মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৫
মুসতারিন মুসাররাত
রোদ চশমটা কপালের উপর তুলল প্রীতি। সরু চাহনিতে কয়েক মূহুর্ত চেয়ে থেকে পরপর ঠোঁটে কোমল হাসি টেনে বলল,
-” কী আশ্চর্য! তুমি এখানে?”
প্রীতির মুখে হাসি, কোমল স্বর, সৌজন্যতা প্রত্যাশাকে বিস্মিত করল। মুখের দু’টো ভালো কথাই সেদিনের প্রীতি আর আজকের প্রীতির মাঝে বিস্তর ফারাক তৈরি করে মূহুর্তেই। প্রত্যাশা মুখে সরল হাসি নিয়ে বলল,
-” কলেজ থেকে ট্যুরে এসেছি। আপনি এখানে? ইচ্ছে…. ইচ্ছে কোথায়?”
-” আমি ভাইয়া আর ওর ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছি। লং জার্নি, এতটা দূর তাই ইচ্ছেকে আনা হয়নি। ইচ্ছে বাসায়।”
প্রত্যাশার মুখের হাসি মিলিয়ে আসলো। ভাবল– বাপরে মেয়েকে রেখে ঘুরতে এসেছে। ভাবা যায়! প্রত্যাশার ভাবনার ছন্দপতন ঘটল মেয়েলি মিষ্টি কোমল কণ্ঠে,
-” প্রীতি, কী হলো দাঁড়িয়ে গেলে যে? তুমি চিনো ওনাকে?”
অদ্রিকা ক’কদম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল। প্রীতি মিষ্টি হেসে প্রত্যাশাকে বলল,
-” চলো মিট করিয়ে দিই।”
পরপর অদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” অদ্রি আপি ও প্রত্যাশা। আমার বড় জা’য়ের বোন।”
প্রত্যাশার ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। বিড়বিড় করল— আরে বড় জা’য়ের বোন না বলে সরাসরি ছোট জা বললেই তো হয়। কাছের সম্পর্ক রেখে দূরেরটা টানছে কেনো? আ’জ’ব তো!
প্রত্যাশার মুখের দিকে চেয়ে ভেঙে ভেঙে বলল প্রীতি,
-” ওর অবশ্য, আরেকটা পরিচয় আছে। সেটা হলো, এএসপি নীরবের বউ।”
প্রত্যাশা অবচেতনে আওড়ায় — যাক বাবা এবারে তাও ঠিক আছে। ওনার মনে আছে দেখছি। আমি ভেবেছিলাম ভুলে-টুলে গেছে মেবি।
অদ্রিকা মিষ্টি হেসে সৌজন্যতা করল। কথার ফাঁকে যখন শুনল ওদের এইচএসসি ব্যাচ এসেছে…আচমকা অদ্রিকা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” তুমি এবার এইচএসসি দিবে? তুমি দেখতেও তো আরো বাচ্চা আদুরে টাইপের। ওহ্ মাই গড! নীরব একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
প্রত্যাশার রাগ হলো। মনেমনে ঝাড়ল– যেভাবে বলল মনে হচ্ছে আমি যেনো ফিডার খাওয়া বাচ্চা। কোনদিক দিয়ে আমাকে বাচ্চা লাগছে? আমার কয়েকটা ফ্রেন্ডেরও তো বিয়েথা হয়েছে। দুয়েকজন তো আবার বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করেও ফেলেছে। সেখানে এএসপি সাহেব আমাকে বিয়ে করলে তোদের কিসের এত সমস্যা!
প্রীতি বলল,
-” নীরবের বাবা মানে আমার শ্বশুরের থেকে প্রেশার ছিলো। তাই বোধহয় নীরব বিয়েতে দ্বিমত করেনি। শ্বশুর মশাই বয়স্ক তারপর অসুস্থ। বুঝতেই পারছো আপু।”
অদ্রিকা মাথা নেড়ে বলল,
-” ও আই সী।”
-” নীরব আপনাকে বলেছে এটা?” কথাটা জিভের ডগায় এলেও প্রত্যাশা কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিল। নীরব তো আবার তার ভাবি প্লাস পেয়ারের ফ্রেন্ডকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে বলেছে। তাই মনে জমা প্রশ্ন ঠেসে রাখল এক কোণে। প্রত্যাশা মুখটা ভার করে বলল,
-” আমি আসছি। আমার ফ্রেন্ডরা খুঁজছে হয়তো।”
প্রীতি তৎক্ষণাৎ বলল,
-” তুমি আমাদের সাথে থাকতে পারো। আমরাও তো ঘুরতেই এসেছি। একসাথেই না হয় ঘুরলাম-ফিরলাম।”
প্রত্যাশা ইতস্তত স্বরে বলল,
-” আসলে আমি ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছি। ওদের ছাড়া ঘুরলে…ওরা মন খারাপ করবে। আর আপনারা আমার বড়। বড়দের ভেতর ছোট আমিটাকে বড্ড বেমানান লাগবে। যাইহোক আপু, বলার জন্য ধন্যবাদ।”
-” আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তোমার সাথে যখন দেখা হলো এভাবে খালি মুখে কী করে ছাড়ি। তুমি পর নাকি আমার! এক সাথে না থাকলেও সম্পর্ক তো আর ধুয়ে যায় না। আর ছোট জা তো ছোট বোনেরই মতো। তাই জা নয় বড় আপু হিসেবে বলছি, আজকের লাঞ্চটা আমাদের সাথে করবে কেমন?”
মিষ্টি করে এতবার বলছে। প্রত্যাশা কীভাবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না! দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে জড়তা নিয়ে বলল,
-” আ-আসলে আপু, সবার সাথে এসেছি। এভাবে একলা আপনাদের সাথে স্যার-ম্যামেরা এলাউ করবে না। একলা ছাড়বে না।”
প্রীতি ভাবুক ভঙিমায় বলল,
-” ওহহো। ঠিক আছে। তবে বিকেলে তো এদিকে থাকবেই। তখন দেখা করো।”
প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে বলল,
-” আচ্ছা।”
সার্থক কোণা চোখে একপল তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অদ্রিকা ঠিকই বলেছে মেয়েটাকে কেমন আদুরে আদুরে লাগে। সার্থক ভেবে পায় না এইটুকু একটা মেয়ের মধ্যে কী এমন দেখেছিলো? যে এতটা মায়ায় ফেসেছে!
এইযে চোখদুটো ফিরিয়ে নিলেও মনটা কী আদৌও ফিরাতে পেরেছে? উঁহু পারেনি। আর পারেনি বলেই প্রত্যাশার সরল মুখটা চোখের তারায় ভাসতে লাগল। সার্থক নিজেই নিজেকে ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” অন্যের শহরে যার বসবাস, তাকে নিয়ে ভাবাটা শুধুই দোষ নয়, বোকামি, অন্যায়।”
কিন্তু মন সে তো নীতিবাক্য সহজে মানতে নারাজ। কেমন উস্কিয়ে দিল। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে গোপনে দু’টো ছবিও তুলল। ছবিটার দিকে তাকাতেই ব্যথাতুর হাসি ঠোঁটের কোণে ঠাঁই নেয় সার্থকের।
হালকা মেঘলা আকাশ। সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস। প্রত্যাশা, কোয়েল আর হ্যাপি খালি পায়ে হাঁটছে কুয়াকাটার ভেজা বালির ওপর দিয়ে। প্রত্যাশার পরনে কোমড় পর্যন্ত কফি কালারের টপস, আর নিচে স্কার্টের মতোন। লং বেল্টের ছোট ব্যাগটা কাঁধের একসাইড দিয়ে আড়াআড়ি করে কোমড়ের সাথে লেগে আছে। তিনজনের হাতে পেয়ারা। খাচ্ছে আর গল্প করছে। ওই তো অদূরে ছাতার মতো ছাউনীর তলায় গোল করে সাজানো কাঠের আর ক্যানভাসের তৈরি চেয়ারে বসে আছে প্রীতিরা তিনজন। বালির ওপরে রাখা আরামদায়ক চেয়ারগুলোয় শরীর হেলিয়ে, পা সামনে ছড়িয়ে ওরা কেউ ফোন স্ক্রল করছে, কেউ চুপচাপ সমুদ্রের ঢেউ দেখছে। মাঝখানে একটা নিচু টেবিল তাতে রাখা কোমল পানীয়।
প্রত্যাশার সাথে আবার দেখা হয়েছে। প্রীতি বসতে বললেও প্রত্যাশা এড়িয়ে যায়। আর প্রত্যাশারা একটু পরেই *****ঘুরতে যাবে। তারপর সূর্যাস্ত দেখে সন্ধ্যার পরপরই রওনা হবে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকায় ওদের একটু মন খারাপ। মেঘটা কে’টে গেলেই ভালো হয়।
হ্যাপির চোখ সেই তখন থেকে আঁটকে আছে কালো সানগ্লাস চোখে, কালো টিশার্ট আর অফ হোয়াইট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া ডক্টরের দিকে। হ্যাপি ওদিকে চেয়েই প্রত্যাশার কানের পাশে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” ও মাই আল্লাহ! ডক্টরটা এত হ্যান্ডসাম! এ রোগিকে সুস্থ করবে কী? এর কাছে গেলে তো রুগির হার্টবিট বেড়ে অ্যাটাক-ফ্যাটাকও হয়ে যেতে পারে। দেখেছিস তোর ডক্টর বেয়াইকে কী হ্যান্ডসাম! পুরাই চকলেট বয়।”
প্রত্যাশা ঝারি মে”রে বলল,
-” সর তো তুই…. ডক্টর-ফক্টর কে দেখার টাইম নেই আমার। আমার এএসপি বর কম হ্যান্ডসাম নাকি!”
এই বলে পেয়ারায় কামুড় দিতে গিয়ে বেখেয়াল বশত নিম্নোষ্ঠের ডান পাশে কামুড় লাগে। প্রত্যাশা তক্ষুনি মৃদু আর্তনাদ করে উঠল,
-” আয়াআআআ। মা গো লাগল।”
হ্যাপি, কোয়েল একসাথে শুধাল,
-” কী হলো?”
প্রত্যাশা আঙুল দিয়ে কামুড় লাগা স্থানটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল,
-” কামুড় লেগেছে।”
কোয়েল হাসতে হাসতে বলল,
-” আহারেএএ। এইটুকুতেই এমন আর্তনাদ করলি। তাও আবার নিজের লাগা কামুড়েই। বর যখন আদর করতে গিয়ে কামুড় দেয় তখন…তখন কী করিস শুনি?”
হ্যাপি ঠোঁট চেপে হাসছে। কোয়েলের বাহুতে চা’প’ড় মে’রে বলল প্রত্যাশা,
-” দিবো ক টা ফা’জিল একটা। আমার বর রাক্ষস নাকি যে কামুড়-টামুড় দিবে।”
-” আরে মাথা মোটা। এটা সে কামুড় নয় রে। বরের দেওয়া কামুড়কে বলে লাভ বাইট।”
প্রত্যাশা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
-” বাদ দে তো। আমাদের ওরকম কোয়ালিটি টাইম কাটানো হয়নি। তাই আই হেভ নো আইডিয়া। আর আমার বর ওমন রাক্ষস-খোক্ষসের মতো কিছু করবে না, তার কেয়ারিংয়ের মতো তার আদরও হবে সফটলি।”
শেষের কথাগুলো বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে প্রত্যাশা। কোয়েল জোরালো গলায় বলল,
-” কী বললি কোনো আইডিয়া নেই? আনবিলিভেবল।”
কিছুপল পর….হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ প্রত্যাশার পায়ের নিচে ধারালো কিছু একটা পড়তেই ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এল। অস্ফুটে আর্তনাদ বেরোল। সাথে সাথে বাম পা-টা তুলতেই দেখল। গলগল করে র*ক্ত ঝরছে। পায়ের তলায় ভাঙা কাঁচ জাতীয় কিছু পড়েছিল। বাজেভাবে পা-টা কেটেছে। প্রত্যাশা চোখমুখ বন্ধ করে বলে—‘উফ্! মা গো খুব জ্ব’ল’ছে’।
হ্যাপি, কোয়েল ওদের চেঁচামেচি শুনে প্রীতিরা এগিয়ে যায়। পরপর প্রত্যাশাকে এখানে আপাতত বসতে বলে। প্রত্যাশা কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। সার্থক মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে পায়ের উপর ঢালল। পায়ের কাঁদা, বালু ময়লা ধুয়ে গেল। পানির সাথে র*ক্তও এক হয়ে বেয়ে পরছে এখনো। পকেট থেকে রোমাল বের করে শক্ত করে বাঁধতে লাগল। প্রত্যাশা ব্যথায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে হ্যাপির একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল। প্রত্যাশার ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্রিকার মায়া হলো। কণ্ঠে মায়া জড়িয়ে বলল,
-” ইশশ্! অনেকটা তো কেটেছে। ক্ষত হয়ে গিয়েছে। কী করে হলো? তুমি খেয়াল করোনি?”
প্রত্যাশা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে। সার্থক ব্যস্ত হয়ে বলল,
-” পায়ে ভর দিয়ে এসেছে চাপ পড়েছে, তারপর বালুও ঢুকেছে। এন্টিসেপটিক দরকার। ড্রেসিং করা জরুরী।”
প্রীতি দুই হাত বুকে গুঁজে কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। অদ্রিকা মনে পড়ার মতো করে বলল,
-” অ্যাই সার্থ আমার কাছে তো ফার্স্ট এইড বক্স আছে। আমি অলওয়েজ ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিস রাখি। আমার ট্রাভেল ব্যাগের সাইডেই আছে।”
-” অদ্রি তাহলে টাইম ওয়েস্ট না করে জলদি আন।”
প্রীতি আগ বাড়িয়ে বলল,
-” আমি আনছি। তোমরা একটু ওয়েট করো। আমি আনতে যাচ্ছি।”
প্রীতি অনেকক্ষণ হলো গিয়েছে এখনো ফেরার নাম নেই। সার্থক একহাতে কপাল ডলে বিরক্ত হয়ে বলল,
-” প্রীতি করছে কী? এতক্ষণ লাগে নাকি।”
অদ্রিকা বলল,
-” প্রীতি বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না। আমি তো বললাম ব্যাগের সাইডেই আছে। ওয়েট, আমি কল করে দেখছি।”
হ্যাপি, কোয়েলের চোখেমুখে উদ্বেগ চিন্তার ছাপ। প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকালেই হ্যাপির বুক ভার হয়ে আসছে। প্রত্যাশার একটা হাত মুঠোর ভেতর নিয়ে হ্যাপি বলল,
-” প্রত্যাশা ব্যথা করছে? কষ্ট হচ্ছে?”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” হুম।”
খানিকটা দেরি করেই প্রীতি আসল। সার্থক রাগি স্বরে বলল,
-” আমি তো ভেবেছিলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস? এত দেরি হলো কেনো?”
প্রীতি ভাইয়ের ঝাড়ি গায়ে মাখল না। বলল স্বাভাবিক ভাবে,
-” খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
সার্থক ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তারপর পেইন কিলার খুঁজে না পেয়ে বলল,
-” এখানে তো পেইন কিলার নেই দেখছি। আচ্ছা আশেপাশে ফার্মেসি আছে। আমি প্রয়োজনীয় মেডিসিন আনছি।”
ওদিকে হ্যাপি, কোয়েল বলল,
-” আমাদের ফ্রেন্ডরা ওইযে একেএকে বেরোচ্ছে। আমাদের এখন যেতে হবে। নইলে বাস আবার রওনা দিয়ে দিবে।”
সার্থক বলল,
-” পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। আমি জলদি মেডিসিন এনে দিচ্ছি।”
এরমধ্যে প্রীতি সবার জন্য ডাব অর্ডার করল। প্রীতির হাতে থাকা ডাবটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল,
-” ইশশ্! খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়। একটু দেখে চলবে না। কতটা কে’টে গেল। মন খারাপ করো না। মেডিসিন নিলে ব্যথা সেরে যাবে। এই নাও ডাব খাও।”
প্রত্যাশা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মুখটা ভারভার করেই হাতে নিল। ডাব কা’টা ছেলেটা বাকি সবাইকেও একএক করে দিল। প্রত্যাশা কাঠিতে ঠোঁট ছুঁয়ে এক ঢোক গিলতেই নাকমুখ সিঁটকিয়ে ফেলে। কেমন একটা উটকো গন্ধের মতো বেস্বাদ লাগল। প্রত্যাশা বলল,
-” সমুদ্রের পানি যেমন লবনাক্ত, তারপর শুনেছি এই অঞ্চলের খাবার পানিও কেমন একটা গন্ধযুক্ত। আমাদের ওইদিকের মতো মিঠা নয়। খেতে আলাদা একটা গন্ধ নাকে আসে। কিন্তু ডাবের পানিও যে আলাদা হয় এটা কখনো শুনিনি।”
অদ্রিকা বলল,
-” হোয়াট? ডাবের পনি আলাদা মানে?”
প্রত্যাশা বলল,
-” না মানে আমাদের ওইদিকের মতো অতো টেস্টি নয়।”
অদ্রিকা বলল,
-” আমার কাছে তো ভালোই লাগছে।”
হ্যাপি, কোয়েল একসাথে বলে উঠল,
-” ওর কথা, বাদ দিন তো আপু।”
কিছুক্ষণ পরই প্রত্যাশার মাথাটা ভারি ভারি হয়ে আসলো। মাথার মধ্যে ঝিম ধরে আসছে। হ্যাপি, কোয়েল বাস ছাড়ার কথা বলে তাড়া দেয়। প্রত্যাশা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নিশ্চুপ থাকে। হ্যাপি হাত ধরে টেনে বলল,
-” অ্যাই প্রত্যাশা চল। আর দেরি হলে স্যারেরা ব’ক’বে কিন্তু। ঘোরার জন্য যে টাইম দিয়েছিল তা অভার। ওইযে ওরা দ্যাখ যাচ্ছে। আমাদেরও বাসের কাছে যেতে হবে। জলদি চল। এমন ঝিম ধরে আছিস ক্যান?”
প্রত্যাশা অগোছালো ভাবে বলল,
-” আ-আমি ঘুমাব। ঘুরতে যাব….যাব না।”
কোয়েল বিরক্ত হয়ে ঝারি মা’রল,
-” ফাজলামি করছিস নাকি? সবকিছু দেখার জন্য আসা। আর বলছিস যাবি না। না গেলি তুই। আমরা চললাম।”
প্রত্যাশা কোনো সারা দিল না। হ্যাপি বলল,
-” আরে থাম। ওর কিছু হয়নি তো। এভাবে কথা বলছে কেনো?”
-” জানিসই তো সবসময় ও ফাজলামো করে। এখনো করছে।”
প্রীতি ফুরফুরে মেজাজে আছে। বলল নরম সুরে,
-” আচ্ছা ও যেতে চাচ্ছে না। ও থাক আমাদের সাথে। তোমরা ঘুরে আসো। এমনিতেও ওর পায়ে আঘাত পেয়েছে। ঘুরতে গিয়েও তো হাঁটতে পারবে না।”
কোয়েল সায় দিলো। হ্যাপি রাজি হচ্ছে না। মামা শুনলে বকবে। তারপর একা ফেলে হ্যাপি যাবে না। কোয়েল হ্যাপির হাত ধরে টেনে একপাশ এনে বোঝাল,
-” আরে ওনারা তো প্রত্যাশার আত্মীয়। ওদের কাছে থাকলে সমস্যা কী গা”ধা? প্রত্যাশা ঘুরতে পারবে না কাটা পা নিয়ে। তারচেয়ে ওনাদের সাথে বিশ্রাম নিক। আমরা তো হোটেলে ফিরব। তখন প্রত্যাশাকে ফোন দিলে ওনারাই পৌঁছে দিবে।”
হ্যাপি রাজি নয়। তবুও কোয়েল জোর করে নিজের মতো বলল,
-” আচ্ছা আপু, তাহলে আমরা যখন সন্ধ্যায় ফিরব তখন ফোন দিবো প্রত্যাশাকে। আপনারা পৌঁছে দিবেন ওকে। ও তো কাঁটা পা নিয়ে ঘুরতেও পারবে না। আর ও দুপুরে এলার্জির ওষুধ খেয়েছে। তাই হয়তো ওর ঘুম পাচ্ছে।”
-” নিশ্চয় পৌঁছে দিবো। তোমরা চিন্তা করো না। ঘুরো, ইনজয় করো।”
প্রীতির ব্যবহারে ওরা দু’টো খুব মুগ্ধ হলো। প্রত্যাশাটার কত ভালো কপাল। কত ভালো বর, শ্বশুর শাশুড়িও শুনেছে ভালো। এখন তো জা-কেও সামনে দেখল। কত অমায়িক কথাবার্তায়!
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই প্রত্যাশা বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠল। অদ্রিকা চমকে উঠল। অদ্রিকা চিন্তিত বদনে জিজ্ঞেস করল,
-” তোমার ব্যথা করছে? কী সমস্যা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
আবার প্রত্যাশা কেমন হেসে ফেলল। ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো বলল,
-” আম্মুর কাছে যাব।”
হাবিজাবি উল্টা পাল্টা বলতে থাকল প্রত্যাশা। অদ্রিকা ভ’য় পেয়ে গেল। তবে প্রীতি নির্লিপ্ত। হঠাৎ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। প্রত্যাশাকে নিয়ে হোটেলে ফিরতে ওদের দুটোর জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। হোটেলের গেট পেরিয়ে যেতেই প্রত্যাশা নিজের হাত এক ঝাঁকিতে ছাড়িয়ে নিল। আকাশের দিকে মুখ করে দুই হাত উঁচিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার মতো বাড়াল। হাত দু’টো নাড়িয়ে বেসুরো গলায় বলল,
-” টিপটিপ বারছা পানি।”
হাত দু’টো উঁচুতে তোলায় টপস উপরের দিকে উঠে যায়। যার ফলে পেটের কিছু অংশ দেখা যায়। ওদিকে কত মানুষ আসা যাওয়া করছে। অদ্রিকা দ্রুত টেনে নামিয়ে দিল। প্রত্যাশা ঝট করে দুইহাত প্রীতির কাঁধের উপর রাখল। প্রীতি বিরক্তিতে হাত দু’টো ঝারি মে’রে সরাল। প্রীতির গাল দুটো শক্ত করে ধরে টিপে দিয়ে প্রত্যাশা। হাসতে হাসতে বলল,
-” পানি……আগ লাগা।”
প্রীতির যা রাগ হলো না। কী জ্বা”লা। এরমধ্যে সার্থক বৃষ্টি দেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো প্রীতি আর অদ্রিকার খোঁজে। এখানে এহেন দৃশ্য দেখে বিস্ময় নিয়ে বলল,
-” কী হয়েছে ওর?”
প্রীতি প্রত্যাশার কাছ থেকে ফাঁকে আসল। সার্থকের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” ও দিনদুপুরে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে বোধহয়। দ্যাখ না ব্রো। কেমন করছে। দু’জন মিলে ওকে রুমে আনতে হিমশিম খাচ্ছি।”
অদ্রিকা বলল,
-” যদিও আমি ভূত টূতে বিশ্বাসী নই। তবে ওর হঠাৎ পরিবর্তনে আমার কেমন জানি ভ’য় হচ্ছে।”
প্রত্যাশা স্কার্টটা একটু উঁচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” কতো পানি।”
অথচ নিচে পাকা জায়গা। যেখানে শুধু বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা পরে আছে। সার্থক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রত্যাশাকে পরখ করল। বলল সন্দিহান কণ্ঠে,
-” ও কী কোনো ভাবে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছে। ওর সিমটম দেখে আমার তো তাই মনে হচ্ছে।”
প্রীতি সহসাই বলে উঠল,
-” ব্রো খেতে পারে। ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে আসছে। কত বাজে ছেলেপেলে থাকে না। ওদের থেকে খেয়েছিল বোধহয়।”
পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ ভিজে লাল হয়ে উঠেছে। সার্থক দেখে বলল,
-” পায়ে প্রেশার পরে ব্লিডিং হচ্ছে তো।”
অদ্রিকা কোনো রকমে প্রত্যাশার হাত টেনে ধরে আনল। ওরা পাশাপাশি দু’টো রুম নিয়েছে। এক রুমে সার্থক আরেক রুমে ওরা দু’জন। আরো দু’জন ফ্রেন্ডের আসার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সমস্যার জন্য আসার আগ মুহূর্তে ক্যান্সেল করে। প্রত্যাশার পায়ের দিকে তাকিয়ে সার্থক বলল,
-” প্রীতি জলদি দরজা খোল। প্রত্যাশার পা দিয়ে…”
প্রীতি ব্যাগ হাতড়ে বলল,
-” ভাইয়া চাবি পাচ্ছি না তো।”
সার্থক দাঁত কটমট করে তাকাল। পাশ দিয়ে মানুষ যাচ্ছে আর সার্কাস দেখার মতো প্রত্যাশার দিকে তাকাচ্ছে। উল্টাপাল্টা কীসব বলছে, হাসছে। উপায়ান্তর না দেখে সার্থকের রুমেই প্রত্যাশাকে আনল। প্রীতি বলল,
-” ভাইয়া আমার রুমের চাবি তো পাচ্ছি না। সমস্যা হয়ে গেল। ওদের কাছে তো এক্সট্রা চাবি থাকেই। রিসিপশনে গেলাম জানাতে। অদ্রি আপি তুমিও চলো আমার সাথে।”
প্রীতি করিডোর দিয়ে হাঁটছিলো আর ওর ভেতরটা দা’উদাউ করে জ্ব’ল’ছিল। একটা কদম ফেলছিলো আর ভাবছিলো— ত্রিশ বছর আগে মাহবুব সিদ্দিকী যেমন একটা মেয়ের অনুভূতি, ভালোবাসাকে দাম দেয়নি। বরং প্রতারণা করেছে, ঠকিয়েছে। ঠিক ত্রিশ বছর পরেও সিদ্দিকী পরিবারের আরেকজন একটা মেয়ের অনুভূতিকে এক আনাও দাম দেয়নি। ভরা ক্যাম্পাসে প্রত্যাখ্যান করে ফ্রেন্ডদের সাথে হাসিঠাট্টা করেছিলো না। সেদিন মেয়েটির কতটা কষ্ট হয়েছিলো তা কেবল সেইই জানে। খান বংশের মেয়েরা কতটা মা’রা’ত্মক তা আবার জানবে সিদ্দিকী পরিবার। খানরা নিজের নাক কে’টে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে।
প্রত্যাশা বেডে পা ঝুলিয়ে বসে। সার্থক ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে আবার ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। পরপর বসা থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়। রুম থেকে বেরিয়ে যাবে মনঃস্থির করে পা বাড়ায় সার্থক। এমন সময় ওর হাতে টান পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে প্রত্যাশা ওর হাত ধরে আছে। প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে বুঁজে আসা চোখের পাতা টেনে তুলার চেষ্টা করে বলল,
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৪
-” এএসপি সাহেব, তুমি খুউউউব ভালো। আমার কত্ত কেয়ার করো।”
সার্থক ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। প্রত্যাশার চুলগুলো হালকা ভিজে আছে। মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আছে। যা প্রত্যাশাকে আবেদনময়ী করে তুলেছে।