মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৪
নুজাইফা নূন
-”সারজিস এতোক্ষণ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিলো।কিন্তু যখনি শুনলো সব রান্না সিজদা করেছে।তখন আর সেই খাবার সারজিসের গলা দিয়ে নামতে চাইলো না।সারজিস খাবার ছেড়ে উঠে হালিমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে গেলো।সারজিসের এহেন কার্যে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো।যে ছেলেটা এতোক্ষণ তৃপ্তি নিয়ে খাবার খাচ্ছিলো হুট করে তার কি এমন হলো যে তাকে খাবার ছেড়ে উঠে চলে যেতে হলো।প্রশ্নটা সবার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে।সারজিসের খাবার ছেড়ে উঠে যাওয়ার কারণ কেউ বুঝতে না পারলেও হালিমা বেগম ঠিকই বুঝতে পারলেন।তিনি খাবার চিবোতে চিবোতে মনে মনে বললেন,
-”কেউ না জানলেও আমি জানি তোমার বুকের ভেতর কেমন ঝড় চলছে। তুমি ঠিক কতোটা কষ্ট পাচ্ছো। নিজেকে ভালোবাসার মানুষ কে অন্য কারো হতে দেখা মৃত্যুর যন্ত্রণার থেকে কম কিছু নয়। ভেতর টা দুমরে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তোমার। তবু ও মিথ্যা হাসি মুখে ঝুলিয়ে ভালো থাকার ড্রামা করতে হচ্ছে।জীবন যে নাটকের থেকেও নাটকীয় দাদুভাই। প্রতিনিয়ত আমাদের ভালো থাকার নাটক করে যেতে হয়।
সবটা হয়েছে আমার জন্য ।আমি যে এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছি না। হাসি খুশি প্রাণবন্ত ছেলেটা চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে।আমি দুচোখে দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। দাদুভাইয়ের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী।আমি কেন তোমার মন পড়তে পারলাম না দাদুভাই? এই অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
আমি আমার নিজেকে ক্ষমা করবো কিভাবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-”চৌধুরী ভিলায় যাওয়ার জন্য সিজদা সাইফান দুজনেই রেডি হয়ে বসে আছে। তাদের সাথে সামিরাও যাবে। তারা রেডি হয়ে বসে থাকলেও সামিরার এখনো সাজগোজ হয় নি।যার দরুন সিজদা সাইফান দুজনেই অপেক্ষা করছে।তখনি সাইফানের ফোন বেজে ওঠে।সাইফান ফোনের স্ক্রিনে মাই হার্ট তার পাশে লাভ ইমুজি দেওয়া নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে অনেক টা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।সে আড়চোখে সিজদার দিকে তাকায়।যদি সিজদা নামটা দেখে নেয়।এই ভয় টা পাচ্ছিলো সাইফান। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো সিজদা তো ইংরেজি পড়তে পারে না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সাইফাই।সাইফান সন্তর্পণে সিজদার থেকে সরে এসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করলো। ইদানিং তানশির কল রিসিভ করতে ইচ্ছে করে না সাইফানের।কেমন জানি ডিস্টার্ব ফিল করে।সাইফান কল রিসিভ করে কিছুক্ষণ তানশির সাথে কথা বলে আবারো রুমে ফিরে আসে।সামিরা তখনো রেডি হয়ে আসে নি।
প্রায় ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর সামিরা রেডি হয়ে আসে।সামিরা কে দেখে সাইফান সামিরার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-” কি হয়েছে বোন? তোর চোখ মুখের এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে অনেক সময় ধরে কান্না করেছিস।সাইফানের কথা শুনে সামিরা সাইফান কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। কিন্তু কিছু বলছে না দেখে সাইফান আবারো বললো,
-”ভাইয়া কে বলবি না কি হয়েছে?”
-” সামিরা চোখ মুছে বললো কিছু হয় নি ভাইয়া।চলো।”
-” হুম চল বলে সাইফান সিজদা সবার থেকে বিদায় নিয়ে তাদের নিজস্ব গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সামনের সিটে সাইফান আর সিজদা বসলো।আর পেছনে সালেহা বেগম আর সামিরা।সাইফান গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে তখন লক্ষ করলো সিজদা সিট বেল্ট বাঁধে নি।সাইফান সিজদার দিকে ঝুঁকে গিয়ে সিজদার সিট বেল্ট বেঁধে দিলো।সাইফানের এহেন কার্যে সিজদার কিছুদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে গেল।সিজদা মনে মনে বললো,
-”আপনার আর ডাক্তার বাবুর মাঝে অনেক মিল পাই আমি। ডাক্তারবাবু ও ঠিক এই ভাবে আমার সিট বেল্ট বেঁধে দিছিলো। কিন্তু ডাক্তারবাবু তখন না খেয়ে উঠে গেলো কেন?প্রথমে তো ঠিকই খাচ্ছিলো।পরে যখন জানতে পারলো আমি সব রান্না করেছি ।তখন আর খেলো না।আমার সাথে ভালো কইরা কথাও কইলো না।যেনো আমাকে সে চিনেই না।আমি তার অপরিচিত কেউ।তিনি আমার সাথে এমন আচরন করছেন কেন?
সে কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছে? কিন্তু কেন?কি করেছি আমি ?”
-”সাইফান ড্রাইভিং এর ফাঁকে সিজদার দিকে তাকিয়ে দেখে সে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে।সাইফান সিজদা কে কয়েক বার সিজদা বলে ডাক দিলো। কিন্তু সিজদা রেসপন্স করলো না দেখে সাইফান একটু জোরেই সিজদা বলে উঠলো।যেটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই কেঁপে উঠলো সিজদা।সিজদা থতমত খেয়ে বললো,
-” কি কিছু বলছেন?”
-”সেই কখন থেকে তোমাকে ডেকে চলেছি। কিন্তু তোমার কোন সাড়া শব্দ নেই।কি এতো ভাবছো বলো তো? “
-” কই কিছু না তো।”
-” ঘুম আসছে ?”
-” হুম।”
-” সাইফান কাঁধ দেখিয়ে বললো, কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোতে পারো।আমি কিছু মনে করবো না।”
-” সিজদা মুচকি হেসে সাইফানের কাঁধে মাথা রাখতে যাবে তার আগেই সামিরা পেছন থেকে বললো,
-” বউমণি আমি সালেহা খালা দুজনে পেছনে আছি । আমাদের কথা ভুলে যেও না আবার।”
-” সামিরার কথা শুনে সিজদা লজ্জা পেয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে নিয়ে মনে মনে বললো,
-” ইশ্! আমি তো সামিরা আর সালেহা খালার কথা বেমালুম ভুলে গেছিলাম।কি না কি মনে করলো তারা।”
-”গাড়ি চলছে আপন গতিতে। প্রকৃতির শীতল বাতাস সিজদার চোখে মুখে আঁচড়ে পড়ছে। প্রশান্তি তে ছেয়ে যাচ্ছে শরীর মন।বাতাসে সিজদার চুল কপালে এসে বারি খাচ্ছে।সিজদা বিরক্তি নিয়ে বারবার চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে।এক পর্যায়ে সিজদা চুল খোঁপা করতে গেলেই সাইফান বললো,
-” পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি জানো?”
-” কি?”
-” একটা মিষ্টি মেয়ের চোখে মুখে খোলা চুল এসে বারি খাচ্ছে।আর মেয়েটাকে বিরক্তি নিয়ে বারবার সেই চুল কানের পাশে গুঁজে দিতে দেখা।”
-” কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সিজদার মুখে হাসি ফুটে উঠে।সিজদা চুলগুলো খোঁপা না করে ছেড়ে রাখে। রাস্তায় তাদের মধ্যে আর কোন কথা হয় না।গাড়িতে পিনপতন নীরবতা কাজ করে।
ঘন্টা খানেক পর গাড়ি এসে চৌধুরী ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সিজদা সাইফান কে দেখে খুশি হয়ে যায় রাদেশ চৌধুরী।তিনি সাইফান কে সাদরে গ্রহণ করেন। কিন্তু বিথী চৌধুরী খুশি হতে পারেন না। তার মুখে আঁধার নেমে এসেছে।যে মেয়ের জন্য আজ তার মেয়ে জেলে রয়েছে।তাকে বরণ করার কোনো ইচ্ছা ছিলো না তার।তার ইচ্ছা করছিলো বরণের সময়েই খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তার ইচ্ছে কে দমিয়ে রেখেছেন।
রাশেদ চৌধুরীর জোরাজুরি তে তিনি এসে সাইফান কে মিষ্টি মুখ করিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান। কিন্তু ভুলেও সিজদার দিকে তাকিয়ে দেখেন না।এতে মনক্ষুণ্ণ হয় সিজদার। সালেহা বেগম ঐশ্বর্যের পাশের রুমে সিজদা সাইফান কে নিয়ে যান।রুমে প্রবেশ করতেই সাইফানের নাকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে বারি খায়।সাইফান বিছানায় বসে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।
মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৩
রুমে তেমন আসবাবপত্র না থাকলেও রুমটা খুবই পরিপাটি করে গোছানো।বিয়ের আগে সিজদা এই রুমে শিফট করেছিল।তখনি রুমটা সুন্দর করে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিলো। সিজদা ফ্রেশ হয়ে একটা সুতি থ্রি পিস পরিধান করে।সাইফান সিজদা কে দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।যেটা বুঝতে পেরে সিজদা একটু লজ্জা পেয়ে যায়।সিজদার লাজে রাঙ্গা চেহারা দেখে ঘোরের মধ্য চলে যায় সাইফান।সাইফান এক পা দু পা করে সিজদার দিকে এগিয়ে আসে।তাদের মধ্য এক ইঞ্চি সমান দূরুত্ব রয়েছে।সাইফান সেটুকু দূরুত্ব ঘুচিয়ে সিজদার কপালের দিকে নিজের ওষ্ট এগিয়ে নিয়ে যায়।।”