মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১৩+১৪
ফাবিয়াহ্ মমো
অচেতন মেহনূরের মুখ থেকে এমন ভয়াবহ শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মাহতিম!নিজের কানদুটো পযর্ন্ত ঝিঁঝি করে বাজছে। কি শুনলো সে? মেহনূরের গায়ে তরুণ হাত দিয়েছে? আচ্ছা নামটা কি সে ঠিক শুনেছে নাকি ভুলভাল শুনলো? এমন একটা পরিস্থিতি হলো মাহতিম তখন স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনাও যেনো গুলিয়ে ফেললো। বারবার কল্পনায় ভাবতে লাগলো তরুণ ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করছে, মেহনূর তাতে ছটফট করছে, ছাড় পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে, তরুণ আরো হিংস্র হয়ে ছোঁয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, এদিকে মেহনূর চেচাঁমেচিও শুরু করে দিয়েছে —! এরপর আর ভাবতে পারলো না মাহতিম! তড়াক করে ওর পাশ থেকে উঠে দাড়াঁলো।
শরীরের ভেতর রক্তের স্রোত টগবগ-টগবগ করে ফুটছে এখন। এখুনি যেনো আগ্নেয়গিরির লাভা উদগিরণ হবে। মেহনূরের রুম থেকে রাগান্বিত মেজাজে বেরিয়ে গেলো সে। সিড়ি ধরে হনহন করে নামতেই ঘুমঘুম চোখে কলপাড়ের জন্য বাইরে যাচ্ছিলো নীতি। মাহতিমের ওমন ক্রুদ্ধভঙ্গির মেজাজ দেখে চোখ কচলানো থমকে গেলো। চকিত দৃষ্টি ছুঁড়ে মাহতিমের দিকে ছুটে গেলো ও। মাহতিম তখন নীতির পাশ কাটিয়ে দ্রুতবেগে সিড়ি ধরে নিজের রুমের জন্য যেতে লাগলো। পেছন থেকে ওর হাব-ভাব দেখে শঙ্কিত মুখে ছুট লাগালো নীতি। পিছন-পিছন দৌড়ে যেতেই প্রশ্ন করতে লাগলো ওকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– মাহতিম ভাই! ভাই, দাড়াও! ভাইয়া কি হয়েছে? ভাইয়া আস্তে চলো!এভাবে দৌড়াচ্ছে কেনো? জবাব দাও!
নীতির প্রশ্নমালা চলতে থাকলো ঠিকই,রাগে ভষ্ম হওয়া মাহতিম সেটার একটা উত্তর দিলো না। রুমে ঢুকে কাঠের আলমারি খুলে এমন একটা বস্তু বের করলো সেটা দেখে নীতি একদম বিস্ফোরণ চাহনিতে চিল্লিয়ে উঠলো,
– খবরদার ভাইয়া, এটা বের করো না! আমরা এখন শহরে নেই, এটা গ্রাম! এখানে এসব জিনিস বের করো না ভাইয়া। কি হয়েছে, আমাকে বল। আমি সব হ্যান্ডেল করছি ভাইয়া, ফর গড সেক তুমি ঠান্ডা হও। ভাইয়া ঠান্ডা হও। আমি আছিতো, নীতি সব ঠিক করবে। তুমি আমাকে খুলে বলো।
নীতির অস্থির চাউর দেখে মাহতিম কঠোর দৃষ্টিতে একপলক তাকালো। একেবারে ওর চোখে-চোখ রেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– তোকে যদি কেউ মলেস্ট করার চেষ্টা করে ওই সময় আমার কি করা উচিত? এই মূহুর্তে কোনো পাল্টা প্রশ্ন করবিনা! একদম কাট-কাট আন্সার দিবি। ইন্সটেন্ট উত্তর দে এখন!
মাহতিমের কথা শুনে মুখের বুলি হারিয়ে ফেললো নীতি। মাহতিম তখনও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। নীতি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে প্রত্যেকটা শব্দ থেমে-থেমে বললো,
– তুমিতো তাকে মে-রেই ফেলবে।
কাঙ্ক্ষিত এবং যোগ্য জবাব পেয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের কঠোর দৃষ্টি নীতির উপর থেকে সরিয়ে ফেললো মাহতিম। হাতে থাকা চকচকে সিলভার রঙের ভারী বস্তুটা দ্রুতগতিতে টিশার্ট উঠিয়ে পেটের বাঁ-পাশে প্যান্টের সাথে গুঁজে রাখলো। আবার দৃষ্টি তুলে নীতির স্তম্ভিত মুখের পানে কাঠিন্য সুরে বললো,
– তুই সামনে দেখে মুখটা খারাপ করলাম না, কিন্তু তরুণের বাচ্চাকে আমি ছাড়বো না! ওই শালার ইতরামি যদি না ছুটিয়েছি দেখিস! ওর কারেন্ট এক্কেবারে নিভিয়ে দেবো। ওর আসল জায়গায় যদি মেইন কাজ না সারছি, আমি ওর —
মুখ থেকে বাজে কথা ছিটকে আসার পূর্বেই তড়িঘড়ি করে থামিয়ে দিলো নীতি। মাহতিমের একদম সামনে দাড়িয়ে ভীত অবস্থায় নিজেকে শান্ত করে জোর খাটিয়ে বললো,
– আমরা কিন্তু শহরে না ভাইয়া। তোমার এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে, তুমি কিন্তু এই মূহুর্তে কোনোপ্রকার সিনক্রিয়েট করতে পারবেনা। আমরা এখন জমিদার বাড়িতে আছি। এই বাড়ির নাম-ধাম যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, তাহলে কেমন ভয়াবহ অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখো। তুমি আপাতত ঠান্ডা হও, জাস্ট রিল্যাক্স! আমি জানি তুমি এইসব নষ্টালজিক ব্যাপারগুলো নিতে পারো না। কিন্তু ভাইয়া কে মলেষ্ট হয়েছে? কার জন্য তুমি তরুণের উপর তেড়ে যাচ্ছিলে? তরুণ কি করেছে?
একটু আগের ঘটনাগুলো আবার মনে পরলো মাহতিমের। ওমনেই রাগের চোটে টেবিলের পায়ে জোরে একটা লাত্থি মারলো! সেই লাত্থির কারণে কাঁচের গ্লাসটা খাড়া থেকে কাত হয়ে নিচে গড়াতে যাচ্ছিলো। নীতি তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে সেই গ্লাসটা ধরে সোজা করে রাখলো। রাগে নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে মাহতিমের। কয়েক পা পিছিয়ে ধড়াম করে বিছানায় বসে পরলো সে। মুখটা দুহাতের তালুতে ঢেকে রাগ সংবরণের চেষ্টায় আছে। তরুণকে যদি এই মূহুর্তে সামনে পায় ওর শরীরের চামড়া উঠিয়ে তেজ মিটিয়ে দিবে! গলায় দড়ি বেঁধে চামড়া খসিয়ে জিপের পেছনে ছুটাবে! ওর জন্য যখন উত্তপ্ত মস্তিষ্কে উপর্যুক্ত শাস্তির চিন্তা করছিলো, তখনই চিন্তার জালে ছেদন করে নীতি বলে উঠলো,
– ভাইয়া তরুণ কার সাথে বাজে কাজ করেছে? কাকে মলেস্ট করে —
প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না নীতি, পথিমধ্যে মাহতিমের তেজালো কন্ঠ এসে থামিয়ে দিলো ওকে। সেই তেজালো কন্ঠেই চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো,
– মলেস্ট করেনি! শালা শয়তানটা সুযোগে কোপ মেরেছে। মেহনূরকে মেবি একা পেয়েছে, ওমনেই শয়তানের জিহবা টসটস করে উঠেছে। কুত্তার মতো পেটাতে পারতাম! মারতে পারতাম হারামজাদাকে! উফ, এই মূহুর্তে কি উচিত? তাড়াতাড়ি বল কি করা উচিত?
প্রচণ্ড উত্তেজনায় টগবগ করে উঠলো মাহতিম। রাগের চূড়ান্ত অবস্থা ওর চোখে-মুখে পরিদৃষ্ট। এই মূহুর্তে সত্যিই নিজেকে সামলাতে পারছেনা ও! কোনোভাবে তরুণকে একবার হাতের মুঠোয় এনে কেঁচে ফেলবে একদম! নীতি পরিস্থিতি ওমন গরম দেখে দ্রুত মাহতিমের উদ্দেশ্যে অস্থির ভঙ্গিতে বললো,
– ভাইয়া? ভাইয়া দেখো, আগে নিজেকে কন্ট্রোল করো। বেশি উত্তেজিত হয়ো না, এইসময় বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওই বজ্জাত শেফালী কিন্তু ঠিকই ঘাপটি মেরে আছে। যদি উঁচুনিচু কিছু ঘটিয়ে ফেলো সম্পূর্ণ দায়ভার মেহনূরের উপর এসে পরবে। এসব ঘটনায় কিন্তু মেয়েরা বেশি ভিক্টিম হয়। তাই সাবধান করে দিচ্ছি ভাইয়া, নিজেকে ঠান্ডা করো।
মাহতিম ওর কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে আদেশসূচকে বললো,
– তুই ওর রুমে যা এক্ষুনি, ওর অবস্থা কেমন সেটা দ্যাখ। আমি যা করার নিজের মতো করেই করবো। শয়তান তো জানেনা এই মাহতিম কি জিনিস। ওর মতো দশটা কুত্তাকে পায়ের নিচে মাড়াতে আমার টাইম লাগবেনা!
নীতি টান-টান পরিস্থিতির ভেতর শুষ্ক গলায় ঢোক গিললো। গলাটা স্বল্প ভিজিয়ে সম্মতির সুরে মাথা দুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহনূরের রুমের দিকে আসতেই সৌভিকের কানে কথাটা দিয়ে গেলো। সৌভিক প্রথমে রাগে ক্ষেপে উঠলে পরক্ষণে মাহতিমের চিন্তায় সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। তাড়াতাড়ি তৌফ ও সিয়ামের কানে কথাটা পেড়ে ফেলে। ওরা দুজনও বাকরুদ্ধ অবস্থায় দুমিনিট হা করে তাকিয়ে থাকে। এরপর মাহতিমের রুমের দিকে একসঙ্গে তিনজন ছুট লাগায়। নীতি মেহনূরের রুমে ঢুকার আগে বুদ্ধি করে প্রীতি ও ফারিনকে সবকিছু বলে দেয়। এদিকে শানাজ দরজা চাপিয়ে ঘুমাচ্ছে দেখে ওকে আর ডাকে না।
সুরাইয়া এখন কোথায় আছে সেটা কেউ জানেনা। নীতি, প্রীতি, ফারিন একসাথে তিনজন মেহনূরের রুমে আসলো। বিছানায় চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মেহনূর চেতনাশূন্য হয়ে আছে। তিনজন সেই দৃশ্য দেখে নিজেদের মুখের পানে কিছুক্ষণ চাওয়া-চাওয়ি করে। চোখের ইশারায় কিছু সায় বুঝিয়ে বিছানার কাছে চলে আসে। নীতি ওর মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসে। প্রীতি রুমে গিয়ে নিজেদের লাগেজ থেকে গ্লুকোজের বয়াম খুলে একটা ফ্লাক্সভর্তি গ্লুকোজের পানি নিয়ে আসে। ফারিন একটা গামছা নিয়ে সেটা ভিজিয়ে এনে মেহনূরের হাত ও পায়ের তালু মুছে দেয়। প্রীতি চামচে করে গ্লুকোজের পানি ধরলে নীতি ওর ঠোঁট ভেদ করে সেটা খাইয়ে দেয়। প্রীতি ফ্লাক্সের ছোট কাপ থেকে চামচ দিয়ে গ্লুকোজ নিতেই ক্ষুদ্ধ স্বরে বলে,
– এই বাড়ির মানুষগুলো খুবই আজব আপু। মা এদিকে মেয়ের খেয়াল রাখেনা, দাদা বাড়ির গোপন খবর জানেনা, শেফালীর আকাম কারোর চোখে দেখেনা। আবার আজকে দেখো, তরুণের মতো খবিশও সাহস পেয়ে গদগদে হয়ে ওর গায়ে হাত দিয়েছে। আচ্ছা সব ঘটনা মেহনূরের সাথেই কেনো ঘটে আপু? কি এইটার রিজন?
নীতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে একনজর প্রীতির দিকে তাকালো। খাওয়ানোর জন্য মেহনূরের ঠোঁটে চামচ কাত করতেই শান্ত স্বরে বললো,
– মেয়েটার দিকে ঠিকমতো তাকিয়ে দ্যাখ, তাহলেই আসল ঘটনা বুঝবি।
নীতির এমন কথায় আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না প্রীতি। তবুও বড়বোনের কথায় মান্য করে মেহনূরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। মেহনূরের দিকে নিবিড় চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে পাশ থেকে ফারিন বলে উঠে,
– মেয়েটা যে একটু বেশিই সুন্দর এটা তুমি দেখো না? একটা মেয়ে যে ওর সৌন্দর্য্য দেখে হিংসা করতে পারে এটুকু বুঝো না? ওর বোনগুলোর মধ্যে সুরাইয়া এক নাম্বার ফাজিল। ওই মেয়েকে দেখলে জুতিয়ে মারতে ইচ্ছে করে।
ফারিনের কথা শেষ হতেই প্রীতি তীক্ষ্মদৃষ্টি ফেলে ভাবুক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
– আচ্ছা ফ্রক পরিয়ে দিলে কি সত্যিই ওকে বাচ্চা লাগবে? মাহতিম ভাই কি তখন কন্ট্রোল অপশনে থাকতে পারবে? আমার কিন্তু মেয়েটার ফেস মারাত্মক লাগে।
প্রীতি কথাটুকুর ইতি টানবে ওই মূহুর্তেই চট করে ফারিন বলে উঠে,
– সবাই যে এই সময়টায় ঘুমায় এটারই সুযোগ নিয়েছে। তরুণ তো দেখি ডেন্ঞ্জারাস টাইপের চালাক! ওর চালাকি কি কেউ ধরতে পারলো না?
নীতি এবার মুখ খুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– মুখে যদি নকল চেহারা পরে থাকে তাহলে ভালো মানুষরা অবশ্যই ঢপ খাবে। শেফালী মামী ছাড়া সবাই কিন্তু ভালো মনের মানুষ। সবাই যথেষ্ট সহজ-সরল। অন্য দশটা গ্রামের মহিলার মতো উনাদের মনে অতো ঘুরপ্যাঁচ নেই। কিন্তু যা কাহিনী ঘটানোর এই জমিদার বাড়িতে শুধু শেফালী মামীই করে। আর নিজের মেয়েটাকেও খারাপভাবে এক্সপার্ট বানিয়েছে। দেখলি না? কিভাবে মাহতিম ভাইয়ের কাছে চিঠি গুঁজে দিয়েছে। এগুলাকে থাপড়ানো উচিত। হান্নান নানা যদিও সহজ মনের মানুষ কিন্তু আমার মনেহয় তিনি অবশ্যই সবকিছু টের পাচ্ছেন, অথচ মুখে কিছু স্বীকার করছেনা। বাড়ির মধ্যে যদি কলহ সৃষ্টি হয় সেটা কিন্তু বাইরের গ্রামবাসীরা ভালো নজরে দেখবেনা।
নীতির যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে দুজন চুপ করে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহনূর চোখ খুলে সম্বি ফিরে পেলে স্বাভাবিক অবস্থায় একটু-একটু করে চেতন ফিরে এলো ওর।
তবুও দুদফা বমি করলো আবারও। শানাজ ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেলে প্রথম কয়েক মিনিট মূর্খের মতো তাকিয়ে রইলো শানাজ। তারপর ধীরে-ধীরে যখন সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে পারলো সে মূহুর্তে আর স্বাভাবিক রূপে থাকলোনা ও। গর্জে উঠেই হোক বা গালির চোটে, তরুণের গুষ্ঠি তখন শানাজ একদম চোটপোট করে দিচ্ছে। সাবা এই ঘটনা জানার পর ভয়ে কেমন গুটিয়ে গেলো। কিন্তু সুরাইয়া তখনও লাপাত্তার নজিরে রইলো। শেফালী ঘুম থেকে মাগরিবের আযানের সময় উঠলেন। আঙিনায় এসে যখন সুনশান নিরবতা দেখলেন, সেই সঙ্গে যখন বাড়ির ভেতর ওমন সন্ধ্যার অন্ধকারে বাতিহীন অবস্থা ছিলো, তখন শুধূ মেহনূরের রুমেই আলো জ্বালানো হয়েছিলো। আবার সেখান থেকেই অনেকগুলো স্বরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো।
শেফালী মাথায় ঘোমটা টেনে মোটা শরীরটা নিয়ে সিড়ি ধরে মেহনূরের রুমের দিকে এগুতে লাগলো। ক্রমেই যখন পা এগিয়ে রুমের এসে দাড়ালো, তখন সাদা পর্দা সরাতেই রুমভর্তি সকলকে যেনো একত্রে দেখতে পেলো। শেফালীকে আচমকা দরজার সমুখে দেখে পিনপতন নিরবতায় চুপ গেলো সবাই। মেহনূরকে বিছানার মাথার সাইডে পিঠ লাগিয়ে বসতে দেখা যাচ্ছিলো। চুলগুলোও কেউ সুন্দর করে ফ্রেন্ঞ্চ বেণী করে দিয়েছে ওর। মাথার সবগুলো চুল পেছনে টেনে মোটা একটা বেণী ঝুলছে। কপালের কাছে মাথার শুরু-প্রান্তে ছোট-ছোট চুলগুলো ছেয়ে আছে। মলিন-উদাস-বিষণ্ণতায় ঢেকে থাকা উজ্জ্বল-লাবণ্য-সুন্দর মুখটা একটু যেনো তর্জমা করে দিয়েছে কেউ। সবই শেফালী খুটিয়ে খুটিয়ে দরজার দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে পরোখ করছিলো। শেফালীকে ওমনভাবে তাকাতে দেখে সাবির সৌভিকের দিকে সুক্ষ্ম ইশারা করলো। সেই ইশারার ইঙ্গিত ধরে সৌভিক তৎক্ষণাৎ হাসি দিয়ে বললো,
– মেজো মামীর আগমন কি করে হলো? আসেন মামী। আসেন দু’কাপ চা খেয়ে গল্প করি।
শেফালী ওর কথা শুনে সৌজন্যতার খাতিরে হাসি দিলো। তাও হাসিটা কুশ্রী লাগলো। মনে-মনে নাক ছিটকালো সৌভিকরা, কিন্তু মুখের ভাবে সেটা একটুও প্রকাশ করো না। শেফালীর দিকে নমনীয় কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বললো শানাজ,
– মেজো মা, আপনার কি কিছু দরকার?
শেফালী এবার নিরবতার সুতো কেটে বললেন,
– ঘরে যে বাত্তি জ্বালাইতে হয় এইটা কি মনে থাকেনা? ঘরদোর তো আন্ধার হই গেছে। এট্টু পর আব্বা আসি দেখলে গজগজ করবে।
সিয়াম একচুলও শেফালীকে সহ্য করতে পারছেনা। ঝাড়ু এনে যদি ঝাটের মতো বিদায় করা যেতো তাহলে সিয়াম দেদারসে সেটাই করতো। কিন্তু ভদ্রতার খাটিরে সেটা করতে পারছেনা। সৌভিক মনে-মনে ভয় পাচ্ছে যদি হুট করে মাহতিম এ ঘরে ঢুকে, না-জানি এই মহিলা বিবিসির দশটার খবর রটাতে থাকে। মাহতিম এখন না আসলেই চলে। এদিকে মেহনূর চুপচাপ নতমুখে বসে থাকলে পাশ থেকে ওর হাতটা শানাজ মুঠোয় চেপে ধরে। একটুখানি দৃষ্টি তুলে আড়চোখে শানাজের দিকে তাকাতেই দেখলো শানাজ শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী সকলের দৃষ্টিতে যখন অস্বস্তিতে ফাসঁলো, তখন বাধ্য হয়ে নামাজের উছিলায় নিচে চলে গেলো। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলেও মেহনূর মনের ক্যানভাসে যেই বিভীষিকা ঘটনার চিত্র এঁকে ফেলেছিলো, সেটা মুছে বড় দুঃসাধ্য ওর জন্য।
কিন্তু ফারিনের কথায় চিন্তাচেতনা থেকে সৎবিৎ ফিরে পেতেই ফারিনের মুখ থেকে শুনলো, তরুণ নাকি এখনো বাড়িতে আসেনি। ও যদি বাড়িতে ফিরে তাহলে কোনদিক থেকে যে হিংস্র হামলা ঝাঁপিয়ে পরবে সেটা ওরা জানেনা। মাহতিম নাকি নিজের রুমের ভেতর কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। দরজা যদিও আটকানো না, কিন্তু ওর বিধিনিষেধ অমান্য করা কারোর পক্ষেই সম্ভব না। সবই চুপচাপ শুনছিলো মেহনূর, সবাই চা-নাস্তার খাবারগুলোতে মুখিয়ে থাকলে মেহনূর একটা কিছুও মুখে তুললো না। শানাজ অনেকক্ষণ পর নিজের চাপা উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেললো। তীব্র উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে বললো, এই ঘটনার কথা বড়দের মধ্যে কাউকে জানাতে না।
শানাজের মা অর্থাৎ সুজলা জানলে আর কখনোই ওদের স্কুল-কলেজ যেতে দিবেনা। পথেঘাটে মানুষ ছি ছি করবে এসব ঘটনা সুজলৃর নিশ্চয়ই পছন্দ বেনা। হান্নান শেখও বাড়ির বাইরে পা ফেলতে দিবেনা। মেহনূরের মা যদিও সাদাসিধে মহিলা, কিন্তু এসব ঘটনা শুনলে তিনিও ঠান্ডা মেজাজে থাকবেননা। সবাই একমনে শানাজের কথা শুনলো কিন্তু পথে-পথে নীতি, সৌভিক, ফারিন, সামিক দফায়-দফায় বাধা দিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার জন্য রুখতে বললো। কিন্তু শানাজ সেসব কথা মানতে নারাজ। এটা মূলত শহর নয়, এটা একটা গ্রাম। এ গ্রামে একবার দূর্নাম রটে যায়, আর সেটা যদি বাড়ির ভেতর থেকেই ঘটে তাহলে মান-সম্মান সব ধূলিসাৎ হতে একসেকেন্ড লাগবেনা। জমজমাট আলোচনা দীর্ঘসময় নিয়ে শেষ করলো শানাজ। প্রতিটি পয়েন্ট সুন্দর এবং যুক্তি দিয়েই বুঝালো।
সঙ্গে এটাও বুঝালো মাহতিমকে থামতে। ও যেনো তরুণের গমনে কোনো গণ্ডগোল না করে। তরুণকে বিদায় করার জন্য চোরা পথ অবলম্বন করা লাগবে। ওর মতো ধুরন্ধর ব্যক্তকে সোজা করার জন্য ধূর্ত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এদিকে মাহতিম তরুণকে পেটানোর জন্য, মারার জন্য যেভাবে গর্জে উঠেছে সেটা এই মূহুর্তেই থামানো অত্যাবশ্যক। কেউ কোনো পথই বের করতে পারলো না, কারোর কোনো বুদ্ধিও এখানে থামানোর কাজে আসলোনা। ঘন্টা আধা পেরিয়ে গেলে সবাই নিরুপায় হয়ে নিরুদ্যম ভঙ্গিতে বসে থাকলো। কিন্তু বুদ্ধির আসল এবং মোক্ষম সূত্রটা কেবল তৌফের মাথায় আসলো। তৌফ সবাইকে মারাত্মক ভাবে চমকে দিয়ে বললো,
– শুনো এ্যাটেনশন, আমি যা বলি, যেভাবে বলি, সবই প্লিজ মনযোগ দিয়ে শুনবে। আমার মাথায় একটা সলিড-প্রুফ টিকলি এসেছে। এটা যদি খাটাতে পারি, আমার কলিজা-গুরদা সব বলছে, মাহতিম আনসারী মাস্টবি-ডেফিনটলি-সিরিয়াসলি কুপোকাত হবে!
তৌফের এমন প্যাঁচমুখো কথা শোনে সিয়াম ওর পিঠে জোরে একটা কিল বসালো। ব্যথার জন্য তৌফ ফরফর করে সবার সামনে অশ্রাব্য গালি দিলো। শেষে লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে যেয়ে মূল কথায় ফিরলো।
– আমাদের কাছে চাবি আছে, জাস্ট তালার কাছে গিয়ে চাবিটা একটু মোচড় মারা লাগবে। ব্যস, এতেই আমাদের অসাধ্য সাধন হয়ে যাবে শিওর।
তৌফ কথাটা এমন ভঙ্গিতে বললো সবাই ওর ভ্রুঁ নাচানো দৃষ্টি ধরে আসল ব্যক্তির দিকে তাকালো। একমূহুর্ত ওভাবেই নিরবতা কাটলো, কিন্তু পরক্ষণেই সমস্বরে ‘ সলিড আইডিয়া ‘ বলে জোরে হুল্লোড় তুললে, মেহনূর তখন তীব্র শব্দের জন্য বাধ্য হয়ে দুকানে হাত চাপা দিয়ে চোখ কুচঁকে ফেললো। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে মেহনূর চোখ খুলে দেখলো সবাই ওর দিকে হাসি-হাসি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর বোকা-বোকা চাহনিতে ডানে-বামে সবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কান থেকে স্লো-মোশনে হাত নামিয়ে ফেলছে। উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মৃদ্যু স্বরে থেমে-থেমে বলে,
– আ-মার দি-দিকে তাকিয়ে আ-ছো কেনো?
মেহনূর আটকতে যাওয়া কথা শুনে সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো। পরক্ষণে তৌফ ঢোক গিলে বললো,
– তুমি যদি ভাইয়ের কাছে একবার যেয়ে থামতে বলো, তাহলে ভাই কোনো হাঙ্গামা করবেনা। তুমিতো বুঝতেই পারছো আমি কি বলতে চাইছি?
মেহনূর আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– আপপনাদের কথা না শুনে ওই লোক আমার কথা শুনবে?
মেহনূরের বোকার মতো কথা শুনে সবাই মিটিমিটি হাসলো। কিন্তু এখনই কিছু ভেঙ্গে না বলে নিজ থেকে বুঝার জন্য সুযোগ রেখে দিলো। তৌফ সবার তরফ থেকে উত্তর প্রস্তুত করে বললো,
– মানে, ঘটনা হয়েছে কি, তুমিতো এখানে ভিক্টিম। এ্যাটলিস্ট তুমি যদি ভিক্টিম হয়ে আনসারী মশাইকে থুক্কু মাহতিম ভাইকে এখনই কিছু করতে না বলো, তাহলে তোমাদের জন্যই ভালো হবে। নাহলে ভাইসাব যে কাহিনী করতে পারে, সেই কাহিনী যদি এই গ্রামের মধ্যে ঘটে যায়, তাহলে পরদিন যুগান্তর পত্রিকায় এটা হেড শিরোনাম দেখতে পারবা। মাহতিম ভাইজান তো ভালো মানুষ না, এটা তো আমরা নেংটাকাল থেকেই জানি। এজন্য তোমাকে সাবধান করতেছি জলদি ভাইকে থামাও। বাড়ির সবার ফিরতে কিন্তু বেশি টাইম নেই। আমরা এদিকে শেফালী মামীকে টেক্কা মারতেছি। যাও, যাও উঠো। আর বসে থেকো না। তোমার শরীরে এখন আমাদের চেয়েও বেশি পাওয়ার। এই নীতি ছাগলের বাচ্চায় তোমাকে এক লিটার গ্লুকোজ খাইয়ে দিছে। এখন উঠো, শাড়ি ধরো, আর ভাইয়ের রুম দৌড় লাগাও।
মেহনূর আবারও সবার দিকে উজবুকের মতো তাকালো। এখন ওই তরুণের জন্য মাহতিমের রুমে যাওয়া লাগবে? তাও কিনা একা-একা যেতে হবে? কি বলবে মাহতিমকে? কিভাবে গুছিয়ে বলবে এসব কথা? যতবার মাহতিমের সামনে স্বাভাবিক চেতনা নিয়ে হাজির হয়েছে, ততবারই চেতনার নাম-নিশানা পাল্টে দিয়ে অস্থির অবস্থায় কাঠ-কাঠ হয়ে গিয়েছে মেহনূর। এবার এই ভয়াবহ অস্থিরতার জন্য দেহ থেকে প্রাণ বের হয়ে যায় কিনা, কে জানে?
বাঘের আস্তানায় গর্জন থামানোর জন্য পা বাড়ালো মেহনূর। ভয়ের তীব্রতায় মনের অবস্থা বড়োই নাজেহাল। প্রচণ্ড ভয়ের জন্য গায়ের পশম কাটা দিয়ে দাড়িয়ে গেছে, পা চালাতেও প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে। শুস্ক গলায় কয়েকবার ঢোক গিললো মেহনূর, বদ্ধ দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আগে বুকে তিনবার ফুঁ দিলো। ঠান্ডা ও অসাড় হয়ে আসা শরীরটা দরজার একদম নিকটে নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ধাক্কা মারলো। ক্যাচ করে একটা শব্দ তুলে বদ্ধ দরজাটা খুলে গেলো। তখনই রুমের আবছা অন্ধকারে জানালার কাছে আবিস্কার করলো লম্বা দেহের মানুষটাকে। সেই মানুষটা জানালার দিকে মুখ দিয়ে কঠোরভাবে দাড়িয়ে আছে। তার পেশিবহুল হাতদুটো প্যান্টের দু’পকেটে গুঁজিয়ে রেখেছে।
বাইরে থেকে আসা রাস্তার আলোতে এটুকু বুঝা যাচ্ছিলো, তার গায়ে কোনো টিশার্ট নেই। সেই উন্মুক্ত গায়ের উপর ঘামের আস্তরণ লেপ্টে কেমন যেনো চকচক করছিলো। মোটা-মোটা মাংসপেশীগুলো খাপে-খাপে ফুলা তার, চওড়া কাধের মানুষটার দেহ আসলেই আর্কষণীয়। জিমখানার সেই বডি-বিল্ডারদের মতো চোখ ধাঁধানো। দেখতে বিশাল দেহের মানুষ, সেই সঙ্গে উচ্চতাও যেনো অতুলনীয়। লোকটা যদি নিজের বউকে কখনো জড়িয়ে ধরে, তাহলে সেই মেয়ে কি আদৌ নিশ্বাস নিতে পারবে? দম আটকে মারা যাবেনা? সাথে সাথে ধিক্কার দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো মেহনূর। অসভ্য-অভদ্র চিন্তা করার জন্য নিজেকে দু’স্তবক গালাগাল দিয়ে সেই রুমের ভেতর পা ফেলে ঢুকলো। মাহতিমের কানে স্পষ্টভাবে সেই পদজোড়ার শব্দ আসছে। পরিচিত সেই শব্দের জন্য কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও তৎক্ষণাৎ নিজেকে শান্ত করে নিলো। পেছন থেকে আসা আগত বালিকার জন্য কাঠিন্য সুরে বললো,
– কি জন্য এখানে আসা হয়েছে?
পা থামিয়ে চমকে উঠলেও কোনো শব্দ উচ্চারণ করলোনা মেহনূর। কিছুক্ষণ বোকার মতো চুপ থেকে ধীরে-ধীরে গলা খুলে বললো,
– আপনার সাথে দুটো কথা ছিলো।
কথাটা শুনে কোনো হেলদোল হলো না মাহতিমের। যেভাবে দাড়িয়ে ছিলো, সেভাবেই দাড়িয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলোনা সে। চোখের দৃষ্টি আকাশের দিকে স্থির করে চুপ করে রইলো। ঠিক ওইসময় বাইরে একটা পিকআপ গাড়ি থামলে সেই গাড়ির আলোতে রুমের অন্ধকার যেনো একটুখানি কমলো। মেহনূর আবারও দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে তাকালো। কিন্তু সেই দৃষ্টি আর নিচে নামাতে পারলোনা মেহনূর, শত চেষ্টা করেও পারলোনা তখন। ভীতু চাহনির দৃষ্টিটা হঠাৎই যেনো শান্ত হয়ে গেলো ওর। শুধু মাহতিমের পিঠটার দিকে যেনো সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। হৃদযন্ত্রের বেসামাল ধুকপুকনি ধীরে-ধীরে যেনো কমতে লাগলো। সকল ভয় অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেলো কেনো জানি। এতোদিন লোকটাকে টিশার্টের মধ্যেই দেখেছে, টিশার্টের ভেতরেই ভয়ংকর ফিটনেস বুঝা যেতো লোকটার। হাতের বাইসেপ্স মাশলের জন্য টিশার্টের শর্ট-সিল্ভও কুপোকাত হয়ে যেতো। এই লোকটা নিজেকে এতো বড়-বড় করে, তাহলে ইয়াংদের মতো কিভাবে বডি-ফিটনেস ধরে রেখেছে? বয়স কতো? ত্রিশের ওসপার? নাকি আরো বেশি? চিন্তার দুয়ারে কড়া নাড়তেই মাহতিমের গমগম সুর যেনো ওকে বাস্তবে টেনে আনল,
– এখানে দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলে যাও এখান থেকে।
মেহনূর এমন কিছুই শুনবে ভেবেছিলো, আর সেটাই কিনা কাটায়-কাটায় মিলে গেলো। কিন্তু এখনই হার মানলে চলবেনা। সৌভিক বলে দিয়েছে, এই লোকটা যেই পযর্ন্ত কমিটমেন্ট আকারে রাজি হবেনা, সেই পযর্ন্ত কোনোভাবেই আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাবেনা। এই মাহতিম আনসারী একবার যেটা বলে, সেটা আকাশ-পাতাল উলটে গেলেও গড়ায়-দণ্ডায় করে ছাড়ে। মেহনূর আরেকটু সাহস জুগিয়ে মাহতিমের দিকে এগিয়ে গেলো। মাহতিমের বাঁপাশে এসে জানালার কাছে দাড়াঁলো। নিচু করে রাখা চোখদুটো ডানে ফিরিয়ে মাহতিমের মুখের দিকে ধীরগতিতে তুলতে লাগলো। মাহতিমের মুখের বাঁপাশটা কেবল দেখা যাচ্ছিলো, আর তাতেই মেহনূরের গলা যেনো শুকিয়ে খসখস হয়ে গেছে। মাহতিমের মুখটার দিকে দৃষ্টি তুলে তাকালে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বায়ে তাকালো মাহতিম। শান্ত অথচ কঠোর দৃষ্টি দিয়ে একপলক ভীতু প্রাণীটিকে দেখে আবার আকাশের দিকে তাকালো। মেহনূর কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মিনমিন করে বললো,
– আপনি তরুণ ভাইয়ার জন্য বাড়িতে কোনো ঝামেলা করবেন না। আপনার একটা ঝামেলার জন্য আমি প্রচুর বিপদে পরবো। আমার দাদাভাইয়ের নাক কাটা যাবে। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আপনি দয়া করে আজকের ঘটনাটা বাইরে ফাঁস করবেন না।
মেহনূর কথাটুকু শেষ করে আবার মাহতিমের মুখের দিকে তাকালো। উত্তরের জন্য যখন অনিমেষ নেত্রেই চেয়ে রইলো তখন ভীষণ অসহায় অনুভব করছিলো মেহনূর। মানুষ যে কতোটা খারাপভাবে বিশ্রী ঘটনা রটিয়ে দিবে সেটা চিন্তা করলেই কান্না পায়। তারা যদি তরুণের ঘটনা জানতে পারে তাহলে মোল্লাবাড়ি নিয়ে সাত গ্রাম পযর্ন্ত থু-থু করতে থাকবে। মেহনূর আসন্ন বিপদ নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে পাশ থেকে মাহতিম শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো নাকি আমার তাণ্ডবলীলার জন্য টেনশন করছো?
প্রশ্নটা ছুঁড়েই মাহতিম পকেটে হাত গুঁজানো অবস্থায় ওর দিকে ফিরলো, মুখোমুখি হয়ে ওর ভীত মুখটার দিকে দৃষ্টি ফেলে অটল হয়ে দাঁড়ালো। খসখসে গলায় ঢোক গিলে মেহনূর ওর দিকে ধীরগতিতে দৃষ্টি তুলতে লাগলো। আবারও তীব্র উত্তেজনায় বুকের ভেতর হাতুড়ি চালনা হচ্ছে, নিশ্বাস হয়ে আসছে দীর্ঘ-ঘণ-গভীর। মাহতিম আনসারীর মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না তখন, বুক পযর্ন্ত দৃষ্টি তুলেই দাঁত শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেললো মেহনূর। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে কঠোরভাবে শক্ত হয়ে গেলো ও। শরীরের ভেতর যেনো অদ্ভুত শিরশিরে ভাব অনুভূত হচ্ছে, সেই শিরশির অনুভূতির জন্য শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুতের মতো ঝিমঝিম করছে।
মেহনূরকে ওমন অবস্থায় দেখে চোখ তীক্ষ্ম করে কৌতুহলমিশ্রিত চাহনিতে তাকালো মাহতিম। প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে সে মেহনূরের দিকে এক-কদম এগিয়ে গেলো। মেহনূর রুমে ঢুকার পর যেই সুঘ্রাণযুক্ত গন্ধটা মৃদ্যু আঁচে টের পাচ্ছিলো, সেই গন্ধটা আকস্মিকভাবে তীব্র হয়ে ঠেকলো এখন। এটা কিসের ঘ্রাণ? এটা কি কোনোভাবে ক্লোরোফর্মের গন্ধ? ক্লোরোফর্মের গন্ধ কি এরকম হয়? ধুর, যদি হয়েও থাকে তাহলে এই ব্যাটা কি কারণে সেটা ইউজ করবে? মেহনূর চোখ না খুলেই যতসব হাবিজাবি চিন্তা করতে থাকলো, অথচ একজোড়া সুতীক্ষ্ম চোখ ওর মুখের দিকে গাঢ়দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলকে-পলকে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই মাহতিম আনসারী বলে উঠে,
– আমার রুমে যেহেতু এসেছো, আমার দিকে তাকানোর সাহসটাও রাখা উচিত। চোখ খুলে আমার দিকে আই-টু-আই কন্টাক্ট করো।
মেহনূর এটুকু বুঝতে পারলো মাহতিম বর্তমানে ওর কাছে এসে দাড়িয়েছে। ওর মুখের দিকে ভয়ানক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। এদিকে উপায়ন্তর খুঁজাও যখন বৃথা হয়ে দাঁড়ালো, তখন বাধ্য হয়ে মেহনূর নিজের চোখ খুলে মাহতিমের দিকে পিটপিট করে তাকালো। শান্ত-কঠোর-অক্ষুণ্ণ চাহনির মাঝে নিজের ভীত চাহনিটা সম্পূর্ণরূপে আটকা পরে গেলো মেহনূরের। চোখ সরানো তখন দূরের কথা, চোখের পলকও যেনো পরলো না। শুধু ওই সম্মোহন চাহনির মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আস্তে-আস্তে ঢোক গিললো মেহনূর। মাহতিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাচ্ছিল্যের সুরে কঠোর ভঙ্গিতে বললো,
– তোমার ওই ‘ তরুণ ভাই ‘ যদি ভুলেও আমার সামনে আসে, আমি কিন্তু ওর জন্য স্পেশাল গোরখোদক হবো।
গোরের কথা শুনে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো মেহনূরের। ভয়ে চুপসে গেলেও নিজেকে বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখিয়ে ধাতস্থ সুরে বললো,
– কি দরকার এসব করার? যে যেভাবে আছে, সে সেভাবেই থাকুক, আপনার এখানে কিছুই করতে হবেনা। আপনি কেনো মাতামাতি করতে চাইছেন?
মাহতিম এবার চোখ সরু করে তাকালো কাধের নিচে পরে থাকা মেহনূরের দিকে মাথা নুইয়ে সুক্ষ্ম মেজাজ দেখিয়ে বললো,
– তোমার জায়গায় যদি নীতি,প্রীতি বা ফারিন হতো, তাহলে ওই তরুণের নামের আগে ‘ ম-রহুম ‘ শব্দ যুক্ত হতে বেশি সময় লাগতো না। কিন্তু তুমিতো আমার কিছুই হও না। ঠিকই বলেছো, আমারতো তোমার ম্যাটার নিয়ে মাতামাতি করার দরকার নেই। তোমার মতো বলদের জন্য নিজের হাত তো আমি নষ্ট করতে পারিনা। সো, গো-টু-হ্যা-ল! আমার সামনে থেকে নিজের ভীতু মুখখানি নিয়ে বিদায় হও। চেষ্টা করবে ভুলেও আমার সামনে যেনো না পরো। নইলে আমি রাগের মাথায় কেমন আচরণ করবো নিজেও জানিনা। চলে যাও এখান থেকে!
প্রচণ্ড রাগটা সামলে নিলেও শেষোক্ত কথাটা চড়া গলায় বললো মাহতিম। মেহনূরকে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। মাহতিমের খোঁচা-অপমান-গন্ঞ্জনা শুনে মেহনূর নতমুখে ধীরে-ধীরে চলে যেতে থাকলো। মাহতিম তখন উত্তেজিত রাগটা সামলানোর জন্য জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে থাকলো। একপর্যায়ে পকেট থেকে ফোন বের করে সেটা আছাড় মারতে নিলো, কিন্তু পরক্ষণে শূন্যে উঠিয়েও আর ছুড়ে মারলো না মাহতিম। চূড়ান্ত রাগটা সামলে নিয়ে ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো তখন। ফোনটা আবারও পকেটের ফাঁকে ফেলে মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। ঘিয়ে রঙের শাড়িটা অন্ধকারেও উজ্জল হয়ে আছে, মাথার বেণীটা পিঠ থেকে হাটু পযর্ন্ত মায়াবী বালিকার চিত্র প্রদর্শন করছে।
ছোট-ছোট পায়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। জানালার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে বন্ধচোখে ভাবতে লাগলো, ওই পাদুটো আটকানোর জন্য আসল যোগ্যতা কি ওর আছে? যদি কখনো যোগ্যতা এসে যায় ও কি গ্রহণ করবে? মাহতিম সবসময় চাইতো এমন কেউ আসুক, যে তার কাছে চেয়ে-চেয়ে ভালোবাসার আবদার করবে। ব্যস্ত মাহতিমের হাতদুটো টেনে কোমরে রেখে বলবে, উপরে তুলুন আপনার কোমল ওষ্ঠযুগলের স্পর্শ নিতে চাই। কাজের মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলুক, আপনার বাহুগুলোর মধ্যে গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমাতে চাই। এতো আবদারের জন্য যেই মানুষটা দরকার সেই মানুষটাও নেই। এসব চিন্তা করলে সবসময় আফসোসের শূণ্যতা ভর করে ওর। মাহতিম বুকভর্তি নিঃশ্বাস টেনে চোখ খুলে দেখলো, জীবনের মতোই রুমটা নিঃশব্দ-নিঃসঙ্গ-ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই।
এশারের একটু পরেই বাড়িতে ফিরলো মাহমুদা। এসেই দেখেন উঠানের বাতি আজ নিভানো। তিনি কিছুটা অবাক হলেও চুপচাপ বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আঙিনার লাইট জ্বললেও সেখানে কেউ ছিলোনা। তার মানে সুজলা ভাবী, মারজা আপা এখনো আসেনি। মাহমুদা মাথার ঘোমটাটা কপাল পযর্ন্ত টেনে আনলেন। এরপর মেয়েকে একবার দেখার জন্য সবার আগে মেহনূরের রুমে গেলেন। দরজার সমুখে দাড়িঁয়ে পর্দা সরিয়ে দেখলেন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মেহনূর। যখন সেদিকে ভালোমতো তাকালেন তখনই আশ্চর্য হয়ে বিছানার দিকে ছুটে গেলেন মাহমুদা। বিছানায় বসে মেয়েকে দ্রুত নিজের দিকে ঘুরাতেই নানা অস্থির বাক্যে বলতে লাগলেন,
– মা রে, তুই কাদছিস কেন? কেউ কি কিছু বলেছে? মেহনূর, তাকা মা। বাড়িতে কেউ কিছু বলেছে? শেফালী ভাবী কিছু —
কথার মাঝখানে আটকে গেলেন মাহমুদা দমে-দমে ফুলে উঠা পিঠটা নিয়ে বালিশ থেকে মুখ তুলে তাকালো মেহনূর। চোখদুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে রক্তিম হয়ে আছে। এখনো গাল বেয়ে অশ্রুফোঁটা বর্ষণ হচ্ছে ওর। মাহমুদা তীব্র উৎকন্ঠায় আচঁল টেনে মেহনূরের গাল মুছে দিতে লাগলেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কেনো ও কাঁদছে, উনার অনুপস্থিতিতে কেউ কি কিছু বলেছে? নিঃশব্দে কান্নার আওয়াজ যেনো ফিসফিস করে শোনা যাচ্ছে ওর। মাহমুদা আর সহ্য করতে না পেরে এবার ক্রোধ দেখিয়ে জোর দিয়ে জানতে চাইলো। মেহনূর অশ্রুপূর্ণ চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালেও আবার দৃষ্টি নামিয়ে মৃদ্যু সুরে বললো,
– তুমি কারণ শুনে কি কিছু করতে পারবে? কখনো তুমি আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছো? মেজো মা, সুরাইয়া বুবু প্রতিদিন আমাকে কথা শোনায়, তোমাকে ইচ্ছেমতো খোটা দেয়, আব্বাকে নিয়েও যা-তা করে কথা বলে। এসব শুনেও তুমি কিছু করতে পেরেছো? আব্বা বিদেশে দিন-রাত এক করে খাটে, আর সেই খাটুনির টাকায় ওরা নাম ফুটায়। আম্মা ছোট থেকে বড় হলাম ঠিকই, কিন্তু অন্যের লাত্থি-উষ্ট্রা খেয়েই বড় হতে হয়েছে। দাদাভাই সারাদিন বাইরে চলে গেলে ওরা দুজন মিলে বাড়ি চষে খায়। এতোসব দেখেও তুমি কিছু করো না, ওদের কিছু বলো না। আমাকে তুমি ভালোবাসো না আম্মা। তুমি যদি আমাকে মূল্য করতে তাহলে এই বাড়িতে রাখতে না। ওরা কেউ ভালো না।
মাহমুদা এমন কঠিন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বাকশক্তি হারানোর মতো চুপ করে রইলেন। এদিকে মেহনূর চোখ মুছে ঢোক গিলে আবার কান্নাসুরে বলে উঠলো,
– মেজো মা যদি প্রতিবাদ না করে তাহলে কেউ আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেনা। আমি ঝগড়া করতে পারিনা দেখে সবাই ইচ্ছেমতো আমাকে কথা শুনিয়ে যায়। যখন মন চায় আমাকে মারে, চুল ধরে ব্যথা দেয়, এটা-ওটা কাজ করতে দেয়, যা খুশী সবকিছু আমাকে দিয়ে করায়। আমি কোনোদিন অবাধ্য হইনি, কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু সবাই আমাকে কষ্ট দিয়ে যায়। জানো আম্মা, দুনিয়ায় সরল-সহজ মানুষদের জায়গা নেই।
মূঢ় অবস্থায় স্থির হয়ে আছে মাহমুদা। চোখের সামনে মেয়ের ফুপাঁনো কান্না দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন। কি করবেন, কি বলবেন, কি বুঝাবেন কিছুই উনার মাথায় ঢুকলোনা। মাহমুদা সবসময়ের মতোই শান্ত-চুপচাপ-সহজ মনের মহিলা। আজও এমন বৈরি অবস্থা দেখে তিনি কিছুই বললেন না। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখ মুছিয়ে কাছে টেনে নিলেন। ছোট্ট মেহনূর যে বড় হওয়ার পরও ছোটদের মতোই অশ্রু ঝরাচ্ছে সেটা দেখে তিনি মৃদ্যু হাসলেন। মেয়ের কপালে স্নেহমায়ায় গাঢ় চুমু খেয়ে বুকে মাথা টেনে আগলে ধরলেন। মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিতেই কান্না কমে এলো ওর। স্বল্প সময়ের মধ্যে কান্না থেমে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মায়ের পরিচিত উষ্ণতায় গা মিশিয়ে ঘুমিয়ে পরলো মেহনূর। আজকের বীভৎস ঘটনার উপর চাঁদর টেনে দিয়ে ক্লান্ত মনে ঘুমিয়ে গেলো।
বাড়ির সদস্য এক-এক করে ফিরে এলে সবাই একসঙ্গে খাবার খেয়ে নিলো। নীতি, সৌভিকরা আনমনে খাবার খেয়ে উঠলো। মাহমুদা নিজের উদাস মুখটা যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করলো। এদিকে মাহতিম কোনোরকমে দু-লোকমা গিলে নিজের রুমে ফিরে এলো। ওর পিছু-পিছু কয়েক মিনিটের মধ্যে নীতিরা এসে উপস্থিত। মাহতিম বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ লাগিয়ে আধশোয়া স্টাইলে ফোন টিপছিলো। মাহতিমের মুডের অবস্থা দেখে কারোর কথা বলার সাহস হচ্ছেনা। এদিকে নিজেদের মধ্যে ইশারায় কথা চললে শেষে নীতি বলে উঠলো,
– ভাইয়া তুমি কি ঠিক আছো?
মাহতিম একপলক দৃষ্টি তুলে নীতির দিকে তাকালো, পরক্ষণে ফোনের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে শান্ত সুরে বললো,
– আমার কি কিছু হওয়ার কথা ছিলো?
নীতি সাথে-সাথে মাথাটা ‘ না ‘ বোধকে নাড়িয়ে অস্থির কন্ঠে বললো,
– না না, সেটা হবে কেনো? তোমার মুড যে এমন খারাপ হয়ে আছে, সেটাই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি আরকি।
মাহতিম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে আবার বলে উঠলো,
– ওই রামবলদকে তোরাই রুমে পাঠিয়েছিলি ঠিকনা?
এমন সম্বোধন শুনে নীতি ফিক করে হেসে দিতেও সামলে নিলো। পেছন থেকে তৌফ বলে উঠলো,
– রামবলদ না পল্ট্রি মুরগি সেটা সময় আসলেই বুঝবি। যাইহোক, মেহনূর যখন রুম থেকে বের হলো, তখন তুই উদাম গায়ে কি করতাছিলি?
মাহতিম তৎক্ষণাৎ এমন কথা শুনে তৌফের দিকে তাকালো। ভ্রুঁ উঁচু প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– মানুষ উদাম গায়ে কি করে?
তৌফের পাশ থেকে সিয়াম একগাল হাসি দিয়ে মেয়েদের মতো লজ্জামাখা ভঙ্গিতে বললো,
– যাহ্ দুষ্টু, খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে।
সিয়ামের মেয়েলি ঢঙ দেখে ফিসফিস করে হেসে দিলো সবাই। এদিকে সিয়ামের ঘটনার সূত্র ধরে তৌফ অনুযোগের সুরে বললো,
– সত্যটা কও তো মামা, তুমি টিশার্ট খুইলা কি আকামটা করতে চাইছিলা। অন্ধকার তো ভালোই ছিলো, তার উপর সুন্দরী নিজেই তোমার রুমে পদধূলি দিতে আসছিলো। তুমি কি আবার চান্স মারলা নাকি বন্ধু?
মাহতিম টু শব্দ পযর্ন্ত না করে ডানহাতের তর্জনী তুলে জানালার দিকে ইশারা করলো। সবাই ইশারা অনুযায়ী সেদিকে তাকালে দেখতে পেলো, একটা মোটা-লম্বা শক্ত মতোন পাথর জানালার নিচে রাখা। সেই পাথরটা যে রাগ কমানোর জন্য ব্যায়ামের কাজে ডাম্বেলের মতো লেগেছে, সেটা বুঝা শেষ সবার। তরুণ এখনো বাড়িতে ফিরেনি, আর ফিরলেও সম্ভবত মাহতিম কিছু করবেনা। কিন্তু মেহনূরের সাথে কি কথা হয়েছে সেটাও ওরা জানেনা।
মাহতিমের রুম থেকে মলিন মুখ নিয়েই বেরিয়েছে মেহনূর, সেখানে মাহতিম ওকে কিছুই বলেনি। ওরা সবাই দূর থেকে এক্সপেক্ট করছিলো হয়তো মাহতিম যখন মেহনূরকে দেখবে তাদের মধ্যে কিছু-না-কিছু ঠিকই কানেক্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হওয়া তো দূরের ব্যাপার, উলটো মাহতিমের চড়ানো আওয়াজের ধমক শুনে সবাই স্থির হয়ে যায়।
রাত তখন দুটো বাজে। পাড়া-পড়শি-সহ বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণে আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। কিন্তু প্রকৃতির নিরবতা যতো নিস্তব্ধ আকারে নিঃশব্দ হচ্ছে, ততই যেনো একজনের বুকে ভয়ের গোলাটা দারুণভাবে ভীত করে তুলছে। নাকের নিচে মলম লাগানো, হাতের কনুইয়ে ওয়ান-টাইম ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। মানুষটা যে বিকেলের দিকে জঘন্য একটা ঘটনা করে বেরিয়েছে সেটা বাড়ির বয়োজোষ্ঠরা জানেনা।
যারা জানে তারা কেউ জেগে নেই এখন। তরুণ চুপচাপ অন্ধকার উঠান পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়লো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কড়া নাড়তেই দেখলো দরজাটা খোলা। প্রচণ্ড আশ্চর্য হলেও মনে-মনে খুশী হলো তরুণ। যাক বাবা, দরজা যে ভুলবশত না লাগিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, এতে ওর জন্য ভালোই হয়েছে। তরুণ হাসিখুশি মনে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। দরজা আটঁকে আঙিনার দিকে তাকালো। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা, তাই চোখ সয়ে চলার জন্য একটু অপেক্ষা করলো তরুণ। চোখ যখন অন্ধকারে সয়ে এলো তখন দর্প ভঙ্গিতে পা বারিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো তরুণ। দরজাটায় ছিটকিনি দিয়ে বিছানায় এসে বসলো।
জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে আবার উঠে আয়নার সামনে গেলো। আয়নার পাশেই সুইচবোর্ড দেওয়া, তাই লাইটের জন্য সুইচ টিপতে লাগলো। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আশ্চর্য হয়ে দেখলো লাইটও আজ কাজ করছেনা। বাধ্য হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে কাঠের টেবিলে সেটা রাখলো। দেয়ালে ঝুলানো বর্গাকার আয়নায় মুখটা দেখতে গেলো। নাকের নিচটা অনেকখানি কেটে গেছে। তর্জনী আঙ্গুলটা দিয়ে কাটা জায়গায় আলতো ভাবে স্পর্শ করতেই হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পরলো ওর। আয়নার ভেতর যেই প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো, সেটা দেখে অস্ফুট সুরে শিউরে উঠরো তরুণ!
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১১+১২
চোখদুটো গোল গোল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনের ভ্রম নাকি সত্য, সেটা বুঝার জন্য তাড়াতাড়ি দুহাতে চোখ কচলাতে লাগলো, কিন্তু না, মনের ভ্রম না। আয়নায় যেই পুরুষমূর্তি দেখা যাচ্ছে, সেটা মিথ্যা না। সত্যি-সত্যিই তরুণের পিছনে সেই পুরুষমূর্তি দাড়িয়ে আছে, ভয়াবহ দৃষ্টি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের বক্ষস্থল থেকে গলা পযর্ন্ত শুকিয়ে এলো তরুণের, কথা বলতেও যেনো জিহবা ভার লাগছে।
