মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৮
নওরিন কবির তিশা
প্রায় তিন বছর আগে…..
সদ্য ইউএস ইন্টারন্যাশনাল সিআইডি টিমে জয়েন করেছিল একজন বাংলাদেশি যুবক—নাম নাহিয়ান চৌধুরী।সিআইডি ছিল তার স্বপ্ন, তার সাধনা। প্রথমে পরিচিতি না পেলেও তার অসাধারণ দক্ষতা, পর্যবেক্ষণ শক্তি ও ঠান্ডা মাথার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ক্রমেই তাকে ওপরে তুলে আনতে থাকে ।শুধু ইউএস সিআইডি নয়, হেডকোয়ার্টারের “Strategic Shadow Division”-এর অভ্যন্তরেও একটা সময় তার পরিচিতি হয়ে ওঠে এক নামেই,A.R.— The Alpha Reaper।
অন্যদিকে বাংলাদেশি এক যুবকের এত কম বয়সে এত উন্নতি সহ্য হয় না এক সিনিয়র ব্রিটিশ সিআইডি অফিসারের। নাহিয়ানের এই উত্থান গাত্রদাহ সৃষ্টি করে তার মনে।নাম Harry Stives।যে সম্মান, যে র্যাঙ্ক হ্যারি অর্জন করতে সময় নিয়েছিল পাঁচ বছর, সেটা যখন একজন বাংলাদেশি যুবক মাত্র এক বছরের মধ্যে ছুঁয়ে ফেলে—তখন হ্যারির ভিতর জন্ম নেয় ঈর্ষা, তীব্র প্রতিহিংসা।সে শুরু করে উঠতে বসতে নাহিয়ানের পেছনে অপবাদ ছড়ানো, খুঁজতে থাকে তাকে অপমান হেনস্তা করার ছলচাতুরি। প্রথমে নাহিয়ান বিষয়টা বুঝতে পারেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে—হ্যারির এই অপমান কৌশল কেবল তার ভেতরের হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ।ঠিক তখনই আসে এক বড় মিশন।একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের পেছনে কাজ করছিল ইউএস সিআইডি। আর নাহিয়ানকে দেওয়া হয় সেই মিশনের লিডারশিপ।নিজের দক্ষতায়, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় সেই মিশনকে করে সফল।ফলাফলস্বরূপ, সে পেয়ে যায় H5 Clearance এবং হ্যারি-সমতুল্য র্যাঙ্ক। যা আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয় হ্যারির জন্য।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু এরপরই ঘটে এক চমকপ্রদ মোড়…
একটি গোপন অনুসন্ধানে নাহিয়ান জানতে পারে—Harry Stives একজন double agent।সে কাজ করছে “The Black Panther”, নামক একটি ভয়ংকর আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের হয়ে। আর তার হাতেই ”The black panther”গ্যাংয়ের কাছে পাচার হচ্ছিল ইউএস সিআইডি’র সেনসিটিভ ডকুমেন্টস, এনক্রিপ্টেড সিক্রেট কোড, অপারেশন স্ট্র্যাটেজি।
নাহিয়ান সব প্রমাণ, ক্লু, গোয়েন্দা রিপোর্ট একত্র করে হেডকোয়ার্টারে জমা দেয়।তার রিপোর্টের ভিত্তিতে Harry Stives-কে ডিরেক্টর অফ ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স ফায়ার করে দেয়।তার উপর আরোপিত হয়,১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০০০ মার্কিন ডলারের ফাইন।নাহিয়ান সেই মুহূর্তে হয়ে ওঠে হেডকোয়ার্টারের চোখের তারা।
তার কাজের জন্য তাকে দেয়া হয় Gallant Service Medal, আর সাথে নতুন করে প্রমোশন।
তবে যাওয়ার আগে চোখে লাল আগুনের প্রতিচ্ছবি আর ঠোঁটের কোনে এক বিষাক্ত প্রতিশ্রুতি নিয়ে হ্যারি একটা কথাই নাহিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বারবার বলেছিল,,,
“I will be back, Nahiyan Chowdhury.I’ll come back to take my revenge…I will take from you—your peace, your smile, your everything.Even if that means destroying your entire world.”
বর্তমান…
সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন নগরীর সকালটা যেন কাঁচের মতো স্বচ্ছ আর তীব্রভাবে নিঃশব্দ।জানালার কাঁচের ওপাশে সূর্যের এক সোনালি নরম রোদ পড়েছে যেন সোনালি তুলো ছড়িয়ে আছে আলপসের কোলজুড়ে। পাথরের শহর বার্ন আজও সেই পুরনো রাজকীয়তা ধরে রেখেছে নীরবে তবে গর্বিতভাবে।
আর সেই নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত Hotel Schweizerhof Bern & Spa যার সপ্তম তলার একটি এক্সিকিউটিভ সুইটে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান চৌধুরী।অতীতের কথা ভেবে সে একবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো। চোখের নিচে গভীর ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু চোখের ছায়া খেলা করছে এক দুর্বিনীত স্থিরতা।গতকাল রাতেই সে জেনেভা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিঃশব্দে এখানে এসে উঠেছে।
হঠাৎই দরজায় নক পড়ে।নাহিয়ান জানালার ফ্রেম থেকে চোখ না সরিয়েই বলে,
— “Come in.”
দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে শেজাহান। মুখে টান, চোখে আতঙ্ক, নিঃশ্বাস অস্থির।
— “স্যার… আমরা লোকেশন ট্র্যাক করতে পেরেছি!”
নাহিয়ান দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,,
—”কোথায়?কোথায় দেখাচ্ছে লোকেশন?”
—”স্যার লোকেশন পিং উঠেছে Fontana Village, Valle di Blenio… টিকিনো অঞ্চলে।”
নাহিয়ানের মুখে এবার আমাবস্যার রাতের মত আঁধার নেমে আসে। সুইজারল্যান্ডের টিকিনো ক্যান্টনের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত উপত্যকা Valle di Blenio। একে সুইজারল্যান্ডের ঘোস্ট ভ্যালি বললেও ভুল হবে না কারণ সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক ভয়াল রূপ ধারণ করে আছে।আর Valle di Blenio এর Fontana Village এক অর্ধ-পরিত্যক্ত পাহাড়ি গ্রাম, যা স্থানীয়দের কাছে Shadow Valley নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোড়কে আচ্ছাদিত এই অঞ্চলটি এতটাই নির্জন যে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সুইস সরকার সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগই প্রদান করেনি। সেখানকার রাত হয় নিকষ কালো,এতটাই অন্ধকার, যেন চাঁদের আলো পর্যন্ত পথ হারায়। নাহিয়ান খুব ভালো করেই জানে শিশির অন্ধকার কতটা ভয় পায়।আর এমন বিদ্যুৎবিহীন একটি নির্জন উপত্যকায় সে বন্দী।এটা ভাবতেই রাগে, আতঙ্কে কেঁপে ওঠে নাহিয়ানের শরীর। এক ঝটকায় সামনে রাখা গ্লাসটা মুঠোয় দুমড়ে ফেলে। তারপর রক্তাক্ত হাতে শেজাহানের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠে—
—”“I want a helicopter Immediately.Right now.আমি কোনো কথা শুনতে চাই না আগামী ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমি আমার শিশিরবিন্দুকে আমার সামনে দেখতে চাই। আর সেটা যদি না হয় তাহলে তোমরা কেউ বেঁচে থাকবে না মাইন্ড ইট কেউ না।
শেজাহান নাহিয়ানের এমন গর্জনে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় ,ঠোঁট শুকিয়ে আসে পরক্ষণে জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে সে দ্রুত বলে,,
—””Yes, yes sir. I’ll manage everything right away.”
—-
ঘরটা কুয়াশার মতো ঘোলাটে অন্ধকারে ঢাকা।ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারের মতো জানালাবিহীন পাথরের এক কক্ষ, দেয়ালে ছোপ ছোপ র*ক্তের দাগ।নিস্তব্ধ কুঠুরি এক কোণে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে শিশির।চোখের নিচে কালি,গালের পাশে শুকিয়ে যাওয়া এক ফোঁটা র*ক্তের দাগ।একটা মাত্র হ্যাজি হ্যারিকেনের আলো মেঝেতে অর্ধভাঙা কাঁচের মতো ফেলে রেখেছে তার ছায়া।
দরজা খুলে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে Harry।হাতে একটা গ্লাস, আর ঠোঁটে সেই চেনা বিষাক্ত হাসি,,
—”You know… suddenly you look… tempting,”
(“তুমি জানো… হঠাৎই তোমাকে খুব লোভনীয় লাগছে,”)
হ্যারির এমন বাজে ইঙ্গিত পূর্ণ কথা চোয়াল শক্ত হয়ে গেল শিশিরের। হ্যারি আরেকটু এগিয়ে এসে ঠোঁট চে*টে বলে,,
—”I wanna taste you baby girl”
শিশির এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। র*ক্তাক্ত হাতে পাশে থাকা একটা নুড়ি পাথর তুলে হ্যারির মাথার পাশে ছুঁড়ে মারে। পাথর গিয়ে তার কপালের ডানপাশ ফেটে ফেলে।র*ক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে।তবুও সে হাসে।এক বীভৎস হাসি—ঠিক যেমন কোনো হাসে পি*শাচ র*ক্তের সন্ধান পেলে ঠিক সেই ভাবে। র*ক্তহিম করা এক হাসি হেসে সে বলে,,
—”You think I came here for just touching you? No… I came here to ruin you. I thought I’d use you, break you, and then send you back like a cracked doll. but now I just want to test you.”
(“তুমি ভাবছো আমি এখানে এসেছি শুধু তোমাকে ছোঁয়ার জন্য? না…আমি এসেছি তোমাকে ধ্বংস করতে। ভেবেছিলাম, তোমাকে ব্যবহার করব, ভেঙে ফেলব, তারপর একটা ভাঙা পুতুলের মতো ফিরিয়ে দেব। কিন্তু এখন আমি শুধুই তোমাকে আস্বাদন করতে চাই!”)
সে আবারও এগিয়ে আসে।হাত বাড়িয়ে শিশিরের কাঁধ ছুঁতে যাবে ঠিক তখনই—
এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দে দরজাটা যেন উড়ে যায়।ঝড়ের গতিতে ভেতরে ঢুকে পড়ে নাহিয়ান।তার চোখ লালচে, নিঃশ্বাস গরম, হাতে হালকা স্কারফ মোড়া—তবুও ওর চেহারায় এমন এক রুদ্ররূপ, যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিজের প্রাণভোমরাকে ছিনিয়ে আনতে আসা কোনো র*ক্তমাখা দেবদূত।হ্যারি স্তব্ধ…থমকে যায় সময়।
— “You…?”
নাহিয়ানের ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁকা হাসি, কিন্তু চোখ দুটো শীতল ব্লেডের মতো ধারালো। কণ্ঠে যেন বজ্র নেমে আসে, ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা সেই ভয়াবহ নীরবতা ফেটে বেরোয় এক বিস্ফোরণে,,
—”তুই কি ভেবেছিলি আমি কোনদিন তার খোঁজ পাব না? how funny you are! তুই হয়তো ভুলে গিয়েছিলি তুই ওকে পৃথিবীর যে কোনায়ই নিয়ে যাস না কেন সেখান থেকেই আমি ওকে খুঁজে বের করবো। আর মাত্র চার হাজার একশো মাইল দূরে এনেই তুই ভাবলি আমি ওকে পাবো না!”
এরপর আর কোনো কথা নেই।শুধু একটা শব্দ—পাঁচ আঙুলে শক্ত হয়ে বাঁধা এক ঘুষি। আর তাতেই হ্যারি ছিটকে পড়ে দেয়ালের গায়ে। র*ক্ত ছিটকে পড়ে শিশিরের সামনে।শিশির মুখ কুঁচকে চোখ দ্রুত বন্ধ করে।
দুই ঘন্টা বাদে….
নাহিয়ান এর উরুর উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে শিশির।হয়তো কিছুক্ষণ আগে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বিভীষিকার ভার বহন করতে পারেনি তার স্নায়ু।নাহিয়ান নিজের মুখে লেগে থাকা র*ক্তটুকু হাতের উল্টাপিঠ দিয়ে মুছে একবার তাকালো ঘরের মধ্যিখানে। যেখানে একটা চা*ম*ড়া*হী*ন মানব কে উল্টো করে ঝু*লিয়ে রাখা হয়েছে।যার শরীর থেকে এখনো র*ক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আর সেই র*ক্তেই ভিজে যাচ্ছে রুমের মেঝে।নাহিয়ান নিজের বাম হাতের দিকে তাকায়। র*ক্তমাখা আঙুলে ধরা এক টুকরো থেঁ*তলানো য*কৃত, হ্যারির ছি*ন্নভি*ন্ন ক*লিজা। নাহিয়ানের চেহারায় এক ধরনের অদ্ভুত তৃপ্তি ফুটে ওঠে।যেন ওটা শুধু এক টু*করো মাং*স নয়,সেই প্রতিহিংসার কেন্দ্র, সেই ঘৃণার শেকড়, যা আজ ছিঁ*ড়ে তুলে এনেছে সে।নাহিয়ান ধীরে ধীরে শেজাহানের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত, ধ্বংসাত্মক প্রশান্তিতে ডুবে থাকা গলায় বলে,,
—”দেখো শেজাহান কতটুকু ক*লিজা নিয়ে ও এসেছিল আমার কাছ থেকে আমার শিশিরবিন্দুকে ছিনিয়ে নিতে।”
শেজাহান থরথর করে কাঁপছে। ঘরের মধ্যে এতক্ষণ যা ঘটেছে, তা কোনো দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়। হঠাৎ পেছন থেকে একটা নিয়ন আলো এসে নাহিয়ানের মুখে পড়ে। হালকা নিয়ন আলোয় তাকে আরো ভ*য়ানক দেখায়।কিন্তু নাহিয়ান সেদিকে না তাকিয়ে বরং নিজের হাতটা আরেকটু উঁচিয়ে বলল,,
“দেখো দেখো কতটুকু!”
সেদিকে তাকাতেই শেজাহানের মনে হলো তার চোখে যেন কেউ গলানো সিসা ঢেলে দিল,সে ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায়। নাহিয়ান আবার বলতে লাগলো,,
“এই চোখ দিয়েই তো ও তাকিয়েছিল আমার শিশিরবিন্দর দিকে… আমি চেয়েছিলাম,প্রতিটা চোখের কোষ থেকে য*ন্ত্রণা উৎপন্ন করতে… কিন্তু তার আগেই তো বেচারা চিৎকার করে উঠলো।
নাহিয়ানের এমন কথায় শেজাহানের স্মৃতির পাতায় উঁকি দিল কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া এক বীভৎস্য ঘটনা যখন নাহিয়ান তীক্ষ্ণ ধারালো ছু*রিটা বারবার গেঁ*থে দিচ্ছিল হ্যারির চোখে আর হ্যারি য*ন্ত্রণায় কুঁ*কড়ে উঠছিল— বী,ভৎসব চিৎকার করে উঠেছিল। কিন্তু তাতে কোনো হেলদোল ছিলনা নাহিয়ানের। বরং সে পৈ*শাবিক হাসি হাসছিল। এক অদ্ভুত হাসি, যা দেখলে কোন স্বাভাবিক মানুষ শান্ত হয়ে থাকতে পারবেনা। হঠাৎ শিশির হালকা গুঙিয়ে ওঠে। নাহিয়ান সামান্য ঝুঁকে তার কপালে নরমভাবে একটা চুমু দেয়। তার ঠোঁট থেকে র*ক্তের ফোঁটা শিশিরের গালে পড়ে। সে ফিসফিস করে বলে,,
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৭
—”কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না শিশিরবিন্দু। আর যদি কেউ এমন সাহস দেখায় তবে তার পরিণতি হবে হ্যারির থেকেও ভয়াবহ…”