মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৭

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৭
নওরিন কবির তিশা

নিউইয়র্কের শহুরে হট্টগোল থেকে অনেকটাই দূরে, হাডসন নদীর পাশে ছায়াঘেরা এক এলাকা—Westchester’s Riverview Hills। এখানকার প্রতিটি সকাল যেন মেঘ আর সূর্যের এক শান্ত যুদ্ধ। সেই সবুজ পাহাড় আর প্রাকৃতিক নৈঃশব্দ্যের মাঝখানে, নির্জন এক রিজের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাইভেট ডুপ্লেক্স ভিলা—নাহিয়ানের Shadow Haven।

এই বাড়িটি শহরের গ্ল্যামারের বিপরীতধর্মী—গাঢ় কাঠের ফ্রেম, কালো ছাদের ছায়া, লম্বা কাঁচের জানালাগুলো যেন বাইরের প্রকৃতিকে নিজের মধ্যে টেনে আনে। সামনে একটি ছোট ফুলের বাগান, পিছনে পাথরের তৈরি ছোট এক ব্যালকনি—যেখান থেকে দেখা যায় হাডসনের পানির ঢেউ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভবনের ভেতর ঢুকলে শুরুতেই বিশাল একটা লিভিং স্পেস—দেয়ালের একদিকে আধুনিক ডিজাইনের ফায়ারপ্লেসে যেন আগুন জ্বলছে , অন্যদিকে দেওয়ালজোড়া বইয়ের তাক। মাঝখানে একটা ডার্ক কাঠের কফি টেবিল—সেখানে ছড়িয়ে আছে কয়েকটি ম্যাপ, কাগজ, এবং একটি ল্যাপটপ।সেই টেবিলের সামনে বসে আছে নাহিয়ান।তার চোখের নিচে গাঢ় ছায়া, চোখে ঘুমহীন রাত্রির ছাপ। বারবার হৃদয়ের পাতায় ঘুরে ঘুরে চলে আসছে একটিই নাম—শিশির।
ওদিকে সিআইএ হেডকোয়ার্টার থেকে ইতোমধ্যেই এসেছে চূড়ান্ত নির্দেশ ,,Devil King–এর লোকেশন ট্রেস হয়েছে দক্ষিণ ইউরোপে। অপারেশন শুরুর সময়সীমা দেওয়া হয়েছে ঠিক ৭২ ঘণ্টা।আর তাতেই ওকে জানানো হয়েছে,

—“If you miss this, you miss your command.”
“You’ll be off the field, permanently.”
কিন্তু নাহিয়ান…এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি।
শিশিরের নিখোঁজ থাকার এই সময়টাতে, আর কোনো মিশন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, তোর এখন শুধু একটাই লক্ষ্য একটাই উদ্দেশ্য তার শিশির বিন্দুকে খুঁজে পাওয়া। তাই নাহিয়ান একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

“I don’t need a mission.I need her back.”
এই লাইনটাই সে শেষবার সাইবার ট্যাকটিক্স ইউনিটকে লিখে মেইল করে।
ঠিক সেই সময় তার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা এনক্রিপ্টেড মেসেজ।যা এসেছে তার বাংলাদেশে থাকা স্পেশাল অপারেটিভ এজেন্টের কাছ থেকে।সে দ্রুত খুলে দেখে।চোখ দুটো সেকেন্ডেই কুঁচকে ওঠে।
— “Bangladesh Territory Scan Complete.
All CCTV Feed Cross-Checked.
All Exit-Entry Logs Cleared.
Target: No Trace.
Repeat: Subject Not Located.
Status: Possibly Out of Country.”

নাহিয়ানের বুকের ভেতর যেন এক ঝড় বয়ে যায়। পুরো শরীর হঠাৎ কাঁপতে শুরু করে। ষনিজের ভেতরের আগ্নেয়গিরিকে সংবরণ করার শেষ চেষ্টায় সে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, কিন্তু সে তাতে ব্যর্থ হয়। না পেরে শেষমেষ টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের পাশে তার মুষ্টি সজোরে আঘাত করে—আঘাতপ্রাপ্ত হাত থেকে স্রোতের মতো রক্ত বের হয়ে আসে।চোখ বন্ধ করে সে বলে ওঠে—

—“I left the world for her… And now the world can burn.”
চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।শেজাহান সবে তখন কয়েকটা ইনফরমেশন ফাইল হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে সে হতবম্ভ হয়ে যায়।তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক শৃঙ্খলার দেবদূত থেকে ধ্বংসের প্রতীক হয়ে ওঠা নাহিয়ান।এক পুরুষ, যে প্রিয়তমার জন্য বিশ্বের সমস্ত সিস্টেম বদলে দিতে প্রস্তুত।
শেজাহান কিছু বলতে যায় না, পারেও না।শুধু নীরবভাবে চেয়ে নিজের প্রেয়সী‌ কে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাওয়া এক কঠোর মানবের পানে।

একটা ধূসর ছোপ ছোপ রঙের পুরাতন দুইতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামায় রিদিত। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল দূরের পাখিদের ডাক আর রোদে জ্বলে ওঠা পাতাঝরা গাছের ছায়া। ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে সে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে কলিং বেল বাজায়। টানা দুই-তিনবার বেল বাজানোর পর অবশেষে একজন মাঝ বয়সী মহিলা দরজা খুলেন। রিদিত তাকে দেখে মুচকি হাসি হেসে বলে,,
—”আসসালামু আলাইকুম আন্টি। এটা কি আয়নিনদের বাসা?”
মহিলাটি জবাবে মাথা নেড়ে উষ্ণ হাসি হেসে বলে,,
—”ওয়ালাইকুমুসসালাম। হ্যাঁ এটা আয়নিনদেরই বাসা কিন্তু বাবা,তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না?”
—”আন্টি আপনি আমাকে চিনবেন না।আমি শিশিরের কাজিন।”
শিশিরের কাজিন এই কথায় মহিলাটির অর্থাৎ আনায়ার মার চোখে এক ঝলক আলোর রেখা খেলে যায়। আনন্দে, একটুখানি উত্তেজনায় তিনি বলে ওঠেন,

—”শিশিরকে পাওয়া গেছে!”
রিদিত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,
—”না আন্টি।এখনো ওর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
আয়নিনের মা এক মুহূর্তে স্থবির হয়ে যান। হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি ঝুপ করে বিষণ্নতায় মুড়ে যায়। তিনি কষ্টমাখা গলায় বলেন,,
—”ওহহহ…”
রিদিত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

—”আচ্ছা আন্টি আয়নিন কোথায়? শুনলাম ও নাকি হাসপাতালে এডমিট ছিল?”
আনায়ার মার চোখ আবার কষ্টের আবরণে ঢেকে যায়। গলা ভারী হয়ে আসে,,
—”হ্যাঁ বাবা।একটু কান্নাকাটি করলেই আমার মেয়েটার শ্বাসকষ্ট হয়। আর সেইদিন ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর থেকেই শুধু কান্না আর কান্না… তারপর শ্বাসকষ্ট নিয়ে একেবারে পাঁচদিন হাসপাতালে ছিল। আজকেই রিলিজ নিয়ে বাসায় আনলাম। ও কারো সাথে কথা বলছে না … ভীষণ ভেঙে পড়েছে আমার মেয়েটা।”
—”আচ্ছা আন্টি, আমি কি একবার ওর সাথে একটু দেখা করতে পারি?”
আনায়ার মা এবার যেন বাস্তবে ফিরে এলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,,
—”হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন নয় বাবা? তুমি ভিতরে আসো না! দেখেছো… কথা বলতে বলতে তোমাকে বাড়ির ভেতরে আসতে বলতেই ভুলে গেছি। কিছু মনে করো না বাবা।”
রিদিত বিনীতভাবে হেসে উত্তর দিল,,
—”না না আন্টি, কি মনে করব?”

আনায়ার মায়ের সঙ্গে ধীর পায়ে রিদিত এসে দাঁড়ায় দুই তলার একটি ছোট অথচ পরিপাটি রুমটির সামনে। দরজার সামনে এসে তিনি হালকা গলায় ডাকেন,
—”আয়ু.. মা দরজাটা খোল। দেখ কে এসেছে?
ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ আসে না। আনায়ার মা ধীরে হাত রাখেন দরজার ওপর।দরজাটা ‌ভিতর থেকে বন্ধ না থাকায় নিজে থেকেই খুলে যায়।আনায়ার মার সাথে রুমে প্রবেশ করে রিদিত।ভেতরে ঢুকতেই ঘরের হাওয়ায় ওষুধের গন্ধ আর বিষণ্নতা মিশে এক অদ্ভুত ভার ছড়িয়ে পড়ে। রুমে ঢুকতেই রিদিতের প্রথমেই নজরে আসে বেড সাইড টেবিলটার উপর রাখা মেডিসিনের ট্রে পানির গ্লাস আর কেটে রাখা ফল গুলোর উপর। তারপরে সে দেখতে পায় জানালার ধারের বিছানা টার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আনায়া। চুল এলোমেলো খোপায় বাঁধা। সে মনে করে হয়তো সাইফ বা লিমারা এসেছে। এসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিদিত কোমল কণ্ঠে বলে,,

—”আয়নিন।”
চেনা কন্ঠের আয়নিন ডাক্তার শুনে এই মুহূর্তেই সবকিছু যেন থমকে যায়। আয়াত দ্রুত উঠে বসে মাথায় কাপড় টেনে বলে,,
—”আপনি!”
রিদিত আনায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ মুখ এখনো লাল হয়ে আছে। যেন কিছুক্ষণ আগেই তার নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল সমুদ্রের নোনা জল। সেদিকে তাকিয়ে রিদিত বলে,,
—”হ্যাঁ আমি”
আনায়ার মা তখন স্নিগ্ধ হেসে বলেন,
— “আচ্ছা বাবা, তোমরা কথা বলো। আমি একটু নিচে থেকে আসি।”
তিনি চলে গেলে ঘরটা যেন আরও নিঃস্তব্ধ হয়ে ওঠে। রুমে এখন শুধু রিদিত আর আনায়া।রিদিত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,,

—”চোখ মুখের একি অবস্থা করেছ?”
আনায়া দম আটকে আসা গলায় বলে ওঠে,,
—”আপনি এখানে? শিশিরের কি কোন খোঁজ পেয়েছেন?”
আনায়ার এমন উদ্বিগ্ন প্রশ্নে রিদিত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,
—”না এখনো কিছু জানা যায়নি।”
আনায়ার মুখে আবারো নেমে আসে বিষন্নতার ছায়া। তা দেখে রিদিত বলে,,
—”তবে চিন্তা করো না নাহিয়ান বেঁচে থাকতে শিশিরের কোন ক্ষতি হবে না। শিশিরকে যে পৃথিবীর যে প্রান্তেই লুকিয়ে রাখুক না কেন নাহিয়ান অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করবে।”
—”মানে!”

—”মানে নাহিয়ান জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তার শিশিরবিন্দুকে,তার ভালোবাসাকে আগলে রাখবে। খুঁজে আনবে যেখান থেকেই হোক। আর এটা আমার ধারণা নয় আমার বিশ্বাস।”
আনায়ার চোখে উঠে আসে বিস্ময়ের ছায়া। শিশির তো তাকে বলেছিল যে নাহিয়ান নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে তার নাকি সুহাসিনী আছে। তাহলে… সে কিছু বলার আগেই রিদিত আবারো বলে,,
—”কি অবাক হচ্ছ? যদিও অবাক হওয়ারই কথা কিন্তু এটাই সত্যি। নাহিয়ান শিশিরকে ভালবাসে আর এটা কোনো দমকা হাওয়ার মত হঠাৎ আসা অনুভূতি নয়।

এটা এক তীব্র শিকড়, বহু আগেই তার মনের গভীরে গেড়ে বসেছে। এমনিতে তো তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না কিন্তু এই ব্যাপারে বিশ্বাস করতেই পারো। এটা কোন বায়োনট না খাঁটি সত্য কথা। তাই বলছি শুধু শুধু নিজের ক্ষতি করোনা। শিশিরকে খোঁজার জন্য তার সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে নিবেদিত মানুষটা আছে। শিশির নাহিয়ান এর হৃদস্পন্দন। আর কেউ কি তার হৃদস্পন্দন ছাড়া কোনদিন বাঁচে? তাই বলছি আর চিন্তা করো না আর ওষুধগুলোর সময়মতো খেও।
একনাগারে কথাগুলো বলেই বেরিয়ে যায় রিদিত। আনায়া অবাক লুচানে তাকিয়ে থাকে তার চলে যাওয়ার পানে। জালনার হালকা কালো ছায়ায় অবয়ব মিলিয়ে যায় রীদিতের অবয়ব। আনায়া বুঝতে পারে না তার কথার মানে.. তবুও তার কথা তার দেওয়া আশ্বাস আনায়ার হৃদয়ের নিস্তব্ধ শূন্যতায় দোলা দিয়ে যায়।

শেজাহান ধীরে পা ফেলে এগিয়ে আসে। হাতে ধরা ফাইলগুলো কাঁপছে—তবে তার কাঁপুনি কাগজের নয়, আতঙ্কের। নিজের অভ্যন্তরে এক অসম্ভব দ্বন্দ্ব নিয়ে সে বলে ওঠে—
— “স্যার… একটা… একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন এসেছে…।”
নাহিয়ান ধীর কণ্ঠে, কিন্তু চোখে হিংস্র আগুন নিয়ে তাকায়—
— “বলো, শেজাহান… কী খবর?”
— “যে দিন শিশির ম্যামরা গজারিয়া মেঘনা বিচে গিয়েছিলেন, ওই দিন বিকেলের দিকের CCTV ফুটেজে একটা কালো রঙের নম্বরপ্লেটবিহীন মাইক্রোবাস দেখা গেছে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানেই ছিল…আমরা ফুটেজ ট্রেস করেছি, কিন্তু গাড়িটার রেজিস্ট্রেশন, কোনো ড্রাইভিং ইনফো কিছুই মেলেনি। গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেছে স্যার।”
নাহিয়ানের চোখে ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎরেখা।

— “আর?”
— “স্যার… আমাদের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে গাড়ির মালিকের পরিচয়ও ভুয়া তিনি একজন বিদেশি নাগরিক… ফরেনার।”
নাহিয়ান মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল।চোখে ঘন অন্ধকার।আর ঠিক তখনই…তার মনে পড়ে এক নাম।
Harry.Harry Stives
একটা নাম… এক অতীত… এক শত্রু। আরেকটা সম্ভাবনা—ভয়াবহ আর অস্পষ্ট।
বুকের ভেতর যেন বাজ পড়ে। সাথে সাথেই সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে তার এনক্রিপ্টেড সিকিউর লাইন অ্যাক্সেস করে। ওপাশে উঠে আসে একটা পরিচিত কণ্ঠ।
— “A.R.? What’s up?”
নাহিয়ান ঠান্ডা অথচ কাঁপা কণ্ঠে বলে—

— “I need intel on Harry Turner. Last registered status?”
— “Hold on…”
১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড পরে উত্তর আসে—
— “,Harry’s judicial record shows a temporary bail approved under international clause 47B. He’s out of country for 28 days now.”
কল কেটে দিয়েই নাহিয়ান গর্জে ওঠে—
— “Damn it! এইটা আগে মাথায় এলো না কেন… হ্যারি… এটা তো শুধু হ্যারিই করতে পারে…!”
এক ঝটকায় ফোনটা ছুড়ে ফেলে দেয় দেয়ালের দিকে।শেজাহান ভয়ে পিছিয়ে আসে।তখনই তীব্র গলায় বলে নাহিয়ান ওঠে—

— “ঢাকার সব ফাইভ-স্টার হোটেল চেক করো। গত এক মাসে কোনো বিদেশি রেজিস্ট্রেশন ছাড়া সেখানে উঠেছে কিনা, একটাও যেন বাদ না যায়! remember একটাও না।”
প্রায় তিন ঘন্টা পর…
ঘরের বাতাসে অস্থিরতা ঘনীভূত। নাহিয়ান দু’হাতে চুলে আঙুল চালিয়ে বসে আছেন, শেজাহান চুপচাপ এসে তার পাশে বসে কাঁধে চেপে থাকা দায়িত্ব যেন আরও ভারী
— “স্যার… এটা রেজিস্টারড ইনফরমেশন। আমরা ঢাকার সমস্ত ফাইভ-স্টার হোটেলের গত ৩০ দিনের ইনহাউস ফরেনার তালিকা চেক করেছি।”
নাহিয়ান কোনো শব্দ করেন না। তার চোখ শুধু তাকিয়ে থাকে শেজাহানের দিকে, যেন এক সেকেন্ড দেরি করলে ফুঁসে উঠবেন বিস্ফোরণে।শেজাহান তাড়াতাড়ি বলে যায়,,
— “প্রায় দশ জন ফরেনার এসেছিল। তাদের মধ্যে ৯ জনের পরিচয় স্বচ্ছ। তবে একজন… একজনের তথ্য কিছুতেই মেলেনি।”

নাহিয়ান চোখ বন্ধ করে একটানা নিঃশ্বাস নেয়। শেজাহান আবার বলতে শুরু করে,,
— “স্যার… প্রথমে রেস্টুরেন্ট অথরিটি বলতে চাইছিল না। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের কথা বলি, তখন তারা স্বীকার করে—লোকটা একাধিক নাম ব্যবহার করেছে, ছবি সাইন করে রেজিস্ট্রার ভরেছে, আর সব কাগজ ছিল পোর্টেবল রেজিস্ট্রেশনের… যার অনেক কিছু ভুয়া ছিল।”
নাহিয়ান এবার ধীরে বলে ওঠে—
— “এখন সে কোথায়?”
শেজাহান শ্বাস ফেলে বলে,

— “স্যার, সন্দেহজনক ওই অতিথি ‘John Merrick’—কিন্তু সেই নামের অধীনে কোনো পাসপোর্ট, কোনো বৈধ ভিসা ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না।আর তার লাস্ট লোকেশন… ছিল ঠিক শিশির ম্যাম হারিয়ে যাওয়ার দিন পর্যন্ত।”
এবার যেন মুহূর্তেই নাহিয়ানের বুকের ভেতর আরেকটা বজ্রনিনাদ বেজে ওঠে। সে এবার পুরোপুরি শিওর হয়ে যায় যে ওই পরিচয়বিহীন আগন্তকই Harry.
মাথা নিচু করে শেজাহান বলে,
— “স্যার, যদিও আমি আপনার মত অত তীক্ষ্ণ জ্ঞান-সম্পন্ন নই তবুও আমার মনে হচ্ছে এই আগন্তুকই হ্যারি। স্যার আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি
ঢাকার সব এয়ারলাইন্সগুলো চেক করি…??”
নাহিয়ান তাকে থামায় না। সে নিজেই ইতোমধ্যেই নিজের নিরাপত্তা ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে—ঢাকার সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রী তালিকা,যে দিন শিশির হারায়, সেদিন এবং পরের দিন—সব Jet Aircraft, চার্টার্ড ফ্লাইট, বিজনেস ক্লাস,সব চেক করতে।

হঠাৎই তার মোবাইলে আসে একটি এনক্রিপ্টেড নোটিফিকেশন।সেটা খুলে চোখ বোলাতেই, সেকেন্ডের মধ্যে বদলে যায় তার মুখের রঙ।
—“Flight Surveillance Update – Classified
Past One Month Movement Log
Target Day: [Redacted Date]
Biman Bangladesh Airlines – 3 international jets departed.
Flight 2: Suspicious Passport + Visa Entry.
Passenger Name: Arthur Shifar – foreign national.
No match found in Shahjahan’s records.
Departure confirmed.
Destination: Geneva International Airport, Switzerland.”

নাহিয়ান চোখ নামিয়ে রাখে কিছুক্ষণ। নিঃশব্দে, ঠোঁট কামড়ে ধরে।Arthur Shifar—এই নামটা যে একটা ছদ্মবেশ, এটা বোঝার জন্য তার বেশি কিছু লাগে না।সে বুঝতে পারে হ্যারি বিভিন্ন প্লাটফর্মে বিভিন্ন রকম পরিচয় ব্যবহার করেছে।সে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, তারপর নিজের ফাইলের উপরে শক্ত করে ঘুষি মারে।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গর্জে ওঠে—
—“Shahjahan!”
শেজাহান ভয়ে এগিয়ে আসে।নাহিয়ান ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে—
— “Tell Control Ops, I need a private jet. Immediate take-off.Destination: Geneva.”
— “Yes, sir. I’ll arrange everything now.”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৬

নাহিয়ান পেছনে ফিরে জানালার দিকে তাকায়।
সেখানে হাডসনের পাড়ে অন্ধকার, কুয়াশার রেখা ছুঁয়ে আসছে।তার কণ্ঠে চাপা গর্জন, ঠোঁটের কোণে একটুখানি যন্ত্রণার ছায়া।
— “I’m coming…To bring my soul back…And to finish you, you bastard.”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৮