মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৩+২৪

মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৩+২৪
নাফিসা তাবাসসুম খান

দূর্বল শরীর নিয়ে আরেক কদম বাড়াবে আনাস্তাসিয়া তার আগেই রিকার্ডো হুংকার করে বলে উঠে,
” এই মেয়ে কে? এখানে কি করছে? ”
আনাস্তাসিয়া থমকায়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় তার কলিজা তার হাতে এসে পড়েছে। ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। তার সামনে এই মুহুর্তে সে কাকে দেখছে? রিকার্ডো? সে যেই রিকার্ডোকে চিনে সে কখনোই এভাবে কথা বলে না। হলরুমে উপস্থিত বাকি সকলেও ভয় পেয়ে যায়। রিকার্ডোকে এরকম অগ্নি রূপে কেউ কখনো দেখে নি। রাগ হলেও খুব ঠান্ডা মাথায় শান্ত স্বরে কথা বলে রিকার্ডো। হলরুমে আনাস্তাসিয়ার ঘ্রাণে সকল ভ্যাম্পায়ারদেরই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে। মানব রক্তের ঘ্রাণ এবং ভ্যাম্পায়ারের মধ্যের সম্পর্ক চৌম্বকীয়। দূরে থাকা কঠিন। কিন্তু হলরুমে হঠাৎ এক মানব কন্যার আগমনে সবাই বেশি চমকাবে নাকি রিকার্ডোর এমন হুংকারে তা নিয়ে সকলেই শংকায় আছে।

তখনই সেখানে সেই কালো আলখেল্লা পরিহিত লোকটি হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে উপস্থিত হয়। মাথা নত করে বলে,
” ক্ষমা করবেন কাউন্ট। এক মুহূর্তের জন্য আমি সরতেই এই মেয়ে সুযোগ বুঝে পালানোর চেষ্টা করেছে। ”
রিকার্ডো হাত থেকে কাচের গ্লাস ছুড়ে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে সেই আলখেল্লা পড়া লোকটার কাছে এসে তার গলা চেপে ধরে হুংকার করে বলে,
” এই মুহুর্তে আমি জানতে চাই আমার অনুমতি ছাড়া এই মেয়ে আমার দূর্গে কি করছে? ”
আকস্মিক ঘটনায় আনাস্তাসিয়া এক চুল পরিমাণ নড়তে ভুলে যায়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব কি হচ্ছে? রিকার্ডো বাতাসের গতিতে কিভাবে মুহূর্তের মাঝে তার পাশে থাকা লোকের কাছে আসতে পারবে? আনাস্তাসিয়ার মনে হয় তার ভ্রম হচ্ছে। এসব কিছু যা হচ্ছে সব কেবল তার ভ্রম। নিজের পরিবারের মৃত্যুর শোকে কি সে পাগল হয়ে গিয়েছে? এসব ভাবনা তার মাথা ব্যাথা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মস্তিষ্কের সকল নিউরন এক এক করে ছিড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সেই আলখেল্লা পড়া লোকটা কাশতে কাশতে বলে,
” কাউন্ট ক্ষমা করুন। কোভেন মিহাই এই মেয়েকে আজকে দূর্গে নিয়ে এসেছে। কোভেন ম্যাথিউর জন্য উপহার সরূপ। ”
সাথে সাথে রিকার্ডো কালো আলখেল্লা পরিহিত লোকটির ঘাড়ে কামড় বসায়। লোকটি চিৎকার করে উঠে। কিছুক্ষণ রক্ত শুষে দূরে ছুড়ে মারে তাকে। দেয়ালের সাথে মাথায় আঘাত পেয়ে সাথে সাথে লোকটি প্রাণ হারায়৷
কারো সাহস হচ্ছে না রিকার্ডোকে কিছু বলার। সকলেই ভয়ে চুপ করে আছে। আনাস্তাসিয়ার মনে পড়ে যায় ওরিয়নের দেওয়া সেই ডায়েরির কথা। ভ্যাম্পায়ারদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলো সে ওই ডায়েরি পড়ে। ভ্যাম্পায়াররা এভাবেই মানুষদের ঘাড়ে কামড় দিয়ে রক্ত শুষে খায়। তারা অনেক দ্রুত বেগে চলতেও পারে। তারমানে রিকার্ডো ভ্যাম্পায়ার? এসব যা হচ্ছে সব সত্যি? আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর দিকে এক কদম এগিয়ে মনে সাহস জুগিয়ে তার কাধে হাত রেখে ধীর স্বরে বলে,

” তুমি ভ্যাম্পায়ার? ”
রিকার্ডো মুখে লেপ্টে থাকা রক্ত মুছতে মুছতে পিছনে ফিরে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায় হিংস্র দৃষ্টিতে। আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে পিছিয়ে যায়। রিকার্ডোর চোখের হিংস্রতার মাঝে সে নিজের প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায়। এসব কিছু তার মানে সত্যি। তার সাথে যা কিছু হচ্ছে সব সত্যি। তার সামনে থাকা যুবকটি রিকার্ডোই এবং সে একজন ভ্যাম্পায়ারও। এই মুহুর্তে সে ভ্যাম্পায়ারদের মাঝে অবস্থান করছে। কিন্তু সে এখানে কিভাবে এলো? আনাস্তাসিয়ার ভাবনার মাঝেই রিকার্ডো চেচিয়ে একজনকে ডেকে বলে,
” নিয়ে যাও এই মেয়েকে আমার সামনে থেকে। অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করো ওকে। আমি না আসা পর্যন্ত কেউ যেন এই মেয়ের সাথে দেখা না করতে পারে। ”

আনাস্তাসিয়াকে আগুন্তক দুজন পুরুষ এসে শিকল ধরে টেনে নিয়ে যায় সেখান থেকে। প্রস্থান করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আনাস্তাসিয়া বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলো রিকার্ডোর দিকে। কিন্তু তাকে আশাহত করে রিকার্ডো একবারও তার দিকে ফিরে তাকায় না।
আনাস্তাসিয়া প্রস্থান করার সাথে সাথে রিকার্ডো হুংকার দিয়ে মিহাইকে ডাকে। মিহাই ভয়ে ভয়ে হলরুমের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। রিকার্ডো দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে,
” এই মেয়েকে কোথায় পেয়েছিস? ”

” কাউন্ট বুখারেস্টের দাস বাজারে এই মেয়ে চেতনাহীন অবস্থায় পড়েছিলো। যুদ্ধ বন্দী দাসী হিসেবে আনা হয়েছে একে গ্রীক থেকে। দাস বাজারে এই মেয়ের মূল্য সর্বোচ্চ ছিলো। কোভেন ম্যাথিউর মানব রক্তের প্রতি ঝোক সম্পর্কে তো আমরা সবাই জানি। তাই আমি কোভেন ম্যাথিউর জন্য উপহার সরূপ একে কিনে নিয়ে আসি। ”
রিকার্ডো হুংকার দিয়ে বলে উঠে,
” আমার দূর্গে আমার অনুমতি ব্যাতিত মানুষ নিয়ে আসা হচ্ছে। এতো বড় স্পর্ধা তোর! ”
” ক্ষমা করবেন কাউন্ট। ভুল হয়ে গিয়েছে। ”

” আমি হাজার দফা পরিষ্কার বলেছি যে আমার দূর্গের ভেতর কেউ কোনো মানুষ নিয়ে আসবে না আমার অনুমতি ব্যাতিত। কিন্তু মনে হয় সবাই সেই আদেশ ভুলতে বসেছে। ”
এটা বলে সাথে সাথে রিকার্ডো মিহাইয়ের মাথা হাত দিয়ে টেনে ঘাড় থেকে আলাদা করে ছুড়ে দূরে ফেলে। সবাই বুঝে নেয় যে মিহাইয়ের দ্বারা রিকার্ডো সকলকে হুমকি দিয়েছে এই মাত্র। রিকার্ডো হনহনিয়ে হলরুম হতে বেরিয়ে পড়ে। হলরুমে থাকা ড্যানিয়েল ক্যামিলোকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” কাউন্ট রিকার্ডোর মেজাজ এখন উত্তপ্ত কয়লার মতো হয়ে আছে। ম্যাথিউকে বলে দিও আপাতত কিছুদিন যেন রিকার্ডো থেকে দূরে থাকে। ”
ক্যামিলোর কানে যায় না সেই কথা। সে ব্যস্ত অন্য কথা ভাবতে। রিকার্ডো এই মেয়ের সাথে আবার কি না করে। নিজের ছেলের এমন অগ্নিরূপের সঙ্গে তিনি পরিচিত নয়। এই অগ্নি না আবার সেই গ্রীক মেয়েটাকে দগ্ধ করে ছাড়ে ভয় হয় তার।

ঘুটঘুটে অন্ধকার কারাগারে বসে আছে আনাস্তাসিয়া। হাতে পায়ে এখনো শিকল বাধা। হঠাৎ কারাগারের দরজা খোলার শব্দ পেতেই সে পাশ ফিরে তাকায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অবয়বে সে বুঝতে পারে তার সামনে রিকার্ডো দাঁড়িয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া উঠে দাঁড়ায়। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না সে। সে রিকার্ডোর মুখ থেকে একবার শুনতে চায় যে সে ভ্যাম্পায়ার কি না। রিকার্ডো যদি এখন মিথ্যেও বলে তবুও সে প্রয়োজনে সেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করে নিজের মনকে শান্তনা দিবে। কাপা কাপা গলায় অন্ধকারের সেই অবয়বের দিকে তাকিয়ে আনাস্তাসিয়া বলে,

” একবার বলে দাও আমার ধারণা ভুল। এসব কিছু মিথ্যা। সব কিছু আমার ভ্রম একবার বলো আমায়। আমি সেটা বিশ্বাস করে নিবো। তবুও তুমি বলো একটু আগে আমি যা কিছু দেখেছি তা সব মিথ্যা ছিলো। ”
রিকার্ডো কিছু না বলে আনাস্তাসিয়ার পাশ কেটে চলে যায়। কারাগারের একপাশের দেয়ালের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে একটি জানালা। কালো পর্দা দিয়ে ঢাকা ছিলো সেটি। পর্দা সরিয়ে দিতেই জানালার কাঁচ ভেদ করে একফালি চাঁদের আলোয় কারাগারটি আলোকিত হয়ে উঠে। রিকার্ডো এবার আনাস্তাসিয়ার দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু নিজের পিশাচ রূপে ফিরে তাকায় সে। চোখে মুখে হিংস্রতা, উপরের চোয়ালের দুটি সূচালো দাঁত বেরিয়ে আছে। আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে এসে এক হাতে তার গাল চেপে ধরে। আনাস্তাসিয়া ব্যাথায় কুকড়ে উঠতেই রিকার্ডো হিংস্র স্বরে বলে উঠে,

” ভ্রম নয় সব সত্যি। তোমার এই মুহুর্তে আমার দূর্গে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেমন সত্য তেমন আমার পিশাচ স্বত্তাও সত্য। ”
আনাস্তাসিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রিকার্ডোর দিকে। তার দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ব্যথিত কণ্ঠে বলে,
” তাহলে কাস্টোরিয়ায় যার সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার সে কে? জঙ্গলে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের রাতে আমায় যে উদ্ধার করেছিল সে কে? লেকের পাড়ে মাল্টা গাছের নিচে গোধূলি লগ্নে যার সাথে আমার দেখা হয়েছিল সে কে? আমাকে চিঠি যে পাঠিয়েছিলো সে কে? ”
” সব নাটক ছিলো। ঘেটে দেখছিলাম তোমাকে কাছ থেকে। ”
এটুকু বলে রিকার্ডো মুখ নামিয়ে আনাস্তাসিয়ার ঘাড়ের কাছে নিয়ে চোখ বুজে ঘ্রাণ নিয়ে বলে,

” তোমার রক্তের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে পড়েছিলাম। বেশ নেশালো ঘ্রাণ। তবুও তোমায় জীবন ভিক্ষা দিয়ে চলে এসেছিলাম। ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো৷ তোমায় এনে আবারও আমার সামনেই দাঁড় করালো। ”
আনাস্তাসিয়া নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হুট করে নিজের প্রতি ঘৃণা অনুভব করে সে। কাকে মন দিয়ে বসেছে সে? এক পিশাচকে ভালোবেসেছে সে? তার হৃদয়ে পিশাচের অস্তিত্ব? রিকার্ডো কেবল তার ঘ্রাণের প্রতি আকৃষ্ট ছিলো? আনাস্তাসিয়া শিকলে বাধা দু হাত তুলে রিকার্ডোর শার্টের কলার টেনে ধরে ক্ষুদ্ধ বাঘিনীর মতো গর্জে বলে,
” অনুতপ্ত আমি সেই দিনের জন্য যে দিন আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যেন আমাদের আবার দেখা হয়। অনুতপ্ত আমি সেই সন্ধ্যার জন্য যে সন্ধ্যায় আমি তোমার বুকে ছুড়ি না চালিয়ে কাঠ বাদামে তা চালিয়েছিলাম। অনুতপ্ত আমি সেই দিনের জন্য যেদিন তোমায় কেবল দেখে গ্রীক দেবতা এডোনিসের সাথে তোমার তুলনা করেছিলাম। তোমার বাহিরের রূপ যতটাই মন্ত্রমুগ্ধকর তেমনই তোমার ভিতরের স্বত্তাটা ততোটুকই অভিশপ্ত। ”
রিকার্ডো যেন আরেকটু রেগে যায়। আবার আনাস্তাসিয়াকে পিছনে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে তার গাল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” শুনে রাখো মেয়ে এটা তোমার কাস্টোরিয়া নয়। এটা আমার দূর্গ। কাউন্ট রিকার্ডোর তুষ দূর্গ। এখানে মুখ চালিয়ে পাড় পাবে না তুমি। বেশি কথা বললে জিভ কেটে সেই দাস বাজারে ছুড়ে ফেলে আসবো। কেউ ফিরেও তাকিয়ে দেখবে না তখন। আর যদিও কেউ দয়া করে কিনে নিজের মন কামনা মেটায়ও তখনও মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বের করতে পারবে না। ”
আনাস্তাসিয়ার কান গরম যায় এরকম কথা শুনে। সে আশা করে নি রিকার্ডো এমন কিছু বলতে পারে। রিকার্ডোর কাছে তার মূল্য এতোই নগন্য? দাস বাজারের দাসীদের থেকেও নিচে নামিয়ে দিলো তাকে? রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে ধাক্কা মেরে পাশে ফেলে দিয়ে বলে,
” জীবনের শেষ রাতের শুভেচ্ছা তোমায়। কালকের পর আর কখনো সূর্যোদয় দেখতে পাবে না তুমি। ”

মার্থাকে বেশ কিছুদিন ধরে দেখছে না ক্যাথরিন। না পেরে লোল্যান্ডাকে জিগ্যেস করে বসে,
” মার্থা কোথায়? ও প্রতিদিন আমার খাবার নিয়ে আসতো। গত কয়েকদিন ধরে ওকে কোথাও দেখছি না। ”
লোল্যান্ডা বলে,
” আমাকে কিছু জানানো হয় নি। আমাকে শুধু বলা হয়েছে তোমার সাথে থাকতে আর তোমার কি প্রয়োজন তা খেয়াল রাখতে। ”

ক্যাথরিনের মনে সন্দেহ হয়। মার্থা কোথায় যেতে পারে? নাকি আবার কোনো ভুলের কারণে আরোণ তাকে মেরে ফেলেছে? আরোণকে সরাসরি জিগ্যেস করেও লাভ নেই। সে কিছুই বলবে না এই বিষয়ে। ক্যাথরিন মনে মনে ঠিক করে সে নিজে সুযোগ বুঝে প্রাসাদে খুঁজে দেখবে একবার। তার ভাবনার মাঝে লোল্যান্ডা বলে উঠে,

” আমি কিছু ফল কেটে দিয়েছি। তুমি খাও। আমি পরে এসে নিয়ে যাচ্ছি এসব। ”
এটুকু বলেই লোল্যান্ডা চলে যায়। ক্যাথরিন ফল কাঁটার ছুড়ি হাতে নিয়ে একটি এপ্রিকট নিয়ে কাঁটতে থাকে। আবার ভাবনায় ডুব দেয় সে। হঠাৎ দরজার খোলার শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে পাশে তাকাতে নিলে ভুল বসত ছুড়ি লেগে তার হাত সামান্য কেটে যায়। চাপা আর্তনাদ করে উঠে সে। আরোণ মাত্র কক্ষে প্রবেশ করে ক্যাথরিনকে আর্তনাদ করতে দেখে সাথে সাথে তার সামনে গিয়ে বসে বলে,
” কি করছো ক্যাথ? সাবধানে! ”
ক্যাথরিন হালকা রেগে বলে,

” অসময়ে হুটহাট আমার কক্ষে প্রবেশ করার অভ্যাস বদলাও নিজের। নাহয় আজকে হাত কেঁটেছে আরেক দিন ভয়ে নিজের গলায় ছুড়ি চালিয়ে বসবো আমি। ”
ক্যাথরিন রেগে বলেছে নাকি রসিকতা করেছে তা ঠাওর করতে পারে না আরোণ। কিন্তু তার রাগ হয় ঠিকই। বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,
” আজেবাজে কথা বলার অভ্যাস তোমার লোল্যান্ডার সাথে থাকতে গিয়ে হয়েছে তাই না? ”
” তুমি নিজের দোষ বেচারি লোল্যান্ডার উপর দিচ্ছো কেন? দিনে দুপুরে আমার কক্ষে প্রেতাত্মার মতো এসে তুমি হাজির হও, লোল্যান্ডা না। ”
আরোণ ক্যাথরিনের হাত নিজের হাতে নিয়ে রসিকতা করে বলে,

” রাণী সাহেবা অবশেষে এই প্রাসাদকে নিজের মানতে শুরু করেছেন? ”
ক্যাথরিন আমতা আমতা করে বলে,
” কে রাণী সাহেবা? আর এই প্রাসাদকে আমি নিজের মানতে যাবো কেন? ”
আরোণ উঠে ক্যাবিনেট থেকে কিছু ভেষজ প্রস্তুত ওষুধ নিয়ে এসে তা ক্যাথরিনের হাতে লাগিয়ে দিয়ে নিজের পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে তা দিয়ে বেধে দিতে দিতে বলে,
” এই মাত্র তুমিই বললে যে এটা তোমার কক্ষ। তারমানে তুমি স্বীকার করছো এই প্রাসাদ তোমার। ”
” সেটা আমি কথার কথা বলেছি। আর তোমার এই প্রাসাদে থাকার থেকে ভালো আমি বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। ”
আরোণ আবার রসিকতা করে বলে,

” তুমি বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে বনের সকল পশু বন ছেড়ে শহরে চলে যাবে। ”
” তুমি কি ঠাট্টা করছো আমার সাথে? কি বলতে চাও স্পষ্ট বলো? ”
আরোণ এবার হেসে দিয়ে বলে,
” কথার ঝাঁঝে এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নেকড়েদের আলফাকে কাবু করে ফেলেছো। বনের পশুদের তো ছাড় দাও অন্তত। ”
ক্যাথরিন রাগ দেখিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নেয় আরোণের হাত হতে। পাশ ফিরে বলে,
” সোজা সোজা বললেই পারো যে আমার চেহারার আঁচড়ের দাগে পশুরা ভয় পাবে এটাই বলতে চাচ্ছো। ”
আরোণ অবাক হয়। সে বুঝতেই পারে নি ক্যাথরিন সামান্য মজাকে এভাবে নিতে পারে। সে বলে উঠে,
” তোমার এমনটা কেন মনে হলো? ”
ক্যাথরিন আবার রাগ দেখিয়ে বলতে থাকে,

” নাটক কম করবে তুমি। কাল বিকেলে দেখেছি বারান্দা হতে যে প্রাসাদের আঙ্গিনায় কি সুন্দর প্রেমলীলা করে বেরাচ্ছিলে সেই ডাইনীর মতো সুন্দর মেয়ের সাথে। ”
আরোণের ভ্রু কুচকে আসে। গত কাল বিকেলে সে প্রাসাদের আঙ্গিনায় কি করছিলো মনে করে। তারপর বলে,
” ক্রিনার কথা বলছো তুমি? ”
” বাহ! কি সুন্দর। নামও মুখস্ত তোমার। তোমার পালে আর কতো মেয়ে নেকড়ে আছে? তাদের সকলের নামও মুখস্ত নিশ্চিত তোমার! ভ্রিনা নাকি ম্রিনার থেকে চোখ সরছিলোই না একদম। কি প্রেমলীলা চলছে। ”
আরোণের ভ্রু আরো কুচকে আসে এবার। কিছুক্ষণ এভাবে থেকেই সে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,

” ক্যাথ তুমি ঈর্ষান্বিত হচ্ছো? ”
ক্যাথরিনের স্তম্ভিত ফিরে আসে। এতক্ষণ কি বলেছে বুঝতে পেরে নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত হয়। তবুও উপরে তেজ দেখিয়ে বলে,
” তুমি আর তোমার ক্রিনা কৃষ্ণ সাগরে ডুবে মরো। আমার কোনো যায় আসে না। ”
আরোণ এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলে,
” উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমি কেবল ওর সাথে কথা বলছিলাম। আর একটু আগে আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছিলাম। তোমাকে কারো সাথে তুলনা করে কিছু বলি নি আমি। ”
ক্যাথরিন জবাব না দিয়ে উল্টো দিকে ফিরে বসে থাকে। আরোণ এবার ক্যাথরিনের হাত ধরে তাকে টান দিয়ে নিজের দিকে ফিরায়। ক্যাথরিন রেগে চেচিয়ে উঠে,
” আরে! করছো কি? ”

আরোণ কোনো কথা না বলে একহাতে ক্যাথরিনের মুখের সামনে এসে থাকা এলোকেশ ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়। ক্যাথরিন হঠাৎ করে আরোণের এহেন কাজে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আরোণ তাকে অবাক করে দিয়ে এগিয়ে তার গালে আঁচড়ের উপর ছোট করে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। আবার গাল থেকে সরে তার কপালেও একটি চুমু খেয়ে বলে,
” জীবনে একবার কোহিনূরের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছে আমার ক্যাথ। তারপর হতে আমি অন্ধ। আর কাউকে দেখার সাধ্যি আমার নেই। মরণের আগ পর্যন্ত সেই কোহিনূরই কেবল আমার মন ও মস্তিষ্কে রয়ে যাবে। ”
এতক্ষণ ধরে বরফের ন্যায় জমে থাকা ক্যাথরিন হঠাৎ লাজে লাল হয়ে উঠে। দৃষ্টি নত করে লাজ লুকোনোর চেষ্টায় ব্যস্ত সে। আরোণ ক্যাথরিনকে আরেকটু লজ্জা দিতে ফিসফিসিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
” লাজে লাল ক্যামিলিয়া, নিজের লাজ সংবরণ করো। তোমার সামনে থাকা এই নেকড়ে ভীষণ বেহায়া ও নির্লজ্জ প্রকৃতির। ”

হঠাৎ করে এক পশলা পানি এসে পড়তেই আনাস্তাসিয়া ধরফরিয়ে উঠে বসে। তার সামনে এক কালো আলখেল্লা পরিহিত লোক মাটির জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি কর্কশ গলায় বলে উঠে,
” এই মেয়ে! ঘুম শেষ হলে উঠে আয়। এই প্রথম কাউকে দেখলাম যে নিজের মৃত্যু জেনেও এতো আরাম করে ঘোড়া বেঁচে ঘুমাচ্ছে। ”
আনাস্তাসিয়া সেই লোকের কথায় কান দেয় না। আপাতত তার দৃষ্টি সেই লোকটির হাতের মাটির জগের দিকে। লোকটি আনাস্তাসিয়ার সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে,
” পানি পান করবি? ”

তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে আনাস্তাসিয়ার। চোখেমুখে সব অন্ধকার দেখছে। আপাতত পানির খুব প্রয়োজন অনুভব করছে সে। তাই মাথা উপর নিচে ঝাকিয়ে সম্মতি জানায়। লোকটি একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,
” আচ্ছা পারলে আমার হাত থেকে এই জগ নিয়ে পানি খা। ”
জল তৃষ্ণায় আনাস্তাসিয়া এতো কিছু না ভেবে কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে সেই লোকটির হাত থেকে জগটি নেওয়ার জন্য এগিয়ে যায়। লোকটি তাকে বাধা না দিয়ে তার হাতে জগটি দিয়ে দেয়। আনাস্তাসিয়া জগ উপর করে পানি খাওয়ার জন্য মুখ হা করতেই দেখে জগ খালি। ভিতরে এক ফোটাও পানি অবশিষ্ট নেই। আনাস্তাসিয়া হতাশ দৃষ্টি মেলে রয়। সেই লোকটা আবার বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,

” চল নবাবজাদী। পানির তেষ্টা পূরণ হলে এবার মরণ স্বাদ গ্রহণ করবি। ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়ার হাতের শিকল ধরে টেনে তাকে নিয়ে যেতে নেয়। শিকলের টান লাগতেই আনাস্তাসিয়া ব্যাথায় আহ বলে উঠে। লোকটা ইচ্ছা করে আরো জোরে তাকে টেনে নিয়ে যায়।
হলরুমে আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে প্রবেশ করতেই সকল ভ্যাম্পায়াররা নড়েচড়ে বসে। সকলেই ওৎ পেতে আছে রিকার্ডোর আদেশের আশায়। রিকার্ডো এই মেয়েকে মৃত্যুদণ্ড দিবে তা সকলেই জানে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড হিসেবে তার রক্ত পানের সুযোগ দিলে সকলে বেশি খুশি হবে৷ ক্যামিলো রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে ছেলের মনে কি চলছে৷ কিন্তু রিকার্ডোর চেহারা দেখে কিছুই বুঝা যায় না৷ বেশ শান্ত আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে সে। আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা কাঁচের গ্লাস হতে তাজা রক্ত চুমুক দিয়ে পান করছে। আনাস্তাসিয়া একবারও চোখ তুলে তাকাচ্ছে না কারো দিকে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাত ও পায়ে অসংখ্য কাঁটা দাগ। গায়ের গাউনটাও ময়লা হয়ে রঙ বদলেছে।

রিকার্ডো ইশারা দিতেই সেই কালো আলখেল্লা পরিহিত লোকটা আনাস্তাসিয়াকে হলরুমের মাঝে রেখে সেখান থেকে প্রস্থান করে। রিকার্ডো হাতের গ্লাসটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়৷ ধীরে ধীরে হেঁটে আনাস্তাসিয়ার কাছে যায়। ড্যানিয়েল দূর হতে এই দৃশ্য দেখে চোখ কুচকায়৷ এই ছেলে এই মেয়েকে মারা নিয়ে এতো নাটক কেন করছে তা সে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েকে মারা এক মুহূর্তের ব্যাপার। এ নিয়ে এতো টালবাহানার কি আছে? মনে মনে আরেক কথাও ভাবাচ্ছে তাকে। ম্যাথিউ যেন ভুলেও এখন দূর্গে ফিরে না আসে৷ কাল রাতে রিকার্ডোর যে অগ্নিরূপ সকলে দেখেছে সেই অগ্নির তাপ যেন ম্যাথিউকে স্পর্শ না করে তাই চাচ্ছেন তিনি।
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়া চারিদিক দিয়ে একবার ঘুরে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। আনাস্তাসিয়া তবুও চোখ তুলে তাকায় না তার দিকে। রিকার্ডো এবার বলে উঠে,

” আমার কাছে তোমার জন্য একটা প্রস্তাব আছে। যদি মরতে না চাও তাহলে আমার হাতে থাকা এই গ্লাসের রক্ত পান করতে হবে তোমার। তাহলে আমি তোমাকে তোমার জীবন ভিক্ষা দিবো। ”
আনাস্তাসিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকায় রিকার্ডোর দিকে৷ রিকার্ডো বাকা হেসে বলে,
” খুব সহজ এক কাজ দিলাম তাই না? ব্যস! এটুকু করলেই আর তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না। ”
আনাস্তাসিয়া ক্রোধের চোটে এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসে। ভরা মজলিসে সকলের সামনে রিকার্ডোকে উদ্দেশ্য করে থুতু ছুড়ে মারে। আকস্মিক ঘটনায় সকলেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা। সকলেই অপেক্ষায় আছে রিকার্ডো কি করে তা দেখার। ক্যামিলোর মেয়েটির জন্য মায়া হয়। জীবনের সবথেকে বড় ভুল করলো এটা সে। এতো বড় অপমানের পর রিকার্ডো এখন কি কি করতে পারে তা সকলের কল্পনার ও বাহিরে।
রিকার্ডো চোখ বুজে থম মেরে আছে। আনাস্তাসিয়া ক্রোধে মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

” এখন আমি সাদরে মৃত্যুদণ্ড গ্রহণ করতে রাজি আছি। ”
রিকার্ডো চোখ মেলে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায়। সকল কোভেনদের সামনে অপমানে তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হওয়াটাই কেবল বাকি। একহাতে পকেট হতে একটি রুমাল বের করে সেটি দিয়ে মুখ মুছে নেয়। তারপর রুমালটিকে ছুড়ে ফেলে সে। আনাস্তাসিয়া এখনো চোখ বড় করে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে আছে। রিকার্ডো অতিব ঠান্ডা স্বরে বলে,
” মৃত্যুদণ্ডের আগে এই চরম দুঃসাহসিকতার পুরষ্কারও পাওয়া উচিত। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার চুলের মুঠি একহাতে নিয়ে জোর করে তাকে সেই গ্লাসের রক্ত পান করায়। আনাস্তাসিয়া চোখ খিচে বন্ধ করে ছিলো পুরোটা সময়। গ্লাসের রক্ত শেষ হতেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বলে,

” এখন আমার আর তোমার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আমিও যা পান করি তুমিও তা পান করেছ। ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করার সুযোগ পায় না। তার আগেই তার গা গুলিয়ে বমি আসে। হলরুমের মাঝে মেঝেতেই সে বমি করে দেয়। এতে হলরুমে উপস্থিত সকলেই নাক ছিটকে ফেলে। আনাস্তাসিয়ার মনে হচ্ছে সে সম্পূর্ণ অপবিত্র হয়ে গিয়েছে। তার নিজেকে নিকৃষ্ট জীব মনে হচ্ছে। এতোটুকুতে ক্ষান্ত হয় না সে। দু হাত দিয়ে বারবার মুখের চারিদিকে লেপ্টে থাকা রক্ত মুছতে থাকে।
রিকার্ডো নিজের আসনে ফিরে গিয়ে আদেশ দেয়,

” এই মেয়েকে এখনি আমার সামনে শ্বাসরোধ করে মারা হোক। ”
রিকার্ডো আদেশ দিতেই তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক কালো আলখেল্লা পরিহিত লোক এক হাত সমান একটি দড়ি হাতে এগিয়ে যায় আনাস্তাসিয়ার কাছে। আনাস্তাসিয়াকে টেনে সোজা করে বসিয়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার গলায় দড়ি ধরে। আনাস্তাসিয়া শেষ বারের মতো রিকার্ডোর দিকে তাকায়। রিকার্ডোও তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দৃষ্টিমিলন হয়। রিকার্ডোর চোখে মুখে আনাস্তাসিয়া মায়ার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পায় না৷ আশাহত হয় সে আরো একবার। মনে মনে বলে,

” পুণর্জন্ম যদি সত্যি হয় তাহলে আর কোনো জনমেই আমি তোমাকে ভালোবাসবো না। এটাই শেষবার। ”
আনাস্তাসিয়ার চোখ বেয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। রিকার্ডো সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আনাস্তাসিয়া চোখ বুজে তার পরিবারের সকলের চেহারা কল্পনা করতে থাকে। কাভালায় তার নিজের বাসায় তার মা, বাবা, ক্যাথরিন ও লিয়ামের সাথে একসাথে বসে গল্প করার দৃশ্য কল্পনা করে সে। সবশেষে তার চোখে ভেসে উঠে তার ও রিকার্ডোর প্রথম সাক্ষাৎ। রক্তিম চন্দ্রগ্রহনের সময় তার দেখা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর সবুজ চোখ জোড়া তার মনে ভেসে উঠে। দড়ি আরো জোরে পেচিয়ে ধরলেও আনাস্তাসিয়ার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠে। এই মুহুর্তে আর মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে না সে। মনে মনে শেষ বারের মতো বলে,
” তবে এই জনমে ভুল করে হলেও আমি তোমাকে ভালোবেসেছি৷ তাই মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও আমার চোখে কেবল তোমার ছবিই ভাসছে। ”

ক্যাথরিনের মনে ইদানিং উদ্ভট অনুভূতি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে খুব। এইযে হুটহাট আরোণকে দেখলে তার লাজে নুইয়ে পড়া। তেজ আর রাগ দেখাতে গিয়েও কেমন নরম হয়ে পড়ছে। এসব তাকে খুব বিরক্ত করছে। বারবার মনে মনে আওড়াচ্ছে এই নেকড়ের সাথে কেবল তার ঘৃণার সম্পর্ক আছে। নেকড়ের মায়াজালে ভুলেও আটকানো যাবে না। ঠিক করে সে আর আরোণের সামনে সে নরম হয়ে যাবে না মোটেও।
তার এসব ভাবনার মাঝেই লোল্যান্ডা তাকে প্রশ্ন করে,

” আমি লক্ষ্য করছি আজকাল তুমি খুব বেশি ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করছো। রহস্য কি ক্যাথরিন? ”
শেষের প্রশ্নটা লোল্যান্ডা কিছুটা সুর টেনে করে। ক্যাথরিন সেটা বুঝতে পেরে উল্টো লোল্যান্ডাকে প্রশ্ন করে,
” তুমিও তো খুব ক্রিয়াসের আশেপাশে মৌমাছির মতো ঘুরঘুর করো। রহস্য কি লোল্যান্ডা? ”
লোল্যান্ডা স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দেয়,
” আমি ক্রিয়াসকে পছন্দ করি। ”
ক্যাথরিন হেসে বলে,

” তা তোমার কার্যকলাপেই স্পষ্ট প্রকাশ পায়। কিন্তু ক্রিয়াসের সাথে তোমার পরিচয় কি করে হলো? ”
লোল্যান্ডা যেন এধরণের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতই ছিলো। তাই সে কোনো ভনিতা না করে বলা শুরু করে,
” দু বছর আগে আমি ছোট দুই ভাই ও নিজের পেটের দায়ে নিষিদ্ধ পল্লির জগতে প্রবেশ করি। সেখানে সর্বপ্রথম আমার কাছে ক্রিয়াসই এসেছিলো। আমি তখন জানতাম না তার নেকড়ে সত্তা সম্পর্কে। সেদিনের পর থেকে প্রতিদিনই ক্রিয়াসের আসা যাওয়া শুরু হয় আমার কাছে। একদিন তার আগেই অন্য কেউ আগেই আমাকে ভাড়া করে আমার কক্ষে এসে পড়েছিলো। ক্রিয়াস এসে তা জানতে পেরে আমার কক্ষে এসে রেগে সেই লোককে কিছু মুদ্রা দিয়ে সেখান থেকে যেতে বলে।

লোকটি না গিয়ে উল্টো মাতাল অবস্থায় আজেবাজে কথা বলে ওকে রাগিয়ে তুলে। সেদিন প্রথম ক্রিয়াস রাগের মাথায় নিজের নেকড়ে রূপে আমার সামনে আসে। আমি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে মনের অজান্তেই উল্টো ওকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ে গিয়ে দরজা ভালো করে লাগিয়ে দেই যেন কেউ ওকে এই রূপে না দেখতে পায়। সেই লোকটা ক্রিয়াসকে এই রূপে দেখে ভয়ে চেতনা হারায়। সেই রাতেই ক্রিয়াস আমাকে সেই পল্লী হতে দ্বিগুন দাম দিয়ে কিনে নিয়ে আসে। আমার ও আমার ভাইদের দায়িত্ব নেয় সে। এসবের মাঝে ঠিক কবে ওর প্রেমে পড়েছি আমি তা ঠিক খেয়াল নেই আমার। ”

ক্যাথরিন এতক্ষণ ধরে অবাক হয়ে লোল্যান্ডার কথা শুনছিলো। মেয়েটা এতো সাবলীলভাবে সব বলে গেলো যেন এ সবকিছুই কতো সহজ ছিল তার জন্য। ক্যাথরিন লোল্যান্ডাকে কিছু বলবে তার আগেই কক্ষে বাতাসের গতিতে প্রবেশ করে ক্রিয়াস। তড়িঘড়ি করে বলে,
” তোমরা দুজন কক্ষেই থাকবে এবং ভুলেও বের হবে না। আর বিশেষ করে তুমি ক্যাথরিন। আলফার স্পষ্ট আদেশ যেন ভুলেও তুমি কক্ষ থেকে বের না হও। ”
ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,

” কিন্তু কি হয়েছে? ”
” জ্যাকসন এসেছে। আমাদের শত্রু। বাহিরে তোমাদের সুরক্ষার জন্য আমি প্রহরীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছি। তবুও তোমরা কক্ষ থেকে বের হবে না। ”
এটুকু বলেই ক্রিয়াস কক্ষ থেকে প্রস্থান করে। ক্যাথরিন লোল্যান্ডাকে প্রশ্ন করে,
” জ্যাকসন কে? ”
” আমি জানি না। কিন্তু ক্রিয়াস তো বলে গেল তাদের শত্রু। তাহলে শত্রুই হবে হয়তো। ”
ক্যাথরিন চিন্তিত গলায় বলে,
” আরোণের কোনো ক্ষতি করবে না তো? ”
লোল্যান্ডা ক্যাথরিনের কথায় বেশ অবাক হয়। তবুও তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

” চিন্তা করো না। আলফার ক্ষতি করার সামর্থ্য কারো নেই। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসো। ”
ক্যাথরিনের অস্থির অনুভব হয়। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
” আমি আরোণের কাছে যাবো। ”
লোল্যান্ডা বলে,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ২১+২২

” ক্রিয়াস এইমাত্র কি বলে গেলো শুনো নি? আলফার আদেশ যেন তুমি কোথাও না যাও। ”
ক্যাথরিন এগিয়ে গিয়ে আগুনের মশালটা নিতে নিতে বলে,
” তোমাদের আলফা এবং তার আদেশকে তোমরা বসে বসে মানো। আমি চললাম। ”

মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৫+২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here