মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৬

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৬
রায়েনা হায়াত

তাইমুর ল্যাপটপে কাজ করলেও তার মন পড়ে আছে অন্তির কথাতে। কিভাবে অন্তির সাথে এ বিষয়ে কথা বলা যায় সেইটাই ভাবছে সে। যতটা রেগে আছে তাতে এই মেয়ে এখন আর ভালোভাবে কথা বলবে না তা তার জানা তাই কথা বের করতে হলে খোঁচা দিয়েই বের করতে হবে। তাইমুরের ভাবনার মাঝেই অন্তি পানির জগ হাতে রুমে আসে। টেবিলের ওপর পানি রাখতেই তাইমুর বলে,

–‘৫ বছরের প্রেমিককে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়ে সংসারে মন দিয়ে ফেলেছেন! ভালোই।’
অন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। রাগ হলেও স্বাভাবিক ভাবে বলে,
–‘৫ বছরের প্রেমিক কে?’
–‘তন্ময়।’
–‘ওহ! বাকি ৪ বছর বুঝি প্রেমটা আপনার সাথে ছিলো?’
তাইমুর ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অন্তি দরজা লাগিয়ে এসে চুপচাপ নিজের পাশটায় বসে। তাইমুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
–‘আমারে কি মেয়ে মনে হয়?’
–‘না তো।’
–‘তাহলে আমার প্রেমিক কিভাবে হয়?’
–‘তাহলে আমার ৫ বছরের প্রেমিক কিভাবে হয়?’
তাইমুর কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। অন্তির ইচ্ছে কটে ফুলদানিটা তাইমুরের মাথায় ভাংতে তবে তা না করে নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। তাইমুর বোঝে অন্তি আর তন্ময়ের প্রেমটা ৫ বছরের নয় বরং ১ বছরের। নিজের মাথার সবটা ঘেটে ঘ হয়ে যায় তার। পাশ থেকে ফোন তুলে নিয়ে গ্যালারী থেকে একটা ছবি বের করে অন্তির সামনে ধরে শুধায়,
–‘এটা ৫ বছর আগের না?’
অন্তি তাকায় ফোনের দিকে। সেখানে অন্তি আর তন্ময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাসছে। অন্তি ফোন টেনে নিয়ে ছবিটা জুম করে দেখে। তারপর অবাক হয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–‘এটা আপনি কোথায় পেলেন? কে দিয়েছে আপনাকে?’
–‘আপনার প্রেমিক।’
–‘মানে?’
–‘মানে বোঝেন না? তন্ময় দিয়েছে। ৫ বছর আগে।’
অন্তি বড্ড অবাক হয়। কণ্ঠের অবাকতা ধরে রেখেই বলে,
–‘আপনারা ৫ বছর থেকে একে অন্যকে চেনেন? এজন্যই তন্ময় ওর বিয়ের দিন!’
অন্তির কাছে কিছুটা ক্লিয়ার হলেও পুরোটা হয় না। তাইমুর স্বাভাবিক ভাবে বলে,
–‘হ্যাঁ। সেদিন ভেবেছিলো আপনার সাথে বোধহয় আমার কিছু চলছে তাই ইনসিকিউরড হয়ে বউ রেখেই আপনাকে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলো আমার সাথে কেনো এসেছেন!’
কথাটা বলতে বলতেই তাইমুর না চাইতেও হেসে ফেলে। মনে মনে দু’টো গালিও দিয়ে দেয় তন্ময়কে। পাশে বউ রেখে প্রাক্তন কেনো আরেকজনের সাথে এসেছে তার কৈফিয়ত নিতে আসে! অন্তির মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে,

–‘কিভাবে চেনেন আপনারা একে অপরেকে?’
তাইমুর বিরক্তির শব্দ করে জবাব দেয়,
–‘জন্মগত বোকা নাকি আপনি? সায়মনের চাচাতো ভাই হলে আমি ওকে চিনবো না?’
তবে এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্তি হুট করেই শুধায় আরেক প্রশ্ন,
–‘তার মানে তন্ময়ও জানতো আপনি আমাকে পছন্দ করতেন?’
এ প্রশ্নের জবাব তাইমুর দেয় না। তার মুখে অদ্ভুত এক রাগ ভেসে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–‘সে তো আপনিও জানতেন।’
ঠিকঠাক জবাব না দিয়ে উল্টো পাল্টা কথায় অন্তির খুব রাগ হয়। সে সাথে সাথেই তাইমুরের কাছে গিয়ে তার পেটের কাছের টি-শার্ট চেপে ধরে। তাইমুর নিজেকে ছাড়িয়ে না নিয়ে অন্তির চোখের দিকে তাকায়। অন্তিও তার চোখে চোখ রেখেই চোয়াল শক্ত রেখে জবাব দেয়,

–‘সব কিছুর একটা সহ্যসীমা আছে, তাইমুর। আমি কাল থেকে বলছি কিছু জানি না আর আপনি কাল থেকেই একই কথা বলে চলেছেন! কি মনে করেন নিজেকে?’
–‘কিচ্ছু না। আমি মিথ্যা বললে, আপনি সত্যিটা বলে দেন।’
অন্তি তাইমুরের টি-শার্ট ছেড়ে দেয়। কতক্ষণ থম মে’রে বসে থাকে। তার ওই ৪ টা বছর মনে পড়ে। যে ৪ টা বছরের প্রতিটা দিন সে তাইমুরের জন্য অপেক্ষা করেছিল কিন্তু তাইমুর আসেনি। অন্তিকে চুপ থাকতে দেখে তাইমুর খোঁচা দেয়,

–‘কোনো সত্যি থাকলে তো বলবেন!’
অন্তির প্রচন্ড রাগ হয়, খারাপ লাগে। বার বার একই কথায় তার মনটাই ভেঙে যায়। সে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাইমুরের দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘আমার অনেক আফসোস হচ্ছে যে ৪ টা বছর আমি আপনার জন্য নষ্ট করেছিলাম। সত্যি জানার অনেক ইচ্ছে তাই না! অথচ সব সত্যি আপনার চোখের সামনেই কিন্তু আপনার তো আমার মুখ থেকে জানতে হবে তাই না? বলেন, কি জানতে চান!’
তাইমুর যেনো এই কথারই অপেক্ষায় ছিল। সে সাথে সাথেই জিজ্ঞাসা করে,
–‘আপনি সত্যি জানতেন না কিছু? সায়মন আপনাকে কিছু বলেনি?’
–‘আপনি যাওয়ার পর গত ৫ বছরে সায়মন ভাইয়ের সাথে আমার দেখা-ই হয়নি।’
তাইমুর অবাক হয়। নিজেকে সামলে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
–‘৪ বছর আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন? কেনো?’
–‘কেনো করেছি জানি না তবে অপেক্ষা করেছি। রোজ ভাবতাম আপনি আসবেন কিন্তু আপনি আসেননি। এখন এসেছেন আর এসে আমাকেই দোষ দিচ্ছেন!’
–‘তাহলে তন্ময়?’

–‘তন্ময় আমার পিছে পুরো ৪ বছরের বেশি সময় পড়ে ছিলো। আমি ইগনোর করতাম। কিন্তু সে দমেনি, সম্পূর্ণ ভাবে বোঝাতো সে আমাকে ভালোবাসে। আমার সব পরিস্থিতিতে পাশে থেকেছে কিন্তু আমি তবুও তাকে মেনে নেইনি। ১ বছর আগে হঠাৎ করে তন্ময় সুই’সা’ইড করার চেষ্টা করে তখন আমরা ফ্রেন্ডরা আমাকে বোঝায় আপনি কখনো ফিরবেন না। ফেরার হলে আরও আগেই ফিরতেন। তন্ময় এতো ভালোবাসে যখন তখন তাকে একটাবার সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি তখনও রাজি হইনি তবে এরপর কিভাবে কি হয়ে গেলো নিজেও জানি না।’
দুজনেই চুপ থাকে। তাইমুর কার ওপর রাগ করবে নিজেও বোঝে না। অন্তিরও দোষ নেই, দোষ অবশ্য তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে,
–‘আমি এসেছিলাম, কখনো আপনার সামনে যাইনি।’
তাইমুর চলে গেলে অন্তি সেভাবেই বসে থাকে। তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি অনেক বেশি। এই কারণেই তারা অনেক দুরে। যার কোনো ভিত্তিই নেই। অন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ শুয়ে পড়ে।

পরেরদিন শুক্রবার৷ আজ সায়মনদের আসার কথা। আর সকাল ১০ টার মধ্যে তারা চলেও আসবে। তাইমুর হসপিটালে যাবে না আজ। অন্তি একাই সকালের নাস্তা বানাচ্ছিলো তা দেখে তাইমুরও এসে হাতে হাতে সাহায্য করে দেয়। অন্তি কথা বলে না তার সাথে। এটা স্বাভাবিক। বরং এতকিছুর পরও তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেই তাইমুর অবাক হতো, অস্বাভাবিক মনে হতো। অন্তি নাস্তা শেষ করে আগে থেকেই মেহমানের জন্য রান্নার প্রস্তুতি শুরু করে। খালাও চলে আসে ততক্ষণে। তাইমুর একটু জোড় গলায়-ই বলে,
–‘৪ জন আসবে।’
অন্তি আড়চোখে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। ঘড়ির কাটা ১১ টা-তে যেতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। তাইমুরের চোয়াল শক্ত হলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। তার নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। অন্তিকে ডাকে,
–‘অন্তিকা, এদিকে আসেন। মেহমান এসে গেছে।’
–‘আসছি।’

হাত ধুয়ে অন্তিও বের হয়ে আসে। মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে তাইমুরের সামনে যায়। নিজেদের ভেতরে যা-ই সমস্যা থাকুক তা নিজেদের মধ্যে রাখাটাই ভালো মনে করে সে। বাহিরের মানুষকে সব ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়ার কোনো মানে নেই। তাইমুর দরজা খুলে দেয়। সেখানে সায়মন, নাদিয়া, তন্ময় আর তার বউ দাঁড়িয়ে আছে। সায়মন আর নাদিয়াকে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও তন্ময় আর তার বউকে দেখে অন্তির অবাক হওয়ার শেষ থাকে না। সায়মন তাইমুরের সাথে কুশল বিনিময় করে ভেতরে তাকাতেই চমকায়। অন্তি সবাইকে সালাম দেয়। তন্ময়ের মুখ হা হয়ে আছে। সে বোধহয় কল্পনাও করেনি তাইমুরের বউ অন্তি। সবাইকে বসতে বলে অন্তি চা নাস্তা আনতে যায়। সায়মন তাইমুরকে চেপে ধরে। নিচু স্বরে বলে,

–‘অন্তিকা? তোর বউ?’
তাইমুর সুন্দর করে হেসে বলে,
–‘হ্যাঁ, খুশি হোসনি?’
তারপর তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘তারপর তন্ময়! নতুন বিয়ে কেমন যাচ্ছে?’
তন্ময় তখনো ঘোরে আছে। অন্তি আর তাইমুরকে একসাথে দেখে তার মাথার সব গুলিয়ে গেছে। তাইমুর বেশ বোঝে। অন্তি ট্রে হাতে আসলে নাদিয়া বলে ওঠে,
–‘সেদিন তন্ময়ের বিয়েতে একসাথে দেখে ভেবেছিলাম আপনারা হাজবেন্ড-ওয়াইফ! এখন দেখছি একটুও ভুল ভাবিনি।’
তন্ময়ের বউও তাল মিলিয়ে বলে,
–‘আমি তো তন্ময়কেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু সে তো বলেছিল একদমই এরকম না। অবশ্য আপনাদের দুজনকে একসাথে দারুণ মানায়। ঠিক না, ভাবী?’
নাদিয়া মাথা নাড়ায়। তন্ময়ের জ্বলছে। অন্তিকে তাইমুরের পাশে তার হজম হলো না। ৫ বছর পর এসেও এরা এক হয়ে যাবে তা কখনোই সে ভাবেনি। তাইমুর স্বাভাবিক ভাবেই সবার সাথে কথা বলছে। অন্তি রান্নাঘরে গিয়ে বাকি কাজটুকু সেরে এসে নাদিয়াদের বসতে বলে ওয়াশরুমে যায়। পেছন পেছন তাইমুরও যায়। অন্তি ভাবে ওরা যখন শাড়ি পরে এসেছে আজ সেও শাড়িই পরবে। তবে তাইমুর এসে আগেই বলে দেয়,

–‘শাড়ি পরতে হবে না।’
অন্তি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
–‘কেনো?’
তাইমুরের সহজ জবাব,

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৫

–‘আমি চাই না আমার বউ অন্যদের সামনে শাড়ি পরুক। বিয়ের আগে পরেছেন তখন আমার কেউ ছিলেন না। এখন আমার বউ। আর আমি পারমিশন দিচ্ছি না। শাড়ি যেনো পরতে না দেখি!’
তাইমুর আর কিছু না বলে চলে যায়। অন্তি কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে আনারকলি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। এতো কাহিনি করে এখন অধিকার ফলাচ্ছে? সেও এতো সহজে ছেড়ে দিবে না।

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৭