মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২২
মুসতারিন মুসাররাত
-” ভাগ্য ভালো যে আপনার গলায় ছু’রি চালাইনি।”
নীরব ঠোঁটে প্রশ্রয়মাখা হাসি টেনে বলল,
-” তাই নাকি?”
প্রত্যাশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাব নিয়ে বলল
-” ইয়েস, মিস্টার।”
নীরব একহাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
-” বাহ! ভুল বুঝেও যে তুমি এতটা জেলাস আর ক্ষুব্ধ হবে সেটা আমার কাছে কল্পনাতীত ছিলো। কারন এখন অবধি কোনো কিছুতেই তোমার মধ্যে সিরিয়াসনেস দেখিনি। যাক একটা ব্যাপারে তবুও তো দেখলাম। আর যাইহোক না কেনো তুমি বরের ব্যাপারে সিরিয়াস!”
প্রত্যাশা একগাল হেসে সায় দিয়ে বলল,
-” হুম। অবশ্যই সিরিয়াস।”
পরমূহুর্তেই প্রত্যাশা নির্বিকার ভাবে বলতে লাগল,
-” আসলে বিয়ের আগে আপনার বুকশেলফের একটা বইয়ের ভাঁজে ছবি পেয়েছিলাম। তারপর সেদিন একেএকে সবটা এমনভাবে মিলে গেল, ভুল বোঝাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই হয়তো একটু বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলেছি। তবে এরজন্য আমি মোটেই ক্ষমাপ্রার্থী নই।”
শেষ কথাটা বলে দুই হাত এক করে আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুজে দুলতে দুলতে দাঁত কেলিয়ে হাসল প্রত্যাশা। নীরব প্রত্যুত্তরে নরম স্বরে বলল,
-” বুকশেলফে নীবিড়ের বইও আছে। ছবিটা নীবিড়ের বইয়ে ছিলো। এ ব্যাপারে তুমি রং, তোমার রাগ-ক্ষোভ রং, মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং সবটা অযুক্তিক আমি সেটা বলছি না। বিষয়টা কখনো এরকম হবে, সে ব্যাপারে আমার ধারনা ছিলো না। তবে তোমার উচিত ছিলো অ্যাট ফার্স্ট আমার সাথে কথা বলা। তোমার সন্দেহ হয়েছে ডিরেক্ট আমাকে বলা। দু’জনে কথা বললে ক্লিয়ার হওয়া যেতো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” ওই মূহুর্তে আপনার সাথে স্বাভাবিক কথা বলার মুডে আমি ছিলাম না। শুধু রাগ আর রাগ….তরতর করে বাড়ছিলোই। আর সবসময় চোখের সামনে ওই কাপল পিকটাই ভাসছিলো। তাও আবার একহাতে জড়িয়ে ধরা, গালে গাল ছুঁয়ে থাকা। মাথায় আমার দ’পদপ আ’গুন জ্বলছিল…..।”
হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে প্রত্যাশা। ওর বলার ভঙি দেখে নীরব মুচকি হাসল। হঠাৎ আলতো গলায় প্রশ্ন করল,
-” ভালোবাসো আমাকে?”
আকস্মিক প্রশ্নে প্রত্যাশা হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখটা হা হয়ে যায় ওর। নিমিষেই কথার খেই যেন হারিয়ে ফেলল। নিশ্চুপ রইল। নীরব আরও কাছে এগিয়ে গাঢ় স্বরে ফের শুধাল,
-” বলছো না যে কিছুই? তাহলে বুঝি এখনো আমার প্রতি কোনো ফিলিংস জন্মায়নি তোমার? তারপরও এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলে?”
প্রত্যাশা ভ্রু ট্রু কুঁচকে ফেলল। গমগমে স্বরে বলল,
-” ফিলিংস-টিলিংস জন্মেছে কিনা জানি না! তবে শুধু এতটুকু জানি…..”
কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে থামল প্রত্যাশা। নীরব ডান ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বোঝাল—‘কী’ প্রত্যাশা ঠোঁটে হাসি টেনে হুট করে দু’হাতে নীরবের গলা জড়িয়ে ধরল। অধিকার বোধ নিয়ে আবেগি স্বরে বলল,
-” আমি আমার বরের একমাত্র আদরের বউ হয়ে থাকতে চাই। তার লাইফের শুরু থেকে শেষ অবধি একমাত্র মেহবুবা আমিই হতে চাই। আমিই থাকতে চাই। এটা আমার স্যাটিসফিকেশন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
নীরবের শার্টের বোতাম খোলা থাকায় বাতাসে শার্টের দু’পাশ উড়ছে। নীরব আলগোছে প্রত্যাশার একটা হাত ধরে ওর বুকের বা পাশে রাখল। প্রত্যাশা কিঞ্চিৎ চমকাল। হাতটা বোধহয় একটু কাঁপলও। নীরব আলতো স্বরে বলল,
-” অনুভব করে বলো তো এখানে নীরবের মেহবুবা হিসেবে কাকে রেখেছে?”
প্রত্যাশা মুচকি হেসে বুকের উপর মাথাটা রাখল। চোখদুটো বুঁজে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল। কয়েক মূহুর্ত পর কোমল স্বরে বলল,
-” আপনার অর্ধাঙ্গিনী। নীরব মাহবুবের একমাত্র মেহবুবা….. শুধু আর শুধু মাত্র ইয়ানূর প্রত্যাশা।”
সারাদিনের ক্লান্তি, যেটুকু বিষন্নতা ছিলো সব যেন নিমিষেই উবে যায়। সেখানে নীরবের মুখে স্নিগ্ধ সতেজ হাসি বিরাজ করছে। নীরব আলতোভাবে প্রত্যাশার মাথায় একটা হাত রাখল। অন্যহাতটা প্রত্যাশার পিঠ পেঁচিয়ে ধরা।
কয়েক মূহুর্ত দু’জনের মাঝে নীরবতা চলল। নীরবতা ভেঙে প্রত্যাশা হঠাৎ মাথাটা উঁচিয়ে নীরবের মুখের দিকে তাকাল। ঘনঘন বলল,
-” আপনি জানেন ভুল বোঝার পর আমার কী কী মনে হয়েছিল?”
নীরব বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ কাটল। এই মেয়ে সুন্দর একটা মূহুর্তকে কখনো একটু লং করতে দিবে না। আবার শুরু করল। নীরবের থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রত্যাশা ওর মতো করে বলতে লাগল,
-” ভেবেছিলাম; ইয়া আল্লাহ! প্রীতি জিন্টার মতো এত সুন্দরী বউ রেখে আমাকে বিয়ে করার কারণ কী?”
প্রত্যাশার সব কথা শোনার ধৈর্য্য নীরবের হলো না। ও তাড়া দিয়ে বলল,
-” বাইরে থেকে এসেছি এখনো ফ্রেশ হইনি। শাওয়ার নিতে হবে।”
এই বলে নীরব শার্টটা খুলে বিছানার উপর রাখল। প্রত্যাশা ধপ করে বিছানার একপাশে বসল। পা দুটো দুলাতে দুলাতে বলল,
-” তবে যাই বলুন না কেনো….আপনার টুইন ভাইয়ের বউ প্রীতি জিন্টা কিন্তু হেব্বি দেখতে! দেখে বোঝাই যায় না অত বড় একটা বাচ্চার মা। আচ্ছা ওই প্রেম প্রীতির কেসটা কী একটু খুলে বলুন তো? না মানে কেমন কেমন করে দেমাগ নিয়ে কথা বলল। তারপর মা___”
নীরব বিরক্ত চোখে চাইতেই প্রত্যাশার কথা থেমে যায়। পরপর গাম্ভীর্য ভরা কণ্ঠে বলল,
-” প্রত্যাশা, প্রীতি তোমার সিনিয়র। শুধু বয়সেই সিনিয়র নয়, সম্পর্কের দিক থেকেও। কারো সামনে হোক কিংবা আড়ালে কখনোই অসম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত নয়। সম্মান অর্জনের আগে সম্মান দিতে হয়। তুমি যেভাবে প্রীতিকে সম্বোধন করছো, তা আমার কাছে শোভনীয় লাগছে না। তুমি আমার স্ত্রী, আমার জীবনসঙ্গী, আমি চাই তুমি নিজের আচরণে এমন উচ্চতা রাখো যেন কেউ তোমার বিচার না করতে পারে। বরং অনুকরণ করতে চায়।”
-” স্যরি! আর হবে না। আসলে ওনার নামটাই ওরকম তো….তাই বলেছি।”
হঠাৎ প্রত্যাশার কিছু স্মরণ হতেই বিজ্ঞের মতোন চোখ করে তাকিয়ে বলল,
-” আচ্ছা, উনি সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার বড় হলে তো আপনারও বড় হওয়ার কথা। কারন আপনাকে দিয়েই আমার পরিচয়। তাহলে আপুকে যেমন ভাবি বলেন, আপনি করে সম্বোধন করেন। বাট উনাকে তো নাম ধরে তারপর তুমি করেই বলতে শুনলাম।”
নীরব তাকাতেই প্রত্যাশা মাথা চুলকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করল। ফের বলল,
-” জাস্ট ফর কিউরিওসিটি থেকে বলে ফেলেছি।”
-” প্রীতি আমার ব্যাচমেট ছিলো। আগে থেকেই তুমি করে বলায় অভ্যস্ত থাকায়।”
-” ওও… তারমানে উনি আপনার ফ্রেন্ড ছিলো। আচ্ছা যা বুঝলাম ওই ডক্টরটা আপনার বেয়াই হয়। তবে সেদিন আপনাদের দু’জনের কথা শুনে কেমন যেনো একে অপরের শত্রু মনে হলো। তা আপনাদের দুই বেয়াইয়ের রেষারেষিটা কী নিয়ে? জমিজমি নিয়ে বিবাদের মতন একে অপরের চক্ষুশূল হলেন কীভাবে?”
নীরব উত্তর না দিয়ে ত্যাড়া সুরে বলল,
-” এত কিছুর মাঝেও ডক্টরকে ঠিক খেয়াল করেছো!”
-” না করার কী আছে? একটা জলজ্যান্ত মানুষকে চোখের সামনে দেখলাম…..খেয়াল করব না?”
-” কিছু কিছু জিনিস খেয়াল না করাই বেটার।”
প্রত্যাশা না বুঝে আড়ালে ঠোঁট উল্টাল। নীরব টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকবে। প্রত্যাশা হঠাৎ বলল,
-” তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিবেন। রাত হয়ে গিয়েছে। আমি বাসায় যাব।”
নীরব নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
-” বাসায় যাবে….যাও। বারণ করছে কে?”
-” কীহ?”
বলে প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে ফেলল। উঠে নীরবের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” কীভাবে যাবো?”
-” যেভাবে এসেছো।”
-” মাথা খারাপ আপনার? এসেছি একা।”
-” সেজন্য তো একাই যাবে। আসার আগে আমাকে তো জানাওনি।”
-” এখন রাত হয়ে গিয়েছে। দিন হলে সমস্যা ছিলো না। এমনিতেই টেনশনে আছি, আম্মু বকবে। আপু তো আসার পরই আম্মুকে জানিয়েছে, আমি এখানে।”
নীরব কপট রাগের ছাপ মুখে টেনে নেয়। বলল গম্ভীর স্বরে,
-” কিছুটা ব’কু’নি তুমি ডিজার্ভ করো।”
প্রত্যাশা একহাতে কপাল চাপড়ে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! আপনি এটা বলতে পারলেন! আমার মতো মাসুম বাচ্চা বকুনি খাবে, আপনি এটা চাইছেন। আপনার একমাত্র পিচ্চি বউটা বকুনি খাবে, আপনার একটুও খারাপ লাগবে না। আপনার দিল এত কঠোর হলো কবে থেকে?”
ফাজলামির সুরে বলে ঠোঁট টিপে হাসে প্রত্যাশা। নীরব উত্তরে বলল,
-” আমার দেওয়া গিফট ওভাবে ছুঁড়ে ফেলার জন্য, কড়া করে কিছু বলতে গিয়েও বউয়ের ইন্নোসেন্ট ফেস, ভিতু দু’টো চোখ দেখে বলতে পারিনি। তাই ভাবছি, শাশুড়ি মার তরফ থেকে হলেও একটু-আকটু বকুনি খেলে তোমার মাথার উল্টাপাল্টা রিয়্যাকশন করা ভূত দূর হবে।”
চেইনটার কথা মনে হতেই শুকনো ঢোক গিলল প্রত্যাশা। ওটা তো কখনই সবার অগোচরে ব্যাগে তুলে রেখেছে। প্রত্যাশা সহসাই বলল,
-” এটুকুর জন্য অবশ্য স্যরি।”
নীরব প্রসঙ্গ বদলিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
-” স্কুটি আনোনি?”
প্রত্যাশা ঘাড় নাড়িয়ে না বোঝায়। নীরব বলল,
-” সেদিনের ন্যায় আবার ওটাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিতে আরেকজনের হেল্প লাগতো। এদিক দিয়ে কিছুটা সময় বাঁচল।”
গাল দু’টো অল্প স্বল্প ফুলিয়ে প্রত্যাশা বলল,
-” সেদিনের পর থেকে স্কুটি চালাইনি। আম্মু বারণ করেছে। আর আপনি নিজেও তো সেদিন কত কিছু বললেন, তাই আমিও আর জোর করিনি আম্মুকে।”
নীরব বলল,
-” স্কুটি চালানো খারাপ বা আমার অপছন্দ এমন কিছু আমি বলিনি, প্রত্যাশা। বরং আমার মনেহয়, এটা একধরনের উপকারী যান। সুবিধাজনকও বটে। একটা কথা শুনে রাখ; কারো পছন্দ-অপছন্দের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া আমার নীতির মধ্যে পড়ে না। তুমি কী করবে, কীভাবে করবে? সেসব সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। আমি সেদিন যেটা বলেছিলাম আজও একই কথাই বলছি; স্বাধীনতা থাকবে, তবে সেটা যেন মিসইউজ না হয়।”
রাত্রি একটা পার। চারপাশ নিঃস্তব্ধ। দূর থেকে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। ঠোঁটের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে মিজান সাহেব ছাদে উঠলেন। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দেখে হঠাৎ থমকে গেলেন। কাছে এগিয়ে দেখলেন বেঞ্চিতে নীরব। হাত দু’টো ছড়িয়ে, মুখটা আকাশের দিকে করে চোখ বুজে আছে। নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখতেই নীরব ঝট করে চোখ মেলে তাকাল।
-” ঘুমাওনি? এত রাতে ছাদে!”
নীরব মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে বলল,
-” ঘুমাতে যাইনি। যাব। কিছু কাজ শেষে মাইন্ড রিফ্রেশ করতে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মাখতে ছাদে এলাম।”
আলতো করে ভাতিজার কাঁধ চাপড়ে বললেন,
-” গুড…গুড।”
স্ত্রীর থেকে লুকিয়ে ছাদে এসে সিগারেটে সুখটান দেওয়া মিজান সাহেবের নিত্যদিনের রুটিন। সেটা কম-বেশি বাড়ির সবাই জানে। হঠাৎ নীরব প্রশ্ন করে উঠল,
-” আচ্ছা চাচ্চু একটা কথা সত্যি করে বলবে?”
পাশে বসে কপালে কৌতুহলের খাঁজ ফেলে বললেন,
-” কী?”
-” আমার মনেহয় কিছুটা হলেও তোমার জানার কথা। বাবা আমাকে বলতে চাইছেন না। প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। আমার ধারণা বাবা হয়তো বিব্রত বোধ করছেন। আর আমি জেনেশুনে বাবাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে চাই না। তাই জোর করে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তোমাকে বলছি, মায়ের প্রীতি বা প্রীতির পরিবার নিয়ে একচুয়েলি প্রব্লেমটা কী? তুমি কী কিছু জানো?”
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছোট্ট অংশটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষলেন। পরপর হতাশার শ্বাস ফেলে অতীতে ডুব দিলেন।
নীহারিকা বেগমের জীবনটা পুষ্প সজ্জিত ছিলো না। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে আশ্রয় হয় ফুপুর বাড়িতে। ফুপুর শাশুড়ি নীহারিকার প্রতি সহৃদয় ছিলেন না। উঠতে বসতে খোটা তো শুনতেই হতো, আবার ভারি ভারি কাজ করতে হতো। তবুও ফুপুর সস্নেহে জীবন চলছিলো দুই ভাইবোনের। তিক্ত ছোটবেলা থেকেই নীহারিকার গ্রামের চেয়ারম্যান খান বাড়ির প্রতি তীব্র ঘৃ*ণা ছিলো। নিরপরাধ বাবা-মা সেদিন ভোট দিতে গিয়ে লা’শ হয়ে ফেরে। শুধু মাত্র ওই চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলের জন্য। প্রতিপক্ষের সাথে ভোট কেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়। সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে বাবাকে ফের ক্ষমতায় রাখতে সংঘর্ষ বাধায়। সেদিন নীরিহ কয়েকজনের মধ্যে নীহারিকার বাবা-মা ও খান বাড়ির ছেলের হাতে গু”লি বিদ্ধ হয়। পাখির মতো ছটফট করতে করতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় উনারা।
নীহারিকা আর ওনার থেকে কয়েক বছরের বড় ভাই ফুপুর আশ্রয়ে বড় হতে থাকে। ফুপুর শহুরে পড়ুয়া সুদর্শন বড় ছেলের প্রতি নীহারিকার একটা দুর্বলতা ছিলো। তবে কখনো প্রকাশ করা হয়নি। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো একসময় খুশির বাঁধ নামে নীহারিকার। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শখের মানুষটির সাথে বিয়ের কথা শুনে।
ফুপু তার মাস্টার্স পড়ুয়া ছেলেকে ডেকে ভাইঝির সাথে বিয়ের কথা বলতেই মাহবুব সাহেব সাথে সাথেই নাকচ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পড়ুয়া একটা মেয়েকে পছন্দ করেন। দু’জন-দু’জনকে পছন্দ করেন। তাই ওনার পক্ষে নীহারিকাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মাহবুব সাহেবের মা মমতা যখন শুনলেন ওই মেয়ে খান বাড়ির মেয়ে; তক্ষুনিই তীব্র বিরোধিতা করে বসলেন। একমাত্র বোন-বোন জামাইয়ের খু*নি বাড়ির মেয়েকে কিছুতেই ছেলের বউ করবেন না। চেয়ারম্যানরা মানুষ ভালো না। খু*ন খারাবি, হানাহানি, কালো ব্যবসা সবকিছুতেই গ্রামে শীর্ষে। লোকজন আ’তং’কে থাকে তাদের ভ’য়ে।
সেই বাড়ির মেয়ে যতই জ্ঞানী হোক না কেনো, র*ক্ত তো একই।
খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে অনশন করেন মমতা। মাহবুব সাহেবকে এক প্রকার জোর করেই নীহারিকার সাথে বিয়ে দেন। এসব অবশ্য নীহারিকার আড়ালে হয়। বিয়ের পরে জানলেন মাহবুব সাহেবের মনে আছে অন্য রমণী।
বিয়ের পর সাংসারিক জীবন সোনায় সোহাগা ছিলো না নীহারিকার। দু’জনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে ঢের সময় লাগে। যখন একটু একটু করে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছিল, তখনই হঠাৎ করে আরেক ঝামেলার উদয় হলো। হঠাৎ করে ওনার ভাই বিয়ে করে আনলেন। তাও আবার খান বাড়ির সেই মেয়েকে। ওই মেয়ে মাহবুব সাহেবকে ঠক, প্রতারক হিসেবে ভাবত। প্রেম করে অন্য কাউকে বিয়ে করায় এক প্রকার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে নীহারিকার ভাইকে কোনো এক জাদুবলে বশ করে বিয়ে করে আসে। ওনার মূলত উদ্দেশ্য ছিলো, মাহবুব সাহেবের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করা। এক বাড়িতে থাকতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে থাকে। যা ওই মেয়ে ইচ্ছে করে সৃষ্টি করতে থাকে। বুঝদার মাহবুব সাহেব সকল ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চাইছিলেন, তবুও ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নিত্যনতুন ঝামেলা করত।
সময় থেমে থাকে না। এভাবে চলছিলো। হঠাৎ এক অম্যাবস্যার রাত্রি যেন কাল রাত্রি হয়ে এল। আকস্মিক ইলেকট্রনিক শর্ট সার্কিট থেকে পুরো বাড়ি আ*গুনে পুড়ে ছাই হয়। সাথে দগ্ধ হয় তিনটা প্রাণ। শয্যাশায়ী মমতা, নীহারিকার ভাই আর খান বাড়ির মেয়ে। আয়ু থাকায়ই হোক আর ভাগ্য করে হলেও বেঁচে যান নীহারিকা আর মাহবুব সাহেব। নিভান তখন তিন মাসের ছোট্ট বাচ্চা। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় সেদিন সন্ধ্যায়ই সদরে ছেলেকে নিয়ে ভর্তি হোন। আর এটাই হয় ভুল বোঝাবুঝির শুরু।
খানরা ভাবেন মাহবুব সাহেব পরিকল্পিতভাবে তাদের মেয়েকে সরাতে আ*গুন লাগিয়েছে। না হলে আজ হাসপাতালে গেল, আর আজই আ*গু*ন লাগল। নিজে, বউ ছেলে দিব্যি সুস্থ থাকল। মাহবুব সাহেবের নামে মিথ্যা মামলা দেয় খানরা। মাহবুব সাহেবের জেল হয়। নীহারিকা কোলের ছেলেকে নিয়ে স্বামীকে ছাড়াতে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন। খানদের পা পর্যন্ত ধরেছেন। তবুও মন গলেনি। ওই মেয়ের জমজ বোন ছিলো তানিয়া। মূলত তার কথায়ই কেস করা হয় মাহবুব সাহেবের নামে। নীহারিকা কেঁদে বুক ভাসিয়ে তানিয়ার কাছে অনুনয় করে বলেছে। তবুও একটুও মন গলেনি। সেদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নীহারিকাকে ও বাড়ি থেকে তানিয়া বের করে দিয়েছে।
মিজান সাহেব মেসে থেকে কলেজে পড়তেন। ভাবি আর ভাইপোর পাশে দাঁড়ান। জমিজমা বর্গা দিয়ে, তারপর টিউশনি করে পড়াশোনা করছেন আর ভাইয়ের আমানত রক্ষা করেছেন। বছর তিনেক জেলে থাকার পর নীহারিকা আর মিজান সাহেবের মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রামের জমি বিক্রি করে শহরের বড় উকিল ধরেন। তারপর একপর্যায়ে মাহবুব সাহেব ছাড়া পান। গ্রামের পোড়া ভিটেয় আর কখনো যাওয়া হয়নি। শিক্ষিত হওয়ায় মাহবুব সাহেব সহজেই একটা বেসরকারি ফার্মে ভালো পদে চাকরি পান। এরপর থেকে একটু একটু করে নীহারিকার দুইহাতে গড়ে ওঠে শখের সংসারটা।
নীবিড় যখন প্রীতিকে বিয়ের কথা বলে নীহারিকা রাজিও ছিলেন। কিন্তু প্রীতিকে দেখতে গিয়ে অভিশপ্ত সেই মুখটা দেখে নীহারিকার পুরোনো বিষাদ, যাতনার কথা স্মরণ হয়ে তীব্র ঘৃ”ণা নিয়ে সেখান থেকেই ফিরে আসে। কিচ্ছুতেই ওই মেয়েকে বাড়ির বউ করবেন না বলে ঘোষণা দেন।
নীহারিকার ভ’য় হয়। আবার বুঝি ওই খান বাড়ির মেয়ে কোনো ষ’ড়যন্ত্র করতেই মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছে। ওই মেয়েকে ঘরে তুললে আবার তার কাগজের মতোন সাজানো, গুছানো সংসারটা হারিয়ে যাবে। এক সন্তানকে কাছ ছাড়া করলেও, বাকি দু’জনকে নিয়ে নীহারিকা আজও কঠোর হয়ে আছেন। সন্তানদের কাছে অতীতের কথা বলেননি বাবার প্রতি খারাপ ধারণা জন্মাতে পারে ভেবে। অতীতের কষ্ট স্মরণ করতে চান না, কাউকে জানাতেও চান না।
দু-তিন দিন পর….
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত এগারোটার ঘর ছাড়িয়েছে। প্রীতি ডিনারের জন্য সার্থককে ডাকতে আসে। দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাকল,
-” অ্যাই ভাইয়া? ব্রো… শুনছো?”
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবল— ‘গেছেটা কই?’ পরপর আলগোছে দরজা ঠেলে রুমে চোখ বুলিয়ে সার্থককে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনিতে যায় প্রীতি। আধো অন্ধকারে ব্যালকনির দোলনায় একহাত আর পা দুটো ফ্লোরে ছড়িয়ে বসে সার্থক। হাতে হাইকেন ব্র্যান্ডের বিয়ারের ক্যান [অ্যালকোহল ফ্রি]। চোখবুঁজে ঢকঢক করে গিলল। প্রীতি নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে একহাত রাখল।
-” চলো ডিনার করবে।”
-” মা ডিনার করেছে? ইচ্ছে ঘুমিয়েছে?”
-” মনা ঘুমিয়ে দিয়েছে ইচ্ছেকে। সবাই খেয়েছে। শুধু আমি আর তুমিই বাকি।”
আরেক ঢোক গালে নিয়ে গলাধঃকরণ করে বলল সার্থক,
-” সন্ধ্যার পর ক্লিনিকে একটা মিটিং ছিলো ওখান থেকে নাস্তা করেছি। আমার ক্ষুধা নেই। প্রীতি তুই খেয়ে নে।”
প্রীতি ভাইয়ের পাশে বসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” তার বিরহে দেবদাস বনে যাচ্ছ নাকি? আমি বলি, এত চুপচাপ না থেকে, বিরহে কাতর না হয়ে কিছু একটা করো।”
সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-” আমার প্রিয় জিনিস, যেটা হাতের নাগালের মধ্যে আছে, তবুও আমি আমার করছি না। তোর মনেহয়, এরকম কখনো করব আমি?”
প্রীতি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
-” বুঝলাম। তাহলে এতটা নির্লিপ্ত, নির্বিকার কেনো আছো। হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারনই বা কী?”
একটু থেমে পরমূহুর্তেই প্রীতি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
-” ব্রো, তুমি কী নীরবকে নিয়ে ভ’য় পাচ্ছো? নীরবের সাথে পারবে না ভেবেই কোনো স্কোপ নেওয়ার সাহস পাচ্ছো না।”
-” নীরবকে নিয়ে ভ’য় সার্থকের নেই। এখানে প্রথম সমস্যা মেয়েটা ম্যারিড। দ্বিতীয় সমস্যা জোর করে কী সবকিছু পাওয়া যায়?”
-” বাহ্! ব্রো চমৎকার! তুমি তো দেখছি খুব মহান। তবে আমি আবার এতটা মহান নই। যদি কারো জন্য আমার জীবন কষ্টে ভিজে যায়। আমি নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকব না। আমি এমন ঝড় তুলব, যাতে তার সুখের ছাদটাই উড়ে যায়। আমার চোখের এক বিন্দু জল, হারাম করবে তার চোখের ঘুম।”
সার্থকের কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। ও তীক্ষ্ণ চোখে প্রীতির দিকে তাকাতেই প্রীতি সশব্দে হো হো করে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল,
-” আরে… আরে এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো? তোমাকে ইন্সপায়ার করছি। মনটাকে এভাবে শক্তপোক্ত করে গড়ে নাও। আর একটা কথা মনে রাখবে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার লাভ এন্ড ওয়ার।”
এরমধ্যে পাশে নামানো সার্থকের ফোনে ইংরেজি ফন্টে অদ্রিকা আহসান নামে সেভ করা নামটা জ্বলজ্বল করে উঠল। সার্থক রিসিভ করে কথা বলতে থাকল। অদ্রিকা কথা বলার এক পর্যায়ে বলল,
-” অ্যাই শোন একচুয়েলি যেজন্য তোকে ডিস্টার্ব করা। আমরা নেক্সট উইকে কুয়াকাটা যাচ্ছি। কোনো প্রকার না শুনতে চাই না, তুইও আমাদের সাথে যাবি। যাবি মানে যাবিই। আমি, মৌমিতা আর ভাইয়া মিলে প্ল্যান করেছি।”
-” স্যরি ইয়ার আমার হবে না। পেশেন্ট আছে, ব্যস্ত__”
কথা কেড়ে নিয়ে ওপাশ থেকে বলল,
-” ডক্টর তুই একা নোস, আমাদেরও পেশেন্ট আছে। আমরা সময় বের করতে পারলে, তোর এত প্রব্লেম কোথায়?”
-” অদ্রি আমাকে বাদ রাখ, প্লিজ।”
-” নো নেভার। তোর কোনো কথা শুনছি না আজ।”
আরো কিছু কথা বলার পর জিভ কে’টে বলে উঠল,
-” এইরে এত কথার মাঝে আন্টি, প্রীতি ওদের কথাই তো জিজ্ঞেস করতে বেমালুম ভুলে বসেছি। প্রীতি কোথায় থাকে এখন?”
-” প্রীতি আমাদের কাছেই থাকে। ধর প্রীতির সাথে কথা বল।”
পুরোনো বন্ধু, তারপর ভালো বন্ডিং হওয়ায় আগে থেকেই দুই পরিবারের সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রীতির দিকে ফোন বাড়িয়ে সার্থক বলল,
-” অদ্রি।”
প্রীতি হাসিমুখে কথা বলতে থাকে। কুশলাদি বিনিময় করার পর এক ফাঁকে প্রীতি বলল,
-” অদ্রি আপি বলো তো তোমার বিয়ের ইনভ্যাটিশন কবে পাচ্ছি?”
-” সেটা আর ইহজনমে হচ্ছে না।”
-” ও মাই গড! ও মাই গড….কেনো?”
-” কারন তোমার ভাইয়ের মতো হ্যান্ডসাম ডক্টর পাচ্ছি না।”
বলেই হেসে উঠল অদ্রিকা। প্রীতিও হাসল। বলল,
-” তুমি যে কিউট তোমার জন্য ডক্টর পাত্রের অভাব নাকি! এতএত ডক্টরের ভিড়ে চুজ করে নাও কোনো এক সহকর্মী ডক্টরকে। ঠিক মন মতো পেয়ে যাবে, দেখো অভাব পড়বে না।”
-” এতএত ভিড়ের মাঝেও মন মতো একজনের কিন্তু বড্ড অভাব থাকে।”
প্রীতির মুখের হাসি নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। মুখটা ম্লান হয়ে যায়। হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,
-” হুম। একদম ঠিক বলেছো। আই নো।”
অদ্রিকা জোর করে প্রীতিকেও ওদের সাথে ট্যুরে জয়েন করতে বলে। অদ্রিকার এত করে বলা ফেলতে না পেরে প্রীতি রাজি হয়। অদ্রিকা বলল,
-” থ্যাংক ইয়্যু প্রীতি। তুমি রাজি না হলে তোমার কাঠখোট্টা ভাইকে রাজি করানো যেতো না। এবার একটু নিশ্চিন্ত হলাম সেও জয়েন হবে আমাদের জার্নিতে। আর ইচ্ছেকে সরাসরি দেখা হয়নি, এবার দেখতে….”
প্রীতি কথার মাঝেই বলল,
-” ইচ্ছেকে রেখে যাব। ইচ্ছে জার্নি করতে পারে না। ওর ভমিটিং এর প্রবলেম হয়। তারপর ইচ্ছেকে নিয়ে ঘুরাঘুরি হবে না।”
প্রত্যাশা আর ওর বন্ধুরা কলেজ প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে আছে। গাছভরা টকটকে লাল ফুল। বাতাসে হালকা খসখসে শব্দ হচ্ছে। আশেপাশে আরো ছেলে-মেয়েরা বসে পিকনিক নিয়ে প্ল্যানিং করছে। ওদের এইসএসসি ব্যাচ কলেজ থেকে কুয়াকাটা যাচ্ছে। প্রত্যাশার মুখটা কিঞ্চিৎ ভার। মন মরা কণ্ঠে বলল,
-” ধূর ভাল্লাগে না। হ্যাপি যাচ্ছে কনফার্ম। কোয়েলও যাবে। আমি যাব কী না শিওর বলতে পারছি না। আব্বু আম্মু অতদূর একলা ছাড়বে কী না সন্দেহ!”
হ্যাপি বলল,
-” স্যারেরা তো বললই মেয়েদের সাথে গার্ডিয়ান এলাউ করা হবে। মেয়েদেরকে একলা ছাড়তে ইনসিকিওর গার্ডিয়ানেরা সাথে যেতে পারে।”
প্রত্যাশা মুখে ঘোর অন্ধকার নামিয়ে বলল,
-” তোর যেনো প্রফেসর মামা আছে সমস্যা নেই। আলাদা করে গার্ডিয়ান লাগবে না। আন্টি আংকেল নিশ্চিন্তে যেতে দিবে। আমাকে একা ছাড়তে রাজি হবে না। তারপর আব্বুর অফিস থেকে ছুটিও পাওয়া যাবে না। আম্মুর তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”
পাশ থেকে কোয়েল বলল,
-” সমস্যা কী? তোর বরকে সাথে নিবি।”
-” ধ্যাত! বরকে নিয়ে পিকনিকে গেলে সব মজা মাটি। স্যার-ম্যাম তারপর সবার মাঝে বরের লেজ ধরে শো পিসের মতো থাকতে হবে। একটুও মজা করা যাবে না। সবাই চেয়ে চেয়ে থাকবে, কেমন লজ্জা লজ্জা লাগবে না।”
ওরা সবকটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। প্রত্যাশা চোখ গরম করে তাকাতেই হাসি থামাল। রোহান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ফুঁ দিয়ে মুখে পুড়তে পুড়তে বলল,
-” আরে পিকনিক টিকনিক বাদ দে। আগে বল তোর বিয়ের দাওয়াত কবে পাচ্ছি। কব্জি ডুবিয়ে খাব জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” পরীক্ষা নামক বাঁশ খাওয়ার পর। বোর্ড এক্সামের পর বিয়ের অনুষ্ঠান।”
ওরা এটাওটা মুখে দিচ্ছে আর প্ল্যান করছে কে কী ড্রেস পড়বে। প্রত্যাশার মুখ বেজার দেখে হ্যাপি বলল,
-” দোস্ত মন খারাপ করিস না। আন্টি-আংকেলকে রাজি করার দায়িত্ব আমার। আমি আম্মুকে বলব আন্টিকে কনভিন্স করতে। মামার কথা বললে আন্টি নিশ্চয় দ্বিমত করবে না। একটা দিনেরই তো ব্যাপার। রাতে রওনা হবে, ভোরে গিয়ে সূর্যোদয় দেখে, সারাদিন ঘুরা ঘুরি করে সন্ধ্যায় ফেরা।”
নাহিদ মুখে চরম বিরক্তির রেষ নিয়ে বলে উঠল,
-” ধূর! শা’লার যবর এক কাহিনী পায়ছে। সূর্যোদয় দেখতে নাকি এতো গুলা টাকা খরচ করে সেই কুয়ার মধ্যে যাওয়া লাগবে।”
হ্যাপি নাক সিটকে বলল,
-” কুয়ার মধ্যে কী হ্যা? ওটা জায়গার নাম। আর নামটা হলো, কুয়াকাটা।”
নাহিদ মাছি তাড়ানোর মতো বলল,
-” তা ওখানে গিয়ে কাজটা কী? সবাই ফ্রিতে কুয়া কাটে নাকি?”
আবার এক দফা হাসির রোল পড়ল। হ্যাপি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সিরিয়াস গলায় বলল,
-” গর্দভ একটা! ওটা পর্যটক স্পট। বললাম না সূর্যোদয় দেখে তারপর___”
হ্যাপির মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় নাহিদ,
-” এত বড় দামড়ি হয়েছিস সূর্যোদয় কখনো দেখিসনি। ভোরে ঘর থেকে উঠানে নামলেই সূর্য ওঠা দেখা যায়। এরজন্য বেহুদা কচকচে টাকা খরচ করে অতদূর যেতে হয়।”
কোয়েল ওদের দু’টোর ঝগড়া থামাতে বলল,
-” আরে আ’জাইরা ঝগড়া বাদ দে তো তোরা। যা বলা হচ্ছিল সেদিকে ফোকাস কর।”
কোয়েল বাদাম মুখে দিল। চিবুতে চিবুতে প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলল,
-” আন্টিকে না হয় রাজি করানো গেল। বাট ওর বরেরও তো পারমিশনের ব্যাপার-স্যাপার আছে। বউকে একা ছাড়বে?”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২১
প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
-” উনাকে নিয়ে টেনশন নেই। এতটুকু স্বাধীনতা দিবে। উনি নিজেই বলে জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ওনার নীতি বিরুদ্ধ। আশা রাখি উনি যাবার পারমিশন নিশ্চয় দিবে।”