মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪২
মুসতারিন মুসাররাত
ভোরের হালকা কোমল আলো সফেদ পর্দার ফাঁকফোকর গলে রুমে ঢুকছে। আধো অন্ধকার ঘরটায় এক অদ্ভুত শান্তি মিশে আছে। শরীরে গত রাতের ক্লান্তি মিশে থাকা এক মিষ্টি ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে প্রত্যাশার। নতুন ভোরের শুরুতেই একটু অন্যরকম অনুভূতি হলো। দূর্বল শরীর, হালকা পেইন, চোখেমুখে একরাশ লজ্জার আভা নিয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় প্রত্যাশা। এরমধ্যে হঠাৎ করেই কানে এলো দরজায় টোকা পড়ার শব্দ।
প্রত্যাশা সহসাই উঠে বসে হাতড়ে শাড়ি খুঁজল। ব্লাউজের হুকগুলো এলোমেলো করে জোড়া লাগানো। শাড়ি না পেয়ে ত্রস্ত কাঁথা টেনে বুকের উপর তুলতেই চোখে পড়ল— নীরবের ফর্সা উন্মুক্ত পিঠ। সাথে সাথেই লজ্জায় জিভ কা’টল মেয়েটা। নীরব উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে বিভোরে। পরমূহুর্তেই নজর যায়, শাড়ির কিছু অংশ নীরবের গায়ের তলা হয়ে বেড ছাড়িয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আলতো করে নীরবের পিঠে হাত রাখল। মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে ডাকল,
-” শুনুন?”
নীরব এক চুলও নড়ল না, পূর্বের মতন নিশ্চিন্তে আরামসে বান্দা ঘুমুচ্ছেন। প্রত্যাশা এবারে একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল,
-” এই উঠুন না, কেউ এসেছে বোধহয়। শাড়িটা আপনার গায়ের তলায়।”
নীরব এবারে কিঞ্চিৎ নড়ল। প্রত্যাশা দাঁত চেপে বলল,
-” নীরব? কী ঘুম রে বাবা!”
নীরব পাশ ফিরল। কপালে বিরক্তির ছাপ নিয়ে ঘুমুঘুমু স্বরে বলল,
-” সকাল সকাল কী শুরু করেছো বলো তো?”
-” শাড়ি নিবো। আপনার গায়ের তলায় পড়ে আছে।”
চোখদুটো বুজেই এক ঝটকায় প্রত্যাশার হাত চেপে ধরে টেনে নেয় বিছানায়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে নীরব,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” ঘুমাও তো। এক্ষুনি উঠতে হবে না।”
প্রত্যাশা হৈচৈ করে উঠল,
-” আরে ছাড়ুন তো, বললাম কেউ নক করল মনে হলো।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে নীরব। ঘড়িতে সময় দেখে, সাতটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। বলল,
-” বাড়ির সবার মাথা গেছে নাকি! আজকের দিনে সাতটা বাজার আগেই নক করতে আসবে? কেউ আসেনি। তোমার মনের ভুল।”
বলেই লতার মতো প্যাঁচিয়ে ধরে নীরব। প্রত্যাশার দম আঁটকে আসার উপক্রম। হাঁসফাঁস করে ওঠে,
-” মা গো, চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি তো। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে, ছাড়ুন। দূরে সরুন।”
নীরব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-” দূরে সরা ইম্পসিবল।”
দু সেকেন্ড থেমে পরমূহুর্তেই বলল,
-” বরকে ঠিকঠাক সামলানোর জন্য হলেও, তোমার বেশিবেশি খেয়েদেয়ে একটু মোটা হওয়া জরুরী। এতটা থিন যে আমাকে খুব বেশি সতর্ক থাকতে হয়।”
প্রত্যাশা ভেংচি কে”টে ফের মোচড়ামুচড়ি আরম্ভ করে।
বাড়ির গিন্নিরা কিচেনে ব্যস্ত। এরমধ্যে এক প্রতিবেশী প্রৌঢ় হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন সাতসকালে। কণ্ঠে এক সমুদ্দুর অসহায়ত্ব মিশিয়ে লোকটা বললেন,
-” ভাবী নীরবকে একটু ডেকে দিন। কী যে ঝামেলায় আছি ভাবী, বলে বোঝানো যাবে না। সারারাত চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক হয়নি। এখন কী করব ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।”
নীহারিকা উত্তরে বলেন,
-” নীরব এখনো উঠেনি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। নীরব বেরোলেই কথা বলবেন।”
লোকটা নাছোড়বান্দার মতো বলে উঠলেন,
-” ভাবী একটু ডেকে দিন না।”
নীহারিকা বেশ বিরক্ত হলো। ছেলেটা চাকরি পাওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষের একটু কিছু হতে না হতেই ছুটে আসে। যত দায়দায়িত্ব মনেহয় ওনার ছেলের। নিজেরা অকাম-কুকাম করে আসবে, সেখানে তার ছেলের কাছে সাহায্যের জন্য ধন্নাধরবে। নীহারিকা বিরক্তির ছাঁট কপালে নিয়েই বললেন,
-” আপনি বসুন। চা খান।”
অতঃপর পরীকে চা নাস্তা দিতে বলে কিচেনে ঢোকেন নীহারিকা।
শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে নীলার। তলপেটে ব্যথা হচ্ছে। চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। দু’দিন আগেই পিরিয়ড ভালো হয়েছে। তারপর রাত থেকে হঠাৎ আবার ব্লিডিং হচ্ছে। বিছানায় দুইহাত ঠেস দিয়ে কপাল কুঁচকে নীলা বসে। নিভান তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল,
-” নীলাশা বেশি সমস্যা হচ্ছে?”
-” পেইন বাড়ছে।”
-” আমি পরীকে বলছি খাবার রুমে দিতে। অল্প করে হলেও কিছু মুখে দিয়ে পেইন কিলার খেয়ে নাও। আজ যেহেতু বাড়িতে অনুষ্ঠান। অনেক ব্যস্ত থাকব। তাই এ বেলায় ডক্টরের কাছে না গিয়ে বিকেলে যাব। এটুকু সময় খুব কী বেশি সমস্যা হবে?”
নীলা দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
-” না, কিছু হবে না। মেডিসিন নিলে ব্যথা চলে যাবে। তবে হঠাৎ এরকম হওয়ার জন্য মেজাজ খা’রা’প হচ্ছে। বাড়িতে লোকজন, অনুষ্ঠান তারমধ্যে এসবে যা রাগ হচ্ছে না। এমনিতেই প্রত্যেকটা মাসের শেষে আমি কতটা আশা নিয়ে থাকি। বাট বারবার হতাশ হই।”
-” ডোন্ট ওয়ারি। আমরা তো এমনিতেই এই মাসে ডক্টরের সাথে পরামর্শ করতে যেতাম। যাইহোক সেটা না হয় আজই গেলাম। আই হোপ, দ্রুতই আমরা দুজন থেকে তিনজন হবো।”
শেষের কথাশুনে লাজে ফর্সা গাল রঙিন হয়ে ওঠে নীলার। ব্যথায় কপাল কুঁচকে আসলেও অদৃশ্য এক টুকরো ভালোলাগায় ভেতরটা শিহরিত হয়ে উঠল।
লোকটা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন। আনিশাকে দেখে কাছে ডাকলেন। আদুরে গলায় বললেন,
-” নীরবকে একটু ডেকে দাও তো পিচ্চি।”
আনিশা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,
-” ছোটো দাদান?”
লোকটা অত বুঝলেন না। তবে চট করে বললেন,
-” এ বাড়ির পুলিশ ছেলেটাকে তো চিনো?”
-” হুঁ।”
-” হ্যাঁ, হ্যাঁ তার কথাই বলছি। একটু ডাকো তো জলদি।”
আনিশা গিয়ে ছোট হাতে দু’বার থা’প্পড় দিয়েছিল দরজায়। এসে নাকমুখ কুঁচকে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
-” ছোটো দাদান, নতুন ভাবী ঘুমুচ্ছে। দরজা খোলে না।”
-” একটু বলো একজন দেখা করতে এসেছে।”
-” আমি আর যেতে পারব না। ছোটো দাদান ব’ক’বে।”
আনিশা আর কথা কানে না তুলে ইচ্ছের কাছে যায়।
এদিকে চা নাস্তা শেষ হয়েছে, তবুও নীরবের ঘুম থেকে উঠার নাম নেই। লোকটা আবার ডেকে উঠলেন,
-” ভাবী একটু ডেকে দিন না।”
প্রীতি ফ্রেশ হয়ে কিচেনে যায়। মুখে হাসি টেনে কোমল গলায় বলল,
-” মা, আমি কফি বানাই?”
নীহারিকা একপল দেখে ফের হাতের কাজ করতে করতে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক বললেন। ওই লোক আবার বলে উঠতেই পরী খাক করে উঠল,
-” কী গরুর মতো হাম্বা হাম্বা শুরু করছে। একে তো সাত সকালে আইছে। আবার আওনের পর থেইকাই ডাক আসা গরুর মতো ছটফট করতিছে। ওর বউরে না ধইরা ওরে ধরনের দরকার আছিলো।”
নীহারিকা মোটামোটা চোখে তাকাতেই জিভ কা’টে পরী। নীহারিকা গম্ভীর মুখে বললেন,
-” যা নীরবকে ডেকে দে।”
পরী হাত দু’টো ধুয়ে কোমরে গুঁজে রাখা ওড়নার আঁচল ছাড়িয়ে মুছতে মুছতে গেল। দরজার এপারে দাঁড়িয়েই শুকনো ঢোক গিলে নেয়। কোনো রকমে জোরেজোরে বলে,
-” ছোডো ভাইজান, কালাম চাচা আপনার লগে দেখা করতে আইছে।”
বলেই ভো দৌড় দেয় পরী। মানুষের জন্য সে আর ধ’ম’ক টমক খেতে পারবে না। এখন নীরব শুনলে শুনছে না শুনলে নাই।
শাওয়ার নিয়ে এ্যশ কালারের ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট গায়ে চেপে বেরোয় নীরব। ভেজা চুলে আঙুল ঢুকিয়ে ব্রাশ করতে করতে ড্রয়িংরুমে আসছিল। প্রীতি কফির ফ্লাস্কটা ডায়নিংয়ে রাখতে আসতে গিয়ে নীরবের সামনাসামনি পরে। একবার চোখ তুলে নীরবের দিকে তাকায়। মাথাভর্তি ভেজা চুল, কপালের উপর থাকা চুল থেকে দুএক ফোঁটা পানি ঝরছিল। তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় প্রীতি। নীরব ওর মতো গিয়ে সোফায় বসল। আর বসতেই ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন,
-” বাবা বড় বিপদে পড়ে আইছি। শালার ছোট ছেলে এক অকাম করে ফেলেছে। হারামজাদা ছেলে পাশের এলাকার একটা মাইয়ারে নিয়া পালাইছে। মাইয়ার বাপ কেস করছে। এখন রাতে পুলিশ এসে তোমার চাচিরে ধরে নিয়া গেছে। আমার নামেও কেস হয়েছে। তবে আমি বড় বেয়াই বাড়ি দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম দেখে অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গিয়েছি। তোমার চাচি থানায়। মহিলা মানুষ, কও তো কেমনডা লাগে? অকাম করে রাখছে হারামজাদাটা আর গুষ্টি শুদ্ধ এখন ভুগছি। রাতেই তোমার কাছে কল করছি। সারারাতে কতবার তোমার নম্বরে যে কল দিছি হিসাব নাইকা। বারবার ফোন দিয়া বন্ধ পাইছি।”
নীরব খুকখুক করে কেশে উঠল। মনেমনে ভাবল— ভাগ্যিস ফোনটা বন্ধ রেখেছিলাম। ভদ্রলোক এক নাগাড়ে বলতে লাগলেন,
-” তোমাদের আর কারো নম্বর ছিলো না। অবশেষে এই সক্কাল সক্কাল ছুটে আসা লাগলো। বাবা, তোমার চাচিরে জেলে চালান না করে দেয়। দেখা করতে যাব, গেলে আমাকেও আটকিয়ে দিবে। সেই ভয়ে দেখাও করতে পারছি না। বাবা একটা কিছু করো। যেভাবেই হোক তোমার চাচিরে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো।”
সবটা শুনে গম্ভীর স্বরে বলল নীরব,
-” মেয়েটা অনার্সে পড়ে, মানে এডাল্ট। সে যদি নিজের ইচ্ছায় যায়, জবানবন্দি দিলেই কেস হালকা হবে। আপনাদের দিক থেকে চাপ কমে যাবে। আগে আপনার ছেলের সাথে বসে কথা বলুন। তাদেরকে আসতে বলুন।
না এসে ভ’য় পেয়ে পালিয়ে থাকলে উল্টা আপনাদের সমস্যাই বাড়বে।”
-” হারামজাদা কোনে ঘাপটি মাই’রা আছে। ওর মারে জেলে নিয়েছে, ওর একটুও চিন্তা হচ্ছে না। ও শালার ছাওয়াল আছে, আসলে পড়েই মাইয়ার বাপ মাইয়ারে জোর করে নিয়ে যাবে। এমন হারামজাদা জন্ম দিছি।”
প্রত্যাশা চুল আচড়াচ্ছিল। নীরব একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলল,
-” পরীকে বলেছি তোমার নাস্তা রুমে দিয়ে যেতে। এখানে পেইন কিলার আছে খেয়ে নিবে।”
প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে বলে,
-” আচ্ছা।”
-” ভেতরে*** আছে। মনে করে কিন্তু খেয়ে নিবে। খেয়াল ছিলো না, আরো আগে দরকার ছিলো। ইমার্জেন্সি খাবে কিন্তু।”
-” আচ্ছা রাখুন। খেয়ে নিবো।”
ওয়্যারড্রবের উপর রাখতে রাখতে নীরব আবারো সতর্ক করে প্রত্যাশাকে। প্রত্যাশা চিরুনি নামিয়ে কিছুটা বিরক্ত গলায় বলে,
-” আচ্ছা বাবা মনে থাকবে। মনে করে খাবো। এবার হয়েছে?”
এরমধ্যে নীলার গলা এল। দরজার ওপাশ থেকে নক করতেই প্রত্যাশা ঝটপট বলল,
-” আরে আপু দাড়িয়ে কেনো? ভেতরে আসো।”
দুইবোনকে স্পেস দিতে নীরব রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রত্যাশার পরনে লাল রঙের শাড়ি। নীলা দেখে বলল,
-” এখন তো ভালোই একাএকা শাড়ি পড়া শিখে গিয়েছিস।”
প্রত্যাশা একটু খুশিই হলো। আহ্লাদী সুরে বলল,
-” শাড়িটাতে আমাকে ভালো লাগছে?”
নীলা ছোট করে বলল,
-” হুম।”
তারপর একটা ছোট্ট প্যাকেট থেকে লাল বক্স বের করল। প্রত্যাশার হাতে দিয়ে বলল,
-” তোর বিয়ের গিফট আমাদের তরফ থেকে। কখনো আবার বলে বসবি, বোন-দুলাভাই বিয়েতে কিছু দেয়নি। আর ও হ্যাঁ, একটা শাড়িও আছে। দুপুরে শাড়িটা দিবো, ওটা বউভাতের গিফট। এবার দেখ দুলজোড়া পছন্দ হয়েছে কী না।”
একজোড়া স্বর্ণের ঝুমকা। প্রত্যাশা একগাল হেসে বলল,
-” বাহ্, ভারী সুন্দর ডিজাইন। আচ্ছা এটা পড়িয়ে দাও।”
-” তুই পড়ে নে, আমার কাজ আছে।”
-” আরে দাও না। হুক লাগিয়ে দাও।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা কানে দেয়, নীলা হুক লাগিয়ে দেয়। প্রত্যাশা আঙুল দিয়ে ঝুমকা নাড়িয়ে বলল,
-” ডিজাইনটা সত্যিই চমৎকার হয়েছে! থ্যাংকিউ আপু।”
বারবার নীলার কপাল কুঁচকে আসছিল। প্রত্যাশার নজরে পড়তেই মুখের হাসি উবে গেল। কণ্ঠে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল,
-” আপু তোমার মুখটা শুকনো লাগছে। অসুস্থ তুমি।”
-” না তেমন কিছু না।”
নীলা আর বাড়তি কথা না বলে চলে আসে। বাড়িতে আত্নীয় স্বজন আছে কাজটাজ না করলে আবার কথার সৃষ্টি হবে। নীলা কিচেনে যায়। বারবার কোমড়ে হাত চেপে ধরছিল ও। নীহারিকা লক্ষ্য করতেই বললেন,
-” নীলাশা শরীর খারাপ লাগলে রুমে যাও, বিশ্রাম নাও।”
-” হাতের কাজটা শেষ করি।”
-” সবাই আছে কাজ একটু দেরি হলেও হয়ে যাবে। তুমি রুমে যাও।”
যদিও কাজটাজ করতে একটুও ভালো লাগে না নীলার। তবে সবার সামনে ভালো থাকতে চাওয়ার জন্য হলেও একটু-আকটু নিজ ইচ্ছায় করতে আসে। অবশ্য আজ শরীরটা সত্যিই খারাপ। নীলা যেতেই পরী ভেংচি কে’টে বলল,
-” বড় ভাবীর তো কাম দেখলেই শরীর খারাপ হইয়া থাকে। যেদিনই বেশি কাম থাকে সেদিনই উনি__”
নীহারিকার কথায় থেমে যায় পরী। নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,
-” বাড়তি কথা বাদ দিয়ে তোর কাজ তুই কর।”
বউভাতের অনুষ্ঠান ভালোভাবে মিটতে না মিটতেই নীলাশা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজনের খাওয়া-দাওয়ার পাঠ অবশ্য চুকে গিয়েছিল। কাছের নিকট আত্মীয় ছাড়া বাকি নিমন্ত্রিত অতিথিরা বিদায় নিয়েছে। প্রত্যাশা-নীরব ও বাড়ি যাবে। এরমধ্যে অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ে নীলা জ্ঞান হারায়। নীলাশাকে সাথে সাথেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দ্রুত ব্লাড দেয়া হয়। সাথে একের পর এক টেস্ট তো আছেই। টেস্টের রিপোর্ট এখনো দেয়া হয়নি। ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার ঘর ছুঁইছুঁই। নীরব নিভানের সাথে হাসপাতালে। অধরা আর নীহারিকা আছেন কেবিনে নীলার কাছে।
নীরবের ফোনটা কেঁপে উঠল। রিসিভ করতেই প্রত্যাশার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠস্বর আসলো। একটু পরপরই ফোন দিয়ে জ্বা’লিয়ে খাচ্ছে। আর কান্না করছে। নীরব ঠাণ্ডা গলায় বলল,
-” হ্যাঁ, প্রত্যাশা বলো।”
প্রত্যাশা ভেজা গলায় বলল,
-” নীরব, আপু কেমন আছে? আমি ওখানে যাব।”
-” প্রত্যাশা, বাচ্চাদের মতো জিদ করো না। এখানে ভিড় বাড়ালে ভালো হবে না। ভাবী আগের থেকে একটু ভালো আছেন, জ্ঞানও ফিরেছে। রিপোর্ট হাতে আসুক, সব তোমাকে জানাব। রাতের খাবার আনতে আমি একটু পর বাসায় আসছি। তুমি খেয়ে নাও, আর একদম কান্নাকাটি করবে না, কেমন?”
প্রত্যাশাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নীরব ফোন রাখে। এরমধ্যে একজন দায়িত্বরত নার্স এসে কাগজে কিছু লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন,
-” পেশেন্টের ছেলে-মেয়ে কজন?”
জানানো হলো এখনো কোনো সন্তান নেই। বিয়ের বছরও পূর্ণ হয়নি। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার পেশেন্টের গার্ডিয়ানকে ডাকে। নিভান যায়। গাইনোকলজিস্ট সাবরিনা জাহান জিজ্ঞেস করলেন,
-” পেশেন্টের কী হোন আপনি?”
নিভানকে খুব টেনস আর উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো চোখেমুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। বুকটা অজানা আশংকায় অস্থির। বলল,
-” আমি নিভান মাহবুব, পেশেন্টের হ্যাজবেন্ড। ডক্টর আমার ওয়াইফ..”
ডক্টর হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
-” বসুন।”
হাতের পেনটা এক টুকরো কাগজে ঠুকতে ঠুকতে বললেন,
-” রিপোর্টে দেখা গেছে, পেশেন্টের ইউটেরাসে টিউমার। সেটা দ্রুত বাড়ছে এবং জটিল আকার নিচ্ছে। অপারেশন না করলে অবস্থা মারাত্মক হতে পারে। এমনকি রোগীর জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”
নিভানের মাথায় বজ্রপাত হল যেন। অসহায় দু’টো চোখে ডাক্তারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। ডক্টর এক মূহুর্ত থেমে এক নিঃশ্বাসে বললেন,
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪১
-” মিস্টার নিভান আপনার স্ত্রীর ইউটেরাসে টিউমার হয়েছে। যেটা দ্রুত ছড়াচ্ছে, ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। ইমিডিয়েট অপারেশন জরুরি। তবে একটা তিক্ত সত্যি মেনে নিতে হবে, এই সার্জারির পর আপনার ওয়াইফ সারাজীবনের জন্য মা হওয়ার সক্ষমতা হারাবে। আপনার ওয়াইফ কোনোদিন মা হতে পারবে না।”
গোটা আসমান গুঁড়োগুড়ো হয়ে যেন নিভানের মাথায় ভেঙে পড়ল। পৃথিবীর সবচেয়ে তিক্ত কথা মনে হলো এই প্রথম শুনল সে। শরীর অবশ হয়ে এল সেকেন্ডেই। বুকের উপর পাথর চাপা দেয়ার মতো যাতনায় দম আঁটকে এল।
