মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪২+৪৩

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪২+৪৩
ফাবিয়াহ্ মমো

সূর্যের চাকাটা সম্পূর্ণ আলো হরণ করে চারধার অন্ধকার করে দিলো। প্রকৃতি যেনো নিরব হতে গিয়ে কুয়াশার প্রহেলিকায় ঘাপটি মেরে বসলো। কেমন শূন্য শূন্য আবহাওয়া চারপাশে ছড়িয়ে আছে, শূন্যতার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে নিঃশব্দ রুমটা। আলোহীন রুম, সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালানোর ইচ্ছে জাগেনি। খোলা জানালাটা লম্বা-লম্বা পর্দা দ্বারা আবৃত, বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়াটা পর্দার বুক ফুলিয়ে শূন্যে তুলে দিচ্ছে, ওমনেই রুমের ভেতর প্রবেশ করছে দূরের নিয়নবাতির টিমটিমে আলো। স্টাডিটেবিলকে সামনে রেখে রকিং চেয়ারে বসে আছে মাহতিম। তার চোখের কপাটদুটো ক্লান্ত ভঙ্গিতে বন্ধ করে রেখেছে।

মনের ভেতর বহুচিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আজ। সেসব চিন্তাগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সজ্জিত করে ভাবছে, একে-একে সব চিন্তার সমাধান ওই অন্ধকার রুমে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভাবছে। এসময় যদি এক কাপ গরম কিছুর আয়োজন হতো, তবে মন্দ হতো না। কিন্তু আবদার করতেও এখন সংযত থাকা লাগবে, যতটুকু সান্নিধ্য মেহনূরের প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই সে পূরণ করবে। মন তো সবসময়ই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চায়, মনের সব খোরাক যদি সাথে-সাথে পূরণ হতো, তবে অপেক্ষার পর সুমিষ্ট আনন্দটা এতো উপভোগ্য ঠেকতো না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বন্ধ দরজাটা কে যেনো খুলছে, নব্ মোচড়ে অতি সাবধানে রুমের ভেতরে পা রেখেছে, আবার সুন্দর করে দরজাটা আগের মতো বন্ধও করে দিলো। মাহতিমের কর্ণধার হামেশার মতো এখনো সজাগ, সমস্ত ইন্দ্রিয় খুব সচলভাবেই চালনা করছে সে। যে মানুষটা রুমে ঢুকেছে তার পায়ের আওয়াজটাও কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস আঁটকে অনুভব করলো, অনুমান শেষে নিঃশ্বাসটা স্বাভাবিক ভাবে ছেড়ে দিতেই ততক্ষণে উক্ত ব্যক্তি নিকটে এসে হাজির। বুকভর্তি লম্বা নিশ্বাস টানলো মাহতিম, এটাও তার নিজস্ব কায়দা। বাতাসে যেই গায়ের গন্ধ মিশে যায়, সেই গন্ধটা টেনে আরেকবার পরোখের কাজটা সেরে নিলো। রকিং চেয়ারে মাথা ও পিঠ হেলানো অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখেই মাহতিম উক্ত ব্যক্তিকে চমকে দিয়ে বললো,

– আমি জেগে আছি মেহনূর। লুকোচুরির প্রয়োজন নেই।
আশ্চর্য হয়ে গলার কন্ঠনালি পযর্ন্ত শুকিয়ে গেলো। যেই মানুষটা চোখ বুজে প্রায় নিদ্রা মৌনে শান্ত হয়ে আছে, সে কি করে ঠিকঠাক অনুমানটা করতে পেলো? মাহতিম কি কানে ব্লুটুথ ডিভাইস লাগিয়েছে, বা এমন কিছু সিস্টেম আছে যেটা দ্বারা সে চোখ বুজেও সঠিক অনুমান করতে পারে? মেহনূর অবাক দৃষ্টিতে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ একজোড়া চোখ চট করে তাক হলো। সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে ফেললো মেহনূর। আশ্চর্য অবস্থার রেশ এখনো কাটেনি, বারবার চোরা দৃষ্টি দিয়ে মাহতিমকে একটু-একটু করে দেখছে। এমন অদ্ভুত মানুষ দ্বিতীয়টি দেখেনি মেহনূর, অন্ধকারের মধ্যেও মানুষটা যেনো সবই টের পাচ্ছে। আধো-আধো গলায় আবছা সুরে সঙ্কোচের সাথে বললো মেহনূর,

– আ-আ-আপনি কি করে বুঝলেন?
ফিসফিস করে হেসে দিলো মাহতিম। হাসিটা চোখে-মুখে স্থায়ী রেখে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা আবদ্ধ করে হাসি আঁটকালো, হাসির ছলকে তাকিয়ে থাকতেই তর্জনীটা দুবার নাড়িয়ে কাছে আসার ইশারা করলো। তর্জনীর নাড়ানো দেখে ঢোক গিললো মেহনূর। একবার থেমে যাওয়া তর্জনীর দিকে তাকালো সে, আরেকবার হাঁশফাঁশ দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো। কালো শার্ট গায়ে হুড়ি পরা লোকটা এখনো নিচের ঠোঁট কামড়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে, মেহনূর মাথাটা নিচে ঝুঁকিয়ে চেয়ারটার দিকে দু’কদম এগিয়ে যেতে লাগলো। রকিং চেয়ারটাও ‘ ঘ্যাড়ঘ্যাড় ‘ জাতীয় শব্দ করে উঠলে আড়চোখে দেখতে পেলো, মানুষটা এখন আর হেলে নেই।

সে এখন সোজা হয়ে বসেছে, খুব দক্ষতার সাথে ফ্লোরে পা ঠুকে চেয়ারটা সম্পূর্ণরূপে মেহনূরের মুখোমুখি করে নিলো, মেহনূর এসে পায়ের কাছে দাঁড়ালে নিজের শূন্য হাতদুটো বাড়িয়ে দিলো মাহতিম। দুটো বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে একবার-একবার করে দৃষ্টি দিলো মেহনূর, নত চোখজোড়া বেখেয়ালি ভাবে উপরে তুলতে নিলে হঠাৎ সম্মোহন আবেশে থমকে গেলো সে। স্থির দৃষ্টির মাঝে হাসিমাখা চোখদুটো কেমন করে যেনো একীভূত হয়ে গেলো, মেহনূর একবারের জন্যও পলক ফেলার কথা চিন্তা করতে পারলো না।

ধীরে-ধীরে বাড়িয়ে দেওয়া হাতদুটোর দিকে আনমনে হাত তুলতে লাগলো, নির্বিঘ্নে শূন্য হাতদুটোর উপর নিজের হাতজোড়া ধীরভাবে ছেড়ে দিতে থাকলো মেহনূর। ধীরগতিটা সহ্য হলো না মাহতিমের, সেই ধীরগতিকে এক লহমায় উপেক্ষা করে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠোবন্দি করে সে নিজেই খাবলে ধরলো। শিরশির করে শিউরে উঠার সুযোগও পেলোনা মেহনূর, ক্ষণিকের ভেতর অকুন্ঠ হৃদয়ে হেঁচকা টান মারলো মাহতিম। পায়ের তলা থেকে ফ্লোরের সাদা টাইলস হড়কে যেতেই তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচে ফেললো মেহনূর, ভয়ে হৃৎপিন্ডটা যেনো একলাফ দিয়ে গলায় বসে গেছে। কিছুক্ষণ হা করে আতঙ্কের নিশ্বাসগুলো ছাড়তেই ছোট-ছোট চোখে তাকালো মেহনূর, বুকটা এখনো হুল্লোড় অবস্থায় ঢিপঢিপ করছে।

ঠোঁট-গলা শুকিয়ে চৌচির যেনো, পানির জন্য খাঁ খাঁ করে দামাল করছে। কপালের উপর বিন্দু-বিন্দু ঘামও জমে গেছে মেহনূরের, ঘামের আস্তরনের উপর ছোট চুল এসে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে। লেপ্টানো চুলগুলো ডানহাতে সরিয়ে দিলো মাহতিম, সেই হাতটা দিয়েই মেহনূরের গালটা আদর করে ধরলো। মাথার পেছন থেকে খোপা পাঁকানো ব্যান্ডটা খুলে নিতেই বন্দি খাঁচার পাখির মতো কেশরাশি মুক্ত হতে লাগলো, প্রথমে ঘাড় ছুঁয়ে পিঠের উপর পরলো, এরপর অবাধে পিঠ ছাড়িয়ে ঝপ করে ফ্লোরের উপর জমা হলো। গালটা ধরে নিজের কাছে আনলো মাহতিম, সরু-চিকন নাকটার ডগায় আলতো করে নিজের নাক ছুঁইয়ে নিলো। অনুভূতির কাছে নত স্বীকার করে ফের চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, মুক্ত হাতদুটো দিয়ে বেখেয়ালেই হোক, বা ইচ্ছাকৃত, সে মাহতিমের কলার দুটো হালকা করে চেপে ধরলো। নাকের উপর ছোট্ট স্পর্শ ছাপিয়ে শীতল কন্ঠে নরম সুরে বললো,

– তোমাকে চেনার জন্য বেশি কিছুর দরকার নেই।
উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকালো মেহনূর। চোখ খুলে চকিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– কেনো?
আবার হাসলো মাহতিম। গাল থেকে হাত সরিয়ে কোমরের ডানপাশটায় রেখে দিলো, মোলায়েম কন্ঠে ধীরভাবে বললো,
– মনে নেই?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ কাটা জায়গায় চুমুর ঘটনা মনে পরলো তার। আকস্মিক লজ্জায় চোখ নামিয়ে স্ফুট সুরে বললো মেহনূর,
– জ্বী।

লজ্জায় ছোটোখাটো হওয়া মুখটার দিকে দৃষ্টি রেখে চেয়ারে পিঠ ছেড়ে দিলো মাহতিম। কলার থেকে মেহনূরের হাতদুটো ফসকে যেতেই মেহনূর চোখ খুলে তাকালো। চেয়ারের দুই হ্যান্ডেলে সোজা করে হাত রাখলো মাহতিম, নরম রূপটা সাইডে ফেলে এবার যেনো মূখ্য রূপে ফিরে আসলো। মেহনূর হাসিশূন্য মুখটার কারণ ধরতে পারলো না, অকস্মাৎ লজ্জার বরফটা পানি হয়ে কৌতুহলের সাগরে হারিয়ে গেলো তার। সহজ রূপ পালটে কাঠিন্যের মোড়কে আবদ্ধ হলো মাহতিম, গলায় ঝাঁঝ-তেজ-দাপট মিশিয়ে বললো,
– আমাকে যদি কেউ ঠাস করে চ’ড় মারে, এর পরিবর্তে তুমি তাকে কি করবে? কোনো মিনমিনে জবাব চাই না। স্ট্যাট-কাট কোয়েশ্চ্যান করেছি, স্ট্যাট-কাট আন্সার দিবে। ভেলকিবাজি আমার সামনে করার চিন্তা করবে না মেহনূর। ভালো মানুষের মতো উত্তর দাও।
কথার তেজ দেখেই অবাক হয়ে গেলো মেহনূর। এই মূহুর্তে তাড়াতাড়ি জবাব না দিলে স্থিতি-পরিস্থিতি দুটো বাজে হয়ে যাবে। মেহনূর কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে মাহতিমের দিকে বললো,

– ওটা অবস্থার উপর নির্ভর করছে। যদি মা…
চট করে কথা কাটলো মাহতিম। শক্ত কন্ঠে বললো,
– মা আমার গায়ে কখনো হাত তুলেনা। তাকে স্কিপ করো।
আবারও ভাবনাচিন্তায় পরলো মেহনূর। এ কি জ্বালা? এমন অসময়ে কেমন জেরা চালাচ্ছে? মাহতিমকে যদি কেউ চড় মারে তাহলে মেহনূর তো কিছুই বলতে পারবে না। সে তো কখনো উঁচু গলায় ধমক পযর্ন্ত দেয়নি। নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে রাখতে গিয়ে অন্যায়ের উপর গলা উঁচাতে শিখেনি। উলটো ছোট থেকে ধমক-মার-গালি খেয়ে বড় হয়েছে। কোনো উত্তর না পেয়ে অসহায় চোখে তাকালো মেহনূর, নিজের অযোগ্যতার উপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে এখন। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, কেনো এসব বাড়ি থেকে শিখলো না?

মেহনূরের নির‍ুত্তর-নিরুত্তেজ অবস্থা দেখে রাগে শরীরের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে! মানুষ তো নিজের খাতিরেও একটু-আধটু গর্জে, একটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীও নানা মিথ্যে যুক্তি সাজিয়ে বেঁচে যায়, অথচ ওকে একা ফেলে গেলে জীবনেও স্বস্তিতে থাকবেনা মাহতিম। এবার রাগের হুঙ্কারটা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দামামা ফাটাচ্ছিলো, যা করতে চায়নি আজ মেহনূরের সাথে তাই করলো। মেহনূরের দু’বাহু বাঘের থাবার মতো খামচে ধরে কাছে টানলো মাহতিম, রাগান্বিত চাহনি দিয়ে উত্তপ্ত তেজে নিশ্বাসগুলো ফোঁস-ফোঁস শব্দ করে ছাড়ছিলো। মেহনূর দুপাটি দাঁত শক্ত করে ব্যথা চেপে নিলো, ব্যর্থ হয়ে গেলো সে। অন্তরের শিরায়-শিরায় ব্যথার ইন্ধন জেগে উঠতেই মস্তিষ্ক তখন চোখের বহিঃপথে অশ্রু ছেড়ে দিলো, দাঁত আরো শক্ত করলো মেহনূর। চোখ থেকে একটা অশ্রুও নিচে পরতে দিবে না, ব্যথা হোক, আরো হোক, এটাই তার প্রাপ্য! রাগটা কোনো আঙ্গিকেই কমার অবস্থাতে ছিলো না, মাহতিম সেটা চড়াও করে ফলিয়ে দিলো, দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

– তোমাকে কেউ যদি চ’ড় মারতো, আমি ওর নাম-নিশানাই মুছে দিতাম! রজনী মামী তোমাকে আদর করে গিয়েছে, অনা সতেরটা শাড়ি নষ্ট করে দিয়েছে, দুজন মিলে তোমার সাথে মাইন্ড-গেম খেলছে তুমি এসব বুঝতে পারো না? তুমি কি শিশু? তুমি কি এখনো চাও, আমি কাজ ফেলে ছুটি নিয়ে তোমার সেবা করি? তুমি কবে বুঝতে শিখবে তোমার এখন নরম সেজে থাকলে চলবে না! তুমি এখন নিজেতে মত্ত নও মেহনূর! তোমার সাথে আমার অস্তিত্ব গেঁথে আছে। ক’দিন পর তোমার সাথে আমার শারীরিক-মানসিক-পারিবারিক-সামাজিক সবকিছু মিশে যাবে, আমি সর্বক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকতে পারবো না বলদ মেয়ে! আমার চাকরী আছে আমার উপর একটা সুস্থ টিম আছে, একটা সুস্থ ডিপার্টমেন্ট নির্ভর করছে। সময়ে-সময়ে তাদের সাথে কাজ করাটা আমার কর্তব্য-ধর্তব্য দুটোই! তোমাকে কি করে বোঝাবো, আমি এখান থেকে এক পা সরিয়ে ফেললে তোমার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পযর্ন্ত সময় নেই! তুমি প্রতিবার একেকজনের চ’ড়-থা’প্পর —
নরম হাত দিয়ে মুখে চাপা দিলো মেহনূর। মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে ঠোঁট উলটে বলতে লাগলো,

– মা উঠে যাবে, দোহাই চুপ করুন। আমাকে মারলে মারুন, যা খুশী তাই করুন। চিৎকার করলে মা উঠে আসবেন।
হাত সরিয়ে ক্রুদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মাহতিম। রাগের আড়টা তখনো বজায় রেখে চলছে সে। মেহনূরের বাহুটা তাচ্ছিল্যের সাথে ছেড়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে রাগ হজমের প্রক্রিয়া চালাতে থাকে। আঁচলে ভেজা চোখ শুষ্ক করতেই আর্দ্র কন্ঠে বললো মেহনূর,
– একটা প্রশ্ন করি?
কিছুক্ষণ নিরব থাকলে হঠাৎ শঠতার সাথে জবাব এলো,
– বলো,
প্রশ্নটা করবে-কি-করবে না এমন দ্বিধায় ফের ফাঁসলো মেহনূর। শেষপর্যন্ত গলা ঝেড়ে আমতা-আমতা সুরে বলে উঠলো,

– আপনি অনামিকার সাথে কি করেছিলেন? ও আপনাকে কেনো ‘ চরি’ত্রহীন ‘ বলে ডাকে? কেনো বলে আপনি আমাকে ভো’গের জন্য তুলে এনেছেন? ওর পিঠের দাগগুলো আপনি করেছেন না? আমি আপনার ভোগবস্তু?
দুই মিনিট যাবৎ কোনো শব্দ হলো না রুমে। একদম শান্ত, সুনশান, নিঃশব্দ হয়ে রইলো অন্দরখানা। উত্তরের অপেক্ষায় মেহনূরের তৃষ্ণার্ত মন উন্মুখ হয়ে ছিলো, এরপরই বিকট শব্দ যেনো পুরো রুমের ভেতরটা ঝালা-পালা করে দিলো! চুরচুর করে মারাত্মক এবং তীব্র শব্দে সবার ঘুম যেনো তখনই লন্ডভন্ড! একলাফে শয্যা ছেড়ে সবাই তখন শব্দ-উৎসের দিকে দ্রুতবেগে দৌঁড় লাগালো, সৌভিক দৌঁড়ের গতিতে সবাইকে পিছু ফেলে দরজার কাছে সবার আগে পৌঁছলো। এক ধাক্কায় দরজা খুলতে যাবে, ভেতর থেকে আরেকদফা শব্দ তেড়ে এলো, শব্দের উত্তেজিত আওয়াজে দুকান বরাবর হাত চেপে খিঁচে উঠলো সৌভিক। তাড়াতাড়ি উত্তেজনা কাটিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো, ওমনেই ভয়ে-আতঙ্কে বিস্ফোরণ চাহনিতে ‘ মাহতিম ‘ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো!

সৌভিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেওয়ার পর তার অবস্থা বিমূঢ়! সে চোখের পলকও ফেলতে পারলো না তখন। কি-থেকে-কি হলো কিছুইতেই আন্দাজ করার অবস্থাতে ছিলো না। শুধু ফ্লোরের উপর তরতর করে ছড়িয়ে পরা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, কানের মধ্যে পেছন থেকে সকলের হৈহৈ-রইরই চিৎকারে ‘ কথা বল! ওখানে কি হয়েছে সৌভিক? এই সৌভিক? ‘ শুনতে পাচ্ছিলো, কিন্তু অসাড়ে আঁকড়ে থাকা স্তম্ভিত মন কিছুইতেই জবাব দেওয়ার মতো স্থিতিতে ফিরতে পারলো না। পেছন থেকে সবাই ততক্ষণে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসলো রুমে, এরপর সব যেনো শান্ত-চুপচাপ-নিঃশব্দ। যেই হুল্লোড়টা রাতের তিনটে তেইশের দিকে বাড়ি মাতিয়ে উঠেছিলো, সেটার নূন্যতম শব্দ এখন আর অবশিষ্ট নেই।

আবছা অন্ধকারে ডুবো-ডুবো রুমটা এখন সাদা লাইটের আলোয় ফকফকা দেখা যাচ্ছে। স্টাডি টেবিলটার মধ্যখানটা হা করা মুখের মতো ফাঁকা, কাঁচের যেই মোটা আস্তরণটা টেবিলের চার পায়ের উপর দাম্ভিকতার সাথে সেঁটে ছিলো, সেটা এখন বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লোরে চূর্ণিত। প্রতিটি কাঁচ-টুকরোর সাথে রক্তের ছিঁটেফোঁটা কামড় দিয়ে লেগে আছে, সাদা টাইলসের উপর ঘণ তরল রক্ত। সৌভিক সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রুমের ডানদিকে নজর ঘুরালো। ফ্লোরে বসে জড়সড় অবস্থায় বিছানায় মুখ গুঁজে ভয়কাতুরে প্রাণীটা রীতিমতো ফোঁপাচ্ছে, অন্যদিকে বিছানায় বসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে শক্ত-কাঠিন্য মুখটা। থরথর করে সমস্ত শরীর রাগের তপ্ত জোয়ারে কাঁপছে তার।

বাদামী শার্টের স্লিভদুটো একটানে কনুইয়ে তোলা হয়েছে, কনুইয়ে আজ স্লিভদুটো ভাঁজ করা নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাতের চামড়াটা লম্বাটে হয়ে ফালিফালি হতে গেছে, টলটল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে তখন, অথচ মানুষটা নির্বিকার ভঙ্গিতে এমন ভাবে বসে আছে যেনো হাতে কোনো পীড়া নেই। মারজা চোখে-মুখে যেনো অন্ধকার দেখলেন কিছুক্ষণ, মনে হচ্ছিলো যেনো গভীর রাতে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন তিনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলে শরীরটা নেতিয়ে পরে উনার, সাথে-সাথে পাশ থেকে ‘ কাকীমা ‘ বলে চিৎকার দিতেই মারজাকে দুহাতে ধরে ফেলে সামিক। মারজার মাথাটা একহাত দিয়ে তার বুকে আগলে ধরে, অন্যহাত দিয়ে মারজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। রজনী যেনো হতবুদ্ধির মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অনামিকার শান্ত-দৃঢ় দৃষ্টি কেবল গম্ভীর রূপধারী আহত মানুষটার উপর স্থির।

নীতির মুখে বাক্য ফুরিয়ে হতভম্ব অবস্থা, প্রীতি কোনো চিন্তাশক্তিতে নেই। তৌফ শুধু ভয় পাচ্ছিলো মাহতিমের চেহারা দেখে, সিয়াম কাঠ-কাঠ দৃষ্টিতে যেন কথা বলার অবস্থা গুলিয়ে ফেলছে। সৌভিক পুরো পরিস্থিতিটা ঠান্ডা করার জন্য শীতল মস্তিষ্কের সাথে সামাল দিলো, মাহতিমের দিকে পাঠিয়ে দিলো তৌফ-সিয়াম-সাবিরকে। মেহনূরের দিকে চোখের ইশারায় পাঠিয়ে দিলো নীতি-প্রীতি-ফারিনকে। দু’দলের ছ’জনই সম্মতির সূচকে একবার মাথা নাড়িয়ে ইশারা বুঝিয়ে দিলো, এরপর দু’দলে বিভক্ত হয়ে দু’দিকে এগিয়ে গেলো তারা। সৌভিক ঠান্ডা মাথায় অনামিকা, রজনী ও সামিকসহ মারজাকে রুম থেকে পাঠিয়ে দিলো। এই মূহুর্তে সবকিছু গুছিয়ে আনা প্রয়োজন, কি হয়েছে সেটা সেটা ঠান্ডা ভাবে জিজ্ঞেস করাই উচিত হবে।

নীতিরা ফ্লোরে ঝুঁকে মেহনূরকে ঘিরে উঠার জন্য তোষামোদ করতে থাকে, নীতি ফ্লোরের উপর দু’হাঁটু বসিয়ে বিছানা থেকে মেহনূরের মাথাটা তুলে, আঁচড়ানো চুলগুলো তখন এলোমেলো হয়ে মেহনূরের মুখ ঢেকে ছিলো। প্রীতি পেছন থেকে মেহনূরের চুলগুলো আঁটো করে উঁচু একটা খোপা পাকিয়ে দেয়, ফারিন নিজের স্লিপার-ট্রাউজারের পকেট থেকে টিস্যু বের করে মেহনূরের ভেজা মুখটা মুছে দেয়। নীতি ওর গালে-কপালে-মাথায় বারবার নরম করে হাত বুলিয়ে দেয়, একটু কান্না থামিয়ে শান্ত হতে অনুনয় করে।

ফারিন ওইসময় মেহনূরের হাত-পা ও শরীরের উপর ক্ষত জায়গার সন্ধান করছিলো, কিন্তু যদ্দূর বুঝলো এই ধ্বংসাত্মক অবস্থায় মেহনূরের শরীরে নখ পরিমাণ আঁচড় লাগেনি। একদিকে মনটা শান্ত হলেও সান্ত্বনার স্বাদটা নিতে পারলো না ফারিন, মাথাটা ঘুরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। মাহতিমের বাদামী শার্টের পিঠটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, দুটো হাত বিছানার দুপাশে শক্তভাবে রেখে কঠোর ভাবে ফ্লোরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে। যেই দুটো হাত দিয়ে বিছানায় ভর রেখেছিলো, ওই জায়গায় গলগল করে ফোঁটায়-ফোঁপটায় রক্ত পরে চাদরটা ভিজে যাচ্ছে। মেহনূরের উপর থেকে সহসা মনোযোগ সটকে গেলো ফারিনের, সে চুপচাপ উঠে দাঁড়াতেই ধীর পায়ে মাহতিমের সামনে দাঁড়ালো। মাহতিমের কিন্ঞ্চিৎ নত মাথায় হাত রাখলো, চুলের চামড়ায় আঙ্গুল বসিয়ে বুলিয়ে দিতেই মুখ তুলে তাকালো মাহতিম। দৃষ্টিটা একদম ফারিনের উপর পরলে ভেতরের শক্তভাবটা একটুখানি হ্রাস করলো, নাক দিয়ে সশব্দে জোরে নিশ্বাস ছাড়তেই মাথাটা নামাতে-নামাতে বললো,

– রুমে যা, ঘুমিয়ে পড়্। টেনশন করিস না।
ফারিন কথাটা শুনলো না। উলটো ভাইয়ের মুখটা দুহাতে উপরে তুলে উদাস দৃষ্টিতে করুণ গলায় বললো,
– তুমি এরকম কেনো করলে ভাইয়া?
ফারিনের প্রশ্নে সবাই যেনো মুখ তুলে তার দিকে তাকালো। কয়েক জোড়া বিমর্ষ চাহনি তাদের দিকে নিবদ্ধ হলেও অশ্রুজোড়া চোখদুটো একবারও সেদিকে তাকালো না। ফারিন গালদুটো ছেড়ে দিয়ে সৌভিকের সাথেই ফ্লোরে আসন পেতে বসলো। সৌভিক মাহতিমের পায়ে কাঁটাছেঁড়া জায়গাগুলো ড্রেসিং করাকালীন একপলকের জন্য ওর দিকে তাকালো, তাকিয়ে ফের কাজে মনোযোগ দিলো। ফারিনও যখন মাহতিমের হাত টেনে ড্রেসিং শুধু করলো, তখন বাধা দিতে গিয়ে মাহতিম বিরক্তির সুরে বললো,

– তোরা দুটো শুরুটা করলি কি? কি জন্যে এখানে বসে আছিস? আমার তো এসব কাহিনী সহ্য হচ্ছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে। মাথাটা একটু ঠান্ডা করি। চলে যা রুম থেকে। রুমে এখন কাউকে চাই না।
ফারিন আর সৌভিক দুজনেই মুখ তুলে মাহতিমকে দেখলো, দেখা শেষ করে না-শোনার ভঙ্গিতে একমনে কাজ করতে থাকলো। মাহতিম জানে, এদের হাজার বললেও এখান থেকে ড্রেসিং সম্পন্ন না করে একপাও নড়চড় করবেনা। তার মধ্যে মাথাটা এতো টনটন করছে, সম্ভবত অতিমাত্রায় ফাস্ট্রেশন থেকে আবার নার্ভগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। মাহতিম যখন মেহনূরের মুখ থেকে ‘ চরিত্রহীন ‘ শব্দটা শুনে তখনও রাগের উত্তপ্ত পিন্ডটা ফুলে-ফেঁপে উঠেনি, কিন্তু যখন ‘ ভোগবস্তু ‘ শব্দটা শুনে তখন রাগেরটা পিন্ডটা ভস্ম হয়ে ভয়াবহ আকারে উদগীরণ হয়ে যায়। দামাল মুঠোর এক আঘাতেই স্টাডিটেবিলের কাঁচটা চুরমার হয়ে শেষ, বাঁহাতের মুঠো জুড়ে তখন অথৈ রক্তের বর্ষা!

মেহনূর চিৎকার দিয়ে যে নিজের ভয়গুলো জানান দিবে, তার আগেই পরপর কয়েকটা তাণ্ডব মাহতিম দেখিয়ে ফেলে। তার বাঁহাতটা কাঁচের হিংস্র খোঁচায় বহু জায়গায় ক্ষতবীক্ষত হয়ে তরতাজা রক্ত বেরুতে থাকে, পাষাণের মতোই রুমের ভেতর যাবতীয় জিনিসপত্র ভাঙার মতলবে ছিলো মাহতিম, কিন্তু বিছানার কোণায় গুটিশুটি পাকানো ভয়ার্ত মূর্তির দিকে দৃষ্টি পরতেই তার হাতের ফুলদানীটা শূন্য থেকে নিচে নামিয়ে ফেললো, চুপচাপ বিছানায় এসে ধপ করে বসলো। শেষমেশ মেহনূরকে ছাদের রুমে ফিরিয়ে আনলো নীতি, শব্দহীন অবস্থার মতো শান্ত হয়ে গেছে মেহনূর। চোখ থেকে পানি পরছিলো ঠিকই, কিন্তু ফুঁপিয়ে কান্নাটা থেমে যায় আপনা-আপনি। বালিশে শুইয়ে দিয়ে গলা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় ওরা। নীতি ডানপাশে বসেছে, প্রীতি অন্যপাশে, ফারিন তখনো ফিরে আসেনি। নীতি কপালে শান্তসূচকে হাত ছুঁইয়ে দিতে থাকলে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– মনটা হালকা করো ভাবী। কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। না বললে কি করে বুঝবো বলো?
মেহনূর চোখ বন্ধ করা অবস্থায় ঠোঁটদুটো মুখের ভেতরে পুড়ে নিলো, শুষ্ক ঠোঁটে জিভ ছুঁইয়ে ধাতস্থ কন্ঠে বললো,
– অনামিকা কেনো চরিত্রহীন ডাকে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর কেনো তিনি ওর পিঠে —
ঠোঁট কুঁচকে ডুকরে কেঁদে উঠে মেহনূর। মুখটা দুহাতের তালুতে ঢেকে নিলে একটু আগের চিত্রগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। নীতি দ্রুত মেহনূরের উপর শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও প্রীতির সাথে চোখাচোখি দৃষ্টি বিনিময়ে আলাপ হচ্ছে। প্রীতি যেনো ভয়েই তটস্থ, প্রশ্নপর্ব পুরো শেষ না হলেও বাকি ঘটনা কি হতে পারে, সেটা ইতিমধ্যে দুজনের মাথায় ঢুকে গেছে।

রাত তখন চারটার ঘরে ছুঁই-ছুঁই, ফ্যান না চলার জন্য ঘড়ির টিক-টিক শব্দটা বিদঘুটে লাগছে। বাইরের সাথে যেনো পাল্লা দিয়ে ভেতরের অবস্থাও থমথমে। নীতি ড্রিম লাইটের আলোয় রেডিয়াম ধাতুর জ্বলজ্বল করা ঘড়িটার দিকে তাকালো, বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে ওর। অজানা ভয়, অনিশ্চিত আশঙ্কা, বিপন্ন পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিই বুকটার ভেতর তুফান খেলে যাচ্ছে। যেই কঠিন কথাগুলো বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলো, সেগুলো একটার-পর-একটা সাজিয়ে হালকা গলায় কেশে নিলো সে। কাশির শব্দে শুনে সচকিত হলো প্রীতি, বড় বোন নীতি নিশ্চয়ই অতীতের বন্ধ দরজা খুলে ফেলেছে, এখন কিছুক্ষণের ভেতর আসল ঘটনা ব্যক্ত করবে। মেহনূর ঘুমায়নি, চোখ এমনে-এমনেই বন্ধ করা ছিলো। নীতি আরেকদফা অক্সিজেন টেনে নিয়ে সাহসের পিত্তিটা শক্ত করলো, মেহনূরের কপাল থেকে হাত সরিয়ে ওর পেটের উপর থেকে ডানহাতটা তুলে নিলো নীতি। মেহনূর চোখ খুলে তাকাতেই নীতি নিজের হাতদুটোর ভেতর মেহনূরের ডানহাতটা আবদ্ধ করলো, হালকা গলায় বলতে শুরু করলো,

– আমি তোমায় সব বলবো ভাবী। সব গোড়া থেকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি একটু শান্ত হও। অযথা চিন্তা করে ভাইয়াকে কষ্ট দিও না। ও মানুষটা তোমায় খুব ভালোবাসে। তুমি তাকে নিয়ে ভুল সময়ে ভুল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলেছো। এটার জন্য তোমাকেও দোষ দিতে পারিনা, আবার ভাইয়াও অসময়ে এসব কথা শুনে স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। ওগুলো একদম অযৌক্তিক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন। ভাইয়া মোটেই আজকের মতো রাগী ছিলো না, কোনোদিন আমরা মনে করতে পারি না ভাইয়া কখনো আমাদের সাথে জঘন্য রাগ দেখিয়েছিলো কিনা। খুব ছোট থেকেই অনামিকা এ বাড়িতে যাতায়াত করতো। রজনী মামী, অনামিকা উনারা এ পরিবারের সদস্যের মতোই থাকতো।

পড়াশোনার জন্য ঢাকার পিলখানার এরিয়ায় থাকতো ভাইয়া, যখন ফুপা ছুটিতে বাসায় আসতেন তখন ভাইয়াকে কোনোভাবেই সেখানে আঁটকে রাখা যেতো না। ভাইয়া ছুটে বাসায় আসতো, আর হয়তো তখন থেকেই অনামিকার মন নরম হতে থাকে। আমরা কেউ বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দেইনি, কারণ, মনেহতো ওটা বয়সের ঝোঁক। ধীরে-ধীরে বুঝতে শিখলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়ার ইচ্ছা ছিলো, ফুপা যেই মেয়েকে চুজ করবে তাকেই বিয়ে করবে, সে কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়াবে না। এই একটা কথার উপর ভাইয়া যেনো বাঘের মতো অটল ছিলো, কোনো মেয়েই তাকে এই কথা থেকে একচুল নড়াতে পারেনি।

অনামিকা যে অসুন্দর তা কোনোদিন বলবো না, কিন্তু অশালীন পোশাক আর উগ্র চিন্তাভাবনার জন্য আমরা কেউই ওকে পছন্দ করতাম না। আমরা দশটা মানুষ আপনের চেয়েও আপনের মতো থেকেছি, কেউ আমাদের দেখলে বলতে পারতো না, কে কাজিন বা কে বন্ধু। সৌভিক, তৌফ, সিয়াম ভাই তারা তো আমাদের সাথেই শৈশব কাটিয়েছে, যদিও তারা ভাইয়ার ছোটবেলার বন্ধু। অনামিকা তখন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে, ওই সময় নেভি থেকে ভাইয়ার জয়েন এপ্রুভাল এসে যায়, কিছুদিনের মধ্যেই সব রেডি করে ট্রেনিংয়ের জন্য বিদায় নেয় ভাইয়া। প্রায় ছয়মাসের বেশি সময় সে চট্টগ্রামের ট্রেনিং সেন্টারে ছিলো।

একদিন মারজা মামীর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়, উনিতো আগে থেকেই অসুস্থ ছিলো, তার উপর একদিন বুকে শ্বাস টান উঠে। সবাই পাগলের মতো একগাদা টেনশন নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিলাম, কিন্তু এই টেনশনের ভেতর মস্ত বড় ভুল করি আমরা। আমরা কেউই জানতাম না সারপ্রাইজ হিসেবে ভাইয়া সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরবে, এটাই আমাদের দূর্দশা হয়ে দাঁড়ালো। ভাইয়া কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জার্নির ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলো, কিন্তু তখন বাড়ির অবস্থা সুনশান। ওইদিন শুধু সিরাজ কাকা সাবু খালা বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য ছিলো, তারা ভাইয়ার আগমন দেখে মামীর সিচুয়েশন নিয়ে ফট করে জানায়নি। এদিকে ভাইয়া নিজের রুমে যায়, গোসল নিয়ে পোশাক পালটে হালকা মতোন খেয়েও নেয়, তখনও সিরাজ কাকা মামীর ব্যাপারটা মিথ্যা কথা দ্বারা ঢেকে দিয়েছে। ভাইয়ার যে লম্বাদিনের ধকল শেষে বিশ্রামের প্রয়োজন সেটা সিরাজ কাকা বুঝতো। ভেবেছিলো রাতে চুপ করে অনামিকার কথাটাও এই ফাঁকে বলে দিবে। এরই মধ্যে অনামিকা তখন —

একটানা কথা বলতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠে নীতি। নির্ঘুম রাতের সাথে ফ্লাইটের ক্লান্তিটা এখনো যেনো ঘুচেনি। মেহনূর উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এরপর কি হয়েছে সেটা জন্য বুকের ভেতর ধ্বক-ধ্বক হচ্ছে। নীতি ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে আবারও মেহনূরের দিকে তাকালো, প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে, প্রচণ্ড! যদি মেহনূর উনিশ-টু-বিশ বুঝে তখন? নীতিকে হঠাৎ থামতে দেখে মেহনূর নিজেই উৎকন্ঠার সুরে বলে উঠলো,
– বলুন না নীতি আপু, আমি শুনতে চাই এরপর কি হয়েছে। ওই খালি বাড়িতে তিনটা মানুষ তো ছিলো, উনি তো একা ওখানে ছিলেন না। বলুন না, এরপর কি ঘটনাটা ঘটেছিলো?
নীতি নড়েচড়ে দৃষ্টি নত করলো, শান্ত গলায় বলতে-বলতে ক্রমশ উত্তেজিত হতে লাগলো তার কন্ঠ, যেনো পুরোনো রাগের ভয়ানক জেদটা শরীরের উপর আবারও জেঁকে ধরেছে।

– ওই ন’ষ্টা কোথাকার ভাইয়ার রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দেয়। ভাইয়ার সাথে কেমন বেহায়াপনা করতে চেয়েছে মুখে বলতেও থু আসে। কিছু জিনিস নিজের করে না পেলে, তার প্রতি অদম্য আকর্ষণ জাগে। মূলত অনামিকার এটাই হয়েছিলো। বারবার রিজেকশন খাওয়ার পর নে’শাও করতো এই ন’ষ্টা! এ’লএসডি ড্রা’গে এডি’ক্টেড ছিলো। যেই প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তো ওখানকারই একদল ওর খাশ বন্ধু ছিলো, সবগুলো শয়তান ছিলো, জাস্ট শয়তান! অনামিকা আর ভাইয়ার মধ্যে কেমন ধস্তাধস্তি হয় কেউ জানে না। কিন্তু ওর অবস্থা আর ভাইয়ার হাল দেখে সিরাজ কাকা বলেছিলো, মাহতিম ভাইয়া ওকে আচ্ছা মতো মে’রেছে। এদিকে সাবু খালা অনামিকার অবস্থা দেখে বলেছিলো ভাইয়া নাকি লালসা মেটাতে গিয়ে রেপ করেছে। তুমিই বলো, আমার ভাইকে দেখার পর কোনো মেয়ে কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? আমার কথাগুলো অহংকার ভেবো না ভাবী। আমার ক্লাসমেটরা পযর্ন্ত আমাদের জয়েন ফটো দেখলে মাহতিম ভাইয়াকে ক্রাশ কনফেশনে লেটার দিতো। যেখানে ভাইয়া তুড়ি বাজালেই সুন্দর মেয়ের আনাগোনা চলে আসতো নিশ্চিত, সেখানে ওর মতো ন’ষ্টার দিকে কোন্ দুঃখে তাকাতে যাবে? এরপর যখন —

– থেমে যা নীতি। ভাবীকে ঘুমাতে দে। কাল আমাদের লম্বা জার্নি মনে আছে তো? রেস্ট করতে দে।
দরজার দিকে একসঙ্গে তিনজনের দৃষ্টি চলে গেলো। সৌভিকের চিন্তিত মুখটা এখন পরিশ্রান্ত হয়ে মলিন আকার ধারণ করেছে। হয়তো মাহতিমের মুখ থেকে সেও আসল ঘটনা শুনে ফেলেছে। নীতি আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে বিছানা থেকে নামতেই বললো,
– কাল যাবো মানে? ভাইয়ার অবস্থা কি খুবই ভালো? সে তো ভুলেও ড্রাইভার নিবে না, কাউকে সে জিপও চালাতে দিবে না, তাহলে চালাবেটা কে? কিছুতেই যাবো না আমি। ট্যূরে যাওয়া বাতিল। ওই সা’পের সাথে কোনোমতেই ট্যূরেই যাবো না।
সৌভিক খানিকটা বিরক্ত হয়ে বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করলো। মলিন দৃষ্টি পালটে আক্রোশের ভঙ্গিতে সরল কন্ঠে বললো,

– এসব কথার ভেলকি ওর কানে গেলে এখুনি উঠে এসে চড় লাগাবে।
দৃষ্টিটা তখন নীতির উপর থেকে সরিয়ে এবার নীতির পেছনে ছুঁড়লো সৌভিক। যোগ্যমতো জায়গায় দৃষ্টি স্থির রেখে গমগম সুরে বললো,
– ওর রাগ এখনো কমেনি। কমার মতো ঘটনাও ঘটেনি। হয়তো এখনো সবকিছু ঠিক করার চিন্তায় আছে, নাহলে এইসব ট্যূর-ফ্যূর ফেলে কখন লাগেজ উঠিয়ে বিদায় হতো।
নীতি প্রসঙ্গটা না বুঝে সৌভিকের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সৌভিকের স্থির দৃষ্টিটা লক্ষ করে সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো, মেহনূরের অবসন্ন দৃষ্টি এখন সৌভিকের দিকে। নীতি মাথাটা দ্রুত ঘুরিয়ে সৌভিকের দিকে অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– মানে?
সৌভিক একই তেজে মেহনূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নীতির পানে তাকালো। হাতদুটো স্বাভাবিক করে বলে বললো,
– রেস্ট করতে দে এখন, কথা বলিস না। একটু পরই বের হতে হবে। পারলে ভাবীর ব্যাগটা রেডি করে দিস। আর এটা —
অর্ধপূর্ণ কথাটুকু ওখানেই আঁটকে রেখে রুমের বাইরে গেলো সৌভিক। নীতি কিছু বুঝতে না পেরে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ সৌভিক ভাই কোথায় যাচ্ছো? ‘। সৌভিক হনহন করে যেমন বেরুলো, তার বদৌলতে ‘ ঘ্যাচঘ্যাচ ‘ শব্দ করে রুমের ভেতরে ঢুকলো। তার ডান পা বরাবর পিছু-পিছু বেশ বড় একটা কালো লাগেজও এসে উপস্থিত, সৌভিক হ্যান্ডেলটা ধরে আধহেলানো লাগেজটা সোজা করে রাখলো। হ্যান্ডেলটা ছেড়ে দিতেই তটস্থ সুরে বললো,
– এয়ারপোর্টের গোলমালের জন্য এটা অন্য ফ্লাইটে আঁটকে গিয়েছিলো। এটা আমাকে দিতে বললো, এজন্য দিয়ে গেলাম। নীতি, প্রীতি চলে যা তোরা। ভাবীকে ঘুমাতে দে।

সৌভিকের কথায় দুবোনই সেখান থেকে চলে আসলো। আসার আগে মেহনূরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো, কিছু দরকার হলে সাথে-সাথে তাদের ডাকতে, ডাকতে যেন দেরি না করে। মেহনূর কম্বল সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাথাটা দুহাতে চেপে কিছুক্ষণ গভীরভাবে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস নিলো, শরীরটা খুবই শক্তিহীন লাগছে, মাথাটাও ভনভন করছে। শেষ রাতের সময় চলছে এখন, এই উছিলায় রুমে ঢুকছে হিম জাগানো বাতাস। ঠান্ডা বাতাসটা সূঁইয়ের মতো খোঁচাচ্ছে, ভালোই শীত লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহনূর খোলা দরজাটা বন্ধ করার জন্য ফ্লোরের উপর দু’পা ফেললো, হাতে ভর দিয়ে বিছানা থেক্র উঠে দাঁড়ালো।

দরজার স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। অনেক চিন্তাভাবনার পর, অনেক যুক্তি মেলানোর পর সিদ্ধান্ত নিলো, লাগেজটা খুলে দেখা উচিত। লাগেজের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিলো মেহনূর, সেটা নম্রভাবে ছেড়ে দিয়ে হাতদুটো এগিয়ে লাগেজটার হ্যান্ডেল আঁকড়ে বিছানার কাছে টেনে আনলো, বিছানায় তুলতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে গেলো। লাগেজটা প্রচুর ভারী। আচ্ছা, এটার মধ্যে কি রাগ ভরে-ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে? নাকি রাগের সাথে ওই কাঁচের গুঁড়াগুলো ভর্তি করে পাঠিয়েছে? মেহনূর সরু আঙ্গুলগুলো লাগেজের চকচকে দেহের উপর রাখলো, ঠান্ডা-শক্ত লাগেজটা ছুঁতেই কেমন এক ঘোর আবেশে প্রসন্ন হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো ব্যথাক্লিষ্ট চোখদুটো। চোখের সামনে অন্ধকার, একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেলো, সেখানে কোনো আলো দেখতে পেলো না মেহনূর। হঠাৎ অন্ধকারের মাঝখানটা যেনো চিঁড়ে যেতে লাগলো, চিঁড়টা বড় ফাঁক গলে ভোরের আলোর মতো উজ্জ্বলটা ভেদ করে এলো। হঠাৎ, এক লহমায় সকল অন্ধকার ধূলিসাৎ করে ভোরের আলোয় ফুটে উঠলো সবকিছু, সেই পুরোনো কথা, সেই পুরোনো দিনগুলো মনে পরলো তখন। হাসি-হাসি চোখে বাঁকা হাসিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। চোখের মনি জুড়ে তার হাসি-হাসি চোখদুটোর চাহনিটা মিলে আছে, হঠাৎ মুখটা ধীরভাবে এগিয়ে এনে ফিসফিস আওয়াজে বললো,

অজ্ঞাত পরিচয় আমার, অচেনা ছিলাম একদিন।
দ্বিগ্বিদিক জানতো মানুষ, তুমি-আমি কেউ নই।
সময় যেনো ছল খাটালো, ধরিয়ে দিলো সবই।
তোমায় মন বাড়িয়ে ছুঁই মেহনূর, মন বাড়িয়ে ছুঁই।
চোখ খুললো মেহনূর, সিলভার চেইনটা ধরে একটানে বাম থেকে ডানে ঘুরিয়ে আনলো। লাগেজের উপর পার্টের অংশটা দুহাতে ধরে আস্তে করে উপরে উঠাতে লাগলো মেহনূর, লাগেজ ধীরে-ধীরে খুলে যেতেই নির্লিপ্ত চাহনিতে থমকে গেলো। চিরকুটের মতো চারকোণা হলুদ কাগজটা সবার আগেই দৃষ্টি কেড়ে নিলো ওর, সেখানে সুবিন্যস্ত শব্দে নীল কালিতে লেখা ছিলো,
– আমার ভাগ্যবতী বউ, আমার চিরসঙ্গিনী, আমার মেহনূর আফরিনকে আঠারো শাড়ির ভালোবাসা।

শোকাহত বাড়ির মতো নিস্তব্ধ ছিলো দশটা নাগাদ। মাঝরাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর ভোররাতে ঘুমাতে পারেনি কেউ। সকালের আলোটা গগনপটে ছড়িয়ে পরলে তখন যেনো ঘুম-ঘুম ভাব হলো, কিন্তু ঘুমকে তখন পাত্তা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিলো না কারোর। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতেই ফোনের বিপ্ আওয়াজে চমকে উঠলো আট মাথা, ফোনের উপর চোখ বুলাতেই সব ফেলে হুড়মুড়িয়ে উঠলো, একসঙ্গে নিজ-নিজ রুমের ওয়াশরুমে ছুটলো তারা। দ্রুত নিজেদের ফ্রেশ করে বাড়ির ঠিক বাগান সাইডটায় জড়ো হলো। সূর্যহীন আকাশটা শীতের আবরণে গুমিয়ে আছে, কুয়াশাচ্ছন্নে আবৃত হয়ে আছে চারপাশ।

বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে ডানে বাঁক নিলো সবাই, যার-যার হুডির পকেটে সবারই হাত গোঁজা, মাথায় কেউ হুডি টেনেছে, কেউ পেচিয়েছে মাফলার। শিশির জমা ঘামের উপর পা ফেলে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এক-এক করে জড়ো হলো তারা, মুখে কারোর রা নেই, নিশ্বাসের সাথে-সাথে নাক দিয়ে ধোয়ার মতো বেরুচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনেহয় নাক দিয়ে আগুনের রেশ ফুটছে। কনকনে শীতের সকালে দেয়ালহীন পাকাপোক্ত কটেজটার সামনে এলো সবাই, এটা মাহতিম নিজের জন্য বানিয়েছে।

গোলকার কটেজটা সুউচ্চ হলেও চর্তুদিকে দেয়াল দেওয়া নেই, কটেজে ঢুকার জন্য একপাশে তিনটে সিড়ি দেওয়া আছে, কেউ সিড়ি দিয়ে শালীনভাবে উঠতে পারে, আবার কেউ ঘাস থেকে পা বাড়িয়ে এমনেতেও কটেজে ঢুকতে পারবে। মেয়েদল যেহেতু কমফোর্ট জোনে থাকতে ভালোবাসে, তাই নীতি-প্রীতি-ফারিন সিড়ি দিয়ে উঠলো, বাকিরা নিজেদের মতো পা উঁচিয়ে কটেজে ঢুকে পরলো। গোলাকার একটা মস্ত টেবিল বিছানো সেখানে, টেবিলের চারদিক জুড়ে বারোটার মতো চেয়ার সাজানো হয়েছে। ফাঁকা চেয়ারগুলোতে নিজেদের আসন অধিকার করে আসল জায়গায় দৃষ্টি দিলো সবাই। সেখানে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্নটা শান্ত গলায় বললো তৌফ,

– মামু, এই সকাল-সকাল এই তলবে ডাকলা ক্যান? এক্সক্লুসিভ কিছু হইছে?
কথা বলার জন্য গলাটা একটু কেশে শীতের রুক্ষতা কাটালো সৌভিক। হাতদুটো টেবিলের উপর মুঠোবন্দি করে রাখতেই গম্ভীর সূচকে বললো,

– মাহতিম এবার গোপন কিছু করছে গাইজ। আমি ধরতে পারছিনা। কালরাতে যে রাগটা দেখালো, সেটা স্রেফ একপাক্ষিক জেদ ছিলো না। ওর আচরণগুলো আমার সেন্স অন্যদিকে ডিটেক্ট করছে। প্রথমত, ও কখনো চার মাসের ছুটিতে ঢাকা ফিরে না। দ্বিতীয়ত, অনামিকার ব্যাপারটায় ওভাবে রিয়েক্ট করে হুল্লোড় দেখাবে এটা আদতেও সম্ভব না। মেহনূরকে ক্ষতি করেনি জানি, এটা যে করবে না শিওর ছিলাম। তৃতীয়ত যেটা খটকা লেগেছে সেটা হলো ‘ তাড়াহুড়ো ‘। এই তাড়াহুড়োটা আগে কখনো ওর ভেতর দেখিনি, ও নেভির কোন্ পদের কর্মকর্তা এটা নতুন করে আর বললাম না। ওর মাইন্ড-ফিটনেস সবগুলোই এক্সিট্রিম লেভেলের ডিটারমাইন্ড, তার উপর ও যেই ফিল্ড থেকে বিলং করে সেখানে তিল পরিমাণ দয়া দেখানোর দীক্ষা শিখেনি। ও কেনো তাড়াহুড়োটা করছে বুঝতে পারছিস কেউ?
পালাক্রমে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো ওরা। সৌভিকের দৃষ্টি এখনো পূর্বের মতোই কঠোর। সিয়াম কথাটা আমলে নিয়ে এমনভাবে বললো যেনো কাকপক্ষি পযর্ন্ত কথাটা ওর শুনতে না পায়,

– ও কি কিছু নিয়ে ভয়ে আছে?
তৎক্ষণাৎ চকিত ভঙ্গিতে সিয়ামের দিকে তাকালো সবাই, এমন অবস্থা দেখে সিয়াম যেনো বিষম খেয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। সৌভিকের দৃষ্টি শুধু কঠিনের মতো শক্ত হয়ে রইলো, গলার স্বর আগের চেয়েও গম্ভীর করে বললো,
– আমার মন বলছে, ও গোপন মিশনে জড়িয়ে আছে। ও চাচ্ছে আমরা যেনো আউট অফ ঢাকা হই। চট্টগ্রামে চলে গেলে ওর কোনো টেনশনই থাকবেনা। সেখানে কোনো প্রবলেম হলে যেকোনো সময় স্পেশাল ফোর্স এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে, কিন্তু ঢাকায় থাকলে সেই টিম আসতে-আসতে যা ঘটার সব ঘটে যাবে। ও যে কি নিয়ে টেনশন করছে সেটাই আমি রাত থেকে চিন্তা করছি। ধরতে পারিনি।
সৌভিকের কথায় নিজের বাক্য ঠেকিয়ে তেজী সুরে বললো প্রীতি,

– ভাইয়া যেটাই করুক তাই বলে কি ভাবীর সাথে ওরকম বিহেভ করবে? মেহনূর ভাবী যেমনই হোক, এখানে প্রত্যেকটা মেয়ের নিজস্ব গন্ডি আছে। কেউ খুব তাড়াতাড়ি অন্যের ইজি হয়ে যায়, কেউ বেশি টাইম লাগায়। কিন্তু ভাইয়ার আচরণটা আমার —
সৌভিক এমন কথায় দারুণ চটে গিয়ে বাঁজখাই গলায় বললো,
– আরে রাখ তোর আচরণ! একটা মানুষ যদি তোর সাথে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে তুই কি নখ কামড়ে বসে থাকবি? ভাবী কি বুঝেনা মাহতিমের ভেতরে কি চলে? ওর মুখের দিকে ঠিকমতো তাকালেও তো বুঝার কথা ও এখানে বিশ্রাম নিতে আসেনি। একটা মানুষের মধ্যে নূন্যতম সহ্য থাকে রে, আমি তো নিজেই ভাবীর ন্যাকামো দেখে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, মাহতিমের মধ্যে কি হয় সেটা নাইবা বললাম।

সৌভিকের গরম মেজাজ দেখে আজ কেউই আগ বাড়িয়ে কথা বললো না। প্রীতিও নিজের কথায় বাধা পেয়ে বাকি কথাটুকু গিলে ফেললো। তৌফ এতে ক্ষান্ত রইলো না, তেড়ে এসে যুক্তি ছেড়ে গজগজ সুরে বললো,
– শা’লার মাথাই কাজ করতাছে না। এইসব প্যাঁচ যে ক্যামনে সামলামু, ক্যামনে যে ঠিক করমু, রাস্তাই তো চোখে দেখিনা। তোরা কিছু ভাবছোস কেউ?
তৌফকে শান্ত করে পাশ থেকে বললো সামিক,

– আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আছে। এক্জিকিউট করতে হেল্প লাগবে। আমার এখন মাহদিকে প্রয়োজন, আমি যেই টোপ ফেলতে যাচ্ছি, সেটা জায়গামতো নিশানা পেলেই সবকিছু ঠান্ডা হয়ে আসবে।
সামিকের চোখের ভাষাই যেনো দক্ষবুদ্ধির পরিকল্পনা বোঝাচ্ছে। সবাই কিছুক্ষণ মৌনতার সাথে নিরব থাকলো ঠিকই, পরক্ষণে সবার ঠোঁটে ফুটে উঠলো আত্মবিশ্বাসের চিন্তামুক্ত হাসি। নয়জন মাথা যখন দিনশেষে একত্র হয়, তখন হাজার বিপদের ভেতরেও সুরাহা যেনো অন্ধকার চিঁড়ে বেরিয়ে আসে। মনের সকল ভয়-ডর-শঙ্কা এমনভাবেই নিঃশেষ করে দেয় যেনো আশার আলোতে বলিয়ান হয়ে উঠে তাদের স্বতন্ত্র প্রাণ।

শাওয়ারের সিলভার নবটা বাঁদিকে ঘুরাতেই ফোঁটায়-ফোঁটায় বর্ষণ শুরু হলো। নবটা মোচড়ে স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিতেই এবার তুমুল আকারে বর্ষণ শুরু হলো। কৃত্রিম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তুষারকণার মতো ঠান্ডা, ভোর-সকালে বরফের মতো কনকনে ঠান্ডা পানিতে গা ভেজাচ্ছে মাহতিম আনসারী। শীত-গ্রীষ্ম কোনোটাই তার নিয়মমাফিক রুটিনকে ছেদ করতে পারেনা, টানা চারটা বছর যাবৎ নিজেকে কঠিন নিয়মে আবদ্ধ করার ফল এটা। শার্টের বোতামগুলো ডানহাতে খুলতে লাগলো মাহতিম, মুখটা শাওয়ার দিকে উঁচু করে রাখা। প্রতিটি ঠান্ডাতুল্য বিন্দু তার দেহের ভাঁজে-ভাঁজে মিশে গিয়ে সিক্ত করতে মত্ত।

ঠান্ডা পানি যেনো তার চোখদুটোর দেখা পেয়ে আনন্দে উল্লাসিত, ঠোঁটদুটো যেনো ঠান্ডার সংস্পর্শ পেলে সাথে-সাথে রক্তিম হয়ে উঠে। বাঁহাতে মোটা ব্যান্ডেজ থাকা সত্ত্বেও তোয়াক্কা করেনা মাহতিম, একটানে সেখান দিয়ে শার্ট খুলে আনে সে। কাটা জায়গাটা আবার যেনো চনমনিয়ে বিষিয়ে উঠলো, ব্যথায় শুধু বন্ধ চোখদুটো যেনো খিঁচুনি দিয়ে ফের স্বাভাবিক হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ থাকার পরও মনের আন্দাজ মোতাবেক শার্টটাকে ছুঁড়ে মারলো, ওমনেই জবজবা ভেজা শার্টটা ‘ ছলাৎ ‘ শব্দ করে ভরা বালতিতে গিয়ে পরলো। দেয়ালে ডানহাতে ফেলে মাথাটা নিচু করলো মাহতিম, হাতসহ সমস্ত দেহ যেনো চিনচিন করে ব্যথা করছে, মাথাটাও ভীষণ টনটন করছে, চোখ খুলে তাকাতে গেলে ভারী ব্যথা এখন। এটা নির্ঘাত গতরাতের ফলাফল, যার দরুন এখন বেখাপ্পা কায়দায় ফাঁসতে হলো। আজকের মধ্যেই সবাইকে কক্সবাজার পাঠাতে হবে, সবাইকে এখান থেকে নিরবে সরিয়ে ফেললে তবেই চিন্তামুক্ত হওয়া সম্ভব। ছুটি নেয়নি, চায়নি, কোনোটাই করেনি মাহতিম। এখানে আসার পেছনে পূর্বঘটনার অপারেশনটা কঠিনভাবে জড়িত। নেভির স্পেশাল ফোর্সের তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই বছর আগে যেই ‘ অপারেশন ঝিলতলা ‘ নামের অভিযান হয়েছিলো, সেই ঘটনার চূড়ান্ত পর্ব এবার নিজ হাতে সাজাবে মাহতিম।

রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে লুকিয়ে-লুকিয়ে অ’স্ত্র আনাগোনার ব্যবসা করছিলো একদল গোপন সংগঠন। ভ’য়াবহ, বিধ্বং’সী, আক্রম’ণাত্মক অ’স্ত্রগুলো তারা বিপুল টাকার বিনিময়ে দেশের যেকোনো প্রান্তে কিছু অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিচ্ছিলো, সরকার ও জনগণের অগোচরে চলছিলো বিশাল বড় কারসাজি। কিছু অ’স্ত্র বিশেষ সুপারিশের ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীর জন্য আনা হতো, কিছু অ’স্ত্র এমনও ছিলো যা দেশে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নি’ষিদ্ধ, সেসব ভয়াবহ নিষিদ্ধ অ’স্ত্রগুলো নির্দ্বিধায় সকলের চোখে ধূলো দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছিলো। ওসব বিপদজ্জনক অ’স্ত্রের ব্যাপারে যদি একটা মানুষ তিল পরিমাণ ধারণা পেতো, তাহলে তার পায়ের তলায় মাটি খসে যেতে সময় নিতো না।

এমনই একটা সংঘবদ্ধ দলকে ধরার পেছনে সামরিক বাহিনীর বিশেষ দল লেগেছিলো। প্রত্যেকটা দেশেই মূলত ‘ নেভাল ফোর্স ‘ নামে স্পেশাল ফোর্স রেডি তৈরি করা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের ‘ মারকোস ‘, আমেরিকার ‘ সিল টিম ৬ ‘, পাকিস্তানের ‘ এসএসজিএন ( SSGN ) টিম ইত্যাদি। যারা মূলত নেভাল ফোর্স বেস্ড স্পেশাল ফোর্স। তেমনি বাংলাদেশের জন্য আমাদেরও সফল ফোর্স রয়েছে, নাম ‘ সোয়াডস ‘ (SWADS)। যারা আমেরিকার ঘাঁটি থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসছে সেই বহু শতক আগে থেকে। তবে এর শুরুটা ২০০৮ সালের দিকে চট্টগ্রামে হলেও আনুষ্ঠানিক জন্ম ২০০৯ সালের দিকে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হওয়া সোয়াডস সদস্যদের প্রশিক্ষনটা কোনো সাধারণ ধাঁচের প্রশিক্ষণ নয়।

উক্ত প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ইন্সট্রাক্টদের আগমন ঘটে, যারা মূলত আমেরিকা-কোরিয়া-তুরস্ক থেকে এসে থাকে। তাদের চরম কঠোর-কাঠিন্য-শক্ত স্বভাবের জন্য তারা ‘ দ্যা ব্রুট ‘ বলেও পরিচিত, একজন সোয়াডস ক্যান্ডিডেটকে সফল সোল্ডার ( Soldier ) হিসেবে রূপান্তর করার জন্য এই ব্রুট ব্যক্তিদের বিশেষ অবদান উল্লেখ্যযোগ্য। বলে রাখা প্রয়োজন, প্রশিক্ষকরা কোনোপ্রকার নমনীয়তা, কোমলতা, দয়া দেখান না। তারা নির্মমতা এবং ত্রুটির ব্যাপারে অতি মাত্রায় হিংস্র। মূলত সকলেই সোয়াডস হবার সুযোগ পায় না, ঝরে পরার সম্ভবনা প্রায় ৯৮%। ‘ সোয়াডস ‘ এর অন্যান্য স্বতন্ত্র ইউনিট সম্পর্কিত তথ্যসমূহ ‘ হাইলি ক্লাসিফাইড ‘ বিধায় তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ জানা অসম্ভব। তবে এটুকু নিশ্চিত এই দল জল-স্থল-আকাশ পথে চলার জন্য সদা প্রস্তুত, সদা তৈরি। এবার ভেলকি দেখানোর আখেরী পর্ব চলে এসেছে।

স্বচ্ছ আয়নার সামনে দাঁড়ালো মাহতিম। চুল থেকে টুপ-টুপ করে পানি পরছে, ডানহাতটা দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে চুলগুলো পেছনে ঠেলে নিলো। শেভটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে কিনা সেটাও গাল ঘুরিয়ে দেখে ফেললো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফাস্ট-এইডের খোলা বাক্স থেকে একটানে গজ কাপড়টা বের করলো, ক্ষতের মুখে তুলা চেপে সাদা ব্যান্ডেজের কাপড় দিয়ে বাঁহাতটা পেঁচাতে লাগলো। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর ফোন বেজে উঠলে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো সে, ‘ HANNAN SHEKH ‘ ! ওমনেই মুখের স্বাভাবিক আঁচটা বদলে গিয়ে চিন্তার আদলে ছেয়ে গেল তার, মাহতিম ফোনটা বন্ধ ধরলো না। ফোনটা বেহালভাবে বাজতে-বাজতে একইভাবে আপনা-আপনি কেটে গেলো। টানা তিনবার কেটে যাওয়ার পর যখন আর কোনো কল আসলো না, তখন তাড়াতাড়ি নিজের ড্রেসিং সম্পণ্ণ করে ফোনটা হাতে তুললো মাহতিম। একসেকেন্ডও দেরি না করে কল বসালো জায়গামতো। সাতসকালে এমন একটি অচেনা নাম্বারের কল পেয়ে অপর প্রান্তের লোক বেশ বিরক্ত নিয়ে কল রিসিভ করলো, তার চেয়েও দ্বিগুন বিরক্তি মিশিয়ে বললো,

– হ্যালো, কে?
মাহতিম বিরক্তির ধাঁচটা পুরোপুরি ধরতে পারলেও সময় নষ্ট না করে মোদ্দাকথায় আসলো,
– আরাফাত সাহেব, নেভি ফোর্স থেকে মাহতিম আনসারী বলছি। এই মূহুর্তে আমার এলাকায় নেটওয়ার্ক জ্যাম করা চাই। টানা দুটো ঘন্টার জন্য সব স্থগিত। কল ড্রপ করার সাথে-সাথে কাজটা যেনো শুরু দেখি। এই এরিয়ায় যদি একটা কল আসতে দেখি, কিছুক্ষণ পর ইমেইল একাউন্টে নিজের রাস্টিগেট লেটার দেখতে পাবেন।
কল কাটার শব্দ হতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। এখনো আশ্চর্যের ঘোরটা তিনি কাটাতে পারেননি। পরিচয় শোনার পর ‘ বস্ বা স্যার ‘ বলে সম্বোধন করে মাফ চাইবেন, সেই সুযোগটাও এই নৌ-কর্মকর্তা দিলো না। কান থেকে ফোন নামিয়ে উক্ত সেল নাম্বারে তাকালেন তিনি, সত্যিই কি মাহতিম আনসারী কল দিয়েছে? তিনি কতো শত পুলিশকে তুড়ি বাজিয়ে ঢপ মেরে দিলেন, অথচ এই কন্ঠের কাছে এতো ঘাবড়ে গেলেন কি করে? কাছের কথা মনে পরতেই দ্রুত তিনি হন্য হয়ে ছুটলেন, এখুনি অনেকগুলো কল করতে হবে। একটু দেরি হলেই তার চাকরি নট, একেবারেই সাসপেন্ড!

চিন্তিত হান্নান শেখ কপালে রীতিমতো ঘাম ছেড়ে পায়চারি করছেন। হাতদুটো পিছমোড়া করে আবদ্ধ রেখে একবার এমুখো, আরেকবার ওমুখো করে ছুটছেন। বাড়িতে সবাই ঘুম শেষে নিজ-নিজ কাজে লিপ্ত, শানাজ একটু আগে কলেজের দিকে বেরুলো, সুরাইয়া-সাবা ঘরের কাজ দেখছে। সাবা উঠোনে বসে কাঁচা মরিচের বোটা আলাদা করতেই দাদার রুমের দরজা গলে ভেতরে তাকিয়ে আছে। দাদাকে খুবই চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে এখন, কি নিয়ে চিন্তায় মগ্ন সেটা জানার জন্য খচখচানি হচ্ছে সাবার। সাবা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে বারবার সেদিকে দেখছে, ব্যাপারটা সুরাইয়ার দৃষ্টিতে আঁটকা পরলে সাবার মাথায় চাট্টি মেরে বলে,

– ওখানে কি? কি দেখিস ওখানে? ভাতার দেখিস?
সাবা মুখটা বিকৃত করে সুরাইয়ার দিকে তাকালো, সেও পালটা প্রতি’শোধ হিসেবে সুরাইয়ার দিকে মরিচ ছুঁড়ে বললো,
– মুখ সামলে কথা বল্! আমি ওখানে দাদাভাইকে দেখছি। তোর মতো খাচ্চ’র ভাবিস নাকি?
সুরাইয়া এবার ফুঁসে উঠে বললো,
– খবরদার আমাকে ‘ খা’চ্চর ‘ ডাকবিনা সাবা!
সাবা আরো রাগ দেখিয়ে আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
– তুই আমাকে নাম ধরে ডাকবি না! তোর মায়ের মতো ফাতরামি করলে দাদাভাইয়ের কাছে বিচার লাগাবো! চুপচাপ মরিচ কুট্। অন্যদিকে চোখ দিলে এক্কেরে কষিয়ে মা’রবো।
সাবার হুঙ্কারে চুপটি মা’রলেও রাগে দপদপ করছিলো সুরাইয়া। উঠোন থেকে চেঁচানির আওয়াজ পেয়ে এবার হান্নান শেখ নিজেই ছুটে এলেন, আক্রোশে ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,

– তোমাদের ঝগড়া কি কোনোদিন থামবে ভাই? প্রতিদিনই তোমরা বোনেরা-বোনেরা লড়াই করো, আমার বুড়ো শরীরটা এসব দেখলে কি টিকবে?
হান্নান শেখের কড়া গলায় দু’বোন খামোশ হয়ে মাথা নিচু করলো। সাবা অপরাধীর মতো মুখ করে আরো খিঁচিয়ে গেলো, সুরাইয়ার অবশ্য গায়েও লাগলো না। সাবা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে অধোমুখে বললো,
– দাদু, আজ আমি ভুল করিনি। এই সুরাইয়া আমাকে ইচ্ছা করে রাগায়। দাদু, আপনি কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?
টনক নড়লো হান্নান শেখের, তিনি নিজের চিন্তান্বিত চেহারার উপর স্বাভাবিক চেহারার মুখোশ লাগিয়ে চাপা হাসিতে বললেন,

– না না, কিসের চিন্তা দাদু? ওই আমার ছোট দাদুভাইয়ের কথা একটু খুব মনে পরছিলো। কতোদিন ওকে একটু দেখিনা। সবসময় তো চোখের সামনে থাকতো, মনে একটা জোর পেতাম। দূরে থাকে তো, কথাও হয়না।
মুখে উদাসী ছাপ ফেলে মলিন করে হাসলেন হান্নান শেখ। তাঁর চলে যাওয়ার দিকে নির‍্যুত্তর ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো সাবা, অন্যদিকে সুরাইয়া দাদার দিকে মুখ ভেঙচি করে তীব্র আপোষ বুঝালো। হান্নান শেখ পুনরায় মলিনতার ছাপ উবে দিয়ে রাগান্বিত মুখায়বে ফিরে এলেন, কলটা ধরলো না, আবার মেহনূরের নতুন ফোনটাও বন্ধ। এখন সবার ফোনই ‘ নট রিচেব্যাল ‘ বলছে। কি চালাকি হচ্ছে ওখানে? ও কি টের পেয়ে গুটি সরালো নাকি? গায়ের রক্ত যেনো টগটগ করে মাথায় উঠে গেলো, তিনি দ্রুত বিছানার তোশক উঠিয়ে গোপন ফোনটা বের করলেন। এবার এটার ব্যবহারের সময় এসে পরেছে।

সূর্যের অবস্থানটা আকাশের মধ্যখানে ঠিক মাথার উপর। ভূমিতে সোনালি আলোটা বেশ প্রখর হচ্ছে, ঘড়িতে ঘন্টার কাটাটা বারোর দিকে, মিনিটের কাটাটা সদ্য পনেরোর ঘরটা ছুঁয়েছে। বাড়ির সিড়ির কাছে একসারিতে তিনটা গাড়ি থামানো। প্রথমে ভোলভো কোম্পানির আভিজাত্যপূর্ণ গাড়িটা আয়েশী স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে দশ সিটের পারিবারিক মাইক্রোবাসটা, তার পেছনে দাম্ভিকের চেহারা নিয়ে থেমে আছে জিপটা। রজনী আজ শাড়ি পালটে হলুদ থ্রিপিসের বেশে সেজেছে, স্পা করা চুলগুলো ছেড়ে সানগ্লাসটা মাথায় সেঁটে রেখেছে। অনামিকার পড়নে হাতাহীন কালো কূর্তি, ভেতরের মেয়েলি পোশাকের স্বচ্ছ চিকন স্ট্রিপদুটো দু’কাধের উপর দৃশ্যমান।

রজনী নিজেই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করবে বলে মারজাকে সে জোর করে পাশে বসিয়ে নিলো, অনামিকার সুপ্ত ইচ্ছাটা জিপের ড্রাইভিং সিটের পাশে বসার ছিলো, কিন্তু রজনী সে ইচ্ছাতে পানি ছুঁড়ে চোখ রাঙানি দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। মাইক্রোটাকে বিদায় দিয়ে রজনীর ভোলভো গাড়িটা সবার আগে ছুটলো। তৌফের সাথে ট্যূরের রাস্তা নিয়ে কথা বলতে-বলতে আসছিলো মাহতিম, এদিকে মাইক্রোটা আস্তে-আস্তে পূরণ হয়ে শেষ। হুট করে কল আসলে বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করতে কোণায় চলে যায় মাহতিম, ততক্ষণে নীতির হাত ধরে নিচে নেমে আসে মেহনূর। গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা আজ ভিন্ন কায়দায় পরিয়ে দিয়েছে নীতি, শাড়ির সাথে হুবহু কালার মিল করে মখমলের ছোট হাতার ব্লাউজ।

নীল জামদানী শাড়িটাকে লেহেঙ্গার মতো পরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা লেহেঙ্গার ওড়না যেমন ঘুরিয়ে এনে বুকের সামনে দিয়ে আঁচলের মতো পিছনে ছেড়ে দেয়, ঠিক সেই স্টাইলে যেনো শাড়ির বেশভূষা। চুলগুলো সব পেছনে টেনে বেশ মোটা এবং লম্বা একটা বেণী ঝুলিয়ে দিয়েছে, মাথার অগ্রভাগে ছোট-ছোট চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দিয়েছে। নীতি ইচ্ছে করে সাজায়নি মেহনূরকে। যে মেয়েটা আকাশের সমস্ত নীলকে একীভূত করে নিজের গায়ে জড়িয়ে ফেলেছে, তার দেহে আলগা রঙের কৃত্রিম সাজটা একদম বেমানানই লাগবে। সিড়ি দিয়ে নামতে-নামতে এই ফাঁকে আরেকবার ব্লাউজটা নিচের দিকে টান মারলো, তবুও ব্লাউজটা পেটের চিলতেখানি ফাঁকটা ঘুচালো না। নীতির হাত ছেড়ে পিছু-পিছু আসতেই হঠাৎ বাঁদিকের কোণায় চোখ পরলো মেহনূরের, সাদা শার্টের টানটান পিঠটা আড়চোখে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। আজ কেনো শার্টের হাতাদুটো গুটায়নি? বাঁহাতটা কি প্রচণ্ড ব্যথা? সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই অন্যমনষ্ক মেহনূর শাড়িতে হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পরলো, ওমনেই হাতের নীলগাছী চুড়িগুলো রিনঝিন করে উঠলো। নীতি সদর দরজার কাছে এসে পাশের সু’শেল্ফ থেকে দুজনের জুতা বের করতে নিলে পেছন থেকে বাধা দিলো মেহনূর,

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪০+৪১

– আমার জুতা নিতে হবেনা আপু, আমি নেই। আমি নেই। আপনি গাড়িতে উঠুন।
কথা মতো, দ্বিতীয় গাড়িটাও ‘ সরাৎ ‘ করে মেইন গেট দিয়ে ছুটে গেলো। জানালা দিয়ে গাড়ি যাওয়ার দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে চিন্তার ভারী নিঃশ্বাসটা ছাড়লো মাহতিম। কলে কথা বলতে-বলতে দরজার কাছে আসতেই দেখলো তার সু’জোড়া রেডি। কাজটা নীতির ভেবে এক পশলা হাসি দিয়ে কালো সু’য়ের খাপে পা ঢুকিয়ে দিলো। ফিতা বাঁধার জন্য নিচে ঝুঁকতে নিলে তখনই সরু ফিতাগুলো আয়ত্তে নিয়ে ফেললো এক খন্ড নীল রাজ্যের উষ্ণতা। মাহতিম অনুভব করলো, তার হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার হাতে থাকা ফোনটা কান থেকে নির্লিপ্তে নেমে যাচ্ছে, কলের ওপাশ থেকে অনবরত বলেই যাচ্ছে,
– হ্যালো স্যার? স্যার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আনসারী স্যার, আপনি কি…..

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪৪+৪৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here