মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৭+৮
ফাবিয়াহ্ মমো
মেহনূরের কোমর থেকে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে! কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িটা রক্তের কারনে ভিজে যাচ্ছে! ওর কোমরে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে মাহতিম। হতভম্ব দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে মেহনূরের ব্যথাগ্রস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহনূরের চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে নিচে পরছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ফুপিয়ে কাঁদছে ও। মাহতিম ওর কোমর থেকে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে ফেললো। চোখের সামনে রক্ত মাখা হাতটার দিকে একপলক দৃষ্টি দিতেই তৎক্ষণাৎ বুকটা মোচড়ে আসে ওর। শরীর যেনো অদ্ভুত ভাবে শিরশির করে উঠলো।
নিজের ভেতরে যে ঝড়টা ফের শুরু হয়েছে সেটা বুঝতে দিলোনা একটুও। চোখদুটো নির্বাক হয়ে গেলেও দৃষ্টি শুধু ক্ষত জায়গাটার দিকে স্থির ছিলো। কাঠ-কাঠ গলায় ঢোক গিলে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িটা পেটের কাছ থেকে সরিয়ে কাধে তুলে দিলো মাহতিম। হঠাৎ পেটের উপর থেকে শাড়ির আবরণ উঠে গেলে চমকে যায় মেহনূর। অশ্রুতে টলটল করা চোখদুটো তখন আতঙ্কগ্রস্তে লিপ্ত। জোরে-জোরে অনবরত নিশ্বাস নিতেই নির্বোধের মতো আবার পালাতে গেলো। কিন্তু গাধার মতো আবারও পিছাতে গিয়ে একই জায়গায় একইভাবে তারকাটা ঢুকে বিদ্ধ হলো কোমর। ক্ষত জায়গায় হাত চেপে ‘ বুবু ‘ বলে চিৎকার দিতেই দুইঠোঁট শক্ত করে কুঁচকে ফেললো মেহনূর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এমন কান্ডে আশ্চর্য হতে গিয়ে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে গেছে মাহতিম! বিস্ফোরণ চাহনিতে কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থাকলে চেঁচিয়ে এক ধমক লাগায়। ধুকপুক-ধুকপুক করছে এমন আকস্মিক কান্ডের জন্য! কি করলো ও? কেনো আবার পালাতে চেয়েছিলো? কি জন্য একাজ করলো? কি প্রয়োজন ছিলো? মাহতিম গমগম মুখে ট্রাউজারের বাম পকেট থেকে রুমাল বের করলো। দ্রুত নিজের রক্তমাখা হাতটা রুমালে মুছতেই হঠাৎ ওর দৃষ্টি মেহনূরের পেছনে থাকা পুরোনো শেল্ফটার দিকে আঁটকালো। কাঠটা ঘুণে খাওয়ার জন্য একটা তারকাটা বের হয়ে গেছে, মেহনূর যখন ভয় পেয়ে পিছাতে গেলো, তখনই কোমরের ডানপাশে ওই তারাকাটা ঢুকে গভীরভাবে কেটে যায়।
মেহনূরের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। মাহতিম এগুতে গেলেই মেহনূর ভয়ে ছটফট করে পিছানোর জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যথার জন্য একপা ঠিকমতো ফেলতে পারেনা সে। একপর্যায়ে মাহতিম আর সহ্য করতে না পেরে মেহনূরের হাতটা ধরে নিজের দিকে টান মারে। আকস্মিক এমন কান্ড দেখে মেহনূর ব্যালেন্স বিগড়ে ফেলে, কিন্তু তখনই ওর দুহাটুর নিচে একহাত এবং ঘাড়ের নিচে অন্যহাত ঢুকিয়ে একেবারে কোলে তুলে ফেলে মাহতিম। মেহনূরের মাথাটা মাহতিমের বুকে এসে ঠেকলে ছাড় পাওয়ার জন্য মেহনূর ছুটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু আর পালাবার পথ থাকেনা মেহনূরের জন্য। একদিকে শক্ত বাহুর মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে মাহতিম, অন্যদিকে কোমরের কাছে বীভৎস যন্ত্রণায় শরীর যেনো নিংড়ে আসছে ওর।
জ্বরের দূর্বলতা, ক্ষত জায়গার যন্ত্রণা, প্রচণ্ড ভয়ের প্রবলতায় চারপাশ যেনো অন্ধকার দেখছে মেহনূর। মাহতিমের বামহাতের পেশিতে মাথা ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে ও। মাহতিম ওই অবস্থা দেখে আর দেরি না করে দ্রুত নিজে রুমে নিয়ে আসলো। বাড়িতে কেউ ছিলোনা তখন, সবাই আম-কাঠালের জাকজমক দেখতে পনের মিনিটের দূরত্বে একটা গ্রাম্য-বাগানে গিয়েছিলো। মাহতিম বড় বড় পা ফেলে তাড়াতাড়ি বিছানায় এনে লম্বা করে শুইয়ে দিলো। রক্তের কারনে মেহনূরের হাটু পযর্ন্ত লম্বাটে হয়ে ভিজে গিয়েছিলো। মাহতিম ওইমূহুর্তে হাতের কাছে কোনো ফার্স্ট-এড-বক্স না পেয়ে নিজের লাগেজ থেকে হেক্সিসল বের করলো। কোনো তুলা জোগাড় করতে না পেরে লাগেজের পকেট থেকে এক্সট্রা রুমাল বের করলো। রুমালটায় হেক্সিসল ঢেলে মেহনূরের কাছে এসে বিছানায় উঠে বসলো। আবারও শাড়ি উঠাতে হাত বাড়ালে মেহনূর কান্নারত অবস্থায় শক্ত কন্ঠে বললো,
– বুবুকে ডাকুন। আপনি এই কাজ করবেন না। বুবু কলপাড়েই আছে। বুবুকে ছাড়া আমি কারো কাছে ওই ঔষুধ লাগাবো না। বুবুকে ডাকুন প্লিজ।
মেহনূর কান্নায় আছড়ে পরলেও সংযত গলায় আকুতি-মিনতি করছিলো। মাহতিম চুপ করে ভাবছিলো, এখন যদি শানাজকে ডাকতে যায়, তাহলে উটকো ঝামেলার পাশাপাশি একশো একটা জবাবদিহিও করতে হবে। এদিকে রক্তের কারনে বিছানাও রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাহতিম সবটা চিন্তা করতেই ভ্রুঁ কুঁচকে ক্রুদ্ধসুরে বললো,
– তোমার কাছ থেকে পারমিশন নেওয়াটা প্রয়োজন মনে করিনা। এখানে তোমার পেট দেখে লুচ্চামি করার জন্য বসিনি। জায়গাটা ডিপলি কেটেছে দেখেই বাধ্য হয়ে রক্ত মুছতে এসেছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কালরাতে কি কি করেছো সব যেয়ে নানার কাছে ভাইরাল করে দেবো। মুখে তালা লাগাও।
মাহতিমের ক্যাটক্যাট জবাব শুনে আর কথা বলতে পারলোনা মেহনূর। আশ্চর্য হয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে রইলো। কালরাতে জ্বরের ঘোরে কি করেছিলো? কি করার কথা মাহতিম ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাচ্ছে? এই অসভ্য লোক তাহলে সুযোগ লুফে কিছু করে গেছে? মাথাটা যেনো ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে কথাটা শুনে। মেহনূর হতভম্ব হয়ে চুপসে গেলে আর বসে না থেকে চট করে পেটের উপর থেকে শাড়ি সরিয়ে ফেলে মাহতিম। লাল ব্লাউজ এবং পেডিকোটের জন্য পেটের তেমন অংশ তখন দেখা না গেলেও রক্ত মুছার জন্য ডানপাশের কিছু জায়গা উন্মুক্ত করলো মাহতিম। ব্লাউজ কিছুটা উপরে এবং পেডিকোটটা কিছুটা নিচে নামিয়ে রুমাল দিয়ে অতি সাবধানে ক্ষতটা মুছতে লাগলো। মাহতিমের আলতো হাতের পরশে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে শক্ত হয়ে রইলো মেহনূর। ক্ষতটা জ্বলার পাশাপাশি সমস্ত শরীরে যেনো সুঁইয়ের মতো কাটা ফুটছিলো। বরফের মতো হিমভাব অনুভূত হচ্ছিলো প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
চোখের বন্ধ করে খিচ মেরে ব্যথা সহ্য করার যুদ্ধ করছিলো সে। অনেকক্ষন টাইম নিয়ে মাহতিম রক্ত-সহ ক্ষত সাফ করে ফেলে। চার ইন্ঞ্চির মতো লম্বাভাবে কেটেছে জায়গাটা, ফুলে একদম লাল হয়ে উঠেছে। রুমালটা রক্তে শেষ হলেও মাহতিমের হাতে ভালোই রক্ত লেগেছে। ক্ষত থেকে দৃষ্টি তুলে মেহনূরের মুখের দিকে তাকায় মাহতিম, দুচোখের কার্নিশ থেকে এখনো টপটপ করে অশ্রু পরছে ওর। মাহতিমের ইচ্ছে করলো মুখটা ধরে চোখদুটো মুছে দিতে, কিন্তু মনের উপর পাথর ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে সেখান থেকে উঠে পরে। নীতির রুম থেকে চটপট গজ কাপড় এনে আবার মেহনূরের কাছে এসে বসে। এসব কাজের মধ্যে একবারের জন্যও মাহতিমের দিকে তাকায় না মেহনূর, চোখ বন্ধ করে সেইযে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, শেষপর্যন্ত আর ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়নি। ব্যান্ডেজের কাপড় নিয়ে প্রচণ্ড ইতস্তত বোধ করছে মাহতিম, ব্যান্ডেজ পেঁচাতে গেলে সত্যিই পেটের চারপাশে হাত লাগার সম্ভাবনা আছে। এমতাবস্থায় মেহনূরের দিকে শান্ত দৃষ্টি ফেলে সরল কন্ঠে বললো মাহতিম,
– এই মূহুর্তে ব্যান্ডেজ না করলে তোমার ইনফেকশন হবে। কি করবো আমি? তুমিতো অন্য জায়গায় টাচ করতে দিবেনা। তুমি কি চাও আমি শানাজকে ডেকে তোমার বোকামির জন্য কৈফিয়ত দেই? শানাজ সম্ভবত গোসলে ঢুকে গেছে। বাকি রইলো তোমার দুইবোন। দুজনের মধ্যে সাবার মেবি ব্লাড ফোবিয়া আছে। নিজের কাটা আঙ্গুলটা পযর্ন্ত শানাজকে দিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়েছে। বাট সুরাইয়াকে আমি ডাকতে পারবো না, সরি। তুমি চাইলে অপেক্ষা করতে পারো। কিন্তু এতে তোমারই ক্ষতি হবে। যতক্ষণ বাতাস লাগবে, ততক্ষণ ওই ক্ষতটা জ্বলতে থাকবে। কি করবো আমি? আমাকে ব্যান্ডেজ করতে দিবে নাকি ওভাবেই ব্যথা নিয়ে কাঁদতে থাকবে?
মাহতিমের সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে চোখ খুলে মুখ ফিরিয়ে তাকায় মেহনূর। কান্নায় চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে আছে ওর। মাহতিম সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– আমাকে দেখে ওরকম রিয়েকশন দেয়ার প্রয়োজন ছিলোনা। আমি নিশ্চয়ই তোমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে নোংরামি করতাম না। কিন্তু তুমি আজ যা করলে এতে নিজেরই ক্ষতি করলে। এখন বলো আমার কি করা উচিত? ব্যান্ডেজ করতে দিবে? নাকি করানোর জন্য মানুষ ডাকবো?
মাহতিমের কথা শুনে মেহনূর আবার চোখ বন্ধ করলো। জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে সেটা ধীরে-ধীরে ছেড়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শক্ত কন্ঠে বললো,
– রাতে যেহেতু সব কাহিনী ঘটিয়েই ফেলেছেন, সেখানে এমন ঢং করার মানে কি? আপনিতো আমার কোনো কিছুই দেখা বাদ রাখেননি। এখন তাহলে বুজরুকি তামাশা করছেন কিজন্য?
মাহতিম ওর কথার ধরন শুনে সরু চোখে তাকালো। মেহনূরের স্টাইলেই শক্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– ওহ্ তাই? তাহলে ইনডাইরেক্ট আমাকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে?
মাহতিম প্রশ্ন ছুড়ে আর পাল্টা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলোনা। ব্যান্ডেজ নিয়ে খুব সাবধানে ক্ষতের মুখে কাপড় চাপা দিতে লাগলো। নিজের চোখ ও মনকে শক্ত রাখার জন্য কঠোর অবস্থা ধারন করলো। কাজ শেষে ফ্লোরে পা রেখে মেহনূরকে কোলে তুলে নিলো। আশেপাশে সবদিক চেক দিয়ে দ্রুত মেহনূরের রুমের দিকে পা চালাতে লাগলো মাহতিম। ওকে রুমে এনে ওর বিছানার আস্তে করে শুইয়ে দিলো। যাওয়ার জন্য পা ঘুরিয়ে চলে যেতেই হঠাৎ পা থমকে মাথা ঘুরিয়ে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কাল রাতে কিছুই হয়নি। হলে নিজেই টের পেতে। আমি শুধু চেক করতে এসেছিলাম জ্বরের টেম্পেরেচার কেমন। দ্যাটস ইট, এর বেশি আমি কিছুই করিনি। আশা করবো, মিস-আন্ডারস্টেন্ডিংটা দূর হবে। আর ব্লাউজ যেভাবে বড় পরো, আমি কেন, শানাজও তোমার পেট দেখতে পাবেনা। আমি ওই ক্ষতটা ছাড়া আর কিছু দেখিনি। ট্রায় টু লেস ইউর ইগো, ইট ডাজেন্ট ম্যাচ ফর ইউর এ্যাজ।
মাহতিম যেভাবে ঠান্ডা মেজাজে রুমে এসেছিলো, সেভাবেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। শুধু মেহনূরের দৃষ্টি যেনো শূন্য দরজার দিকে স্থির হয়ে রইলো। কিছুক্ষন পর জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে নীলাভ আকাশের তেজঃপূর্ণ সূর্যটা দেখতে লাগলো মেহনূর। এই লোকটার মতো এতো অসভ্য জাতের পুরুষ মেহনূর আর দেখেনি। নিজেই অভদ্রের মতো রুমে ঢুকে অনুমতি না নিয়ে জ্বর দেখতে আসে, আবার সভ্যশিষ্টের মতো নিজেকে বেটার পার্সোনালিটির জেন্টেলম্যান বলে দাবি করে। কেমন বদমাশ ধরনের লোক হলে এমন দুমুখো কথা বলে? ভবিষ্যতে কেউ দুমুখো মানুষের কথা তুললে এটার জন্য মাহতিম আনসারী যেনো জলন্ত প্রমাণ হবে!
রুমে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলো মাহতিম। কিন্তু হাতদুটো পরিস্কার করা দরকার। কলপাড়ে এখন মেয়েরা আছে, সেখানে গিয়ে যদি হাত ধুতে যায় সবাই মেহনূরের ব্যাপারটার সাথে কানেক্ট করে দিবে। রিস্ক নেওয়ার মানেই হয়না। রক্ত শুকিয়ে গেছে এখন, আর ভেজা ভাব নেই হাতে। মাহতিম বিছানার উপর থেকে ফোন নিয়ে সৌভিককে কল দেয়। কিছুটা শক্ত ভঙ্গিতে তীব্র উৎকন্ঠায় বলে উঠে,
– তুই কোথায় আছিস? বাজারে না বাইরে?
সৌভিক পেয়ারায় এক কামড় দিতে যেয়ে থেমে গেলো। কিছুটা কৌতুহল হয়ে সন্দেহজনক কন্ঠে বললো,
– তোর গলার টোন এমন শোনাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?
মাহতিম খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেও নিজেকে যথাযথভাবে সংযত করে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– আমার ভয়েস টোন কি তোর গানের মতো লাগে? এটা কেমন প্রশ্ন সৌভিক? তুই কি এখন ক্ল্যারিফিকেশন চাইবি না আন্সারটা ফটাফট দিবি?
সৌভিক কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। তবুও শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– দোস্ত বাড়ির পেছনে আছি। পেয়ারা গাছের নিচে। খাবি একটা? নিয়ে আসি? লবণ মরিচ দিয়ে হেব্বি টেষ্ট লাগছে! পুরাই টাটকা ফিলিং!
মাহতিম ওর কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
– ফিলিংয়ের বাচ্চা, তোর ফিলিংয়ের টুট টুট করতে জাস্ট দুইমিনিটের ব্যাপার। আজাইরা প্যাচাল না পেরে আমার জন্য এক মগ পানি নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর।
সৌভিক প্রথমে কথার মানে বুঝলোনা। পরক্ষনে কি যেনো ভেবে দুপাটির দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো,
– পেট মোচড় মারছে বললেই পারতা মিয়া। বুঝছি তো মেয়েরা গোসল করতে গেছে দেখে চিপা জায়গায় কাজ সারতে চাইছো। থাক ফিকার নট, আমি এক্কেবারে দুই মগের ব্যবস্থা করে কলাপাতা আনতেছি।
মাহতিম রেগেমেগে বারুদ হয়ে কিছু অশ্রাব্য ভাষা উচ্চারণ করবে ওমনেই সিয়ামের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো। ফোনটা সম্ভবত লাউড স্পিকারে ছিলো, তাই সিয়ামও প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– কলাপাতা দিয়ে কাজ করতে পারবি? সমস্যা হবেনা?
মাহতিম আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না। এক ধমক দিয়ে দুটোকে গালিগালাজ করতেই সৌভিক হাসতে-হাসতে বললো,
– আচ্ছা আচ্ছা থাম ভাই। পানি আনতেছি, চিন্তা করিসনা আনতেছি। তুই নিচে আয়, আমি নীতিকে দিয়ে পানি আনতে পাঠাইতেছি।
সৌভিকের কথা শেষ হতেই টুট টুট শব্দ হতে লাগলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখলো মাহতিম ফোন কেটে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাহতিম চলে আসতেই সবার দৃষ্টি ওর হাতের দিকে আটকে যায়। দুই হাত লালবর্ণে রাঙা এবং ডার্ক ব্লু রঙের টিশার্টটা পেটের কাছে কালচে হয়ে শুকিয়ে আছে। নীতি বিষ্ময়সূচকে চক্ষুতারা বিশাল বড় করে মগ হাতেই প্রশ্ন করলো,
– ভাই তোমার হাতে এগুলো কি? ব্লাড নাকি?
মাহতিম একপলক নীতির দিকে তাকিয়ে হাতে পানির ঢালার জন্য ইশারা দেয়। নীতি সৎবিৎ ফিরে পেলেও আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে। মগের পানিতে দুইহাত ধুয়ে নীতির ওড়না টেনে হাত মুছতেই মাহতিম স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
– কাহিনীর ব্যাপারে এখন প্রশ্ন করতে আসবিনা। পরে জিজ্ঞেস করিস। এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা। মা আসলে বলবি কাল ভোরের দিকে চলে যাচ্ছি।
কথা শেষ হতেই পা ঘুরিয়ে চলে যায় মাহতিম। একটুও পিছু ফিরে তিনটা কৌতুহল দৃষ্টির জন্য দাড়ালো না। নীতি খালি মগটা নিয়ে দাড়িয়ে থাকতেই অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললো,
– ঘাপলা আছে সৌভিক ভাই। মাহতিম ভাইয়ার ব্যাপারে বিরাট ঘাপলা আছে।
মাহতিমের যাওয়ার পানে দৃষ্টি রেখে সিয়ামও কৌতুহল গলায় বলে উঠে,
– হাতের রক্তগুলা সোজা মনে হইলো না। তৌফরে খবর দেওয়া লাগবো। ওই রক্ত —
সিয়ামের কথায় দাড়ি বসিয়ে এবার সৌভিক বলে উঠলো,
– হাতে রক্ত লাগছে ভালো কথা, টিশার্টে কিভাবে লাগলো? আপাতত আর কাউকে এ ব্যাপারে বলিস না। তৌফ আসলে শুধু তৌফকে কথাটা বলিস। প্রীতি বা ফারিনকে এব্যাপারে ভুলেও বলবিনা।
বিকেলের সময়টায় ঠান্ডা মূহুর্ত ধারন করেছে প্রকৃতি। সূর্য এখন তেজ হারিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। পাখিরা এখন মুক্ত আকাশে উদাস ভঙ্গিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের বাতাস যেনো দেহমন জুড়িয়ে দিচ্ছে। মনকে করে দিচ্ছে আরো প্রশান্তমনা। গ্রামের সতেজ ভূমির গন্ধে মনের গ্লানি দূর হয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনিতে চারপাশ সম্মোহন হয়ে উঠছে। মেহনূর সারাটা দুপুর পেরিয়ে বিকেলে এসে কিছুটা আরামবোধ করছে।
কোমরের যন্ত্রণাটা অনেকখানি কমে গেছে। বাড়িতে সবাই জেনে গেছে মেহনূরের কোমর কাটার ঘটনা। কিন্তু তাও সবাই জেনেছে মিথ্যা বানোয়াট কথা। শানাজ এসেই যখন ব্যান্ডেজ দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো, তখনই বাড়ির সবকয়টা মানুষ এসে চিৎকারের কারন জানতে চাইলো। মেহনূর তখন সবার কাছে মাহতিমের ঘটনা কোনোভাবেই বলতে পারলোনা। ওই অভদ্র লোকটার অসভ্যতার কথা বলতে গিয়ে বিবেকে বাঁধলো ওর। জীবনে প্রথমবারের মতো মেহনূর মিথ্যা হিসেবে বললো রান্নাঘরে যে দরজা আছে, সেই দরজার ছিটকিনি দিয়ে ভুলবশত কেটে গেছে। এরপর থেকেই বিছানায় শুয়ে আছে মেহনূর। গোসল করতে পারেনি দেখে কলপাড় থেকে হাতমুখ ধোয়ার জন্য সাহস করে বিছানা থেকে উঠে। ফ্লোরে দুইপা রেখে দাঁড়াতে গেলে হঠাৎ ব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ওর। চোখ কুঁচকে সাথে-সাথে বিছানায় বসে পরে মেহনূর। একা উঠার সাহস না পেয়ে সাবাকে ডাক দিলে তৎক্ষণাৎ সাবা এসে নিচে নিয়ে যায়। সিড়ি দিয়ে নেমে আঙিনার কাছে আসতেই সুরাইয়ার মা শেফালী হঠাৎ কটাক্ষ করে বলেন,
– তুই নুলা হইছোস? সাবারে ছাড়া হাঁটতে পারোস না?
শেফালী গ্রামের নিচুঘর থেকে এসেছেন এবং এবাড়ির মেজো বউ হওয়ার মতো সৌভাগ্য পেয়েছেন। মেহনূরের মেজো চাচার সাথে প্রেমের নামে নানা ছলচাতুরি করে বিয়ের করেছেন। কিন্তু শেফালী নিতান্তই হিংসুটে, অহংকারী, লোভী এবং তিরিক্ষি মেজাজের মহিলা। বাড়ির তিন বউয়ের মধ্যে যদি সবচেয়ে খারাপ বউয়ের কথা কেউ জিজ্ঞেস করে, তাহলে মানুষ দেদারসে শেফালীর দিকে আঙ্গুল তাক করে দেখিয়ে দিবে। শেফালী কিছুদিন যাবৎ দূর-সম্পর্কের আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলেন, আজ দুপুরের দিকে ঠিক ঘন্টা খানেক আগে মোল্লাবাড়িতে ফিরেছেন। এসেই তিনি মারজাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠেন। খুশীর কারণ একটাই, মারজা বিরাট পয়সাওয়ালা মানুষ। এমন পরিবারে নিজের মেয়েটাকে যদি ইনিয়ে-বিনিয়ে গছিয়ে দিতে পারেন, তাহলে মেয়ে যে রাণীর মতোই পায়ের উপর পা তুলে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বরন্ঞ্চ নিজেও এতে ভালোই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। মেহনূরকে তিনি দুচোখে সহ্য করতে পারেন না। আড়ালে থাকলে চটাশ-চটাশ করে থাপ্পর মারতেও পিছপা হন না। আজ মেহনূরের প্রতি বিশেষ যত্ন দেখে তিনি রাগ সামলাতে পারলেন না। আঙিনার একপাশে শুকনো মরিচের ডালা রেখে ওর সামনে এসে দাড়ালেন। বিরক্ত মুখে কপাল কুঁচকে বললেন,
– তুইযে নুলা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস লজ্জা করেনা? বাড়িতে অতিথি দেইখা ঢঙ মারাচ্ছিস? পুলাগুলার সামনে খাতির চাচ্ছিস? চড়িয়ে গাল ফাটিয়ে দেবো বজ্জাত ছেড়ি! যা, একলা যাবি। ওই সাবা ওরে ছাড়।
মেহনূর বিষণ্ন মুখে সাবার দিকে তাকালো। মুখের অবস্থা এমন যেকোনো মূহুর্তে কেদেঁ দিবে ও। মেজো মার কোনো কথাই সহ্য করতে পারেনা মেহনূর। আজ পর্যন্ত বাড়িতে একটা মানুষও ওকে ছোট করে কথা বলেনি, কিন্তু মেজো মা একদিনও তাচ্ছিল্য করে খোঁটা দিতে ভুলেননি। ওরা চারবোনই শেফালীকে বাঘের মতো ভয় পায়। শেফালী সবার সামনে ভালো আচরণ করলেও আড়ালে যেভাবে মারেন সেই খবর আজও চারবোন ভয়ের কারনে ফাঁস করেনি। সাবা ভীতশঙ্কিত চোখে মাথা নিচু করে ফেললে মেহনূর নিজেই সাবার হাতটা সরিয়ে দেয়। সাবা যদি ওর কারনে মার খায়, সেটা সহ্য করতে পারবেনা মেহনূর। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সাবার উদ্দেশ্য বললো,
– সাবা বুবু, তুমি যাও। আমি যাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না। আমি শুধু হাত-মুখ ধুয়েই চলে আসবো।
মন খারাপ করে সাবা প্রশ্ন করলো,
– একা পারবি? ব্যথা করবেনা?
এমন কথা শুনে শেফালী বজ্রকন্ঠের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন,
– পারবো না ক্যান? এই ছেড়ি কি আঙ্গুল চুষা বাবু? সাবা তুই যাবি! যাবি তুই!
শেফালীর উত্তেজিত কন্ঠে ভয়ে কাঁচুমাচু করে চলে গেলো সাবা। মেহনূর নতমুখে কোমরে হাত চেপে ধীরে-ধীরে পা ফেলে এগুতে থাকলে শেফালী ওর পথ আঁটকে দাঁড়ান। কোমর থেকে হাত সরিয়ে শাড়ি উঠিয়ে সাদা ব্যান্ডেজটা দেখেন। এদিকে মাহতিম ও নীতি কথা বলতে-বলতে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, তখন নিচের দিকে নজর পরলে প্রথমে নীতির দৃষ্টি সেদিকে স্থির হলো। মাহতিম ট্রাউজারে দুইপকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে হাটঁছিলো, কিন্তু পাশে আর নীতি দেখতে না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। নীতি বারান্দা থেকে কেমন থমকানো দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখছিলো। মাহতিম কৌতুহল মনে ওর দৃষ্টি ধরে নিচে তাকাতেই মেহনূর ও শেফালীর কীর্তিকান্ড স্পষ্ট দেখতে পেলো। কৌতুহলটা ক্রমান্বয়ে বাড়তে-বাড়তে এমন পর্যায়ে গেলো মাহতিম কপাল কুঁচকে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে দ্রুত এগিয়ে গেলো। ট্রাউজারের দুই পকেট থেকে হাত বের করে রেলিংয়ের উপর রাখলো। শেফালী কোমরটা দেখতেই হঠাৎ ব্যান্ডেজের উপর দুআঙ্গুলে এতো জোরে টোকা মারলেন, মেহনূর চোখ খিঁচুনি মেরে অস্ফুট শব্দে মাথা নিচু করে ফেললো। দোতলা থেকে এমন দৃশ্য দেখে নীতি ও মাহতিম চরম মাত্রায় অবাক হয়ে গেলো! নীতি আশ্চর্য কন্ঠে চমকিত চাহনিতে বললো,
– ওকে কিভাবে ব্যথা দিলো ভাইয়া? কি খারাপ! ও এমনেই হাঁটতে —
বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই মাহতিম এক হুঙ্কার দিয়ে উঠলো!দোতলা থেকে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
– আপনি ওর সাথে এটা কি করলেন! ওকে ব্যথা দিলেন কেনো! কি হলো? এ্যাই! আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি না? ওর ব্যান্ডেজের উপর ব্যথা দিলেন কেনো?
মাহতিমের চেঁচানো গলা শুনে শেফালী যখন উপরে তাকালো আতঙ্কিত হয়ে গেলেন তিনি। মাহতিম গর্জে উঠেছে যেনো, এখুনি সব লন্ডভন্ড করে তান্ডব করে দিবে ও। শেফালী অনবরত ঢোক গিলতে থাকলে বারবার রান্নাঘরের দিকে তাকাতে লাগলো। সুজলা আর মাহমুদা সব শুনলো কিনা আল্লাহ-ই জানে! মাহতিম ততক্ষণে ধুপাধুপ নিচে এসে দাড়িয়েছে। নীতিও একদৌড়ে ভাইয়ের পাশে এসে উপস্থিত। এক-এক করে সবাই যে-যার রুম থেকে ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হতে থাকে। শানাজের সাথে সুজলা, মাহমুদাও এসে হাজির হলো। সবাই যখন প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে মাহতিম ও শেফালীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন হঠাৎ করে নিরবতা চ্ছিন্ন করে মারজা এসে প্রশ্ন করলো,
– মাহতিম, তুই চেঁচালে কেন? তুই মেজো ভাবির সাথে জোর গলায় কথা বলছিস? মাহতিম! তোকে কি বলেছি শুনছিস না?
মায়ের চেঁচামেচি শুনে বুক ফুলিয়ে লম্বা নিশ্বাস নেয় মাহতিম। চোখের দৃষ্টি ভয়াবহ, মুখের অবস্থাও কঠোর। এমনভাবে নিশ্বাস নিলো, যেনো হিংস্রভাবে হামলে পরার জন্য পূর্ব-প্রস্তুতি সারলো। মারজা উত্তর না পেয়ে এবার মেহনূরের দিকে তাকালো। এতোক্ষন মেহনূর সিক্তচোখে নতমুখে দাড়িয়েছিলো, এরই মধ্যে মারজাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাহতিম আরেকদফা চেঁচিয়ে উঠলো,
– আপনাকে আমি কি বলেছি শোনেননি? ওর ব্যান্ডেজে ব্যথা দিলেন কেনো? কোন্ সাহসে এই কাজ করলেন? আপনার মেয়ের আঙ্গুল কেটে যদি মোচড়ে দেই, তখন কেমন লাগবে?
শেফালী একবার মাহতিমের ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকালেন, আরেকবার সুজলা ও মাহমুদার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালেন। কিন্তু পরিস্থিতি কোনোভাবেই ঠান্ডা অবস্থায় ফিরে আসলোনা। শানাজ ব্যাপারটা সামলানোর জন্য নিজের মা সুজলার কানে গিয়ে ঘটনাটা বললো। সুজলা সবটা শুনে কথা বলাই যেনো ভুলে গেছেন। তিনি শানাজের দিকে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকালে শানাজ অসহায় ভঙ্গিতে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়লো। এবার সুজলা দৃষ্টি ফিরিয়ে শেফালীর দিকে রাগান্বিত চাহনিতে তাকালেন। শানাজকে ইশারা দিয়ে মেহনূরকে হাত-মুখ ধোয়াতে নিয়ে যেতে বললেন। এরপর মাহতিমের পাশে এসে শেফালীর সামনে দাড়িয়ে শক্ত গলায় বললেন,
– তুই মেহনূরকে মেরেছিস?
প্রশ্ন শুনেই তোতলাতে থাকে শেফালী। নিজেকে সত্য প্রমাণ করার জন্য বৃথা চালাতে গিয়ে সুজলা ওকে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে থামিয়ে বলে,
– চুপ কর। আর কোনো মিথ্যা কথা বলতে যাবিনা। তুই সাবাকে তাড়িয়ে দিয়েছিস এই কথা অস্বীকার করবিনা। আজ আব্বা আসুক। তুই যে কতো বড় পাপ করছিস আব্বা আজকে বিচার করুক। আমি তোকে বাঁচাবোনা। মাহমুদা? তুই যদি ওকে বাঁচাতে আসিস, তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবোনা। তোর মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার শুনে আমার গায়ের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। এ বাড়ির সবাই জানে আমি মেহনূরকে নিজের মেয়ের তুলনায় বেশি আদর করি। অথচ তুই আজকে কি অঘটনটা করছিস খেয়াল আছে? তোর কোনো খেয়ালই নাই। আজ আব্বা আসুক খালি! আজকে তোর বিচার হোক!
সুজলা হামেশার মতোই ন্যায়পরায়ণ এবং নীতিনিষ্ঠ মহিলা। কোনো অন্যায় যেমন সহ্য করেন না, তেমনি কেউ অপরাধ করলে খুব সহজে মাফ করেন না। তিনি মেহনূরকে সবচেয়ে বেশি আদর করেন এটা মেহনূরের মা মাহমুদাও ভালো করে জানে। এদিকে শেফালী কোনোভাবেই আজ পার পাবেনা, এটাও সবাই ভালোমতোই বুঝে গেছে।
হান্নান শেখকে ডাকার জন্য খবর পাঠালে তিনি বলে দেন রাতে একটু দেরি করে ফিরবেন। পাশের গ্রামে বিরাট গন্ডগোল লেগেছে, সেটা দেখার জন্য নালিশে বসেছেন। সুজলা আঁটি গেড়ে উঠোনের চৌকিতে বসে আছেন। যেপযর্ন্ত শেফালীর বিচার না হবে সেইপর্যন্ত বাড়ির ভেতরে পা দিবেন না তিনি।
সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বের হওয়াটা অশুভ হলেও আজ সকলেই সুজলাকে ঘিরে দাড়িয়ে বা বসে আছেন। মারজা ও মাহমুদা সুজলার পাশেই চৌকিতে উঠে বসে আছে। আজ এই ঘটনার জেরে বাড়িতে কেমন এলাহীকান্ড ঘটবে কে জানে? নীতি, প্রীতি, সামিক, সাবির ও মাহদি তীব্র উৎকন্ঠায় আঙিনার চৌকিতে বসে আছে। নীতি বাদে চারজন বিষণ্ণ ভাব কাটানোর জন্য মোবাইলে ‘ লুডুকিং ‘ খেলছে। সৌভিক, তৌফ ও সিয়াম রুক্ষ মুখে বেতের চেয়ারে গোল করে বসে আছে। সবার মধ্যেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
নীতি ওদের লুডু খেলা দেখতেই হঠাৎ ওর নিজের ফোনটা ভাইব্রেট হয়ে উঠে। চমকে গিয়ে মোবাইলের দিকে তাকাতেই মাহতিমের ম্যাসেজ দেখে। ম্যাসেজের লিখা দেখে নীতি এবার সত্যি-সত্যিই ঘাবড়ে যায় ,
‘ রাস্তা ক্লিয়ার? ক্যান আই গো? তাড়াতাড়ি চেক কর! ‘
নীতি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় মেসেজ দেখে। সে জানেনা মাহতিম কি করতে চাইছে। মনের মধ্যে অজানা ভয়ে উৎকন্ঠা অবস্থা ধারন করেছে, সেই সঙ্গে ভয়জড়িত অবস্থায় সংকোচ বোধ করছে নীতি। এদিকে মাহতিম কাঙ্ক্ষিত উত্তর জানার জন্য দ্বিতীয়দফায় মেসেজ পাঠালে নীতি সবকিছু ঠিকঠাক দেখে বলে দেয়, বাইরে আসতে প্রবলেম নেই, এখানে বড়দের মধ্যে কেউ নেই। মাহতিম ঠিক দুই মিনিটের মাথায় নিজের রুম থেকে বের হয়। গায়ের পোশাক ততক্ষণে পাল্টে নিয়েছে মাহতিম। টিশার্ট খুলে শার্ট গায়ে দিয়ে শার্টের দুইহাতা দ্রুততার সাথে কনুইয়ের ভাঁজে গুটাচ্ছে। নীতি আঙিনায় বসা অবস্থায় দোতলার দিকে তাকায়, মাহতিম যে বারান্দা পেরিয়ে সিড়ির কাছে এসে পরেছে সেটা সম্পূর্ণ দেখতে পায় নীতি। মাহতিম ততক্ষণে নিচে এসে দাড়ালে প্রীতি ও ফারিনের দৃষ্টি মাহতিমের দিকে থমকে যায়। তারা সুক্ষ্ম কারনে কৌতুহল ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
– ভাইয়া তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?
মাহতিম শুধু নীতির দিকেই তাকিয়ে থাকে। এইমূহুর্তে কাউকে না জানিয়ে কাজটা সারতে হবে। তাই প্রীতি ও ফারিনের কথায় উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বাইরের বেরিয়ে যায় মাহতিম।নীতিকেও জানায় না কোথায় যাচ্ছে সে। নীতি বিমর্ষ চাহনিতে মাহতিমের যাওয়া দেখতে থাকে। ও কি কাল ভোরের জায়গায় আজই চলে যাচ্ছে? এসব ভাবতেই নীতি ঝট করে উঠা থেকে দাড়িয়ে পরে, দ্রুতপায়ে সৌভিকদের কাছে গিয়ে মাহতিমের ঘটনা বিস্তারিত বলে দেয়। কথাগুলো শুনতেই মেজাজটা সামলাতে না পেরে নীতির মাথার পেছনে চাট্টি মারে সৌভিক। স্বর নামিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে কটমট করে বলে,
– তোর মাথায় কি গোবর ভরে রাখছিস? ও যে চলে গেলো তুই আমাদের আগে বলবিনা? শা*লার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে!
সৌভিকের কথায় আড়ি ভেঙ্গে মাঝখান থেকে তৌফ বলে উঠে,
– দোস্ত এবার কি হইবো? মাহতিম যদি এইবার চলে যায় তাহলে আর জীবনেও ওর কপালে শান্তি জুটবো না। শা*লা বাটপার তো আবারও বালের চাকরির পেছনে কুত্তার মতো খাটবো। না দোস্ত, কিছু কর। অনেক হইছে।
তৌফের উত্তেজিত কথার মধ্যে হঠাৎ থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে মুখ করে থাকে। সবাই যখন একই চিন্তার রেশে প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে উঠে, তখন সিয়াম নিরবতা ভেঙ্গে চুরমার করে বলে,
– ও কি যাওয়ার সময় লাগেজ নিয়ে গেছে? ওই নীতি! শা*লী দামড়ি মনে কর, ও কি লাগেজ নিয়ে গেছে?
নীতি জলদি কিছু মনে করার ভঙ্গিতে চুপ থেকে হঠাৎ ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
– না না, ভাইয়া সঙ্গে কিচ্ছু নেয়নি। শুধু জিপের চাবিটা হাতে দেখছি, আর কিচ্ছু ছিলো না।
এটুকু কথা শুনে সবাই একসাথে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ালো। ভাবটা এমন করলো যেনো মাথায় তাক করা বন্দুকটা কেউ নামিয়ে ফেলেছে। সিয়াম বেতের চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে,
– লাগেজ না নিলেই শান্তি। লাগেজের চিপায় ওর পাসপোর্ট লুকিয়ে রাখছি। শালা ক্যামনে এই সুন্দরিখানা থেকে বাহির হয় আমিও দেখুম।
মাহতিম হনহন করে মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতেই জিপের কাছে এগুতে লাগলো। আঙিনার চৌকিতে বসা মারজা তখন ছেলের আকস্মিক গমন দেখে মারজা ভ্রুঁ কুন্ঞ্চন করে বলেন,
– এই তুই কোথায় যাচ্ছিস?
মাহতিম পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবি বের করতেই মারজার উদ্দেশ্যে শক্ত কন্ঠে বললো,
– তোমার বুঝা উচিত কেনো জিপ নিয়ে বের হচ্ছি। পেছন থেকে আর ডাকবেনা।
কথা শেষ করতেই জিপে গিয়ে উঠলো মাহতিম। চাবি ঢুকিয়ে জিপ ঘুরিয়ে শোঁ করে চলে গেলো রাস্তার দিকে। চারপাশে রাতের অন্ধকারে হতবাক হয়ে গেশেন মারজা। ছেলের এমন উগ্র আচরণে বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন তিনি। সুজলা সবটা খেয়াল করলেও না-দেখার ভান করে মাহমুদার সাথে কথা বলতে লাগলেন। অপরদিকে রুমে শুয়ে হাঁশফাস করছে মেহনূর।
কোমরের যন্ত্রণাটা আবারও যেনো চাড়া দিয়ে উঠেছে। সাদা ব্যান্ডেজটা যেনো হালকা মতোন লাল হয়ে গেছে। মাহতিম যদি না আসতো শেফালী ওকে পীড়া দেওয়ার জন্য আরো কতো কি করতো কে জানে। কিন্তু এই ঘটনা কারনে দাদাভাই কেমন প্রতিক্রিয়া দিবে সেটা নিয়েই ভয় পাচ্ছে মেহনূর। ওর দাদাভাই যতোই শক্ত হয়ে থাকুক না কেনো, এসব কারনে অসুখ বাধানোর শঙ্কা আছে। মেহনূর সেটা নিয়েই চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কর্ণকুহরে জিপ ছুটানোর ভুমভুম আওয়াজ হলে কৌতুহল মনে বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। মাহতিম অন্ধকারের মধ্যে জিপের ফ্রন্ট লাইট জ্বালিয়ে কোথায় যেনো যাচ্ছে, সেটা দেখে কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও পাত্তা না দিয়ে পুনরায় বালিশে শুয়ে পরে।
সময়ের প্রহর এশার ওয়াক্তের জন্য প্রস্তুত হলো, ঠিক ওইসময় আবারও সেই দাপুটে আওয়াজে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠলো। হিংস্র বাঘের মতো ছুটন্ত জিপের বেগ একেবারে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বিরাট উঠানের একপাশে এসে থামলো। জিপের অবস্থার জন্য উঠানের ওটুকু অংশ যেনো ধূলায় অন্ধকার হলো। মারজা, মাহমুদা, সুজলা সহ শানাজ-সাবাও চকিত দৃষ্টিতে জিপের পানে তাকিয়ে রইলো। ধূলো ভেদ করে হঠাৎ দুজন ব্যক্তির আগমন দেখে সুজলা তৎক্ষণাৎ চৌকি থেকে উঠে মাথায় ঘোমটা টানলেন। সেই সঙ্গে বাকি দুজন মহিলাও ঘোমটা টেনে বৃদ্ধের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিছুটা নতমুখে দাড়ালেন।
হান্নানের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘটনা ইতিমধ্যে জানা শেষ। কাজটা যে মাহতিম-ই করেছে এটাও সবার কাছে পানির মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। হান্নান শক্ত ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতরে পা দিয়েই জোর গলায় শেফালীকে ডাকলেন। নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে থাকা শেফালী ভয়ে কেঁপে উঠলো। মিনমিন করতে-করতে শেষে দরজা খুলে আঙিনায় এসে হান্নানের সামনে দাড়ালো। দাদাভাইয়ের তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ শুনে পা টিপে-টিপে বারান্দায় আসলো মেহনূর। রেলিংয়ের কাছে এসে দেখলো, দাদাভাইয়ের মুখ যেনো রাগে লাল হয়ে গেছে। আর ঠিক পাশেই পকেটে দুহাত গুঁজিয়ে মাহতিম ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছে। সুজলা এসে সমস্ত ঘটনা আবার ব্যাখ্যা দিতেই হান্নান শক্ত গলায় প্রশ্ন করলেন,
– মেজো বৌ, আমি আজ পযর্ন্ত তোমার কান্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। তোমার শ্বাশুরি যখন বেঁচে ছিলো, সেও তোমার কাজে অসন্তুষ্ট ছিলো। তবুও তোমার কাজে নিন্দাবাক্য শুনাইনি। তুমি কোন্ স্পর্ধা দেখিয়ে আমার মেহনূরকে মেরেছো? এই অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে মেজো বৌ? তুমি কি জানোনা, আমি এখনো কর্তা হিসেবে মোল্লাবাড়িতে জীবিত আছি? নিজেকে তুমি এখনই সেয়ানা ভাবতে শুরু করেছো? জবাব দাও মেজো বৌ! আজ যদি তুমি চুপ করে থাকো, আমি হান্নান শেখ কড়ায়-গন্ডায় এর বিচার করবো।
হান্নানের কথা শুনে শেফালী এমন একটা ভাব করলো, সে ভুলবশত দোষ করে ফেলেছে, ইচ্ছাকৃত ভাবে করেনি। কিন্তু হান্নান শেখ কোনো কথাই শুনতে রাজি হয়নি, তিনি হামেশার মতোই শক্ত এবং অনড় মানুষ। শেফালীকে তিনি স্পষ্ট শব্দে বলে দিলেন,
– আমার নাতনীগুলোর দিকে এবাড়ির কোনো সদস্য যদি সামান্য আঙ্গুলও তুলে, আমি ওই ব্যক্তির আঙ্গুল তোলার সাহস ভালোভাবে বুঝিয়ে দিবো। এই কথা যেনো সকলের মনে থাকে। আমি আমার নাতনীদের এমন শিক্ষা দেইনি, যাতে তারা কখনো অন্যায় আচরণ করবে। শুধু সুরাইয়ার ব্যাপার নিয়ে আমি পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবো। মেজো বৌ খুব ভালো করেই জানো, তুমি আমার মেজো নাতনীকে কেমন উগ্র বানিয়েছো। আমি আর বিস্তারিত বলে নিজের রক্ত গরম করতে চাইনা। সবাই ভেতরে যাও। আর বড় বৌ, তুমি আমার অনুপস্থিতিতে আমার নাতনীদের প্রতি খেয়াল রাখবে। ছোট বৌ যাও, খাবার বাড়ো, আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।
গজগজ মুখে হান্নান শেখ কলপাড়ের দিকে চলে গেলেন। সুজলা ও মাহমুদা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে মারজা ভাবীদের কাছে সাহায্য করতে গেলেন। মাহতিম নিজের রুমের জন্য পা বাড়ালে আচমকা শানাজ ও সাবা ওর পথ রোধ করে। শানাজ সবার আগে বলে উঠে,
– আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি যদি দাদাভাইকে তাড়াতাড়ি আনতে না যেতেন, তাহলে মা বাড়ির বসে অপেক্ষা করতে-করতে অসুস্থ হয়ে যেতো। এজন্য —
শানাজকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে মাহতিম পকেট থেকে একটা মলমের টিউব বের করে বললো,
– ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য এই কাজ করিনি। বাড়ির পরিবেশ খুবই গুরুতর ছিলো, এজন্য বাধ্য হয়ে নানাকে আনতে গিয়েছি। মলমটা ধরো। ওর কাটা জায়গাটায় দুই টাইম লাগিয়ে দিও। তাড়াতাড়ি শুকাতে হেল্প করবে।
টিউবটা শানাজের হাতে তুলে দিয়েই মাহতিম নিজের রুমে চলে গেলো। বাড়ির মধ্যে যেই থমথমে অবস্থাটা কায়েম ছিলো, সেটা কিছুটা যেনো সুস্থির হলো। রাতটুকু সকলে নির্বিঘ্নে ঘুমালেও শেফালীর তখন ঘুম আসেনি। বিছানায় বসে প্রচণ্ড রাগে বারবার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা বালিশে ঘুষি মারছিলো। ইচ্ছে করছিলো মেহনূরকে ফ্লোরে ফেলে ইচ্ছামতো পিটাতে! কিন্তু রাগ সংবরন করে চুপচাপ বালিশে মাথা ঠেকালো শেফালী। এদিক রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে! মেহনূরকে ধরে যদি আজকের শোধ না তুলেছে, তাহলে শেফালী নিজের অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলবে! কাটা জায়গা একেবারে ক্ষতবীক্ষত করে ঝাঁঝরা করে দিবে ও! একটুও ছাড়বেনা মেহনূরকে! চিলতেখানিও না !
ফজরের টাইমে অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে উঠলো মেহনূর। কালরাত অনেক কষ্টে ঘুমাতে পেরেছে সে। ব্যথার জন্য রাতভর নিঃশব্দে কাতরাতে হয়েছে। কিন্তু এখন ব্যথা একটু কম বোধ হলে গোসলটা সবার আগে সারার জন্য উঠে যায়। এইসময় কেউই ঘুম থেকে উঠবেনা। কাল গোসল না করাতে গা ম্যাজম্যাজ করছে, মাথায় পানি না ঢালার জন্য তালুতে তাপ অনুভূত হচ্ছে। মেহনূর গামছা নিয়ে চুপিচুপি পা বাড়িয়ে সিড়ি ধরে নিচে নামে। আঙিনার বাতি নিভানো আছে, তারমানে কেউই উঠেনি এখন। মেহনূর এই সুযোগে সদর দরজা খুলে কলপাড়ে চলে গেলো। আকাশের কালো চাঁদরটা ধীরে-ধীরে সরে যাচ্ছে, পূর্ব আকাশে সোনালী সূর্য আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে। আশেপাশে একটা মানুষ তো দূর, কুকুরের মতো প্রাণীও নেই।
ছোট থেকেই ভৌতিক বিষয়ে ভয় নেই মেহনূরের, একা-একাই সব কাজ করতে পারে সে। হাতমুখ ধুয়ে ভেজা গামছাটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো মেহনূর। গামছা দিয়ে চুল মুছতে-মুছতে আধো অন্ধকারের ভেতর নিজের রুমের দিকে যেতেই হঠাৎ গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে গামছা ছেড়ে দেয় মেহনূর। পায়ের সামনে ভেজা গামছা পরে যেতেই সেটার উপর পারা দিয়ে দাড়ালো শেফালী। চোখদুটো যেনো নির্ঘুমের কারনে ফুলে আছে, সেই সঙ্গে রক্তিম-লাল অবস্থা। মেহনূরের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেনো হিংস্রভাবে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি সারছে। মেহনূর ভয়ের চোটে লম্বা-দীর্ঘ নিশ্বাস নেওয়া শুরু করলে হঠাৎ ওর চোখদুটো শেফালীর হাতের দিকে পরে। শেফালী একটা ভাঙ্গা কাঠের লম্বা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লাঠির দিকে চমকিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই আরো অস্থির হয়ে উঠে মেহনূর! পায়ে-পায়ে পিছাতে থাকে পিছনের দিকে! শেফালীও ওর ভয়ার্ত চেহারা দেখে মনের দগ্ধজ্বালা মিটাতে পৈশাচিক আনন্দে এগুতে থাকে। এদিকে তিন কদম না পিছাতেই শেফালী কেনো যেনো থমকে গেলো, ওর দৃষ্টি যেনো ভূত দেখার মতো পলকহীন হলো। মুখের সেই পৈশাচিকতার আভাসটুকুও হারিয়ে গিয়ে ভয়ের আবছায় মূর্ছিত হলো। শেফালীর অবস্থা দেখে মেহনূর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলে ওর স্থিরদৃষ্টি লক্ষ করে পেছনে তাকালো। ওমনেই মৃদ্যুভঙ্গিতে শিউরে উঠে শেফালীর দিকেই পিছিয়ে গেলো মেহনূর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেহায়া ব্যক্তিটি কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি মেহনূর। তারমানে মেহনূর যখন পিছাচ্ছিলো, তখন ওর পেছনে মাহতিমকে দেখেই শেফালী হাতের লাঠিটা শাড়ির আচঁল লুকাচ্ছিলো। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝতেই মেহনূর চুপ করে ঢোক গিলতে লাগলো। এদিকে মাহতিম রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে শেফালীকে ভয়ের জালে এফোড়-ওফোড় করতেই গম্ভীর গলায় বললো,
– মেজো মামী কি ভাঙা লাঠি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে আসছিলেন? সবাইকে ডাকি? সবাই আপনার ক্রিকেট খেলাটা একটু দেখুক। কি বলেন মামী?
শেফালী অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসি টেনে বললো,
– কি যে কও বাবা, কিসের কিরিকেট? আমি এগ্লা পারিনা।
মাহতিম একপা এগিয়ে আসলে মেহনূর সাথে-সাথে দুইপা পিছিয়ে শেফালী ও মাহতিমের মাঝখান থেকে সরে দাড়ায়। মাহতিম এতে সন্তুষ্ট হলেও মেহনূরের দিকে না তাকিয়ে শেফালীর দিকে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে,
– আমার সামনে কাহিনী একটু কম-কম করবেন মামী। আমি আবার মানুষের খেলাধুলা একটু বেশি বুঝি। এইযে আপনি চুপিচুপি কাউকে না-জানিয়ে মেহনূরকে ক্রিকেট খেলা দেখাতে এসেছিলেন, সেটা আমি বুঝে গেছি। বলিকি, একটু সাবধানে থাকবেন মামী। আমি মানুষটা আবার বেশি একটা ভালো না। ঠান্ডা মেজাজে থাকি তো, এজন্য কেউ রাগিয়ে দিলে ছাড়িনা। মাঝেমাঝে নির্দয়ের মতো কর্মকাণ্ড করার রের্কড আছে, দেখতে চাইলে নীতিকে বলবেন, ও আপনাকে উসুল করে দেখিয়ে দিবে। চলি কেমন?
মাহতিম সুন্দর একটা হাসি দিয়ে কথাটুকু শেষ করলো। এবার মেহনূরের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে মুখ তেঁতো করে বললো,
– আজীবন এভাবেই মানুষের লাত্থি-উষ্টা খেয়ে বড় হতে থাকো তুমি। তোমার মতো বলদের মুখ দেখলে আমার গা রি রিন করে জ্বলতে থাকে।
মেহনূরের মুখের উপর কড়া কথা শুনিয়ে সত্যি-সত্যিই বাইরে চলে গেলো মাহতিম। শেফালী মেহনূরের দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি ছুঁড়ে শব্দ করে হাতের লাঠিটা সেখানেই ফেলে দিলো। আর দাড়ালোনা, চুপচাপ নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে চলে গেলো। সকালের নাস্তা পর্ব চলাকালীন মাহতিম সবাইকে জানিয়ে দিলো ঠিক এগারোটার দিকে সে একাই চলে যাবে। মারজাসহ বাকিরা সব এখানেই কিছুদিন থাকবে। হান্নান একথা শুনে অনেক অনুরোধ করলেন মাহতিমকে, কিন্তু মাহতিম কোনোভাবেই রাজি হলোনা থাকার জন্য। তবে সময় পরিবর্তন করে দুপুর দুইটা ঠিক করে দিলো। অন্তত দুপুরের খাবার খেয়ে এখান থেকে বিদায় নিবে মাহতিম। মাহতিমের ‘ বিদায় ‘ শব্দ শুনে সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হয় কাজিন ও বন্ধুদের। অপরদিকে সুজলাও মন খারাপ করে ফেলেন একথা শুনে। মাহতিম যে কোনোদিন এ পরিবারে যুক্ত হয়নি, এটা মনেই হয়নি ওর আচরণ দেখে। মাহতিম সবার সাথেই খোশমেজাজে আনন্দ উপভোগ করে গেছে। এদিকে নাস্তা সেরে শানাজ মেহনূরকে দেখতে যায়। মেহনূর তখন কোমরের ড্রেসিং খুলে নতুন ড্রেসিং লাগানোর জন্য কার্যত ছিলো। শানাজকে দেখে মেহনূর তৎক্ষণাৎ বললো,
– খবরদার বুবু, তুমি আমাকে ধরবেনা।
শানাজ থতমত খেয়ে অবাক হয়ে বললো,
– কি আজব! ব্যান্ডেজ তুই একাই পাল্টাবি? ব্যথা হবেনা? দে আমি করে দেই।
মেহনূর সঙ্গে-সঙ্গে দুপা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
– লাগবে নাতো। তোমাকে এখান থেকে যেতে বলছি।
শানাজ অনেক চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হিসেবেই উপনীত হলো, তখন আর সেখানে থাকতে পারলোনা। মেহনূর যে রেগেমেগে ভীষণ অভিমানে ওর সাথে এমন ব্যবহার করছে সেটা বুঝে গেছে শানাজ। তাই বিষণ্ণ মনে চুপচাপ সে আঙিনায় এসে মাহতিমের পাশে হাঁটু তুলে বসে। দুগালে হাতের তালু লাগিয়ে কনুইদুটো হাঁটুতে ঠেকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহতিম ওইসময় ফোনে কথা বলছিলো, শানাজের এমন অবস্থা দেখে কল কেটে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে? এভাবে বসে আছো কেন? আবার মেজো মামী কিছু বলেছে নাকি?
এই কথা শুনে শানাজ তাড়াতাড়ি শশব্যস্তে বললো,
– আরে না না ভাইয়া, মেজো মা কিছুই বলেনি। আসলে —
– বলো শানাজ, আমার কাছে লুকানোর কোনো মানে হয়না।
শানাজ একটু চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে তারপর ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
– আপনি কালরাতে যে মলম দিয়েছেন, ওই বান্দরটা নেয়নি। ব্যান্ডেজও পাকনামো করে নিজেরটা নিজেই খুলছে। কি করবো আমি, কিছুই যে বুঝতে পারছিনা ভাইয়া। আমার সাথে রেগে আছে কেনো এখনো ঠিকমতো জানিনা।
মাহতিম কোনো কথা না বলে শানাজের পাশ থেকে উঠে দাড়ালো। সোজা সৌভিকের রুমে যেয়ে দরজায় দাড়িয়ে বললো,
– সৌভিক, নীতি উঠে আয় তো।
সৌভিকের রুমে সবাই মিলে গান নিয়ে মেতেছিলো। হঠাৎ মাহতিমের আদেশ শুনে পুরো রুমে পিনপতন নিরবতা ছেয়ে গেলো। দুজন গানের সভা ভঙ্গ করে মাহতিমের সাথে বাইরে আসলে মাহতিম ওদের বুঝিয়ে বললো জরুরী একটা কাজ আছে। নীতি কাজটার বিষয়ে পুরোপুরি না বুঝলেও একটু-আধটু আঁচ করতে পারলো। পরক্ষনে নীতিকে সেদিনের মতো রুমের বাইরে পাহারাত্তয়ালা বানিয়ে দিলো, আর সৌভিককে পাঠিয়ে দিলো শানাজ,সাবা ও সুরাইয়ার সাথে আড্ডা জমিয়ে তুলতে। ভুলেও রুমের দিকে কেউ যেনো না আসে। সৌভিক ও নীতি মিটিমিটি হাসতেই ভ্রু নাঁচিয়ে নিজেদের মধ্যে চোখের ইশারায় কথোপকথন করে। এদিকে মাহতিম নীতিকে টেনে মেহনূরের দরজায় নক করতে বলে। নক করলে ভেতর থেকে জবাব দেয়,
– আসো ,
নীতি দরজা ঠেলে যেই পা ভেতরে রাখবে ওমনেই পেছন থেকে কান টেনে ধরে মাহতিম। চোখের ইশারায় বলে উঠে,
– চটকে গাল লাল করে দেবো! তুই ক্যান ভেতরে যাবি? তোর কাজ শেষ। যা!
নীতি কানের ব্যথায় আকুতি দৃষ্টিতে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
– ভাই ভাই কান ছাড়ো, তোমার হাতে প্রচুর ব্যথা লাগে। আমি যাচ্ছি তো, আমি পাহারা দিচ্ছি।
মাহতিম তৎক্ষণাৎ কান ছেড়ে দিয়ে একটা শয়তানি মার্কা হাসি দিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকলো। নীতি কান ডলতে-ডলতে কোমরে একহাত রেখে পাহারা দিতে শুরু করলো। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাহতিম এমন চেহারা নিয়ে বের হলো, যেটা দেখে নীথি রীতিমতো ভয় পেয়ে অস্থির হয়ে বললো,
– ভাইয়া কি হয়েছে? আল্লাহ্, ভাই তুমি আবার ক্ষেপলে কেনো?
মাহতিম নীতির দিকে অগ্নিদদৃষ্টি ফেলে দরজা সম্পূর্ণ খুলে দিয়ে তর্জনি উঁচিয়ে ইশারা করে বলে,
– ও কোথায়?
নীতি উজবুকের মতো জবাব দেয়,
– কে কোথায়?
মাহতিম দুপাটি দাঁত চিবিয়ে উত্তর দেয়,
– বলদ কোথায়?
নীতি চকিতে ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
– মেহনূর কি ভেতরে নেই?
মাহতিম আরেকবার ক্ষুদ্ধদৃষ্টিটা তীব্ররূপে ছুঁড়ে সেখান থেকে চলে যায়। অনেক হয়েছে আর ওই বলদের পেছনে সহানুভূতির মানে হয়না। নীতি ভ্যাবাচ্যাকা দাড়িয়ে থাকলে ভেতরে গিয়ে দেখে কোথাও মেহনূর নেই, খুজঁতে গিয়ে আবিষ্কার করে সুরাইয়ার রুমে দরজা লাগিয়ে মেহনূর আরামসে ঘুমিয়ে আছে। কাজটা সে কেনো করেছে, এটা বোঝা শেষ।
আকাশের উত্তপ্ত অরুণটা দারুণ তেজ দেখাচ্ছে। কাঠ ফাটা গরমের জন্য পরিবেশে তপ্ততা বিরাজ করছে। হান্নান শেখ বিরসমুখে সকলের সঙ্গ বাদ দিয়ে দুপুরের খাবারটা মাহতিমের সাথে খেলেন। মাহতিম শার্ট-প্যান্ট একদম পরে রেডি হয়ে নেমেছে এখন। খাবারের কয়েক লোকমা শেষ করে সোফায় গিয়ে বিশ মিনিটের রেস্টের জন্য বসলো। ওকে ঘিরে সবাই তখন না যাওয়ার জন্য শেষ অনুরোধ করলো। মাহতিম ওদের বলে দিলো,
– আমি আর এখানে আসার নামও নিবো না। দয়াকরে এখানে থাকার জন্য বৃথা চেষ্টা করিস না। পাসপোর্টটা ভালোয়-ভালোয় ফিরিয়ে দে, নয়তো বাসায় পৌঁছে তোদের কি অবস্থা হবে বুঝে নিস।
কেউই মুখ খুললোনা, পাসপোর্ট দিলোনা। মাহতিমও পাসপোর্ট ছাড়া যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। সঙ্গে-সঙ্গে সদর দরজা দিয়ে একটা ছেলের কন্ঠ শোনা গেলো,
– দাদাজান কই? দাদাজান? ও দাদাজান?
আগত স্বরটার দিকে সবাই তাকিয়ে থাকলে মাহতিম পিছু ফিরতেই দেখে একটা হাসিখুশি সুন্দর ছেলে ‘দাদাজান’ বলে ডাকাডাকি করছে। সুজলা, মাহমুদা বাইরে বেরিয়ে আসলে খুশীতে পুলকিত হয়ে এগিয়ে গেলেন ছেলেটার দিকে। নীতি প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বলে উঠে,
– এই ছেলেটা কে? সুরাইয়ার ভাই নাকি? কিন্তু সুরাইয়ার ভাইকে তো দেখেছি। ও তো সেই ছেলে না।
মাহতিম এখনো শান্তদৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে আছে। ক্রমে নীতির নরে প্রীতি, সামিক, সৌভিক, সাবির একই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। তখনই সুরাইয়ায মা শেফালী রুম থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে ছুটে এসে ছেলেটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন,
– ও তরুণ, কতোদিন পর আসলা? আমগোর কথা কি ভুইলে যাও? একবার কি আসোন যায়না?
তরুণ হাসি দিয়ে কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বলে,
– আন্টি, কাজের চাপে তো সময় কুলায় না। আমি আব্বার সাথে দেখা করা বাদ দিয়ে আপনাদের আগে দেখা করতে আসছি। দাদাজান কই? মেহনূর কি গোয়াল ঘরে?
এবার শান্ত কপালটাতে অসংখ্য ভাঁজ পরলো মাহতিমের। কিন্তু মুখে কিছু না বলে পরিস্থিতি দেখতে লাগলো। মারজাও এসে তরুণকে দেখে খুশী হলেন। তরুণ সুরাইয়ার ভাইয়ের ছোটবেলার বন্ধু। তরুণরা যদিও পাশের বাড়িতে থাকতো, কিন্তু মা মা-রা যাওয়ার পর তরুণ চাকরী নিয়ে শহরে চলে যায়, তরুণের বাবাও ছেলের সাথেই থাকেন। হান্নান শেখ এসে উপস্থিত হলে বাড়ির পরিবেশই যেনো পাল্টে যায়। কেউ আর স্মরণে রাখেনা, মাহতিম এখান থেকে চিরদিনের মতোই বিদায় নিচ্ছে। তরুণের সাথে মাহতিমের কুশল বিনিয়ে ঘটে। সৌজন্যমূলক কুলাকুলি করলে মাহতিমের উদ্দেশ্যে তরুণ বলে,
– ব্রাদার, তুমি আমাকে চিনবে না। না চিনারই কথা। কিন্তু একি! তুমি কি কোথাও চলে যাচ্ছো?
মাহতিম ঠেলেঠুলে হাসি টেনে বললো,
– আমি তোমার চেয়ে কয়েক ইয়ারের বড় মেবি। তবে ফরমালিটি হিসেবে ‘ তুমি ‘ না বলে ‘ আপনি ‘ বললেই খুশি হবো।
কথাটায় তীক্ষ্ম খোঁচা ছিলো। তরুণ সেটা বুঝতে পেরে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কিন্তু মাহতিম তখনো সহজ হতে পারলৌ না। এদিকে মারজা তাগাদার সুরে বলে উঠলেন,
– কিরে মাহতিম? তুই না আড়াইটার মধ্যেই বের হবি? ঘড়িতে তো তিনটা বেজে যাচ্ছে।
মাহতিম তৎক্ষণাৎ বাঁ কবজির দিকে ঘড়িটার উপর চোখ রাখলো। একমিনিট ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চিন্তার জন্য চুপ থেকে, হঠাৎ উদ্বেলিত কন্ঠে বললো,
– মা, আমার যাওয়া সম্ভব না।
মারজা বিচলিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ঝুলিয়ে বললেন,
– মানে? তুই না নিজেই যাওয়ার জন্য লাফালাফি শুরু করলি? এখন এই কথার মানে কি?
মাহতিম হাসিশূন্য মুখে তরুণের দিকে একপলক তাকালো। দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই পকেটে হাত গুজিঁয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললো,
– আমার আদরের ভাইবোনগুলো আমাকে ছাড়া একটা সেকেন্ডও থাকতে পারেনা মা।
মাহতিমের কথা শুনে সবাই যেনো আকাশ থেকে ঠাস করে মাটিতে পরলো। নিজেদের মধ্যে অবাক চাহনিতে চাওয়া-চাইয়ি করতেই মাহতিম আবারও একই ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– নীতি তো পা পযর্ন্ত ধরে ফেলেছে। আর কি বলেছে জানো?আমি চলে গেলে ও নাকি খাবার পযর্ন্ত মুখে তুলবেনা। এবার বুঝো? ওদের মতো আদরের ভাইবোনগুলো ছেড়ে আমি কিভাবে একা থাকবো? আমার কষ্ট হবেনা বলো? সৌভিক তো একেবারে মেয়েদের মতো কান্না করে দিয়েছিলো, নাক দিয়ে পানি ছুটানো যেটা বলে। অনেক কষ্টে থামিয়েছি। সবশেষে চিন্তা করলাম, আমিতো নিষ্ঠুর হতে পারিনা। এজন্য ভেবেছি যাবো না। তোমরা যখন যাবে, তখনই আমি যাবো।
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫+৬
এই কথা শুনে সৌভিকের ইচ্ছা করলো, নিজের গালে মাতালের মতো থাপ্পড় মেরে স্মরণ করতে, সে কবে মেয়েদের মতো কেদেঁ দিয়েছে? কবে নাক দিয়ে পানি ছুটিয়ে কেদেঁছে? এই ঘটনা কবে হলো? মায়ের পেট থেকে বের হয়ে কেদেঁছিলো এইকথা সকলেই বলে, কিন্তু মাহতিমের ভাষ্যমতে কবে এভাবে পানি ছুটিয়ে কাঁদলো কবে?নীতির দুইকান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বের হতে লাগলো। মাহতিমের পা সে কবে ধরলো? আবার খাওয়া বাদ দিবে বলেও কঠিন অনুনয় করেছে? সবার মুখের অবস্থা অমাব্যসার রাতের মতো কালো হয়ে গেছে। মানুষ এলিয়েন দেখলেও বোধহয় এতোটা আশ্চর্য হতোনা, যতোটা মাহতিমের বানোয়াট মিথ্যা শুনে আহাম্মক হয়ে গেছে।
