ভৈবর নদীর পাড় পর্ব ৩
ফারহানা কবীর মানাল
আজ সোমবার। এই সপ্তাহে আজই প্রথম স্কুলে যাব। আজকে দিনটা অন্য দশটি দিনের মতো এক রকম নয়। একটু যেন অন্য রকম। আলো কেমন অন্য দিনের চেয়ে কোমল। বাতাস ভেজাভেজা। মানুষের চিন্তা ভাবনার সাথে দিন পাল্টে যায় নাকি?
বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে ছিলাম। রাতেরবেলা ঘুম না আসলে গল্প করার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। অনেকদিন ধরে এই প্রয়োজনীয়তাটা অনুভব করছি। তবে সে প্রয়োজন মেটানোর কোন উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলেও কিছুটা সময় কাটানো যেত। কিন্তু দাদি আমার হাতে মোবাইল দিতে রাজি হন না। কেন হন না সেও এক রহস্য। এমন নয় যে তার টাকা পয়সার সমস্যা। দাদা সারাজীবন অমানুষিক পরিশ্রম করে অঢেল সম্পত্তি রেখে গেছেন। বাবাও কিছু কিছু করেছেন। সেই সম্পত্তির প্রতি ফুফুদের আগ্রহের শেষ নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দূরসম্পর্কের আত্মীয় পর্যন্ত কিছু পাওয়ার আশায় বসে থাকে। মানুষ হিসেবে দাদা খুবই চালাক এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। সুস্থ থাকতেই সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন। যার যার প্রাপ্য অংশ তাদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। গ্রামের দিকে এক বিঘের মতো ধানিজমি ফুফুর নামে লিখে দেওয়া হয়েছে। বাবার নামে খুলনা শহরের দিকে ছোট মতো একটা বাড়ি কিনে দিয়েছেন। দাদিকেও আলাদা করে কিছু জমি লিখে দিয়েছিলেন। শুধু এই বাড়িটা নিজের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছেন।
কথা ছিল বাড়িটা এমনই থাকবে। বংশ পরম্পরায় বসবাস করবে। বাড়িতে খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু মুফতে যা পাওয়া যায় তাতেই ফুফুর লোভ। বিশেষ করে ফুফুর শাশুড়ি। তাকে আমি ছোট দাদি বলে ডাকি। ছোট দাদি প্রথম প্রথম খুব ভালো ছিলেন। এখন কেমন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছেন। দিন গেলে সবাই পাল্টে যায়। আমিও বোধহয় অনেক পাল্টে গেছি। আগে দাদির সাথে অনেক সময় নিয়ে গল্প করতাম। আজ-কাল আর তেমন সময় হয়ে ওঠে না। একা থাকতে ইচ্ছে করে।
বেশ ক’দিন ধরে খেয়াল করছি বেশিরভাগ খারাপ খবরগুলো খাবার টেবিলে দেওয়া হচ্ছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফুফু বেজার মুখে বলল, “তাড়াতাড়ি খেয়ে নে সবাই। আজকে আমি তোদের স্কুলে দিয়ে আসব।”
শিমুল মুখ বেজার করে ফেলল। ম’রা গলায় বলল, “এই রোদের মধ্যে তোমাকে যেতে হবে না মা। আমরা তিন ভাই মিলে চলে যেতে পারব।”
তিন ভাই কথাটা বলে সে নিজে খানিকটা চমকে গেল এবং টেবিলে বসে থাকা বাকি সদস্যদেরকেও চমকে দিল। ফুফা গম্ভীর গলায় বললেন, “তোদের মা যা বলছে তাই কর। ফয়সালের ওপর এত বিশ্বাস করে বসে থাকিস না। ও তো তোদের সাথে যায় না। একা একা আগে আগে হাঁটে।”
শিমুল মুখ কালো করে তরকারির আলু ভাঙতে লাগল। তালেব বলল, “ফয়সাল ভাই আমাদের সাথে যাবে কিভাবে? দাদি তো তার সাথে কথা বলতেই নিষেধ করেছে।”
ফুফা তীক্ষ্ণ চোখে তালেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না। খেয়াল করলাম ছোট দাদি চোখ মোটা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মহিলা সবকিছুতে আমার দোষ দেখতে পান। শিমুল তালেব কোন ভুল কাজ করলেও দোষ হয় আমার।
ফুফু বলল, “শুনেছি ছেলে ধরা বের হয়েছে। ফেসবুকে খুব লেখালেখি হচ্ছে এটা নিয়ে। ছেলে মেয়েদের সাবধানে রাখতে বলা হচ্ছে। তাই আমি তোদের সাথে যাব। এই নিয়ে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাই না।”
শিমুল আর তালেব খুব করে চাচ্ছিল যেন ফুফু ওদের সাথে না যায়। আড়ালে আবডালে তিশা আপু সাথে যাওয়ার জন্য রাজি করতে চেষ্টা করল। লাভ হলো না। আজকে তার খুব জরুরি ক্লাস আছে। সকাল বেলা তৈরি হয়ে তারপর খেতে বসছে। আপুর সাজ খুব চমৎকার।
কলেজ ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে সাদা পাথরের কানের দুল, গলায় পাতলা চেনের সাথে লকেট ঝুলছে। ঠোঁটে মেরুন কালারের লিপস্টিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় এমন কড়া লিপস্টিক পরার নিয়ম আছে জানা ছিল না। আমাদের স্কুলের রিতা মেডাম এসব ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করেন। মেয়েরা উনার জন্য লিপস্টিক পরতে পারে না। উগ্র সাজে চুল বাঁধতে পারে না। এ কারণে বেশিরভাগ মেয়ে মেডামকে দু’চোখে দেখতে পারে না। বি’শ্রী ভাষায় গা’লা’গা’ল দেয়।
শেষ পর্যন্ত ফুফু আমাদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ছোট দাদির সাথে কিসব কথা বলে আসলো। আজ-কাল শাশুড়ি বউয়ের খুব ভাব হয়েছে। এক সময় সাপে নেউলের সম্পর্ক ছিল। স্বার্থ মিলে গেলে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
শিমুল আর তালেব বেজার মুখে হাঁটতে লাগল। ফুফার পকেট থেকে চু’রি করা পাঁচশ টাকার নোটটা আজ আর খরচ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ফেরার পথে ফুফু সবাই আইসক্রিম কিনে দিল। আগে হেঁটে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “বাজান আমার উপর রেগে আছিস নাকি?”
চমকে উঠলাম ঠিকই, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “না না। রেগে থাকব কেন?”
“এই যে ঠিকঠাক তোর খেয়াল রাখতে পারি না। সারাক্ষণ মুখ পু’ড়ি’য়ে কথাবার্তা বলি।”
“না ফুফু, আমি রেগে নেই।”
“কি আর বলব বাজান! নানান চিন্তায় মাথা খারাপ থাকে।”
আমি চুপ করে রইলাম। ফুফু নিজের কন্ঠে আগের থেকে অনেক বেশি দরদ জড়ো বলল, “বাজান, তোর ফুফার হাতে টাকা-পয়সা নেই। সংসার চালতে গিয়ে অনেক ধার দেনা করতে হচ্ছে। মা তো আজ-কাল কোন টাকা পয়সা দিতে চায় না।”
“আমি কি দাদিকে টাকা দেওয়ার জন্য বলব?”
“বলে আর কি করবি? তোর দাদির হাত দিয়ে কি টাকা সরে নাকি? এমন কৃপণ মহিলা আজও আমার চোখে পড়েনি।”
ফুফু ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করতে চেষ্টা করল। দাদি কৃপণ নয় বরং তাকে দিলখোলা মানুষ বলা যায়। বাবা থাকতে প্রায় প্রতি মাসে ফুফুর বাড়ি বাজার দিয়ে পাঠাতেন। অবশ্য বাজার খরচ বাবার দিতে হতো না। দাদা দাদির জন্য কিছু টাকা আলাদা করে সরিয়ে রেখেছিলেন। দাদি সেখান থেকেই সব খরচ করতেন। মাঝেমধ্যে বাবাকেও কিছু দিতেন। আশেপাশের মানুষ, দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনরা কেউ এই দেওয়া-নেওয়ার ভেতর থেকে বাদ পড়ত না। মাঝেমধ্যেই মনে হয় দাদা নিশ্চয়ই অসৎ পথে রোজকার করার ব্যবস্থা ছিল। না হলে উনি এতো টাকা কোথায় পেয়েছেন? প্রায়ই ভাবি দাদিকে জিজ্ঞেস করব, সময় কালে মনে থাকে না।
ফুফু বলল, “তোর ফুফার কাছে এক লোক টাকা পাবে। তাগাদা দিচ্ছে, মা’রার হুমকি দিচ্ছে।”
“কত টাকা পাবে?”
“তা লাখ খানেকের মতো। কোথা থেকে এতো টাকা জোগাড় করব ভেবে পাচ্ছি না। ভাবছি কিছু গহনা বিক্রি করব। মানুষটা তো আগে বাঁচুক। তোর ক্লাসের ছেলেগুলো বলে দেখিস তো। কেউ যদি কিনতে চায়।”
পৃথিবীতে এক শ্রেণির মানুষ থাকে। যাদের সাথে কেউ মিষ্টি করে কথা বললে খুব সহজে পুরনো কথা ভুলে যায়। সেই মুহূর্তে তাদের জন্য জীবন দিয়ে দিতেও পারে। আমি সেই শ্রেণির মানুষের মধ্যে একজন। যখন যে আমার সাথে ভালো কথা বলে তখন তাকে সবচেয়ে কাছের মনে হয়। এ কারণে ফুফুর কষ্ট খুব সহজে আমার হৃদয়ে আ’ঘা’ত করল। সাত-পাঁচ না ভেবেই বললাম, “আমি দাদিকে বলল টাকা দিয়ে দিতে। তোমার গহনা বেচতে হবে না।”
“লাভ নেই রে বাজান! আমি মা পায়ে ধরে পর্যন্ত বলেছি।”
“তবুও আমি বলে দেখব। যদি কিছু হয়।”
“চাইলে তুই নিজেও এই টাকা শোধ করতে পারিস।”
“কিভাবে? আমার কাছে এই মুহূর্তে বিশ টাকার একটা নোট ছাড়া এক পয়সাও নেই।”
“কাছে নেই তো কি হয়েছে? ব্যাংকে আছে। ভাইজান তোর জন্য আলাদা করে জমা করে রাখত। মা’য়ের কাছে চেকবই আছে। সেখান থেকে একটা চেক নিয়ে আসব। তুই সই করে দিলেই টাকা তুলতে পারব। দিবি বাজান? চিন্তা করিস না। তোর ফুফা টাকা পেলে পরে আবার ফেরত দিয়ে দেব।”
মাথা দোলাতে দোলাতে হ্যাঁ বললাম। ফুফু চওড়া হাসি দিল। তার চোখ মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
রাতে খাবার আয়োজন ভালো। বড় সাইজের গলদা চিংড়ি ভাজা হয়েছে। গরুর গোশতের সাথে পাতলা ডাল। সরু চালের ভাত। সবগুলোই আমার পছন্দের। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব খাবারের ভালো ভালো অংশটুকু আমার পাতে জমা পড়েছে। বহুদিন বাদে মন ভরে খেতে পারছি। অনেকদিন এমন করে খাওয়া হয় না। দাদি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব অবাক হচ্ছেন, সেই সাথে দুশ্চিন্তাও করছেন। খাওয়া শেষে মিষ্টি পানের ব্যবস্থা করা হলো। এই খাদ্যবস্তুটা আমার খুব পছন্দের। ছোট দাদি আমায় দু’টো পান দিলেন। আদুরে গলায় বললেন, “নেও জামাই, পান খাও। ঠোঁট লাল করে ঘুরে বেড়াও। মোরে পানে ফিরা চাও।”
ফুফু খুব জোরে জোরে হাসতে লাগল। আগে ছোট দাদি আমায় নানা ভাই বলে ডাকত। এই বাড়িতে আসার পর থেকে জামাই বলে ডাকে। এ বাড়িতে আসার পর সবার সম্মোধন পাল্টে গেছে। ফুফা আগে দাদিকে শাশুড়ি মা বলতেন, এখানে থাকতে শুরু করার পর থেকে আম্মা ডাকেন। ফুফার অন্য ভাই-বোনরাও আম্মা ডাকে। কেন ডাকে কে জানে! এসব নিয়ে দাদিকে খুব একটা ভাবতে দেখা যায় না।
শোবার আয়োজন করছিলাম। খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়ার মুহূর্তে ফুফু এলো। তার আসার ভঙ্গি অনেকটা চো’রের মতো। ফিসফিস করে বলল, “বাজান, চেক নিয়ে আসছি। সই করে দে।”
কোনকিছু চিন্তা না করে সই করে দিলাম। আমার টাকায় যদি একটা মানুষের দেনা শোধ হয় তো হোক। একটা সইতে যদি ফুফুর চিন্তা দূর হয় তবে না হয় সই করেই দিলাম। কি যায় আসে? আমার তো কিছু কম পড়ে যাচ্ছে না। ফুফুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বাতি নিভিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম।
সকালে ঘুম ভাঙলো চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে। ফুফু আর ফুফার মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ফুফা কুৎসিত ভাষায় ফুফুকে গা’লা’গা’ল দিচ্ছেন। ফুফুও কিছু কম যাচ্ছে না। সমান তালে উত্তর দিচ্ছে। ছোট দাদি তাদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করছেন। ক্রমাগত ফুফার গায়ে হাত বুলাচ্ছেন। নিচু গলায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। লাভ হচ্ছে না।
ভৈবর নদীর পাড় পর্ব ২
দাদির অবশ্য কোন হেলদোল নেই। সোফায় বসে পান চিবুচ্ছেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঝগড়া দেখে খুব মজা পাচ্ছেন। ফুফুদের ঝগড়া ততক্ষণ চলল যতক্ষন না খবর এলো তিশা আপু পালিয়ে গেছে। ক্লাসের কোন ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। সেই ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। আপুর বান্ধবী মনিরা এসে এই সংবাদ দিল। ফুফু ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।