিছু এনে রাখল টেবিলে। বিষন্নতায় ঠাসা উজ্জ্বল মুখশ্রী। রিচার্ড ঘাড় তুলে এলিজাবেথের দিকে তাকাতেই এলিজাবেথ নিঃশব্দে বয়েল ফুডগুলো রিচার্ডের প্লেটে সার্ভ করে দিতে থাকল। রিচার্ড সকালে শুধু সিদ্ধ খাবার খায়। গ্লাসে পানি ডেলে দিচ্ছিল এলিজাবেথ। হঠাৎ হাত থমকে গিয়ে শরীরটা মৃদু কাঁপুনি দিয়ে উঠে টিভি থেকে ভেসে আসা নিউজ শুনে। টিভিতে যমুনা টেলিভিশনের নিউজ চলছে,

[ব্রেকিং নিউজ | যমুনা টেলিভিশন
মানবতার মুখোশ খুলে দিলেন তাকবীর দেওয়ান আদালতের পথে ইতিহাসের এক কলঙ্কপৃষ্ঠা
‘সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন মন্ত্রী তাকবীর দেওয়ান যিনি এতদিন পরিচিত ছিলেন ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে আজ তারই নামে মুখরিত আদালত চত্বর। সদ্য পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি সজ্ঞানে নিজের যাবতীয় অপকর্ম স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেছেন। স্বীকার করেছেন অবৈধ ব্যবসা, দুর্নীতি এবং একাধিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সম্পৃক্ততা। তার এই স্বীকারোক্তি ছড়িয়ে পড়তেই গোটা দেশে নেমে এসেছে বিস্ময়ের ছায়া। যারা একসময় তার জন্য চোখ ভেজাতেন তারা আজ ফাঁসির দাবি নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন আদালতের সামনে। বিরোধী দলের মুখে ফুটে উঠেছে স্বস্তির হাসি। ঈদের চাঁদের মতো খুশির ঝলক দেখা যাচ্ছে তাদের প্রতিক্রিয়ায়।

‘তবে চমকে দিয়েছে এক তথ্য—আত্মসমর্পণের পর থেকে তাকবীর দেওয়ান আর কোনো কথা বলেননি এমনকি নিজের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগেও আপত্তি জানিয়েছেন তিনি। তার এই আচরণে জন্ম নিয়েছে নতুন প্রশ্ন। এই আত্মসমর্পণ কি সত্যিই অনুশোচনায়? নাকি আরও কোনো অজানা চাপের ফল? গোপনসূত্রে আরো জানা গেছে যে জেলে থাকার সময় তার উপর দুই দফা হামলা হয়েছে। সন্দেহের তীর ঘুরছে বিরোধী দলের দিকে যদিও এখনো স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। আজ ‘সুনামির লাস্ট ডেট’। আদালত চত্বরে জনতার ঢল, মুখে একটাই দাবি “তাকবীর দেওয়ানের ফাঁসি চাই!”কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—তাকবীর কি সত্যিই নিজের পাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে নাকি তার পাপই তাকে ফেলে দিয়েছে গহ্বরে?আজকের রায় কি গড়বে নতুন ইতিহাস? জানতে চোখ রাখুন যমুনা টেলিভিশনের পর্দায়।

‘নিউজটি কানে পৌঁছানো মাত্রই এলিজাবেথের হাতে থাকা গ্লাসটি অবহেলায় ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে গেল মেঝেতে। মুহূর্তেই স্তব্ধতা নেমে এলো ঘরে। রিচার্ড তৎক্ষণাৎ উঠে এসে এলিজাবেথকে কোলে তুলে টেবিলের অপর প্রান্তে বসাল। এলিজাবেথের শরীর থরথর করে কাঁপছে, চোখেমুখে বিভ্রান্তি। প্রতিধ্বনির মতো কানে বারবার বাজছে “তাকবীর দেওয়ানের ফাঁসি”। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠছে সেই মুখ কৃষ্ণগহ্বর, গভীর দুটি চোখ, নিষ্পাপ মুখশ্রী, আর ঠোঁটজুড়ে চিরস্নিগ্ধ হাসি। হোক না সেই হাসির আড়ালে হিংস্রতা, তবে এলিজাবেথ তো দেখেছে শুধু কোমলতা। তার জন্যে তো সেই কণ্ঠ কঠোরও হয়নি কখনও। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল এলিজাবেথ। খামচে ধরল রিচার্ডের শার্টের কলার। কণ্ঠে একরাশ অস্ফুট কাঁপুনি,

“না! না, মরতে পারে না লোকটা! এত সহজে মরতে পারে না!”
‘রিচার্ডের চোখে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বোঝা দায় এমন খবরে এই পাষণ্ড লোকটার মনের ভেতর কি হচ্ছে। এলিজাবেথ আবার বলে উঠল, কণ্ঠে রুদ্ধপ্রায় আর্তনাদ,
“শুনছেন? সে মরতে পারে না! পারে না!”
‘লুকাস এক কোণে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ। কোনো নড়াচড়া নেই।এলিজাবেথের কান্নাভেজা কণ্ঠ তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। সে সুচারু চোখে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের চোখে। হয়তো খুঁজে ফিরছে অভ্যন্তরের সাড়া কিংবা বোঝার চেষ্টা করছে নিস্তব্ধতার অন্তরালে সঞ্চিত চাপ। এলিজাবেথ আবারও কাঁপিয়ে তোলে রিচার্ডের কাঁধ,
“আপনি শুনছেন? আপনার ভাইয়ের ফাঁসি হতে যাচ্ছে!”
‘এইবার এলিজাবেথের দৃষ্টিতে ক্লান্তি আর বেদনায় ভরপুর। জোরে ঝাঁকাতে থাকে রিচার্ডের কাঁধ। রিচার্ড নিরুদ্বেগহীন ভাব নিয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল,

“Who cares?”
‘ধাক্কা খেল এলিজাবেথ। হঠাৎ করেই হুড়মুড়িয়ে কেঁদে উঠল,”না না উনি মরতে পারে না এতো সহজে।”
“কেন মরতে পারে না? মৃত্যুর ফয়সালা হয়ে গেলে আমরা আটকানোর কে?”
“মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়ে থাকে, জমিনে না।”
‘কোনো এক অযাচিত কারণে শক্ত করে এক ঢোক গিলল রিচার্ড। কণ্ঠটাও এবার বেশ মলিন শোনাল অথচ অধর কোণে উপহাসের হাসি,”এবার ফয়সালা হয়তো আসমান থেকেই এসেছে।”
“যদি তা হয়ে থাকে তাহলে সবার আগের মৃত্যুর ঘন্টা আপনার উপর ভাজার কথা।”
‘রিচার্ড চাতক পাখির মতো চকিতে চাইল এলিজাবেথের দিকে। কাতর দৃষ্টি ফেলল সান্নিধ্যের ভেজা চোখ দুটোতে। এলিজাবেথ হাতের পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ মুছে নেয়।

“কারণ আপনিও খুনি। হাজারো মানুষের রক্ত ঝরেছে আপনার হাত দিয়ে। পাপের শাস্তি যদি মৃত্যু হয়, তাহলে আপনিও মৃত্যুদণ্ডের আসামী। নাহলে যে বড্ড অন্যায় হয়ে যায়। আপনারা অপরাধী, দুজনেই অপরাধী। তাহলে সে একা কেন শাস্তি পাবে? সে মরলে সবার আগে আপনাকে মরতে হবে।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠনালি হতে ছিটকে বেরিয়ে এলো আহত স্বর,”রেড।”
‘এলিজাবেথ অবুঝের মতো বারবার বলতে থাকে,”উনাকে বাঁচান। প্লিজ বাঁচান। আমি জানি আপনি পারবেন! শুধু আপনিই পারবেন। আমার যে অনেক কিছু জানার আছে তার কাছ থেকে। অনেক প্রশ্ন জমে রয়েছে আমার কাছে। যেগুলোর উত্তর শুধুমাত্র তার কাছেই আছে৷”

‘অজানা এক দহনে পুড়ছে শক্ত হৃদয়। ফোঁস নিশ্বাস ফেলল রিচার্ড,”কি প্রশ্ন?”
‘এলিজাবেথ হঠাৎ করেই জাপ্টে ধরল রিচার্ডকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “আমি জানি না, কিচ্ছু জানি না আমি। আমার খুব করে অনুভব হয় আমার অতীতের সাথে উনি জড়িত। আমি সেই রহস্যময় অতীতের ধোঁয়াশা থেকে বের হতে চাই। বের হতে চাই আমি, মুক্তি চাই আমি! মুক্তি।”
‘রিচার্ড ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। কণ্ঠে বলিয়ান তেজ বজায় রেখে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে, “মিথ্যা আকাঙ্কা জ্ঞানের চোখকে অন্ধ করে দেয়।” বলে উপরে চলে যেতে উদ্যত হয়।
“ম্যাম নো।”

‘লুকাস দূর থেকে আতঙ্কিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ছুটে আসে এদিকে। ঘূর্ণন গতিতে পিছন ফিরে রিচার্ড। এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে গলায় নাইফ ধরে। জবুথবু করে কাঁপছে তনু।
চোখে ভাঙাচোরা ভয় আর অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ।
অন্তর্জগতে তান্ডব নেমেছে। উপচে পড়ছে এলোমেলো অনুভূতির ঢেউ। রিচার্ডের চিবুক মুহূর্তেই শক্ত হয়ে ওঠে। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটোতে গৌড় বর্ণের শিরা-উপশিরা ফেটে বেরিয়ে আসে। পৈশাচিক রক্তিমতায় বিড়বিড়িয়ে ওঠে সাইকো মস্তিষ্ক। ঠোঁট ফাটিয়ে ঝরে পড়ে হিংস্র বাক্য:
“পরপুরুষের জন্য এতো উৎকণ্ঠা? দুনিয়ার কলঙ্ক মেখে নেবে এবার?”
‘বিপন্ন দোটানায় দাঁড়িয়ে হৃদয়টা এক টুকরো ছাই।
হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো নিস্তব্ধতা। হঠাৎ এলিজাবেথের কান্নার স্রোত থেমে যায়।
কণ্ঠে জ্বলে ওঠে আগুন। অবশেষে মেয়েটা প্রতিবাদ করে,

“জাহান্নামে যাক দুনিয়া, দুনিয়ার মানুষ। এই দুনিয়া দেখেনি লোকটার চোখের পানি। দুনিয়া স্বাধ দেয়নি লোকটার করুন সময়ে। কোথায় ছিল তারা যখন লোকটার হেদিয়ে মরেছিল, যখন তার মায়ের প্রয়োজন ছিল তখন কোথায় ছিল আপনার দুনিয়া? দুনিয়া ভুলে গেলেও আমি পারব না লোকটার অবদান। দুনিয়ার সাথে যা-ই করুক সে, আমার কাছে সে ছিল স্বচ্ছ, পানির মতো স্বচ্ছ, ফুলের মতো কোমল ছিল তার আচরণ। এই জনমে আমি মেটাতে পারব না তার ঋণ। সে পাপী হলেও আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ, অপার কৃতজ্ঞ। আমি ভুলতে পারব না সেই সময়গুলো, যখন আমার চোখের জল তার চোখে জল আনিয়েছে। আমার যন্ত্রণা নিঃশব্দে কাঁদিয়েছে লোকটাকে। আপনি যখন কষ্ট দিয়ে চলে যেতেন, তখন সেই লোকটাই টিস্যু এগিয়ে দিত। সে আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। বন্ধুত্বের মর্যাদা যে রাখতে না পারলেও সে শ্রেষ্ঠ পাপী। সেই পাপী সে, যে শত্রুর ভালোবাসার যত্ন নিয়েছে। দুনিয়া কলঙ্ক দিক আমাকে, কালি ছুড়ুক আমার মুখে। তবুও আমি বলব, আপনি যদি একটা সুযোগ পেতে পারেন, অবশ্যই সেও পেতে পারে। সে তো শুধুই ভালোবাসতে চেয়েছিল। যে সহ্য করতে জানে, দুনিয়া শুধু তাকেই কেন নিঃস্ব করে দেয় বারবার? দুনিয়া, দুনিয়ার মানুষেরা যা খুশি বলুক না। এবার না-হয় আমি আমার মনের কথা শুনি একটু। যে অনুতপ্ত হয়, তাকে সুযোগ দিতে হয়। দয়াকরে এত নিষ্ঠুর হবেন না দুনিয়ার মতো। লোকটার পুরোটা জীবন গিয়েছে ধোঁকার উপর দিয়ে। ভাগ্য বরাবরই তাকে ঠকিয়ে গিয়েছে।”

‘রিচার্ড নির্বাক। বটগাছের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিথর। লুকাসের মুখে কোনো শব্দ নেই। সবিতা বেগম কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছেন, চোখে বিস্ময়ের ছায়া।এলিজাবেথ ছুঁড়ে ফেলে দেয় ছুরিটা। জখম হৃদয়ের ভারে হেঁটে আসে রিচার্ডের কাছে। চোখে দাহ! কণ্ঠে জ্বলন্ত আর্তি। হঠাৎ বসে পড়ে এলিজাবেথ। জাপটে ধরে রিচার্ডের পা,
“আপনার তো তাও আমি আছি। তার কে আছে বলুন? আরে আপনি তো নিজের মা-বাবাকে কয়েক বছরের জন্য হলেও কাছে পেয়েছিলেন, তাদের স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছিলেন। সে তো কিছুই পায়নি। অথচ সব ছিল তার। তাও কিছুই পায়নি। তার থেকে বড় দূর্ভাগা আর কে আছে বলুন না? নিজের মায়ের রক্ত ঝড়েছে তার হাত দিয়ে। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? তার সবথেকে বড় শাস্তি, সে বেঁচে আছে। ধুঁকে ধুঁকে মরবে সারাজীবন। আপনি তো সেটাই চেয়েছিলেন তাই নাহ? তবে তাই হোক। তবুও সে বেঁচে থাকুক। ভাগে এবার একটু সহায় হোক তার উপর।”

‘রিচার্ড পরপর কয়েকবার ভারি নিঃশ্বাস ফেলে বসল হাঁটু মোড়ে। ঝুঁকে অঝোরের কাঁদতে থাকা মেয়েটার রক্তার্ভ অবয়ব দুহাতের আজলায় চেপে ধরে উপরে তুলল৷ এলিজাবেথের নিঃশ্বাস অতি দ্রুত ছুটছে। কথাগুলো বারবার থেমে আসছে কণ্ঠনালিতে। এলিজাবেথ নিজেও আলগোছে আগলে ধরল রিচার্ডের ধারালো চোয়াল। নিদারুণ কোমলতা মাখানো গলায় বলল,
“মানবজীবনে এমন দ্বন্দ্ব বিবাদ অনেক হয়ে থাকে। তাই বলে কি কেউ কাউকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে? দিন শেষে আবারও সবাই এক হয়। দ্বন্দ্বের পরেও মানুষ একসাথে আছে মানে এটা নয়, সে ভুলে গিয়েছে। এজন্য থাকে, কারণ তারা মাফ করে দেয়। আপনিও ভুলে যান না সবকিছু। জান! প্লিজ জান৷”

‘অনবরত বাজতে আছে ফোনটি কর্কশ শব্দ তুলে। বিরক্তে লাড়ার কপাল কুঁচকায়। বালিশের নিচ থেকে মাথা বের করে হাতড়ে ফোন খুঁজে কান তুলতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল একজন পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর,
লাড়ার দিকে। ধীরে ধীরে বলল,
“লাড়া আমার হৃদয়হরণী, প্রণয়নী ভালোবাসি তোমায়।”
‘সকাল সকালই ফুরফুরে মেজাজে তিরিক্ষি মেজাজে পরিণত হয় লাড়ার মেজাজ। প্রেম ফাজলামিতে সাই না দিয়ে কল কেটে ফোনটাকে ছুঁড়ে মারে লাড়া। আবারও উপুড় হয়ে চোখ বুজল। হঠাৎ মস্তিষ্কে ধাক্কা খেলো৷ কলে প্রেম ছিল। প্রেম আজ আবারও ভালোবাসার নিবেদন জানালো? কিন্তু প্রেম তো সেদিনের পর আর কোনোদিন মুখ থেকে এই কথা বের করেনি। লাড়া কানে বাজতে থাকে প্রেমের বলা সেই কথাগুলো,
“আবার আরেক দিন বলব। মৃত্যুর আগের দিন বলে যাবো শেষ বারের মতো ‘লাড়া আমার হৃদয়হরণী, প্রণয়নী ভালোবাসি তোমায়।”

‘লাড়া তড়িৎ প্রবাহের মতো উঠে বসল। দরদরিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোনের স্ক্রিন অন হতেই সোশ্যাল প্লাটফর্ম হতে একটা নোটিফিকেশন আসে। চাপ লাগতেই একটা সংবাদ মাধ্যমেের ভিডিও চালু হয়ে যায়৷ সেখানে দেখা যায় সকালেই প্রকাশিত হওয়া একটি তাজা নিউজ।
[ব্রেকিং নিউজ: রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়, তবে দেশের মানুষ নিরাপদ কোথায়? সাম্প্রতিক সময়ে আতঙ্কের জন্ম দেওয়া একের পর এক সিরিয়াল কিলিং-এর ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। অবশেষে বহু চেষ্টার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ খুনিকে শনাক্ত করেছে। তবে তার পরিচয় যেন বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি আর কেউ নন—সিআইডি অফিসার প্রেম আহসান।

বিগত কয়েক মাস ধরে একের পর এক যুবতী নিখোঁজ হচ্ছিলেন রাজধানীসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। কিছুদিন পরেই পাওয়া যাচ্ছিল তাদের বিকৃত মরদেহ ঠোঁট কাটা, মুখে হিংস্র নির্যাতনের চিহ্ন। প্রত্যেকটি খুনেই ছিল একই প্যাটার্ন, একই নির্মমতা। ধর্ষণের কোনো আলামত না থাকলেও, খুনের ধরনে ফুটে উঠছিল এক বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর প্রবণতা। অবশেষে ফাঁস হয় সেই অন্ধকার সত্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে খুনের কিছু গোপন ভিডিও যেখানে খোদ সিআইডি অফিসার প্রেম আহসানকেই দেখা যায়। একজন আইনরক্ষক যিনি কিনা নিজেই হয়ে উঠেছে আইনের ভয়ঙ্করতম ভাঙন। এই ঘটনার পর পুরো আইন বিভাগে নেমে আসে এক অভাবনীয় গ্লানি ও শোকের ছায়া। অফিসার প্রেম আহসান বর্তমানে পলাতক, তাকে খুঁজছে পুলিশ। ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য সাথেই থাকুন।

আমরা খুব শীঘ্রই হাজির হবো আরও তথ্য নিয়ে।]
‘নিউজটা দেখামাত্রই লাড়ার বুকের ভিতরটা দরদর করে উঠল। ঠিক তখনই প্রেমের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আসে। উত্তেজনায় হাত কাঁপতে থাকে লাড়ার। তড়িঘড়ি করে মেসেজটা খুলে দেখে একটা লোকেশন। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ড্রয়ার থেকে নিজের পার্সোনাল গান আর বাইকের চাবি তুলে নিয়ে হস্ততস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল লাড়া। বুকের ভিতর অস্থিরতার ঢেউ যেন ঘূর্ণি তুলছে।
‘এক হাতে গিয়ার ধরে অন্য হাতে অনবরত ফোন করে যাচ্ছে প্রেমকে। কিন্তু বারবার ভেসে আসে সেই একটাই ভেসে আসা কণ্ঠ—”এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।” রাগে চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে লাড়ার। প্রেমের পাঠানো ঠিকানামতো একটি পুরনো ব্রিজের কাছে গিয়ে বাইক থামায় লাড়া। নামতেই চারপাশে চোখ ঘোরায়। যেন ক্ষুধার্ত কোনো পাখি তার হারিয়ে যাওয়া সাথীকে খুঁজে ফিরছে।

“হেই লাড়া জান্স।”
‘চমকে উঠে সামনের দিকে ঘোরে লাড়া। প্রেম বসে আছে ব্রিজের রেলিঙে। পা দু’টো ঝুলে আছে নিচের দিকে। প্রেমের হাসিখুশি মুখটা আজ মলিন, ঠোঁটজোড়া ফ্যাকাসে, চোখ লাল, অসম্ভব লাল। শক্ত গোছের ছেলেটা কি কান্না করেছে? লাড়া দৌড়ে যেতে চায় প্রেমের দিকে। হঠাৎ প্রেম পকেট থেকে একটি গান বের করে সেটি নিজের কপালে ঠেকিয়ে ধরে। থমকে যায় লাড়ার পা।
“নো! প্রেম, নো!”
‘চিৎকার করে উঠে লাড়া। গলা ছিঁড়ে ফেলবার উপক্রম সেই আর্তনাদে। সময় থেমে যায়, বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। প্রেমের চোখে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে নাকি বৃষ্টির ফোঁটা কেউ জানে না। প্রেম ইশারায় লাড়াকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। রেলিঙের উপর থেকে অবহেলিত ফোনটা হাতে নিয়ে কল করল লাড়ার নাম্বারে। শ্বাসপ্রশ্বাস গুলো যেন দৌড়প্রতিযোগিতায় নাম লেখিয়ে ছুটছে আজ। লাড়া সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করল।

”লাড়া আমার হৃদয়হরণী, প্রণয়নী ভালোবাসি তোমায়।”
‘লাড়া এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ঠুকরে উঠল। থরথরিয়ে কেঁপে উঠে কণ্ঠ। গলা ফাটিয়ে বলে উঠল,
“প্রেম, প্লিজ না… তুই এটা করতে পারিস না, অফিসার। আই বেগ ইউ…”
‘প্রেম বরাবরের মতোই গা ঝাড়া ভাব নিয়ে ঠোঁটে হাসি খেলাল। দুঃখের মুখোমুখি হয়ে ঠাট্টা করে বলল,
“কেন প্রেমে পড়ে গেলে নাকি প্রেমের?”
‘আজ লাড়া কাঁদছে। নিজের শক্তপোক্ত তকমাটা যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে। আকুতি মাখা টলমলে চেয়ে চোখে বলল

“প্রেম আমি কোনোদিন ভালোবাসা পাইনি। চোখের সামনে দেখেছি যার দিকে মন ছিল সে অন্য কারোর হয়ে যাচ্ছে।আমার মা নেই প্রেম, খুব ছোটবেলায় হারিয়েছি তাকে। এমনকি মুখটাও মনে নেই ভদ্র মহিলার। ড্যাড থেকেও ছিল না। সবসময় দূরের মানুষ ছিল লোকটা। এই পাওয়া না-পাওয়া জীবনে একটা বন্ধুই ছিল, আর আজ তাকেও হারাতে বসেছি…৷ কেন প্রেম? আমার পূর্ণতার খাতা সবসময় কেন শূন্য রয়ে যায়?”
‘কথাগুলো থেমে এলো কান্নায়। ফ্যাসফাঁসে গলায় লাড়া আবারও বলল,
“তুই যখন সেই বিরক্তিকর জোকসগুলো বলতি,আমার রাগ হতো ঠিকই। তবে বিশ্বাস কর অফিসার সেই সময় আমি অনুভব করতে পারতাম আমারও কেউ আছে। আমার জন্য হলেও প্লিজ থেকে যা, অফিসার…”
‘প্রেম, একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পুরুষ। এই শেষ মুহূর্তে এসে নিজেকে ভেঙে পড়তে দিল না সে। ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখল। নিরেট ঠান্ডা গলায় বলল,

“আমি পারলাম না লাড়া, তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্বটা যথাযথ পালন করতে…”
‘দু’জোড়া চোখ দূর হতে কাতর অপলক তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। মুহূর্তটা থেমে আছে যেন এক নষ্ট ঘড়ির কাঁটায়। লাড়া বহু কষ্টে কাঁপা ঠোঁটের কম্পন থামিয়ে নিঃশব্দ যন্ত্রণায় বলল,
“থেকে যা অফিসার…”
‘ব্যাথতুর কণ্ঠে গুরুতর কথাটাকেও হেসে উড়িয়ে দিল প্রেম। দূর থেকে ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,
“থেকে গেলেই বুঝি আমার হবে?”
“নামহীন সম্পর্কে নাহয় রয়ে গেলাম আমরা সারাজীবন। যেমনটা ছায়া আর আলোর সম্পর্ক। কোনো বন্ধনে বাঁধা নয়, তবু একটার অস্তিত্ব ছাড়া অন্যটা অসম্পূর্ণ…”

”শিরশিরে অনুভূতিতে ভিজে গেল প্রেমের চোখ। ঘাড় ঘুরিয়ে আলগোছ লুকানোর চেষ্টা করল দুঃখের পাহার। পরপর কয়েক দফা ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলে আবারও চাইল লাড়ার দিকে। লাড়ার চোখে আজ অদ্ভুত এক মায়া তারজন্য। ফোনটা বুকে চেপে ধরল প্রেম। যথাসম্ভব চেষ্টা করেও আজ নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে অফিসার প্রেম আহসান। দীর্ঘশ্বাস টেনে প্রেম ফোন কানে তুলল।
“আমি বাঁচতে চাই লাড়া।”
“আমি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি৷ ফিরে আসো প্রেম। নতুন করে বাঁচো।”
‘লাড়া সত্যি সত্যি এক হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রেম ঠৌঁট কামড়ে ধরল। কান্না আটকানো বুঝি এতো দায়?
“আমি আর আমার কর্মে ফিরে যেতে পারব না। এতো শখের পেশা ছেড়ে কিভাবে থাকব আমি? ছোট থেকে আমার স্বপ্ন ছিল এটা। আমি সেগুলো ইচ্ছেকৃত ভাবে করিনি। কি যেনো হয়ে যেতো আমার। অস্থির এক অনুভূতি কাজ করত, নিজের মধ্যে থাকতাম না আমি। সকলের চোখের ঘৃণা গুলে গ্রহণের মতো দহন নিতে পারব না আমি লাড়া।”
‘লাড়া নির্বাক। তার কাছে জবাব নেই। প্রেম কিছু বলতে চাইছিল,

“লাড়া আমি,,,,,
‘তখনই কাছের কোনো এক রাস্তা হতে ভেসে আসে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল লাড়ার। চকিতে চাইল প্রেমের দিকে, যে আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। দু’টি কাতর চোখ অমীমাংসিত দৃষ্টিতে আবদ্ধ হতেই প্রেমের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বিটক এক শব্দে গুলির ঝাঁঝ মস্তক ভেদ করে বের হল। প্রেমের দেহাটা আঁচড়ে পড়ল পানিতে। শেষ অব্দি আহত দৃষ্টি চেয়েছিল লাড়ার দিকে। চিৎকার করে ছুটে গেল লাড়া। তবে ধরতে পারল না উড়াল দিতে চাওয়া পাখির পাখনা। পাখি উড়াল দিয়েছে তার গন্তব্যে। রেলিঙের উপর ঝুঁকে ফুটন্ত পানির মতো বুদবুদ করতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে লাড়া। চারিপাশে নেমে আসে ভয়াল নিস্তব্ধতা। মৃত্যুর ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারিপাশ। স্থলে জলে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে লাড়ার গগনবিদারী চিৎকার। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল লাড়া। কেমন যেন নিঃস্ব নিঃস্ব লাগছে আজ নিজেকে, যেমনটা লেগেছিল, রিচার্ডের বাহুডোরে এলিজাবেথকে দেখে।

(একজন সাইকোপ্যাথের জন্মকথা)
‘শুনতে মন্দ শোনালেও কিছু কিছু মা-বাবার জন্য নষ্ট হয় সন্তানদের জীবন। প্রেমের জন্ম হয়েছিল ভালোবাসার সংসারে। অন্তত বাইরের চোখে তাই মনে হতো। মা-বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন সমাজ-সংসারকে তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু ভালোবাসার গল্পটা আটকে গিয়েছিল শুধু শুরুতেই। এরপর ছিল শুধুই অশান্তি, ঝড়, ভাঙন। প্রেম যখন পৃথিবীর ভাষা বুঝতে শিখছে তখন তার কানে ঢুকছিল চিৎকার, থাপ্পড়ের শব্দ, মায়ের কান্না। মা-বাবার প্রতিটি ঝগড়ার মাঝে ছোট্ট প্রেম খুঁজে ফিরত একটু শান্তি, একটু ছায়া। কিন্তু সেই আশ্রয়ও ছিল না তার জন্য। বাবা ছিল জোয়ায় আসক্ত, রাতভর খেলায় হেরে ঘরে ফিরত ক্ষিপ্ত হয়ে, ঝাল ঝাড়ত মায়ের উপর। কাঁপা কাঁপা হাতে মা প্রেমকে বুকে জড়িয়ে রাখত।তার বুকের ভেতরেও জমে থাকত ভয়।

‘সাত বছর বয়সে একদিন প্রেমকে জিজ্ঞেস করা হয় সে কার সঙ্গে থাকবে? মা না বাবা? প্রশ্নটা তার ছোট মনটা ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সে চুপ করে থাকে। অথচ এই প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে। বারবার তাকে দুই টুকরো করে ফেলে। মা ছিল ভালো কিন্তু অসহায়। চোখে কালি, ঠোঁটে ফাটল, শরীরে আঘাতের চিহ্ন সবকিছু নিয়েও সে সন্তানকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিল। সে বলত প্রেমের জন্যই সব সহ্য করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রেম একদিন দেখে ফেলে—তার মা যার হাসি দেখে কেউ একদিন প্রেমে পড়েছিল সেই হাসির নিচে ছিল রক্ত, ক্লান্তি আর অভিশাপ।
‘প্রেম মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি এমন একজনকে বিয়ে করলে কেন?”

‘মা বলেছিল, “কারণ সে আমার হাসি পছন্দ করত। আমার হাসির পাগল হয়েই আমাকে বিয়ে করেছিল।”
‘এই উত্তরে প্রেমের হৃদয়ে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা। একটা হাসির জন্য কেউ একজন জীবন বাঁধে? তারপর সে হাসি হারিয়ে গেলে অন্য হাসির পেছনে ছুটে যায়? তাহলে সেই ভালোবাসার মানে কোথায়? এরপর সব আরও খারাপ হতে থাকে। প্রেমের বাবা জড়িয়ে পড়ে অন্য এক মেয়ের সঙ্গে। সংসারে আসে নতুন মানুষ, পুরনো সম্পর্ককে পিষে ফেলে আরও নীচে। মা একদিন আর সহ্য করতে পারে না। আত্মহত্যা করে। প্রেম তখন বারো। তার ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়ায় ফুপু। বিধবা, নিঃসন্তান, একটু স্নেহ নিয়ে তাকে আগলে রাখে। কিন্তু কপাল এখানেও পুড়ে যায়। কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান ফুপুও। এরপর প্রেম যেন ভেসে যায়। হয়ে পড়ে সম্বলহীন, দিকহীন। বাবা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রেমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনাথ আশ্রমে।

‘সেখানেই জন্ম নেয় প্রেমের দ্বিতীয় রূপ। সে ধীরে ধীরে নিঃশব্দ হয়ে যায়৷ চোখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায়। যে ভালোবাসা চেয়েছিল সে। তবে তা তাকে বারবার ফেলে দিয়েছিল অন্ধকারে। সে অনুভব করতে শুরু করে, মেয়েদের হাসি মানেই প্রতারণা। একদিন তার মায়ের হাসি হারিয়ে যায়, আরেকদিন বাবার নতুন প্রেমিকার হাসি তার জীবনের শেষটুকুও কেড়ে নেয়। টিনএজ প্রেম আর পাঁচজনের মতো ছিল না। সে কারও চোখে চোখ রাখত না, মুচকি হাসিতেও মুখ ফিরিয়ে নিত। অথচ যখন কোনো মেয়ের মুখে ঠিক সেই পুরনো হাসির ছায়া খুঁজে পেত তার ভেতর যেন জেগে উঠত তীব্র কষ্ট, রাগ আর প্রতিশোধের আগুন।

‘সে ভাবত এই হাসিই আমার সবকিছু নষ্ট করেছে। প্রথম হত্যাটা ছিল অস্পষ্ট। একটা মেয়ে যে বন্ধুর মতো ছিল, হেসে বলেছিল,”তুমি তো অনেক চুপচাপ, কিন্তু তোমাকে হাসতে দেখতে ভালো লাগবে।”সেই হাসিতে প্রেম দেখেছিল তার মায়ের প্রতিচ্ছবি। ওই রাতে মেয়েটির নিথর শরীর পড়ে ছিল রাস্তার ধারে। কেউ জানে না কে করল। প্রেম শুধু জানত। সে খুব হালকা অনুভব করছিল অনেকটা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো। তারপর একে একে আরও। মেয়েরা যাদের হাসিতে ছিল আকর্ষণ। প্রেম সেখানে খুঁজত ছলনা আর ছলনার শেষ করতে ছুটত সে। নৃশংসতা তার কাছে ছিল ন্যায়বিচার। প্রতিটি হত্যার পর তার মনে হতো সে যেন নিজের অতীতকে একটু করে মুছে দিচ্ছে। এভাবে প্রেম হয়ে ওঠে এক ঠান্ডা মাথার সাইকোপ্যাথ৷ যার চোখে ভালোবাসা নেই, করুণা নেই। শুধু আছে একটা হাসির বিরুদ্ধে চাপা ঘৃণা, যা জন্ম নিয়েছিল সেই দিন, যখন মা বলেছিল, “তোমার বাবা আমার হাসি পছন্দ করত।”
‘তবে প্রেম যেমনই হোক কর্মজীবনে ছিল সৎ, নিষ্ঠাবান এক অফিসার। ছোটবেলা থেকেই তার চোখ ছিল পুলিশের পোশাকে। নিজের কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠার মাধ্যমে হয়ে ওঠে সে এক গর্বিত পুলিশ অফিসার। একের পর এক প্রমোশন, সম্মান। তবুও তার জীবন ছিল নিঃসঙ্গ। একঘেয়ে সেই জীবনে একমাত্র রঙ ছিল তার পেশা। তবে তার চরিত্রে যে ভয়ংকর ছায়া ছিল—সেই অন্ধকার দিক, যেটা কখনো তার পেশাকে কলুষিত করেনি। প্রেম এতটাই নিখুঁত ছিল যে কেউ জানতেই পারেনি তার ভিতরে আরেকটা সত্তা লুকিয়ে আছে।

‘প্রথমবার এক অচেনা মেয়ের হাসিতে কোনো বিষাদ খুঁজে পায়নি প্রেম। নিজেই অবাক হয়েছিল সেদিন। সে জানত না প্রেমে পড়বে এক মেয়ের। যেখানে তার নামেই আতঙ্কে কেঁপে উঠে শহর। তবে বাকি চরিত্রের মতো এ গল্পে প্রেমের ভালোবাসারও জায়গা ছিল না ছিল কেবল প্রতিক্রিয়া, অনুশোচনা আর ছিন্নভিন্ন এক সমাপ্তি। কারণ প্রেম জানত নিজের ভিতরের হিংস্র রূপ। জানত, নিজেকে যতই দূরে রাখার চেষ্টা করুক সে টান ঠিকই তাকে ফিরিয়ে আনবে। তবে সেই ভালোবাসা পূর্ণতা না পেলেও প্রেম হয়তো আজ বেঁচে থাকত যদি না সে জড়িয়ে পড়ত রিচার্ড কায়নাত নামক ভয়ংকর খেলোয়াড়ের খেলায়।
‘রিচার্ড জানত প্রেমের সব। জানত প্রেম সাইকোপ্যাথন। যা তখন দুনিয়ার কেউ জানত না। রিচার্ড কাউকে সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে না। আগে দেয় সতর্কবার্তা, দেয় সময়, বুঝে নেয় প্রতিক্রিয়া। তারপরই খেলা শুরু। প্রেম শুরু থেকেই ছিল রিচার্ডের পেছনে লেগে ছিল। একবার বাগানবাড়িতে এক মেয়ের হাসির কথা বলে প্রেমকে শব্দহীন হুমকিও দিয়েছিল রিচার্ড। প্রেম তখনো গুরুত্ব দেয়নি।

‘প্রেমের দ্বিতীয় সত্তার কথা জানত শুধু রিচার্ড, লাড়া আর এরিক। লাড়াও রিচার্ডের মতোই একজন, সুযোগ পেলেই মেয়েদের নিয়ে কটাক্ষ করত প্রেমকে। তাতে প্রেমের জবাব বন্ধ হয়ে যেত। আর এরিক সে শুধু তাকবীর নয় প্রেমের অতীতও তুলে এনেছিল টেবিলে। প্রেমের মুখের উপর কোনো ব্যবস্থা না নিয়েও দিয়েছিল সতর্কবার্তা। তবু প্রেম ছিল উদ্দাম, বেপরোয়া। সেই বেপরোয়া ভাব শেষ করে দেয় মাঠের কোচ—রিচার্ড কায়নাত। এরিক সুযোগ দিলেও রিচার্ড ভুলে যায়নি কোনো হিসেব। সময় মতো ছক কষে প্রেমকে সরিয়ে দেয় সে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে প্রেমকে মেয়েদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাতে দেখা গেছে, সেগুলোর পোস্টার আর কেউ নয় রিচার্ড নিজে। সবশেষে প্রেমের গল্পটা ছিল না কোনো ভালোবাসার। ছিল এক বুনো আগুনের যেটা ভুল হাতে পড়ে শেষমেশ নিজেকেই পুড়িয়ে ফেলল।

‘বুকে হাত চেপে উঠে দাঁড়াল লাড়া। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। বুকের ভেতর অজানা কাঁপুনি। হঠাৎ নজরে পড়ল রেলিঙের উপর রাখা একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ। কিছু একটা টের পেল সে। ধীরে, কাঁপতে কাঁপতে কাগজটা হাতে তুলে নিল। ভাঁজ খুলে যেই পড়া শুরু করল, চোখে ছলা ছলা জল…
প্রিয় লাড়া,
তোমার অপ্রিয় প্রেম আহসান। অফিসার প্রেম আহসান।
I’m extremely sorry লাড়া। আমি পারলাম না তোমাকে আগলে রাখতে। স্বার্থপরের মতো চলে গেলাম। তবে আমার ভালোবাসা? পুরোটাই রেখে গেলাম তোমার জন্য। যত্নে রেখো, প্লিজ। আমি পারিনি তোমাকে যত্নে রাখতে।
‘লাড়া আমার বাপ নাই, মা নাই। আমার পেশাই ছিল আমার সব। সন্তানের মতো ছিল আমার পেশা আমার কাছে। বিশ্বাস কর আমার দ্বিতীয় সত্তা যেমনই হোক, আমি আমার পেশার প্রতি ছিলাম সৎ। কাল যারা আমাকে দেখে শ্রদ্ধায় দাঁড়াতো, সালাম দিতো, তারা কাল ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। লোকে গালি দেবে, কাদা ছোঁড়াবে। সেই অপমান, সেই অবজ্ঞা আমি সইতে পারব না লাড়া। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণার মতোই, সম্মান হারানোর ব্যথাও সহ্যের নয়।

‘আমি দুঃখিত, লাড়া। খুব করে দুঃখিত।
তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি এই অপরাধের জন্য।
ভীতু মানুষের প্রেমে পড়তে নেই। প্রেমিক হলে সাহসী হতে হয়। সত্যের পাশে দাঁড়াতে হয়। আমার সেই সাহস ছিল না। যদি থাকত, তাহলে হয়তো,,,,,,হয়তো আমাদের গল্পটা আরেকটু দীর্ঘ হতো। চলার পথে একদিন তোমায় পাশে পেতাম। কিন্তু আমি পারিনি। আমি তো ভীতু। লোকের চোখের ঘৃণার থেকে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। তবে আজ আমি নিজেকে শেষ করছি না, শেষ করছি আমার ভিতরে থাকা সেই পৈশাচিক সত্তাকে।
‘মাঝের কয়েকটা লাইন ঘেঁটে গেছে। হয়তো চোখের পানি ছিল। লাড়া নিঃশ্বাস আঁটকে ধরে আবারও পড়তে শুরু করল
‘বেশি ভালোবাসলে মানুষ তুচ্ছ মনে হয়।

আমি সেই তুচ্ছত্ব মেনে নিয়েও তোমাকে চেয়েছি লাড়া। খুব করে চেয়েছি, আমার স্রষ্টার কসম। দেখো সময় কতো কম আমার হাতে। চিঠিতে সবাই সব বলে, আর আমি কিছুই ঠিক করে বলতে পারছি না। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। ভয় হচ্ছে। না জানি কোন দিক দিয়ে পুলিশের একটা জিপ এসে হাজির হয়। চোখের সামনে তুলে ধরে মোটাসোটা একটা হ্যান্ডকাফ। আমার ভিতর শব্দ আছে, কিন্তু সময় নেই। পৃষ্ঠার শেষের অংশের মতোই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল আমার জীবনও।
‘আর হ্যাঁ একটা কথা লাড়া, কাঁদবে না একদম—দয়া করে? আমি এবার পারিনি তো কী হয়েছে! পরেরবার ঠিক পারব। তখন ইন্ডিয়া হারবালের শরণাপন্ন হয়েই আসব তোমার কাছে।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৪

ইতি,
অপ্রিয় প্রেম।
লুজার অফিসার।
‘সত্যিই শেষে লাড়া আর কাঁদল না। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। চিঠিটা সযত্নে ভাঁজ করে পকেটে রাখল। তারপর কোমরে গুঁজে রাখা রিভলভারটা বের করে শক্ত করে ধরল হাতে। বাইকে গিয়ে বসল চুপচাপ। রওনা দিল এক ভয়ংকর যাত্রার উদ্দেশ্যে। যেখানে ফিরে আসার কথা কেউ ভাবে না।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫ (২)