ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪১

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪১
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি নিজের রুমে বসে আছে বিষন্ন মনে৷ এমন সময় হঠাৎ করে রাফা মিষ্টির রুমে এসে প্রবেশ করে। রাফা এসেই বলে,
“মম, ড্যাড কোথায়? ড্যাড কি আর আসবে না আমাদের কাছে?”
মিষ্টির মেজাজ এমনিতেই ভালো ছিল না। তার উপর রাফার মুখে এহেন কথা শুনে সে বলে ওঠে,
“ড্যাড, ড্যাড, ড্যাড। এছাড়া কি আর কোন কথা নেই তোমার মুখে? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো। মরে গেছে তোমার ড্যাড, বুঝতে পেরেছ তুমি? তোমার ড্যাড আর নেই৷ এখন বিদায় হও আমার চোখের সামন থেকে।”
রাফা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“না, তুমি মিথ্যা বলছ মম ড্যাডের কিছু হয়নি৷ আমি তো ড্যাডকে দেখেছি।”
মিষ্টি এবার রাফার গায়ে হাত তুলতে যায় এমন সময় আসাদ এসে রাফাকে আগলে নিয়ে বলে,
“এসব কি হচ্ছে মিষ্টি? তুমি রাফার সাথে এমন করছ কেন? ও তো ছোট বাচ্চা।”
“বাচ্চা তো বাচ্চার মতোই থাকতে বলো না ওকে। কেন আমার মাথা খারাপ করছে।”
এদিকে রাফা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“তুমি দেখো না এঞ্জেল, মম এসব কি বলছে। ড্যাড নাকি মারা গেছে। আমি তো ড্যাডকে দেখেছি বলো।”
আসাদ রাফাকে সামলানোর জন্য বলে,
“তোমার মম একটু অসুস্থ তো তাই আরকি এসব বলছে। তুমি চলো, আমি তোমাকে একটু পার্কে নিয়ে যাই। ওখানে গেলে তোমার একটু ভালো লাগবে।”
বলেই আসাদ রাফাকে নিয়ে চলে যায়। এমন সময় হঠাৎ করে আমিনা মিষ্টির রুমে চলে আসে। আমিনাকে দেখেই মিষ্টি ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“আমার ভাগ্য আমার এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছে আমিনা? আর কত ধৈর্য ধরব আমি বলতে পারো?”
আমিনা বলে,
“আর তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে না, আপু। তুমি আসাদকে বিয়ে করে নাও। তাহলেই তুমি জীবনে সুখী হতে পারবে।”
কথাটুকু বলার সময় আমিনার চোখে জল এসে জমে। তার কন্ঠ শুনেও তার ব্যথা উপলব্ধি করা যায়। মিষ্টিও আমিনার এই ব্যথা উপলব্ধি করতে পারে। সে মনে মনে বলে,
“কার সাথে কার বিয়ে হবে সেটা তো খুব শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ আমি আগুন নিয়ে খেলছি আমিনা৷ জানি না,এই আগুনে শেষ অব্দি আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাব নাকি। কিন্তু এটা আমায় করতেই হবে। তাছাড়া যে কোন উপায় নেই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিকেল বেলা রাফা হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে যায়। জ্বরে তার গা একদম পুড়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হয় না। তার শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নিজের মেয়ের এই অবস্থা দেখে মিষ্টির চোখে জল চলে আসে। মিষ্টি রাফার শিয়রে বসে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে,
“আমায় ক্ষমা করে দাও মামনি, আমি অনেক বড় ভুল করেছি তোমায় বকা দিয়ে। দয়া করে আর মমের উপর রাগ করে থেকো না। প্লিজ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।”
এদিকে রাফা সমানে, “ড্যাড, ড্যাড”
করে চলছিল। রোকসানা শিকদার এসে মিষ্টির পাশে বসে। তাকে দেখামাত্রই মিষ্টি রোকসানা শিকদারকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“আমি মা হিসেবে খুব খারাপ তাই না মা? আজ শুধুমাত্র আমার জন্য আমার মেয়েটার এই অবস্থা। আমার তো জীবনটাই ব্যর্থ। না ভালো স্ত্রী হতে পারলাম আর না তো ভালো মা। ”
রোকসানা শিকদার মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো মিষ্টি। যা কিছু হয়েছে তাতে তোমার কোন দোষ নেই।”
এদিকে রাফা ক্রমশ বলে চলেছিল,
“ড্যাড..ড্যাড প্লিজ তুমি চলে এসো। তোমাকে ছাড়া আমরা কেউ হ্যাপি নেই।”
মিষ্টি রাফার মাথায় হাত বোলাতে থাকে। এদিকে আসাদ রুমে এসে বলে,
“আমার ডাক্তারের সাথে কথা হলো। রাফাকে সুস্থ করার এখন একমাত্র উপায় হলো ওর ড্যাডের সাথে ওর দেখা করানো।”

রোকসানা শিকদার হতবাক স্বরে বলেন,
“কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?”
আসাদ বলে,
“অবশ্যই সম্ভব। আপনি শুধু আমার উপর একটু ভরসা রাখুন।”
বলেই সে নিজের ফোন বের করে কাউকে একটা কল করে। অতঃপর আসাদ বলে,
“আমাকে ইমিডিয়েটলি ইন্সপেক্টর ইমানুয়েল পলের ফোন নাম্বার দিন। আমার ভীষণভাবে দরকার তার নাম্বার।”
কিছু সময় পর,
ইমানুয়েল পল এসে বসে রাফার শিয়রের কাছে। রাফা বলতে থাকে,
“ড্যাড..”
এমন সময় পল বলে ওঠে,
“হ্যালো সুইটিপাই..”
রাফা পলের কন্ঠ শোনামাত্রই বলে ওঠে,”তুমি এসেছ ড্যাড। আমি জানতাম তুমি ফিরবে। মম কিচ্ছু জানে না। মম বলছিল তুমি নাকি আর ফিরবেনা। তুমি আমার হয়ে একটু মমকে বকে দাও তো।”
“ঠিক আছে, আমি তোমার মমকে বকে দেব। তুমি এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।”
“জানো ড্যাড, ছোটবেলা থেকে আমার সব ফ্রেন্ডসদের কাছে তাদের ড্যাডের সাথে মজা করার গল্প শুনতাম। কিন্তু আমার সাথে মজা করার কেউ ছিল না জানো। আমি খুব মিস করেছি তোমায়।”
পল এবার একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এদিকে ওষুধের প্রভাবে ও পলের আসায় কিছুটা স্বস্তি অনুভব করায় রাফা ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।
রাফা ঘুমিয়ে পড়ার কিছু সময় পর পল উঠে দাঁড়ায়। আসাদ এগিয়ে এসে পলকে বলে,

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য। আপনি না এলে যে কি হতো..”
“কোন ব্যাপার না। মেয়েটা বড্ড ইনোসেন্ট।”
“হুম। আর ভীষণ অভাগী জানেন তো৷ জন্মের পর থেকে বাবার সহচর্য পায়নি।”
“একচুয়ালি আমায় এখন কিছু জরুরি কাজে যেতে হবে।”
“হ্যাঁ যান।”
পল রুম থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ডাক দেয়,
“রাফসান!”
পল এবার পিছন ফিরে তাকায়। রোকসানা শিকদার পলের দিকে এগিয়ে যান। অতঃপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“এতদিন কোথায় ছিলিস বাবা? এই বুড়ো মায়ের কথা কি একবারো মনে পড়েনি? তোর বাপ তো তোর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন৷ আর আমি…আমার কথা আর কি বলবো৷ দেখতেই পারছিস আমার কি অবস্থা হয়েছে।”

পল বলে ওঠে,
“আপনি ভুল করছেন আন্টি। আমি রাফসান নই। আমি ইমানুয়েল পল।”
“চুপ৷ একদম চুপ কর তুই। গোটা দুনিয়ার সামনে তুই নাটক করতে পারবি কিন্তু নিজের মায়ের সামনে তোর কোন নাটক চলবে না। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি, তুই আমার রাফসান।”
পল আর কিছু বলবে এমন সময় মিষ্টি সেখানে এসে বলে,
“উনি ঠিক বলছেন মা। উনি আপনাদ ছেলে নন৷ উনি হলেন ইমানুয়েল পল। উনি যদি আপনার ছেলে হতো তাহলে আপনার এত কষ্ট দেখেও এইসব অভিনয় চালিয়ে যেতে পারত না।”
মিষ্টির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় পল। এদিকে মিষ্টির পিছনে মোর্শেদ চৌধুরী ও সুইটি চৌধুরীও ছিল৷ মিষ্টি বলে ওঠে,
“এতক্ষণ সময় যখন দিতে পারলেন আর একটু সময় কি দিতে পারবেন মিস্টার পল? একচুয়ালি আজ আমাদের বাড়িতে ছোট পরিসরে আমার আর আসাদের এনগেজমেন্ট হতে চলেছে। এমনিতে বাইরের কাউকে বলিনি। আপনি নাহয় গেস্ট হিসেবে উপস্থিত থাকলেন।”
পল বলল,

“আসলে আমার কিছু..”
“বেশিক্ষণ লাগবে না। আপনি শুধু আমাদের সাথে ড্রয়িংরুমে চলুন এক্ষুনি সব হয়ে যাবে।”
বলেই মিষ্টি একপ্রকার জোর করে পলকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যায়। সেখানে আসাদ অপেক্ষারত ছিল। মিষ্টি আসতেই রাফসান একটা আংটি নিয়ে এগিয়ে আসে মিষ্টির দিকে। সুইটি চৌধুরী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। মিষ্টি পলের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি ছিল স্থির। ধীরে ধীরে আসাদ মিষ্টিকে আংটিটা পড়িয়ে দেয়। অতঃপর মিষ্টিও একটা আংটি পড়িয়ে দেয় আসাদের হাতের অনামিকা আঙুলে। সুইটি চৌধুরী বলেন,
“যাক, তোমাদের এনগেজমেন্ট সুসম্পন্ন হলে।”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪০

কিছুটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আমিনার চোখ জলে ভিজে উঠল। এদিকে মিষ্টিও ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেল৷ তবে নিজের দুঃখ প্রকাশ করল না৷ পলের দিকে তাকিয়ে দেখল সে এখনো ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে৷ মিষ্টি মনে মনে বলে,
“আমিও দেখব তুমি আর কতদিন এভাবে শক্ত থাকতে পারো৷ নিজেকে আর আমাকে আর কত কষ্ট দিতে পারো।”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪২