মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৭

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৭
নুজাইফা নূন

-”সারজিস জটলা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই যেন সারজিসের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হয়। কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসে।হাত থেকে ফোন পিচঢালা রাস্তায় পড়ে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়।।
তার যেন নিজের চোখ কে বিশ্বাস হচ্ছে না। এতো দিন যে মানুষ টাকে সে মৃত ভেবে এসেছে।যার ছবি বুকে নিয়ে সে দিনরাত চোখের পানি ফেলেছে।যে মানুষ টার জন্য একটু আগেও তার বাবাকে কথা শুনিয়েছে।সেই মানুষ টা তার সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।সারজিস আর এক মুহূর্তও কালবিলম্ব করে না। দৌড়ে গিয়ে যমুনা মির্জা কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। সারজিসের এহেন কার্যে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।সবার মনে প্রশ্ন জাগে কে এই অজ্ঞাত মহিলা?”

-”সারজিস কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যমুনা মির্জা কে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে তার।সে ভাবতেও পারে নি এতো গুলো বছর পরে আবার তার মায়ের দেখা পাবে।মাকে ফিরে পেয়ে যতোটা না আনন্দ হচ্ছে তার থেকেও বেশি ভয় হচ্ছে তাকে হারিয়ে ফেলার। মিনিট কয়েক অতিবাহিত হতেই
গাড়ি এসে হসপিটালে সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
সারজিস যমুনা মির্জা পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে হসপিটালের ভেতরে ছুটে এসে ডক্টর ডক্টর বলে হাঁক ছাড়তেই নার্স স্ট্রেচার নিয়ে ছুটে আসে
। যমুনা মির্জা কে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে ওটি তে নিয়ে যাওয়া হয়।তার মাথা, শরীর থেকে এখনো চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।তার রক্তে সারজিসের পুরো শরীর ভিজে গিয়েছে।
খুব‌ই ক্রিটিক্যাল অবস্থা তার। যমুনা মির্জার কন্ডিশন দেখে মুখে আঁধার নামে ডক্টর রায়হানের।তার বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” হসপিটালের করিডোরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে সারজিস।চোখে মুখে আতঙ্ক বিরাজ করছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হয়েছে। কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। শরীরে যেন বিন্দুমাত্র শক্তি নেই।প্রিয় মানুষ কে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে দেখে কোনো পুরুষের ই সাধ্য নেই নিজেকে‌ ঠিক রাখার।সারজিস ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।তার নিজের হাতেই কতোশতো অপারেশন হয়েছে। চোখের সামনে কতো মানুষ কে মরতে দেখেছে।তখন খারাপ লাগলেও সেটা কখনোই প্রকাশ পায় নি। ডক্টরদের সহজে ভেঙ্গে পড়লে চলে না। কিন্তু সারজিস যেন আজ তার ডক্টরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়েছে তার।সারজিস ধপ করে ফ্লোরে বসে‌ পড়ে। উপস্থিত সবাই সারজিসের এই রুপ দেখে যেন হতবম্ব হয়ে যায়।সবাই সারজিস কে একজন শক্ত মনের ডক্টর মনে করে।এর আগে তাকে কখনোই এতোটা ভেঙ্গে পড়তে দেখে নি।”

-” এর‌ই মধ্যে ডক্টর রায়হান বের হন।তাকে দেখেই
সারজিস ছুটে এসে ভেজা কণ্ঠে বললো,
-” ডক্টর আমার মাকে বাঁচিয়ে দিন প্লিজ।এর আগে অসংখ্য মানুষ আমার কাছে এসে এই রিকোয়েস্ট করেছে।আজ আমি আপনার কাছে রিকোয়েস্ট করছি।প্লিজ আমার মাকে বাঁচিয়ে দিন ডক্টর ।প্লিজ।”
-” তোমাকে আজকে বড্ড অচেনা লাগছে সারজিস। এতো দিন আমি ডক্টর সারজিস কে দেখেছি। আর আজ সারজিসের অন্য রুপ দেখছি। সত্যি‌ই মায়ের প্রতি সন্তানের এতোটা ভালোবাসা সব ছেলের মধ্যে থাকে না।বাট ইউ আর টু লেট।তোমার মায়ের কন্ডিশন খুবই আশঙ্কাজনক।মাথায় খুব‌‌ই বাজে ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। মাথায় অপারেশন করতে হবে। তাছাড়া প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।অনেক রক্তের প্রয়োজন।।”

-” আমার এবি নেগেটিভ গ্ৰুপ।যতো ব্লাড প্রয়োজন আপনি আমার শরীর থেকে নিন। তবুও আমার মাকে সুস্থ্য করে দিন ডক্টর।”
-” তুমি একজন ডক্টর হয়েও এমন আন‌ইউজুয়াল কথা কিভাবে বলছো সারজিস? তুমি খুব ভালো করে জানো তোমার মায়ের যতোটা ব্লাড প্রয়োজন।তুমি তার সবটা যোগান দিতে পারবে না। আমাদের ব্লাড ব্যাংকেও এবি নেগেটিভ ব্লাড পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। তুমি অতি দ্রুত এবি নেগেটিভ ব্লাডের ব্যবস্থা করো।আমি ও আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

-” সারজিস কিছু বলার আগেই পেছন থেকে পুরুয়ালী কণ্ঠে ভেসে আসলো ,
-” ব্লাডের জন্য আপনাদের কোনো স্ট্রেট নিতে হবে না। আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।যতো ব্লাড প্রয়োজন আমরা দিবো।আমরা আমাদের মাকে মরতে দিবো না। কিছুতেই না।।”

-” রাতে ডিনার শেষে সিজদা কিছুক্ষণ সালেহা বেগমের সাথে গল্পগুজব করে এসে দেখে সাইফান বিছানা রেডি করছে।সিজদা গুটি গুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করে বললো,
-” আরে আপনি এসব মেয়েদের কাজ করছেন
কেন? আপনি গিয়ে বসুন ।আমি বাকিটা করে নিচ্ছি।”
-” সাইফানের যেন সিজদার কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না।সাইফান নিঃশব্দে বিছানা রেডি করে মশারী টাঙিয়ে বিছানার চারপাশে মশারী গুজে দিয়ে বললো,

-”এটুকু কাজ করেছি বলে আমার হাতে ফোস্কা পড়ে যায় নি।এসব ছোট খাটো কাজ করার অভ্যাস আছে আমার।”
-” এমন ভাবে বলছেন যেন আপনার আগের ঘরের ব‌উ আছে।আপনি ব‌উয়ের কাজে সবসময় সাহায্য সহযোগিতা করেন।যার জন্য আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে।সিজদা যদিও রসিকতা করে কথাটা বলে তবু ও‌ সাইফানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।বুক ধুক করে উঠে।ঘামতে শুরু করে সাইফাই।সাইফানের মুখে আঁধার দেখে সিজদা শাড়ির আঁচল দিয়ে
সাইফানের মাথার ঘাম মুছে দিয়ে বললো,

-”বাব্বা।আমার সামান্য কথা শুনে এসির ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে থেকে ও আপনার কপালে ঘামের সৃষ্টি হয়ে গেলো? আরে বাবা আমি তো মজা করে বলেছি কথাটা।”
-” সাইফান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।সে ধীর গলায় বললো,
-”অনেক রাত হয়ে গিয়েছে শুয়ে পড়ো।বেশি রাত জাগা শরীরের জন্য ভালো নয়।তোমার শরীর খারাপ করবে।যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
-” আপনি শুবেন না?”
-” তুমি শুয়ে পড়ো। আমার একটু কাজ আছে।আমি কাজ শেষ করে তারপর শুবো।”
-” ঠিক আছে বলে সিজদা বিছানার গা এলিয়ে দেয়।সাইফান সিজদার গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়ে।”

-” সাইফানের কাজ শেষ হতে হতে প্রায় এক টা বেজে যায়। বিরক্তিতে মাথা ভার হয়ে আসে তার।সাইফান ল্যাপটপ বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে বিছানায় যেতেই সিজদার ঘুমন্ত মুখ দেখে তার সব বিরক্তি মূর্ছা যায়।সাইফানের মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি ভর করে‌।সাইফান তাদের মাঝখানের কোলবালিশ নিচে ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে সিজদার দিকে এগিয়ে গিয়ে সিজদার কপালে আলতো চুমু খেয়ে সিজদা ঘা ঘেষে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছে না।রাত যতো গভীর হচ্ছে নিষিদ্ধ চাওয়ারা যেন সাইফান কে উষ্কে দিচ্ছে।সাইফান নিজেকে কন্ট্রোল করার অনেক চেষ্টা করে।সিজদা কে দেওয়া কথার খেলাপ করতে চায় না। কিন্তু আগুন আর ঘি এক জায়গায় থাকলে যে কোনো বাঁধাই মানতে চায় না।সব কিছু শেষ করে দেয়।এই মুহূর্তে সাইফানের নিজেকে আগুন আর সিজদা কে ঘি মনে হচ্ছে।ইচ্ছে করছে দুজনে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে‌।সিজদা কে আপন করে পাওয়ার তীব্র বাসনা জেগেছে তার মনে।সাইফান যেন নিজের মধ্যে নেই।সে তার দেওয়া সমস্ত কথা ভুলে সিজদার দিকে অগ্রসর হয়।সিজদার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখতে গিয়েও কপালে চুমু খেয়ে সাইফান বিছানা ছেড়ে নেমে বেলকনি তে চলে যায়।”

-” সাইফান যেতেই চোখ খোলে সিজদা।সে সজাগ থাকলেও ঘুমের ভান ধরে পড়ে ছিলো।এক মূহুর্তের জন্য সাইফানের প্রতি সব সম্মান শ্রদ্ধা ঘৃণায় পরিনত হয়েছিলো । কিন্তু সিজদা যখন দেখলো সাইফান তার দেওয়া কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।তখন সাইফানের প্রতি তার সম্মান শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো।সিজদা মনে মনে বললো,
-” আপনি ধৈর্য্যর পরীক্ষায় পাশ করেছেন সাইফান।।আমি আপনাকে যতো দেখছি ততোই অবাক হয়ে যাচ্ছি।আপনার প্রতি দিন দিন আমার সম্মান বাড়ছে বৈকি কমছে না।

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৬

আপনার মতো একজন মানুষ কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমি সত্যিই গর্বিত।আপনাকে বেশি দিন কষ্ট পেতে দিবো না‌‌ আমি।আপনি আমার মন ছুঁয়ে নিয়েছেন।আর যে মানুষ টা মন ছুঁতে পারে।শরীর ছোঁয়া ও অধিকার রয়েছে তার। খুব শ্রীঘ্রই সেই অধিকার দিবো আপনাকে।আপনাকে আপন করে নিবো। ততোটাই আপন যতোটা আপন হলে আপনি আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাবেন।আপনার রঙ্গে আমি রঙ্গিন হয়ে যাবো।”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৮