মহাপ্রয়াণ পর্ব ৩+৪
নাফিসা তাবাসসুম খান
আনাস্তাসিয়া ও লিয়ামকে জঙ্গলে হন্য হয়ে খুঁজে ফিরছে ক্যাথরিন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। ক্যাথরিন জোরে জোরে তাদের নাম ধরে ডাকছে। তবুও কোনো জবাব আসছে না কোথাও থেকে। বরফে ঢাকা জঙ্গলে দৌড়াতে বেশ বেগ পেড়োতে হচ্ছে ক্যাথরিনকে। চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঠান্ডায় তিরতির করে কাঁপতে থাকে ক্যাথরিন। সে একটি লম্বা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। থেমে কিছুটা দম নিয়ে নেয়। হঠাৎ অনুভব করে তার কাধে তরল কিছু উপর থেকে টপটপ করে পড়ছে। সে তার বাম হাত কাধে নিয়ে সামনে এনে ধরে দেখে তার হাতে রক্ত লেগে আছে। ভয়ে ভয়ে সে উপরে তাকায়। উপরে তাকিয়ে দেখতে পায় আনাস্তাসিয়া আর লিয়ামের মাথা গাছে ডালের সাথে ঝুলে আছে। এই দৃশ্য দেখে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে ক্যাথরিন। সে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে দৌড়ানো শুরু করে। দিক বেদিক বেমালুম ভুলে চোখ বন্ধ করে দৌড়াতে থাকে সে। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে সে পড়েই যাচ্ছিলো কিন্তু একজোড়া পেশিবহুল হাত তাকে জড়িয়ে নেয়। ক্যাথরিন ভয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলো। কিন্তু তখনই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর বলে উঠে,
” ক্যাথ! ”
ক্যাথরিন সেই বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সামনে তাকাতেই দেখে তার সামনে আর কেউ নয় বরং রক্তিম চোখের সেই নেকড়ে মানব দাঁড়ানো। তার ঠোঁটের একপাশে তাজা রক্ত মেখে আছে। ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়েই বাকা হাসছে। ক্যাথরিন পালানোর জন্য আশেপাশে তাকাতেই দেখে চারিদিক দিয়ে তাদের ঘিরে অসংখ্য নেকড়ে দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র চোখে। আবার সামনে তাকিয়ে দেখে সেই নেকড়ে মানব তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয়ে ক্যাথরিন দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে জোরে চিৎকার করে উঠে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়। এতক্ষণ সে সপ্ন দেখছিলো। সপ্নটাকে একদম বাস্তবের মতো মনে হচ্ছিলো। ক্যাথরিন নিজেকে ঠান্ডা করে আশেপাশে তাকিয়ে অবাক হয়। একটি অপরিচিত বিশাল কামরায় আছে এমুহূর্তে সে। কামরায় জ্বালানো বেশ কতগুলো মোমের আলোয় সে আশেপাশে নজর বুলিয়ে নেয়। কামরায় একটা বড় বিছানা, একটা আয়না, কাঠের এনটিক ক্যাবিনেট ও বিশাল একটা বইয়ের তাক আছে। ক্যাথরিনের ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যায়। তার এতদিন জ্ঞান ছিলো না। কিন্তু কতদিন ধরে সে এখানে? এটাও জানার কোনো উপায় নেই।
ক্যাথরিন গায়ের চাদড় সরিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য পা নাড়াতে নিয়ে ব্যাথায় ” আহ! ” বলে উঠে। সে তাকিয়ে দেখে তার বাম পায়ে পট্টি বাঁধা। সেদিন পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গাছের ভাঙা ডাল তার পায়ে গেঁথে যায়। তখন ক্যাথরিন খেয়াল করে নি এতকিছুর মাঝে। এখন মনে পড়েছে। সে এখন কোথায়? এটা কোন জায়গা এসব কিছুই সে জানে না। ওর গায়ের জামাটাও পরিবর্তন করে একটা সাদা রঙের ম্যাডিভাল নাইট গাউন পড়ানো হয়েছে। কে পরিবর্তন করেছে? হঠাৎ করে সেই নেকড়ে মানবীর চেহারা ভেসে উঠে ক্যাথরিনের চোখে। সাথে সাথে সে রাগে বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।
আশেপাশে পিনপতন নীরবতা। রাতের নিঝুম আধারে নিজের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে ক্যাথরিন। কিন্তু এটাই ভালো সুযোগ। এখান থেকে পালাতে হলে আগে তার জানতে হবে সে কোথায় আছে বা পালানোর রাস্তা কোথায়। ক্যাথরিন বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে দাঁড়ায়। পায়ে ব্যাথা করলেও সে সেটা মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। তার কামরার সাথেই একটা বারান্দা আছে বিশাল। ক্যাথরিন ধীরে ধীরে হেঁটে বারান্দায় আসে। আরেকটু সামনে যেতেই সে দেখতে পায় বিশাল এক প্রাসাদের সবথেকে উঁচু কামরায় এই মুহুর্তে সে অবস্থান করছে। গহীন অরণ্যের মাঝে এই প্রাসাদটি ছাড়া আর দূর দূরান্ত পর্যন্ত আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাহিরে তুষারপাত হচ্ছে। তুষারে সবকিছু ঢাকা পড়ে আছে।
ক্যাথরিন সামনে এগিয়ে সামান্য নিচের দিকে ঝুঁকে কাউকে দেখা যায় নাকি দেখার জন্য। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হঠাৎ সে তার পিছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে। ক্যাথরিন থেমে একটু শ্বাস নিয়ে তৎক্ষনাৎ পিছনে ফিরে হাতের সাহায্যে আঘাত করতে নেয় পিছনে থাকা ব্যক্তিকে। কিন্তু আরোণ তার আগেই ক্যাথরিনের দুই হাত নিজের হাতের সাহায্যে ক্যাথরিনের কমোড়ের পিছনে নিয়ে চেপে ধরে তাকে রেলিঙের বাহিরে নিয়ে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় ক্যাথরিন ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থেকে যখন দেখে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তখন সে পিটপিট করে চোখ মেলে। চোখ খুলে দেখে সেই রক্তিম চোখের নেকড়ে মানব তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে লেপ্টে আছে সেই বাকা হাসি। ক্যাথরিন চেঁচিয়ে উঠে,
” তোমার সাহস কিভাবে হয় আমাকে ছোঁয়ার? অসভ্য কোথাকার! এই মুহুর্তে আমাকে ছেড়ে দাও নাহয় যে হাত দিয়ে আমাকে ছোঁয়ার সাহস দেখিয়েছো সেই হাত কেটে ফেলবো। ”
আরোণ কিছুটা সামনে ঝুঁকে ক্যাথরিনের চোখে চোখ রেখে বলে,
” ক্যাথ! অসভ্যতামির এখনো কিছুই দেখো নি। তাই আমাকে অসভ্য বলে সম্বোধন করা সম্পূর্ণ অনুচিত। ”
এই বলে আরোণ আরো একটু সামনে ঝুঁকে। ক্যাথরিনের এতো কাছে আসায় কিছুটা বেসামাল হয়ে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার হৃৎস্পন্দনের উঠা নামার শব্দ হয়তো এই নিরব পরিবেশে যে কেউ স্পষ্ট শুনতে পাবে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ক্যাথরিন আড়চোখে আরোণের দিকে তাকায়। সোনালী চুল ও হালকা সোনালী দাড়ি ফরসা গড়নের বলিষ্ঠ দেহের লোকটির উপর বেশ মানানসই। আরোণ ফিসফিসিয়ে বলে,
” আরোণ। আরোণ রদ্রিগেজ। ”
আরোণের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনলেই ক্যাথরিনের শরীর হিম হয়ে আসে। আরোণ কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে,
” ছেড়ে দিবো? ”
ক্যাথরিন হ্যাঁ বোধক করে মাথা নাড়ায়। আরোণ ক্যাথরিনকে ছেড়ে দিতেই ক্যাথরিন পিছনের দিকে পড়ে যেতে নেয়। ক্যাথরিন ভয়ে চিৎকার করে উঠে। আরোণ সাথে সাথে নিজের ডান হাত দিয়ে ক্যাথরিনের বাম হাত ধরে ফেলে। ক্যাথরিন রাগ দেখিয়ে বলে,
” মেরে ফেলতে চাইলে হাত ধরেছো কেন? হাত ছেড়ে দাও। তোমার মন বাসনা পূর্ণ হবে। ”
” উফ ক্যাথ! তুমি নিজেই আমাকে বললে তোমাকে ছেড়ে দিতে। এখন তুমিই আবার রাগ দেখাচ্ছো? আর তোমাকে এতো সহজে আমি মরে যেতে দিতে পারি? আমি কি এতোটাই খারাপ? ”
কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলে আরোণ।
” ক্যাথরিন। আমাকে ক্যাথ বলে ডাকার অধিকার আমি তোমাকে দেই নি। ”
” তোমার কি মনে হয় আমি তোমার অনুমতির নেওয়ার প্রয়োজন মনে করি? ”
” মেরে ফেলার হলে এখনই মেরে ফেলো নাহয় পরে অনুশোচনা করবে। আমাকে জীবিত রাখা তোমার জন্যই বিপজ্জনক হবে। ”
” সহজ কোনো কিছু এভাবেও আমার পছন্দ না। বিপজ্জনক খেলা আমি খুব ভালোবাসি। ”
ক্যাথরিন চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকে আরোণের দিকে। আরোণ ক্যাথরিনকে এখনো একইভাবে ধরে রেখেছে। কিছু না বলে তাকিয়ে আছে ক্যাথরিনের দিকে। আরোণ হঠাৎ একটানে ক্যাথরিনকে তুলে আনে । ক্যাথরিন এসে আছড়ে পড়ে আরোণের বলিষ্ঠ বুকে। আরোণ নিজের এক হাত দিয়ে ক্যাথরিনের চুলের ভাজে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু তুষার গুলো সরিয়ে দিতে থাকে। এই মুহুর্তে ক্যাথরিনের মোটেও মনে হচ্ছে না সে কোনো নেকড়ে মানবের সাথে আছে। এই শান্ত, নিশ্চুপ আরোণকে দেখে কেউই বুঝবে না সে কোনো হিংস্র জন্তু। ক্যাথরিনের ভাবনায় ফোড়ন কেটে আরোণ বলে,
” তোমাকে এখনো মারি নি মানে এই না যে আমি তোমাকে আর মারবো না। তোমার মৃত্যু আমার হাতেই। ভুলে যেও না যে তুমি আমার শিকার। কোনো রকমের চালাকি করার চেষ্টা করলে এতো সুন্দর দেহ ছিন্নভিন্ন করে নেকড়েদের মাঝে বিলিয়ে দিবো। তোমার পরিণতিও তোমার মা বাবার মতো হবে। ”
এই বলে ক্যাথরিনকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে চোখের পলকে কামরা থেকে বেরিয়ে যায় আরোণ। ক্যাথরিন হতবিহ্বল হয়ে সেখানেই বসে থাকে। তারমানে তার মা বাবার খুনী আরোণ। তার মা বাবার কথা মনে পড়তেই চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ক্যাথরিনের নিজের উপরই রাগ হয় এই ভেবে যে সে এইমাত্র একটা জানোয়ারকে মানুষের সাথে তুলনা করছিলো। একা একা বিড়বিড় করে সে বলে,
” আমিও তোমাকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো না আরোণ রদ্রিগেজ। রক্তের খেলা তুমি শুরু করেছো কিন্তু এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো। ”
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে আনাস্তাসিয়া। বাসার সামনে আঙ্গিনাতেই লিয়াম আর পাশের বাসার দুটি বাচ্চা বরফ নিয়ে খেলছে। কামরার দরজা খোলার শব্দ পেতেই সে পিছনে ফিরে তাকায়। বয়স্ক একজন মহিলা কামরায় প্রবেশ করে। চেহারায় উনার বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। তিনি এসে বলেন,
” অ্যানা নিচে আমি তোমাদের জন্য টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে এসেছি। নিচে চলো নাস্তা করে নিবে। ”
” গ্র্যানি আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি তুমি আর লিয়াম নাস্তা করে নাও। ”
এই বলে আনাস্তাসিয়া আবার জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধা কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নেমে আসে। তিনি জানেন আনাস্তাসিয়া মুখে বললেও খেতে আসবে না। গত পাঁচ দিনে পানি ছাড়া কিছু মুখে তুলেনি সে। মাঝে জোর করে দুবার স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেও বিশেষ একটা লাভ হয়নি। এক রাতে এতো কিছু সহ্য করার পর কারোই স্বাভাবিক থাকার কথা না। লিয়াম এখনো ছোট তাই সে কিছুই বুঝতে পারে নি। তাকে শুধু এতোটুকুই বলা হয়েছে তার মা, বাবা এবং বড় বোনকে সে আর কখনোই দেখতে পারবে না। দু দিন মন খারাপ করে থাকলেও প্রতিবেশীদের বাচ্চাদের সাথে খেলা করে এখন সে মন খারাপের বিষয়টা ভুলেও গিয়েছে। শুধু ভুলতে পারে নি আনাস্তাসিয়া।
নিচে নেমে নিজের কামরায় এসে বৃদ্ধা একটি সিন্দুক থেকে কিছু পুরনো খেলনা বের করেন। সেগুলোর মধ্যে থেকে একটি খেলনা ঘোড়া হাতে নিয়ে তিনি মন খারাপ করে বসে থাকে। মেয়ে, জামাতা এবং নাতনিকে হারিয়ে বেশ ভেঙে পড়েছেন অফিলিয়া কোলান। কিন্তু আনাস্তাসিয়া ও লিয়ামের জন্য যথাসম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। লিয়াম তাও কিছুটা সময় গেলে সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আনাস্তাসিয়া? এতো চঞ্চল মেয়েটা এক রাতেই সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো। নির্জীব প্রাণীর মতো সারাদিন কামরায় বসে থাকে। অফিলিয়ার খুব চিন্তা হয় নিজের নাতনিকে নিয়ে। আদৌ আনাস্তাসিয়া এই মানসিক আঘাত থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে নাকি কে জানে?
ক্রিসমাস উপলক্ষে সকাল থেকেই অফিলিয়া বেশ অনেককিছু রান্না করেছেন। মুসাকা, তারামাসালতা, ডলমেডেস, মাগিরিৎসা সহ আরো অনেক রকম গ্রীক ঐতিহ্যবাহী খাবারই রান্না করেছেন। এর পাশাপাশি রিজোগালো, লোকুমদেস সহ আরো অনেক ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে পাঠিয়েছেন। কাস্টোরিয়া গ্রামে ক্রিসমাস উপলক্ষে প্রতি বছরই সম্পূর্ণ গ্রামে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পরে। গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দ খুশি ভাগাভাগি করে নেয় সন্ধ্যার পর। সেখানে নাচ, গান সহ আরো বিভিন্ন আয়োজন করা হয়।
বিকেলে অফিলিয়া অনেক জোরাজোরি করার পরও আনাস্তাসিয়া কোথাও যেতে রাজি হয় না। কিন্তু লিয়ামের খুব ইচ্ছে সে আনন্দ উদযাপন করবে সবার সাথে একত্রে। তাই অফিলিয়া লিয়ামকে নিয়ে যায় এবং আনাস্তাসিয়াকে বলে যায় বাসায় সাবধানে থাকতে ও একা বের না হতে। অফিলিয়ার বাসাটি দোতলা কাঠের তৈরি। দোতলায় দুটি কামরা এবং নিচতলায় একটি কামরা, রান্নাঘর এবং বসার ঘর। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন কাঠের বেষ্টনী দ্বারা সীমাবদ্ধ। তুষারপাতের কারণে সম্পূর্ণ উঠোন তুষারে ঢাকা পড়ে আছে। বাড়ির পিছনেই রয়েছে একটি ছোট্ট কুড়ে ঘরের মতো। সেখানে দুটি ঘোড়া পালে অফিলিয়া। আনাস্তাসিয়া ছোট থেকেই ঘোড়া খুব ভালোবাসে। গ্র্যানির বাসায় এলে সবসময় সে ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ের ওদিক থেকে ঘুরে আসে।
গোধুলিলগ্ন পেরিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ আগেই। ঘন জঙ্গলের গহীনে পৌঁছানো চাঁদের আলোয় আবছা আবছা চারপাশ দেখা যাচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আনাস্তাসিয়া ধীরে ধীরে সেই জায়গায় এসে পৌঁছায় যেখানে সে তার বোনকে শেষ দেখেছিলো। সেদিন রাতে নাসোকে নিয়ে গ্র্যানির বাসায় পৌঁছে আনাস্তাসিয়া সব বলার পর গ্রামের সবাই মিলে ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পরে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সম্পূর্ণ জঙ্গল তন্য তন্য করে খুঁজেও জুলিয়া, মার্টিন ও কোচম্যানের লাশ ব্যাতিত অন্য কাউকেই পাওয়া যায় নি। সবাই ভেবে নিয়েছে যে ক্যাথরিনকেও হয়তো কোনো বন্যপ্রাণী মেরে তাকে আহার হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে। কিন্তু আনাস্তাসিয়ার বিশ্বাস সে তার বোনকে এখানেই কোথাও খুঁজে পাবে৷ তাই সুযোগ বুঝে সে একটি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই মার্টিন অ্যালভেজ নিজের মেয়েদের সাহসী করে গড়ে তুলেছেন। ঘোড়ায় চড়া, তরবারি চালানো থেকে শুরু করে আত্মরক্ষার জন্য যা যা জানা প্রয়োজন সবই শিখিয়েছেন। ক্যাথরিন ছোট থেকেই নির্ভীক প্রকৃতির হলেও আনাস্তাসিয়া তার বিপরীত। কিছুটা উড়নচণ্ডী স্বভাবের হলেও আনাস্তাসিয়া অন্ধকার, রক্ত, মৃত্যু এই জিনিসগুলোকে খুব ভয় পায়। কিন্তু এই মুহুর্তে তার বোনকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্খা ভয়ের থেকেও তীব্র।
আবছা চাঁদের আলো, হালকা তুষারপাত, নিশ্চুপ চারিপাশ যেন পরিবেশকে আরো ভুতুড়ে করে তুলেছে। আনাস্তাসিয়া সতর্ক চোখে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। তুষারপাতের ফলে বরফ জমে গিয়েছে সব জায়গায়। বরফ ঠেলে ঘোড়া নিয়ে আগানো কষ্টের ছিলো তাই আনাস্তাসিয়া ঘোড়া থেকে নেমে সেটাকে একটা গাছের সাথে বেঁধে একা সামনে পা বাড়ায়। একটি কালো রঙের লম্বা গাউন পড়ে আছে সে। দুহাত দিয়ে গাউন কিছুটা উঁচু করে ধরে হাঁটার ফলে পায়ে ঠান্ডা লাগছে খুব। লাল রঙের হুডযুক্ত লম্বা ক্লকটির নিচের অংশ পিছনে বরফ ঘেঁষে নিচে পড়ে আছে। নির্ঘুম ও খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করায় শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে আছে আনাস্তাসিয়ার। তবুও মনের জোরে সে আশেপাশে চোখ বুলাতে থাকে। হয়তো কোথাও ক্যাথরিনের বা সেই রক্তিম মানবীর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবে।
বেশ অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পরও কিছু না পেয়ে আনাস্তাসিয়া ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শরীর ঝিমিয়ে আসায় পাশের একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠে সে ব্যাথায়। ডান হাত পিঠের কাছে নিয়ে একটানে একটি গাছের চিকন ধারালো ডালের অংশ বের করে আনে। ডাল বের করার সময় ধারের কারণে তার ক্লকের ভিতরে জামাও পিঠের দিক দিয়ে বেশ ক্ষাণিকটা ছিড়ে যায়। আনাস্তাসিয়া পিছনে ফিরে একটু এগিয়ে যায় ঘোড়া যেখানে বেঁধে রেখে এসেছিলো সেখানে। কিন্তু সেখানে ফিরে এসে দেখে দড়িটা গাছের পাশে পড়ে আছে এবং ঘোড়া সেখানে নেই। একে তো ঠান্ডায় কাঁটা ঘা বেশ জ্বলছে, এখন আবার ঘোড়াটাও বাধনমুক্ত হয়ে লাপাতা হয়ে গিয়েছে। কিছুটা ভয়ও পায় আনাস্তাসিয়া। হেঁটে বাসায় ফিরাটা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয় হবে এই তুষারে আচ্ছন্ন রাস্তা হয়ে।
মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায় আনাস্তাসিয়া। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
” আমাকে শক্তি দাও ঈশ্বর। এতোটা নির্মম জীবন কেন হলো আমার? মা বাবাকে হারিয়েছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার বোন জীবিত আছে। আমাকে ক্যাথরিনের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা দেখাও। ”
হঠাৎ সে দেখে ঘন কালো অন্ধকারের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তীব্র বেগে বাতাস বওয়া শুরু হয়। হঠাৎ এমন পরিবর্তনে আনাস্তাসিয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মুহূর্তের মাঝেই পরিবেশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে পড়ে। দূর্বল আনাস্তাসিয়া বোধ করে মৃত্যুর হয়তো খুবই সন্নিকটে সে। এই এতো অন্ধকার কি তাকে গ্রাস করে ফেলবে? দু চোখ খোলা অবস্থায়ও সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কোনো তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি জলতেষ্টায় যেমন কাতর হয়ে উঠে আনাস্তাসিয়া এমুহূর্তে ঠিক ততটাই কাতর এক রশ্মি আলোর জন্যে। থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা আনাস্তাসিয়া কম্পিত পা জোড়া এগিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার শরীর অসাড় হয়ে আসে খুব কাছেই অগ্রসর হওয়া অশ্বস্বরে। বাতাসের বেগ যেন হঠাৎ আরেকটু তীব্র হয়।
ঘোড়ার স্বর খুব কাছ থেকে পাওয়ার সাথে সাথেই হঠাৎ একটি হিমশীতল হাত নিজের কোমরে অনুভব করে আনাস্তাসিয়া। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। একমুহূর্তের জন্য তার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। চোখের পলকেই সে নিজেকে ঘোড়ার পিঠে আবিষ্কার করে। চোখ মেলে তাকায় আনাস্তাসিয়া। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ভারসাম্য রক্ষার জন্য সে তার এক হাত দিয়ে পিছনে বসা মানুষটির ঘাড় আঁকড়ে ধরে। পরক্ষণেই সে লক্ষ্য করে আঁধারে তলিয়ে যাওয়া চাঁদ আস্তে আস্তে আড়াল হতে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু চাঁদ রক্তিম বর্ণ কেন ধারণ করেছে? আজকে কি তবে চন্দ্রগ্রহণ? আনাস্তাসিয়ার মনে পড়ে ছোট থাকতে তার বাবা একবার চাঁদ নিয়ে তার সাথে গল্প করার সময় চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে বলেছিলো। চন্দ্রগ্রহণের সময় কখনো কখনো চাঁদ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ, পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করে। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ায় প্রচ্ছায়া অবস্থানে চাঁদ প্রায় অদৃশ্য হয় না। সূর্যের আলো, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প, ধূলিকণা ও গ্যাস দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে চাঁদের উপর পড়ে। এই অবস্থায় লাল বর্ণের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অন্যান্য বর্ণের আলোর তুলনায় বেশি হওয়ায় এটি সব থেকে কম বিচ্ছুরিত হয়। তাই ওই সময় সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে লাল বর্ণের আলো চাঁদের উপর পড়ার ফলে চাঁদকে তখন লাল দেখায়।
চাঁদের লাল আভাযুক্ত দীপ্ত আলোতে আনাস্তাসিয়া দেখে সে যে ঘোড়ায় বসে আছে সেটা তারই ঘোড়া যেটা কিছুক্ষণ আগে বাধনমুক্ত হয়ে গিয়েছিল। বাতাসের বেগে আনাস্তাসিয়ার চুল উড়ে মুখের উপর এসে পড়ছে বারংবার। অপর হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে আনাস্তাসিয়া দেখে দুটি হাতের বাধনের মাঝে আপাতত সে আবদ্ধ। হাত দুটি তার দুপাশ হয়ে সামনে ঘোড়ার লাগাম ধরে আছে। এক পাশ হয়ে বসায় আনাস্তাসিয়া খুব সহজেই পাশ ফিরে তাকায় উদগ্রীব চোখে।
সাদা রঙের ম্যাডিভাল টিউনিক শার্ট, কালো রঙের ব্রীচেস প্যান্ট এবং কালো বুট জুতো পড়া একজন যুবক শক্ত হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে আনাস্তাসিয়ার পিছনে বসে আছে। শার্টের উপর একটা হালকা নীল রঙের কোট এবং তার উপর আবার লম্বা কালো হুডযুক্ত ক্লক পড়ে আছে। ক্লকের হুড তুলে মাথায় দিয়ে রাখা এবং মুখের অর্ধাংশ কালো মুখোশ দ্বারা ঢাকা। কিন্তু এসবকিছুর মাঝে আনাস্তাসিয়ার চোখ পড়ে যুবকের একজোড়া সবুজ উজ্জ্বল চোখের উপর। সেই সবুজ চোখ জোড়ার দৃষ্টিও আনাস্তাসিয়ার উপর নিবদ্ধ। দু জোড়া নীলকান্তমণি এবং সবুজ নেত্রের সাক্ষাৎ হয়। এক অদ্ভুত আলোড়ন তৈরি হয় সতেরো বছর বয়সী কিশোরীর হৃদয়ে। নিশ্বাসের গতির পরিবর্তন হয়। সম্মোহিত নেত্র পল্লব মেলে তাকিয়ে থাকে সেদিকে আনাস্তাসিয়া। যুবকের কপালে এলোমেলো হয়ে আছে কিছু বাদামী রঙের চুল। চন্দ্রগ্রহনের ফলে রক্তিম চাঁদের আলোয় যেন সবুজ চোখ জোড়া আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে। কাঁপা কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করে আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” কে তুমি? ”
ভরাট কন্ঠে যুবকটি প্রতুত্তর করে,
” রিকার্ডো। ”
গহীন এই অরণ্যে দূর দূর পর্যন্ত কোথাও কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। যাদের অস্তিত্ব আছে তারা হলো এক পাল নেকড়ে। এই অরণ্যের বুকে বিশাল এই পরিত্যক্ত প্রাসাদটি বাহির থেকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এর ভিতরের সৌন্দর্য সম্পর্কে। এক অমিমাংসিত রহস্য হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই বাসকোভ প্রাসাদ।
গত দু দিনে ক্যাথরিন এতটুকু বুঝতে পেরেছে সে গ্রীকে নেই। কারণ সেদিন রাতে আরোণ তার কামরা থেকে যাওয়ার পর পরই একটি মহিলা আসেন ক্যাথরিনের কাছে। তার হাতে একটি ট্রে তে কিছু খাবার ছিলো যেগুলোর বেশিরভাগের নামই ক্যাথরিনের অজানা। গ্রীকে কখনো এধরণের খাবার ক্যাথরিন দেখে নি। মহিলাটি হাতের খাবার বিছানায় একটি পাশে রেখে ক্যাথরিনের কাছে এগিয়ে আসে। ক্যাথরিন প্রথমে কিছুটা ভয় পায় এটা ভেবে হয়তো এই মহিলাও কোনো নেকড়ে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে মহিলাটি রোমানিয়ান ভাষায় বলে উঠে,
” আমাকে ভয় পেও না। আমিও মানুষ তোমার মতো। ”
রোমানিয়ান ভাষা শুনে কিছুটা অবাক হয় ক্যাথরিন। ছোট বেলায় তাকে আর আনাস্তাসিয়াকে তার বাবা বাসায় ব্যাক্তিগত শিক্ষক রেখে তিনটি ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়ায়। যার মধ্যে রোমানিয়ান অন্যতম। তাই সে মহিলার কথার অর্থ বুঝতে পারে। সে এখন রোমানিয়ান ভাষায় প্রশ্ন করে সেই মহিলাকে,
” এই জায়গা কোথায়? আমি কতদিন ধরে অজ্ঞান ছিলাম? তুমি মানুষ হলে তুমি এখানে কি করছো? আর আমার কাপড় কে বদলেছে? ”
” তুমি এই মুহুর্তে রোমানিয়ান সাম্রাজ্যের সিবিউ শহরের বাসকোভ প্রাসাদে আছো। তুমি পাঁচদিন ধরে অজ্ঞান ছিলে। তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে দিতে পারবো না। তোমার কাপড় আমিই বদলেছি। ”
এই শুনে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ক্যাথরিন। আশেপাশে তাকিয়ে সামনের দিকে ঝুকে মহিলাকে প্রশ্ন করে,
” এই প্রাসাদে কি ওই অসভ্য ছাড়াও আরো কেউ থাকে? ”
” আলফা আমাদের প্রধান। এই প্রাসাদ উনারই। কিন্তু প্রাসাদ রক্ষার স্বার্থে আরো অনেক ওমেগা জাতের নেকড়ে আছে। ”
” ওমেগা জাতের নেকড়ে কি? আর ওই অসভ্যকে তুমি আলফা বলছো কেন? ”
” আলফা হলো একপাল নেকড়ের প্রধান। আর ওমেগা হলো সাধারণ নেকড়ে মানবী। আলফার শক্তির সাথে তাদের শক্তির তুলনা চলে না। এবং তুমি ভুলেও আলফাকে আরেকবার অসভ্য বলবে না। কেউ শুনতে পেলে তোমার গর্দান ছিড়ে খাবে। মনে রেখো এই প্রাসাদে দেওয়ালেরও কান আছে। ”
কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ক্যাথরিন আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই মহিলাটি বলে,
” তুমি খেয়ে নাও। আর কিছুর প্রয়োজন হলে বাহিরে দাঁড়ানো ওমেগাকে আওয়াজ দিয়ে বলবে আমাকে ডেকে দিতে। ”
এই বলে মহিলাটি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন হতে ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” তোমার নাম কি? ”
মহিলাটি এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পিছনে না ফিরেই জবাব দেয়,
” মার্থা। ”
এই বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে সে।
ক্যাথরিন মনে মনে ভাবতে থাকে এখন কি করবে সে? এই প্রাসাদ থেকে কি করে পালাবে সে? গ্রীক হলেও একটা কথা ছিলো। এতো এতো নেকড়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে, গহীন অরণ্য পার করে নিজের পরিবারের কাছে জীবিত ফেরত যাওয়া নেহাৎই অসম্ভব বিষয়। কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে ক্যাথরিনের। এতকিছুর মাঝে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সেই অসভ্য আলফা প্রধানকে নিজ হাতে খুন করা। নিজের পিতা মাতার খুনিকে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ ক্যাথরিন নয়। এজন্য কিছুতেই দূর্বল হয়ে পড়া যাবে না ক্যাথরিনের। তাকে শক্ত থাকতে হবে। তাকে দূর্বল দেখলেই এই নেকড়ে পাল তাকে ঘিরে ধরবে। এই সুযোগ কখনোই দিতে চায় না ক্যাথরিন। তাই সে উঠে চুপচাপ বসে খাবার খেয়ে নেয়।
আজ দু দিন হলো সেই অসভ্য নেকড়েদের আলফার আর দেখা পায় নি ক্যাথরিন। এতে অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ক্যাথরিন এই দু দিন কামরায় বসে পরিকল্পনা করছে কিভাবে সে ওই আরোণকে খুন করে এখান থেকে পালাতে পারবে। এর মাঝে মার্থা প্রতিদিন সময়মতো এসে তাকে খাবার দিয়ে গিয়েছে। তখন টুকটাক কথাও বলেছে ক্যাথরিনের সাথে। কিন্তু ক্যাথরিন একটা জিনিসই বুঝতে পারছে না তা হলো মার্থা যদি মানুষ হয় তাহলে সে এখানে কি করছে?
রাত গভীর হয়েছে। চারিদিক নিশ্চুপ হয়ে আছে। ক্যাথরিন নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দেয়। বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে সেই কাঠের এনটিক ক্যাবিনেটের কাছে যায়। সেখান থেকে কাপড় নিয়ে পড়ে থাকা গাউনটা পরিবর্তন করে একটি নীল ও কালো মিশেলের গাউন পড়ে নেয়। কোমড়ে একটি বেল্ট পড়ে তার উপর দিয়ে একটি হুডযুক্ত ক্লক গায়ে দিয়ে নিয়েছে। হেঁটে আবার বিছানার কাছে গিয়ে সাবধানে বালিশের নিচ হতে একটি কাঁচের টুকরো হাতে নিয়ে নেয়। আজকে দুপুরে মার্থা খাবার নিয়ে আসার পর ইচ্ছে করে একটি কাঁচের থালা সে হাত থেকে ফেলে দেয়। মার্থা সে কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করার সময় ক্যাথরিন গোপনে একটি টুকরো সরিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়।
মার্থা বলেছিলো ক্যাথরিনের কামরার বাহিরে সুরক্ষার জন্য ওমেগা নেকড়ে আছে। ক্যাথরিন জানে না এই কাঁচের টুকরো দিয়ে কতটা ঘায়েল করতে পারবে সে কোনো নেকড়েকে কিন্তু আপাতত যা আছে সেটিকেই হাতিয়ার বানিয়ে নেয়া উত্তম। ধীরে ধীরে ক্যাথরিন দরজার কাছে এগিয়ে যায়। খুব সাবধানে দরজা হালকা ফাঁকা করে দেখে দরজার সামনে কেউ আছে নাকি। কিছুটা অবাক করার বিষয় হলেও দরজার সামনে কেউ নেই। ক্যাথরিন এবার দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে বেরিয়ে আসে। কিছুটা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে এখানে কেউ নেই কেন। মনে মনে কিছুটা খুশিও হয় এই ভেবে যে অন্তত দরজার কাছে তাকে বেশি একটা ঝামেলা পোহাতে হয় নি। সামনে তাকিয়ে ক্যাথরিন দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিপাশ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। তাই সে তাড়াতাড়ি কামরায় ফিরে এসে একটি মশালে মোমবাতি থেকে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের মশাল হাতে কামরা থেকে বের হয়।
বিশাল সাদা করিডোরের দু পাশ ঘিরে মোট ১২ টা কামরা। পাথরের হাঁটার পথের দু পাশেই বিভিন্ন ভাস্কর্য রাখা আছে। ক্যাথরিন মশাল হাতে একটি কামরার দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু দরজার বাহির হতে তালা দেওয়া। অপর আরেকটি দরজার সামনে যায় সেটিও একইভাবে তালা দেওয়া। এরকম করে এক এক করে সবগুলো কামরার দরজাই তালা দেওয়া। কিছুটা বিরক্ত হয় ক্যাথরিন। সে ভাবে কি এমন আছে যে কামরা তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। সে এসব রেখে হেঁটে সামনের দিকে এগোতেই করিডোরের শেষ মাথায় পৌঁছায়৷ সেখান থেকে বামদিকে আরেকটু লম্বা করিডোর পার হয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় ক্যাথরিন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে সে। আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অসভ্য ও তার নেকড়ে পাল কি সব বনে শিকার করতে গিয়েছে নাকি ভাবে ক্যাথরিন।
বিশাল প্রাসাদের দুয়ার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেই দু পাশে দুটি লম্বা করিডোর। আরেকটু সামনে আগালেই বিশাল হলরুম। সাদা পাথরের এই হলরুমটি কালো মখমলের পর্দা দ্বারা সজ্জিত। হলরুমের মাঝ হয়ে সিঁড়ি উপরের দিকে কয়েকধাপ পর্যন্ত উঠে দুপাশ হয়ে উপরের দিকে গিয়েছে। মশালের আলো দিয়ে এতক্ষণ এসব ঘুরে ঘুরে দেখছিলো ক্যাথরিন। হঠাৎ সিঁড়ির পাশে মশাল ধরতেই একটি নেকড়ে দেখে ভয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে ক্যাথরিন। কিন্তু সাথে সাথে খেয়াল করতেই সে বুঝতে পারে এটি একটি ভাস্কর্য। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে ক্যাথরিন বলে,
” অসভ্য নেকড়ে কোথাকার। ”
হঠাৎ দূর হতে ক্ষীণ কোলাহলের শব্দ পায় ক্যাথরিন। তৎক্ষণাৎ আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কোথাও কেউ নেই৷ তাহলে এই শব্দ আসছে কোথাথেকে? শব্দ অনুসরণ করে ক্যাথরিন মূল দরজার বাম পাশের করিডোর ধরে হাঁটা শুরু করে। যতই সামনে এগোচ্ছে ততই শব্দ আরো পরিষ্কার হচ্ছে। করিডোরের শেষ মাথায় এসে সে দেখে নিচের দিকে সরুঙ্গ পথ গিয়েছে। ক্যাথরিন কৌতূহল নিয়ে খুব সন্তর্পণে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। নিচে পৌঁছে সরাসরি সামনে না গিয়ে আড়াল হতে মাথা বের করে সামনে তাকাতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে ক্যাথরিন। এক বিশাল অন্ধকার কক্ষের একপাশে তিনটি জানালা ভেদ করে চাঁদের আলো কক্ষে ঠিকরে পড়ছে। কক্ষের দু পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বহুসংখ্যক নেকড়ে। কক্ষের ঠিক মাঝে মেঝেতে বসে আকুতি মিনতি করছে একটি যুবক। তার সামনেই বিশাল আসন পেতে বসে আছে স্বয়ং নেকড়ে পালের আলফা আরোণ রদ্রিগেজ। সে মানব রূপেই বসে আছে আপাতত। সেই যুবকটি রোমানিয়ান বাসায় বারবার বলছে,
” আমাকে ছেড়ে দিন দোয়া করে। আমার বৃদ্ধ মা একা আছে বাসায়। তার দেখাশোনা করার জন্য আর কেউ নেই। আমাকে ছেড়ে দিন। আমাকে মারবেন না। ”
আরোণ কিছু না বলে আসন থেকে উঠে যুবকটির সামনে এসে দাঁড়ায়। একহাত দিয়ে যুবকটির গলায় চেপে ধরে তাকে বেশ ক্ষাণিকটা উঁচুতে তুলে ধরে। ছেলেটা হাত পা মেলে ছোড়াছুড়ি করছে। তার চোখ উপচে পানি পড়ছে। আরোণ চোখ বুজে চোখ মেলে তাকায়। এই মুহুর্তে তার চোখ আগের তুলনায় বেশি জ্বলজ্বল করছে। তার হাতের নখ বেশ লম্বা ও ধারালো রূপ ধারণ করে। সে নখের আঁচড় বসাবে এমন সময়ই ক্যাথরিন হাতে মশাল নিয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠে,
” ছেড়ে দাও এই ছেলেকে। ”
সবার দৃষ্টি ক্যাথরিনের উপর নিবদ্ধ হয়। আরোণ বাদে বাকি সব নেকড়েগুলোই ভীতসন্ত্রস্ত হয় ক্যাথরিনকে দেখে। আরোণ কিছুটা চোখ কুচকে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে। ক্যাথরিন হাতের আগুনের মশালটি চারিদিকে ঘুরিয়ে ভয় দেখানোর মতো করে বলতে থাকে,
মহাপ্রয়াণ পর্ব ১+২
” সব-কয়টাকে পুড়িয়ে মারবো। ছেড়ে দাও ওকে নাহয় আমি সত্যি সত্যি সবগুলোর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিবো। ”
আশেপাশের কতগুলো নেকড়ে ক্যাথরিনের এহেন কাণ্ডে ভয় পেয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। বিরক্ত মাখা চোখ জোড়াকে শীতল করে ক্যাথরিনের দিকে তাকায় আরোণ। কিছু না বলে চোখের পলকে ধারালো নখের সাহায্যে আরোণ যুবকটির বক্ষমাঝ বরাবর হাত ঢুকিয়ে টেনে তার হৃৎপিণ্ড বের করে আনে। ক্যাথরিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে থাকে এই দৃশ্য দেখে। তার হাত থেকে আগুনের মশালটি নিচে পড়ে যায়। আরোণ সেই ছেলেটির দেহ দূরে ছুড়ে মেরে সেই হৃৎপিণ্ড হাতে এগিয়ে আসে ক্যাথরিনের কাছে। ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা হৃৎপিণ্ডটিতে কামড় বসায়। এরকম নৃশংস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায় ক্যাথরিন।
