মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৭
ইয়াসমিন খন্দকার
অহনা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সে শপথ করে নিয়েছে কিছুতেই পাত্রপক্ষের সামনে যাবে না। সুনীতি অনেক কসরত করে কোনরকমে অহনাকে একটু সাজিয়ে দিয়ে বলল,”এরকম করে কোন লাভ নেই অহনা। তুই এমন জেদ করলে পাত্রপক্ষের সামনে তোর ফ্যামিলির মান-সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো তুই আজ পাত্রপক্ষের সামনে চল৷ এমনি দেখা-সাক্ষাৎ হোক। তারপর নাহয় তুই তোর ফ্যামিলিকে বুঝিয়ে না করে দিস। এদিকে আমিও নাহয় অভিকের সাথে কথা বলব। অভিক, আরাফাত ভাইকে সবটা জানাবে। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুই ঠিক বলছিস তো?”
“হ্যাঁ, রে বোকা। আমি ঠিক বলছি।”
“বেশ, শুধুমাত্র তুই বললি জন্য আমি মেনে নিলাম। তুই তোর কথাটা রাখিস।”
“আচ্ছা।”
অহনার মা হঠাৎ এসে সুনীতিকে তাড়া দিয়ে বলেন,”তুমি জলদি অহনাকে নিয়ে আসো। ছেলে পক্ষ চলে এসেছে।”
“আচ্ছা, আন্টি। আপনি যান। আমি অহনাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অহনার মা নিশ্চিত হয়ে চলে যায়। সুনীতি অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এই তুই শোন, পাত্রপক্ষের সামনে আবার এমন কীর্তি করিস না যাতে তারা অপমানিত বোধ করেন। ওদের সামনে একদম ভদ্র মেয়ে হয়ে বসে থাকবি।”
অহনা মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,”ভদ্র মেয়ে মাই ফুট! তুই শুধু দেখে যা, পাত্রপক্ষের সামনে আজ আমি এমন সার্কাস করব যে ওরা নিজেরাই বিয়ে ভেঙে দিয়ে চম্পক দেবে।”
“অহনা! তুই কিন্তু খবরদার এমন কিছু করবি না!”
অহনা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”আমার মতের বিরুদ্ধে কেউ আমার সাথে কিছু করতে চাইলে আমি এমনই করবো।”
সুনীতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। অতঃপর অহনাকে নিয়ে রওনা দেয় তাদের বাসার ড্রয়িংরুমের দিকে। ড্রয়িংরুমে যেতে যেতে সুনীতি আবারো অহনাকে বলে,”বোন, তুই প্লিজ একটি শান্ত থাকিস। কোন ভেজাল করিস না। আমার তোর মুখ-চোখ দেখে ভীষণ ভয় লাগছে।”
“তুই শুধু দেখে যা আমি কি কি করি।”
বলেই অহনা একটা অন্যরকম হাসি দেয়। সুনীতি বুঝতে পারে, সে যাই বলুক অহনা যা ভেবেছে তাই করবে। এজন্য সেও আর কথা বাড়ায় না।
সুনীতি অহনাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতেই অহনার মামা পাত্রপক্ষের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ঐ তো অহনা এসে গেছে। আয় মা এখানে এসে বস।”
অহনা তো তার মামার এহেন কথা শুনে একটুও খুশি হয়না। তবু মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। তখনো সে ছেলের দিকে তাকায় নি। অহনার মামা পাত্রপক্ষের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এই হলো অহনা, আমার ভাগ্নি। অহনা মা, ওনাদের সালাম দাও।”
অহনা সালাম দেয়ার জন্য পাত্রপক্ষের দিকে তাকাতেই হতবাক হয়ে যায়। বিস্ময়ে তার মুখ থ হয়ে যায়। এদিকে সুনীতিও তো পাত্রপক্ষকে দেখে পুরোই অবাক। কেননা, সেখানে আর কেউ নয় পাত্র হিসেবে বসে আছে আরাফাত। এদিকে অভিকও আরাফাতের পাশের স্থান দখল করে বসে আছে।
অহনা বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। আরাফাত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলে,”মুখটা বন্ধ করুন, ম্যাডাম। নাহলে তো মাছি ঢুকে যাবে।”
আরাফাতের মুখে এহেন কথা শুনে অহনা ভীষণ লজ্জা পায়। কোনরকমে সালাম দিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু তার বিস্ময় ভাব কখনো কাটেনি। এদিকে সুনীতিও অভিকের দিকে জিজ্ঞাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। অভিক ইশারা করে সুনীতিকে আশ্বস্ত করে যে, সে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলবে।
অহনা সোফায় বসতেই আরাফাতের মা আনোয়ারা বেগম বলে ওঠেন,”মাশাল্লাহ,মেয়েটা তো অনেক সুন্দর। আমার ওকে ছেলের বউ হিসেবে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তুমি কি বলো আরাফাতের বাবা?”
আরাফাতের বাবা শফিক ইসলাম বলেন,”আমার ছেলের পছন্দ একদম আমার মতোই সেরা। দেখো কি সুন্দর পরির মতো মেয়ে পছন্দ করেছে। আমাদের আর কষ্ট করে মেয়ে খুঁজতে হলো না।”
অহনা তো এসব কথা শুনে একদম লজ্জায় মিইয়ে যায়। অহনার মা অহনার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,”কিরে! খুব তো বলেছিলি বিয়েটা করবি না। এখন চুপ যে? আমি বলেছিলাম না, গুরুজনেরা কখনো খারাপ সিদ্ধান্ত নেন না। তুই যে তলে তলে এতদূর এগিয়ে গেছিস সেটা তো আর আমরা জানতাম না। তবে যাই বলিস, তোর পছন্দ খারাপ না। ছেলেটাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। এমন একটা জামাই তো আমি খুঁজছিলাম তোর জন্য। এখন তোকে বিয়ে দিতে পারলেই আমি সকল দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিয়ে শান্তিতে দুচোখের পাতা বন্ধ করতে পারব।”
অহনা বলে ওঠে,”মা! একদম এসব বাজে কথা বলবে না।”
এত সবকিছুর মাঝে অভিক বলে ওঠে,”আমাদের তো আর বেশি কিছু বলার নেই। পাত্র-পাত্রী তো একে অপরকে আগে থেকেই পছন্দ করে নিয়েছে। আর আজ পারিবারিক দেখাশোনাও হয়ে গেল৷ এবার শুধু বিয়েটাই বাকি আছে।”
আরাফাত বলে,”পরশু তো আমায় সেনা ক্যাম্পে ফিরতে হবে। তাই আমি চাইছি কালকে বিয়েটা সম্পন্ন করে একেবারে বউ নিয়ে যেতে।”
অহনা যেন আজ একের পর এক অবাক হচ্ছে। অহনাকে আরো অবাক করে দিয়ে অহনার মামা বলে,”হ্যাঁ, আমাদের কোন অসুবিধা নেই। তুমি তো নাকি শুনলাম আগে থেকেই কমিউনিটি সেন্টার বুক করে রেখেছ। আমাদেরও খুব একটা আত্মীয় স্বজন নেই আসার মতো। যারা আসবে তাদের আজকেই জানিয়ে দেব।”
অহনার অবাক মুখ দেখে অহনার মা হেসে বলে,”দেখেছিস, ছেলেটা কি চতুর! কিভাবে গোপনে গোপনে সব এরেঞ্জমেন্ট করে নিয়েছে অথচ তোকে কিছু বুঝতেও দেয়নি।”
অহনা বুঝতে পারে আরাফাত তাকে লুকিয়ে গোপনে কত কি পরিকল্পনা করেছে। এবার অহনা আরাফাতের উপর একটু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নাটক করে বলে,”কিন্তু আমি এই বিয়ে করতে পারব না।”
আরাফাত সহ বাকি সবাই অবাক হয়ে তাকায়। আনোয়ারা বেগম বলে ওঠেন,”সে কি মা! তুমি বিয়ে করবে না কেন? কোন কি অসুবিধা হয়েছে? তাহলে আমাদেরকে জানাতে পার।”
অহনা মুচকি হেসে বলে,”আমার যে অনেক ইচ্ছা ছিল আমার বিয়েতে অনেক শপিং করব সেটা যে হলো না।”
আরাফাত চটপট বলে ওঠে,”কোন ব্যাপার না। এখনই বসুন্ধরায় চলো। তোমার যা যা নেবার নিও। কিন্তু বিয়ে কালই হবে।”
আরাফাতের এমন ব্যতিব্যস্ততা দেখে সবাই আড়ালে হাসে। বিয়ের জন্য বেচারা কতটা উদগ্রীব! অহনাও আর ব্যাপারটাকে বেশি না পেচিয়ে বলে,”আচ্ছা, ঠিক আছে।”
সুনীতি এবার অভিকের কাছে এসে জানতে চায়,”তুমি বলো তো ব্যাপার কি?”
আরাফাত বলে,”আমাদের ক্যাম্প থেকে ফেরার পরই আরাফাত অহনার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে সব ঠিক করে রেখেছে। অহনাকে এতদিন জানতে দেয়নি সারপ্রাইজ দেবে বলে। আমিও কাল জেনেছি। যখন তুমি আমায় অহনার বিয়ের কথা বললে তখন আরাফাতকে ফোন দিয়েছিলাম। তখনই ও বলল। তোমাকে জানালে তুমি অহনাকে বলে দিতে পার তখন আর এটা সারপ্রাইজ থাকবে না জন্য আরাফাত আমায় এটা তোমায় জানাতে মানা করেছিল।”
“ওহ আচ্ছা। যাইহোক, ব্যাপারটা বেশ ভালোই হলো। অহনা যখন আমায় বলল ও আরাফাত ভাইয়াকে পছন্দ করে আমি তো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে ব্যাপারটা জানাবো।”
“আরাফাত হলো সুপা রুস্তম। দেখলে না, কিভাবে আমাদের থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে তলে তলে কত কি করে নিলো।”
“তুমিও কিছু কম যাও না।”
সুনীতির কথা শুনে অভিক হেসে ফেলল।
মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৬
এদিকে অহনা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”নিজেকে বেশ শেয়ানা ভেবেছেন। একবার শুধু বিয়েটা হতে দিন, তারপর আমি বোঝাবো আপনাকে। আপনার মন রাঙিয়ে দেবার আগে যা করলেন তার একটা সুইট রিভেঞ্জ অবশ্যই নিবো।”
বলেই একটা দুষ্টুমির হাসি দেয়।