মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৯+১০

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৯+১০
ফাবিয়াহ্ মমো

মিথ্যার দরুনে আর ফিরে গেলো না মাহতিম। লাগেজ ঘুরিয়ে সোজা রুমের দিকে চলে গেলো তৎক্ষণাৎ। কিন্তু চক্ষুদৃষ্টি বারবার সেই আগত পুরুষ, আগত ব্যক্তি, তরুণ নামক মানুষটির উপর স্থির ছিলো। মাহতিমের এমন কান্ডে বাকিরা বিচলিত হলেও হান্নান শেখ মনে-মনে প্রচণ্ড খুশি হলেন। শানাজ, সাবাও প্রফুল্লচিত্ত অমোদিত হয়ে মনের গোচরে উচ্ছ্বসিত হলো। রুমে ফিরেই শার্ট খুলতে-খুলতে জানালার কাছে গেলো মাহতিম। বিরাট জানালা দিয়ে স্থির-নয়নে গ্রাম্য-প্রকৃতির নির্মল দৃশ্য দেখতেই শার্ট খুলে ডানদিকের চেয়ারে রেখে দিলো।

বুকভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে হাতের ঘড়িটা খুলতেই চিন্তিত চেতনায় ভাবতে লাগলো, কেনো আজ চলে গেলো না? শেষমূহূর্তে মিথ্যা বলার কি দরকার ছিলো? তরুণের আগমন দেখে মন কেনো অস্তির হলো? না হওয়াটাই কি স্বাভাবিক ছিলোনা? মাহতিম যখন এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তার দেয়ালে ছক করছিলো, ওইসময় ওর ডান পকেট থেকে মোবাইল বস্তুটা ভাইব্রেট হয়ে উঠলো। ঘড়ি খোলা বাদ দিয়ে সৎবিৎ ফিরে পেলো মাহতিম। পকেট থেকে সেটা বের করতেই স্ক্রিনের দিকে একনজর তাকালো, কলের সবুজ আইকনের উপর সোয়াইপ করে ফোনটা কানে রাখলো। নিজের শান্ত-স্থির আচরণটা এক সেকেন্ডের মধ্যে পরিবর্তন করে তীক্ষ্ণ-গম্ভীর রূপে সায় দিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– হ্যালো,
ছোট্ট শব্দটা কানে যেতেই সেকেন্ডের মধ্যে ওপাশ থেকে উত্তর চলে আসলো,
– আপনি কি আজ ফিরবেন না আনসারী? আপনার মেসেজটা দেখে আমরা কিন্তু খুশী হইনি।
ডানহাতে কানে ফোন ধরে পকেটে বামহাত ঢুকিয়ে চোখের দৃষ্টি শক্ত করলো মাহতিম। গলার স্বরটা রুক্ষ মেজাজে কনভার্ট করে কঠোর সুরে বললো,
– আমি আজ আসছিনা। এখনো আপনাদের কাছে অফিসিয়াল মেইলটা পাঠানোর সময় পাইনি। তাই টেক্সট মাধ্যমে কনফার্ম করে জানিয়ে দিয়েছি। আমার কিছুদিনের জন্য ছুটি প্রয়োজন। আমি এখন আসার মতো মানসিকতায় নেই, আমি কিছুদিন ছুটি চাই। আশা করবো, বিগত বছরগুলোর ছুটি এইমূহুর্তে ফিরে পাবো।
এমন উত্তরটা আশা করেনি ওপাশের ব্যক্তি। তাই বিরসমুখে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,

– আপনি যদি বিগত বছরের ছুটিগুলো এবছর চান, তাহলে নিতে পারেন। কিন্তু এটার জন্য আবেদন লিখে হেড-অফিসে পাঠিয়ে দিয়েন। আশা করবো, খুব শীঘ্রই আপনি আপনার কাজে ফিরবেন। ধন্যবাদ।
মাহতিম উত্তরটা শুনে কঠোর ভঙ্গিতেই বললো,
– ধন্যবাদ।
ফোনটা কেটে পিছু ফিরতেই থমকে গেলো মাহতিম। রুমের ভেতর সবগুলো হারামির দল এসে উপস্থিত। মাহতিম ওদের দেখে একপেশে একটা হাসি দিয়ে বললো,

– মুখের অবস্থা এমন কেন? আমিতো চলে যাচ্ছিনা।
পুরো আটজনের দৃষ্টি তখন বিষণ্ণ, মলিন ভারাক্রান্ত। মাহতিম ওদের ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝতেই কিছু একটা বলতে নেবে ওইমূহূর্তে ঝড়ের মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পরলো মাহতিমের উপর। মাহতিমকে ঘিরে সবাই যেনো লতার মতো জাপটে ধরলো। মাহতিম ওদের অবস্থা দেখে নির্বাক হয়ে গেলো। বিমূঢ় ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ শান্ত হয়ে সবার মাথায়-পিঠে-গালে হাত বুলিয়ে বললো,

– আমিতো যাচ্ছিনা পাগলের দল। আমিতো আছি কিছুদিন। শুধু শুধু মন খারাপের মানে আছে? এই দ্যাখ, তোদের সামনেই তো সবকিছু বলে দিলাম। গতবছর যেই ছুটিগুলো পাওনা ছিলো, সেগুলো এখন নিয়ে নিলাম। তবুও তোরা মন খারাপ করে আছিস? দেখি সবগুলো ছাড় তো, কি হলো ছাড়বিনা? সবগুলো সোজা হয়ে দাড়া বলছি।
মাহতিমের এক আদেশে সবাই ওকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু তখনো ওরা নতমুখে দৃষ্টি উদাস করে রইলো। মাহতিম সবার উদ্দেশ্যে কঠোর রূপটা বজায় রেখে বললো,

– মা যতদিন পযর্ন্ত এখানে থাকতে চাইবে আমিও ততদিন পযর্ন্ত এখানে থাকবো। যেহেতু যাওয়া ক্যানসেল, এজন্য এখান থেকে সবগুলা বিদায় হ। যদি দেখছি মন খারাপ করে বসে আছিস, বেল্টের বারি একটাও নিচে পরবেনা। কথাগুলো ভালোমতো আমল করে চুপচাপ এখান থেকে যা।

কথাটুকু শেষ করতেই কোমর থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বেল্ট খুলতে উদ্যত হলো মাহতিম। এই দৃশ্য দেখে আর একটাও রুমে দাড়িয়ে থাকলো না, দুমদুম করে রুম থেকে ছুটে গেলে সবাই। মাহতিম একটানে বেল্ট খুলতেই ওদের ভীত অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হেসে দিলো। ভীতু,পাগল,বোকার দল। এভাবেও কিনা মন খারাপ করে যাওয়ার কথা শুনে।
বিকেলের দিকে সূর্যের আঁচটা কমে এলো। মাহতিম একটা কালো-সাদার চেক শার্ট পরে রুম থেকে বেরুলো। বাড়ির সবাই যেনো তরুণের জন্য খোশগল্পে মেতে উঠেছে। হৈচৈ কলরবের জমজমাট লাগছে আঙিনার চৌকিতে। বড়-ছোট সবাই থাকলেও কেবল একজন ছিলো না সেখানে। সকাল থেকেই দেখা হয়নি তার সাথে।

কোথায় আছে, কেমন আছে খোঁজ নেওয়া হয়নি এখনো। মাহতিম সদা-সর্বদার মতো নেভি ব্লু প্যান্টের দুই পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে সিড়ি দিয়ে নামলো। মাহতিম সবাইকে দেখতে পেলেও আঙিনার কেউই ওকে দেখতে পেলোনা। তরুণ সবাইকে নিয়ে গোল মজলিশ বসিয়েছে, সেখানে হরেক পদের নাস্তা সাজিয়ে সবাই আড্ডা দিতে বসে গেছে। ছোট থেকেই কোলাহল একটু কম পছন্দ মাহতিমের, সে চোখদুটো তীক্ষ্ণ করে সামিককে ইশারা করার জন্য ওর দিকে তাকালো। কিন্তু সামিক তো দূর, এদিকে তরুণের বশে কাবু হয়ে একটা কাজিনও ওর দিকে খেয়াল করলোনা। মাহতিম নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে যেই সেখান থেকে সরে যাবে ঠিক তখনই সে মাহদিকে দেখতে পেলো। দেখার সাথে-সাথেই খেলায় মত্ত মাহদিকে ডাক দিয়ে কাছে আনলো। পকেট থেকে ডান হাত বের করে মাহদির কাধে রেখে মাথা কিছুটা নিচে ঝুকাঁলো। মাহদির মাসুম চেহারার পানে সরল দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,

– একটা কাজ করবি? করলে তোকে অনেকগুলো চকলেট দিবো। আর যদি ঠিকমতো কাজ করিস তাহলে ফোনটাও সিওসি খেলার জন্য পাবি।
মাহদি এটা ভালো করেই জানে, মাহতিম ওকে সহজ কাজের জন্য ঘুষ দিতে চাইছেনা। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ, কঠিন এবং তুলনামূলক গোপনীয়। মাহদি তবুও ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে রাজি বুঝালো। মাহতিম কাঙ্ক্ষিত উত্তরটা পেয়ে মৃদ্যু হেসে ওর কাধে দুটা চপেটাঘাত করে বললো,
– সাব্বাশ, তাহলে এখুনি কাজে লেগে পরবি বুঝলি? যদি কথাটা হাওয়া হতে দেখি, তাহলে মাইর যে কোনদিক দিয়ে এসে কোনদিক দিয়ে পরবে টেরও পাবি না।
মাহদি কপাল কুঁচকে বিরক্ত মুখে বললো,
– ভাইয়া তুমি কাজের কথা না বলে মারের কথা বলছো কেনো? আমি কি কখনো মারের কাজ করেছি?
মাহতিম প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললো,
– না করিসনি। কিন্তু শোন, যেই কাজ করতে দিবো ওটা নিরিবিলি করবি। কাউকে জানতে দিবি না, ঠিকাছে? এখন শোন, এই বাড়ির মহাবলদকে চিনিস? বলদ হচ্ছে তোর মেহনূর আপু। ওই বলদটা এখন কোথায় আছে, কি করছে সেটা একটু চেক দিয়ে আমাকে বলে যা। সাবধান, বারবার বলতেছি কেউ যেনো না জানে। জানলে তোর চামড়া ছিলে শূলে চড়িয়ে দেবো।
মাহদি আরো কয়েক ধাপ বিরক্ত হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থায় বললো,

– আমি গরুও না, খাসীও না। আমার চামড়া না তুলে তুমি একটা বিয়ে করো।
ছোট মুখে বড় কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলো মাহতিম। আশ্চর্য হয়ে মাহদির গায়ে জোর এক ঘা বসাবে ওমনেই মাহদি দৌড় মেরে আঙিনা পেরিয়ে মেয়েদের দোতলার দিকে ছুটে গেলো। তিন সিড়িতে একসঙ্গে টপকে দ্রুত বারান্দা পেরিয়ে মেহনূরের রুমে ঢুকে গেলো। এরপর আর দেখতে পেলো না মাহতিম। চুপচাপ পা চালিয়ে সবার অগোচরে বাইরে চলে গেলো। মেহনূর বিছানায় শুয়ে ‘ শাপমোচন ‘ পড়ছিলো। রুমের ভেতর মাহদির আকস্মিক আগমনে বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দরজার দিকে তাকালো মেহনূর। মাহদি তখন হাঁপানো অবস্থায় জোরে-জোরে শ্বাস টানছিলো। এমন অপ্রতিভ অবস্থা দেখে মেহনূর বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে ধীরগতিতে বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে বসলো। বইটার ভেতর ফিতা টেনে সেটা বন্ধ করে পাশে রাখলো। তড়িৎবেগে মাহদির দিকে দুহাত বারিয়ে কাছে আসার জন্য ইশারা দিতেই মাহদি ফিচেল হেসে এক দমে ছুটে এলো। মেহনূরকে ঝপাং করে জাপটে ধরলে কোমরের কাটা জায়গাটা চিনচিন করে উঠলো মেহনূরের। তবুও ব্যথাটা হজম করে মাহদির পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,

– সারাটা দুপুরের মধ্যে একবারও আসলে না কেনো? তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম তো। ভেবেছিলাম তোমাকে ধরে-ধরে একটু বাইরে যেয়ে ঘুরে আসবো। কিন্তু তুমি আর এলেই না।
মাহদি আরো শক্ত করে মেহনূরের গলা জড়িয়ে ধরলো। মেহনূর দফায়-দফায় কাটা জায়গায় ব্যথা পেলেও দূরে সরালো না মাহদিকে। মাহদি কঠোরভাবে জাপটে ধরে অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,
– মনে ছিলো না আপু। তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো? আমি নিচে একটু খেলছিলাম। সবাই বললো তুমি নাকি অসুস্থ, এজন্য আম্মুও তোমার কাছে আসতে দিলো না।
মাহদির কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো মেহনূর। মাহদিকে ছেড়ে দিয়ে ওর গুলুমুলু গালদুটোয় নরম হাত রেখে বললো,
– আমি অসুস্থ না মাহদি। সামান্য একটু কেটে গেছে, এজন্য আমি হাঁটতে পারিনা। মানে হাঁটার সময় একটু কষ্ট হয়।
মাহদি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো মেহনূরের দিকে। মেহনূরের মুখটা যেনো জ্বরের পর শুকিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কোমরের কাটাও গভীরভাবে কেটেছে। নিষ্পাপ মাহদির মনটা যেনো সঙ্গে-সঙ্গে বিষণ্ণ করুণায় ক্ষুণ্ণ হলো। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নম্র কন্ঠে বললো,

– আপু, তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও। তোমাকে এমন দেখলে ভালো লাগেনা। তুমি আমাকে সেদিনের মতো আমভর্তা বানিয়ে খাওয়াবে, আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে আপু। আপু তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও।
মেহনূর কেমন যেনো নাড়া খেলো ওর কথায়। ছোট্ট মনটা যেনো আকুতিতে জানান দিচ্ছিলো, মেহনূরের জন্য সে হৃদয়াক্রান্ত। মেহনূর কিছু না বলে মাহদির গালটা ধরে কপালে চুমু খেলো। ওর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতেই আচমকা মনেহলো মাহদির কপালটা একদম মাহতিমের মতো, দুই ভাইয়ের চোখদুটোও একইরকম স্বচ্ছ। মাহতিমের চুলগুলো জেলের কারনে সেট করা থাকে, অপরদিকে মাহদির চুলগুলো বাতাসের মৃদ্যু ঝাপটায় উড়তে থাকে। মাহদির হাত টেনে পাশে বসালো মেহনূর। বালিশের কাছে নৌকাডুবি, পারাপার, বাবলি, চন্দ্রনাথ সবগুলো বই সরাতে ব্যস্ত হলে হঠাৎ কথা জুড়ে দিলো মাহদি,

– আপু, তুমি আমাদের বাসায় যাবে? আমাদের বাসায় যদি যাও, তাহলে ভাইয়াকে বলে অনেকগুলো বই তোমাকে কিনে দিবো। আমাদের সাথে যাবে?
মেহনূর ব্যস্ত ভঙ্গিতে বই গুছাঁতেই হাসি দিয়ে বলে,
– তাই? তোমাদের বাসায় গেলে অনেক বই কিনে দিবে?
মাহদি চটপট মেজাজে প্রফুল্ল সুরে বলে,
– তুমি চাইলে তো দিবোই। তাছাড়া জানো, ভাইয়ার রুমে আমার ঢুকতে ইচ্ছে করেনা। কি বিশ্রী যে করে রাখে।
মেহনূর এই কথা শুনে সৌজন্যতার খাতিরে প্রশ্ন করে,
– কেনো?
মাহদি মুখ তেতো করে বলে,

– ভাইয়ার রুমটা যতোসব হাবিজাবি জিনিসে ভরা। ট্রেডমিল, ডাম্বেল, টায়ার, বক্সিং জিনিস দিয়ে এলোমেলো থাকে। কেউ যদি ওইসব ধরতে যায় ভাইয়া যা বকুনি লাগায় না, কেউ আর দ্বিতীয়বার ভাঈয়ার রুমে যায়না।
মেহনূর বইগুলো খাটের পাশে টেবিলের উপর রাখতেই বললো,
– ওহ্,
মাহদি এখানে থামলো না। সে আরো কথা যুক্ত করে বাচালের মতোই বলতে লাগলো। এদিকে মাহতিম উঠানে অপেক্ষা করতে-করতে শেষমেশ জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সন্ধ্যার আধারটা ঘন করে নামলে তরুণের সভা যেনো নামাজের উছিলায় ভেঙ্গে গেলো। সেদিন আর দেখা-সাক্ষাৎ হলোনা ওই অসভ্য পুরুষটার সাথে। স্বস্তির সাথে নিশ্বাস ছেড়ে সুরাইয়ার রুমে ঘুমালো মেহনূর। সুরাইয়ার সাথে রুমের বদলটা সবার অজান্তে করে ফেললো। এদিকে রাতেরবেলা সুরাইয়া এসে মেহনূরের রুমে ঘুমালো।

পরদিন সকালে নাস্তার পর্ব সারতেই মাহতিম আঙিনার এসে বেতের চেয়ার-টেবিলে বসলো। সঙ্গে ছিলো তৌফ, সিয়াম ও সৌভিকও। কিন্তু অনতিদূরে হুট করে তরুণের উদয় হলে মাহতিম তখন মোবাইল নিয়ে কিছু একটা করছিলো, কিন্তু সৌভিকের কনুই গুতা খেয়ে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকালো মাহতিম। সৌভিকের মুখের অবস্থা এমন ছিলো যেনো, জলের ডলফিন ডাঙায় উঠে কোমর দুলিয়ে নাচছে, আর এই বিরল দৃশ্য দেখে সৌভিক হাবার মতো আশ্চর্য হয়ে গেছে। মাহতিম ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে পেছনে তাকালে বজ্রপাতের মতো আহত হলো ঠিকই কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসলো, হাতে আবার আগের মতো মোবাইল নিয়ে কাজে মনোযোগ দিলো। তরুণের পেছনে শানাজ,সাবা, সুরাইয়ার পাশাপাশি মেহনূরও যেনো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিচে নামছিলো। এটুকু দৃশ্য দেখে মাথা খারাপ হয়ে সিয়ামের। তৎক্ষণাৎ মাহতিমের হাতটা শক্ত করে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

– মামা, এইটা কি দেখতেছি? শা*লারপুত আসতে-না-আসতেই এগ্লা কি করতাছে? কিরে মাহতিম? তোরে তো কিছু বলতেছি! মামা তুই কি রিয়েক্ট করাও কি ভুলে গেলি?
মাহতিম নিজের হাত থেকে সিয়ামের হাতটা সরিয়ে দিলো। বেপরোয়া ভঙ্গিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– যেটা মন চায় ওইটা করুক। তুই কোনোদিকে ধ্যান দিবি না। তোর তো ওখানে কাজ নেই, তুই রাম-ছাগলের মতো তাকিয়ে আছিস কেন?
সিয়াম এবার রূঢ় ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– রাম-ছাগল যে তোমার পল্ট্রির মুরগীর পিছে পরছে এইটা তুমি চোখে দেখো না?
মাহতিম চট করে ওর দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,

– কার? আমার ?
সিয়াম দাঁত খিচিমিচি করে কঠিন উত্তর দিবে পাশ থেকে তৌফ এসে যুক্ত হলো,
– বন্ধু, সময় থাকতে মুরগীটারে বুকের মধ্যে তুলে ফ্যাল। অন্য কেউ কোলে তুলে ফেললে এরপর ‘ হায়হায় পরান-পরান ‘ করলে লাভ হইবো না।
এমন গাজাখুরি মার্কা কথা শুনে মাহতিমের হাতটা পিটানোর জন্য কাপঁছে। দুজনের মুখ থেকে এমন নষ্টালজিক বার্তা শুনে চোখমুখ কুঁচকে আসছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেখান থেকে উঠে গেলো মাহতিম। তৌফরা হতভাগার মতো নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনো উপায় ঠাহর করতে পারলোনা।

নিশিরাত চলছে। চারপাশ নিঃশব্দে ছেয়ে গেছে। আকাশে যেনো রুটির মতো চাঁদ উঠেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই, সুক্ষ আওয়াজও নেই কোথাও। হুট করে চারধার বীভৎস অন্ধকার করে বিদ্যুৎ চলে গেলত আজ। মেহনূরের চোখের সামনে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার চলে আসলো, সে উপন্যাসের বইটা রোমান্ঞ্চকর অনুভূতিতে পড়ছিলো। কিন্তু অন্ধকারের জন্য বইটা বন্ধ করে রেখে দিলো সে। শোয়া থেকে উঠৈ টেবিলের ড্রয়ার খুলে মোম বের করলো। দিয়াশলাইয়ের আগুনে মোমটা জ্বালিয়ে বিছানায় উঠলো, জানালার দুই দ্বার খুলে দিতেই হঠাৎ খট করে দরজার দিকে শব্দ হলো। মেহনূর সাথে-সাথে পিছনে ফিরে অদ্ভুত শব্দটার দিকে তাকালো।

কই দরজা তো বন্ধই, তাহলে দরজা ধাক্কার মতো শব্দ হলো কেনো? শব্দটা বাইরে থেকে এসেছে ভেবে মেহনূর লম্বা কেশগুলো খোপার জন্য পেঁচাতে লাগলো। কিন্তু তখনই ধাম করে দরজার দুই দ্বার খুলে প্রবেশ করলো মাহতিম! আকস্মিক এমন তীব্র শব্দ শুনে হকচকিয়ে যায় মেহনূর! শিউরে কেঁপে উঠতেই সঙ্গে-সঙ্গে বিছানায় দুহাতে ভর দিয়ে পিছিয়ে যায় জানালার দিকে। মাহতিমকে দেখে যেনো কলিজা শুদ্ধো লাফিয়ে উঠেছে! ধড়ফড়-ধড়ফড় করে বুকের ভেতর আন্দোলন চলছে! প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় কাঁপতে-কাঁপতে মেহনূর ধীরগতিতে জানালার দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির সোনালী আলোয় মাহতিমের লম্বা উচ্চতার পেশিবহুল শরীরটা ভয়ঙ্কর লাগছে।

দেখে মনে হচ্ছে অতর্কিত হামলার জন্য এগিয়ে আসছে। কালরাত যে ঢপ মেরে সুরাইয়ার রুমে শুয়েছিলো, আজ রাতে যেনো সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এসেছে। কিন্তু আজ যে দ্বিতীয়বারের মতো রুম বদলে সাবার রুমে শুয়েছে সেই তথ্য কিভাবে জানলো মাহতিম? মেহনূর ওই দূধর্ষ মূহুর্তে কোনোকিছুই ভাবতে পারছিলোনা। মাথার ভেতর বুদ্ধির চাকা যেনো অকেজো হয়ে গিয়েছিলো। মাহতিম বিছানার কাছে এসে মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রেখে টেবিলের দিকে বাড়ালো। মেহনূর ভয়ে সংকুচিত হয়ে দুহাঁটু তুলে কুকড়ে বসেছিলো। ডানহাতে জলন্ত মোমবাতি তুলে নিলো মাহতিম, বিছানায় হাঁটু রেখে ওর দিকে শক্ত মুখে এগুতে লাগলো। একপর্যায়ে মেহনূরের নিকটে ঠিক একহাত দূরত্ব রেখে বসলো। জলন্ত মোমবাতির আলোয় দুজনের চোখদুটো দুজনের দিকে আটকে গেলো। একজনের চোখে ভীষণ ভয়, আরেকজনের চোখে তখন শক্ত চাহনির দহন দেখা যাচ্ছিলো।

মেহনূরের সম্পূর্ণ মুখের লাবণ্যময় শুভ্রতা, ঘন পাপড়ির সেই কালোমনির মায়াপূর্ণ চোখদুটো, কমলাভ ঠোঁটের থরথর কাপুঁনি, নাকের শেষভাগে ঘামের সুক্ষ্ম অসংখ্য কনা, মাথার কেশবহুল মোটা খোপা, সবই একে-একে সরুদৃষ্টিতে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলো মাহতিম। আবারও কয়েক ধাপ এগিয়ে স্বল্পতম দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে মেহনূরের একদম নিকটে এসে পরলো। ভয়ে অনবরত হিড়িকের মতো কাঁপতেই চোখ খিচুনি মেরে ডানে মুখ ফেরালো মেহনূর। দুহাতের মুঠোতে শাড়ির আচঁল খাবলে কাঁপতে লাগলো ও।

মেহনূরের গালের কাছে এসে খুব কৌশলের সাথে মোমবাতিটা ফুঁ মেরে নিভিয়ে দিলো মাহতিম। রুমটা আবারও পৈশাচিক অন্ধকারে ঢেকে গেলো। মেহনূরের ভয়ার্ত নিশ্বাসের প্রতিটি ফিসফাস শব্দ যেনো মাহতিমের কর্ণধারে প্রবেশ করছিলো। মাহতিম আন্দাজের উপর ভিত্তি করে মেহনূরের কোলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। ভয়ে হিম হয়ে যাওয়া মেহনূরের হাতটা উষ্ণতার সাথে ধরলো মাহতিম। ওর ডানহাতের মুঠো থেকে শাড়ির আচঁলটুকু টেনে বের করলো সে। খুব সাবধানে ঠান্ডা আঙ্গুলের মাঝে উষ্ণ আঙ্গুল ঢুকিয়ে চট করে আঁকড়ে ধরলো হাতটা। আবারও সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো মেহনূরের, সশরীরে কেঁপে উঠলো তীব্ররূপে। মাহতিম কেনো এসেছে, কি করতে চাইছে ভাবতেও পারলো না মেহনূর।

মোমবাতি নিভানোর পর কেবল তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। সেই তপ্ত নিশ্বাসের প্রতিটা ঝাপটা মেহনূরের গালের উপর আছড়ে পরছিলো। মেহনূর বিমূঢ় অবস্থায় বসে থাকলেও মাহতিমের হাতের মুঠোয় ছোট্ট নরম হাতটা শক্ত করে আবদ্ধ ছিলো। মাহতিম কি করতে চাইছে এখনো সেটা অস্পষ্ট, তাই মেহনূর পরিস্থিতির উপর নির্ভর হয়ে চুপচাপ সব সহ্য করছিলোম এমনি সময় হঠাৎ করে মাহতিম নিরবতা চ্ছিন্ন করে একটুখানি কাশলো। কোমল আর্দ্র নরম কন্ঠে অসহায় সুরে বললো,

– আমি যে অসভ্য সেটা আরেকটু প্রমাণ করলাম মেহনূর। তবে সেদিন রাতে এমনই করে তুমি আমার হাতটা ধরতে চেয়েছিলে। সেটা ঘুমের ঘোরেই হোক বা অন্য কোনো কারনে, তুমি কিন্তু আমার হাতে চুমু খেয়েছিলে। আমি যেহেতু অসভ্য, তাই সেটার শোধবোধ নিশ্চয়ই করতে পারতাম। কিন্তু করিনি।
মাহতিম কথাটুকু শেষ করে মেহনূরের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামলো। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মেহনূর ঝরঝর করে কেদেঁ উঠলো, কিন্তু শব্দ হলোনা একটুও। মেহনূরের কান্নার শব্দ যখন হেচকির সুর তুললো, তখন ওই মূহুর্তে আকড়ে ধরা হাতটা মাহতিম ধীরগতিতে উপরে উঠালো। অন্ধকারে মুখও দেখা যাচ্ছিলোনা মাহতিমের, সেই অবস্থায় হঠাৎ করে হাতের উল্টোপিঠে নরম ওষ্ঠের উষ্ণছোঁয়া অনুভব করলো মেহনূর। অস্ফুট শব্দ করে তুমুল আকারে কেঁপে উঠলো সে। কিন্তু মাহতিম সেটা দমন করে মৃদ্যুকন্ঠে বলে উঠলো,

– হিসাব সমান-সমান হলো। সবসময় একটা জিনিস মনে রাখবে, নিজেকে এতোটাও বেকুব বানিয়েও না, যেটা তোমার জন্য ক্ষতির কারন হবে। আজ শুধু একারনেই এসেছি, মলমটা দিয়েছো কিনা সেটা দেখতে। কিন্তু আফসোস, ভংচং করে সেটা আর লাগাওনি। যাইহোক পরবর্তীতে ইনফেকশন হলে শহরে আসার অনুরোধ রইলো। আর পারলে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো ভুলার চেষ্টা করো। আজকের পর থেকে না তুমি আমায় চিনো, না আমি তোমায় চিনি। পূর্বে যেভাবে ছিলে, সেভাবেই যেনো সব চলতে থাকে। আমি মাত্র কিছুদিনের জন্যই আছি, তাই কষ্ট করে আমার সামনে থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখার চেষ্টা করো।

কথা শেষ করতেই হাত ছেড়ে দিলো মাহতিম। সেটা এমনভাবে ছেড়ে দিলো, সেটা যেনো ছুঁড়ে মারার মতো ঘটনা হলো। বিছানা থেকে নেমেই টেবিলের উপর মোমবাতি রেখে দিলো। পাশ থেকে দিয়াশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে চুপচাপ ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে চলে গেলো। একবারও পিছু ফিরে তাকালোনা মেহনূরের দিকে। ফিরেও দেখলোনা মেহনূর কতটা আশ্চর্য হয়ে হকচকিয়ে গিয়েছে। হতভম্ব মেহনূর তার হাতটা ঘুরিয়ে উল্টোপিঠের দিকে তাকালো, নাক টেনে বাম হাতের তালুতে চোখ মুছে সেই ওষ্ঠ স্পর্শ করা জায়গাটা দেখতে লাগলো। আজ এবং এই প্রথম বোধহয় পুরুষের স্পর্শ পেলো মেহনূর,হাতের উল্টোদিকটা অনিমেষ নয়নে দেখতে থাকলে আচমকা পুরো রুম আলোকিত হয়ে কারেন্ট চলে এলো। ভেজা চোখে রুমের চারপাশ দেখতেই মনে হলো, এই অন্ধকার, এই কারেন্ট, এই নিস্তব্ধতা যেনো মাহতিমের ইচ্ছায়, স্বেচ্ছায়, ইশারায় হয়েছিলো। এতে যেনো কাকতলীয় ঘটনা ছিলোনা।

সকালের নির্মল পরিবেশটা সূর্যের তীব্রতায় দুপুরের দাপটে পরিণত হলো। বাড়িতে আজ বড় করে খাওয়া-দাওয়ার ধুম লেগে গেলো। শুরু হলো রান্নার জন্য মহিলাদের দৌড়াদৌড়ি, পানি আনার জন্য মেয়েদের ছুটাছুটি, সবজি কুটার জন্য সকলের হাতাহাতি একসঙ্গে শুরু হলো সকাল থেকে।সুজলা, শেফালী, মাহমুদা রান্নাঘরে গিয়ে সব কাজ দেখতে লাগলো, মারজা এসে যুক্ত হলো ধনিয়াপাতা বাছার কাজে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজের একটা এসে পরলো শেফালীর কাধে। কচুর লতি কাটার মতো ভয়াবহ চুলকানির কাজটা শেফালীর করতে হবে। উপায় ঠাহর করতে না পেরে ডালাভর্তি কচু এনে আঙিনায় এসে বসলো তখন। এদিকে শানাজ, সাবা, সুরাইয়া, মেহনূর উঠানের দিকে বড়ই পারার কাজে ছিলো, হঠাৎ সেদিকে চোখ পরতেই শেফালী এক হাঁক দিয়ে সবগুলাকে আঙিনায় এনে হাজির করলো। শানাজ কচুর ডালা দেখেই বুঝে যায় মেজো মা এখানে খাটাতে ডেকেছে। শেফালী সবগুলার দিকে তিরিক্ষি দৃষ্টি ছুড়ঁলে শেষমেশ প্রতিশোধের মেজাজটা মেহনূরের উপর ফলিয়ে বললো,

– এ্যাই ঢঙি, এইদিকে আয়। এই পিড়িতে বসতে পারবিনা তুই? নাকি কোমর নিয়া টাফালিং করবি?
মেহনূরের ঘা-টা সকাল থেকেই শুকিয়ে আসছে, কিন্তু বেশি চাপের কাজ করলে জায়গাটা ফের কাঁচা হয়ে যাবে। মেহনূরের ওমন নিরবতার দেখে ধমকে উঠলো শেফালী। একসঙ্গে চারবোনই প্রচণ্ডরূপে ভয়ে চমকে উঠলো। মুখ কালো করে চোখ নিচু করে সবাই কাঁচুমাচু করছিলো। কিন্তু শেফালী সেটা ভঙ্গ করে হাত ধরে টেনে মেহনূরকে পিড়িতে বসিয়ে দিলো। রান্নাঘরের দিকে একপলক দৃষ্টি দিয়ে মাথার ঘোমটা আরেকটু মাথায় টেনে এবার বাকি তিনজনের দিকে ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো।

কপাল কুঁচকে এমন গালি দিলো কেউ আর দাড়ালো সেখানে। মেহনূর জানে, সে যদি এই মূহুর্তে একটা টু শব্দ উচ্চারণ করে তাহলে ঠাস করে চড় মারতেও এই মহিলা দেরি করবেনা। বাড়িতে সৌভিক, নীতিরা গ্রাম দেখতে মাইক্রো নিয়ে বেরিয়েছে। কাছাকাছি সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে কিছুসময়ের জন্য বাইরে গেছে। মাহতিমও জিপ নিয়ে কিছু সময়ের জন্য ভিজিটিং স্পট দেখতে গিয়েছে। এদিকে ঘন্টার-পর-ঘন্টা কচু কেটে হাত কালো হয়ে যায় ওর, মারাত্মক চুলকাতে শুরু করে হাতের তালু। একদিকে হাত চুলকাতে থাকে, অন্যদিকে কাত থাকে কচু। দূর থেকে শানাজ, সাবা সব দেখলেও মেজো মার ভয়ে একপাও এগুতে পারছেনা, অপরদিকে সুরাইয়া শেফালীর সাথে চৌকিতে বসে এ্যালোভেরার জেল বের করছে।

ফেসপ্যাকের জন্য চন্দন গুড়া, মুলতানি মাটি মিক্স করে সেখানে এ্যালোভেরার জেল নিংড়ে রাখছে। হঠাৎ আরো উপাদান মিশানোর জন্য শেফালী দ্রুত মেয়েকে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলো। ঠিক ওইমূহুর্তেই জিপের শব্দ তুলে মাহতিম এসে ভিড়লো। কানে ফোন এঁটে পকেটে হাত গুঁজিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলো মাহতিম। মেহনূর যে আঙিনার মাঝখানে বসে কচু কাটার যন্ত্রণায় হাঁশফাস করছিলো সেটা একপলকের জন্যও দৃষ্টিগোচর হলোনা মাহতিমের। দ্রুতপায়ে আঙিনা পেরিয়ে সোজা সিড়ি ধরে উপরে উঠলো, ওই অবস্থাতেই রুমের দরজা খুলে সেটা ভিড়িয়ে দিলো। মেহনূর আড়চোখে মাহতিমের কীর্তিকলাপ পর্যবেক্ষণ করলেও এই মূহুর্তে বীভৎস জ্বালায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেলো। কাজ শেষে পুরো হাত কালো কুচকুচে হয়ে তীব্র চুলকানিতে বিষিয়ে উঠলো। এদিকে কলপাড়ে যেয়ে নিরব চিত্তে হাত ধুচ্ছে মেহনূর। সাবা কল চেপে দিলে শানাজ মগ কাত করে ওর হাতে পানি ঢালছে। শানাজ রাগে গজগজ করতেই ক্ষীপ্র সুরে বলে উঠে,

– মেজো মা এই কাজটা ইচ্ছে করে করলো। সে ঠিকই জানতো তোর অবস্থা এখন খারাপ, আর তুই কচু কাটার জন্য উপযোগী না। এই বদমাইশ মহিলা আমাদের শান্তি দিলো না মেহনূর, একটুও শান্তি দিলো না। কাকা যে কেমন বজ্জাত মহিলাকে বিয়ে করেছে সেটা যদি এক ইঞ্চি কাউকে দেখাতে পারতাম? পোড়া কপাল! কেউ জানেও না এই শয়তান মহিলা আমাদের তিনজনকে খাটিয়ে মারছে। অথচ দ্যাখ, নিজের মেয়েকে রূপচর্চা করাচ্ছে। ফালতু মহিলার জায়গায় এখন সুরাইয়ার উপর জিদ উঠে! কষিয়ে যদি মারে পারতাম? হারামিটা কেমন পল্টি মেরে মায়ের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেলো। এমন বোন কিভাবে জুটলো রে মেহনূর? আমাদের সাথে থাকার পরও এতোটা নির্লজ্জ, বেহায়া, স্বার্থপর হয়েছে সেটা মুখে বলতেও লজ্জা করে। দেখি তুই উঠ, আর হাত ডলিস না।
শানাজ মগটা সাবার হাতে দিয়ে কলপাড়ের টুল থেকে মেহনূরকে দাড় করিয়ে দিলো। দুবোন একসাথে যখন ভেতরে ঢুকে রুমের দিকে গেলো, তখন শানাজ রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে অবাক হয়ে দাড়িয়ে পরলো। চৌকির কাছে ফেসপ্যাকের কাছে মাহতিমকে কি যেনো করতে দেখলো। শানাজ কৌতুহল হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,

– ভাইয়া? আপনি ওটা কি করছেন?
মাহতিম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফেসপ্যাকের বাটিটা নাকের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। দৃষ্টি তুলে শানাজের দিকে তাকিয়ে ফেসপ্যাকের বাটি দেখিয়ে বললো,
– এগুলো কি জিনিস সেটাই বুঝার চেষ্টা করছি। আচ্ছা এগুলো কি কোনো মশলা? রান্নার কাজে দিবে?
ফেসপ্যাক নিয়ে এমন উটকো প্রশ্ন শুনে মৃদ্যুভঙ্গিতে হেসে দেয় শানাজ। এগিয়ে এসে মাহতিমের উদ্দেশ্য বলে উঠে,
– ভাইয়া এগুলো রূপচর্চার জিনিস। আপনি চাইলে আপনিও দিতে পারেন। তবে আপনার না দিলেই ভালো হবে। আপনিতো এমনেতেই হ্যান্ডসাম।

মাহতিমও সৌজন্যের সঙ্গে হেসে দিয়ে ফেসপ্যাকের বাটিটা চৌকির উপর রেখে দিলো। শানাজও রান্নাঘর থেকে লেবুর টুকরো নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। কিন্তু বিপত্তি শুরু হলো বিশ মিনিট পর। এক তুমুল চিৎকার দিয়ে বাড়িঘরের নিরবতা ক্ষুণ্ণ হয়ে গেলো। হাউমাউ করে চিৎকার করতেই দাপাদাপির শব্দ শোনা গেলো নিচ থেকে! কেউ গলা ফাটিয়ে ‘ মা, ও মাগো, বাঁচাও ‘ বলে আহাজারি করছে। শানাজ,সাবা, মেহনূর তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি ধরে নিচে নামে। কোমরের ব্যথার জন্য আবারও জায়গাটা চিনচিন করে উঠলে মেহনূর সেটা দাঁতে কামড়ে নিচে এসে হাজির হয়।

এসেই দেখে শেফালী পাগলের মতো কপাল চাপড়ে ‘ হায় হায় ‘ করছে। অন্যদিকে সুরাইয়া মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে কান্নারত অবস্থায় দুগাল চুলকিয়ে যাচ্ছে। সুজলা এসেই ভেজা আচঁল দিয়ে ওর ফেসপ্যাক তুলে চুপ করার জন্য সান্ত্বনা দিচ্ছে। মাহমুদা চটজলদি কলপাড় থেকে ঠান্ডা পানি এনে মুখ ধুয়াতে থাকে। মারজা দ্রুত শেফালীকে ঠান্ডা হতে বলে। শানাজ এতোটা আশ্চর্য হয়ে যায় সে আর কিছুই বলতে পারলোনা।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৭+৮

সাবাও মুখে দুহাত দিয়ে বিস্ফোরণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পুরো ঘটনা নিয়ে মন খচখচ করতে থাকলো। কি মনে করে যেনো, অপজিট দোতলায় তাকালো, ওমনেই দেখতে পেলো বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত ফেলে মাহতিম শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টিতে চোখাচোখি হতেই মাহতিম অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হেসে দিলো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১১+১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here