মহাপ্রয়াণ পর্ব ৩৩+৩৪
নাফিসা তাবাসসুম খান
ম্যাথিউ ভেবেছিলো যে আনাস্তাসিয়া মারা গেলে হয়তো তার জন্য ভালোই হবে। হয়তো তার মনের অস্থিরতা কমে যাবে আনাস্তাসিয়ার প্রতি। কিন্তু আনাস্তাসিয়া মৃত এটা ভাবতেই তার মনে একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে সে। রিকার্ডোর সাথে এইমাত্র দেখা হয়েছিলো তার। রিকার্ডো তাকে বলে যে আনাস্তাসিয়াকে এতক্ষণে মেরে জ্যাকসন হয়তো তাকে আহার হিসেবে গ্রহনও করে ফেলেছে। ম্যাথিউ মনে মনে নিজেকে শাসিয়ে বলে,
” আমি দূর্বল নই। ভ্যাম্পায়ারা দূর্বল হয় না কখনো। আমি কখনোই আর ওই মেয়েকে নিয়ে ভাববো না। এক-দুই দিন এর ব্যাপার। তারপর আমি ওই মেয়েকে ভুলে যাবো। ”
ক্যাথরিন এবং আরোণ হলরুমে একসঙ্গে প্রবেশ করতেই সকলে বেশ অবাক হয়। সবার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির উত্তর হিসেবে আরোণ বিনাবাক্য ব্যয়ে ক্যাথরিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হেসে সামনে তাকায়। আরোণের এরকম কাণ্ডে প্রথম সবাই অবাক হলেও পরে ক্যাথরিনের হাস্যোজ্বল মুখ দেখে তাদের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। ক্রিয়াস বলে উঠে,
” আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? ”
ক্যাথরিন মাথা নেড়ে বলে,
” তুমি এখন সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় আছো এবং এটা কোনো স্বপ্ন না। ”
সঙ্গে সঙ্গে সকলের মাঝে খুশির রোল পড়ে যায়। আরোণ তাকিয়ে আছে ক্যাথরিনের দিকে। ক্যাথরিন আরোণের দিকে তাকাতেই হালকা হাসি বিনিময় করে। আরোণ ক্যাথরিনের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তুমি এখন কক্ষে যাও। আমি কিছু কাজ শেষ করে আসছি। ”
ক্যাথরিন মাথা নেড়ে বলে,
” অপেক্ষা করবো। ”
আরোণ হালকা হাসতেই ক্যাথরিন হলরুম থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে সাথেই আরোণের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
” শত্রু শেষ করার সময় এসে পড়েছে। জ্যাকসনকে পৃথিবীর যে কোনো কোণা থেকে খুঁজে বের করে খুন করতে হবে। ও জীবিত থাকতে ক্যাথরিন নিরাপদ নয়। আর আমি ক্যাথরিনের নিরাপত্তা নিয়ে নূন্যতম গাফলতি মেনে নিবো না। ”
ক্রিনা বলে,
” কিন্তু আমরা তাকে খুঁজে পাবো কোথায় আলফা? ”
আরোণ বলে উঠে,
” পুরো রোমানিয়ায় সকলে ছড়িয়ে পড়ো। প্রতিটা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজবে। জ্যাকসন আর মার্থাকে যেখান থেকে পারো ধরে নিয়ে আসবে। ওদের নিজ হাতে খুন করবো আমি। ”
সকলে একসাথে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
জুন এবং জেনি আনাস্তাসিয়ার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু আনাস্তাসিয়ার চোখে ঘুম নেই। জোয়ান্দ্রা একটু আগে এসে বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু আনাস্তাসিয়া বললো ওরা ঘুমিয়ে আছে শুধু শুধু উঠে যাবে। তাই জোয়ান্দ্রা আর আপত্তি করে নি। নিজের কক্ষে ফিরে যায়। জোসেফের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দরজায় কারো করাঘাতের শব্দ শুনতেই আনাস্তাসিয়া উঠে বসে। মাথা ধরে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নেমে তাড়াতাড়ি কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। জোসেফ ফিরেছে। জোয়ান্দ্রা দরজা খুলে দিয়েছে উঠে। আনাস্তাসিয়াকে কক্ষ থেকে বের হতে দেখে জোসেফ প্রশ্ন করে,
” তুমি এখনো ঘুমাও নি? ”
আনাস্তাসিয়া কিছু বলার পূর্বেই জোয়ান্দ্রা বলে,
” ওর হয়তো এখনো মাথা ব্যাথা করছে। তাই ঘুমোতে পারছে না। আঘাত এখনো তাজা আছে। ”
আনাস্তাসিয়া জোসেফের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সাথে কথা ছিলো। ”
জোসেফ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” এখন? ”
” হ্যাঁ। যদি তুমি কিছু মনে না করো। ”
জোসেফ জোয়ান্দ্রার দিকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি অপেক্ষা করো। আমরা উঠোনেই আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বো। ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জোসেফ। বাসার সামনে জ্বলজ্বল করা চারটি লণ্ঠনের আলোয় উঠোনটা মৃদু আলোকিত হয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া জোসেফের সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে প্রশ্ন করে,
” তুমি আমাকে দূর্গে না নিয়ে তোমার বাসায় কেন নিয়ে এসেছো? ”
আনাস্তাসিয়ার প্রশ্ন শুনে জোসেফের ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। বিরক্তির সুরে সে বলে উঠে,
” দূর্গের সকলে ভাবছে জ্যাকসন হয়তো তোমাকে মেরে ফেলেছে। তাই তোমার পিছনে আর কেউ আসবে না। যতদিন না সুস্থ হও এখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। তারপর তুমি চাইলে নিজের দেশে ফেরত যেতে পারো। বললে আমি ব্যবস্থা করে দিবো। ”
আনাস্তাসিয়া সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
” আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো? ”
” আমার মনে হয় মাথায় সত্যিই তুমি জোরে আঘাত পেয়েছো। তাই আমি কি বলছি তা বুঝতে পারছো না। তুমি এখন স্বাধীন। দাসী হিসেবে আর দুর্গে থাকতে হবে না তোমার। তোমার খুশি হয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। তুমি উল্টো সন্দেহ করছো। ”
” ওই জ্যাকসন কে ছিলো? আর ও নেকড়ের রূপ কীভাবে ধারণ করেছিল? ”
” তোমার এতো কিছু জানার কোনো প্রয়োজন নেই। কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ”
আনাস্তাসিয়া এবার কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বলে উঠে,
” আমি বুঝতে পেরেছি তোমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি। তাই তোমার আমাকে কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। আমি সরাসরি তার থেকে উত্তর নিবো যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। ”
” মানে? ”
” গতরাতে যখন তোমার কাউন্ট ফিটনে করে আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে আসছিলো তখন এক দণ্ডের জন্য আমার জ্ঞান ফিরেছিলো। ”
জোসেফ অবাক হয়ে যায়। এই মেয়ের থেকে কথা লুকানো এতো কঠিন কেন? জোসেফ কঠিন গলায় জবাব দেয়,
” সেটা তোমার ভ্রম ছিলো কেবল। ”
” ভ্রম এবং বাস্তবতার মাঝের পার্থক্য সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানি আমি। ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়া ভিতরে যাওয়ার জন্য উল্টো ঘুরে দু কদম বাড়ায়। হঠাৎ আবার পিছনে ফিরে বলে,
” তোমার কাউন্টকে বলে দিও আনাস্তাসিয়া তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। যদি সে না আসে তবে আমি তার পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তা খুঁজে নিবো। ”
আনাস্তাসিয়া ভিতরে চলে যেতেই জোসেফ পায়চারি করা শুরু করে। সে পড়েছে মহাবিপদে। কাউন্টকে সে কিভাবে গিয়ে এই কথা বলবে? জোসেফ মনে মনে নিজেকে বলে,
” তোর মৃত্যু এই মেয়ের কারণেই হবে জোসেফ। হয় এই মেয়ে আমাকে একদিন জানালা থেকে ছুড়ে ফেলে মারবে আর নাহয় এই মেয়ের কারণে কাউন্ট আমাকে কৃষ্ণ সাগরে ছুড়ে ফেলে মারবে। ”
হলরুমে সকল কোভেনরা উপস্থিত আছে। সকলের দৃষ্টি রিকার্ডোর দিকে স্থির। রিকার্ডো বলে,
” জ্যাকসনকে খুঁজে বের করে খুন করা এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য। ওর এতো বড় সাহস ও আমার দূর্গে এসে আমার মা কে নিয়ে আমাকে হুমকি দেয়৷ ”
ম্যাথিউ হালকা স্বরে বিদ্রুপ করে বলে,
” আমার মা। ”
সকলে হলরুম থেকে বেরিয়ে যেতেই জোসেফ হলরুমে প্রবেশ করে। জোসেফকে দেখে রিকার্ডো উঠে তার দিকে এগিয়ে যায়। একদম ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,
” ওই জংলী মেয়ের কি অবস্থা এখন? ”
জোসেফ ভেবে পায় না রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার এতো চিন্তা করলে ওকে আবার জংলী মেয়ে ডাকে কেন? অবশ্য রিকার্ডো ভুল নাম দেয় নি। এই মেয়েটা আসলেই জংলী। জোসেফ মাথা নত করে উত্তর দেয়,
” এখন ঠিক আছে কাউন্ট। ”
” সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলে ওকে নিরাপদে গ্রীকে ফেরার ব্যবস্থা করে দিবে। আমি এই আপদকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করতে চাই। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো চলে যেতে নেয়। জোসেফ অনেক সাহস করে রিকার্ডোকে পিছুডাকে। রিকার্ডো ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই জোসেফ বলে,
” আনাস্তাসিয়া আপনার সাথে দেখা করতে চায়। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে বলে,
” কি বললে? ”
জোসেফ ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয়। আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
” আনাস্তাসিয়া জানে ওকে আমি নই আপনি বাঁচিয়েছেন। ”
” ওকে এটা কে জানিয়েছে? ”
জোসেফ সাথে সাথে এক হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে বলে,
” আমি বলি নি কাউন্ট। বিশ্বাস করুন। আনাস্তাসিয়ার ওদিন রাতে কিছু মুহূর্তের জন্য জ্ঞান ফিরেছিলো। ও ফিটনে আপনাকে দেখেছে নিজের সাথে। ”
রিকার্ডো দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
” এই মেয়ের সবসময় ভুল জিনিস দেখার, ভুল কথা শোনার এবং ভুল জায়গায় উপস্থিত থাকার রোগ আছে। ”
রিকার্ডো কিছু না বলে চলে যেতে নেয় তখনই জোসেফ আবার পিছু ডাকে। রিকার্ডো বিরক্ত হয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
” কি সমস্যা জোসেফ? আমাকে বিরক্ত করছো কেন? মৃত্যুর শখ জেগেছে? ”
” আনাস্তাসিয়া বলেছে আপনি যদি ওর সাথে দেখা করতে না আসেন তাহলে ও নিজ দায়িত্বে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে দেখা করার জন্য। ”
রিকার্ডোর রাগ হয়। সে বুঝে পায় না এই মেয়ের সমস্যা কি? একে স্বাধীনতা দিলেও সমস্যা, বন্দী করে রাখলেও সমস্যা। রিকার্ডো জোসেফের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আজ মাঝরাতে ওই জংলী মেয়েকে নিয়ে তোমাদের গ্রামের গোরস্থানের পিছনের জঙ্গলে আসবে। ওর আমার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা আজীবনের জন্য ঘুচিয়ে দিবো। ”
” আমি আগে থেকেই জানতাম তুমি আলফাকে ভালোবাসো। ”
কথাটি বলতে বলতে একটি চেরি মুখে দেয় লোল্যান্ডা। ক্যাথরিন হাসতে হাসতে বলে,
” আমিও জানি যে তুমি ক্রিয়াসকে পছন্দ করো। ”
” হু। কিন্তু ওর মনে আমাকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই। ”
” তুমি কি নিশ্চিত? ”
” হ্যাঁ। ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। ”
ক্যাথরিন এবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে। অবাক হয়ে বলে,
” কিভাবে সম্ভব? আমি তো কখনো ক্রিয়াসকে কারো সাথে ওভাবে দেখি নি। ”
” ক্রিয়াস যাকে ভালোবাসে সে পৃথিবীতে নেই। ”
ক্যাথরিন এবার অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে আসে,
” কি? ”
লোল্যান্ডা কিছুটা মন খারাপ করে বলে,
” ক্রিয়াস একজন মানবীকে ভালোবাসতো। সেই মেয়েটাও ওকে ভালোবাসতো। কিন্তু ক্রিয়াসের সাথে শত্রুতার হিসেব মেটাতে একজন ভ্যাম্পায়ার ওই মেয়েটাকে মেরে ফেলে। এরপর ক্রিয়াস আর কখনো কাউকে ভালোবাসে নি। ”
” তুমি এসব কিভাবে জানো? ”
” ক্রিয়াস নিজে আমায় এসব বলেছে৷ ”
ক্যাথরিনের মন খারাপ হয়। দরজায় করাঘাত হতেই লোল্যান্ডা বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। আরোণ কক্ষে প্রবেশ করতেই লোল্যান্ডা কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। আরোণ ক্যাথরিনের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
” দিন কেমন কাটলো তোমার? ”
ক্যাথরিন মন খারাপ করে বসে রয়। আরোণের দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টি। সে হাত বাড়িয়ে ক্যাথরিনের হাতের উপর হাত রাখে। ক্যাথরিন আরোণের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে এগিয়ে তার বুকে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। আরোণ প্রশ্ন করে,
” মন খারাপ কেন? ”
” ক্রিয়াস কাউকে ভালোবাসতো জানো? ”
আরোণ বুঝতে পারে কি নিয়ে ক্যাথরিনের মন খারাপ। সে উত্তর দেয়,
” হুম। ”
” মেয়েটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ”
” হুম। ”
ক্যাথরিন এবার প্রশ্ন করে,
” আমিও তো কখনো না কখনো মারা যাবো, কিন্তু তুমি আজীবন রয়ে যাবে। তুমিও কি কখনো আর কাউকে ভালোবাসবে না? ”
হঠাৎ ক্যাথরিনের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আরোণ অবাক হয়। সে পাল্টা প্রশ্ন করে,
” তোমায় কে বলেছে যে আমার অমরত্ব রয়েছে? ”
” নেই বুঝি? ”
” আছে৷ কিন্তু আমাকে মারার অস্ত্রও রয়েছে। ”
ক্যাথরিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
” অস্ত্র? ”
আরোণ ক্যাথরিনকে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
” আমার সাথে চলো। ”
ক্যাথরিনকে নিয়ে নিজের কক্ষে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় আরোণ। তারপর তার বিছানার পাশে দেয়ালের একটি চিত্রকর্ম নামিয়ে সেখানের একটি বড়সড় পাথর টান দিয়ে সেটা সড়িয়ে বের করে আনে আরোণ। ক্যাথরিন দেখতে পায় পাথরটি সড়তেই সেখানে ভেতরে কাপড় দ্বারা পেঁচানো কিছু একটা রাখা আছে। আরোণ সেটা হাতে নিয়ে ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্যাথরিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে কাপড়টি খুলে ভেতর থেকে একটি খঞ্জর বের করে আনে। তারপর নিজেই বলে,
” এই খঞ্জর দ্বারা আমার জীবন শেষ করা সম্ভব। ”
” একটি সামান্য খঞ্জর তোমার কি ক্ষতি করতে পারবে? ”
” এটা কোনো সামান্য খঞ্জর নয় ক্যাথ। এই খঞ্জরে বিশেষ কিছু আছে যা একজন নেকড়ে আলফার জীবন নিতে সক্ষম। এই সম্পর্কে আর কেউ অবগত নয় তুমি, আমি এবং যে এই খঞ্জর তৈরি করেছে সে ছাড়া। আজ পর্যন্ত এই খঞ্জর ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব করি নি আমি কখনো। কিন্তু যদি কখনো বিধাতা তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নেয় তবে সেদিন এই খঞ্জর ব্যবহার করবো আমি। তুমি জীবনে আসার আগে জীবন আপন গতিতে চলছিলো ক্যাথ। কিন্তু তুমি আসার পর এখন তোমাকে ছাড়া নিজের জীবন কল্পনাও করতে পারি না আমি। ”
ক্যাথরিনের চোখেমুখে বিস্ময়। সে বলে উঠে,
” এসব কেবল পাগলামি আরোণ। জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। ”
” পাগলামি হলে পাগলামিই বলো। ”
” আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও আমি থাকি বা না থাকি কখনো এধরণের পাগলামি করতে যাবে না তুমি। ”
” তোমার ঈশ্বরও তো এটাই বলেছে ক্যাথ। একদিন সকলকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে। তুমি কি এখন মৃত্যুর বিরুদ্ধে যেতে চাও? ”
” ভালোবেসেছি আমি আরোণ। ভালোবেসে স্বার্থপর হয়েছি আমি। আর নিজের জীবন নেওয়াও পাপ। আমি চাইনা তুমি কখনো এই পাপ করো। ”
” পাপে ভরা জীবন আমার। পাপীকে বলছো পাপ না করতে? ”
” ক্ষমা চাও ঈশ্বরের কাছে। সকল পাপ ক্ষমা করবেন তিনি। ”
আরোণ তাকিয়ে থাকে ক্যাথরিনের দিকে। ক্যাথরিন এগিয়ে এসে আরোণকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” বুখারেস্ট যাই চলো। ওখানে গিয়ে চার্চে যাবো আমরা। ক্ষমা চাইবে তুমি। আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি ঈশ্বরও তোমায় ক্ষমা করবেন। ”
ফিটন থেকে নামতেই আনাস্তাসিয়ার ভয় হয়। তার সামনে একটি গোরস্থান। জোসেফ তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে? উহু সে ভুল ভাবছে। তার ভাবা উচিত রিকার্ডো তাকে এখানে কেন ডেকেছে? দেখা করার জন্য কি জায়গার অকাল পড়েছিলো রোমানিয়ায়? রিকার্ডো তো চাইলেই তার প্রিয় কৃষ্ণ সাগরের তীরে আনাস্তাসিয়ার সাথে দেখা করতে পারতো। কিন্তু এই গোরস্থানেই কেন আসতে বললো? যাতে মেরে একেবারে এখানেই সমাধি দিতে পারে? ঝামেলা কম করার জন্য?
জোসেফের ডাকে আনাস্তাসিয়ার স্তম্ভিত ফিরে। জোসেফ বলে,
” চলো তাড়াতাড়ি। ”
আনাস্তাসিয়া কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। গোরস্থানের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আনাস্তাসিয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিলো। সে সুযোগ বুঝে মাটি থেকে একটা গাছের লম্বা ডালা তুলে ক্লকের ভেতর লুকিয়ে ফেলে। কিছুটা সামনে যেতেই সে দেখে গোরস্থান পেরিয়ে তারা জঙ্গলের দিকে এগোচ্ছে। আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে জোসেফের পিছু পিছু যেতে থাকে। আবার সে আরেক হাতে লুকিয়ে মাটি থেকে একটা পাথর তুলে ক্লকের ভেতর লুকিয়ে ফেলে। রিকার্ডো বা জোসেফ যদি তাকে মারতে আসে তাহলে একজনকে গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে সে ছাল তুলে ফেলবে আর আরেকজনকে পাথর মেরে মাথা ফাটিয়ে দিবে বলে মনে মনে ঠিক করে। কিছুদূর যেতেই একটা জায়গায় এসে জোসেফ থামে। আনাস্তাসিয়া লক্ষ্য করে দেখে জোসেফের থেকে কয়েক হাত দূরে লম্বা কালো ক্লক পড়া একজন দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় হুড তোলা। গায়ের গড়ন দেখে আনাস্তাসিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা রিকার্ডো। জোসেফ হালকা স্বরে ডাকে রিকার্ডোকে,
” কাউন্ট। ”
রিকার্ডো ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে। এক মুহূর্তের জন্য আনাস্তাসিয়ার হৃৎস্পন্দনের গতি থমকে যায়৷ রিকার্ডো মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কেবল তার চোখ দেখা যাচ্ছে মাথার উপর চাঁদের আলোয়। একদম তাদের প্রথম সাক্ষাতের মতো। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকাতেই আনাস্তাসিয়ার মনে জমিয়ে রাখা সকল রাগ এবং প্রশ্ন এলোমেলো হয়ে যায়। রিকার্ডো জোসেফের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করে। সাথে সাথে আনাস্তাসিয়া জ্বলে উঠে। সে নিজের ক্লকের ভেতর থেকে একহাতে পাথর এবং অন্য হাতে গাছের ডাল বের করে চিল্লিয়ে বলে উঠে,
” ভুলেও কেউ আমাকে মারার কথা ভাববে না। একদম মেরে মাথা ফাটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিবো। ”
রিকার্ডোর মধ্যে কোনো ভাবান্তর না হলেও জোসেফ বিরক্ত হয়। মনে মনে বলে,
” ঠিক বলে কাউন্ট। এই মেয়ে আস্ত জংলী। বনের রাজাকে সামান্য পাথর আর ডালের ভয় দেখাচ্ছে৷ ”
রিকার্ডো এবার স্ব স্বরে বলে উঠে,
” জোসেফ তুমি ফিটনের কাছে যাও। আমার এই জংলী বিড়ালের সাথে কিছু কথা আছে। ”
জোসেফ এবার শব্দ করে হেসে উঠে। রিকার্ডোর মুখে এই নাম শুনে এভাবেই আনাস্তাসিয়ার মাথা গরম হয়ে ছিলো। এর মাঝে জোসেফের হাসি আরো তার কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতো মনে হচ্ছে। রাগে সে হাতের পাথর জোসেফের দিকে ঢিল মারে। সৌভাগ্যক্রমে জোসেফ সড়ে যায় এবং সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে। রাগে ফুসতে ফুসতে আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি আমাকে জংলী বিড়াল বলেছো? ”
রিকার্ডো কোনো জবাব দেয় না। আনাস্তাসিয়া এতে আরো রেগে যায়। হাতে গাছের ডাল নিয়ে তেড়ে যায় রিকার্ডোর দিকে। রিকার্ডো ঝড়ের বেগে আনাস্তাসিয়ার সামনে এসে তার হাত মোচড়ে কোমরের পিছনে নিয়ে ধরে বলে,
” জংলী কাজকারবার করে বেড়াও তাহলে জংলী বিড়াল নয়তো কি বলবো? ”
হঠাৎ রিকার্ডো এতো কাছে আসায় আনাস্তাসিয়া ভয় পেয়ে যায়। হাত থেকে গাছের ডালটি পড়ে যায়। কতদিন পর আবার সেই একইভাবে রিকার্ডোর চোখ জোড়া দেখছে সে। এই সবুজ নেত্রপল্লবের সম্মোহনী দৃষ্টি এড়ানোর ক্ষমতা নেই আনাস্তাসিয়ার। এই চোখে তাকালে সে কেবল একটা জিনিসই দেখতে পায়। নিজের সর্বনাশ!
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দৃষ্টিকে একবার পরখ করে নেয়। তারপর মনে মনে বলে,
” এখনো এতো দূর্বল? আর কি করলে এই মেয়ে ঘৃণা করা শিখবে? ”
আনাস্তাসিয়াকে ধাক্কা দিয়ে কিছুটা দূরে সড়িয়ে দেয় রিকার্ডো। তারপর স্পষ্ট বলে,
” কি বলার আছে তাড়াতাড়ি বলো। আমি তোমার মতো বেকার ঘুরি না, অনেক কাজ আছে আমার। ”
আনাস্তাসিয়া বিদ্রুপ করে বিড়বিড়িয়ে বলে,
” আসছে আমার রোমানিয়ার কাউন্ট। কি ব্যস্ত মানুষটা! খাবে তো ওই মানুষের রক্তই। ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কথা শুনতে পায়। তবুও কিছু বলে না। আনাস্তাসিয়া নিজেই বলে,
” তোমার সমস্যা কি? ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে আপাদমস্তক পরখ করে বলে,
” সমস্যা তো আমি দেখতে পারছি তোমার হচ্ছে। স্বাধীনতা পেয়েও খুশি হও না দাসত্ব পেয়েও খুশি হও না। তুমি কি চাও? ”
আনাস্তাসিয়া ভুল করে মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
” তোমাকে। ”
রিকার্ডো চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আনাস্তাসিয়া কথা ঘুরিয়ে বলে,
” তোমাকে কেন বলবো? ”
রিকার্ডো বিরক্তির সুরে বলে,
” আমাকে যেহেতু বলবেই না তাহলে ডেকেছো কেন? ”
আনাস্তাসিয়া এবার কোমরে দুহাত রেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
” বাঁচিয়েছো কেন আমাকে? ”
” কে বাঁচিয়েছে তোমাকে? ”
” তুমি। ”
রিকার্ডো হালকা হেসে বলে,
” আমি বাঁচাবে তোমাকে? হাসালে আমায়। এসব অদ্ভুত দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করো। তুমি বাঁচো অথবা মরো তোমার মর্জি। ”
আনাস্তাসিয়া আরো রাগান্বিত স্বরে বলে,
” আমি সেদিন রাতে তোমাকে দেখেছি। তোমাকে অনুভব করেছি। ”
রিকার্ডো দু কদম সামনে এগিয়ে প্রশ্ন করে,
” আমাকে অনুভব করেছো? কাস্টোরিয়ার অনুভূতি এখনো মন থেকে যাচ্ছে না? ”
আনাস্তাসিয়া রাগে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
” আমার বাঁচা মরা দিয়ে তোমার কিছু যায় আসে না তো? ”
” না। ”
আনাস্তাসিয়া কিছু না বলে হঠাৎ দৌড়ানো শুরু করে। রিকার্ডো যখন দেখে আনাস্তাসিয়া তাকে অতিক্রম করে অপর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে তখন সে নিজেও ঝড়ের গতিতে আনাস্তাসিয়াকে পিছনে থেকে গিয়ে জাপটে ধরে রেগে প্রশ্ন করে,
” এই মেয়ে। কোথায় পালাচ্ছো? ”
” তোমার কি আসে যায় হ্যাঁ? আমি মরতে যাচ্ছি। আত্মহত্যা করা পাপ তাই আমাকে মারার জন্য তোমার শত্রুকে নিমন্ত্রণ দিতে যাচ্ছি। ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়া জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
” জ্যাকসন ভাইইইই। কোথায় আপনি? আমাকে এসে মেরে যান। আপনার শত্রু আমাকে আপনার থেকে বাঁচিয়ে এখন নিজেই বলছে আমার বাঁচা মরা দিয়ে তার কিছু আসে যায় না। তাই আজকে আমি মরতে চাই। আপনি কোথায়? জ্যাকসন ভাইইইইই! ”
রিকার্ডো পিছন থেকেই এক হাত দ্বারা আনাস্তাসিয়ার মুখ চেপে ধরে। আনাস্তাসিয়া তবুও কথা বলার চেষ্টা করলে রিকার্ডো দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” জংলী বিড়ালের মতো আরেকটা শব্দ করে দেখো। মেরে কুটি কুটি করে কৃষ্ণ সাগরে ভাসিয়ে দিবো একদম। ”
আনাস্তাসিয়া কিছুটা শান্ত হতেই রিকার্ডো মুখ থেকে হাত সরিয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই আনাস্তাসিয়া উল্টো ঘুরে রিকার্ডোর বুকে জোরে ধাক্কা মেরে প্রশ্ন করে,
” এতো লুকোচুরি কেন করছো? আমাকে দূর্গে না নিয়ে জোসেফের বাসায় কেন পাঠিয়েছো? ”
রিকার্ডো চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,
” তোমাকে বাঁচাচ্ছি আমি নিজের থেকে। আমি কতো ভয়ংকর তা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। তোমার সামনে তোমার স্বাধীন জীবন পড়ে আছে। যেভাবে খুশি গিয়ে নিজের জীবন পার করো। নিজের মস্তিষ্ক থেকে ট্রান্সিলভেনিয়া, তুষ দূর্গ এবং আমাকে মুছে ফেলো। ”
” আমি যদি দূর্গে ফেরত যেতে চাই? ”
” তোমার চাওয়া না চাওয়া দিয়ে কিছু আসে যায় না। তুষ দূর্গের দ্বার তোমার জন্য চিরজীবনের জন্য বন্ধ করা হলো। ”
আনাস্তাসিয়া রাগে বলে,
” যাচ্ছি আমি। আর কখনো তোমার পিছু নিবো না। তুমি নিজে আসবে আমার পিছু। তখন সারাদিন পিছে পরে থাকলেও পাত্তা দিবো না। তুমি আর তোমার তুষ দূর্গ কৃষ্ণ সাগরের অতলে গিয়ে ডুবে মরো। আমি আর পাত্তা দিবো না। ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়া হনহনিয়ে গোরস্থানের দিকে হাঁটা ধরে। আর একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না। পিছনে ফিরে তাকালে হয়তো সে দেখতে পারতো রিকার্ডো নিশব্দে লুকিয়ে তার পিছু পিছু আসছে যতক্ষণ না সে জোসেফের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
বুখারেস্টের এক গভীর জঙ্গলে পাহাড়ের এক গুহায় বসে আছে ওয়ানা। তার সামনেই বসে আছে মার্থা। অপেক্ষা করছে জ্যাকসনের ফিরে আসার। ওয়ানা মনে মনে বেশ খুশি। বারবার নিজের পেটের উপর হাত রেখে কিছু একটা ভাবছে। মার্থার চোখ এড়ায় না বিষয়টা। তবুও সে কিছু বলে না। ক্ষাণিকক্ষণ পর জ্যাকসন ফিরে আসতেই ওয়ানা হেসে উঠে এগিয়ে যায় তার দিকে। ওয়ানা কিছু বলার পূর্বেই মার্থা বলে উঠে,
” ওয়ানার গর্ভে তোর সন্তান আছে। ”
কথাটা শুনতেই জ্যাকসনের চোখে আগুন জ্বলে উঠে। জ্যাকসনের দৃষ্টি দেখে ওয়ানার মুখের হাসিও মিলিয়ে যায়। ওয়ানা নিজের পেটের উপর হাত রেখে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে,
” তুমি খুশি হও নি? ”
জ্যাকসন বলে,
” আমি কোনো ভ্যাম্পায়ারের গর্ভে নিজের সন্তান চাই, কোনো মানুষের গর্ভে না। ”
ওয়ানা আমতা আমতা করে বলে,
” সেটা তো কেবল ক্ষমতার জন্য। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। এটা আমাদের সন্তান। ”
জ্যাকসন অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ওয়ানাকে বলে,
” আমি কখনো বলেছি যে আমি ভালোবাসি তোকে? আমি কেবল একটা জিনিসকেই ভালোবাসি৷ তা হলো ক্ষমতা। হাইব্রিডের ক্ষমতা চাই আমি। যা দিয়ে ভ্যাম্পায়ার এবং নেকড়ে উভয়ের উপর রাজ করতে পারবো। ”
ওয়ানার এই মুহুর্তে মনে হয় জ্যাকসনের এই অগ্নিদৃষ্টি তার সন্তানের উপর। ওয়ানা বলে,
” আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। এই সন্তানের দায়িত্ব তোমার নিতে হবে না। ”
জ্যাকসন কিছু বলার আগেই মার্থা উঠে এসে ওয়ানার পেট খামচে ধরে। আকস্মিক আক্রমণে ওয়ানা ব্যাথায় চিল্লিয়ে উঠে। জ্যাকসন কিছু না বলে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে পড়ে। মার্থা ওয়ানা কিছু বলতে নিবে তার আগেই তার পেটে জোরে লাথি মেরে তাকে গুহার বাহিরে নিয়ে ফেলে। তারপর গুহার ভিতরে জ্বলজ্বল করা একটি আগুনের মশাল হাতে নিয়ে ওয়ানার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওয়ানা চিৎকার করতে করতে কিছুক্ষণ পর দম ছেড়ে দেয়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। মার্থা সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এসব ঝামেলা শুধু শুধু পালিস। নেকড়েদের সঙ্গী প্রয়োজন হয় না। ”
জ্যাকসন ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
” নেকড়েদের কথা জানিনা। কিন্তু আমার মনের চাহিদা মেটানোর জন্য সঙ্গীর প্রয়োজন পড়ে। যাক, এই আপদ থেকে মুক্তি পেয়েছি আপাতত এটাই বেশি। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে এই আরোণ এবং রিকার্ডোর পাখা কিভাবে কাঁটা যায়। ”
মার্থা হালকা হেসে বলে,
” আরোণকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। আরোণ এখন দূর্বল। তার প্রাণভোমরা ক্যাথরিনের ভেতর। আর ওই ক্যাথরিন একজন মানবী। মূর্খ এবং বোকা। ওকে বোকা বানিয়ে একবার বন্দী করতে পারলে আরোণ নিজে এসে আমাদের সামনে নত হবে। ”
বোনের কথা শুনে জ্যাকসন হেসে উঠে। তার এই ক্ষমতা পাওয়ার যাত্রায় তার বোন হবে তার সবচেয়ে শক্তিশালী সঙ্গী।
ক্যাথরিনকে নিয়ে বুখারেস্ট শহরে এসেছে আরোণ। তারা দুজনেই আলাদা দুটো ঘোড়ায় করে আসে। আরোণ সকল নেকড়েদের রোমানিয়ার বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে জ্যাকসন এবং মার্থাকে খুঁজতে। ক্রিয়াস এবং লোল্যান্ডাও তাদের সাথে বুখারেস্ট এসেছে। ক্রিয়াস লোল্যান্ডাকে তার বাড়িতে দিয়ে জ্যাকসন এবং মার্থাকে খুঁজতে যাবে।
চার্চের সামনে আসতেই ঘোড়া থেকে নামে ক্যাথরিন এবং আরোণ। চার্চে প্রবেশ করার আগে আরোণের পা থমকে যায়। সেই ছোটবেলায় শেষ বারের মতো সে চার্চে গিয়েছিলো। আজ এতো বছর পর চার্চে প্রবেশ করতে তার মাঝে দ্বিধা কাজ করছে। এতো পাপের পর ঈশ্বর তাকে কখনো ক্ষমা করবেন?
ক্যাথরিন আরোণের চোখের দিকে তাকিয়ে সেই দ্বিধা এবং অপরাধবোধ স্পষ্ট দেখতে পায়। সে আরোণের কিছুটা কাছে ঘেঁষে তার হাত ধরে। আরোণ ক্যাথরিনের দিকে তাকাতেই ক্যাথরিন চোখের ইশারায় আরোণকে সাহস দেয়। আরোণ একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়িয়ে ক্যাথরিনকে সম্মতি জানায়। সে এখন প্রবেশের জন্য প্রস্তুত। এতো বছর পর আরোণ আবার চার্চের ভিতর পা রাখে ক্যাথরিনের হাতে হাত রেখে। ঈশ্বরের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চায়। তারপর চার্চে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে। মনে মনে বলে,
” ঈশ্বর পাপী তো আমি। কিন্তু সেটার শাস্তি হিসেবে কখনো ক্যাথকে আমার থেকে কেড়ে নিও না। এতো বছর পর আমার আবার তোমার কাছে ফিরে আসার পিছনের কারণ ক্যাথ। হিংস্র পশু থেকে আমার হৃদয়ে মায়া জন্মানোর পিছনের কারণ ক্যাথ। নিজেকে পরিবর্তন করে নিজেকে শোধরাতে চাওয়ার পিছনে কারণ ক্যাথ। ও অনেক হারিয়েছে। অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। আমাকে এখন ওর জীবনে যেন শুধু খুশির কারণ হওয়ার সুযোগ দাও৷ আমি আর কিছু চাইবো না তোমার থেকে। ”
ক্যাথরিন আরোণের দিকে একদৃষ্টিতে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। এখন সে নিজেও একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে। মনে মনে বলে,
” ঈশ্বর আরোণকে ক্ষমা করে দাও। ওর হিংস্র হওয়ার পিছনে তো আর ওর দোষ ছিলো না। আমি নিশ্চিত ও নিজেও কখনোই এই জীবন পেতে চাইতো না। আর সবথেকে বড় কথা হচ্ছে ও অনুতপ্ত। প্রায়শ্চিত্তের একটি সুযোগ তো তার পাওয়া উচিত। সেই সুযোগটা ওকে দাও তুমি। ”
প্রার্থনা শেষে আরোণ এবং ক্যাথরিন একে অপরের দিকে তাকায়। ক্যাথরিন হালকা হাসি দিয়ে আরোণের হাত ধরে বের হওয়ার জন্য। ক্যাথরিন এক পা বাড়াতেই হাতে টান অনুভব করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে আরোণের বুকে আবিষ্কার করে সে। আরোণ ফিসফিসিয়ে বলে,
মহাপ্রয়াণ পর্ব ৩১+৩২
” ধন্যবাদ ক্যাথ। আজ এতো বছর পর মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে এক পাহাড় সমান বোঝা নেমে গিয়েছে। ”
ক্যাথরিন কিছু না বলে মৃদু হেসে আরোণের পিঠে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। অনেকদিন পর তার অনুভব হচ্ছে অবশেষে সে খুশি হওয়ার কোনো কারণ পেলো। এই খুশি হওয়ার কারণ কখনো হারিয়ে না যাক এটাই তার একমাত্র চাওয়া এখন।
