মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১
মুসতারিন মুসাররাত
-” আপু, তোর দেবর এএসপি নীরব মাহবুবের সঙ্গে একটা সুন্দরী মেয়ের ঘনিষ্ঠ ছবি, আমি নিজ চোখে দেখেছি। এমন একটা দৃশ্য দেখে, আমি কীভাবে তাকে বিয়ে করতে পারি? সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়, বরং এটা এক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তাই বলছি, তোর দেবরকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাড়াতাড়ি এই বিয়ে ক্যান্সেল কর।”
ইয়ানূর প্রত্যাশা কাটকাট কণ্ঠে তার সিদ্ধান্ত জানাতেই নীলাশার ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ প্রত্যাশার বাহু সজোড়ে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। চোখ রাঙিয়ে ধ’ম’কের সুরে বলল,
-” বিয়ে করবি না, সেটা বল। মিথ্যে কেনো বলছিস?”
নীলাশা এতটা জোড়ে হাত চেপে ধরেছে যে প্রত্যাশা মৃদুস্বরে-‘আহ’ বলে উঠল। তবে সেদিকে নীলাশার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রত্যাশা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে তেজি গলায় বলল,
-” ম-মিথ্যে কেনো বলব? আমি যা দেখেছি তাই বলছি, লাস্ট যে বার তোর শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম, সেইসময় ওনার বুকশেলফ থেকে একটা বই হাতে নেই। আচমকা বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা ছবি পড়ে। যেখানে মিস্টার নীরব একটা মেয়ের কপালে চুমু খাচ্ছে। যদিও মেয়েটার ফেস পুরোপুরি দেখতে পাইনি। যতটুকু দেখেছি তাতে বেশ সুন্দরীই মনে হয়েছে। মেয়েটা ওনার গার্লফ্রেন্ড হতে পারে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রত্যাশা একটু বাড়িয়ে বলে, ছবিটাতে নীরবের আঙুল মেয়েটির ফর্সা লম্বা লম্বা আঙুল ছুঁয়ে আছে। দু’জনে খুব কাছাকাছি, চোখে চোখ রেখে। দু’জনের মুখেই একটা স্নিগ্ধ হাসি লেগে আছে। প্রত্যাশা ছবিটা খুঁটিয়ে দেখতে নেওয়ার আগেই কোত্থেকে ভূ’তের মত নীরব এসে ছো মে’রে একটানে নিয়ে নেয়। প্রত্যাশা সেই থেকে ভেবে নিয়েছে নীরবের প্রেমিকা হবে মেবি। এদিকে নীলাশা কিচ্ছুতেই বোনের কথা বিশ্বাস করল না। ভাবল বিয়েতে রাজি না হতে মিথ্যে বলছে প্রত্যাশা। নীলাশা নীরবের পক্ষ নিয়ে হাজারটা গুণের কথা শোনাল। নীলাশা বিশ্বাস না করায় প্রত্যাশা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। ফের বলল,
-” ধরলাম তোর দেবর খুব লয়্যাল। তার দ্বারা এমন কিছু সম্ভব নয়, তবুও এই বিয়েটা আমি করতে পারব না।”
নীলাশা গর্জে উঠল,
-” সম্ভব নয় মানে? এত দেমাগ কই থেকে আসছে তোর, শুনি? নিজেকে কখনো খেয়াল করেছিস? একে তো গায়ের রং চাপা, ফেস কাটিংও আহামরি নয়, তারপর গজ দাঁতটা। ইশশ্! হাসলে পরে সবার সামনে বেরিয়ে আসে। আচ্ছা সৌন্দর্যের কথা না হয় বাদই দিলাম। পড়াশোনাতেও তো টেনেটুনে পাস করিস। ওহ্ গড! আমার তো মাথায় ধরছে না আমার শ্বশুর তোর মধ্যে এমন কী দেখল! তার এত সুন্দর হ্যান্ডসাম তারপর এত ভালো চাকরি, এক কথায় হিরের টুকরো ছেলের জন্য তোকে চুজ করল।”
নিজের বোনের মুখ থেকে নিজেকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথাবার্তা শুনে প্রত্যাশার এখন আর বিন্দুমাত্র মন খা’রা’প করে না। এতটুকুও কষ্ট লাগে না। আগে প্রত্যাশার খুব আফসোস হতো। তার বোন কেনো অন্যদের বোনের মতো নয়? প্রশ্ন জাগত, আদৌও কী তারা আপন বোন? না আছে চেহারায় মিল, আর না তো আছে মনমানসিকতা, চাল-চলনে। তবে প্রত্যাশা কোনো কথা চুপচাপ সয়ে নেবার মেয়ে নয়। ওর আবার মুখের উপর ঠাসঠাস জবাব দেওয়ার স্বভাব। প্রত্যাশা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ঠেস দিয়ে বলল,
-” কথায় আছে না–রতনে রতন চেনে। তারপর আরো আছে, কী যেনো..ওহহো মনে পড়েছে–নুন ছাড়া তরকারি আর গুণ ছাড়া রুপবতী নারী__”
নীলাশা ফুঁসে উঠল। প্রত্যাশার কথা থামিয়ে দিয়ে রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-” কী বলতে চাইছিস তুই? আমার গুণ নেই?”
-” আরে আপু রিল্যাক্স, রিল্যাক্স। এত হাইপার হচ্ছো কেনো? আমি একবারো তোমার নাম নিয়েছি। বলো…তুমিই বলো?”
নীলাশার মুখটা ক্রো’ধে থমথমে হয়ে যায়। দুইবোনের সম্পর্ক দা-কুমড়া। প্রত্যাশা একটু হেঁটে সামনে এগোয়, জানালা বরাবর বাইরে শুন্যে দৃষ্টি মিলল। নিম্নস্বরে বলল,
-” চেহারা আর বাহ্যিক আকর্ষণ কিছু সময়ের জন্য মন টানতে পারে, কিন্তু একদিন সেগুলো একেবারে ম্লান হয়ে যায়। একজনের প্রকৃত মূল্য তার মনের গভীরতা এবং তার কাজে আর যাদের মনটা অগভীর, তারা কখনোই বড় হতে পারে না। যতই বাহবা পাবে বাহ্যিক সৌন্দর্যের, অন্তরে যদি কিছু না থাকে, সব শেষ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার হৃদয়ের গুণে, বাহ্যিক নয়।”
থেমে জোড়াল শ্বাস ফেলল প্রত্যাশা। ফের কিছু বলতে নিবে তার আগেই নীলাশা মুখ কালো করে দাঁত খিচে বলল,
-” তোর এই জ্ঞানের কথা রাখ। আর একটা কথা কান খুলে শোন, আমার মোটেই তোকে ও বাড়ির বউ করে নেওয়ার ইচ্ছে নেই। কে চায় যেচে ঘরের শত্রু বিভীষণকে আদর করে কাছে রাখতে? সব সময় তো সবার সামনে আমাকে ছোট করে কথা বলিস। তোর বড় হই, মান্য করে খুব কমই চলিস। এরপরেও তোকে বিয়েতে রাজি হতে বলার কারন– আমার শ্বশুর। নেহায়েৎ লোকটা আমাকে খুব ভালোবাসে। এই প্রথম একটা দায়িত্ব দিলেন। তাই দায়িত্বটা পালন করতে তোকে বলা।”
চোখদুটো বুঁজে প্রত্যাশা দুই আঙুল কপালে চেপে ধরল। কয়েক সেকেন্ড পরে বলল,
-” সমস্যা নেই, ও বাড়িতে তোর মান সম্মান ক্ষুন্ন হয়, এমন কিছু আমি কক্ষনোই করব না। আমি নিজে আংকেলকে বুঝিয়ে বলব। যাতে তোকে না ভুল বোঝে ওনারা।”
এরমধ্যে নীল রঙের সিল্কের শাড়ি, উপরে কয়েকটা লাল রঙের বক্স হাতে নিয়ে অধরা রুমে ঢুকল। এগিয়ে আসতে আসতেই বললেন,
-” কাউকে আর কারো সাথেই কথা বলতে হবে না।”
হাতের শাড়ি আর গহনার বক্স বিছানায় নামিয়ে রাখলেন। প্রত্যাশার দিকে একপল তাকিয়ে ফের নীলাশার দিকে চেয়ে আদেশের সুরে বললেন,
-” নীলা, এই শাড়ি আর গহনাগুলো ওকে পড়িয়ে দে। তাড়াতাড়ি রেডি করিয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আয়।”
প্রত্যাশা সাথে সাথে বলে উঠল,
-” আম্মু আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না। কিছুদিন পরেই আমার এইচএসসি পরীক্ষা। এখন….না মানে পড়াশোনার উপর ইফেক্ট পড়বে তো।”
-” পড়াশোনায় আপনি কেমন? পড়াশোনার প্রতি আপনার কত আগ্রহ তা আমি জানি, মা জননী।”
মা নিশ্চয় খুব রে’গে আছে, কথার ধরনই তাই বলছে। মা যখন রেগে থাকে তখন-আপনি করে সম্বোধন করে। আর গলার টোন শুনেই বোঝা যায়। প্রত্যাশা মুখটা কাঁদো কাঁদো করল। অধরা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-” নিভানের [ নীলাশার বর] বাবা হজ্জ করতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক ওনার সকল দায়িত্ব পালন করেই পবিত্র কাজটা সম্পাদন করতে চাচ্ছেন। তাই হুট করে এই বিয়ের সিদ্ধান্ত। তোর বাবা রাজি। ছেলে ভালো, ভালো ঘর এসব তো আমাদের অজানা নয়। আর ওনারা যেহেতু নিজ থেকে চাইছে; না করবেনই বা কী করে! আজ আকদ সারবেন। তোর অনার্সে ভর্তির পর সবাইকে জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তুলবে।”
প্রত্যাশা এবার যেন অথৈ সাগরে পড়ল। ওর রাগ হচ্ছে, সাথে কান্না পাচ্ছে। সমস্যাটা বিয়েতে না। মূল সমস্যা ওই জলদগম্ভীর মিস্টার নীরবকে নিয়ে। তারপর ওই ছবিটাও ভাবাচ্ছে প্রত্যাশাকে।
একতলা বাড়ির সামনে বিশালাকার উঠোন। একপাশে রঙিন ফুলের গাছ সাজানো, আর অন্যপাশে ফলফলাদি গাছগুলো ছায়া দিচ্ছে। ফুলগুলো গোধূলির নরম আলোতে আরও ঝলমল করছে। বাড়ির মেইন গেটের সামনে দিয়ে পিচের চিকন রাস্তা চলে গেছে। মেইন গেইট বরাবর রাস্তার উপর গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত লম্বা চওড়া, গায়ের রং কাগজের মতো ধবধবে সাদা, সুদর্শন দেখতে ছেলে আর ষাটোর্ধ্ব সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত বাবার শান্ত তর্ক চলছে। মাহবুব সাহেব ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
-” সবটা তো শুনলে, এতে তোমার কী কোনো আপত্তি আছে?”
নীরব মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড ভাবল। পরপর মুখটা তুলতে তুলতে বলল,
-” বাবা এ ব্যাপারে আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।”
বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে আসল। প্রগাঢ় স্বরে বললেন,
-” বিয়ের উপযুক্ত তুমি। আর বাবা হিসেবে ছেলে-মেয়েকে বিয়ে-শাদি দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
নীরব দুই আঙুলে কপাল স্লাইড করল। ওভাবেই বলল,
-” বাবা, মেয়েটা আর আমার এইজ ডিফারেন্স অনেক বেশি। একটা হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করা আমার পক্ষে পসিবেল নয়। আর এটা শোভনীয়ও দেখায় না। তাই বলছি বাদ দাও।”
ডিউটিতে ছিলো নীরব। হঠাৎ বাবার জরুরী ফোন, কোনো এক জরুরী প্রয়োজনে নীলাদের বাড়িতে আসতে হবে–আসতে হবে মানে, আসতেই হবে। নীরব ভেবেছিলো কোনো সমস্যা হয়তো। কিন্তু এখানে এসেই যেন এক ফ্যাসাদে জড়াল সে। ওদিকে বাবা আর মা দাওয়াত খেতে এসেছিলেন বেয়াই বাড়ি। এসে হুট করে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন? নাকি আগে থেকেই প্ল্যান ছিলো! নীরবের বোধগম্য হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব ছেলেকে বোঝাতে উদাহরণ টেনে আনলেন,
-” আটাশ চলছে তোমার, প্রত্যাশা মা আর তিন’মাস পরেই আঠারোতে পা রাখবে। এমন বেশিও ডিফারেন্স না। তোমার মায়ের সাথে যখন আমার বিয়ে হয় তখন তার সবে পনেরো চলছিলো, আমার ত্রিশ পার ছিলো। আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি তো। তোমার দাদা….”
নীরবের এবার বি’র’ক্ত ঠেকল। বাবার এই উদাহরণ না তার দাদা…তার দাদা এভাবে বংশ পেরোতে পেরোতে শেষমেষ মুঘলদের যুগে গিয়ে থামে। উফ্! তড়িঘড়ি করে নীরব বাবাকে থামিয়ে দিল,
-” বাবা, দয়াকরে থামবে তুমি।”
-” নীরব, নেক্সট সপ্তাহেই আমার ফ্লাইটের ডেট। হাতে সময় খুব কম। সময় থাকলে ভাববার জন্য তোমাকে আমি সময় দিতাম। আমি অলরেডি নীলার বাবাকে কথা দিয়ে ফেলেছি। আশাকরি তুমি আমার কথার মান রাখবে।”
বাবা যেন এক প্রকার ইমোশনাল ব্লাকমেইল করছে। নীরব নম্রস্বরে প্রতিবাদ স্বরূপ বলল,
-” বাবা বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমার সিদ্ধান্ত না জেনেই তুমি কথা দাও কীভাবে?”
এরমধ্যে মুখটা গোমড়া করে নীহারিকা বেগম এগিয়ে আসলেন। বাবা-ছেলের কথার মাঝে ফোড়ন কা’ট’লেন,
-” দ্যাখো…দ্যাখো আমার ছেলেটাকে কীভাবে জোর করছে। আরে ছেলে রাজি হচ্ছে না তারপরেও জোর করার কোনো মানে হয়।”
স্ত্রীকে দেখে মাহবুব সাহেবের মুখটা পাংশুটে হয়। বি’র’ক্তি’র ছাঁট পড়ল কপালে। বলল,
-” তুমি আবার এখানে আসতে গেলে কেনো? আমরা তো কথা বলছিই।”
নীহারিকা বেগম নাকমুখ কুচকালেন। হায় হায় করে উঠলেন,
-” আমার সংসারটা শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, আর আমি কিছুই বলব না? চুপচাপ দর্শক হয়ে দেখে যাব! আরে এক বাড়ি থেকে দুই মেয়ে নিতে নেই। আমার সোনার সংসার শেষ হয়ে যাবে। আমার সোনার টুকরা ছেলে দু’টোকে শ্বশুড় বাড়ি মুখো করে ছাড়বে। আমার তিলেতিলে গড়া সংসার শেষ হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ বাবার সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার থেকেও মায়ের এই অহেতুক, আগাম আ”জগুবি কথা নীরবের কাছে বেশি অসয্য ঠেকছে। নীরব মৃদুস্বরে বলল,
-” আহ্, মা থামবে।”
নীহারিকা স্বামীর দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-” শোনো, আমি অতশত জানি না। এই মেয়েকে আমার ছোট ছেলের বউ করতে, আমি রাজি নই। বড় মেয়েটা তাও দেখতে, শুনতে ভালো ছিলো। আচার-ব্যবহারও ভালো। আর এই মেয়ের আজ পর্যন্ত কোনো গুণ আমার চোখে পড়েনি। কেমন একটা উড়নচণ্ডী মেয়ে! মেয়ে হয়ে সারা শহর স্কুটি নিয়ে ঘোরে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। বাপ-মা কেমন আস্কারা দেয়, নিষেধও করে না।”
মাহবুব সাহেব মৃদুস্বরে ধ’ম’ক দিলেন,
-” থামবে তুমি। বেয়াই-বেয়াইন শুনবে। আর মেয়েটা একটু চঞ্চল। তবে খুব ভালো। দেখো, আমার আজকের কথার একদিন না একদিন চাক্ষুস প্রমাণ পাবে।”
বাবা-মায়ের বাকবিতন্ডা থামাতে নীরব বলল,
-” বাবা, লিভ মি অ্যালোন। লেট মি থিঙ্ক ফর আ হোয়াইল।”
সাঁঝ পেরিয়ে গোধূলির শেষ আভা মিলিয়ে গেছে দিগন্তে। রাতের নরম আঁধার ধীরে ধীরে গ্রাস করছে শহরটাকে। ছাদে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নীরব। চোখে একরাশ ভাবনা। টিমটিমে হলুদ আলোয় ছায়াটা লম্বা হয়ে পড়েছে মেঝেতে।
প্রত্যাশা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। পরনে নীল শাড়ি, হালকা বাতাসে আঁচল দুলছে। কপালের কাছে কয়েকটা চুল উড়ে এসে আটকে গেছে। নার্ভাস হাতটা আঁচলের গিঁটে পেঁচিয়ে ধরল মেয়েটা। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ বাড়ছে, মনে হচ্ছে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, শুধু ওর শ্বাসের শব্দই শোনা যাচ্ছে। এতটা নার্ভাস কেনো লাগছে প্রত্যাশা বুঝতে পারছে না! নীরব আলাদা করে কথা বলতে চেয়েছে। নীলা জোর করে পাঠিয়েছে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিকঠাক, তবু হৃদয়ের গতি যেন আরও বেগবান হয়ে ওঠে প্রত্যাশার। নার্ভাসনেসকে জোর করে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে উপরে শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত করার চেষ্টা করে নিজেকে প্রবোধ দেয়,
-” ধূর! এত ভ’য় পাওয়ার কী আছে? লোকটা বা’ঘও না ভা’ল্লুকও না, যে আমায় খেয়ে ফেলবে। প্রত্যাশা বি কুল।”
পায়ের খসখসে শব্দে নীরব ঘুরে দাঁড়ায়। শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে এগিয়ে আসে প্রত্যাশা, মৃদু আলোয় শ্যামবর্ণ মুখটা যেন রহস্যময় আলোছায়ার খেলায় মায়াবী হয়ে উঠেছে। নীরব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। প্রত্যাশা শাড়ি সামলাতে ব্যস্ত। কুঁচি বারবার পায়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশা ভাবল–কে কীসে আ’টকায় জানি না, তবে আমি যে শাড়ির কুঁচিতে আ’টকাবো, তা একদম নিশ্চিত!”
কথাটা ভাবতেই নিয়তি যেন মুচকি হাসে। মুহূর্তেই শাড়ির কুঁচিতে পা জড়িয়ে উস্টা খায় প্রত্যাশা। শরীর ভারসাম্য হারিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ে, প্রত্যাশা ভ’য়ে আর্তনাদ করে ওঠে–“আও” কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই এক বলিষ্ঠ হাত কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফেলে। প্রত্যাশার বুক রীতিমতো দুরুদুরু করে কাঁপছে। নীরব ওর দিকে ঝুঁকে। নীরবের হাত শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে প্রত্যাশার কোমল, উষ্ণ ত্বকে আলতো স্পর্শ হয়। সেই অপ্রত্যাশিত স্পর্শে দু’জনেই থমকে যায়! অপ্রস্তুত হয়। নীরব দ্রুত প্রত্যাশাকে সোজা করে দিয়ে অপ্রস্তুত ভঙিতে বলল,
-” স্যরি। আর ইউ ওকে?”
প্রত্যাশা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দু’জনেরই কেমন একটা বিব্রত ফিল হচ্ছে। এমন সময় নীরবের ফোনটা ভো ভো শব্দ তুলল। উফ্! প্রত্যাশা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নীরব ব্যস্ত ভঙিতে পকেট থেকে ফোন হাতে নিল। ফোনের স্ক্রিনে ‘Priti’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। নীরব কয়েক পা হেঁটে একটু দূরত্বে গিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি চিকন কণ্ঠস্বর আসলো,
-” হ্যালো, নীরব তুমি কোথায়?”
নীরব উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
-” কেনো?”
প্রীতি একটু আ’হ’ত হলো বোধহয়। কণ্ঠের স্বর ম্লান হয়ে আসলো,
-” আজ ইচ্ছের বার্থডে। ইচ্ছে জিদ করছে, পাপা না আসলে সে কেক কা’ট’বে না। তুমি কী..”
ওপাশের কথা পুরোটা না শুনেই নীরব বলল,
-” তুমি ইচ্ছেকে কিছু বলে ম্যানেজ করো।”
এক ঝলক ফোনের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে পুনরায় বলল,
-” আই উইল বি লেট টু কাম।”