মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৪

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৪
ইয়াসমিন খন্দকার

অভিক সুনীতিকে নিয়ে বাসায় ফেরে। অতঃপর দুজনে কিছু সময় একসাথে পার করে। দুজনের মধ্যে ভাব হয়েছে এটা দেখে আহসান চৌধুরী এবং রাহেলা খাতুনও স্বস্তি পান।
অভিক সুনীতির সাথে কথাই বলছিল এমন সময় তার ফোন একটি কল আসে। অভিক ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বলে৷ কথা বলা শেষ হতেই অভিক সুনীতিকে বলে,”তোমার মা-বাবার খু*নির শাস্তি পাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র নীতি। আমি ওর সম্ভাব্য লোকেশন জানতে পেরেছি৷ এবার আর ও আমার থেকে পালিয়ে বেড়াতে পারবে না।”

সুনীতি ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে বলে,”ঐ জানোয়ারটাকে একদম উচিৎ শিক্ষা দেবেন। নাহলে যে, আমার মা-বাবার অতৃপ্ত আত্মা কিছুতেই শান্তি পাবে না।”
“তুমি চিন্তা করো না। আমি ওকে সেই শাস্তি দেব যেটা ও ডিজার্ভ করে। আইনের ভরসায় শুধুমাত্র বসে থাকব না। নিজের হাতে ওকে শাস্তি দেব তাও তোমার সম্মুখে। তুমি সেটা দেখে আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করিও।”
“আমি অপেক্ষায় থাকব এই আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করার জন্য। আমার মা-বাবাকে ঐ মন্টু কত কষ্ট দিয়েই না মে*রেছে। তার সবটা যেন ও ফিরে পায়। ওর এমন অবস্থা করবে যা দেখে ওর নিজের আত্মাও ভয় পাবে! মৃত্যু তো অনেক স্বাভাবিক শাস্তি। ওর যেন মৃত্যুর থেকেও বড় কোন শাস্তি হয়।”
“এমনটাই হবে। তুমি চিন্তা করিও না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মন্টু ঢাকার অদূরে একটা বস্তি এলাকায় লুকিয়ে আছে নকল পরিচয়ে। এখানে থেকে মূলত সে সবসময় টোকাইয়ের ছদ্মবেশে ঘুরছে তাই তাকে কেউ চিনতেও পারছে না। তবে মন্টু এতটা কাচা খেলোয়াড় নয়। বেশ ক’দিন থেকেই সে লক্ষ্য করছে এই বস্তির আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক ব্যক্তির আনাগোনা। যারা বস্তির বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ধূর্ত মন্টু সহজেই বুঝতে পারে তাকে খোঁজার জন্যই এত আয়োজন। কিন্তু মন্টু তো এত সহজে ধরা দিবে না। মন্টু একটা শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে বলে,”আমার কাছে সম্পূর্ণরূপে পৌঁছানোর আগেই আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে যাব তোমাদের ত্রাস হয়ে। শুধু আমার পরবর্তী চাল দেখার জন্য অপেক্ষা করো।”

বলেই মন্টু গায়ে একটি শাল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। বস্তি থেকে বেরোনোর সময় আজ দূর থেকে অভিকের মুখোমুখি হয়৷ অভিক মন্টুকে দেখতে পাওয়ার আগেই সে লুকিয়ে পড়ে। ফলে অভিকের দৃষ্টিগোচর হয় না মন্টু। অভিক খোঁজ করতে করতে বস্তির ভিতরে ঢুকে পড়ে। মন্টু লুকিয়ে থেকে অভিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,”টাইমিং এর একটু গণ্ডগোল করে ফেললে মেজর। তোমার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। তোমাকে আমি এতটা কাচা খেলোয়াড় খাবিনি। তোমার চাল তো বিফলে গেল। এবার আমার চাল দেখার জন্য অপেক্ষা করো। কিভাবে এক চালেই চেকমেট করে দেই। আমি জানি, খুব বেশিদিন হয়তো আর এভাবে পালিয়ে বেরাতে পারব না। তবে ধরা খাওয়ার আগে যার জন্য আমার আজ এই দশা মানে ঐ সুনীতির একটা ব্যবস্থা তো আমি করবোই। আমি জেলের ঘানি টানব আর ঐ সুনীতি সুখে সংসার করবে এমনটা তো হতে পারে না।”

এটা বলেই মন্টু বেরিয়ে পড়ে বস্তির বাইরে। একটা রিক্সায় উঠে পড়ে রওনা দেয় কোথাও একটা।
সুনীতি বাসাতেই নিজের রুমে বসেছিল। কয়েক ঘন্টা আগে অভিকের ফোনে একটা কল আসায় সে হঠাৎ বেরিয়ে যায়। সুনীতির বেশ উদ্বিগ্ন লাগছিল অভিকের জন্য। অভিককে সুনীতি ফোন করে চলেছে অনেকক্ষণ থেকে কিন্তু অভিক ফোনটাও রিসিভ করছে না। সব মিলিয়ে তার চিন্তা বাড়ছে অভিকের জন্য।

সুনীতি অস্থির হয়ে ঘরে পায়চারি করছিল। এরমধ্যে অভিকের ফোনও সুইচ স্টপ বলছে। সুনীতি আর এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। এবার সে ভাবে অভিকের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। যেই না সুনীতি বের হতে যাবে এমন সময় তার ফোনে একটি ফোনকল আসে। সুনীতি ফোনটা রিসিভ করে বলে,”হ্যালো, কে বলছেন?”
বিপরীত দিক থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে,”আপনি কি মেজর অভিকের বাড়ির লোক বলছেন?”
“হ্যাঁ, আমি মেজর অভিকের স্ত্রী বলছি। আপনি কে?”
সুনীতির মন হঠাৎ কু ডেকে ওঠে। এমনিই অভিককে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন সময় হঠাৎ কেউ ফোন দিয়ে অভিকের খোঁজ নিচ্ছে!

“আসলে মেজর অভিক তো একটা সিরিয়াস এক্সিডেন্ট করেছেন। আমরা কয়েক জন মিলে ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ওনার ফোনটাও কাজ করছে না। জ্ঞান হারানোর আগে অনেক কষ্টে এই নাম্বারটা দিল। তাই আমি কল করলাম।। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিটি হাসপাতালে চলে আসুন।”
এহেন কথা শুনে সুনীতি যেন আকাশ থেকে পড়ে। তার পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়। অভিকের চেহারাটা মুখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন যে তার আপন বলতে শুধু অভিকই আসে। এদিকে আহসান চৌধুরী এবং রাহেলা খাতুনও আজ বাসায় নেই। আহসান চৌধুরীর এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গেছেন। সুনীতি ভীষণ অসহায় বোধ করে। সে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সিটি হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
এদিকে মন্টু তার ভাড়া করা একটা গুণ্ডার কাধে হাত রেখে বলে,”সাব্বাস, কি সুন্দর অভিনয় করলি। প্ল্যান তাহলে সাকসেসফুল।”

বলেই মন্টু হাসতে থাকে। মন্টু জানত, ঐ বস্তি এলাকায় প্রবেশ করলে ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা হবে। তাই সুনীতি নিশ্চয়ই অভিককে কল দিলে তাকে ফোনে পাবে না। আর এই জিনিসটার সদ্ব্যবহার করেই এমন একটা ফন্দি এঁটে ফেলল সে। এসব ভেবেই একটা তীক্ষ্ণ হাসি দিয়ে বলে,”তুমি আমার থেকে অনেক পালিয়ে বেরিয়েছ সুনীতি। কিন্তু এবার আর পালানোর কোন পথ খুঁজে পাবে না। এবার তোমাকে আমার কাছে ধরা দিতেই হবে। ধরা না দিয়ে যাবে কোথায়?!”

সুনীতি হাফাতে হাফাতে সিটি হাসপাতালের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। সিটি হাসপাতাল মোটামুটি নিরবিলি একটা স্থানে অবস্থিত। হাসপাতাল ছাড়া আশেপাশে তেমন কোন বাড়িঘর বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। শহরের অদূরে অবস্থিত এই স্থানটা তাই বেশিরভাগ সময় জনশূন্যই থাকে। শুধুমাত্র হাসপাতালের সামনে রোগী এবং স্বজনদের ভীড় থাকে।
সুনীতি হাসপাতালের সামনে গিয়ে সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে দেয়। আজকাল ভীষণ লোডশেডিং হচ্ছে তাই সন্ধ্যাবেলাতেই রাস্তা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে গেছে। সুনীতি ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

এমন সময় হঠাৎ বুঝতে পারে, কে বা কারা যেন তাকে ফলো করছে। সুনীতি ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরতেই আতকে ওঠে। কয়েকটা ছায়ামূর্তিকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সামনের দিকে দ্রুত পা চালায়। সামনে এগোতে এগোতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। এমন সময় কেউ পেছন থেকে তার মাথায় শক্ত একটা জিনিস দিয়ে আঘাত করে যার ফলে সুনীতি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মন্টু রড কাঁধে রেখে একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,”শেষপর্যন্ত তোমায় আবার বাগে পেলাম সুনীতি। এবার তোমার শেষ দেখে ছাড়ব। তোমার জন্য আমায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আগেরবার তো ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছিলে। যদিও তোমার মা-বাবা মারা গেছল কিন্তু তোমাকে জীবিত দেখে আমার পরিতৃপ্তি আসেনি। এবার এই শুভ কাজটাও সেরে নেই!”

এদিকে,
অভিক গোটা বস্তিতে খুঁজেও মন্টুর দেখা পেল না। কয়েক ঘন্টা ধরে পুরো বস্তি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন লাভ হয়নি। অভিক বস্তির বাইরে এসেই মুখ দিয়ে বিরক্তিতে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে বলল,”শেষ অব্দি কি তাহলে তীরে এসে তরী ডুবল?”

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৩

এরমধ্যে হঠাৎ করেই সুনীতির জন্য অভিকের চিন্তা হয়। তাই সুনীতির ফোনে কল লাগায়। কিন্তু ফোনটা রিং হলেও সুনীতি রিসিভ করে না। বস্তির ভেতরে নেটওয়ার্ক ছিল না জন্য এতক্ষণ অভিক সুনীতির খোঁজ নিতে পারেনি। এরইমধ্যে অভিকের ফোনে একটা ম্যাসেজ আছে যা দেখে সে ঘাবড়ে গিয়ে৷ তুমুল ক্রোধে বলে,”মন্টুর বাচ্চা! এটা তুই ঠিক করলি না। আমার নীতির গায়ে একটা আঁচড় পড়লে আমি তোকে ছিঁড়ে খাব।”

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৫