ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (৩)

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (৩)
মিথুবুড়ি

‘দুই ভাই আজ একসঙ্গে নেমেছে শত্রু শিকারে। অবাক লাগছে? দু’জন তো দুই মেরুর—তাহলে এক হল কিভাবে? বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক। এলিজাবেথের খোঁজ মিলেছে এ খবর শুধু তাকবীর জানে না, জানে গোটা ইতালি। আর এই খবরের পেছনে যিনি ঢাকঢোল পিটিয়েছেন, তিনি রিচার্ড কায়নাত নিজেই। শহরজুড়ে আগুন লাগিয়ে সে-ই জানিয়েছে এলিজাবেথের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই খবর শুনেই তাকবীর ছুটে এসেছে। যখন রিচার্ড ন্যাসোর ফোন পেয়ে তীব্র উত্তেজনায় বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন প্রধান ফটকের সামনে তাদের দেখা হয়। দাঁড়িতে ঢেকে থাকা মুখ, এলোমেলো কুঁকড়া চুল, আর পাগল-পাগল চেহারার তাকবীরকে দেখে রিচার্ড কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। তারপর আর কোনো কথা না বলে সঙ্গে নিয়ে নেয় তাকেও।

‘রিচার্ডের সাহায্যে পিজবোর্ড থেকে দ্বীপে পা রাখে তাকবীর। রিচার্ড তাকে আর এক মুহূর্তও সময় না দিয়ে সোজা হাঁটা দেয় ইনচিয়া দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু বাড়ির দিকে। তাকবীর ধীরে ধীরে কাটা পায়ের ব্যথা সয়ে পেছন পেছন এগোয়। রিচার্ড ছাদে পৌঁছাতেই ন্যাসো চেয়ার ছেড়ে উঠে রিচার্ডের বাজপাখির মতো শাণালো দৃষ্টিতে, ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু ইশারা করে চোখে ইস্পাতের ন্যায় ধারালো আধিপত্য বজায় রেখে বেরিয়ে গেলো। সিঁড়িতে নেমে আসতেই ন্যাসোর চোখে পড়ে তাকবীরকে। ভেতরে বিস্ময় জাগলেও সে কিছু বলে না। নিঃশব্দে চলে যায়। খোলা ছাদের ওপর একটি ধাতব টেবিল। তার ওপর হাত-পা বেঁধে শুইয়ে রাখা হয়েছে জেমসকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘রিচার্ড শীতল চোখে শূলের মতো এক উল্কাঝলক জেমসের দিকে ছুড়ে দিয়ে রাজারহালে রকিং চেয়ারে গিয়ে বসল। ঠোঁটের কোণে জমে উঠেছে আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। তাকবীর সময় নিয়ে এক পায়ে উঠে এলো ওপরে। জেমসকে দেখামাত্র তার পুরু ভ্রু কুঁচকে উঠল নির্দয় গম্ভীরতায়। তামাটে কপোলে পড়ল দু’টি অবিচ্ছেদ্য চিন্তার ভাঁজ। ওদিকে জেমস এখনও ছটফট করছে শেষ চেষ্টায়। তাকিয়ে থাকতেই যেন ধূসর আলোয় উদ্ভাসিত হলো তার দেহভঙ্গির ভিতরকার অস্পষ্ট আতঙ্ক। কিয়ৎক্ষণ অবুঝ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতেই অকস্মাৎ মস্তিষ্কের ভেতর খেলে গেল সেই নৃশংস ছক। সংবিৎ ফিরতেই তাকবীরের চোখের কৃষ্ণাভ তারা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখার মতো।
‘রাজারহালে, পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা দুর্ধর্ষ পুরুষ ‘রিচার্ড কায়নাত’ সমুদ্ররঙা চোখে ইস্পাতের ন্যায় ধারালো আধিপত্য বজায় রেখে, ঠোঁটে বাঁকা কপটতা টান দিয়ে ধরে রেখে তাকবীরের উদ্দেশ্য, কণ্ঠে রাশভারি আওয়াজ বহাল রেখে বলে উঠল,

“নে, তুই শুরু কর আগে।”
‘পুরুষমূর্তি একটুও নড়ল না। শুধু গ্রীবা সামান্য বাঁকিয়ে শীতল দৃষ্টির এক ঝলকে তাকালো পিছনে। চোখের গভীরে লুকোনো ক্ষীণ ইঙ্গিতে যেন নিঃশব্দে কিছু সেরে নিল আলাপ-আলোচনা। ঠৌঁট নাড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। তারপর আর কোনো সময়ক্ষেপণ নয়। ঠোঁটের কোণে একপাশে চেপে ধরা কপাট-হাসি ঝুলিয়ে তাকবীর এগিয়ে গেল দানবীয় তীব্রতায়, এক নির্দয় জল্লাদের মতো নিঃশব্দ আক্রমণের সংকল্প নিয়ে।

‘ধাতব টেবিলের ওপর জেমসের হাত-পা এমনভাবে বাঁধা যে, দড়িগুলো মনে হয় মাংসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। বাধনের জায়গাগুলো র-ক্তা-ক্ত হয়ে উঠেছে। দড়ির রংটাও সাদা থেকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। জেমসের মুখ চেপে বেঁধে রাখা, চোখের ওপর কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ছোটার জন্য বারবার ছটফট করছে, কিন্তু এতে লাভ তো হচ্ছেই না, বরং ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তাকবীর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। কৃষ্ণ বদনে কোনো ভঙ্গি নেই, কেবল নির্লিপ্ত শীতলতা। পাশে বসে থাকা রিচার্ড সিগারেট ধরাল। গাল ভর্তি ধোঁয়া মাঝে মাঝে আকাশমুখী হয়ে নির্গত হচ্ছে। সেই ধোঁয়া কুয়াশার মতো চারপাশে পাক খেয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটের কোণে হালকা তাচ্ছিল্য হাসি অটলভঙ্গিতে লেপ্টে থাকলেও মুখমণ্ডল একদম শীতল— হিমালয়েয় বরফের ন্যায়। বহির্মুখী দৃষ্টিতে বোঝা মুশকিল, ভেতরে কি চলছে। তার স্থির,তীক্ষ্ণ, বরফঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চাক্ষুষ যা অবলোকন হলো তা যে কারো ঘাম ছুটাতে বাধ্য। সে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করবে, স্বয়ং মৃতদ্যুত যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘তাকবীর প্রথমে ছোট এক ছুরি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ে জেমসের পায়ের কাছে। বাতাসে তখনো নিকোটিনের বিষাক্ত ধোয়া আর ছিন্নভিন্ন ধ্বনি ছড়িয়ে আছে। নিঃশব্দে, নিখুঁত এক মনোযোগে তাকবীর জেমসের গোড়ালির ঠিক উপর দিয়ে আঙুলের ফাঁক গলিয়ে ছুরির ধার বুলিয়ে দেয়। যেন মগ্ন হয়ে আঁকছে কোনো নকশা। তারপর কোনো সাবধানবাণী ছাড়াই এক আকস্মিক আঘাতে রগ কেটে ফেলে গোড়ালির। একটা কাঁচ ফেটে যাওয়ার মতো চিঁড়চিঁড় শব্দ হয়। জেমসের মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে যন্ত্রণায়। তার শরীর ধকধক করে মুচড়ে ওঠে। গোড়ালি থেকে হড়হড় করে থকথকে, গা ঘিনঘিনে গরম র-ক্ত ধাতব টেবিলের কোল বেয়ে ঝরে পড়ে। একটা দানব যেন হঠাৎ গিলে ফেলেছে তাকে। ফিনকি দিয়ে ছিটকে আসা র-ক্ত তাকবীরের জামার ছিটে ছিটে ভিজিয়ে দেয়৷ কিন্তু সে নির্লিপ্ত।

‘রিচার্ড তখনো সেই আগের মতো চুপচাপ বসে সিগারেটে টান দিচ্ছে। ধোঁয়া তার মুখ ঢেকে রাখলেও চোখে এক পশুর মতো নির্লিপ্ততা। সে পাশের চেয়ারটা খেঁচে এনে দুই পা ফাঁক করে বসল। ঠিক যেন বাচ্চাদের কার্টুন দেখছে দারুণ উৎফুল্লতার সহিত। চোখে একফোঁটা কৌতূহল বা করুণা নেই। তাকবীর নিচু হয়ে জেমসের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে পকেট থেকে ছোট এক ব্লেড-চিমটি বের করে। র-ক্তমাখা আঙুলে সেটি ধরে জেমসের নখের নিচে ঢোকাতে শুরু করে মন্থর, অমানবিক ছন্দে। প্রথমে এক চুল, তারপর গভীরে, এরপর আরও গভীরে। তারপর হঠাৎ এক ঝটকায় পুরো নখটা তুলে আনে। কাঁচা মাং-স আর চো-ষা চো-ষা স্নায়ুর কাঁপুনি স্পষ্ট দেখা যায়। সেই দৃশ্যেই জেমসের চোখের পাতা কেঁপে ওঠে, আর ঠোঁটের বাঁধন পেছন দিকে জেগে উঠে। একটা হাহাকারের মতো শব্দ তার গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু মুখ বাঁধা বলে বেরোতে পারে না।

‘এক, দুই, তিন… একে একে সব নখ উঠে যায়। তাকবীর যেন গণনা করে এগোয়। বেহিসাবি সে আজ হিসেবি কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে মিনিস্টার মসাই। প্রতিটি টানে একটুখানি র-ক্ত ছিটকে পড়ে তাকবীরের গালে, ধূসর পাঞ্জাবীতে। জেমস শুধু কাঁপে, ছটফট করে, আর চোখের কিনার দিয়ে নোনা এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নৈঃশব্দ্যে। ঠিক যেমন ভাবে নারীরা গোপন ব্যাথা সয়ে যায় নিরবে, অগোচরে। এরপর, ছু-রি তুলে নিল তাকবীর। এবার সে মৃত্যুঞ্জয়ী সংকল্প নিয়ে জেমসের উরুর দিকে অগ্রসর হয়।নরম অথচ শিকড়গাঁথা মাংসের নিচে খেলা করা স্নায়ুদের ক্যানভাস। ঠাণ্ডা, নিখুঁত গতিতে সে ছু-রির ধার চালায়। চামড়ার স্তর আস্তে আস্তে খুলে আসে, যেমনভাবে কেউ ফলের খোসা ছাড়ায়। নিচে লালচে-মেটে র-ক্তনালী, সাদা টানটান স্নায়ু, সব পরিষ্কার দেখা যায়। জীবন্ত যন্ত্রণা একের পর এক পাঁজরের নিচে উঠানামা করে।

‘জেমসের বুক উঠতে থাকে ঘনঘন। ঠোঁটের কোনা থেকে থকথকে লালা আর র-ক্ত মিশে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে মুখের কাপড়ে। কাপড় ভিজে লাল হয়ে ওঠে। তাকবীর কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায়। একটানা র-ক্তস্নাত হাতে চোখ মুছে রিচার্ডের দিকে তাকায়। তার চোয়াল যেন শিলায় খোদাই, ঘাড়ের শিরা ফুলে, শ্বাস ভারী। চোখে আগুনের মতো এক গভীর, গা ছমছমে নির্দয়তা। রিচার্ড সিগারেট মাটিতে ফেলে পায়ের নিচে পিষে ফেলল। মুহূর্তে দুই জোড়া চোখে জ্বলে ওঠে একই হিংস্র চাহনি। বড্ড নির্বিকার, হাড়-ভাঙা নির্মমতা ভরা চাহনি। তাকবীর এবার ছু-রি সরিয়ে রেখে রক্তা-ক্ত হাত দিয়ে জেমসের ক্ষতগুলোতে সরাসরি চাপ দিতে থাকে। চাপের প্রতিটি স্পর্শে জেমসের মাংস যেন টনটনে করে সেঁধিয়ে যায়। তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, হাত ঝুলে পড়ে, মাথা কাঁপে। কিছুই আর বলার নেই। শুধু মৃত্যু ধীরে ধীরে দমবন্ধ যন্ত্রণার গর্ভে জেগে উঠছে।

‘তাকবীর ধীরে ধীরে জেমসের মুখের কাছাকাছি চলে আসে। তার চোখে তখনো আগুনের মতো এক নিষ্ঠুর দীপ্তি। ঠান্ডা হাতে মুখের বাঁধন খুলে দেয়। কিন্তু মুক্তির পর মুহূর্তও পেরোয় না। তাকবীর ঝুঁকে দাঁতের ফাঁকে ঠেসে দেয় ছু-রি-র ধার, এক চাপেই দাঁতের গুঁড়ি চূর্ণ হয়ে ছিটকে পড়ে। একটি তীক্ষ্ণ, হাড়ভাঙা শব্দ! র-ক্ত, লালা, আর দাঁতের গুঁড়ো মিলে এক বিশ্রী তরল গড়িয়ে পড়ে জেমসের ঠোঁট বেয়ে বুকে। জেমস চিৎকারের চেষ্টা করে। কিন্তু গলা দিয়ে শুধু অস্পষ্ট গোঙানি বেরোয়। চোখ উলটে যায়, মাথা কাঁপে। অথচ তাকবীর তাকে মেরে ফেলে না। সে চায় এই যন্ত্রণার শরীর যেন ধীরে ধীরে নিজের ভেতরেই গলে যায়। পরের মুহূর্তে সে জেমসের এক কান ধরে টেনে তুলে ছু-রি-র ধার রাখে নিচের স্নায়ুর উপর। ফস করে কানটা আলগা হয়ে যায়।জন্মচিহ্নের মতো ঝুলে থাকে এক টুকরো মাং-স। গরম র-ক্ত স্রোতের মতো ঠোঁট পেরিয়ে গড়িয়ে পড়ে গলার হাড় বেয়ে। রিচার্ড এবার পেছন থেকে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,

“ওকে সম্পূর্ণ মেরে ফেলিস না। কিন্তু বাঁচার মতো শক্তিও রাখবি না।”
‘ঠোঁটে তখন শীতল, ধ্বংসাত্মক এক হাসি। তাকবীর বুঝে যায় ইশারা। মাথা নিচু করে ছু-রির ফলা এবার সে জেমসের চোখের নিচে বসাতে যায় একদম স্নায়ুর কাছাকাছি, ঠিক এমন জায়গায়, যেখানে ব্যথা চিৎকার ছাপিয়ে আত্মা পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়। জেমসের শরীর ছটফটিয়ে ওঠে, গলার গভীর থেকে হেঁচকি ওঠে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তাকবীর থেমে যায়। ছুরির ধার মাত্র কয়েক মিলিমিটার দূরে রেখে সে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃত্যুকে শুধু ঘ্রাণ করায়, ছোঁয়ায় না। তারপর মুখ এগিয়ে আনে খুব কাছে। জেমসের রক্তভেজা কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,”এখনও তো অনেক কিছু বাকি। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু ধরে রাখিস।”

‘তাকবীর উঠে দাঁড়ায়। দূরে সরে যায়। জেমস এখন নিছক এক মৃতপ্রায় শরীর। কাঁপে কিন্তু গর্জে না। চোখ খোলা, কিন্তু প্রাণ নেই। বেঁচে আছে শুধু পরবর্তী নিপীড়নের প্রতীক্ষায়। রিচার্ড শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে সামনে এগিয়ে আসে।তার চোখে তখন কসাইয়ের নির্দয় নিষ্ঠা। দৃশ্যটা এমন যে— কোনো প্রশিক্ষিত মাংস কাটা কসাই এখন কেবল কাজ শুরু করার আগের প্রস্তুতিতে। তাকবীর চেয়ারে বসে হাঁপাতে থাকে। ডান পায়ের যন্ত্রণায় হাড়ে হাড়ে বাজছে আগুনের সুর।
‘জেমসের হাত-পায়ের দড়িগুলো একে একে খুলতে খুলতে রিচার্ড হঠাৎ ক্ষিপ্তস্বরে বলল,

“শিকারী যদি ছটফট আর চিৎকারই না করে, তাহলে তাকে মেরে আনন্দটা কোথায় থাকে বল?”
‘শেষ দড়িটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটল, তা ছিল অন্ধকার ইতিহাসে এক নতুন উপাখ্যান। জেমস, শরীরের অবশিষ্ট শেষ কণাটুকু শক্তি জড়ো করে হঠাৎ এক ধাক্কায় রিচার্ডকে ছাদের ধারে নিয়ে ঠেলে ফেলে ঝাপ দেয় ছাদ থেকে। রিচার্ড পড়ে যেতে যেতে ঝুলে পড়ে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে রেলিঙের ওপর ঝুকে জেমসের এক হাত খামচে ধরে ফেলে। জেমসের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা র-ক্তের মধ্যেই ফুটে ওঠে এক নির্মম হাসি। সে তেজালো ক্ষিপ্তস্বরে বলল,

“হাহাহা… ইউ মাদারফাকার। তুই কী ভেবেছিস—সবসময় তুইই জিতবি? না রিচার্ড কায়নাত না, তুই আজ হারবি। তুই কি ভেবেছিস, তুই আমাকে ধরেছিস? না, না, না। আমি নিজে ধরা দিয়েছি তোর ফাঁদে। আরে আমি তো এমনিতেই মরে যেতাম। আমি কবে থেকে মরতে চাইছি, কবে থেকে আমার মেয়ের কাছে যেতে চাইছি জানিস? আমার লাড়া বেটা ওখানে একা আছে। তোর হাতে মরলে তোর আত্মাকে শান্তি দিয়ে দেওয়া, তোকে জিতিয়ে দেওয়া। না রিচার্ড, আজ তা হবে না। আজ আমি নিজেই শেষ চালটা দিয়ে গেলাম। আমার এই আত্মবলিদানই তোর মৃত্যুর ঘন্টা বাজাবে। শুধু তুই না—তোর ভাইটাকেও নিয়ে ডুবাব। সব শেষ হয়ে যাবে একচালেই। নিজের ধ্বংসের জন্য তৈরি হ, লুজার কায়নাত। বিকট আগুন আসছে। আমি শুধু সলতে জ্বালিয়ে দিলাম!”

‘তারপর জেমস নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতেই সে তলিয়ে গেল সমুদ্রগর্ভে। মুহুর্তেই সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল পানি, রক্তলাল হয়ে গেলেও তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। জেমসের সাথেই হারিয়ে গেল সমুদ্রের তলদেশে। রিচার্ড বিদ্যুৎস্পষ্টের মতো স্তব্ধ হয়ে তখনও ফেনিল জলরাশির দিকেই তাকিয়ে ছিল। তার মাথায় চক্রের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে জেমসের বলা শেষ কথাগুলো। কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল সে? কোন চালের মাধ্যমে শেষ হবে রিচার্ড কায়নাত? ঠিক তখনই পকেটের ভেতর সেলফোনটা ভাইব্রেট করল। কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গার্ডের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর,
“বস! ম্যাম ম্যানশন থেকে বেরিয়ে পড়েছেন!”

‘জড়বৎ মূর্তির মতো নিশ্চল রিচার্ডের মস্তিষ্ক সে-বার্তায় হঠাৎ তড়াক করে জেগে উঠল। মুহূর্তেই উপলব্ধি করল সবটা। স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হলো সবটা। তীক্ষ্ণ এক উপলব্ধির তাড়নায়, হিংস্র দানবের মতো চিৎকার করে উঠল রিচার্ড,
“That’s a trap! That’s a trap!”
‘সাহারা মরুভূমির উত্তাপমাখা গলায় হুংকার তুলে ছুটে বেরিয়ে গেল রিচার্ড। পেছনে দাঁড়িয়ে তাকবীর কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে দেখল রিচার্ডের প্রস্থান।

‘লোকেশন অনুযায়ী এলিজাবেথ পৌঁছায় এক পুরনো কনস্ট্রাকশন সাইটে। চারপাশে শুধু অপূর্ণ সুউচ্চ দালান। বাঁদিকে থাকা তিনতলা ভবনটির দিকে ছুটে চলে সে। নিচ্ছি নির্দ্বিধায় রেলিংহীন সিঁড়ি দিয়ে ছুটে ওপরে উঠল। চারিদিকে শূন্যতার খাঁ খাঁ প্রতিধ্বনি তবু থামে না পা, দম ফুরালেও দমে না। এলিজাবেথ ছুটে যায় ঠিক সেই নির্দিষ্ট জায়গায় যেখানে তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। জায়গামতো দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে এলিজাবেথ। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ যেন তর্জনী দিয়ে সময় গোনে। ঠিক তখনই বাতাস ছিঁড়ে এক কণ্ঠস্বর কান ছুঁয়ে যায়,
“মাই প্রিন্সেস।”

‘এক লহমায় কেঁপে ওঠে এলিজাবেথের অন্তর। চোখ তুলে চমকে তাকায় সামনে। চোখে টলমল জল। আহা সময়! মানুষের চেহারা নয়, মানুষটাকেই পাল্টে দেয় যেন! এটাই সেই কি এলিসা? সেই সিঙ্গার এলিসা, যাঁর সৌন্দর্যে আলো কেঁপেছে একসময়? আজ কোথায় সে লাবণ্য, কোথায় সে আভিজাত্য? মিস এলিসার চামড়ায় গোলাপি দীপ্তি আর নেই। বয়সে ভেঙে পড়েছে চেহারার পেলবতা। লালচে চুলও আজ আর নেই। মাথা প্রায় শূন্য। দূর থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, দৃষ্টি জলে ছলছল। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কষ্টের উষ্ণ ধারা। এ দৃশ্য দেখে, মাকে হারানোর শোকও হালকা মনে হয় এলিজাবেথের। যে-ই মায়ের জন্য অজস্র দীর্ঘরাত নিদ্রহীন কাটিয়েছে, ভাগ্যসারথি আজ সে-ই মায়ের সামনেই এনে ফেলল।

‘মিস এলিসা পাখির ডানার মতো শুষ্ক দু’হাত মুক্ত করে বাড়িয়ে ধরলেন সামনে। নীরব আহ্বান, কাঁপা ঠোঁট আর চোখের গভীরে জমে থাকা আকুলতা দিয়ে ডেকে উঠলেন সেই কাঁপতে থাকা মেয়েটিকে। তার দৃষ্টির ভিতর একধরনের উন্মত্ত আকর্ষণ। তৃষিত চাহনি যে আকুল হয়ে চাইছে মেয়েটা ছুটে আসুক। যেভাবে ক্ষুধার্ত শিশু খেলাধুলা ফেলে মায়ের বুকের উষ্ণতা খুঁজে ছুটে যায়, সেভাবেই…এলিজাবেথের পা আর তার নয়। পা ছুটল মনের আদেশে। ঝোড়ো হাওয়ার মতো আচড়ে পড়ল মায়ের বুকে। মুহূর্তেই গগনবিদারী কান্নায় ভেঙে পড়ল মা-মেয়ে। ঝরঝর কান্নায় ভারি হয়ে উঠল আবহ। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মিস এলিসা যেন বুঝতেই পারছিলেন না তিনি জাগ্রত না স্বপ্নে। এতদিনের শূন্য বুকটায় আজ এতখানি উষ্ণতা এসে ভর করেছে, তবু তিনি যেন স্পর্শ অনুভব করতে পারছেন না। এলিজাবেথ বারবার চুমু খেয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে মায়ের মুখ৷ তবু এলিসা বুঝতে পারছেন না এ তার মেয়ে, তারই বুকফাটা ব্যথার উলটোপিঠ।

‘এলিজাবেথ মাথাটা শক্ত করে মায়ের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অস্থির নিঃশ্বাসের সাথে ফিসফিস করতে লাগল,”মা… মা… আমার মা। আর হারাতে দিবো না তোমায়। আমার মা।”
‘মিস এলিসা কণ্ঠের গলা খুলে কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই হঠাৎ সেখানে ছুটে এসে উপস্থিত হলো রিচার্ড।
এলিজাবেথের চোখদুটো দ্বিগুণ আলোয় জ্বলে উঠল।মেয়েটি এক হাতে মায়ের বাহু আঁকড়ে ধরে, অন্য হাত রিচার্ডের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল,
“মি. কায়নাত, দেখুন! দেখুন আমার মমকে! এতো বছর পর আমি আবার আমার মাকে ফিরে পেয়েছি। আজ আমি খুব, খুব খুশি মি. কায়নাত। আজকের মতো এতো খুশি আমি আর কখনোই হইনি।আমি এতিম না—না, আর না।”
‘বিরতিহীন উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে যেতে, হাস্যজল এলিজাবেথ তাকাল মায়ের দিকে। অধর কোণে ঐন্দ্রজালিক হাসি। গর্বে টইটুম্বুর কণ্ঠে বলল,

“মম, হি ইজ মাই হাসবেন্ড। লাভ অফ মাই লাইফ।”
‘এলিজাবেথ খুশিতে অনর্গল বলে যেতে লাগল৷ চোখে একধরনের আলো—যা বিশ্বাস করে সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু সেই আলো যে ছুঁতে পারেনি রিচার্ড আর মিস এলিসার দৃষ্টি। তাদের চোখ দুটো একে অপরকে ছুঁলো ঠিকই, কিন্তু তাতে ছিল না বিন্দুমাত্র কোমলতা। এক ধরনের অকাট্য গম্ভীর মুখ চেয়েছিল একে-অপরের দিকে। রিচার্ড বাজপাখির মতো শাণালো দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করছিল মিস এলিসাকে। এই শান্তমূর্তি মুখশ্রীর আড়ালে কি আদেও লুকিয়ে আছে কিছু? নীরব যুদ্ধ যেন দুই চোখের ভাষায় মুখর হয়ে উঠল।

‘এলিজাবেথের কথা তখনও শেষ হয়নি। মায়ে ফিরে পাওয়ার খুশিতে লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে পুরন্ত দু’টি ঠৌঁট। ঠিক তখনই রিচার্ডের ফোন বেজে উঠল। চোখ না সরিয়ে নিস্পৃহভাবে মিস এলিসার দিকে তাকিয়েই কল রিসিভ করল রিচার্ড। মুহূর্তেই চোখের দৃষ্টিতে বদলে গেল কিছু। যেন হাওয়ার গতিবদল।
“মমকে আমাদের সাথে নিয়ে যাব মি. কায়—’বাক্যটা শেষ করার আগেই এলিজাবেথ থমকে গেল। চোখ ফেরিয়ে তাকাতেই দেখল রিচার্ড তার পকেট থেকে একটি গান বের করেছে, আর সেটির নিশানা মিস এলিসার দিকে। মুহূর্তে এলিজাবেথের ভেতর কেঁপে উঠল সবকিছু। রিচার্ডের চোখে এতটুকু করুণা নেই। আজ যেন সে আরও বেশি স্বার্থপর আরও বেশি শীতল। এলিজাবেথ কিছু বলতে যাবে, তখনই

“ঠাসসসসসস!”
‘বিকট শব্দ। এক দলা উষ্ণ রক্ত এসে ছিটকে পড়ল মুখে। চোখমুখ কুঁচকে উঠল। ভয় পেয়ে চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল মা নেই। গলা ঘুরিয়ে দেখল মিস এলিসার শরীর শূন্যে ভেসে পড়ছে নিচের দিকে। চোখদুটো এখনও তাকিয়ে আছে এলিজাবেথের দিকেই। শেষ মুহূর্তে যেনো কোনো দায় বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। এলিজাবেথ ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু পারল না। তার শরীর পাথরের মতো জমে গেল ওখানেই। নির্জীব, অনুভূতিহীন, স্তব্ধ এক প্রতিমা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে ছুঁয়ে গেলো না আর কোনো উষ্ণতা, কোনো শব্দ, শুধু এক অবিরত নিঃশব্দ আর্তনাদ।
‘হঠাৎই এলিজাবেথের শরীর দুলে উঠল। নিজেকে অনুভব করল শূন্যে ভেসে। তারপর আচমকা আছড়ে পড়ল এক বলিষ্ঠ বুকে। রিচার্ড তাকে কোলে তুলে ছুটে যাচ্ছে। কেন? কী হয়েছে? লোকটার মুখে এত আতঙ্ক কেন? চোখেমুখে যেন মৃত্যুর ছায়া। হঠাৎ রিচার্ড দুতলা থেকে ঝাঁপ দিল। আর ঠিক তখনই পেছনের বিশাল বিল্ডিংটা বিস্ফোরণে উড়ে গেল বিকট শব্দে। এজন্যই বুঝি লোকটা এমন করে ছুটছিল? মাটিতে পড়ার মুহূর্তে এলিজাবেথের শরীর তীব্রভাবে কেঁপে উঠল। তবে বলিষ্ঠ শরীরের আবরণে সে শুধুই ঝাঁকি টের পেল, যন্ত্রণায় চিৎকার করতে হয়নি। রিচার্ড আবার ছুটল। পিছনে আগুন দাউ দাউ করে ধেয়ে আসছে তাদের দিকে।

‘এলিজাবেথের শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে।
চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আধো খোলা চোখে সে তাকিয়ে থাকল রিচার্ডের মুখের দিকে। লোকটার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। এলিজাবেথ অস্থির নিঃশ্বাসের সাথে। স্বগোতক্তিতে বিরবিড়ালো,
“আপনি আমাকে আবারও ঠকালেন, রিচার্ড কায়নাত?
মায়ের খুনিকে কিভাবে ছেড়ে দিই আমি?”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (২)

‘এই কথাগুলো কানে গেলেও রিচার্ডের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এই মুহূর্তে সে শুধু ছুটছে একটি নিরাপদ জায়গার খোঁজে। তবু মাঝেমাঝেই অনুভব করছে, এলিজাবেথের শরীরটা জ্বলছে। জ্বর এসে গেছে। মেয়েটা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তার কোলে। তবু এখন থেমে যাওয়ার উপায় নেই। জ্বরতপ্ত শরীরটা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। চোখের সামনে এলিজাবেথের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। সে জ্ঞান হারানোর ঠিক আগে শেষবারের মতো ফিসফিসিয়ে বলে গেল,
“পূর্ণতার লোভ দেখিয়ে আমাকে পুরোপুরি এতিম করে দিলেন। তুই স্বামী না, তুই এক পিশাচ…”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৬