মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৭+২৮
নাফিসা তাবাসসুম খান
জ্ঞান ফিরতেই মৃদুস্বরে চেঁচানোর শব্দ শুনে আনাস্তাসিয়া। পুরোপুরি চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় সে এক অচেনা জায়গায় বিছানায় শুয়ে আছে। ভোরের আলোতে সম্পূর্ণ কক্ষ আলোকিত হয়ে আছে। বিছানার পাশেই এক পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। ম্যাথিউ। আনাস্তাসিয়াকে চোখ মেলতে দেখেই ম্যাথিউ বলে উঠলো,
” এই মেয়ে। ঠিক আছো? ”
আনাস্তাসিয়া ম্যাথিউর কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের বাম হাতের দিকে তাকায়। হাতের কব্জির এখানে সাদা কাপড় দিয়ে পট্টি করা। শরীরেও তার পরিষ্কার নতুন জামা। ম্যাথিউ আবার ডাক দেয়,
” এই মেয়ে। খুব সাহস হয়েছে তোমার? আমার ভিক্ষা দেওয়া জীবন নেওয়ার চেষ্টা করো? ভেবেছিলে আত্মহত্যা করলে এসব থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে? ”
আনাস্তাসিয়া ম্যাথিউর কথার জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে,
” আমাকে কারাগারে কে বাঁচিয়েছে? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ম্যাথিউর ভ্রু কুচকে আসে। প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্নে বিরক্ত হয় সে। তবুও জবাব দেয়,
” কারাগার হতে হঠাৎ কিছু একটার শব্দ পেয়ে লিভিউ তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে দেখে তুমি মাটির উপর পড়ে আছো। হাতের শিরা হতে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো খুব। কারাগারের একপাশে পানির পাত্রও পড়ে ছিলো। লিভিউ তোমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমাকে খবর পাঠায়। তোমার ভাগ্য ভালো যে আমি দূর্গে ছিলাম। নাহয় মরে পড়ে থাকলেও কেউ ফিরে তাকাতো না। ”
আনাস্তাসিয়া কিছু না বলে চোখ বুজে ফেলে। আনাস্তাসিয়ার থেকে কোনো প্রতুত্তর না পেয়ে ম্যাথিউ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আপাতত এই মেয়েকে কিছুটা সময় দেওয়াই উত্তম হবে বলে ভাবে সে। পুরোপুরি জ্ঞান ফিরলেই এই মেয়ের সাথে তার কথা বলতে হবে।
ম্যাথিউ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই আনাস্তাসিয়া চোখ মেলে তাকায়। ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে সে। সম্পূর্ণ কক্ষে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কক্ষের একপাশের দেয়াল জুড়ে মস্ত বড় জানালা। সেই জানালার পাশেই রয়েছে লম্বা বসার জন্য জায়গা। অন্যপাশের দেয়ালে রয়েছে ফায়ারপ্লেসের ব্যবস্থা। তাছাড়াও কক্ষে একটি বিছানা, আয়না, ক্যাবিনেট সহ আরো বেশ কিছু আসবাবপত্র রয়েছে।
আনাস্তাসিয়া কক্ষে চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গতরাতের কথা মনে করে সে। তার স্পষ্ট মনে আছে জ্ঞান হারানোর পূর্বে সে রিকার্ডোকে দেখেছিলো৷ তার কাছে, তার পাশেই ছিলো সে। রিকার্ডোর স্পর্শ এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার। তাহলে ম্যাথিউ বা সেই লিভিউ তারা এসে রিকার্ডোকে দেখে নি কেন? রিকার্ডো কি তার আগেই আড়াল হয়ে গিয়েছিলো? আনাস্তাসিয়া আর ভাবতে পারছে না। যতবারই সে রিকার্ডোকে বুঝার চেষ্টা করছে ততবারই সে নিজেকে এক গোলকধাঁধার মাঝে আবিষ্কার করছে। রিকার্ডো যদি সত্যিই এসে থাকে তাহলে সে ধরা দিচ্ছে না কেন? আড়ালে অগোচরে লুকিয়ে থেকে আনাস্তাসিয়াকে বারবার দ্বিধায় কেন পোড়াচ্ছে?
আনাস্তাসিয়া নিজের বাম হাতটা তুলে সেটির দিকে ক্ষাণিকক্ষণ তাকিয়ে রয়। পট্টির উপর দিয়েই ডান হাত দিয়ে বাম হাতটা স্পর্শ করে সে। সাথেসাথেই চোখ বুজে গতরাতের কথা ভাবতে থাকে সে। রিকার্ডোর সেই ছায়া রূপে প্রবেশ, তার কাছে এসে তাকে আগলে ধরা, তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা সবকিছু তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। চোখ মেলে তাকায় আনাস্তাসিয়া। নিজের প্রতি খুব ক্ষুব্ধ সে। এতো সবকিছুর পর তার উচিত রিকার্ডোকে ঘৃণা করা। কিন্তু সে ঘৃণা করতে পারছে না সম্পূর্ণ রূপে। আবার রিকার্ডোর তার প্রতি ব্যবহার দেখে না পারছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে। এ কেমন দ্বিধার মাঝে পড়ে গেলো সে? আনাস্তাসিয়া মনে মনে বলে,
” ঈশ্বর কি করবো আমি? হয় আমার প্রাণ নিয়ে নাও নাহয় রিককে আমার কাছে ধরা দেওয়াও। তবুও এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে আমায় উদ্ধার করো। নিজেকে কোনো তুচ্ছ কীট হিসেবে অনুভব করছি আমি। স্বাধীন হয়ে জন্মেছি আমি, কারো দাসীর পরিচয়ে বেঁচে থাকা আমার কাছে মৃত্যু সমতুল্য। ”
অদ্ভুতভাবে প্রাসাদের সকল নেকড়েরাই আজকাল ক্যাথরিনের সাথে ভালো ব্যবহার করছে। এইতো একটু আগেও হলরুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মারিয়া নামক এক নেকড়ে মানবীর সাথে তার দেখা হয়। মেয়েটা ক্যাথরিনের সাথে কি নরম স্বরে কথা বলল ও খোঁজ খবর নিলো। প্রাসাদের দরজার কাছে আসতেই ক্যাথরিনের ক্রিনার সাথে দেখা হয়। এই মেয়েটার সাথেই সেদিন আরোণকে কথা বলতে দেখে ঈর্ষান্বিত হচ্ছিলো ক্যাথরিন। ক্রিনা ক্যাথরিনকে দেখেই একগাল হেসে প্রশ্ন করে,
” কেমন আছো ক্যাথরিন? ”
” ভালো। তুমি? ”
” নেকড়েরা কখনো খারাপ থাকে না। ”
এটুকু বলেই ক্রিনা হেসে দেয়। ক্যাথরিনের নিজেকে বোকা মনে হয়। ক্রিনা আবার প্রশ্ন করে,
” কোথাও যাচ্ছো তুমি? ”
” সামনেই আঙিনায় হাঁটতে যাচ্ছি। কক্ষে বসে থেকে বিরক্ত বোধ করছিলাম। ”
” আমি সাথে চললে কিছু মনে করবে না তো? ”
ক্যাথরিন হেসে বলে,
” না। উল্টো আমার ভালো লাগবে। হাঁটার সময় কারো সঙ্গ আমার সবসময়ই প্রিয়। ”
ক্যাথরিন ও ক্রিনা আঙিনায় হাঁটছে। ক্রিনা হঠাৎ প্রশ্ন করে,
” খুব ভয় পেয়েছিলে তুমি? জ্যাকসন যখন প্রাসাদে এসেছিলো? ”
” সত্যি বলতে গেলে, হ্যাঁ। পেয়েছিলাম। ”
ক্রিনা হেসে বলে,
” এখন থেকে আর কাউকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন পালের প্রতিটি নেকড়ের। আর আমাদের কাছে নিজেদের দায়িত্ব সবার আগে। দায়িত্বের জন্য আমরা জীবন দিতেও প্রস্তুত সদা। ”
ক্যাথরিন কিছুটা বিস্মিত হয়। সেদিন আরোণের বলা কথা সবাই এতো সহজে মেনে নিবে তা সে ভাবে নি। ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” তোমরা সবাই ই আরোণের কথা এতো মান্য করো? ”
” হ্যাঁ। সবাই ই। আমরা সকলেই স্ব ইচ্ছায় নেকড়ে হয়েছি। আর সকল ওমেগা নেকড়েরাই তাদের আলফার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ”
এটুকু বলেই ক্রিনা বলে,
” বসবে কিছুক্ষণ? ”
ক্যাথরিন সম্মতি জানায় মাথা নাড়িয়ে। তারা দুজন একটি গাছের নিচে বসে পড়ে। ক্যাথরিন বলে,
” মার্থা? সে ও তো ওমেগা ছিলো? সে ও কি বিশ্বস্ত আরোণের? আর জ্যাকসনের সাথেই বা তোমাদের কি নিয়ে শত্রুতা? আর জ্যাকসন যদি তোমাদের শত্রুই হয় তাহলে তার বোনকে প্রাসাদে থাকার অনুমতি কেন দিলো আরোণ?
এতগুলো প্রশ্ন একসাথে পেয়েও বিরক্ত হয়না ক্রিনা। উল্টো সবগুলো প্রশ্নেরই জবাব দেয়া শুরু করে সে।
” জ্যাকসন ওমেগা জাতের নেকড়ে। কিন্তু সে লোভ করেছিলো। একইসাথে ভ্যাম্পায়ার ও নেকড়ের শক্তি ধারণ করে সর্বশক্তিমান হতে চেয়েছিলো সে। একজন হাইব্রিড হয়ে ভ্যাম্পায়ারদের কাউন্ট রিকার্ডো এবং নেকড়েদের আলফা আরোণ রদ্রিগেজকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে সে। তার এই পরিকল্পনা ভ্যাম্পায়ার ও নেকড়েরা জানতে পারলে সে এখান থেকে পালিয়ে যায়৷ ”
ক্রিনা হালকা থেমে আবার বলা শুরু করে,
” জ্যাকসন যখন প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যায় তখন মার্থা প্রাসাদে রয়ে গিয়েছিলো। আলফা মার্থাকে প্রাসাদে দাসী হিসেবে নিযুক্ত করে এবং জ্যাকসনকে খুঁজে আনার জন্য লোক লাগায়। কিন্তু জ্যাকসন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। তারপর আলফা হুকুম করে মার্থাকে বন্দী করতে। আলফার সন্দেহ ছিলো প্রাসাদের কেউ হয়তো জ্যাকসনের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে। তাই মার্থাকে বন্দী করে অত্যাচার করা হলে সেই খবর ও জ্যাকসন পাবে। ঠিকই তাই হয়েছে। জ্যাকসন মার্থার জন্য নিজ থেকে এসে ধরা দেয়। কিন্তু তুমি সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায় তোমাকে তাসের পাতার মতো ব্যবহার করে উল্টো সে মার্থাকে সহ পালিয়েছে। এখন জ্যাকসনকে খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন হয়ে যাবে। খবর পেয়েছি ভ্যাম্পায়াররাও তন্নতন্ন করে খুঁজে বেরাচ্ছে জ্যাকসনকে। কারণ জ্যাকসন একবার নিজের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে গেলে তখন তাকে দমানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ভ্যাম্পায়ার ও নেকড়ের শক্তির সমন্বয়ে সৃষ্ট হাইব্রিডকে দমানো কোনো চারটি খানি কথা নয়। ”
ক্যাথরিন এতক্ষণ খুব মনযোগ দিয়ে ক্রিনার বলা প্রতিটা কথা শুনছিলো। তার নিজের এখন নিজের প্রতি খুব রাগ হচ্ছে। কেন সে সেদিন হলরুমে উপস্থিত হয়েছিল? আরোণ তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শত্রুকে ছেড়ে দিয়েছে। এতে এখন আরোণ সহ সকলের জীবনই হুমকির মুখে আছে। ক্রিনা ক্যাথরিনের একটি হাতের উপর হাত রেখে বলে,
” আমি জানি তুমি হয়তো নেকড়েদের ঘৃণা করো। ঘৃণা করাটাও স্বাভাবিক। তাছাড়া আমাদের কাছে বন্দী থাকার ক্ষোভও তোমার মনে জমে আছে। আর আলফাকেও তুমি ঘৃণা করো কারণ তুমি মনে করো আলফা তোমার মা বাবাকে মেরেছে। ”
ক্যাথরিন এবার নড়েচড়ে বসে। হ্যাঁ এটা সত্যি আজকাল আরোণের জন্য তার মন নরম হয়ে আসছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে সে আরোণকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না তার মা বাবাকে হত্যা করার জন্য। ক্রিনা বলে,
” সেদিন রাতে যখন তোমাদের উপর হামলা হয় তখন আমরা গ্রীকে জ্যাকসনকেই খুঁজতে গিয়েছিলাম। আমারা সকলেই তখন অনেক রাগান্বিত আর ক্ষুব্ধ ছিলাম। পথিমধ্যে তোমাদের ফিটন দেখে আমরা আমাদের রাগ ও ক্ষুধা মেটাতে তোমাদের উপর আক্রমণ করি। কিন্তু বিশ্বাস করো সেদিন তোমার মা বাবাকে আলফা খুন করেন নি৷ তিনি তোমার পিছু নিয়েছিলেন। তোমার মা বাবা আমাদের কাছে ছিলো। আমরা তাদের খুন করেছি। ”
ক্রিনার মুখে নিজের মা বাবার মৃত্যু সম্পর্কে এমন অকপটে সত্য শুনে ক্যাথরিনের ঘা আবার তাজা হয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না তার কি বলা উচিত। আরোণ তার মা বাবাকে মারে নি এটার জন্য খুশি হবে নাকি ক্ষনিকের জন্য এই নেকড়েদের আপন মনে করায় নিজের গালে দুটো চড় বসাবে সে? ক্যাথরিন উঠে যায় বসা থেকে। চলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয় তখনই ক্রিনা বলে,
” আমাদের ক্ষমা করে দিও ক্যাথরিন। কিন্তু আমরাও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই এই কাজ করি। আমরাও নিরুপায়। আমাদের জীবনই আমাদের এই নেকড়ে সত্তা নিয়ে টিকে থাকতে বাধ্য করেছে। ”
ক্যাথরিনের চোখে পানি টলমল করছে। সে পিছনে না ফিরেই ক্রিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” এমন অস্তিত্বর ধ্বংস হয়ে যাওয়াই উত্তম যেই অস্তিত্ব অন্য কাউকে অনাথ করে দেয়। ”
এটুকু বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না ক্যাথরিন। সেখান থেকে প্রস্থান করে তৎক্ষণাৎ।
রাত গভীর হয়েছে। কাস্টোরিয়ায় যেমন বসন্তকাল ছিলো, ট্রান্সেলভেনিয়ায় তার উল্টো। প্রচুর শীত। তীব্র তুষারপাত হচ্ছে বাহিরে। আনাস্তাসিয়া গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে। ম্যাথিউ আনাস্তাসিয়াকে এখন থেকে এই কক্ষেই থাকার আদেশ দিয়েছে। দূর্গের সবথেকে উঁচু কক্ষ এটা। অনেকটা চিলেকোঠার মতো বলা যায়। এই কক্ষের মেঝে কাঠের পাটাতনের তৈরী। কক্ষের বাহিরে একটি কালো আলখেল্লা পরিহিত ভৃত্য নিযুক্ত আছে পাহাড়ার জন্য। কক্ষের বাহিরে দেখতে কেমন তা সম্পর্কেও আনাস্তাসিয়া জানেনা। তার কক্ষের বাহিরে পা রাখার অনুমতি নেই।
চোখ বুজে শুয়ে আছে হঠাৎ আনাস্তাসিয়া কক্ষে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করে। বরফের মতো জমে যায় সে। মনে মনে ঠিক করে আজকে সে নিজের মনের দ্বিধা দূর করেই ছাড়বে। রিকার্ডোই প্রতি রাতে আসে নাকি তা প্রমাণ হয়ে যাবে আজকে। ধীরে ধীরে সেই অন্য কেউটা বিছানায় এসে আনাস্তাসিয়ার পিছনে বসে। কিছুটা ঝুকে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। আনাস্তাসিয়া তার কানে ফিসফিসিয়ে কারো কণ্ঠস্বর শুনে,
” এই যাত্রায় ও তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম নাসিয়া। ”
এটুকুর পর আর কোনো কথা শুনতে পারে না আনাস্তাসিয়া অপর পাশ থেকে। কিছুক্ষণ পর যখন সে অনুভব করে তার ঘাড়ের উপর থেকে গরম নিশ্বাস সড়ে যাচ্ছে তখন চকিতে আনাস্তাসিয়া সোজা হয়ে সেই কালো ছায়াটির শার্টের কলার টেনে ধরে। এতে সেই আগুন্তকঃ তার দিকে কিছুটা ঝুকে পড়ে। আনাস্তাসিয়া শান্ত স্বরে বলে উঠে,
” গতরাতে তুমিই এসেছিলে কারাগারে। ”
রিকার্ডো কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে আছে। হঠাৎ করে আনাস্তাসিয়ার কাছে ধরা খাওয়াটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো বটে। তবুও সে নিজের বিস্ময় দমিয়ে চোখে মুখে কঠিন করে বলে,
” হ্যাঁ। মারতে এসেছিলাম। কিন্তু তার আগেই নিজেই নিজের হাতের শিরা কেটে মরতে বসেছিলে। ”
” মারতে এসেছিলে নাকি বাঁচাতে? ”
রিকার্ডো তাচ্ছিল্যের সহিত হেসে বলে,
” মাথায় আঘাত পেয়েছো বুঝি? আবলতাবল বকছো খুব। ”
” আজকেও কি মারার উদ্দেশ্যে এসেছিলে? মারতে আসলে না মেরে কোথায় যাচ্ছো? ”
” তোমাকে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য নই আমি। ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর শার্টের কলার টেনে আরো কিছুটা নিজের দিকে নিয়ে আসে। তারপর রিকার্ডোর চোখে চোখ রেখে বলে,
” তুমি বাধ্য। ”
” অনাধিকার চর্চা আমার সবথেকে অপছন্দের কাজ। ”
” অধিকার আছে আমার। ”
রিকার্ডো বাকা হেসে বলে,
” অধিকার? কিসের অধিকার? ”
” তোমার প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছিলাম কাস্টোরিয়ায়। ভুলে গিয়েছো? সেদিন চাইলেই আমি ছুড়ি তোমার বুকে চালাতে পারতাম। কিন্তু আমি তা না করে গাছে ছুড়ি চালিয়েছিলাম। তোমার জীবন আমার দান। ”
রিকার্ডো এক হাত আনাস্তাসিয়ার গলার উপর নিয়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
” তোমার কি মনে হয়? তোমার সেই সামান্য ছুড়ি আমার প্রাণ নিতে সক্ষম? উল্টো আমি বলতে পারি যে আমার তোমার উপর অধিকার আছে। তুমি এখনো বেঁচে আছো, আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখাতে পারছো এই সব আমার কারণেই সম্ভব হয়েছে। কারণ আমি তোমার প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার গলা চেপে ধরে বলে,
” আমি খাঁটাবো আমার অধিকার? ”
রিকার্ডো এতো জোরে চেপে ধরেছে যে আনাস্তাসিয়ার মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসবে। তবুও সে কোনমতে বলে,
” মিথ্যুক তুমি। মিথ্যা বলেছিলে যে তোমার পরিবারে কেউ নেই। ”
” বিশ্বাস কেন করেছিলে আমার কথায়? ”
” নির্বোধ ছিলাম আমি। ”
” স্বীকার করছো তবে? ”
এই প্রশ্ন করে রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার গলা ছেড়ে দেয়৷ আনাস্তাসিয়া নিজের গলা ধরে উঠে বসে সাথে সাথে। মুখ বিতৃষ্ণাময় করে পাল্টা প্রশ্ন করে বলে,
” আমাকে সেদিন কোন পশুর রক্ত পান করিয়েছো জোর করে? ”
রিকার্ডো বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে দায়সারাভাবে জবাব দেয়,
” পশু না মানুষ। ”
আনাস্তাসিয়ার চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম হয়। তার পেট গুলিয়ে বমি পায়। কিন্তু বমি যেন গলায় এসে ঠেকেছে। আনাস্তাসিয়ার এমন অবস্থা দেখে রিকার্ডোর হাসি পায়। এইমাত্র সে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। সেদিন আনাস্তাসিয়াকে যে রক্ত সে পান করিয়েছিলো সেটি মানুষের নয় ভেড়ার রক্ত ছিলো। আনাস্তাসিয়া হাতের পাশে থাকা বালিশ রিকার্ডোর দিকে ছুড়ে মেরে রাগান্বিত স্বরে বলে,
” এই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাও এবং পারলে মরে যাও গিয়ে। ”
রিকার্ডো সোজা হয়ে বসে। নিজের হাসি চেপে রেখে চোখে মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে বলে,
” আমার দূর্গে থেকে আমাকেই হুকুম করছো? ”
” তোমার ভাগ্য ভালো যে আমি তোমাকে এখনো এই জানালা দিয়ে ছুড়ে নিচে ফেলে দিচ্ছি না। ”
রিকার্ডো উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
” শুনো মেয়ে। ম্যাথিউর কারণে এই দূর্গে জায়গা পেয়েছো দেখে নিজেকে খুব স্বাধীন ভেবে বসার ভুল করবে না। আর আমার সামনে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে কথা বলবে। নাহয় মেরে কৃষ্ণ সাগরে ভাসিয়ে দিবো। ”
আনাস্তাসিয়া বিরক্ত হয়। এই প্রাসাদে সবাই কথায় কথায় মেরে কৃষ্ণ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কি মজা পায় তার বুঝে আসে না। আনাস্তাসিয়াকে সেই অবস্থায় রেখেই রিকার্ডো নিরবে বেড়িয়ে যায়। আনাস্তাসিয়া ভাবনা থেকে বেরিয়ে যখন আশেপাশে তাকায় তখন দেখে রিকার্ডো আর কক্ষে নেই। আনাস্তাসিয়া বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” পিশাচ কোথাকার। মন তো চাচ্ছে মেরে ওকে রক্তের সাগরে ডুবিয়ে মারি। রক্ত পানের স্বাদ মিটে যাবে জনমের জন্য। ”
কক্ষে প্রবেশ করতেই সিসিলিয়া দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে কাউন্ট লোনেল। সিসিলিয়া এগিয়ে এসে লোনেলের পাশে বসে বলে,
” আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে কাউন্ট। ”
লোনেল চিন্তিত সুরে বলে,
” ড্রাগোস আজ আবার রাতে প্রাসাদ হতে সকলের অগোচরে বেড়িয়েছে। ”
” এতে চিন্তিত হওয়ার কি আছে? ”
” তোমার ছেলে যেদিন রাতে প্রাসাদ ছেড়ে বের হয় তার পরের দিনই যে রাজ্যে কোনো মেয়ের লাশ পাওয়া যায় তা সম্পর্কে যেমন তুমি কিছু জানোনা? ”
” ছেলে তো আর ধরা পড়ছে না। তাহলে এ নিয়ে অহেতুক ভাবছেন কেন আপনি? ”
” ভুলে যেও না ড্রাগোস এই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ কাউন্ট। সে ছাড়া এই সিংহাসনের আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই৷ তাকে খুব সচেতন থাকতে হবে। ”
সিসিলিয়া আনমনে বলে উঠে,
” হতেও তো পারে এই সিংহাসনের অন্য কোনো উত্তরাধিকারও আছে। ”
কাউন্ট লোনেল ভ্রু কুচকে পাশ ফিরে সিসিলিয়ার দিকে তাকায়। সিসিলিয়া লোনেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আপনি ভুলে যাচ্ছেন একশো বছর পূর্বে রাজ জোতিষ্যী ভারতানের করা ভবিষ্যৎ বাণী? মৃত্যুর পূর্বে আকাশের তারা দেখে তিনি ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছিলেন যে একদিন এই সাম্রাজ্যের এবং এই সিংহাসনের আসল উত্তরাধিকারী ফিরে আসবে। তার আগমনেই হেনরিকসদের শাসনামলের ইতি ঘটবে। সাম্রাজ্য আবার আলবার্টদের দ্বারা শাসন হবে। ”
” এসব যা-তা বলে আমার মাথা খারাপ করো না সিসিলিয়া। কাউন্ট লিও এবং কাউন্টেস ম্যারি একশো বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছে। ট্রান্সিলভেনিয়াতেই তাদের লাশ পচে তাদের অস্তিত্বও বিলিন হয়ে গিয়েছে। কাউন্ট লিওর ফেলে যাওয়া এই বিধ্বস্ত সাম্রাজ্যকে আমার পূর্বপুরুষ কাউন্ট লুকাস হেনরিকস সামলেছে। তাহলে কোন আলবার্ট আবার ফিরে আসবে? ”
” জানিনা কাউন্ট। কিন্তু জোতিষ্যীর বলে যাওয়া সেই শেষ কথা এতো বছর ধরে এই রাজ পরিবারের সকলে মনে রেখেছে। তাই ভয় হয় আমার। ”
” সকলে নয় কেবল তুমি মনে রেখেছো এই কথা। এসব কথা ভুলে নিজের ছেলের প্রতি মন দাও। ওকে বুঝাও নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে। কেবল এক যুদ্ধ জিতে আসাতেই তার যোগ্যতা প্রমাণ হয়ে যায় নি। আর এতো নারী আসক্ত হলে বলো বিয়ে করে প্রাসাদে নিজের স্ত্রী নিয়ে থাকতে। সাম্রাজ্যের সাধারণ নিচুস্তরের মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকা কি ওকে শোভা পায়? ”
এটুকু বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় লোনেল। সিসিলিয়া চুপচাপ বিছানায় বসে ভাবনায় মশগুল হয়ে থাকে। কাউন্ট লিও এবং কাউন্টেস ম্যারিকে এক শতাব্দী পর আজও এই সাম্রাজ্যের মানুষ মনে রেখেছে। তাদের গল্প এখনো সবার মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়৷ কেউ কেউ তো এমনটাও বলে যে কাউন্টেস ম্যারি এবং তার গর্ভের সেই সন্তান এই সাম্রাজ্যের জন্য অপয়া ছিলো। তাইতো সেই সন্তান গর্ভে আসতেই সাম্রাজ্যে এতো বড় দূর্যোগ নেমেছিলো।
সিসিলিয়ার এই কক্ষে একা থাকতে ভয় হয়। এই কক্ষেই কাউন্ট লিও এবং কাউন্টেস ম্যারি থাকতো। একা থাকলে প্রায়ই তার মনে হয় কাউন্ট লিও এবং কাউন্টেস ম্যারির অতৃপ্ত আত্মা এই কক্ষে ঘুরাফেরা করছে। পরে নিজেই আবার নিজেকে শান্তনা দেয় এ বলে যে ট্রান্সিলভেনিয়ার গন্ডি পেরিয়ে তাদের আত্মা কখনোই বুখারেস্টে পৌঁছাতে পারবে না।
সিসিলিয়া মনে মনে বলে,
” ঈশ্বর। এই সাম্রাজ্যে আলবার্টদের ছায়া যেন কখনো না পড়ে। রাজ জোতিষ্যী ভারতানের ভবিষ্যৎ বাণী যেন কখনোই সত্যি না হয়। ”
” কি হয়েছে ক্যাথ? বলবে তো? ”
আরোণ এই নিয়ে শতাধিকবার এই প্রশ্ন করে ফেলেছে ক্যাথরিনকে। কিন্তু ক্যাথরিন পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো বসে আছে মুখ ফিরিয়ে। আরোণ বলে,
” তুমি না বললে এখন আমি প্রাসাদের সবাইকে ডেকে প্রশ্ন করবো। তাদের কেউ না কেউ ঠিকই বলে দিবে যে কি হয়েছে তোমার। ”
এই পর্যায়ে ক্যাথরিন পিছনে ফিরে তাকায়। শান্ত স্বরে বলে,
” তুমি আমার মা বাবাকে মারো নি। ”
হঠাৎ ক্যাথরিনের মুখে এই কথা শুনে অবাক হয় আরোণ। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,
” হঠাৎ এই বিষয়ে কেন কথা বলছো? ”
” তোমাকে আমি এতবার নিজের মা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছি তবুও তুমি মুখ ফুটে একবারো কেন বলো নি যে তুমি আমার মা বাবাকে খুন করো নি? ”
আরোণ চোয়াল শক্ত করে বলে,
” কারণ এটা বললে মিথ্যা বলা হতো। ”
ক্যাথরিন অবাক হয়ে বলে,
” মানে? ”
” প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ভাবেই হোক আমিও দায়ী। আমার আদেশ না পেলে তারা তোমার মা বাবাকে মারতে পারতো না। ”
ক্যাথরিনের পুরনো ক্ষত আবার তাজা হয়ে উঠে। আরোণের জন্য কিছুটা নরম হয়ে আসা মন আবার বরফের মতো শক্ত হয়ে যায়। মুখ ফিরিয়ে বলে উঠে,
” আমি একা থাকতে চাই। ”
আরোণ বিনাবাক্য ব্যয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। নিজের কক্ষে ফিরে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। মনে মনে ভাবে ভাগ্য সবসময় তার সাথেই এতো নিষ্ঠুর কেন? সে তো এই জীবন কখনো চায় নি। তবুও এই জীবন সে পেলো। এই জীবনকে মানিয়ে নিয়ে যখন হিংস্র জানোয়ার হয়ে উঠলো তখন ক্যাথরিন কেন তার জীবনে এলো? আর ক্যাথরিনকেই যেহেতু সে ভালোবেসেছে তাহলে ক্যাথরিন সবসময় তার থেকেই কষ্ট কেন পায়? আরোণকে যদি এখন বলা হতো তুমি অমরত্ব চাও নাকি ক্যাথরিন তাহলে আরোণ নির্দ্বিধায় জবাব দিতো সে ক্যাথরিনকে চায়। কিন্তু এমন কোনো উপায় নেই কেন? নিজের সকল পাপ মুছে ক্যাথরিনকে আপন করে নেওয়ার কোনো উপায় নেই কেন? আরোণ রাগে হিংস্র স্বরে গর্জন করে উঠে। অতি রাগে তার শরীর কাপছে। ভিতরের নেকড়ে সত্ত্বা জেগে উঠে তার। আরোণ সাথে সাথে উঠে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। তার এখন শিকার প্রয়োজন। নেকড়ে সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করার এই এক উপায় তার কাছে।
ক্যাথরিন বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে আরোণের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। মনে মনে বলে,
” আমি কখনোই আরোণকে ভালোবাসতে পারি না। নিজের মা বাবার খুনীকে ভালোবাসা কখনোই সম্ভব না আমার দ্বারা। একজন জানোয়ারকে কখনোই ভালোবাসা সম্ভব না আমার দ্বারা। সে আমাকে যতই ভালোবাসুক না কেন তবুও এই সত্যি কখনোই বদলাবে না যে সে একজন নেকড়ে। আর নেকড়েদের জঙ্গলেই মানায়, মানুষের মনে নয়। ”
এটুকু বলতেই ক্যাথরিনের গাল গড়িয়ে এক বিন্দু অশ্রু পড়ে। সাথে সাথে সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। চোখে মুখে কাঠিন্য ভাব নিয়ে বলে,
” জানোয়ারদের মানুষের ব্যবহার উপহার দিয়ে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি আমি। জানোয়ারদের সাথে এখন থেকে তেমন ব্যবহারই করবো যেমন ব্যবহার এরা প্রাপ্য। ”
কক্ষ থেকে বের হতেই অবাক হয় আনাস্তাসিয়া। সিড়ি দেখে তার প্রায় মাথা ঘুরানোর উপক্রম। সে জানতো সে খুব উঁচু কক্ষে আছে কিন্তু তাই বলে যে এই কক্ষে পৌঁছাতে এতো এতো সিড়ি পাড় করতে হয় তা সে ধারণা করে নি। গোল হয়ে সিড়ি গুলো একদম নিচে গিয়ে পৌঁছিয়েছে। আনাস্তাসিয়া তার পাশে বিরক্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো আলখেল্লা পরিহিত লোকটাকে প্রশ্ন করে,
” তোমার নাম কি? ”
লোকটা বিরক্তি নিয়ে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
” জোসেফ। ”
আনাস্তাসিয়া হালকা হেসে প্রশ্ন করে,
” জোসেফ আমাদের এই সিড়ি পেরিয়েই নিচে যেতে হবে? ”
এরকম বোকা প্রশ্ন শুনে জোসেফ মুখ পানসে করে বলে,
” এটা কি ধরনের প্রশ্ন? ”
” মানে এই সিড়ি ধরে নিচে যেতে যেতে আমার একমাস সময় পেরিয়ে যাবে। এর থেকে ভালো না আমি কক্ষেই থাকি। তোমার কাউন্টকে বলো কক্ষে এসে আমার সাথে দেখা করতে। ”
জোসেফ চোখ বাকা করে বলে,
” তুমি চাইলে আমি তোমাকে এখান থেকে ধাক্কা দিতে পারি। তাহলে তোমার একমাস সময় লাগবে না। কম সময়েই পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু নিচে না সোজা উপরে। ”
আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে বলে উঠে,
” কোনো প্রয়োজন নেই। এর থেকে ভালো আমি নিচেই নামি। শুধু শুধু উপরে গিয়ে লাভ কি আমার? ”
জোসেফ আর কথা না বাড়িয়ে আনাস্তাসিয়ার পিছু পিছু সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে। প্রায় সত্তুর ধাপ সিড়ি পেরিয়েই আনাস্তাসিয়া বসে পড়ে। ক্লান্ত স্বরে কোমর ধরে বলে উঠে,
” কোন অসভ্য এই দূর্গ তৈরী করেছে? আর কোন অসভ্য আমাকে এই কক্ষে থাকতে দিয়েছে? এর থেকে তো ওই কারাগারেই ভালো ছিলাম আমি। অন্তত আমার কোমরের উপর অমানবিক অত্যাচার তো হতো না সেখানে। ”
জোসেফ বলে উঠে,
” এই কিছু সময়ের সিড়ি পেরিয়ে নামতে তুমি ঘন্টা পার করে দিচ্ছো মেয়ে। ”
আনাস্তাসিয়া মুখ গোমড়া করে বলে,
” এই রাস্তা তোমার কিছু সময়ের মনে হচ্ছে? এর থেকে তাড়াতাড়ি তো কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দেওয়া যায় আমার মনে হয়। কোন অমানুষ আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় এতো উপরের কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলো? ”
” তোমার এতো বড় সাহস তুমি কাউন্টকে অমানুষ বলছো? ”
আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে মাথা তুলে তাকায় জোসেফের দিকে। তারপর প্রশ্ন করে,
” কাউন্ট? কাউন্ট রিকার্ডো? ওই ভ্যাম্পায়ার? সে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় কোলে করে এতো উপরের কক্ষে নিয়ে এসেছিলো? ”
জোসেফ বলে,
” মেয়ে অতিরিক্ত কথা বলছো তুমি। চুপচাপ নিচে নামো৷ ”
আনাস্তাসিয়া মুখ বাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হনহনিয়ে পা ফেলে নিচে নামতে থাকে সে। মনে মনে সিড়িগুলোকে গালি দিতে থাকে সে৷
মাতাল অবস্থায় প্রাসাদে ফিরে আসে ড্রাগোস। সেনাপতি বেঞ্জামিনের কাধে ভর করে নিজের কক্ষের দিকে যাচ্ছে সে। কক্ষের দরজা খুলতেই ভয় পেয়ে যায় বেঞ্জামিন। ড্রাগোসের কক্ষে কাউন্ট লোনেল দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাগোসকে দেখেই লোনেল বলে,
” বেঞ্জামিন আমি প্রিন্স ড্রাগোসের সাথে একান্তে কথা বলতে চাই। তুমি যেতে পারো এখন। ”
বেঞ্জামিন মাথা নত করে দরজা চাপিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে যায়। কাউন্ট লোনেল এগিয়ে এসে বলে,
” রোমানিয়ান প্রিন্স ড্রাগোস সারা রাত বাহিরে থেকে সকাল সকাল মাতাল হয়ে মুখ লুকিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসে। এরকম প্রিন্সের হাতে আমি নিজের সাম্রাজ্য কোন ভরসায় দিবো? ”
ড্রাগোস লোনেলের কথায় পাত্তা না দিয়ে বিছানায় গিয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। লোনেল হতাশ হয়ে ড্রাগোসের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। বেঞ্জামিন বাহিরেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। লোনেল তাকে ডেকে বলে,
” যা করে এসেছে তার সব প্রমাণ মিটিয়ে এসেছো? ”
” জ্বি কাউন্ট। মেয়েটার লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে সেই বস্তা পাথর দিয়ে বেধে ট্রান্সিলভেনিয়ার সীমান্তের লেকে ফেলে দিয়ে এসেছি। ”
” খেয়াল রাখবে যেন কেউ সেই লেকের কাছেও না ঘেঁষে। ”
” আপনি চিন্তা করবেন না কাউন্ট। সেই লেককে রাজ্যের সকলেই অভিশপ্ত মনে করে। আবার সেটা ট্রান্সিলভেনিয়ার সীমান্তে। ওই নিশ্চুপ ভয়ংকর জায়গায় কেউ পা মাড়ানোরও সাহস করবে না। ”
কাউন্ট লোনেল মাথা নেড়ে বলে,
” প্রিন্স ড্রাগোস ঘুম থেকে উঠলে তাকে সর্বপ্রথম আমার সাথে দেখা করতে বলবে। ”
” যা হুকুম কাউন্ট। ”
একটি বিশাল কক্ষের মাঝে ছোট গোল পুকুরের মতো জায়গা। গোছল করার কক্ষ এটা তা স্পষ্ট। আনাস্তাসিয়া বুঝতে পারছে না তাকে এখানে কেন ডেকেছে রিকার্ডো। এই ছোট পুকুরে ডুবিয়ে মারার ফন্দী এঁটেছে নাকি? মারার হলে রিকার্ডো চাইলেই আনাস্তাসিয়াকে উপরে গিয়ে কক্ষের জানালা দিয়ে ফেলে মেরে ফেললেই পারতো। তাতে আনাস্তাসিয়ার কষ্ট একটু কম হতো। শুধু শুধু আনাস্তাসিয়াকে টেনে নিয়ে নিচে আনার কোনো মানে হয়?
আনাস্তাসিয়া আড়চোখে জোসেফের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এখানে এখন কি করবো আমি? ”
” অপেক্ষা করো চুপচাপ। কাউন্ট আসছে। ”
এটুকু বলে জোসেফ বেরিয়ে চলে যায়। আনাস্তাসিয়া বিরক্ত হয়ে চারিদিকে ঘুরে কক্ষটি দেখতে থাকে। পুরো কক্ষ জুড়ে সাদা পর্দার বিচরণ। পুকুরের পানির উপর বিভিন্ন রঙের ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া পুকুরের সামনে গিয়ে সামান্য ঝুকে পানিতে হাত ডুবিয়ে দেখছিলো। হালকা কুসুম গরম পানি। আনাস্তাসিয়া বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” বিলাসিতা দেখে তো মনে হয় যেন সে নিজেই রোমানিয়ান প্রিন্স কোনো। ”
” প্রিন্স নই কাউন্ট। ”
হঠাৎ কারো কণ্ঠ শুনে আনাস্তাসিয়া আকস্মিক পিছনে ফিরে তাকায়। তাড়াহুড়ো করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে উল্টো আরো পা পিছলে পুকুরে পড়ে যায়। সাতার কেঁটে সোজা হয়ে দাঁড়ায় আনাস্তাসিয়া পুকুরের মাঝে। তার হালকা গোলাপি গাউন ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। আনাস্তাসিয়া সামনে তাকিয়ে দেখে রিকার্ডোর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আনাস্তাসিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” কাউন্ট আমি কোভেনদের। কোনো সাম্রাজ্যের প্রিন্স নই। ”
আনাস্তাসিয়া কোনো জবাব দিতে পারে না। সে তাকিয়ে আছে রিকার্ডোর দিকে। কালো ব্রীচেস প্যান্ট পড়ে উদম দেহে দাঁড়িয়ে আছে সে। শরীর ও মাথার বাদামী চুল বেয়ে টুপটুপ করে বিন্দু বিন্দু পানি পড়ছে। একহাতে একটি সাদা কাপড় দিয়ে মাথার চুলগুলো মুছতে মুছতে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” দৃষ্টি সংযত কর আনাস্তাসিয়া। এই ভ্যাম্পায়ার এতো আহামরি কোনো সুন্দর না যে তোর একে চোখ দিয়ে গিলে খেতে হবে। ”
” চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া শেষ হয়েছে তোমার? ”
আনাস্তাসিয়া চমকে যায়। এই ভ্যাম্পায়ার তার কথা কিভাবে শুনে ফেলল? আনাস্তাসিয়ার মনে পড়ে সে ওই ডায়েরিতে পড়েছিল যে ভ্যাম্পায়ারদের শ্রবণশক্তি খুব প্রখর। আনাস্তাসিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে পুকুর থেকে উঠে আসতে আসতে বলে,
” আমি মোটেও তোমায় চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলাম না। উল্টো তুমি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলে। ”
এটুকু বলে আনাস্তাসিয়া গাউনের নিচের অংশ চেপে পানি ঝেড়ে নেয়। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কথার কোনো প্রতিবাদ করে না। নিজের মতো চুল মুছতে থাকে সে। আনাস্তাসিয়া আবার তাকায় রিকার্ডোর পেশিবহুল হাতের দিকে। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” তোমার আমাকে মারার এতো শখ থাকলে আমাকে উপরে কক্ষে গিয়েই জানালা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে আসতে পারতে। শুধু শুধু আমাকে কষ্ট করিয়ে নিচে কেন ডাকলে? তাও এই ছোট পুকুরে ডুবিয়ে মারতে? তুমি হয়তো জানোনা আমি ছোট থেকে সমুদ্রে সাতার কেঁটে বড় হয়েছি। এসব ছোট খাটো পুকুরে ডুবিয়ে আমাকে মারতে পারবে না তুমি। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে তাকায় আনাস্তাসিয়ার দিকে। হাতের সাদা কাপড়টা মাথা থেকে নামিয়ে প্রশ্ন করে,
” তোমাকে আমি এখানে ডুবিয়ে মারবো সেটা তোমাকে কে বললো? ”
” মারার না হলে তাহলে কেন ডেকেছো আমায়? ”
” দূর্গে তুমি পায়ের উপর পা তুলে রাণীর হালে জীবন কাটানোর পরিকল্পনা করে যেন না বসো সেজন্য ডেকেছি। ”
” মানে? ”
” মানে তুমিও বাকি সব দাস দাসীদের মতো দূর্গের কাজ করবে। ”
” আমি কারো দাসী নই। ”
আনাস্তাসিয়া প্রতিবাদের সুরে বলে। রিকার্ডো হালকা হেসে বলে,
” ভুলে গিয়েছো ম্যাথিউ কিসের বিনিময়ে তোমার জীবন দান নিয়েছে আমার থেকে? দাসী হিসেবে থাকবে যেহেতু সেহেতু কাজ তো করতেই হবে। ”
” আমি কোনো কাজ করতে পারবো না। ”
” সেটা আমার দেখার বিষয় না। তুমি কোনো কাজ না করলে প্রতিদিন এক গ্লাস করে মানুষের রক্ত পান করাবো তোমাকে। সেটা হয়তো তোমার বেশি পছন্দ হবে। ”
আনাস্তাসিয়ার মুখ হা হয়ে যায়। সে ভাবতেও পারে নি রিকার্ডো এভাবে তাকে কথার জালে ফাসাবে। রাগে ক্রোধে ফুসতে ফুসতে সে বলে,
” কি কাজ করতে হবে আমার? ”
” প্রতিদিন আমি গোছল করতে আসার আগে এই জায়গা সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখবে। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” আমাকে তাহলে নিচে কোনো কক্ষ দাও। আমি প্রতিদিন এতো সিড়ি বেয়ে উপর থেকে নামতে পারবো না। ”
রিকার্ডো বাহিরে অপেক্ষারত জোসেফকে ডাকে। জোসেফ আসতেই রিকার্ডো বলে,
” এই মেয়ের জন্য সেই চিলেকোঠার কক্ষই বরাদ্দ করা হলো। যদি প্রতিদিন তার উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নামতে কষ্ট হয় তাহলে ওর কষ্ট কমানোর জন্য ওকে ধাক্কা মেরে নিচে পৌঁছে দিবে। বুঝতে পেরেছো? ”
” ঠিকাছে কাউন্ট। ”
আনাস্তাসিয়া বিরক্তি নিয়ে বলে,
” এতো নাটক না করে নিজেই আমাকে কোলে করে উপরে দিয়ে আসলে পারো সেদিনের মতো। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” কোন দিনের মতো? ”
” জোসেফ বলেছে। যেদিন আমি অজ্ঞান ছিলাম তুমি আমাকে উপরের কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলে। ”
রিকার্ডো সাথে সাথে চোখ পাকিয়ে জোসেফের দিকে তাকায়। জোসেফ মাথা নত করে বলে,
” ক্ষমা করুন কাউন্ট। এই মেয়ে এতো বেশি কথা বলে যে আমার মাথাও খেয়ে দিয়েছিলো। ভুলে আমি বলে ফেলেছি। ”
রিকার্ডো চোয়াল শক্ত করে বলে,
মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৫+২৬
” নিজের মুখ সামলাতে না পারলে বলবে একদম জিভ কেটে দিবো। তাহলেই আর ভুল করে কিছু বলতে পারবে না তুমি। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো পাশে থেকে নিজের একটি শার্ট নিয়ে পড়তে পড়তে বেরিয়ে যায়। আনাস্তাসিয়া জোসেফের দিকে তাকিয়ে দেখে জোসেফ তার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” কি সমস্যা তোমার? ”
” আর একবার তুমি একটাও কথা বলে যদি আমার মাথা খেয়েছ তাহলে মেরে একদম কৃষ্ণ সাগরে ভাসিয়ে দিবো। ”
আনাস্তাসিয়া মনে মনে বলে,
” এই দূর্গের সবার কৃষ্ণ সাগর এতো প্রিয় হলে নিজেরা সেখানে ডুবে মরতে পারে না? ”
