মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫২+৫৩
ফাবিয়াহ্ মমো
সৌভিক থতমত খেয়ে মহা বিষ্ময়ে হা করে আছে। তার মাথা ঘোলাটে হয়ে গেছে, চিন্তাশূন্য হয়ে খারাপ অবস্থা। তাড়াতাড়ি ফোন কেটে ড্রাইভ করছে সে, দ্রুত আনসারী নিবাসে পৌঁছে মেহনূরকে সরিয়ে ফেলতে হবে। স্পিড বাড়িয়ে দ্রুততার সাথে গাড়ি ছুটালো, এদিকে মাহতিমের প্রখর বুদ্ধি দেখে প্রশংসা না করে পারলো না। দূর থেকেও সামান্য একটা ফোনকলের মাধ্যমে চরম একটা ব্যাপার ধরে ফেলেছে। ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের ধরার কথা না, সামান্য একটা বাক্যের মধ্যে যেভাবে বেফাঁস কথা বেরিয়ে গেছে সেটা ভাবতেও গা ছমছম করছে।
মেহনূর তার গলাব্যথার কথা কাউকে জানায়নি, অনেক রাত পযর্ন্ত যে মাহতিমের সাথে কথা বলেছে সেটাও ওই বাক্যের ভেতর স্পষ্ট। তার মানে একটা ব্যাপার পুরোপুরি স্পষ্ট, বাড়িতে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে, সে টাইম-টু-টাইম বাড়ির ভেতরকার খবর বাইরে চালান দিচ্ছে। মাহতিমের কথামতো, তাড়াতাড়ি সৌভিক বাড়িতে পৌঁছে গেলো। সৌভিককে দেখে সবাই আশ্চর্য হলেও সৌভিক সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত মেহনূরকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। ডাক্তার কোনোভাবেই দূরগামী জার্নির জন্য সম্মতি দিচ্ছিলেন না। এদিকে নাছোড়বান্দা সৌভিক জিদ-ক্ষোভ দেখিয়ে হুঙ্কার করতে-করতে ডাক্তারকে হসপিটালে ফিরতে বললো। এই মূহুর্তে ডাক্তারকে কিছুই বলার সময় নেই। বাড়িতে কে সাধু সেজে বসে আছে সেটা মাহতিমও জানে না। বিপদ কতটা ঘন হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে কে জানে? মেহনূর নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে জেরা করতে শুরু করলে সৌভিক কোনোটাই উত্তর করলো না। চুপচাপ ঠাঁট বজায় রেখে শেষবারের মতো বলে ফেললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– সরি ভাবী। এ্যাক্সট্রেমলি ভেরি সরি। আমাকে প্লিজ বাধা দিবেন না, আমি যা করছি, যেমন করছি সবই কারো নির্দেশ মোতাবেক। আশাকরি আপনি আমার কথা বুঝেছেন। আপনি এই মূহুর্তে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমি সব সময় মতো বলবো।
সুক্ষ্ম ইঙ্গিতটা বুঝতে দেরি করলো না মেহনূর। কথায়-আভাসে বুঝে গেছে মাহতিম দূর থেকে কড়া নির্দেশ চাপিয়ে দিয়েছে, মাহতিমের কথা অমান্য করা অসম্ভব! মেহনূর অসুস্থ হলেও নার্সের সহযোগিতায় রেডি হয়ে নিলো, মাহতিমের দেওয়া লাগেজটায় সবগুলো শাড়ি গুছিয়ে রুম থেকে বেরুলো। অনামিকা ও রজনী প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে, ড্রয়িংরুমে মেহনূর যখন সবার কাছ থেকে একে-একে বিদায় নিচ্ছে, তখন তারা দুজন একে-অন্যের দিকে বিষ্ময়ে চাওয়াচাইয়ি করছে। অনামিকা চোখ দিয়ে রজনীর দিকে ইশারা করলো, ইশারায় বুঝিয়ে বললো,
– এই গেঁয়োটা কোথায় যায়? হুট করে কোথায় ছুটলো?
রজনী সবার আড়ালে ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে ঠোঁট উলটে ফেললো। ইশারায় বুঝিয়ে দিলো,
– জানি না।
অনামিকার কৌতুহল ভাব কাটলো না। সে এখন পুরোপুরিভাবে সুস্থ হলেও ডে-টু-নাইট ডাক্তারের কনসাল্ট মোতাবেক চলা লাগে। রজনী সরু চোখে মেহনূরের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টায় আছে। গতরাতে সে ঠিকই মাহতিমকে ভয় দেখানোর জন্য টেক্সট পাঠিয়েছিলো, কিন্তু সেটা কেবল হালকা মতোন ভয় ঢুকানোর জন্য। সে যে কতটা ভয়ংকর মানুষ, সেটাই মাহতিমকে তিলে-তিলে ঠাওরাতে চাচ্ছিলো। অথচ, এখন যে সিন-সিনারি দেখছে তার সাথে একটুও গতরাতের চিন্তাভাবনা মেলাতে পারছেনা রজনী।
মাহতিম তো এতো সহজে ভয় পাবার পাত্র নয়। তাকে টলাতে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙার কথা, সেদিকে আরামসে মেহনূর বাড়ি থেকে বিদায় হচ্ছে এটাই বড় চিন্তার বিষয়। মারজা চুপচাপ ভঙ্গিতে নতমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনার ভাব-ভঙ্গিতে তীব্র অসন্তুষ্টের ছাপ বোঝা যাচ্ছিলো, তিনি যে নিরুপায় ও নিঃস্ব, ছেলের সাথে কঠিনভাবে পরাজিত, এটা মুখ দিয়ে না বললেও করুণ দৃষ্টি দিয়ে উপচে-উপচে বোঝা যাচ্ছে। মেহনূর যাওয়ার পূর্বে মারজাকে গলা জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে রাখল। উপস্থিত সবাই নিরব দর্শকের মতো তাকানো ছাড়া হাল দর্শাতে পারছিলো না।
অবশ্য কারোর হাতেই কিছু করার মতো স্থিতি নেই। মাহতিম যেখানে জড়িত, সেখানে তার গর্ভধাত্রী মা-ও বিফল। নীতি চুপচাপ সব দেখতে থাকলেও তার মনের কোণে কিছু একটা নিয়ে খটমট লাগছিলো। এভাবে তো মেহনূরকে বাড়ি থেকে পাঠানো যায় না, এর পেছনে কি গুরুতর কারণ আছে? তার ভাই মাহতিমের মাথায় কি গভীর পরিকল্পনা ঘুরছে? নিশ্চয়ই ঘুরছে। নাহলে এমন সিনেমাটিক ঘটনা সে ঘটাতে যেতো না। নীতি খামোশ থাকলেও তার ভেতরটা বলছে সামনে কোনো দূঃসহ পরিণতির জন্য মাহতিম আগেভাগে মাঠে নেমেছে। মাহতিম নির্ঘাত নিরবে-নিরবে দাবার ঘরগুলো উদ্যমের সাথে সাজাচ্ছে। এই খেলাটা বুদ্ধির, আবার অনেকটা কৌশলের। প্রতিপক্ষটা কে, সেটা আপাতদৃষ্টিতে না জানলেও জয়ীটা যেনো মাহতিম হোক। নীতি মনে-মনে তেজের সাথে কথাগুলো আওড়ালো। আজই সে মাহতিমকে কল করবে। কি ধরনের ছলাকলা প্রস্তুত হচ্ছে তা জানা আবশ্যক! আর দেরি নয়।
গাড়িটা হাইওয়েতে উঠিয়ে স্পিড আরো দ্বিগুণ করলো। ডানে মুখ ঘুরিয়ে দেখলো সৌভিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে। শীতল এসির ভেতরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম কণা তার সুডৌল কপালে চিকচিক করছে। স্টিয়ারিং ধরে খুব তাড়াহুড়োতে আছে সৌভিক। শান্ত দৃষ্টিতে সেটাই মেহনূর চুপ করে দেখছিলো। বন্ধুদেবর সৌভিকের সাথে অতোটা খোশমেজাজের সম্পর্ক নেই, অনেকটা শীতল সম্পর্কের মতোই তারা চলেছে। কিন্তু বিপদে-আপদে এই সৌভিককেই পাশে পেয়েছে সবাই। আজ কেনো জানি চিন্তিত মুখ দেখে একটু ভাবান্তর হলো ওর। সৌভিকের উদ্বিগ্ন হবার কারণ জিজ্ঞেস করতে মন চন্ঞ্চল হয়ে উঠলো,
– ভাইয়া?
হাই স্পিডে ড্রাইভ করা সৌভিক চকিতে মুখ ফেরালো। মেহনূরের উজবুক চাহনিটা দেখতে পেয়ে মিছে-মিছে হাসি টেনে বললো,
– জ্বী ভাবী, কিছু প্রয়োজন? কিছু লাগবে? খারাপ লাগছে?
মেহনূর দ্রুত মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়াতে-নাড়াতে বললো,
– না, না ভাইয়া। ওসব কিছু লাগবে না, আমি ঠিক আছি। আপনাকে একটা কথা বলি?
প্রশ্নের আঁচ টের পেয়ে ঢোক গিললো সৌভিক। নাজানি কেমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে মুখ থুবড়ে পরতে হয়। স্বাভাবিক থাকার ভান ধরে বললো সে,
– হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। তা আর বলতে? জিজ্ঞেস করুন।
মেহনূর সিটে গা হেলানো অবস্থায় আস্তে করে বললো,
– উনি আপনাকে কি বলেছেন ভাইয়া? ঠিক কি কথা শুনে আপনি অফিস ফেলে এইভাবে ছুটে এসেছেন? মিথ্যা বলবেন না ভাইয়া, দয়াকরে কোনোকিছু লুকোবেন না। উনি যা বলেছেন সবটুকুই আমি জানতে চাই।
সৌভিক কঠিন অস্বস্তির ভেতর পরে গেলো। ড্রাইভটা ঠিকঠাক মতো করলেও একজোড়া প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি তার দিকে উন্মুখ হয়ে আছে। এখন কি করে আসল কোথাটা বলতে যাবে? সৌভিক ইনিয়ে-বিনিয়ে মিথ্যা বানিয়ে বললো,
– ভাবী, মাহতিম আসলে তেমন কিছুই বলেনি। শুধু বললো সামনে তো আমার কাজের চাপ বাড়বে। তাই যেনো দেরি না করি। তখন নানারকম মিটিংয়ের জন্য এমনেতেও আমি সময় পাবো না। এজন্য এখনই যেনো কাজটা সেরে ফেলি। ব্যস, এটুকুই জোর দিয়ে বলেছে।
মেহনূর কয়েক মূহুর্তের জন্য স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। সৌভিক মনে-মনে ভাবলো মেহনূর বোধহয় বিশ্বাস করে ফেলেছে, তাই সে চুপ করে আছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিরোধী গলায় বললো মেহনূর,
– আপনি সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা বলছেন সৌভিক ভাইয়া। উনি কক্ষনো আপনাকে এ ধরনের কথা বলেননি। গতকাল উনি যখন কল দিয়েছিলেন, উনি কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক ছিলেন না। আপনিও গড়িমসি করে উত্তরগুলো দিলেন।
অস্বাভাবিক হবার কারন সৌভিকের জানা। তবুও অকাট্য সত্যটা মুখ ফসকে বলতে পারছেনা। সামনেই একটা ট্রাফিক জ্যামে ওদের গাড়িটা থামলো, মেহনূর তার প্রশ্নের জবাব না পেলেও চুপ করে রইলো। জার্নির প্রায় দুটো ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এরই মধ্যে পকেট থেকে লাগাতার কল বেজেই যাচ্ছে। বাঁ পা-টা এক্সিলেটর থেকে সরিয়ে একটু সোজা করলো সৌভিক। বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাজতে থাকা ফোনটা বের করতেই রিসিভ করলো সে। সৌভিক মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে কাঁচটা একটু নামিয়ে দিলো, আড়চোখে মেহনূর সেটাই তখন বারবার লক্ষ করছিলো। সৌভিক খুবই নিচু কন্ঠে কথা বলছে, ফিসফিসানির মতো শোনালেও মেহনূর কান পেতে ভাসা-ভাসা কিছু শুনতে পেলো,
– সুস্থই আছে। এখনো বমি-টমি করেনি, না কিছুই খায়নি। তুই টেনশন করছিস কেন? জ্যামে পরেছি —
আর শোনার প্রয়োজন নেই। মেহনূর নিশ্চিতরূপে বলতে পারবে এটা কে করেছে। জ্যামের ভেতর উটকো অবস্থায় আঁটকে পরলেও মাহতিম তার খোঁজখবর নিয়েই চলছে। চোখ বন্ধ করে বুকভর্তি নিশ্বাস ছাড়লো মেহনূর, তার জীবনে এমনও মোড় আসবে ভাবতে পারেনি সে। ছোট থেকে গ্রামের দায়বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। সেখানে সবকিছু শৌখিন ভাবে পেলেও বাইরের আবহাওয়ায় মেলামেশার সুযোগ কম ছিলো। গ্রামের মেয়েরা যেমন চন্ঞ্চল, দক্ষ ও উড়নচণ্ডী স্বভাবের হয়ে থাকে, সেখানে তাদের পরিবারের চারটা মেয়েই সেসব থেকে মুক্ত।
কেবল, ঘর-দুয়ারেই তাদের আসল সীমাটা নির্ধারণ করা থাকতো। আজ বহুদিন পর মহিমপুর গ্রামে দাদাভাইয়ের কাছে ফিরছে মেহনূর। ছোট্ট থেকে যার আঙ্গুল ছুঁয়ে বড় হয়েছে তার কাছে যেতে একটুখানি বিরহ লাগছে। এই বিরহ ভাবটা হয়তো মাহতিমের জন্য। উদাসী মুখে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেললো মেহনূর। নীল আকাশের বুকটায় সাদা-সাদা মেঘগুচ্ছ আশ্রয় নিয়েছে, হাওয়ায় ধীরে-ধীরে দূর-দূরান্তে পাড়ি দিচ্ছে সেগুলো, নীল বুকটা যেনো খালি করে হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, চোখের সামনে কালো পর্দা নেমে পরলেও সেখানে সুন্দর-সুন্দর স্মৃতিগুলো দেখতে লাগলো। গ্রামের পরিবেশে সুনশান রাত, চারিদিকে ঘোর বর্ষণে আকাশ কাঁপছে, ঠান্ডা মৌসুমের শীতল হাওয়া রুমে ঢুকছে। বিয়ের প্রথম রাত ছিলো, মনে ছিলো একবুক জড়তাযুক্ত ভয়। সেই ভয়ের ভেতর যুবা পুরুষটা তার কাছে এসে অমোষ আবদার জুড়ে দিলো।
সেই আবদারটা ফেলতেও পারলো না, নাকোচও করলো না মেহনূর। তার নিরবতাকে সম্মতি ভেবে সেদিন শুধু ওইটুকু চুমুই কোমরের ক্ষতটায় ছুঁয়ে দিয়েছিলো। বাকিটা রাত সে কিছুই করেনি। সেদিন বৃষ্টিস্নাত রেসোর্টের অন্ধকার কামড়ায় প্রথম অধরযুগলের আচ্ছাদনটা তার জীবনে প্রথম আনন্দানুভূতি ছিলো। মাহতিমের উন্মুক্ত বুকের ভেতর পুরোটা রাত নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো মেহনূর। মাহতিমও তার দেহের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে ছায়ার মতো আগলে রেখেছে তাকে। কখনো চুলের চামড়ায় আঙ্গুল রেখে বুলিয়ে দিয়েছে, কখনো আধো-আধো বুজে আসা আঁখিপল্লবে চুমু খেয়েছে, কখনোবা বুকের কাছে ছোট্ট মাথাটা দুহাতে ঢেকে রেখেছে সে। এমন রাত বারবার পেতে চায় মেহনূর, যদি এমন রাত পাওয়ার জন্য কষ্টও সহ্য করা লাগে তাও করবে সে।
স্বামী-স্বর্গ-সুখ পুরো ব্যাপারটাই সে বারবার-বহুবার-অসংখ্যবার পাওয়ার জন্য চন্ঞ্চল-অস্থির-উন্মাদ হতে প্রস্তুত। দুচোখের পাতা হঠাৎ খুলে ফেললো মেহনূর। কোলের হ্যান্ডব্যাগ থেকে ত্রস্ত হাতে মোবাইল বের করলো, পাশে থাকা সৌভিক একটু জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেও তার মনোযোগ এখন জ্যাম ছুটা উদ্যম রাস্তার দিকে। মেহনূর কাঁপা-কাঁপা আঙ্গুলগুলো কোনোরকমে স্ক্রিনে চালিয়ে দ্রুত একটা কল বসালো। বাঁহাতটা কাঁপতে-কাঁপতে উপরে উঠিয়ে ওমনেই জানালার সাথে কনুই ঠেকিয়ে দিলো, কনুইয়ে ভর রেখে বাঁ-কানে ফোন ধরলো মেহনূর। গলার ঢোক গেলার গতিটা ফোনের প্রতিটা টোনের সাথে বেড়ে চলেছে। একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে, ‘ একটু যেনো ফোনটা ধরুক, ফোনটা যেনো নি’ষ্ঠুরের মতো না কাটুক। হোক সে ব্যস্ত, তবুও ওই ব্যস্ততা থেকে একটা মিনিট দিলেই চলবে, অন্ততপক্ষে ‘ হ্যালো ‘ শোনার সুযোগটা হোক। ‘ মেহনূরের উৎকন্ঠা দেখে সৌভিক শুধু হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো।
ড্রাইভের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিলেও তার ব্রেনের অন্য অংশটা স্মৃতির পাতা ঘাটছে। কতগুলো দিন, কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে, সে ভুলেও পেছনের দিকে ফিরে দেখেনি। পেছনের সেই বর্ণিল সুন্দর সময়গুলো, সেই রেসোর্টের শেষ রাতটায় পুকুরপাড়ে বসে দুজনের গালগল্পটা এখনো বুকের ভেতর হু হু করে আন্দোলন তোলে। শানাজের অশ্রুভরা টলটলে চোখদুটো সৌভিকের চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, সেই শানাজ আজ কোথায়? শানাজ তাকে বলেছিলো, ‘ তুমি শহরে গেলে আমাকে ভুলে যাবে সৌভিক ‘। সৌভিক তো সত্যিই ভুলে গেছে, এমন নির্দয়ের মতো কর্মকাণ্ড করার পর আজ কি করে শানাজের মুখোমুখি হবে? সাহসটা কি করে পাবে সৌভিক? শানাজকে সে দূরে সরিয়ে রেখেছে, এতে কি শানাজ কঠিনভাবে মর্মাহত হয়নি? শহরে ফেরার পর শেষ একটা ম্যাসেজ করেছিলো শানাজ, তাও কলেজের বাইরে গিয়ে এক সহপাঠীর চোরা ফোন দিয়ে ম্যাসেজ করেছিলো। সেই ম্যাসেজের উত্তর আজও দেয়নি সৌভিক।
‘ আমি জানি তোমরা খুব বড়লোক সৌভিক, তোমরা কোনোদিন গ্রামের মেয়েকে বউ হিসেবে ঘরে তুলবে না। তোমার সাথে আমার যে কদিনের সম্পর্ক ছিলো, সেটা যেমনই হোক একটা স্বচ্ছ-সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। আমি কষ্ট পাইনি, আমার জন্য চিন্তা কোরো না। তোমার সাথে সুন্দর একটা গোছানো স্বপ্নের জগত এতোদিনে ভেঙ্গে গেছে। তোমাকে কোনোদিন দোষারাপ করবো না। সব সম্পর্কের পরিণতি যদি সুখই হতো, তাহলে ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার পর মানুষ প্রচণ্ড খুশীতে হাউমাউ করে কাঁদতো না।
আমি আর কোনোদিন তোমাকে বিরক্ত করবো না, আমার পক্ষ থেকে আর কখনো তুমি বাধা পাবে না, ঝামেলাও যাবে না। তুমি ঘর সংসার করে সুখী হও। তোমার ব্যবসায়িক জীবন, তোমার আগামীর পথচলা যেনো সফলতার হোক সৌভিক, তুমি খুব ভালো থাকো। ‘
একহাতে স্টিয়ারিং ধরে পকেট থেকে ছোট্ট একটা রুমাল বের করলো সৌভিক। রুমালটা দিয়ে খুব সাবধানে চোখের অসতর্ক বিন্দুটা মুছে নিলো। এমন একটা ভান করলো যেনো চোখে ডাস্ট ঢুকেছে। মেহনূর একপলক সৌভিকের দিকে তাকিয়ে ফের নিজের কাজে ফিরলো। কলটা এখন শেষ টোনের কাছাকাছি এসে গেছে, যেকোনো মূহুর্তেই আপনাআপনি কেটে যাবে। ব্যথা গলাটায় আরেকবার ঢোক গিলে মৃদ্যু ব্যথাটা চোখ খিঁচে সহ্য করলো, তখনই কলটা খট করে রিসিভ হতেই ব্যস্ত সুরে বললো,
– হ্যালো?
কুঁচকানো চোখ খুলে এবার জোরেসোরে ঢোক গিললো সে, গলায় প্রচুর ব্যথা হলেও সেটা পাত্তা দিলোনা মেহনূর। চাপা অস্থিরতায় স্বর নামিয়ে বললো,
– আপনি কোথায় আছেন?
গাড়ির বেদম গতির জন্য সৌভিকের কান পযর্ন্ত কথা যাচ্ছে না। মেহনূরের অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে ফোনের বিপরীতে আশ্চর্য হলো মাহতিম। কপালে অসংখ্য দাগ ফেলে গম্ভীর গলায় বললো,
– কেনো? কোথায় আছি এটা জিজ্ঞেস করছো কেনো? কি হয়েছে তোমার?
মেহনূর সত্য কথাটা বলতে যেয়েও ইতস্তত বোধ করছে। মুখটা জানালার কাছে এনে শূন্য গলায় বললো,
– জানিনা, শুধু জানি আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
কথাটা বলেই চোখ বুজলো মেহনূর, সূর্যের তাপটা সরাসরি জানালার কাঁচ ভেদ করে বদ্ধ চোখের পাতায় পরলো। রৌদ্রের গাঢ় উষ্ণতা টের পেতেই ওপাশ থেকে কন্ঠ নরম করে বললো,
– আমি আসবো তো। আমার বউ আমাকে স্মরণ করছে, ডাকছে, তার কথা কি আমি ফেলে দেবো? নিজের দিকে যত্ন নাও মেহনূর। যেখানে পাঠাচ্ছি সেখানকার আলো-বাতাসে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠো। আমি ফ্রি হয়ে তোমাকে রাতে কল করছি। এখন রাখি, ব্যস্ত।
মেহনূরের কথাটা না শুনেই কল কাটলো মাহতিম। কাঁপুনি দেওয়া হাতটা আস্তে করে কোলের উপর রাখলো মেহনূর। হঠাৎ হাতটা কেঁপে উঠতেই জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে কোলে তাকালো সে, স্ক্রিনের নোটিফিকেশনে একটা ম্যাসেজ শো করছে। চলন্ত গাড়ির ঝাঁকুনির ভেতর ম্যাসেজটায় চোখ বুলালো মেহনূর, সাথে-সাথে এক ফালি রোদ্দুরের মতো উজ্জ্বল হলো মুখ। প্রাণবন্ত মিষ্টি হাসিটা তার সারা মুখ রাঙিয়ে রাঙা করে তুললো। বারবার একই ম্যাসেজটা পড়তেই লাগল মেহনূর,
I just want three things Mehnur Afrin,
To see you,
To hug you,
To kiss you.
When you kissed me with love in your heart, you owned my soul.
ILY .
– Mahtim Ansari.
খুব ব্যস্ত সময় কাটছে। এবার দেশের ভেতর দামী-দামী ‘ মাল ‘ আনার কন্টাক্ট পেয়েছে। এই কন্টাক্টটা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি মোটা অঙ্কের টাকাও পাবে। এই ‘ বিদেশী মাল ‘ জায়গা মতো পৌঁছানোর আদেশ পরেছে, কাজটা করতে পারলে বিরাট একটা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। দেশের ভেতর গুপ্ত ষ’ড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে অনেকেই, কিন্তু তাদের হাতে উপর্যুক্ত মা’ল নেই বলা চলে। মালের মজুদ ঠিকঠাক মতো জোগান পেলেই আবার মাথাচাড়া উঠবে তারা। কালাম সরদার পুরোদমে দলের সাথে লেগে পরেছে, একে-ওকে নানা কাজ চাপিয়ে হিসেব বুঝিয়ে যাচ্ছে। এবারের পরিকল্পনা খুব সহজ, তাদের যাতে কেউ বাগে আনতে না পারে তার জন্য খুব শীঘ্রই হাতের কাছে একজনকে মে-রে ফেলবে তারা। পুরো প্ল্যানও ফিক্সড। তাকে আগে কু’টিকু’টি করে টুকরো করবে, তারপর নিজেদের কাজে মত্ত হবে তারা। রাত এখন বারোটা।
গ্রামের সবচেয়ে জঙ্গলপূর্ণ লোকশূন্য জায়গাটা এখন হারিকেনের আলোয় আলোকিত। হারিকেনের পলতেটা ইচ্ছে করে কমানো। যাতে দূর থেকে কোনো মা’তাল গাঁ’জাখোর ভুলেও এখানকার হদিশ না করতে পারে। নিরিবিলি বনভূমিতে গুপ্ত কারবার চালাচ্ছে তারা। একদল বিশ্বস্ত ছেলে-যুবক কা’মলার মতো খেটেখুটে কাজ করছে। গরুর খড়ের মধ্যে কারসাজি করছে তারা। উঠোনের খড় ছড়ানো জায়গাটার একপ্রান্তে দাঁড়ালো কালাম সরদার, তার পড়নে এখন লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেন্ঞ্জি। লুঙ্গিটা হাঁটুতে তুলে ভাঁজ করে রেখেছে, মাথায় একটা গামছা বাঁধা। সে কালচে আকাশে দৃষ্টি তুলে সময়ের হিসাব কষে নিলো, আর মাত্র দুই ঘন্টা পরেই মেহনূর এখানে পৌঁছে যাবে। সৌভিকের শেষ কল মতে তারা এখন নিকটবর্তী গ্রামে চলে এসেছে।
কিন্তু গ্রামের ভাঙ্গাচুরা, খাঁজওয়ালা রাস্তার জন্য ইচ্ছে করে আস্তে ধীরে আসছে। মেহনূর ঝাঁকুনি নিথে অসমর্থ বিধায় পন্ঞ্চাশ মিনিটের জায়গায় এখন দুই ঘন্টা লাগবে। আজ যদি মেহনূর এসে যায়, তার মানে বাকি হিসাব খুব সহজ। মেহনূরকে দেখতে আসার জন্য একবার হলেও এখানে আসবে মাহতিম, এই আসার দিনটাই ঘনঘটা করে তাকে স্বাগতম জানাবে।দিনটা যেনো খুব দ্রুত আসুক এটাই চায় হান্নান শেখ। তার মন পৈশাচিক আনন্দে ফুরফুরে হয়ে উঠলো, ফূর্তির মেজাজে লুঙ্গির কোচা থেকে একটা ছোট্ট মোড়ানো কাগজ বের করলো। মোড়ানো কাগজটা সিধা করে খুলতেই সেখান থেকে দু’আঙ্গুলে এক চিমটি মশলা নিলো হান্নান শেখ, মুখ খুলে জিভের উপর ছেড়ে দিতেই স্বাদটা নিতে লাগলেন। সাথে সাথেই তার মাথাটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো, এক ঝটকায় মাথাটা দুপাশে নাড়িয়ে চনমনে জিনিসটা উপভোগ করলো সে। বাড়ি ফেরার আগে খুব কৌশলে মুখটা ধুয়েও নিতে হবে।
চারপাশে একযোগে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। কান যেনো তাক লাগানোর মতো শব্দ। লম্বা-লম্বা গাছগুলো ভূতুড়ে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে-মাঝে দমকা হাওয়ায় ডালাপালা নাড়িয়ে আরো ছমছমে ভাব জাগায়। চারিদিকটা আলোহীন, টিনের বাড়িগুলো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ফসলী জমি থেকে ধৈ-ধৈ করে অন্ধকার তেঁড়ে আসছে, অন্ধকার মেঠো রাস্তাটা দিয়ে একজোড়া হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলছে। এর আগেরবারও রাস্তাটা এমন জঘন্য ছিলো না, অথচ এখন এটার বেহাল দশা। মেহনূরের দিকে খেয়াল রেখে খুব সাবধানে ড্রাইভ করছে সৌভিক, মেহনূরের ঘুমটাও এমন ঝাঁকুনি খেতে-খেতে একটু আগে ভেঙ্গেছে।
মাহতিমের ডিউটি একটু আগে শেষ হলেও তার নাকি জরুরী একটা মিটিং পরেছে। মেহনূর জানালা দিয়ে তাকাতে পারলো না। এই গ্রাম, এই পরিবেশ তার চিরচেনা হলেও আজ বহুদিন পর এসে অচেনা ঠেকছে। রাতের নিরিবিলি অবস্থা দেখে ভয়-ভয় লাগছে। সৌভিকের জায়গায় যদি মাহতিম এখন পাশে থাকতো, সে মাহতিমের কাধে মুখ লুকিয়ে তার বাহুটা শক্ত করে ধরে রাখতো। এখন তার বদলে সিটবেল্টটা খামচে আছে মেহনূর। আরেকটু পথ এগোতেই একটানে পরিষ্কার রাস্তা পেয়ে গাড়ি হাঁকালো সৌভিক। একেবারে অন্ধকার ফুঁড়ে সেই ছেড়ে যাওয়া সদর দরজাটা দূর থেকে দেখতে পেলো, হেডলাইটের আলোয় সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছে এই রাস্তাটা আগের মতোই আছে। সোজা রাস্তাটা ধরে ডানে মোড় ঘুরিয়ে একদম উঠোনে এসে গাড়িটা থামলো। গাড়ির হর্ণ না বাজালেও হঠাৎ করে বাড়ির সদর দরজাটা ধপাস করে খুললো।
হারিকেন হাতে বেড়িয়ে এলো শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া সুজলা, মাহমুদা। তার পাশে উৎসুক চোখে হাসি-হাসি চোখে ছুটে এলো সাবা, এসেই মেহনূরকে অতি সাবধানে কলপাড়ে নিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে দিলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে সঙ্কোচ অনুভব করলেও সুজলার সুলভ আচরণে বিগলিত হয়ে প্রবেশ করলো সৌভিক। বুকের ভয়টা দুরুদুরু করছে, চোখদুটো বেহায়ার মতো কাউকে খুঁজে চলেছে। আশেপাশে কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছে সৌভিক। কি আশ্চর্য! এ বাড়িতে অতিথি এলে বউ নাতনীই স্বাগতম-সাদর জানায়, সেখানে আজ সে অনুপস্থিত? প্রচণ্ড খটকা লাগলেও হঠাৎ দুম করে বুকের ভেতর জোরে একটা ধাক্কা লাগলো। শানাজের কি বিয়ে হয়ে গেছে? শানাজকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না কেনো? হাতমুখ ধুয়ে রাতের খাবারটা খেলো সৌভিক। মেহনূরও তার পাশের চেয়ারে বসে খাবার নষ্ট করলো। হান্নান শেখ আজ বাড়িতে নেই। একটা গুরুত্বপূর্ণ তলবের ডাক পেয়ে সেখানে নাকি ছুটে গিয়েছে। সৌভিক একবার চিন্তা করলো সাবাকে সোজাসুজি শানাজের কথাটা জিজ্ঞেস করবে কিনা, পরক্ষণে লজ্জায় পরতে হবে বলে করলো না।
সব আয়োজন শেষে ঘুমানোর জন্য আগের রুমটাই দেখিলো দিলো মাহমুদা। সৌভিক হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে অতীতে থাকা সেই রুমটায় চলে গেলো। সবকিছুই আগের মতথ, আগের জায়গায় রাখা আছে। শুধু পরিবর্তন হিসেবে আলনায় জায়গায় একটা আলমারী দেখতে পাচ্ছে। সাদা ফুল স্লিভের শার্টটা খুলতে-খুলতে নরমাল টিশার্ট পরলো সে। প্যান্টটা বদলাতে গিয়ে সেটা পালটালো না। ঘড়িতে ভদ্র দাগে দুইটা ত্রিশ বাজছে। সৌভিক চুপচাপ কিছুক্ষণ মনস্থির করে বন্ধ দরজাটা খুললো। ডানে-বামে মুখ ঘুরিয়ে দেখলো চারপাশ অন্ধকার। বুকভর্তি দম নিয়ে দরজা ছেড় বেরিয়ে পরলো, অন্ধকারে পা টিপে-টিপে ছুটে গেলো পরিচিত দিকে। ছোট্ট প্রশস্ত জায়গাটা পেরিয়ে অপরপ্রান্ত চলে এলো, দোতলার সিড়ির ধরে সতর্কভাবে উপরে উঠে কাঙ্ক্ষিত রুমটার সামনে দাঁড়ালো। মেঝে ও দরজার যেটুকু ফাঁক থাকে সেখান দিয়ে কমলাভ আলো আসছে। তার মানে ভেতরেই আছে, ইচ্ছে করে বাইরে বেরুয়নি। দরজায় কড়াঘাত করার আগে আরেকবার দম নিলো সে, এরপর টকটক করে মৃদ্যু শব্দ করতেই কয়েক মূহুর্ত নিঃশব্দে কাটলো। এরপর আবার টকটক করলে বিছানা থেকে নামার মতো শব্দ হলো, তখুনি ভেতর থেকে গলা এলো,
– কে? মেহনূর আসলি নাকি?
সৌভিক ইচ্ছে করে দু আঙ্গুল দিয়ে ‘ টকটক ‘ জাতীয় শব্দ করেছে। এটা মেহনূরের নিয়ম, এটা সে শানাজের মুখেই শুনেছে। ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতেই খট করে ছিটকিনিটা খুললো, দরজাটার মাঝ বরাবর সরু ফাঁক হতেই হারিকেনের আলোটা বেরিয়ে এলো। সরু দরজাটার দুধার একপর্যায়ে খুলে যেতেই শানাজের হাসিটা ঝট করে নিভে গেলো, জুলজুল চোখে সামনের পুরুষ অবয়বটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ জোরে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেলো শানাজ। বুকের ভেতর নিশ্বাস আঁটকে যেতেই কানে দরজা চাপানোর শব্দ পেলো সে। ভয়ে চিৎকার দেওয়ার আগেই তার গলা বন্ধ হয়ে এলো! কন্ঠরোধ হয়ে শ্বাসটান হলেও হাত নাড়াতে পারলো না শানাজ। ঝরঝর করে তার চোখ ভিজে উঠলো!
হারিকেনের পলতেটা বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় আসলো মেহনূর। দুপুর থেকেই নাকি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, পুরোটা গ্রাম অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। কখন কৃত্রিম আলোতে উজ্জ্বল হবে জানা নেই। ছোট থেকেই দেখেছে গ্রামে একটুখানি হেরফের হলেই বিদ্যুৎ চ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে বিদ্যুৎ যাওয়ার রহস্যটা আজও ধোয়াশা রয়ে গেছে। জানালার কপাটটা দুহাতে চাপ দিতেই খটাশ করে খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকলো এক পশলা অন্ধকারযুক্ত আবছা আলো। গায়ে পাতলা-নরম কাথাটা টেনে জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে পরলো সে। আকাশ পরিষ্কার, কিন্তু আকাশটা অদ্ভুত মায়াজালে রহস্যঘেরা নভোমণ্ডল ঠেকছে। মনের ভেতর তীব্র উৎকন্ঠায় জানান দিচ্ছে, ‘ এখানে আসাটা ঠিক হয়নি, এখানে আসাটা একদম ঠিক হয়নি ‘। এমন অদ্ভুত মনোভাবের উদয় দেখে দারুণ বিচলিত হলো মেহনূর। তার ছোট্ট মাথাটা আস্তে-আস্তে গূঢ় বিষয়গুলো ধরার চেষ্টা করলো।
মাহতিম আনসারী, সে একজন নৌসদস্যের বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তা। তার পেশাজীবনটা ব্যস্ততায় ভরা থাকলেও সে কখনো পিছুটান ভুলেনা। সে যে বয়সে বড়, তার ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা-অভিজ্ঞতা সবকিছুই দূরদর্শী, তবুও সে মেহনূরের প্রতি কটাক্ষসূচক অবহেলা দেখায়নি। তার শক্ত চেতনার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আগেভাগে ঠাহর করা যায়না। সে খুবই ঠান্ডা মাথায় একেকটা কাজ করে, তার ওই নিষ্পাপ-হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে কেউ তার গভীর চিন্তার আয়তনটা মাপতে পারবেনা। জানালা থেকে মুখ সরিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকালো মেহনূর। সোজা হয়ে শুতেই বুকের উপর কাথা ও কাথার উপর দুহাতের আঙ্গুলগুলো আষ্টেপৃষ্টে রাখলো সে। একে-একে ভাবতে লাগলো, রজনী ও অনামিকা দুচোখে তাকে সহ্য করতে পারেনা। এমনকি যতোবার অনামিকার সাথে তার চোখাচোখি হয়েছে সেখানে অনামিকার চোখে কেবল হিংস্রতাই দেখেছে। রজনীও তাকে একা পেলে যথেষ্ট অত্যাচার করে।
এসব ঘটনা লজ্জায় কোনোদিন মাহতিম বা অন্যকারো কাছে বলেনি মেহনূর, না বলার ফলে তার সরল মনটায় গভীর একটা দাগ কেটেছে। কক্সবাজার গিয়েও মাহতিমকে একমিনিটের জন্য শান্ত দেখেনি। কি একটা চিন্তায় সবসময় বিভোর হয়ে থাকতো। তার বিভোর ভাবটা মিথ্যা হাসির কারসাজিতে ঢাকা পরলেও মেহনূরের কাছ থেকে চোখ এড়াতে পারেনি। এবার গ্রামে পাঠিয়ে যেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ডটা ঘটালো, এতে আরো স্পষ্ট হয়ে গেছে মাহতিম ভয়ানক কিছু লুকাচ্ছে। গ্রামে পাঠানোর মতো স্পর্ধা মাহতিমের হবার কথা নয়। যেখানে সে নিজেই মেহনূরকে দূরে রাখতে নারাজ ছিলো, আজ ইচ্ছে করেই বহু মাইল দূরে গ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সৌভিকের আচরণেও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছে ব্যাপারটা খুবই গুরুতর।
বাড়িতে দাদাভাই নেই, তিনি সম্ভবত গাঁয়ের কোনো কাজ দেখতে আবার বেরিয়ে পরেছেন। এই মূহুর্তে দাদাভাইয়ের সাথে মাহতিমের উটকো চিন্তার কারণটা আলোচনা করলে হয়তোবা দাদাভাই বুদ্ধি দিতে পারবেন। একমাত্র দাদাভাইয়ের কাছেই সব সমস্যার সমাধান থাকে। না, এবার আর দেরি নয়। সকল লজ্জা মাটি করে কাল সকালেই দাদাভাইয়ের সাথে মাহতিমকে নিয়ে আলোচনা করতে যাবে। এইসময় বাইরে ‘ ঘেউ ঘেউ ‘ করে কুকুর ডেকে উঠলো, বাতাসে গাছের শাখা-প্রশাখা নড়েচড়ে পাতার মর্মর আওয়াজ তুললো। লম্বা একটা জার্নি করেও চোখে ঘুম আসছেনা। চিন্তায়-চিন্তায় তার মাথাটা ঘুমহীনায় ঘন হচ্ছে। আঙ্গুলগুলো আলগা করে বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিলো, টেনে বের করলো এন্ড্রয়েড ফোনটা।
ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই মাহদির কাছে ফোনের বিষয়বস্তু শেখার স্মৃতিগুলো মনে পরলো। এই আধুনিক যন্ত্রটা চালাতে প্রথম-প্রথম খুব যন্ত্রণার হলেও এখন এটা চালাতে বেশ পটু মেহনূর। এটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব শুধু মাহদির। একজন অনভিজ্ঞ মানুষকে অভিজ্ঞ করার পেছনে যতটুকু ধৈর্য্য-শ্রম-ইচ্ছা ঢালা লাগে সবটাই শুধু মাহদি করেছিলো। পাকনাটা কোনো অংশে মেহনূরকে পিছিয়ে রাখেনি। একটা মোবাইল ফোন চালানো দ্রুততার সাথেই শিখিয়ে দেয়, একটা কম্পিউটার হুটহাট দরকারে কিভাবে অন করতে হয় তাও শিখিয়ে গিয়েছে। শহুরে কায়দা বোঝার জন্য, ধরার জন্য মাঝে-মাঝে ফারিনকে কল দিয়ে বুদ্ধি সংগ্রহ করতো। সেই বুদ্ধি মেহনূরের সাথে আলাপালোচনা করে দু-একটা খাটিয়ে ফেলতো। মেহনূরকে ‘ বউ ‘ ডাকার স্বভাবটা মুছতে পারেনি কেউ, খোদ মেহনূরই মাহদিকে বলে-কয়ে ‘ ভাবী ‘ ডাকাতে পারেনি। সবসময় মাহদি বলতো,
– ভাইয়া তো তোমার চেয়ে বড়। বড় মানেই আগে-আগে বুড়ো। বুড়ো হলেই হাড়গোড় ভেঙ্গে ম-রে যাবে। আমিও ততদিনে হ্যান্ডসাম হয়ে যাবো, এরপর তোমাকে বিয়ে করবো। ঠিক আছে না?
এমন উত্তর শুনে কাধে বা মাথায় আলতো করে চাপড় মারতো মেহনূর, একগাল হেসে দিয়ে কখনো-কখনো মাহদির ফর্সা গালদুটো টেনে দিতো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো সে, চোখের পাতা ভিজে উঠার আগেই নিজেকে ঠেলা দিয়ে শক্ত করলো। ফোনটা অন করে তর্জনী চালাতে-চালাতে একটা কল বসালো, ফোনটা কানের কাছে ধরতেই নিচের ঠোঁট কামড়ে রাখলো। খুব স্বাভাবিক আওয়াজে রিং হচ্ছে কিন্তু কল ধরছেনা।
বাজতে-বাজতে কলটা কেটে যেতেই স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কলটা কেনো ধরেনি? এই মাঝরাতে তো ডিউটি থাকার না। এই সময় সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। ফোনটাও কলের জন্য নরমাল মুডে রাখে। ওই লোক কি তাকে কল দিতে ভুলে গেলো?প্রচণ্ড রাগ লাগছে! ভুলে যাওয়ার তো কথা নয়। সে কি ফেলনা নাকি? কটমট রাগ নিয়ে আবার কল দিলো মেহনূর, এবারও একই কাণ্ড ঘটিয়ে কলটা কেটে গেলো। পরপর দুবার ব্যর্থ হয়ে হতাশার বদলে অদ্ভুত জেদ চেপে ধরলো। কোনোদিকে না ভেবেই ডিরেক্ট অন্য একটা নাম্বারে কল বসালো সে। একবারও ভাবলো না কলটা দেওয়ার পর কি দশা হতে পারে। কলের কয়েকটা টোন যেতেই রিসিভ হলো, সৌজন্যতার সাথে পুরুষ কণ্ঠটা বললো,
– হ্যালো,
মেহনূর যথাসম্ভব ভদ্রতা রেখে বললো,
– আপনার স্যার কোথায়?
চমকে যেতেই ভ্যাবাচ্যাকা গেলো কণ্ঠটা। থতমত সুরে বললো,
– ক-ককি? কাকে চান?
ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বললো মেহনূর,
– আমি আনসারী সাহেবের স্ত্রী বলছি। উনি যদি ফ্রি হন তাহলে বলে দিবেন উনার স্ত্রীর নাম্বারটা ব্লকলিস্টে ফেলে দিতে। ভালো থাকবেন। রাখি, আল্লাহ্ হাফেজ।
কলটা টুপ করে কেটে যেতেই স্থির হয়ে গেলো নোমান। সময় ও পরিস্থিতির গণ্ডি হঠাৎই যেনো তালগোল পাকিয়ে ফেললো। ডানকানে এখনো ফোনটা চেপে রেখে একদৃষ্টিতে অন করা কম্পিউটারে তাকিয়ে আছে। সে বসে আছে মাহতিমের ডেষ্কে, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের জন্যে। জোরে শাওয়ার ছাড়ার আওয়াজ হতেই সৎবিৎ পেলো নোমান, হালকা একটা ঝাঁকুনি খেয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে ফেললো। সত্যিই তার বসের বউ কল দিয়েছিলো? এটা কি বসের মুখে শোনা সরল-সহজ বউ? সরল-সহজ বউ হলে হালকার-উপর-ঝাপসা মেরে ধমক দেয়? বাম হাত উঠিয়ে নিজের বাঁগাল বরাবর চড় মারলো নোমান, তবুও বিশ্বাস হতে চাইছেনা! নোমান তড়িৎ গতিতে ডেষ্ক থেকে উঠে সোজা ওয়াশরুমের সামনে গেলো, ভেতর থেকে জোরালো শব্দে শাওয়ারের আওয়াজ ভেসে আসছে। ধপধপ করে দরজায় আঘাত করলো নোমান, নূন্যতম হেলদোল না রেখে বলতে লাগলো,
– স্যার, স্যার আপনি এক্ষুণি বাইরে আসুন। ম্যাডাম বলেছে তাঁর নাম্বারটা এক্ষুনি ব্লকে ফেলতে।
আকাশ থেকে পরার মতো চমকে যায় মাহতিম। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– তুমি কি বলছো? কে বলেছে?
মাহতিমের কথা আংশিক বুঝলো নোমান। দ্রুতগতিতে উত্তর দিয়ে বসলো,
– স্যার, আপনার ম্যাডাম বলেছে।
নোমানের বেকুব মার্কা কথা শুনে গা জ্বলছে মাহতিমের! এই ছেলে সামান্য উত্তরটাও ঠিকঠাক মতো দিতে পারেনা। মাহতিম রাগ দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
– আরে কোন্ ম্যাডাম? আমার মা না আমার বউ?
নোমান এতোক্ষন পর বোকামিটা বুঝতে পারলো। জিভ কামড়ে চোখ খিঁচে সাথে-সাথে জবাব দিলো,
– স্যার, আপনার বউ।
ঠোঁট গোল করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। হাত বাড়িয়ে শাওয়ারের স্পিডটা ধীর হাতে কমাতেই হঠাৎ কিছু একটা মনে পরলো। ‘ এক মিনিট ‘, কথাটা মনে মনে বলতেই স্থির হয়ে গেলো সে। চোখ বড়-বড় করে তাড়াতাড়ি শাওয়ারের নবটা বন্ধ করতে লাগলো মাহতিম। সর্বনাশ! সাংঘাতিক! সে ভুলে গেছে! একদম ভুলে গেছে!
ছোট্ট চারকোণা কাঠের টেবিলটার উপর হারিকেন রাখা। হারিকেনের হলুদাভ-কমলা রঙটা রুমের অন্ধকার কাটিয়ে দিচ্ছে। সুন্দর গোছানো রুমটার দু-দুটো জানালাই খোলা। গ্রামাঞ্চলে অন্ধকার নামলেই জানালা খোলার ছোটোখাটো রেওয়াজ আছে। রেওয়াজ হয়তো বাতাসের জন্য অথবা রুমের ঘুটঘুটে অন্ধকার কাটানোর জন্য চলে। বিছানার মাঝখানটায় বসে আছে দুজন। দুজনই মুখোমুখি হয়ে আছে। নতমুখে বসে আছে সৌভিক, দৃষ্টি তুলে তাকানোর ক্ষমতা তার নেই। নিজের কোলের উপর শানাজের হাতটা দুহাতের ভেতর শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেনো আলগা করে ধরলেই শানাজ পালিয়ে যাবে। চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে আছে শানাজ। অনেকক্ষণ যাবৎ দুজনের মধ্যে গম্ভীর নিরবতা চলছে। সৌভিকের আকস্মিকভাবে জাপটে ধরার ফলে একটু কেঁদে ফেলেছিলো শানাজ, আপাতত সে রাগী-রাগী ভাব দেখানোর অনর্থক চেষ্টা চালাচ্ছে। সৌভিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই তার গালে হাত রাখলো সে। বিমর্ষ মুখের গালটা আঙ্গুলের স্পর্শে ছুঁয়ে দিতেই মুখ তুললো সৌভিক। শানাজের সাথে চোখাচোখি দৃষ্টি রেখে তাকালে শানাজ মলিন হাসি দিয়ে বললো,
– অনেক শুকিয়ে গেছো। এর আগেরবার এতো খারাপ অবস্থা দেখিনি।
ফ্যাকাশে ঠোঁটে কাষ্ঠ হাসলো সৌভিক। সেই হাসিতে বলে ফেললো,
– এর আগেরবার তুমি ছিলে না। এখনো আছো।
চুপ রইলো শানাজ। একটু থেমে আবার বললো,
– যোগাযোগ তো তুমি বন্ধ করেছো সৌভিক। আমি বেহায়ার মতো যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলাম, একবারও তোমার কাছ থেকে সাড়া পাইনি।
শানাজের কথায় কোমল করে সায় দিলো সৌভিক। মাথাটা উঁচুনিচু দুলিয়ে শানাজের হাতটা টেনে ঠোঁটের উপর রাখলো। চোখ বন্ধ করে আলতো স্পর্শ করে বললো,
– আমাদের সম্পর্কটা আগানো মানে বিরাট ঝামেলা টানা। তুমি কি ঝামেলা টানতে চাচ্ছো?
শানাজ মোটেও এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। গাল থেকে হাতটা চট করে সরালো সে, অপ্রস্তত ভাবটা প্রকাশ করে গমগম রাগ দেখিয়ে বললো,
– কেনো? আমার সাথে যখন সম্পর্ক করতে গিয়েছো তখন এই খেয়াল ছিলো না? তখন কি মনে পড়েনি এই সম্পর্কটাই একদিন ঝামেলার মতো হয়ে যাবে? তখন এই হুঁশ-জ্ঞান কোথায় গিয়েছিলো তোমার? আজকে কোন্ সাহসে তুমি ঝামেলা টানার বলছো?দোষ কি আমার ছিলো নাকি তোমার ছিলো? কেনো তোমার দোষের জন্য আমি কষ্ট পাবো? আমি তো তোমার পিছু-পিছু বেহায়া হতে যাইনি! তুমিই এমন সব কাজ করেছো যার জন্য আজ আমার এমন দশা। একমাত্র তুমি এমন যন্ত্রণায় আমাকে ফেলে গিয়েছো সৌভিক! দায়ী তো তুমি।
শানাজের ক্ষিপ্ত মুখ দেখে কিছু বলতে গিয়েও শেষপর্যন্ত নিজেকে আঁটকে ফেললো সৌভিক। কথাটা বলতে নিজের বিবেক পযর্ন্ত কাঁপছে! শানাজকে কিভাবে আসল সত্যটা বলবে? ওর দাদা যে নিজেই সৌভিককে কল দিয়ে যোগাযোগ নষ্ট করতে বলেছে এটা কি ঠাস-ঠাস বলা যায়? শানাজ হয়তো আন্দাজও করতে পারবেনা আজকের এই মনোমালিন্যের জন্য ওর দাদা কি ধরনের কথা উচ্চারণ করেছে। ওই বুড়ো লোকটাই আজকের জন্য সর্বেসর্বা দায়ী! সৌভিক যদি যোগাযোগ নষ্ট না করতো তাহলে পুরো ব্যাপারটা মাহতিম ও মাহতিমের পরিবারের কাছে বিশ্রী ভাবে ধরা পরতো। মাহতিম অবশ্যই সৌভিকের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিতো, কিন্তু বাকিরা কি তা করতো? সৌভিক কথাটা মিথ্যে করে বললো,
– আমি ক্যারিয়ার নিয়ে বিজি ছিলাম শানাজ। তখন আমার লাইফে একটা বেস্ট অপোরচুনিটি চলে এসেছিলো। তাই
আর বানিয়ে-বানিয়ে বলতে পারছেনা সৌভিক। এভাবে কঠিন সত্যকে মিথ্যার চাদরে ঢাকাটা তার জন্য কষ্টকর। সৌভিকের কথা ও নিরবতা শুনে ওর গালে একটা চড় মারতে মন চাচ্ছিলো। সম্পর্ক করার সময় এইসব ক্যারিয়ার-ফ্যারিয়ার হেনতেন কোথায় চলে যেতো? তখন কি ভুলেও মনে পরতো না, আমার ওমুক একটা ক্যারিয়ার আছে, তমুক একটা ঝামেলা আছে? চড়ের ইচ্ছাটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে কাটাকাট আওয়াজে বললো শানাজ,
– তুমি আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যাও সৌভিক। তোমার ভেতর যদি লজ্জা থাকে, আর তুমি যদি ভদ্রঘরের সন্তান হয়ে থাকো, তাহলে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও। পারলে সকালেই আমাদের বাড়ি থেকে চুপচাপ কেটে পরবে। মেহনূরের কাছে কোনো অভিযোগ করার দুঃসাহস দেখাবে না! আমার বোন আর বোন জামাইকে এসবের ভেতর ঢুকালে তুমিও আমার জঘন্য রূপ দেখে ছাড়বে। চলে যাও এখান থেকে। ভুলেও আমার কাছে লজ্জাহীনতা পরিচয় দিতে এসো না।
নিজের অসহায় অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো না সৌভিক, চট করে শানাজের দিকে থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। শানাজের মুখের উপর রাগের আস্তরটা লেপ্টে আছে, সেখানে টান-মায়া সবকিছু লুপ্ত। শানাজ কোনোখানে না তাকিয়ে সোজা তর্জনী তুলে দরজার দিকে তাক করলো। সরাসরি মুখের উপর বললো,
– বেরিয়ে যাও।
মাথা হেঁট করে বিছানা থেকে নামল সৌভিক। ফ্লোরে পাদুটো ফেলে দাঁড়িয়ে পরতেই একবার মাথা ঘুরিয়ে পিছু চোখে দেখলো, এরপর পা চালিয়ে দরজাটা খুলে ভারী বুক নিয়ে চলে গেলো সে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডানে মোড় নিতেই পেছন থেকে হিঁচকে কান্নার আওয়াজটা পেলো, মেঝের দিকে দৃষ্টি নত রেখে একপা-একপা করে চলে যেতে লাগলো।
সকালটা শান্ত। পাখপাখালির কলরবে চারপাশটা মুখর। আকাশের বুকে অগ্নিপিণ্ডটা আলো বিকিয়ে চলছে, মাঠে-ঘাটে সোনালি আলো ছড়িয়ে ধাবমান আছে সূর্য। গ্রামের মানুষগুলো অলসতা ছেড়ে নাস্তা পানি সেরে নিজ-নিজ কাজে ব্যস্ত হচ্ছে। এদিকে ফসলি জমিতে চাষীদের হরদমে কাজ চলছে। শেফালী তার মেয়েকে নিয়ে দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে, এই আত্মীয় আবার কেমন আত্মীয় সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ। সাবা কলেজের একটা মূল্যায়ন পরীক্ষা দিতে চলে গেছে। কলপাড়ে হাত-মুখ ধুয়ে শানাজের হাতটা ধরলো মেহনূর, শানাজ একহাতে মেহনূরকে ধরে রেখে অন্যহাতে মেহনূরের মুখটা গামছায় মুছে দিচ্ছে। দুবোনের দৃশ্যটা দূর থেকে দেখছে দুধ দুয়ানো সুজলা। কেউ কি বলবে ছোটটার এখন বিয়ে হয়ে গেছে? এখনো দুবোনের ভেতর ভারী আশ্চর্যজনক মহব্বত দেখা যায়। সুজলার অন্যমনস্কতার দিকে দৃষ্টি দিতেই মাহমুদার নজরে দূরের দৃশ্যটা চোখে পরলো। বাছুরের মুখে কচি ঘাস ধরে প্রশান্ত গলায় বললো,
– এদের দেখলে পরানটা জুড়িয়ে যায়।
মুখ ফিরিয়ে মাহমুদার দিকে একগাল হাসলো সুজলা। দু’পাটি ধবধবে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো,
– এখন কোমরটা বাঁধো ছোটো বউ। বিয়ে তো দিয়েই দিলে। এখন নাতী-পুতির মুখ দেখার জন্য সময় গুনতে থাকো।
সুজলার কথায় সেও হাসলো তখন। অন্যদিকে হান্নান শেখের জন্য চিন্তিত মেহনূর শানাজের উদ্দেশ্যে বললো,
– দাদাভাই কখন আসবে বুবু? সেই রাত থেকেই দাদাভাই বাড়ি নেই। এমন দেরি তো আগে কখনো করতে দেখিনি। দরকার পরলে সকালের নাস্তাটা মুখে দিয়ে তারপর কাজে বেরিয়ে যায়। তুমি কিছু জানো?
ভেজা গামছা নিজের কাধে ফেলে মেহনূরকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। শান্ত স্বরে বললো,
– তোর এই গাঁইয়া বুবুকে বিশ্বাস করলে সমস্যার কথাটা বলতে পারিস। অন্তত তোর চিন্তার চাকা কিছুটা হলেও থামবে।
সিড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলতেই কপাল কুঁচকালো মেহনূর, শানাজের হাতটা ঝাঁকুনি দিয়ে কপট দেখিয়ে বললো,
– খুবই বাজে কথা বুবু! এই গাঁইয়া আবার কেমন শব্দ? তুমি এসব বলে-বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছোনা ?
মেহনূরের কথায় হাসি দিয়ে উপহাসের ভঙ্গিতে বললো,
– ধুর পাগলী, দূরে ঠেলাঠেলির কি আছে? তুই তো এখন দূরেই থাকিস। শহরে থেকে-টেকে পাকা হয়ে গেছিস সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আগে চড় মা’রলেও তোর মুখে খই ফুটতো না, আর এখন ভাইয়ার সাথে উঠ্-বস্ করে কত চালু হয়েছিস ভাবা যায়? আমার কাছে এলি তাও ঘুরঘুর করে দাদাজানকে খুঁজছিস, এটার ইঙ্গিত বুঝি বুঝবোনা?
শানাজের হাত ধরে দোতলা সিড়িতে পা রাখলো মেহনূর। শানাজের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
– তুমি একটু বেশি খোঁ’চাচ্ছো না?
ড্যাবড্যাব চাহনিতে হা হয়ে গেলো শানাজ। অবাক হয়ে বললো,
– ওমাগো, কার মুখে খোঁ’চার কথা শুনি? তুই দেখি চপর-চপর কথা বলতে শিখেছিস। সবই তোকে ভাইয়া শিখিয়েছে তাইনা? ঠিকই করেছে। তোর মতো আস্তো বোবা নিয়ে সংসার করা যায় নাকি? চল্ উপরে চল্। উপরে যেয়ে আমার কাছে সব ঝেড়ে-কেশে হালকা হয়ে বলবি। কাল রাত থেকে দেখছি তোর মুখটা ভার। কি নিয়ে টেনশন করছিস ওটা তোর দেবরের জন্য জিজ্ঞেস করিনি। এখন চল, সব ফটফট করে বলবি।
শানাজের সাথে বহুদিন পর খোলামেলা কথায় বসলো মেহনূর। শানাজের হাতে খাবারের প্লেট, সে ডাল চচ্চরিতে ভাত মাখিয়ে চালাকি করে মেহনূরকে টপাটপ খাইয়ে দিচ্ছে। মেহনূর খাবার চিবোতে-চিবোতে সবটুকু কথাই বলে দিলো। অনামিকার ঘটনা থেকে শুরু করে এই গ্রামে আসার ঘটনা পযর্ন্ত বললো। সব শুনে শানাজের কপালে একটু পরপর ভাঁজ পরছিলো। হঠাৎ শানাজ দরজার দিকে তাকাতেই দ্রুত সেটা ছিটকিনি মেরে লাগিয়ে দিলো। ‘ দেয়ালেরও কান থাকে ‘ প্রবাদটার মতো শানাজ একটু সতর্ক কন্ঠে বললো,
– তুই আপাতত চুপ থাক্। মাহতিম ভাইয়াকে কিচ্ছু বলিস না। ভাইয়া যে তোকে এখানে পাঠালো, আমার মনেহচ্ছে ভাইয়া নিজেই এখানে আসতে যাচ্ছে। দেখিস ভাইয়া ঠিকই আসবে। পুরো কাহিনী শোনার পর মনেহলো ভাইয়া তোকে কিছু একটা থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছে। সেটা ওই রজনীও হতে পারে, আবার অন্য কেউ। আচ্ছা একটা কথা বলতো, তুই কোন আক্কেলে ভাইয়ার কাছে ওই অনামিকার কাহিনী জানতে চেয়েছিলি? তোর কি ঘিলুতে এটুকুও কাজ করেনি তার আত্মসম্মানে ঘাঁ লাগবে?
– আমি তো তখন পুরো ঘটনা জানতাম না বুবু। নীতি আপু যখন পুরো ঘটনা বললো, আমার তখন এতো খারাপ লেগেছিলো, বলে বোঝাতে পারবোনা। ওইদিন আমার উপর ক্ষেপতে গিয়ে হাতটা কি করেছিলো, ওটা ভুলবো না বুবু। ওইদিনের পর থেকে নিজের কাছে ওয়াদা করেছি আর কখনো ওরকম করবো না।
– তোর শ্বাশুড়ি কবে যাচ্ছে?
– সোমবারে টিকিট। মার শরীর যে কি খারাপ হয়েছে। রাতে ঘুমের ট্যাবলেট দিলেও শেষরাতে জেগে যায়।
– খুব কাঁদে, নারে? মাহদিটা অনেক চন্ঞ্চল ছিলো। বাচ্চাটা আর নেই ভাবতেই বুকটা খালি লাগে। ভাইয়ার মনে খুব কষ্ট আছে মেহনূর। তোর বরটা আসলেই খুব শক্ত, তুইযে বললি একটুও কাঁদেনি আমার খুব অবাক লাগছে। আমি যদি ভাইয়ার জায়গায় থাকতাম অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পরে থাকতাম। সেখানে দ্যাখ, নিজের ছোটো ভাইকে দাফন করে শান্ত ভাবে কাজে ফিরে গেছে। ভাইয়ার সাথে খবরদার উঁচু গলায় কথা বলবি না, খুব সম্মান করবি। আমাকে সকাল-সকাল ফোন দিয়ে কি বলেছে জানিস?
মেহনূর খাবার চিবোনো বাদ দিয়ে উৎসুক হয়ে বললো,
– কি বলেছেন?
শেষ লোকমাটা গোল-গোল করতেই শানাজ বলতে লাগলো,
– বলেছে, ‘ শোনো বড় শ্যালিকা, আমার বউটার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবে। আমি আসার পরপরই যেনো সুস্থ দেখতে পাই। যদি টাষ্কটা ঠিকঠাক মতো করো, তাহলে তুমি যা চাইবে তাই-ই দিবো। ‘
শানাজ একদম নকলবাজের মতো অভিনয় করে দেখালো। অভিনয় দেখে হাসতে-হাসতে বললো মেহনূর,
– তারপর?
ঠিক তখনই দরজার কাছ থেকে উত্তর ছিঁটকে এলো,
– তারপর আমি দেখা করতে খুব দেরি করে ফেললাম দাদু।
চমকে গিয়ে শানাজ-মেহনূর দুজনেই দরজার দিকে তাকালো। দেখলো হান্নান শেখ সদ্য গোসল সেরে সুতির পাণ্ঞ্জাবী পরে দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনেই খুশীতে গদগদ হয়ে উঠলো, এবার দাদার সাথে জম্পেশ আড্ডা চলবে।
সময়ের কাটা ও সপ্তাহের বার অজান্তেই চলতে লাগলো। বিরতিহীন সময়ের গণ্ডিটা ধীরে-ধীরে কঠিন দিনের দিকে এগোচ্ছে। খুব নির্ঝঞ্ঝাটে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি দিলো মারজা, তার চিকিৎসার পুরো প্রক্রিয়ার জন্য সদা-সর্বদা নীতি-প্রীতি সঙ্গে থাকবে। আমেরিকার ঘাঁটিতে চিকিৎসার সুবাদে দেশে থাকবেনা কয়েক মাস। খাঁ খাঁ বিরান ভূমির মতো শূন্যতায় ছেয়ে গেছে পুরো আনসারী নিবাস। বাড়িতে বিশ্বস্ত চাকর সিরাজ কাকা তদারকিতে আছেন, সাবু খালা দেশের বাড়িতে ভাতিজির বিয়ে খেতে গেছেন। আরো যতো চাকর-বাকর ছিলো তাদের যাওয়ার আগে ছুটি দিয়ে গেছেন মারজা, শুধু ছুটি চাননি সিরাজ কাকা।
তিনি সকলের অনুপস্থিতিতে বাড়ির দেখভালের কাজ নিজ হাতে করতে ইচ্ছুক। মারজা যাওয়ার পরপরই বিদায় নিয়েছে রজনী, সে তার ভাইয়ের জন্য উত্থাল নির্বাচনে সাহায্য করতে ছুটেছে। রজনীর নির্দেশে জাফলং বেড়াতে গিয়েছে অনা। অপরদিকে গ্রামের মাটিতে ফিরতে পেয়ে প্রাণবন্ত হয়েছে মেহনূর। তার গোমড়ামুখো ভাব কেটে গিয়ে স্বচ্ছ চন্ঞ্চলতার ভাবসাব দেখা দিচ্ছে। মায়ের সাথে, বড় মার সাথে, সাবা ও শানাজের সাথে সহজ হয়ে গেছে মেহনূর। সকলের সেবা ও যত্নের কঠোরতায় সুস্থ হচ্ছে সে। নিউমোনিয়ার মতো রোগটা সারতে-সারতে শূন্য স্কেলে এসে পৌঁছেছে। এখন দেহে কেবল মাংসের ঘাটতি।
উপন্যাসের বইগুলো এখন আগের রুক্ষ লাগেনা, মাঝে-মাঝে পড়তে-পড়তে গভীর স্মৃতিতে ডুবে যায়। কখনো মাহতিমের দুষ্টু কথাগুলো ভেবে বই হাতেই খিলখিলিয়ে হাসে, কখনো মাহতিমের চিন্তায় মুখ কালো হয়ে বই নামিয়ে রাখে। আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে গেলে মনে হয়, এই বুঝি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, এই বুঝি পেছন থেকে কাধে মুখ গুঁজে দিলো। কিন্তু দিনশেষে কেউই তার গা কাঁপিয়ে শিরশির অনুভূতিটা জাগাতে আসেনা, কেউ সম্মোহন দৃষ্টিতে মুগ্ধ করে হাসি ছুঁড়ে তাকায় না। দিনে-রাতে যখনই মাহতিম একটুখানি অবসর পায় তখনই মেহনূরের খোঁজ নেয় সে। মেহনূর প্রতিবারই জিজ্ঞেস করবে,
– কবে আসছেন?
মাহতিম হরহামেশার মতো একই উত্তর দেয়,
– এইতো আর কিছুদিন।
কয়েক মিনিটের জন্য মনে হতো কালই চমকে দেওয়ার জন্য মাহতিম আসছে। আবার, মন থেকে জবাব আসতো, অপেক্ষা করিস না, সে আসবে না। রাতে ঘন্টার-পর-ঘন্টা কথা বললেও মেহনূরের কাছে শূন্য-শূন্য ঠেকে, যেনো কত কথা বলার ছিলো, সেগুলো নিষ্ঠুর সময়ের জন্য ফুড়িয়ে গেছে। একদিন রাতে ঠকঠক করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। মেহনূর চমকে গিয়ে অদ্ভুত শিহরণে লাফিয়ে উঠলো, বইটা নির্দয়ের মতো ফেলে রেখে তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলতে লাগলো। প্রশস্ত এক হাসি দিলেও মনটা ভীষণ মুষড়ে পরলো তার। হাসিটা মন থেকে উঠে গেলেও ঠোঁট থেকে মুছলো না। সে তার দাদাভাইকে দেখে কেনো মন থেকে খুশী হলো না? দাদাভাইয়ের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে খুব খুশী হতো? দাদাভাই সেদিন রাতে উদ্ভট কথা বললো,
– দাদুভাই, যদি তোমাকে সবসময়ের জন্য আমার কাছে রেখে দেই তাহলে তুমি থেকে যাবে?
বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মেহনূর কোনোকিছু না ভেবে চুপ ছিলো। মাহতিমের ‘ আসবো-আসবো ‘ করে আশাভঙ্গের কথাগুলো মনে পরতেই অন্যমনষ্ক গলায় বলেছিলো,
– আমি থাকবো।
অন্যমনষ্ক মেহনূর যদি একটুখানি সজাগ হতো, যদি একটু বুঝতো তাকে এমন প্রশ্ন কেনো করা হচ্ছে, তাহলে সে বুঝি লাগেজ ফেলেই পালিয়ে যেতো। হান্নান শেখের ধূর্ত ইচ্ছাটা যদি মাইন্ড রিডিংয়ের মতো ধরা পরতো, তাহলে মেহনূর আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে থাকতে পারতো না। গোল-গোল চাহনিতে বরফের মতো জমে যেতো সে। হান্নান শেখ নিজ রুমে ফিরে আসতেই তোশকের নিচ থেকে ফোন, ক্যালেন্ডারের সবশেষ পাতা থেকে স্কচট্যাপে আঁটকানো সিম, মস্তিষ্কের ভেতর থেকে হাতড়ে বের করা মুখস্ত নাম্বার একত্র করলো। কলটা ডায়ালে দিতেই তিন-থেকে-চারবার বাজার পর রিসিভ হলো। হান্নান শেখ ওরফে কালাম সরদার নিচু গলায় বললো,
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫০+৫১
– খবর কি সজীব্বা?
সজীব নামের ছেলেটা ঘ্যাটঘ্যাট করে বিশ্রী হাসি দিলো। ফচ্ করে একদলা পানের পিক ফেলে বললো,
– আফনের মা’ল দেহি নায়কের লাহান। হেরে ট’পকাইতে বহুত কসরত করন লাগবো। এই লিগ্গা সোইপ্পার দলডারে আইতে কইছি। হা’লারা মিডিসিন লইয়া আইতাছে। পেডে চা’ক্কু হান্দায়া মুচুড় মারলেই দ’ম শেষ। কুনো টেনশান নাই মামু। আফনে নিচ্চিত থাহেন।
