ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫ (২)
মিথুবুড়ি
‘অসময়ের বৃষ্টির মতো হঠাৎ বদলে গেল কোর্ট প্রাঙ্গণের পরিবেশ। উপচে পড়া ভিড় দমকা হাওয়ায় উড়ে যাওয়া বালির মতো মিলিয়ে গেল যেন হঠাৎই। নেই সাংবাদিকদের আনাগোনা, চারপাশ থমথমে। গুমোট পরিবেশে রূপান্তর হয়েছে জায়গাটি মূহুর্তেই।
‘সরকারি কোনো পক্ষ থেকে নয় হঠাৎ করেই প্রায় বিস্ময়ের মতো আদালতে হাজির হয় এক খ্যাতনামা ব্যারিস্টার তাকবীরের পক্ষে অ্যাটার্নি হিসেবে। ঘটনাটি তাকবীরকে একেবারে স্তব্ধ করে দেয়। জলজ্যান্ত হলেও সে যেন প্রাণহীন; কাঠের তৈরি কোনো জড়বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু কাঠগড়ায়। আর ফাঁপা চোখে চেয়ে দেখে কিভাবে একক পদক্ষেপে অ্যাটার্নি পুরো মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেন। তাকবীর যা করেছে তার জন্য ফাঁসির আদেশ ছিল অনিবার্য। কিন্তু দণ্ডবিধির ধারা ৪৬৫ অনুযায়ী যদি কোনো আসামি বিচারযোগ্য অবস্থায় না থাকে অর্থাৎ মানসিক ভারসাম্যহীন হয় তবে বিচার স্থগিত রাখতে হয়। এবং ধারা ৪৬৮ অনুযায়ী তাকে মানসিক চিকিৎসার আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। এই আইনি ফাঁকটাই ব্যবহার করেন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সেই অ্যাটার্নি। জজ সাহেবের সামনে পেশ করেন তাকবীরের মানসিক অসুস্থতার একগুচ্ছ রিপোর্ট। যার সবগুলো যে নিখুঁতভাবে সত্যনিষ্ঠ, এমন নয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘তাকবীর আগে থেকেই হ্যালুসিনেশন নামক এক জটিল সমস্যায় ভুগছিল, তবে আদালতে সেটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। সেই কৌশলই ফাঁসির রায় থেকে রক্ষা করে তাকবীরকে। আদালত আদেশ দেয় তাকবীরকে চিকিৎসার জন্য পাবনার মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হবে। অপরদিকে তাকবীরের সকল অপরাধে সহায়তাকারী রেয়ানকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তাকবীর তখনও যেন এই পৃথিবীতে নেই। সামনে যা ঘটছে, চোখে দেখে সে কিন্তু মস্তিষ্ক তা বুঝে উঠতে ব্যর্থ। সবকিছুই তার কাছে একটি অনস্তিত্বের চিত্রনাট্য -নীরব অথচ প্রগাঢ়।
‘রায় ঘোষণার পর তাকবীরকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলা হচ্ছিল। হঠাৎ তাকবীরের গোলাটে দৃষ্টি গেল আদালত প্রাঙ্গণের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা লাল চুলের এক রমনীর উপর। সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ প্রবাহের মতো একটি ঝাঁটকা খেল গড়ন। পা থমকে গেল সেখানেই। ফাঁপা দৃষ্টিতে মূহুর্তেই প্রাণ ফিরে এল। অধর হেলে গেল দুপাশে গাল প্রসারিত হয়ে৷ দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল কপালের উপর আঁচড়ে পড়া চুলগুলো। সূর্যের সোনালী দূত্যিতে জ্বলজ্বল করে উঠে কৃষ্ণগহ্বর। নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে দীর্ঘক্ষণ লাস্যময়ীর মুখাবয়বে চেয়ে ভিতরের সকল তৃষ্ণা মিটিয়ে দৃষ্টি ধীরে ধীরে নিচে নামতেই থমকাল। শখের নারীর হাত আবদ্ধ আরেকটু পুরুষের হাতে। খুব শক্ত করে ধরা।
‘সমুদ্রের উতালপাতাল ঢেউয়ের দোলায় দুলে উঠল অভ্যন্তর। রিচার্ড শক্ত হাতে চেপে ধরে রেখেছে এলিজাবেথের হাত। পিছনে সারি সারি করে রাখা কয়েকটি কালো মার্সিডিস। তাদের দু’পাশে রক্ষাকবচের মতো দাঁড়িয়ে কালো পোশাকদারী অনেকগুলো গার্ড লম্বা দূর্গের মতো। এলিজাবেথ ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি মেলে চাইল তাকবীরের হাতের হাতকড়ায়, চাইল ফ্যাকাসে শ্যাম বর্ণে। অতঃপর ঘাড় তুলে চাইল রিচার্ডের দিকে, অনুভূতি শূন্য মুখটাতে। এলিজাবেথ আলগোছে ছাড়িয়ে নিতে চাইল হাত। রিচার্ড কটমটিয়ে আরো শক্ত করে চেপে ধরল ওর হাত, তীব্র চাপ প্রয়োগ করে। এলিজাবেথের চোখের কোণে জল জমে। নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে নিঃশব্দে মাথা নুইয়ে ফেলে। ঠৌঁটের কোণ নিচে নেমে গিয়েছে অভিমানী নিরবতায়। রিচার্ড তা লক্ষ করে তপ্ত শ্বাস ফেলল। ক্লান্ত নাবিকের মতো ছেড়ে দিল হাত। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে এলিজাবেথ চাইল রিচার্ডের পানে। তার ঠৌঁট শক্ত করে চেপে রাখা, কুঁচকানো ভ্রুতে চাপা রাগ৷ এলিজাবেথ আজ সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে তাকবীরের দিকে এগিয়ে গেল।
‘তাকবীর সেই অনড় চিত্তাকর্ষক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এলিজাবেথের দিকে। হঠাৎ তার কব্জিতে বেপরোয়া টান পড়ল। আইনের রক্ষক টানছে গাড়িতে তোলার জন্য। রিচার্ড চোখ গরম করে তাকাতেই চুপসে যায় তাদের মুখাবয়ব। ছেড়ে দিল তাকবীরের কব্জি। থমথমে পরিবেশ যেন এক মুহুর্তের গেয়ে উঠল শোকে৷ অগ্রাসরিত পায়ের প্রতিটি পদধূলিতে মুচড়ে যাওয়া অনুভূতি গুচ্ছের মতো বুকের মাঝখান দিয়ে ভয়ে যাচ্ছে। এলিজাবেথ এসে দাঁড়াল তাকবীরের মুখোমুখি হয়ে। এই অসহনীয়, অসহায় মূহুর্তেেও হেসে ফেলল তাকবীর।
“আমার ড্যাডের সাথে আপনার কি সম্পর্ক ছিল?”
‘কথাটা খুব তীক্ষ্ণ ছিল। তবে তা যেন মাতোয়ারা সুর হয়ে প্রবেশ করল পাগল প্রেমিক পুরুষের কর্ণগহ্বরে। এলিজাবেথ পূনরায় জিজ্ঞেস করল একই স্বরে,
“আপনার সকল কূকর্মের নথিপত্রে আমার ড্যাডের নাম কেন ছিল? বলবেন না কাকতালীয়, এক নাম অনেকের ই হতে পারে।”
‘তাকবীরের কাছ থেকে এবারও কোনো জবাব এল না। সে শুধু তাকিয়ে আছে নির্ভার চোখে। জ্বলজ্বল করছে কার্নিশ কোণে সুপ্ত আলো। এলিজাবেথ অধৈর্য হল। গ্রীবা বাকিয়ে চাইল রিচার্ডের দিকে। যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে তার উপর। এবার বেশ শক্ত হল এলিজাবেথের কণ্ঠস্বর।
“ফাঁসির কাঠগড়ায় কিন্তু আপনাকে উঠতেই হবে৷ এ মুক্তি কিন্তু সাময়িকের।”
“তুমি বাঁচিয়েছ বুঝি!”সত্যটা জানা সত্ত্বেও অনর্থক প্রশ্নটা করল তাকবীর প্রাণহীন অভিব্যক্তিতে চেয়ে।
“আপনি যে-ই পাপ করেছেন, আপনার মুক্তি নেই। শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। হয় আজ নয় কাল৷”
“আজ তো তুমিই বাঁচিয়েছ, তাই না?”
‘এলিজাবেথ শক্ত করে ঠৌঁট চেপে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল,
“না।”
‘তাকবীর এক ফিচলে হেসে পূর্ণরায় দীপ্ত কণ্ঠেে শুধালো,”আমি জানি, বিশ্বাস করি৷”
‘এলিজাবেথ মিথ্যে হাসল,”বিশ্বাস? দয়াকরে এই শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। আপনার মুখে অন্তত এই শব্দটা মানায় না।”
‘থেমে, কণ্ঠনালিতে পাকিয়ে থাকা দলা শক্ত ঢোক গিলে ভিতরে পিষে এলিজাবেথ আবারও রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘আমি আপনারর মিথ্যা ছলনা বোঝার পরেও আপনাকে বলেছিলাম ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি, আমার বিশ্বাস টা ভাঙ্গবেন না প্লিজ।’ আপনি তবুও ভেঙে দিয়েছেন।”
‘তাকবীরের বুকের গভীরে যেন বাজ পড়ল। হৃদয়টা মোচড়াতে মোচড়াতে থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। চোখ তুলে তাকাল এলিজাবেথের দিকে ছায়াঘেরা, বিমূঢ়, আহত দৃষ্টিতে। ঠোঁট কাঁপে, গলা জড়ানো স্বরে ফিসফিস করে ওঠে,
“এলোকে…শী…”
‘এলিজাবেথ হাত তুলে থামিয়ে দেয় বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগ মূহুর্তে। ওর চোখ জ্বলছে রাগ, ঘৃণা সেই সাথে অভিমানে বুদবুদ। তাকবীরের কানের কাছে মুখ এনে বিষমাখা স্বরে ফিসফিস করে বলল,
“প্রতারণা করে ভাববেন না আপনি জিতেছেন। কাটা দিয়ে কাটা তোলার পুরোনো কৌশল কিন্তু আমি আমার স্বামীর কাছ থেকেই শিখেছি। যদি কখনো জানতে পারি আমার অতীতের সাথে আপনি জড়িত, তাহলে আপনার শেষ রক্তফোঁটা আমার হাতেই ঝরবে ”
‘শব্দগুলো যেন শীতল ছুরির মতো বয়ে গেল তাকবীরের শিরা-উপশিরায়। আমার স্বামী!এলোকেশীর স্বামী অন্যকেউ? মস্তিষ্কে কয়েকবার পাক খেলো শব্দটা। হঠাৎ তাকবীর করে বসল এক বিষ্ময়কর কান্ড। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশের কোমর থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেয়। অতঃপর এক ঝটকায় এলিজাবেথকে টেনে আনে নিজের বুকের সঙ্গে, কপালে ঠেকিয়ে দেয় বন্দুকের নল। আদালত চত্বরের বাতাস থমকে যায়। এলিজাবেথের মাথায় বন্দুকের সরু নল স্পর্শ করতে দেরি হয়, রিচার্ডের গার্ডদের হাতে থাকা অস্ত্র বিদুৎবেগে তাকবীরের দিকে যেতে দেরি হয় না। কিন্তু রিচার্ড—সে নিশ্চল, ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ সরু, চিবুক ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছে। এলিজাবেথের চোখে বিস্ময়ের ছায়া। অবিশ্বাসে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সে। সেই অবিশ্বাসের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু। তাকবীরের চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা নীরব জলবিন্দু। দুই ভেজা চোখের অমীমাংসিত সাক্ষাতে মাঝে দাঁড়িয়ে কড়া, নির্মম দৃষ্টিতে রিচার্ড। গার্ডরা প্রস্তুত। সেফটি লক খুলে নিয়েছে সবাই। এখন শুধু রিচার্ডের আদেশের অপেক্ষা। এদিকে পুলিশরা থমকে গেছে এত অস্ত্রের স্নায়ুক্ষয়ী নিশানার মুখোমুখি হয়ে। শ্বাসরুদ্ধ সময়, যেখানে একটিমাত্র শব্দই সবকিছুর ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ভয়ে পিছিয়ে গেল তারা।
‘থরথর করে কাঁপছে এলিজাবেথের ঠোঁট। কণ্ঠনালিতেও সেই কাঁপন। ভয়, দ্বিধা আর বিস্ময়ে গলে যাওয়া এক নিঃশব্দ আর্তি। রিচার্ড নির্বিকার। এক হাত পকেটে রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে এক চিলতে আত্মতৃপ্তি। এই বিপজ্জনক মুহূর্তও তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। এ দৃশ্য দেখে দূর থেকে দৌড়ে এসে উপস্থিত হয় ন্যাসো, লুকাস। ন্যাসো হাঁপাতে হাঁপাতে রিচার্ডের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“বস, আপনি এত রিল্যাক্স কিভাবে? ম্যামের তো প্রাণ বিপন্ন!”
‘লুকাসও যোগ করে, “একটু হেরফের হলেই ম্যাম শেষ হয়ে যেতে পারে বস।”
‘ রিচার্ড নীরব। তারা নিজেরা এগিয়ে যেতে চাইলেও রিচার্ড ঠান্ডা গলায় তাদের থামিয়ে দেয়। হতবাক তারা এই মানুষটি কি আদৌ অনুভব করে কিছু?
‘তাকবীরের তর্জনী তখন শক্ত হয়ে চেপে বসেছে ট্রিগারে। ঠোঁটের কম্পন থামিয়ে সে এক তুষ্ট হাসি হেসে বলে,
“Maybe in another world.”
‘মৃত্যুর সন্নিকটে জেনে চোখ বন্ধ করে ফেলে এলিজাবেথ। তবে শরীরে কোনো আঘাত না পেয়ে চোখ খুলে দেখে তাকবীর তাকিয়ে আছে তার দিকে এক আহত, ভালোবাসা-মাখা দৃষ্টিতে। আজ চোখের পানি থামছেই না লোকটার। রিচার্ড ঠোঁটের কোণে এক ফোঁস হাসি টেনে নেয়। সে জানত তাকবীর কখনোই পারবে না এই কাজ করতে। পারবে না এলিজাবেথকে গুলি করতে। তাকবীরের হাত আলগা হয়ে যায়।দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে ধরা গলায় বলে,
“আমি পারব না, এলোকেশী।”
‘কিন্তু ঠিক পরমুহূর্তেই তার মুখের ভাব বদলে যায়।
এক ঝটকায় এলিজাবেথকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।এবার বন্দুকের নলা সোজা তাক করে রিচার্ডের দিকে।
লুকাস, ন্যাসো আজ দ্বিধায় পড়ে যায় তাকবীরের দিকে বন্দুক তাক করতে। তবু তারা নিয়মের দাস। বন্দুক তাক করতেই হয় তাকবীরের দিকে।
‘তাকবীরের গর্জন, “তাকে না পারি, তোকে তো ঠিকই পারব!”
‘চমকে উঠে এলিজাবেথ। ছুটে গিয়ে রিচার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। দু’হাতে আগলে ধরল রিচার্ড’কে।
রিচার্ড এখনও নির্বিকার, ঠান্ডা। এলিজাবেথ কাঁপা কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে,
“আমার স্বামীর বুকে গুলি চালানোর আগে, আপনাকে আমায় মোকাবিলা করতে হবে মি. তাকবীর!”
‘বন্দুক নামিয়ে হঠাৎ করেই পাগলের মতো হেসে উঠল তাকবীর। মুহূর্তটা যেন নাট্যমঞ্চের নাট্যশালা হয়ে উঠেছে। সবাই নীরব সাক্ষী দুই ভাইয়ের এই দ্বন্দ্বের। একটি নারীকে ঘিরে ভাঙছে রক্তের সম্পর্ক। এক মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েও আজ তারা একে অপরের শত্রু। সম্পর্কের জটিল অঙ্কে আজকের এই নাটকীয়তা এক নিষ্ঠুর রাজসাক্ষ্য।
‘তাকবীর হাসছে। খুব করে হাসছে। কোনো ভাবেই থামছে না তার হাসি। অস্বাভাবিক, উদ্ভ্রান্ত সেই হাসিতে তার শরীর কাঁপছে, চোখ বেয়ে নেমে আসছে অশ্রু।
“খারাপ সময় যে আসবে, জানতাম। কিন্তু এতটা ভয়ানক হবে, কল্পনায়ও ছিল না। শখের নারীর মুখে ভিন্ন পুরুষের নাম, প্রিয় নারীর চোখে আরেকজনকে হারানোর ভয়। সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমাকে এজন্যই মৃত্যু দিচ্ছেন না, যেন ধুঁকে ধুঁকে মরণের স্বাদ পাই প্রতিটি নিঃশ্বাসে!”
‘এলিজাবেথ দু’হাতে কান চেপে ধরে তীব্র প্রতিবাদি গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
“পরপুরুষ বলবেন না। সে পরপুরুষ না, স্বামী আমার। আমার স্বামী। বিবাহিত আমি। আমি একজন বিবাহিত মহিলা।”
‘তাকবীর পুরোপুরি গা ঝাড়া ভাব নিয়ে বলল,” তো?”
‘আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকবীর, ঠিক তখনই দূরে একটা বাইকের দিকে চোখ গেল তার।ন্যানোসেকেন্ডও সময় নষ্ট করল না তাকবীর। দৌড় দিল এলিজাবেথের দিকে। প্রচণ্ড একটা শব্দ। তারপরই আরেকটা মাটিতে কিছু ভারী পড়ে যাওয়ার থেমে যাওয়া শব্দ। চারদিক তাকিয়ে গোলমালের উৎস খুঁজছে গার্ডরা।এলিজাবেথ একটুও নড়ল না।সে শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘তাকবীর…
রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর।
নিকষ কালো দু’টো চোখ খোলা! থেমে থাকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এলিজাবেথের চোখে। বুকে ক্ষীণ এক ছিদ্র। সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে উঠছে রক্ত নিঃশব্দ ঝর্ণার মতো। তাকবীর কাঁপতে কাঁপতে হাত তুলল এলিজাবেথের দিকে।তাকে ছোঁয়ার আগেই যেন সময় শেষ হয়ে এলো। তবুও ঠোঁট কাঁপিয়ে বলে গেল কিছু কথা—শুধু তার জন্য।
“তোমার রক্তে বানানো…
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত…
আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই…
বাড়িয়ে দাও… তোমার… হাত…”
‘শরীরটা একবার কেঁপে উঠল। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাতটা আচমকা পড়ে গেল মাটিতে। চোখ থেমে গেল, শরীর নিস্তব্ধ।এক অদ্ভুত ঘোলাটে কুয়াশা নামল এলিজাবেথের চোখে।অজানা দহনে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। ঠিক তখনই কব্জিতে একটা তীব্র টান অনুভব করল । চমকে তাকাতেই দেখল রিচার্ড। চোখে অগ্নি। মুখে আর্তনাদবিহীন রাগ। একটানে এলিজাবেথকে নিজের পেছনে এনে দাঁড়াল।
নিজে সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণে রিচার্ডের হাতে বন্দুক ওঠে। চারদিক চোখ বুলিয়ে খুঁজছে কার গুলিতে পড়েছে তাকবীর?
‘লাড়া বন্দুক হাতে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।
গার্ডরা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলে রিচার্ড এক হাতে থামিয়ে দিল সবাইকে। লাড়ার চোখে স্পষ্ট ঘৃণা, আরেক ধরণের কান্না। এদিকে এলিজাবেথের দৃষ্টি ঝাপসা। সে বারবার তাকায় মাটিতে পড়ে থাকা নিথর দেহটা,যে তার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল। আবার তাকায় সামনে সেই পিঠ, বিস্তৃত, শক্ত, প্রতিজ্ঞাময়, যে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আড়াল করে রাখছে তাকে। এই দুই পুরুষ আজ তার জন্য মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। শরীরটা কেঁপে উঠল এলিজাবেথের।
‘রিচার্ড ঠান্ডা কিন্তু ধ্বংসাত্মক কণ্ঠে এক গার্ডকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠল,
“টেক হিম টু দ্য হসপিটাল!”
‘নিঃশব্দে সকলে মিলে তুলে নিতে লাগল তাকবীরের নিথর দেহ। ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারদিক জুড়ে। এলিজাবেথ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। সব স্পষ্ট, তবুও কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। যেন দেহ আছে মন নেই। নিস্তব্ধতা চিঁড়ে খাচ্ছে তাকে। কণ্ঠনালি হতে উদগীরণ হচ্ছে না কোনো বাক্য। অথচ অভ্যন্তরে,,,
“বস, কী করছেন? লেট আস শুট হার!”
‘ন্যাসো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে লাড়ার দিকে ছুটে যেতে নিলে রিচার্ড হাত তুলে থামিয়ে দিল রিচার্ড। গম্ভীর গলায় বলল,
“রিচার্ড কায়নাত কখনো ঋণ রাখে না। আমি ঋণ শোধ করি সমান ভয়ংকরভাবে। লেট হার গো।”
‘বিধ্বস্ত লাড়া এগিয়ে এল হাতে গান নিয়ে। রিচার্ডের সামনেই দাঁড়াল কিছুটা দূরে। ওর ঠোঁট কাঁপছে, চোখে জল আটকে আছে। মুখ রাগে টকটকে লাল। রিচার্ড ইতিমধ্যেই শুনেছে প্রেমের মৃত্যুর খবর। বুঝেও গিয়েছে কেন লাড়া ছুটে এসেছে এখানে। তবুও সে বন্দুক নামাল না। কঠিন কণ্ঠে বলল,
“লাড়া ইউ নো ইউর লিমিট। এমন কিছু কোরো না, যাতে কৃতজ্ঞতার ঋণ ভুলে আমাকে কঠোর হতে হয়।”
‘বন্ধু হারানোর বিষে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠল লাড়া,
“এই মেয়ে অভিশাপ। আমাদের সকলের জন্য অভিশাপ! এই মেয়ে আসার পর থেকেই ধ্বংস নামছে একের পর এক। আমি ছাড়ব না তাকে!”
‘রিচার্ড গর্জে উঠল,”জবানে লাগাম দাও লাড়া! আমার স্ত্রীর দিকে আঙুল তোলার অধিকার এই পৃথিবীতে কাউকে দিইনি আমি।”
“বলব! একশো বার বলব! এই মেয়েই ধ্বংস। না সে আসত, না তুমি বাংলাদেশে ফিরে আসতে, না আমি তোমার পিছু ছুটতাম, না আমার প্রেমের সাথে দেখা হতো, না বন্ধুত্ব গড়ে উঠত। আমি ভালোবাসা না পেলেও একটা বন্ধু পেয়েছিলাম, তাকেও হারালাম। শুধুমাত্র এই মেয়ের জন্য! এই মেয়েকে পাওয়ার জন্য আর কি কি করবে তুমি রিদ?”
‘রিচার্ড এলিজাবেথকে পিছন থেকে টেনে এনে বুকের সাথে চেপে ধরল। এলিজাবেথ তখনও তাকিয়ে আছে রক্তমাখা মাটির দিকে, নিঃশব্দে, চোখের পাতা কাপছে। রিচার্ড গর্জে উঠল আকাশের দিকে তাকিয়ে,
“পুরো দুনিয়া জ্বালিয়ে দেবো, করবো ছারখার এই মেয়েকে না পেলে৷”
‘লাড়া হেসে উঠল,”তাহলে আমি এই মেয়েকেই শেষ করে দেবো!”
‘লাড়া হঠাৎই গুলি চালাল। রিচার্ড কোনো দ্বিধা না করে ঘুরে গিয়ে এলিজাবেথকে বুকের সাথে চেপে ধরল। গুলিটা গিয়ে বিঁধল তার কাঁধে। এলিজাবেথের কপালে ছিটকে পড়ল রক্ত। রক্তের ছোঁয়ায় বাস্তবে ফিরে এল এলিজাবেথ।চিৎকার করে উঠে রিচার্ডের ক্ষতস্থানে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে।লাড়া আবার গুলি চালানোর আগেই ন্যাসো নিখুঁত নিশানায় গুলি চালাল লাড়ার হাতে, পায়ে। হাঁটু ভেঙে বসে গেল লাড়া কিন্তু থামল না। হামাগুড়ি দিয়ে বন্দুকটা তুলে আবার ছুঁড়ল গুলি। তবে এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা গিয়ে লাগল দেয়ালে, ন্যাসোর গুলির জবাবে। রিচার্ডের হাত থেকে বন্দুক পড়ে গিয়েছে। এলিজাবেথ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরে। রিচার্ড স্পষ্ট টের পাচ্ছিল সেই অস্থিরতা যা কেবল তার জন্যই। মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থেকেও সে স্থির, শান্ত। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এই মুহূর্তের চেয়েও বড় কিছু সে ধরে রেখেছে বুকের ভেতর। এলিজাবেথ ফুঁপাতে থাকে। ফ্যারফ্যার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আপনার কাঁধ থেকে তো অনেক রক্ত পড়ছে… যন্ত্রণা হচ্ছে না?”
‘রিচার্ড তাকাল ওর চোখে। মাথা নাড়িয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
“উমহু… একটুও না। তুমি পাশে আছ যে।”
‘গুলির শব্দ থামছে না। চারপাশে আতঙ্ক আর চিৎকার। সবাই ছুটছে বাঁচার জন্য যে যেদিকে পারে। হট্টগোল, ধুলো, রক্ত সব মিলিয়ে এক বিভীষিকা। তবুও তারা চেয়ে আছে একে অপরের চোখে। সব কোলাহল মুছে সেই দৃষ্টিতে যেন এক অমর শান্তি। মুহূর্তটা যেন থেমে গেছে কেবল দুজনার জন্য। সারাবিশ্ব ভেঙে পড়লেও যেন তাদের মায়া অটুট।
‘হঠাৎ করে শুরু হয় একপ্রকার ঘূর্ণিবাতাস। হেলিকপ্টারের পাখার তীব্র ঘূর্ণিতে উড়তে থাকে চারপাশের ধুলো, শুকনো পাতা আর নুড়িপাথর। আকাশ কালো করে বিশাল আকারের একটি
হেলিকপ্টার নামল কোটের সামনে খোলা চত্বরে। শব্দে কেঁপে ওঠে আশপাশের দেয়াল।হেলিকপ্টারের দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো সশস্ত্র গার্ডদের একদল। তাদের পোশাক, গতি আর চোখের চাহনিতেই বোঝা যায় এরা নিছক দেহরক্ষী নয়। রণক্ষেত্রের জন্য তৈরি একেকজন যোদ্ধা। সবার শেষে গম্ভীর মুখে ঘাড় মটকাতে মটকাতে বেরিয়ে এল জেমস।
‘জেমস কে দেখামাত্র রিচার্ড এলিজাবেথকে আরও শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে। চোখের কোণে জমে ওঠে উগ্র ক্রোধ। চোয়াল মটমট করে ওঠে! শিরা টান টান।
লাড়া বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে হেলিকপ্টার থেকে নামা মানুষটার দিকে। ঠোঁট কাঁপে। গলার ভেতর জমে থাকা শব্দ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে,
“ড্যাড…”
‘জেমস ছুটে আসে রক্তাক্ত মেয়ের দিকে। এক মুহূর্ত দেরি না করে লাড়াকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। লাড়া ছাড়াতে চাইছে কিন্তু দুর্বল শরীরে সে সম্ভব নয়। হাত-পা থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে জেমসের চোখেমুখে জ্বলে ওঠে আগুন। দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠে,
“Finish all of them.”
‘পরপর রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ এক হাসি টেনে বলে,
“আমার মেয়ের শরীর থেকে ঝরা প্রতিটা রক্তের দাম দিতে হবে।”
‘শুরু হয় ভয়াবহ সংঘর্ষ। রিচার্ড এলিজাবেথকে বুকের সুরক্ষায় রেখে একের পর এক শত্রুকে মাটিতে ফেলে দিতে থাকে। ন্যাসো আর লুকাস পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়ছে! পাশাপাশি রিচার্ডকে কভার দিচ্ছে। তবুও, সংখ্যায় অনেক বেশি এবং প্রশিক্ষণে এগিয়ে থাকা আফ্রিকান গার্ডদের চাপে ধীরে ধীরে ব্যাকফুটে চলে যায় রিচার্ডের দল। এই ফাঁকে জেমস লাড়াকে কোলে তুলে হেলিকপ্টার পেরিয়ে গাড়ির দিকে ছুটে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্য।
‘গোলাগুলির শব্দে থরথর করে কাঁপছে এলিজাবেথ। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে গুনগুন করে কাঁদছে। ওর কাঁপুনি রিচার্ডের ভিতরের হিংস্রতা থামিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তোলে রক্ষাকারীর দায়িত্ববোধ। এই যুদ্ধক্ষেত্র এলিজাবেথের জন্য বিপজ্জনক। একটা গুলির ছোঁয়াও প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। চারদিকের বিশৃঙ্খলার মধ্যে আরও একটি দল—পুলিশ। দূর থেকে এগিয়ে আসছে অস্ত্র হাতে। রিচার্ড দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। উচ্চ গলায় চিৎকার করে উঠল,
“লোকা!”
‘লুকাস গুলি চালাতে চালাতে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে হুংকার দেয়,”জি, বস!”
‘রিচার্ড নিচু গলায় দৃঢ়ভাবে নির্দেশ দেয়, “টেক হার ইন দ্য ম্যানশন।”
“না!” রিচার্ডের বুক থেকে মাথা তুলে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে ওঠে এলিজাবেথ।”আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি!”
‘রিচার্ডের চোখে এই মুহূর্তে কোনো নরমভাব নেই। এই মুহূর্তে তার মনোযোগ একটাই এলিজাবেথকে নিরাপদ রাখা। সে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় লুকাসের দিকে! চোখে এক অদৃশ্য আদেশ। লুকাস জানে পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ হতে পারে। সে দ্রুত এগিয়ে আসে।
“স্যরি ম্যাম!”বলে এলিজাবেথের হাত ধরে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে নিরাপদ গাড়ির দিকে।
“না! আমি যাবো না! যাবো না আমি কোথাও।”
‘এলিজাবেথ পেছন ফিরে বারবার চেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে। হাত ছুটিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু লুকাস অনড়। বুলেট বৃষ্টি হচ্ছে চারদিকে। ধোঁয়া, চিৎকার, গুলির শব্দে রণক্ষেত্র যেন নরক হয়ে উঠেছে। এক ঝটকায় লুকাস এলিজাবেথকে গাড়িতে তুলেই দরজা বন্ধ করে। স্টার্ট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কালো গাড়িটা গুলি ভেদ করে ছুটে যায় দুরে। গাড়ি চোখের আড়াল হতেই রিচার্ডের ঠোঁটে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক পৈশাচিক হাসি।
‘এখন তার সামনে আর কোনো বাধা নেই। রিচার্ড তৎক্ষনাৎ পিছনে হাত দিয়ে কোমরের বেল্ট থেকে তুলে আনে দুইটা গান। একে একে ক্লিক করে ট্রিগার লক ছাড়ে। তারপর গভীর নিঃশ্বাসে চোখ বন্ধ করে মুহূর্তটা অনুভব করে। পরপরই চোখ খোলে। চোখ জ্বলে উঠছে আগুনে।
“Let’s dance…”
‘রিচার্ডের শরীর এক ঝাঁকে ঘুরে উঠে। ডান হাতে এক গার্ড, বাম হাতে আরেকজন। মাথা নিচু করে ড্যাশ দেয় সামনে! ঘন ঘন গুলি ছুঁড়তে থাকে! শরীর নিচু করে ফ্ল্যাংক করে এক গার্ডকে। তীব্র সংঘর্ষে একে একে ভেঙে পড়ে গাড়ির কাচ! চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে কাঁচের টুকরো! ছুটে বেড়ায় ধাতব ধ্বংস। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বারুদের গন্ধে। প্রতিটি মুহূর্তে উড়ছে ইট-পাথর! শ্বাসের ফাঁকে ঢুকে পড়ছে ধোঁয়া। গুলির শব্দ এতটাই বিকট যে মনে হয় পুরো পৃথিবী যেন এক ভয়ঙ্কর জ্বালামুখে রূপ নিয়েছে।
‘আকষ্মিক রিচার্ডের কাঁধ ছুঁয়ে এক গুলি সেঁধিয়ে যায় পাশের দেওয়ালে। তবুও রিচার্ড থামে না। ব্যথায় মুখের এক কোণ হালকা বেঁকে ওঠে। কিন্তু সেই বেঁকে থাকা ঠোঁটেই গড়ে ওঠে এক ভয়াবহ পৈশাচিক হাসি। তার কাছে ট্রিগারে চাপ দেওয়া মানে শাস্তির ঘোষণা। প্রতিটি গুলি তার হাতে যেন অভিশপ্ত অনুশোচনার বদলে জেমসের বিরুদ্ধে একেকটি শাস্তিপত্র। ধোঁয়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে রিচার্ড। নগ্ন চোখে দেখা যায় না তাকে! কেবল আগুনের মতো তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। রিচার্ড বেঁচে আছে কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে গড়া এক ছায়াসেনা।
‘অন্যদিকে ন্যাসো একের পর এক শত্রুকে গুলি করে শুইয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই হঠাৎ এক গুলি সাঁই করে ছুটে আসে তার বুক লক্ষ্য করে। সময়টা এতই ক্ষণস্থায়ী যে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু ঠিক তখনই বাতাস চিরে রিচার্ডের গুলি এসে ঠুক করে আঘাত করে সেই গুলিতে। এক মিলিসেকেন্ডে তার দিক পরিবর্তন হয়। ছিটকে পড়ে পাশের ইটের দেয়ালে।
ন্যাসো বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে দেখে রিচার্ড ধোঁয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।চোখে আগুন, ট্রিগারে পেশি শক্ত করে ধরা। রিচার্ড বাঁকা হেসে এক চোখ টিপে ইশারা করে। ন্যাসোর মুখে ফুটে ওঠে বক্র হাসি। সে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে রিচার্ডের দিকে হাত বাড়ায়। রিচার্ড নিঃশব্দে ন্যাসোর হাত চেপে ধরে। অতঃপর জোরপূর্বক টানের মাধ্যমে এক ঝটকায় ন্যাসোকে নিজের পাশে টেনে এনে পজিশন বদল করে।
‘ঠিক তখনই দু’জন একসঙ্গে ড্যাশ দেয় ডান পাশে। রিচার্ড এক হেডশটে মাটিতে ফেলে এক গার্ডকে আর ন্যাসো ছায়ার মতো পিছনে ঘুরে তিন গার্ডকে ঠান্ডা মাথায় স্নাইপ করে। মাটি ভিজে উঠছে রক্তে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে মৃত্যু আর শ্বাসরুদ্ধ নৈঃশব্দ্য। তারা এখন আর শুধু লড়ছে না। তারা শিকারি, যারা শিকারের আগে খেলে না—ছিঁড়ে ফেলে। ক্রমে ক্রমে কমতে থাকে সৈন্য সংখ্যা৷
‘লুকাসের দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরা স্টিয়ারিং।
তবুও প্রতিবার এলিজাবেথের চিৎকারে সে কেঁপে উঠছে।হৃদপিন্ড ধকধক করছে তার৷ তবুও মুখে ছায়া নেই কোনো। পাশের সিটে এলিজাবেথ। একজন বিধ্বস্ত নারী। এক ছিন্নভিন্ন ভালোবাসার স্তব্ধ সাক্ষী। গলা বসে গেছে, চোখের জল শেষ৷ তবুও কাঁদা এখনো শেষ হয়নি। জানালায়, দরজায় কোথাও মুক্তির রাস্তা নেই। বারবার চেষ্টা করছে, হাত ধাক্কায়—তবুও খুলে না, ভাঙে না। সবকিছু লক। তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে এক আশঙ্কার ভিতর।
“গাড়ি থামান। প্লিজ। আমাকে বাধ্য করবেন না এমন কিছু করতে যা… যা আমাকেই শেষ করে ফেলতে পারে।”
‘লুকাস গলায় কিছুটা কৃত্রিম দৃঢ়তা এনে বলল,”আপনি কিছুই করতে পারবেন না ম্যাম। সব লক করা। আর… আমি দুঃখিত। এটা স্যারের অর্ডার।”
‘এলিজাবেথ চুপ। সে ভালো করেই জানে এই লোকগুলো রিচার্ডের ছায়া৷ তার আদেশে নিশব্দে হত্যা করতেও পারে। এদের সারাদিন বললেও কাজ হবে না।
“একটা কল করুন। এক্ষুনি। আমি কথা বলতে চাই তার সাথে। আশা করি আমাকে প্রমাণ করতে হবে না, আমি কাকে বিয়ে করেছি। আমি এই মূহুর্তে চাচ্ছি না একজন গ্যাংস্টারের ওয়াইফের ক্ষমতা দেখাতে। ”
‘লুকাসের কণ্ঠ শুকিয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ফোন বের করে কল দেয় রিচার্ডকে।
প্রথমবার… নো রেসপন্স।
দ্বিতীয়বার… শুধু অপেক্ষা।
তৃতীয়বার… ক্লিক। লাইন ধরে।
‘ওপাশ থেকে শুধু ভেসে আসে গুলির শব্দ।এলিজাবেথ কাঁপতে থাকা হাতে ফোন কেড়ে নেয়। কণ্ঠে অসীম আকুতি৷ কিন্তু গলায় কঠিন খোলস,
“হ্যালো?”
“এলি জান, আর ইউ ওকে?”
‘এলিজাবেথ ফোন কানে চেপে ধরে ডুকরে উঠল,”হুমম…”
‘ওপাশ থেকে শুধু গুলাগুলির শব্দ।
“আমি চাই না আমার স্বামী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকুক। আমি চাই না চোখে ব্যান্ডেজ, বুকে গুলি নিয়ে সে আমার সামনে আসুন। আমি তাকে চাই… সুস্থ, অক্ষত হিসেবে চাই আমার কাছে। শুনছেন? শুনছেন আপনি? আমি আমার স্বামীকে সুস্থ চাই।
‘এবারও ওপাশে শুধু বন্দুকের আওয়াজ। মাঝেমধ্যে ভাঙা শ্বাস। এলিজাবেথ কাঁদতে কাঁদতে নিদারুণ সুরে ডাকল,
“জান…”
“এলি জান…”
“বলুন না ফিরে আসবেন? আজ রাতে একসাথে খাবো হুহ? আমি নিজের হাতে রাঁধব আপনার পছন্দের খাবার। আপনি ফিরবেন… বলুন না প্লিজ।”
‘একটা থেমে থাকা মুহূর্ত।
তারপর…
“ফিরব।”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫
‘তার সাথে সাথেই এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠে এলিজাবেথ। সঙ্গে সঙ্গে কাট হয়ে যায় কল। ফোনটা এলিজাবেথের হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায়। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে আবারও ডুকরে উঠল এলিজাবেথ। মুখ থেকে আর শব্দ বেরোয় না। কেবল
নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে কাঁদে।
গাড়ির ভিতর নিস্তব্ধতা।
শুধু এলিজাবেথের কাঁপা নিঃশ্বাস,
আর এক নারীর অপেক্ষার হাহাকার…