মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৩

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৩
নওরিন কবির তিশা

নেহা: ফারু…রিশান ভাইয়া এখনো আসেনি।
রিহার্সাল রুমে তখন নিঃশব্দ এক দুপুর।বেশ অন্ধকার ‌রুমটাতে আলো-আঁধারির খেলা, কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো জানালায় কাঁচের ওপারে ঝিমিয়ে পড়া রোদের রেখা। ফারিন বসে আছে একা। তার চোখে খানিকটা চাপা উদ্বেগ, আর কপালের ভাঁজে স্পষ্ট চিন্তা। সে অপেক্ষা করছিল মেল সিঙ্গার রিশান আরিয়াশের। হঠাৎই নেহার এমন কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় সে। দুশ্চিন্তা বিজড়িত কন্ঠে বলে,,
“মানে কী? আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পারফরম্যান্স। এক্ষুনি ডাক পড়বে, আর রিশান ভাইয়াই এখনো এল না? এখন আমি কী করব?”
নেহা সামান্য দুশ্চিন্তা নিয়ে বলল,,

“কি করবো বল? উনার খবর তো বড় ভাইয়া-আপুরাও জানে না। উনি নাকি কালকে থেকে ফোনই ধরছেন না।”
ফারিন: মানে… কালকেই তো আমরা রিহার্সাল করলাম। উনিই তো আরও আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা, যে সকালে এসে একটু প্র্যাকটিস করলে ভালো হয়।
নেহা: “সেটাই তো! আমি নিজেও কনফিউজড। আলিয়া আপুও কিছু জানে না।”
ফারিন: তাহলে আমি কী করবো এবার বল? এটা ডুয়েট পারফর্মেন্স। আর সবচেয়ে বড় কথা, এখানে শুধু প্রিন্সিপাল স্যার বা আমাদের কলেজের টিচাররা না—বাইরে থেকেও টিচাররা, ভিআইপি গেস্টরা আসছে। তাদের সামনে আমাদের কলেজের সম্মানের কী হবে? প্রিন্সিপাল স্যার… প্রিন্সিপাল স্যার কি কিছু বলছে?
নেহা: না, সাথে সাথে তো আমার দেখা হয়নি। আর মেইবি উনি এখনো জানেন না যে রিশান ভাইয়া আসতে পারবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারিনের চোখে মুখে এবার দুশ্চিন্তার রেখা গাঢ় হলো। হৃদস্পন্দনটা যেন বেড়ে যায় কয়েক ধাপ। সে বুঝতে পারছে না, এই বিশাল ঝামেলা সে একা কীভাবে সামাল দেবে। ঠিক তখনই মঞ্চ থেকে ডাক আসে তার নামে। পাশ থেকে নেহা বলে ওঠে,,
“যা হবে দেখা যাবে। এখন অন্তত মঞ্চে তো যা। না হলে মান-সম্মান যা আছে, তাও যাবে।”
তার কথা শুনে ফারিন তার দিকে ফিরে বলে,,
“তোর কি মনে হয় মঞ্চে গেলে মান-সম্মান থাকবে? এটা ডুয়েট পারফর্মেন্স ছিল। এখানে আমি একা গিয়ে কী করবো? ভাইয়ার কলিগুলো কি আমার সাথে ভূত এসে গেয়ে দিয়ে যাবে?”
আবারো মঞ্চে ডাক পড়ে ফারিনের। এবার নেহা দ্রুত বলে উঠে,
“দেখ ফারু, এখন রাগারাগির সময় নয়। যা হবার দেখা যাবে। অন্তত মঞ্চে তো যা। যেটুকু সম্ভব, সেটা কর। তুই না হয় পরে সবার কাছে মাফ চেয়ে নিস। কিন্তু এখন কলেজের মান-সম্মান রাখার জন্য যেতে তো হবে।”
ফারিন আর কোনো কথা না বলে সোজা মঞ্চের দিকে পা বাড়ায়।

কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশনের মূল আকর্ষণ—রবীন্দ্রসংগীত ডুয়েট। সামনের সারিতে বসে আছেন প্রিন্সিপাল স্যার, অতিথি শিক্ষকরা, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। স্টেজের আলো নিভে গিয়ে যখন ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হল, মাঝখানে মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়াল ফারিন। চোখ বুজে প্রথম লাইনটা গাইতে শুরু করে—
“আমার পরাণ যাহা চায়…”
কণ্ঠে টলমল এক অনুভব, যেন শব্দগুলো শুধু সুর নয়—তার অন্তরের ভাষা। দর্শক স্তব্ধ। নিঃশব্দ শ্রোতা হয়ে গেছে শিক্ষকরাও। হলভর্তি সে নরম আলোয় ফারিন হয়ে উঠেছে একার অনুভবের দূত। কিন্তু গানের মাঝপথে নির্দিষ্ট মেল পার্টে যখন ফারিন একটু থেমে দাঁড়ায়—ঠিক তখনই… ভেসে আসে একটি পুরুষ কণ্ঠ… দূরের করিডোর পেরিয়ে, অডিটোরিয়ামের পাশের প্রবেশদ্বার থেকে এক টানাটান ভাঙা শ্বাসের মতো নিঃশব্দে উচ্চারিত হয়—
“তুমি তাই… তুমি তাই গোওওও।”

হঠাৎই পুরো হল যেন থমকে যায়। সবার চোখ ফিরে তাকায় সেই শব্দের উৎসের দিকে। শব্দটা এসেছে—দর্শকসারির কোণার দিক থেকে, যেখানে শুভ্র পাঞ্জাবির আলতো রঙে মোড়ানো এক শ্যামবর্ণ পুরুষ, দাঁড়িয়ে আছেন গোধূলির আলোয় গা ডুবিয়ে। তার গালের হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, শার্প জ-লাইন, আর চোখ দুটো এতটাই গভীর—যেন ভেতরে পুরে রেখেছে শতশত না বলা কথা—নির্ঝর।

নির্ঝরকে দেখে সবার মতন ফারিনও তাকিয়ে থাকে অবাকদৃষ্টিতে। এক মুহূর্তের জন্য যেন তার শ্বাস আটকে যায়। অন্যদিকে নির্ঝর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাইক্রোফোন হাতে গানটি গাইতে গাইতে এগিয়ে আসে মঞ্চের দিকে। মঞ্চে এসে নির্ঝর এক ঝলক ফারিনের দিকে তাকায়। ফারিন তখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে নির্ঝরের মতো গম্ভীর রাগী স্যার, যাকে কিনা ফারিন হিটলার উপাধি দিয়েছিল, সেই স্যারই তার সাথে মঞ্চে গান গাইছে! ব্যাপারটা হজম হলো না ফারিনের। তাকে এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনেহা মঞ্চপাশ থেকে গলা চেপে বলে,,
“আরে ফারু, গানটা তো গা! স্যারকে তো পরেও দেখা যাবে। না হলে তো মান-সম্মান তুই ডুবায় দিবি দেখছি।”
নেহার এমন কথা ধ্যানভাঙে ফারিনের। সে কটমট করে নেহার দিকে তাকায়, পরক্ষণেই গাইতে শুরু করে,,

“তোমা ছাড়া আর এ জগতে…”
নির্ঝর মিলিয়ে নেয় কণ্ঠ
“মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো…”
ফারিন এক ঝলক তাকায় তার চোখে,
তারপর…
“আমারো পরাণ যাহা চায়…”
নির্ঝর ফারিনের দিকে না তাকিয়েই
“তুমি তাই… তুমি তাই গো…”

গান শেষ।
শেষ চরণের সুর মিলিয়ে যেতে না যেতেই পুরো অডিটোরিয়ামে ধ্বনিত হয় করতালির ঝড়। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক—সবার মুখে শুধু বিস্ময় আর প্রশংসা। কিন্তু ফারিন কিছুই শুনতে পায় না। তার দৃষ্টি স্থির। তখনই পাশ থেকে ইমন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,,
“নেহা! দেখলি আজকের পারফর্ম্যান্স? পুরাই সিনেমাটিক না? আমার তো মনে হচ্ছিল আমি রীতিমতো রোমান্টিক ফিল্ম দেখছি। গানটা কী যেন ছিল… হ্যাঁ! আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো!”
ইমনের এমন কথায় ফারিন বিরক্ত হয়ে বলল,,
“ইমন, প্লিজ একদম ফাজলামি করিস না! উনি তো আজকে বাঁচায় দিছে। যে উনি আমার সাথে গান গেয়েছে, না হলে কি হতো ভাবতে পারছিস? অতগুলো গেস্টের সামনে কলেজের নাক কান তো কাটা যেত, সেইসাথে আমারও নাক কাটা যেত।”

তার কথা শুনে নেহা হেসে বলল,,
“কেন, তোমার নাক কান কাটা যাবে ফারু সোনা? তোমার জন্য তো নির্ঝর স্যার আছেই! কি সুন্দর করে তোকে বাঁচাই দিল না! হাউ সুইট! আল্লাহ!! আমি তো কেঁপে গেছি রে… ওভাবে হেঁটে এসে গান গাওয়ার মতো সিন তো শুধু সিনেমায় দেখি। মনে হচ্ছিল নিজের চোখের সামনে একটা রোমান্টিক ফিল্ম দেখছি। হাউ রোমান্টিক!”
তারপর নেহা ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“জানিস ইমন? আজকে না আমাদের ফারু হিটলার অর্থাৎ আমাদের নির্ঝরের দিকে হা করে তাকিয়েছিল। সোজা হিটলারের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ও খেয়েছে… খেয়েছে রে ক্রাশ!”
নেহার এমন কথা শুনে ফারিন চটে গিয়ে বলল,,
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না নেহা! আর তুই কবে থেকে এরকম হয়ে গেলি রে?”
তার কথা শুনে নেহা তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“সবকিছু তোর সাথে থাকার ফলরে ফারু! তুই নিজেও কি কম যাস? তিলকে তাল বানাতে তোর দুই সেকেন্ডেও সময় লাগে না। আগের দিন শুধু আরশান ভাইয়া আমার কাছে শুনেছিল যে আমাদের এখন কোন স্যারের ক্লাস? আর তুই? আরশান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে তো কি! পুরো বাচ্চা এনে তার নামও রেখে দিলি! আর এখন আমি কিছু বললেই দোষ। আমি তো এখনো তোদের বিয়ে পর্যন্তই যায়নি। ওয়েট কর, কিছুক্ষণ পরেই যাব।”
তার এমন কথায় ফারিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,,
“দেখ নেহা, ওইটা ভাইয়া ছিল। আর সব ছাইয়াই ফার্স্টে ভাইয়াই থাকে। আর এটা আমার কথা না—একজন বিশিষ্ট অভিনেত্রীর কথা। তাই আর কি! বলেছিলাম কিন্তু, উনি তো স্যার! বল—স্যার বাবার সমতুল্য হয়।”
তার এমন কথা শুনে নেহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,,

“হুমমমম… আইছে! স্যার নাকি বাবার সমতুল্য! যখন তুই স্যারকে হিটলার, রক্তচোষা বাদুর, রাক্ষস এসব বলে গালাগালি দিস তখন কোথায় থাকে তোর বাবার মত সম্মান? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো—তুই তো প্রথম দিন স্যারকে ভাইয়া বলেছিলিস না? সিনিয়র ভাইয়া ভেবেছিলিস। তার মানে কি দাঁড়ালো?”
পাশ থেকে তখনই ইমন হেসে বলে উঠল—
“সব ছাইয়াই…”
নেহা সাথে সাথে যোগ করল—
“…ফার্স্টে ভাইয়াই থাকে!”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২২ (২)

তাদের এমন ইয়ার্কি শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেল ফারিনের। চোখ কুঁচকে কিছু একটা বলতে গিয়েই গজগজ করতে করতে দ্রুত হেঁটে চলে গেল ক্যাম্পাসের বাইরে। পেছন থেকে তা দেখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো নেহা আর ইমন।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৩ (২)